#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
রাতে ঘুমাতে গিয়ে আরো বেশি অস্বস্তিতে পড়তে হলো অর্ষাকে। মন, মস্তিষ্কে এখনো রিহান। সে তো ভাবেনি ভাগ্যের পরিবর্তন এমন নিদারুণভাবে ঘটবে। রিহানের বদলে অন্য কেউ স্বামী হবে। তার সাথে বেড শেয়ার করতে হবে। দৃশ্যগুলো পরিকল্পনা করতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল অর্ষার। আহনাফ শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছিল। অর্ষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
অর্ষা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“কিছু না।”
“আমি কি অন্য রুমে ঘুমাব?”
“কেন?”
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এমনটাই চাচ্ছেন।”
অর্ষা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি কিছুই চাই না।”
এরপর সে খাটে উঠে একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আহনাফ দোনোমনা করে উঠে লাইট অফ করে এসে নিজেও শুয়ে পড়ল। সকালে তার ঘুমও ভাঙল যেই কাৎ হয়ে শুয়েছিল, সেই কাৎ হয়েই। পাশে ফিরে দেখল অর্ষা তখনো ঘুমাচ্ছে। ওর ছোটো কাটা চুলগুলোতে প্রায় অর্ধেক মুখ ঢেকে গেছে। চুলের সাইজ এখন এমনই যে, বেনি করারও উপায় নেই। ঝুটি করলেও ছোটো চুল বিধায় বেরিয়ে যায়। আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। অর্ষার মুখের ওপর থেকে চুল সরাতেই হুহু করে কেঁদে উঠল অর্ষা।
আহনাফ হকচকিয়ে উঠে বসল। নিজেকে ধাতস্থ করে বুঝতে পারল, অর্ষা বোধ হয় আরো অনেকক্ষণ ধরেই কাঁদছে।
“কী হয়েছে?” জানতে চাইল আহনাফ।
অর্ষার চোখ বন্ধ। কিন্তু পানি অবিরতভাবে পড়ছে। আহনাফ সংশয়ে জিজ্ঞেস করল,
“আমি কি ঘুমের মধ্যে কিছু করেছি?”
অর্ষার কোনো জবাব এলো না। আহনাফ ওকে উঠিয়ে বসাল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“আমাকে কিছু না বললে আমি বুঝব কীভাবে? আমাকে বলুন।”
অর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“আমার ওর কথা মনে পড়ছে।”
আহনাফ কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না যে কী করবে বা কী বলবে। বউয়ের চোখে প্রাক্তনের জন্য পানি নিশ্চয়ই সহ্য করার মতো নয়। কিন্তু সে তো অর্ষার অবস্থান সম্পর্কেও অবগত। কতটা ভেঙে গেছে এই মেয়ে এটা তার চেয়ে বেশি ভালো আর কে বুঝতে পেরেছে? রাগ কিংবা অভিমানের বদলে অর্ষার জন্য আহনাফের ভীষণ মায়া হলো। এতটা ভালোবাসার পরও ঠকে গেল মেয়েটা। আর আফসোস হতে লাগল তার রিহানের জন্য। এমন ভালোবাসা কেউ পায়ে ঠেলে দেয়?
আহনাফ কোনো কিছু বলল না। আলগোছে অর্ষার মাথাটি তার বুকে রাখল। এক হাতে জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে অর্ষার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। আশকারা পেয়ে অর্ষার কান্নার গতি বাড়ে। তার এখন আহনাফকে খড়কুটোর ন্যায় মনে হচ্ছিল। মানুষ যখন সর্বহারা হয়ে যায়, কোথাও আর কোনো পথ থাকে না, বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন থাকে না তখন মানুষ একমুঠো খড়কুটো পেলেও সেটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। যেমনটা এখন অর্ষা চাইছে। সে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি খুব বাজে। খুব খারাপ। আমার মতো অলুক্ষণে, খারাপ মেয়েকে আপনি কেন বিয়ে করতে গেলেন? আপনার উচিত হয়নি আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করা। আমি ভালোবাসার মতো মেয়ে না। আমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই। আপনি অনেক বেটার পেতেন। কেন আপনার জীবনটা নষ্ট করতে গেলেন?”
