আহনাফ চৌধুরী পর্ব-১৪

0
86

#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
শুষ্ক আবহাওয়া হঠাৎ করে যেন সতেজ হয়ে উঠেছে। শীতেও শীতল হাওয়া ভালো লাগছে। বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করতে পারছে আহনাফ। সে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অর্ষার মুখপানে। এমন আবেদন, নিবেদন উপেক্ষা করে সেই সাহস হয় কোন পুরুষের?

আহনাফের নিরবতায় আঘাত হানছে অর্ষার বুকে। সে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে শুধাল,

“নেবেন না?”

আহনাফ জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে পড়ল না। দুহাত প্রসারিত করে মুচকি হেসে কাছে ডাকল। অর্ষার শুষ্ক, মলিন ওষ্ঠেও ফুটে উঠল তখন এক চিলতে হাসি। এগিয়ে এসে ঠাঁই নিল আহনাফের বুকে। কান্নায় ভিজিয়ে দিতে লাগল আহনাফের টি-শার্ট। মেয়েটা এত কাঁদে! আহনাফও জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“তোমায় কবে হাসতে দেখব বলো তো?”

অর্ষা জবাব দিল না। তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। শরীর ক্লান্ত লাগছে। কখন যে শরীরের ভার ছেড়ে দেবে কে জানে! জড়িয়ে ধরার বাঁধনও আলগা হচ্ছিল। আহনাফ সেটা বুঝতে পেরে অর্ষাকে কোলে নিয়ে দোলনায় বসল। অজানা এক প্রশান্তিতে চোখ বুজে এল অর্ষার। আহনাফের শার্ট আঁকড়ে ধরে সে খুব স্বল্প সময়ের মাঝেই আহনাফের বুকে ঘুমিয়ে পড়ল।
_______

তামিম ও ঐশির বিয়ের ডেইট কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই বিয়ের এক সপ্তাহ্ আগেই অর্ষা বাবার বাড়ি চলে যায়। তবে গিয়েও তার স্বস্তি ছিল না। উঠতে-বসতে আহনাফ ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছিল। এক পর্যায়ে তো অর্থি ঘরভর্তি মানুষের সামনে বলেই ফেলল,

”আপু, ভাইয়া তোমাকে এত ফোন করে কেন? আমরা কি তোমাকে বিক্রি করে দিচ্ছি?”

বাড়ির মানুষ বিষয়টা কীভাবে নিয়েছে অর্ষার জানা নেই, তবে সে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমেনা বেগম বিষয়টা বুঝতে পেরে চোখ রাঙালেন ছোটো মেয়ের ওপর। ভয়ে তখন চুপসে গেলেও অর্থি দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে তক্কেতক্কে আছে যে, আহনাফ আবার কখন ফোন করবে। এবার ফোন করলেই সে রিসিভ করবে বলে ভেবে রেখেছে। জেনেই ছাড়বে সে, এতবার ফোন দিয়ে কী জানতে চায় ভাইয়া?

বিয়ের দিন বরযাত্রী নিয়ে তামিম আসার পর অর্ষার বান্ধবী, কাজিন সবাই মিলে গেইট ধরে চাঁদা আদায় করার জন্য। অর্ষা তখনই একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। মেয়েদের ভীষণ আগ্রহ রয়েছে আহনাফকে নিয়ে। বিশেষ করে একজন মেয়ের বেশি। খবর নিয়ে অর্ষা জানতে পেরেছে, মেয়েটা তামিমের খালাতো বোন। তামিম এবং আহনাফ যেহেতু ছোটোবেলার বন্ধু সেই সূত্রে আহনাফকে মেয়েটা ভালো করেই চেনে। বলা বাহুল্য একটা ভালোলাগা তার আছে। মেয়েটার নাম সিনথিয়া। দেখতে আহামরি নয়, তবে আল্লাহর সব সৃষ্টিই তো সুন্দর। সেই সুন্দরকে তখনই অসহ্য লাগে যখন সে খুব প্রিয় কারো নিকট আসার চেষ্টা করে। এই যেমন সিনথিয়াকে এখন অর্ষা একদমই সহ্য করতে পারছে না। দুজনের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হওয়াতে বাইরের কেউই জানে না আহনাফ কিংবা অর্ষা বিবাহিত। এজন্যই বোধ হয় সিনথিয়া এমন করছে। আর কেউ না জানুক অর্ষা তো সব জানে। আহনাফও জানে। আর সব জেনে অর্ষা এসব সহ্য করতে পারছে না। তার নিজেকে ভীষণ হিংসুটে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন? তবে কি সে আহনাফকে ভালোবাসতে শুরু করেছে?

