#আহনাফ_চৌধুরী
#পর্ব_২০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
কাঠফাটা রোদ পড়েছে আজ। সূর্যের তেজ বরাবরের চেয়ে বেশি। মনে হয় কিছু নিয়ে সকাল থেকেই রেগে আছে। বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। অবশ্য অফিস ছুটির দিন আজ। বের না হলেও আপত্তি নেই। আপত্তিটা আসলে অন্য জায়গায়। সেদিন অনেক বলেকয়ে বুঝিয়ে অর্ষাকে নিয়ে এসেছিল। এর কিছুদিন পরই আবার অর্ষা বাবার বাড়ি যেতে চেয়েছিল। আহনাফ একেকবার একেক বাহানা দিয়ে আর যেতে দেয়নি। এভাবে সে ছলচাতুরী করেছিল পনেরো দিন ধরে। কিন্তু এখন আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই অর্ষা ব্যাগ গুছাচ্ছে। আহনাফ একটু পরপর জানালার পর্দা সরাচ্ছে আর বাইরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করছে। এটাই এখন মোক্ষম সুযোগ অর্ষাকে আটকানোর। সে কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
“বউ শুনছ?”
অর্ষা লাগেজে কাপড় রাখতে রাখতে বলল,
“শুনছি।”
“আজ সূর্যের তেজ দেখেছ?”
পর্দা জানালার ওপর থেকে হালকা সরানো ছিল। পিছু ফিরে একবার সেদিকে তাকাল অর্ষা। ভাবলেশহীনভাবে বলল,
“দেখলাম।”
“এই অসহ্য গরমে তুমি যাবে কীভাবে?”
“গাড়িতে করে।”
আহনাফ হতাশ হলো কিন্তু হাল ছাড়ল না। বলল,
“আজ বরং যাওয়ার দরকার নেই। কাল যেও।”
“এমন করে করে দুই সপ্তাহ্ পার করেছেন। এরপর বললেন শুক্রবার দিয়ে আসবেন। গতকাল বললেন আজ। আর আজ বলছেন কাল যাওয়ার কথা?”
আহনাফ অর্ষার হাত ধরে বলল,
“সারা সপ্তাহ্ ডিউটি করে গতকাল শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। আজ তো ছুটি ছিলই। তাই ভেবেছিলাম আজ দিয়ে আসব। কিন্তু আমি কি আর জানতাম আজ এমন ঠাডা পড়া রোদ উঠবে?”
“আমিও জানতাম না আপনি এমন ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলাবেন।”
“ছি, ছি! এসব কী বলো? আমি তো তোমার কথা ভেবেই বললাম।”
“এত ভাবতে হবে না। আমি আজই যাব।”
আহনাফ মুখটা মলিন করে বলল,
“আজই যাবে?”
“হু।”
“বলছিলাম যে…”
“আর কিছু বলতে হবে না। আমি আজ, এক্ষুনি যাচ্ছি। আপনি দিয়ে আসবেন নাকি আমি একাই চলে যাব?”
“আমিই দিয়ে আসব।” দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল আহনাফ।
বেচারার নিজের জন্যই নিজেরই এখন ভীষণ মায়া লাগছে। তার বউটা কেমন যেন! বুঝেও কিছুই বুঝতে চায় না। সে যে বউকে না দেখে, আদর না করে থাকতে পারে না এটা যেন বোঝেই না! সবই কপাল। মনের কষ্ট মনেই লুকিয়ে রেখে সে বাড়িতে বাবা-মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। নিচে নামার আগেই উবার ডেকেছিল। যা গরম আজ, বাইকে করে গেলে শুঁটকি হয়ে পৌঁছাতে হবে। কথায় আছে বিপদ এলে সবদিক থেকেই আসে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা যাকে বলে। একই তো প্রচণ্ড গরম আজ, তার ওপর কখনো জ্যাম তো কখনো ট্রাফিক সিগন্যালে বসে থাকা লাগছে। এসিতেও যেন এই গরম ভাব ঠিক দূর হচ্ছে না।
জেদ দেখিয়ে বের হলেও অর্ষার প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল এই গরমে। সিগন্যালে আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কে জানে! শরীরটাও কেমন যেন একটু গুলাচ্ছিল। আহনাফ ড্রাইভারকে বলিয়ে জানালার কাচ নামাল। যাতে বমি এলে অসুবিধা না হয় কোনো। অসহ্য গরমে বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল অর্ষা। ওদের অপজিট রোডে জ্যামে আটকে আছে অসংখ্য গাড়ি। ঠিক ওর জানালা বরাবর রিহানের গাড়ি। পেছনের সিটে বসে আছে জানালা খুলে। অর্ষার সাথে একবার চোখাচোখিও হলো। দুজনই একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। যেন কেউই কাউকে চেনে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ দুজন। কিন্তু এই মানুষ দুটোই শুধু জানে, একটা সময় দুজনে কতটা পরিচিত ছিল,কতটা কাছের ছিল, কতটা ভালোবাসা ছিল দুজনের মাঝে। এখন পার্থক্য শুধু এইটুকুই যে, একজন প্রতারণা করেছে আর অন্যজন প্রতারিত হয়েছে।
গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। আলগোছে আহনাফের বুকে মাথা রাখল অর্ষা। আহনাফ ওর চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল,
“খুব বেশি খারাপ লাগছে?”