আহনাফ বলল,
“বোকা মেয়ে। সরি বোকা বউ! কে বলেছে তুমি ভালোবাসার মতো মেয়ে নও? তুমি জানো তুমি কতটা মিষ্টি, মায়াবী? তুমি অলুক্ষণে নও; তুমি ভাগ্যবতী, তুমি হীরে। তোমাকে যারা চিনতে পারেনি ওটা তাদের ব্যর্থতা। তোমাকে বিয়ে করে জীবন নষ্ট করিনি। তুমিও ভাঙা মনের, আমিও তাই। আমি জানি, একজন ভাঙা মনের মানুষ অন্য একটা ভাঙা মনের মানুষের কষ্ট বোঝে। তাই তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না আমি জানি। আর আমার তো বেটার দরকার নেই। আমার তো বেস্ট তুমি আছো। আমার বেস্ট বউ, আমার বেস্ট অর্ষা।”
এরপর সে অর্ষার মাথা বুক থেকে সরিয়ে দু’হাতের আজলায় নিল। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর শোনো, আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। বিনিময়ে এখন ভালোবাসা না দাও, একটু প্রশ্রয় না হয় দিও?”
বলেই সে অর্ষার ঠোঁটে গাঢ় চুমু এঁকে দিল। অর্ষা কোনো প্রতিবাদ করল না। ঠিক সায়ও দিল না। তবে চুপ করে রইল সে।
.
সকালের নাস্তা করে আহনাফ রেডি হচ্ছিল। অর্ষা রুমে এসে জিজ্ঞেস করল,
“কোথাও যাচ্ছেন?”
“হু।”
“কোথায়?”
“এসে বলব।”
“ওহ।”
“কিছু বলবে?”
অর্ষা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে গেল। গতকাল রাতের চুমুটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেও সকালের চুমু এতটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি অর্ষা। লজ্জায় এরপর থেকে সে আহনাফের দিকে তাকাতেই পারছিল না। আবার সে চেষ্টাও করছে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর। কিন্তু আহনাফ যখন আবার তুমি বলে সম্বোধন করে তখন লজ্জাটা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়।
আহনাফ চলে যাওয়ার পর অর্ষা সম্পাকে কল দিল।
.
আহনাফ মায়ের থেকে দোয়া নিয়ে বের হয়েছে ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য। গতকাল রাতেই তার কল এসেছে। কিন্তু এই ব্যাপারে কাউকেই সে কিছু বলেনি। জবটা হয়ে গেলে বাড়ি এসে একেবারে সারপ্রাইজ দেবে সবাইকে। বিশেষ করে অর্ষাকে সে বলবে,’তুমি মোটেও অলক্ষুণে নও। তুমি তো আমার লক্ষী!’
আনমনে হাসল সে। হঠাৎ তার নিজেকে ভীষণ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। বাড়িতে ফেরার একটা তাড়া অনুভব করছে। বাড়িতে একটা নতুন মানুষ আছে এটা ভাবলেই তার আনন্দ উপচে পড়ে। সেই মানুষটা আবার তারই বিশেষ কেউ! আহনাফের নিজের প্রতি কনফিডেন্স আছে। তার মন বলছে চাকরিটা হয়ে যাবে। এখন বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।
অফিসে গিয়ে দেখল তার মতো আরো অনেকেই ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছে। তার সিরিয়াল নং ১৯। এই ইন্টার্ভিউ কখন শেষ হবে কে জানে! সে একপাশে চুপচাপ বসে রইল। বাকিরা আলাপ-আলোচনা করছে। পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু আহনাফের মাঝে এসব নিয়ে কোনো হেলদোল নেই। সে ভাবছে অর্ষার কথা। কবে সে মেয়েটাকে সুখী করতে পারবে, কবে অর্ষাকে মন থেকে হাসতে দেখবে সেই দিনটার অপেক্ষা করছে সে।
একবার ভাবল অর্ষাকে একটা কল করবে। পরক্ষণেই আবার ভাবনা বাদ দিল। ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতেই অবশেষে তার ইন্টার্ভিউের সময় এলো। ইন্টার্ভিউ সে কনফিডেন্সের সাথেই দিয়েছে। রেজাল্ট তারা আগামীকাল কল করে জানাবে। তবে আহনাফের বিশ্বাস জবটা তার হয়েই গেছে। সে খুশি মনে বাড়ি ফেরার পথে ফুলের দোকান থেকে একটা বেলীফুলের মালা কিনে নিল। মেয়েরা ফুল পছন্দ করে। বিশেষ করে স্বামী কিংবা ভালোবাসার মানুষ ফুল উপহার দিলে সেই উপহারটা তারা আরো বেশি ভালোবাসে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দরজা খুলে দিয়েছেন সাজেদা বেগম। তিনি কিছুটা রাগীস্বরে বললেন,
“সারাদিন কোথায় ছিলি তুই? হুট করে বিয়ে করলি। কোথায় একটু মেয়েটাকে সময় দিবি! তা না করে নিজে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।”
“অর্ষা কোথায়?”