বোনের বিয়েতে অর্ষার আনন্দ করা হলো না। সিনথিয়ার জন্য তার আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরটা অস্বস্তিতে ভরে ছিল। তার বারবার মনে হচ্ছিল আহনাফকে বিয়ে করাটা একদম ঠিক হয়নি। রিহানের পাশে অন্য মেয়েকে দেখার যেই ভীতি অর্ষার মাঝে প্রবেশ করেছে, সেই ভীতির জের ধরেই আহনাফকে বিয়ে করাটা তার ভুল সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে। কারণটাও পরিচিত। সে আহনাফের পাশে সিনথিয়াকে সহ্য করতে পারছে না। আর না পেরেছিল মানতে আহনাফের প্রশ্রয় দেওয়াকে।

রাতে ঐশিকে বিদায় দিয়ে অর্ষা নিজের রুমে চলে আসে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বোনের বিয়ে হওয়ায় নাকি আহনাফের জন্য বুঝতে পারছে না। আর না রিহানের কথা মনে পড়ছে তাও সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে একটা আগাছা, পরগাছা মনে হচ্ছিল।

রুমের দরজায় নক করার শব্দ পেয়ে চোখের পানি মুছে অর্ষা বলল,

“দরজা খোলাই আছে।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে অর্থি বলল,

“আপু, আহনাফ ভাইয়া এসেছে। আমি যাই।”

আহনাফকে রুমে রেখে অর্থি আবার দরজা চাপিয়ে চলে গেল। আহনাফের নাম শুনে ঘুরে বসল অর্ষা। আহনাফ হতবিহ্বল হয়ে শুধাল,

“তুমি কাঁদছ?”

অর্ষা জবাব দিল না। বিয়ে বাড়িতে কাছে না আসতে পারলেও আহনাফ বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে, অর্ষার মন-মেজাজ কোনো কারণে ভালো নেই। তাই সে তামিমের বাড়ি থেকে আবার ব্যাক করেছে অর্ষার বাসায়। এর মাঝে বেশ কয়েকবার সে অর্ষাকে কলও করেছিল। ম্যাসেজও করেছিল। কিন্তু অর্ষা কোনো রেসপন্স করেনি।

এখনো অর্ষাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আহনাফ শুধাল,

“বলো? কী হয়েছে?”

অর্ষা ফোঁপানো স্বরে বলল,

“কিছু না।”

“তাহলে কাঁদছ কেন?”

“আপুর জন্য।”

“মিথ্যা বলছ কেন? আপুর আগে তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি আগে শ্বশুরবাড়ি গেছ। বিয়ের আয়োজন শেষ হলেই আবার চলে যাবে। এমন না যে, তুমি এখানেই থাকবে। তাহলে আপুর জন্য কাঁদবে কেন?”

“এত কৈফিয়ত তো আমি দিতে পারব না।”

“বাই এনি চান্স, তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?”

“আপনার ওপর কেন রাগ করতে যাব?”

“তোমার কথা শুনে তো তা-ই মনে হচ্ছে। আমি কি কিছু করেছি?”

অর্ষা এবার কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

“আমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার মতো মেয়ে নই। আমি ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না।”

“এসব কী কথাবার্তা? এগুলো বলতে নিষেধ করেছি না?”

“মিথ্যা তো কিছু বলিনি।”

“আমাকে বলবে তো কী হয়েছে? না বললে আমি বুঝব কী করে?”

“আমি কিছু বলতে চাই না। আমাকে ভালো না লাগলে ছেড়ে দিতে পারেন। নিজের পছন্দমতো বিয়ে করতে পারেন আবার।”

“অর্ষা! এসব বাজে কথা বলবে না। ছেড়ে দেবো মানে কী? ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি? আমি কি ঐ টাইপ ছেলে? আমার কোনো পছন্দ নেই কোথাও। থাকলে তোমায় নিশ্চয়ই বিয়ে করতাম না?”

“তাই? সত্যিই নেই? নিজের চোখেই তো সব দেখলাম।”

“কী দেখেছ?”

“ঐযে সিনথিয়া আপুর সাথে যা করলেন আজ। পারলে তো কোলে নিয়েই বসতেন। খাইয়ে দিলেন।”

আহনাফ কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভড়কে গেল। কিছুই বলতে পারল না। পরক্ষণেই হেসে ফেলল। বলল,

“আর ইউ জেলাস?”

অর্ষা চুপ করে রইল। আহনাফ নিজেই বলল,

“সিনথিয়াকে আমি সেই ছোটোবেলা থেকে চিনি। ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বিশ্বাস করো। আর ওকে তো আমি ছোটো বোনের মতোই দেখি, স্নেহ করি।”

“কিন্তু সে তো আপনাকে ভাইয়ের নজরে দেখে না। অন্য কিছু ভাবে।”

“এটা তোমার ভুল ধারণা।”

“আমার কোনো ভুল ধারণা নেই। আমি বুঝি। এতটাও অবুঝ নই আমি। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের চোখের ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে।”

“ওকে ফাইন! ও আমাকে পছন্দ করলেই বা কী? আমি তো ম্যারিড। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

“ভালোবাসার মিথ্যা অভিনয় করবেন না।”

“সত্য-মিথ্যার পার্থক্যও বোঝো না এখন? ওর প্রতি আমার কোনোই অন্যরকম কিছু নেই। আমার সকল অনুভূতি এবং সর্বস্বজুড়ে এখন শুধুই তুমি। আমি আমার অর্ষাকে ভালোবাসি। আর কাউকে নয়।”

অর্ষার জবাব না পেয়ে আহনাফ হাত ধরল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

“একটুতেই যে বন্যা বানিয়ে ফেলো সুন্দর চোখ দুটোয়, এটা কি ঠিক?”

অর্ষা তাকালও না। আহনাফ ওর দু’গালে হাত রেখে বলল,

“ভালোবাসি বউ। ভীষণ ভালোবাসি।”

চলবে…