অর্ষা মৃদু হাসল। এক হাত দিয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“উঁহুঁ।”
গরমের সাথে যুদ্ধ করে বাড়িতে পৌঁছে পাঁচ মিনিটের মতো রেস্ট নিল দুজনে। তারপর দুজনেই নরমাল পানির সাথে ফ্রিজের বরফ মিশ্রিত ঠান্ডা পানি মিশিয়ে গোসল করল। আমেনা বেগম লেবুর শরবত বানিয়ে দিলেন। এখন শরীর ও মন দুটোই শান্তি। দুপুরের খাবার খেয়ে অর্ষা ঘুমে ঝিমুচ্ছিল। আহনাফ আগেই রুমে চলে গেছে রেস্ট নিতে। অর্ষা কিছুক্ষণ মায়ের সাথে গল্প করবে বলে টেবিলে বসে ছিল। হাতে হাতে টেবিলও গুছাচ্ছিল। আমেনা বেগম বললেন,
“তোর কিছু করতে হবে না। রুমে যা। একটু ঘুমিয়ে নে।”
“ঘুমাব। একটুপর।”
“এবার থাকবি কয়দিন? নাকি দুই দিন পরই আবার দৌড় দিবি?”
অর্ষা হেসে বলল,
“না, বেশ কিছুদিন তো থাকব ভেবেছি। তোমার জামাই-ই তো থাকতে দেয় না।”
হঠাৎ তিনি মেয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“আহনাফ তোকে খুব ভালোবাসে তাই না?”
অর্ষা মুখে কিছু বলল না। কিন্তু ওর চোখ-মুখের হাসিই বলে দিল আমেনা বেগমের ধারণা সঠিক। তিনি তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন,
“আল্লাহ্ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।”
এ কথা বলাতে আজকে রিহানের সাথে দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ে গেল অর্ষার। সে মাকে বলল,
“আজ রিহানের সাথে দেখা হয়েছিল।”
“কোথায়?” জানতে চাইলেন আমেনা বেগম।
“রাস্তায়। গাড়িতে ছিলাম তখন।”
“যাক। এসব নিয়ে আর ভাবিস না।”
“ভাবছি না মা। শুধু অবাক হচ্ছি। মানুষ কত দ্রুত বদলে যায় তাই না?”
“মানুষ আবহাওয়ার মতো বদলাবেই। কেউ বদলায় নিজের স্বার্থে আর কেউ বদলায় আঘাতে। এখানে বদলানোর পেছনে রিহানের স্বার্থ ছিল, আর তোর ছিল আঘাত।”
“আমি তো ঠকাইনি মা। ঠকেছি। কিন্তু রিহান ঠকিয়েও কী সুন্দর দিব্যি ভালো আছে দেখো! দিন শেষে বুঝি প্রতারকরাই ভালো থাকে বলো?”
“তুই কি ভালো নেই?”
“অনেক বেশিই ভালো আছি মা। সে আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আগলে রাখে।”
“এতেই আলহামদুলিল্লাহ্ বল। রিহান শাস্তি পাক বা না পাক সেসব নিয়ে ভাবিস না। ওকে ভাবনাতে রাখারই প্রয়োজন নেই। অনেক সময় এমন হয় যে, এসব প্রতারকরা শাস্তি ঠিকই পায় কিন্তু প্রকাশ করে না বা স্বীকার করে না। আর আমরাও যেটা দেখি না, জানিনা বলে ভেবে নিই ওরা বুঝি অনেক ভালো আছে। আসলে সবসময় আমরা যেমনটা ভাবি তেমনটা হয় না। ভাবনার বাইরেও অনেক কিছুই হয়। কিন্তু এসব তুই আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়। ভাগ্য করে আহনাফকে পেয়েছিস। সমস্ত ধ্যান ওকেই দে। স্বামী ভালো ও সৎ হলে দুনিয়াতে আর কিছু লাগে না রে মা। বুঝতে পেরেছিস?”
অর্ষা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাল। আমেনা বেগম বললেন,
“যা এখন গিয়ে রেস্ট কর।”
অর্ষা হাত ধুয়ে রুমে চলে গেল। আহনাফ কাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে। দরজা লক করে জানালার পর্দা টেনে দিল অর্ষা। নিঃশব্দে আহনাফের পাশে শুলো। কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল ঘুমন্ত আহনাফের মুখের দিকে জানে না সে। কেমন যেন একটা শান্তি শান্তি অনুভব করছে সে। আলতো করে গাল ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ভালোবাসি।”
এরপর আহনাফের হাতের ওপর মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ঘুমের মধ্যে আহনাফও জড়িয়ে ধরল অর্ষাকে। সেও বিড়বিড় করে বলল,
“ভালোবাসি বউ।”
হেসে ফেলল অর্ষা। মনে মনে ভাবল, বিয়ের পর স্বামীর বুকের চেয়ে শান্তির জায়গা কি আর কোথাও আছে? নিশ্চয়ই নেই!
চলবে…