“রুমে। ঠান্ডা লেগেছে। তোর বাবা ওষুধ এনে দিয়েছে। খাইয়ে দিয়েছি। এখন ঘুমাচ্ছে। শোন, যদি মেয়েটাকে ভালোই না রাখতে পারিস তাহলে শুধু শুধু বিয়েটা কেন করতে গেছিস? সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে! কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে-চিন্তে নেওয়া লাগে। দুম করে মনে চাইল আর বিয়ে করলাম। এমন তো হয় না তাই না? ওর অবস্থাও তো জানিস তুই।”
“সরি, মা।”
বলে আহনাফ নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। এখন মনে হচ্ছে, মনের কথা শুনে ফোন করাটা উচিত ছিল। সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে উলটো মেয়েটাকে সে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। বিছানায় পাশে বসতেই চোখ মেলে তাকাল অর্ষা। চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। আহনাফ ওর কপালে হাত রেখে বলল,
“জ্বরও তো এসেছে দেখছি! সকালে তো ভালোই ছিলে।”
অর্ষা মৃদুস্বরে বলল,
“অসুখ কি বলে আসে?”
আহনাফ চুপ হয়ে গেল। কথা তো সত্যিই! সে জবাব না দিয়ে বলল,
“ওষুধ খেয়েছ?”
“হুম।”
“আমাকে একটা ফোন দাওনি কেন?”
“ফোন দিলে কী হতো?”
“আমি আরো আগেই আসার চেষ্টা করতাম।”
“সত্যি?”
“অবশ্যই।”
অর্ষা হাসল। আহনাফ বলল,
“হাসছ কেন?”
“এমনিই।”
“নিশ্চয়ই ওর কথা ভেবে হাসছ? অর্ষা, সবসময় তো রিহানের সাথে আমার কম্পেয়ার করলে চলবে তাই না? তুমি রিহানকে অনেক সুযোগ দিয়েছ, ভালোবাসা দিয়েছ। ও হয়তো তোমার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। তাই বলে যে আমিও একই রকম হব এটা তুমি ততদিন পর্যন্ত বলতে পারবে না, যতদিন না তুমি আমাকে কোনো সুযোগ দিচ্ছ।”
“সরি। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি।”
“আমি হার্ট হইনি। রেস্ট নাও।”
আহনাফ আলমারি থেকে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। অর্ষা চোখ বন্ধ করতেই দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মনে পড়ে গেল ক্লান্তিকর অতীতের অংশ।
সেবার অর্ষার শরীর খুব খারাপ হয়েছিল। বিছানায় পড়ে ছিল তিনদিন। রিহানের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। জানতও না সে অর্ষার অসুস্থতার কথা। অর্ষা নিজেই রিহানকে কল দিয়ে বলেছিল,
“একটু দেখা করবে প্লিজ? শরীরটা খুব খারাপ লাগছে!”
“শরীর খারাপ ডাক্তার দেখাও। আমি এখন আসতে পারব না বাবুই। আমার কাজ আছে। টাকা আছে? নাকি পাঠিয়ে দেবো?” ব্যস্ত কণ্ঠে বলল রিহান।
অর্ষা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“রিহান, আমি অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানোর মতো টাকা আমার বাবার আছে। আমার তোমার সঙ্গ দরকার ছিল। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, তুমি আমার পাশে বসে আমায় একটু জড়িয়ে ধরো। আমার কপালে হাত রাখো।”
“তুমি তো জানো…”
“রিহান প্লিজ! একটু দেখা করো। পাঁচ মিনিটের জন্য?”
“পরে ফোন করছি।” বলে কল কেটে দিয়েছিল রিহান।
অর্ষা তাও অনেকক্ষণ ফোন কানে নিয়ে চুপ করে বসে ছিল। তার দু’চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছিল সেদিনও।
কল্পনা শেষ হওয়ার পরও অর্ষার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে শোয়া থেকে উঠে বসল। আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় চলে গেছে। অর্ষাও গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গেল। দেখল আহনাফ একটা নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রুমে আসার জন্য। বারান্দার দরজায় অর্ষাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“একি! তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠে এসেছ কেন? আমিই তো যাচ্ছিলাম।”
অর্ষা চুপচাপ ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আহনাফ হেসে নয়নতারা ফুলটা অর্ষার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“তোমার জন্যই নিলাম। সুন্দর লাগছে। তোমার জন্য আরেকটা গিফ্ট আছে। রুমে চলো দিচ্ছি।”
অর্ষা প্রসঙ্গের একদম বিপরীতে গিয়ে আহনাফকে বিস্মিত করে দিয়ে বলল,
“একটু বুকে নেবেন?”
চলবে…