#রাগে_অনুরাগে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
#পর্ব-০৭ (শেষ পর্ব)
.
ফুচকা খেয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। সানাফ ভাইয়ের আম্মু আর সাদ ভাইয়া উনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা বাসায় ফেরা মাত্রই সবাই এক প্রকার ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের উপর। কোথায় গিয়েছিলাম? কী করছিলাম? নানারকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সানাফ ভাই অবশ্য সবটা ম্যানেজ করে নিয়েছিলো। আমার অতো ধৈর্য্য নেই। আমি চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম৷
উনারা চলে যাওয়ার সময় সানাফ ভাই কেমন অসহায় দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হুট করে সবার সামনে থেকে আমাকে বেলকনিতে নিয়ে গেলেন। আমি হতবাক! কী করতে চাইছেন উনি? হঠাৎ দেখলাম উনার ঠোঁট যুগল আমার কপালের দিকে এগিয়ে নিচ্ছেন।
আমি বাঁধা দিয়ে বললাম,
‘আজ এসব থাকুক। এসব করার জন্য আরো অনেক সময় বাকি আছে।’
উনি আকুতি করে বললেন,
‘প্লিজ, তোর কপালে শুধু একটিবার আমার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে দে? শুধু একবার।’
আমি আমার জেদ বজায় রাখলাম। উনাকে স্পর্শ করতে দেইনি আমি কপাল। সানাফ ভাই এক প্রকার মন খারাপ করেই বের হয়ে যান বাসা থেকে। হঠাৎ করেই উনার অসহায় দৃষ্টির কথা মনে করে আমার বুক ধক করে উঠলো।
বিয়ের আসরে বসে এতোক্ষণ এসব ভাবছিলাম। সকাল থেকে সানাফ ভাই কোনো ফোন দেননি আমায়। আমিও দেইনি। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে আমার। হয়তো নতুন পরিবেশে চলে যাবো, তাই এমন হচ্ছে। এই মাত্র আম্মুকে ফোন দিয়েছেন উনি। উনার ফোনের কথা শুনে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলাম। উনারা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা হয়ে যাবেন। যদিও উনাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আসতে মাত্র পনেরো মিনিট সময় লাগে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনাদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে রইলাম।
দশ মিনিট, বিশ মিনিট, এমন করে এক ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছে; উনারা আসছেন না। আমার ভেতরে কেমন জানি তোলপাড় হচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। কিছু উত্তর মেলাতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে আপু কোত্থেকে যেনো দৌড়ে এসে আমার সামনে ধপাস করে বসে পড়লো। ওর চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। উৎকন্ঠা নিয়ে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এই আপু কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?’
আপুর কোনো জবাব পেলাম না। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেলো। কিন্তু আসল বিষয়টা কী, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। মিলি আর অথৈ আমার পাশে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি বিরক্তিকর সুরে ওদেরকে বললাম,
‘আজব, এখনি এভাবে জড়িয়ে ধরছিস কেন? আমি তো এখনই শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছি না। যাওয়ার সময় ধরিস। এখন ছাড় আমাকে।’
আমার কথাটা শুনে ওরা আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি আপুকে ঝাঁকি দিয়ে বললাম,
‘আপু বলবি তো, কাঁদছিস কেন তুই?’
হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
‘সানাফের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।’
কথাটা যেনো কাঁটার মতো ফুঁড়ে গেলো আমার বুকে। মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা কোনো কিছু ছলাৎ করে বেয়ে গেলো। আমি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। চারপাশে এতোক্ষণ যেমন শোরগোল ছিলো, তেমনটা নেই। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ।
আমি এক ঝটকায় মিলি, অথৈয়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আপুর মুখের দিকে তাকালাম। ও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ওকে পাত্তা না দিয়ে দৌঁড়ে আব্বুর কাছে গেলাম। আব্বু ততক্ষণে বেরিয়ে গিয়েছে বাসা থেকে। এবার দৌঁড়ে গেলাম আম্মুর কাছে। আম্মুর অবস্থা আরো খারাপ। উনি কাঁদতে কাঁদতেই প্রেশার হাই করে ফেলেছেন। কারো পরোয়া না করে ছুটতে লাগলাম। উদ্দেশ্য সানাফ ভাইয়ের কাছে পৌঁছানোর। কিন্তু মেইন গেইটের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম আমি।
একটা ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলছে,
‘নতুন জামাই হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা গেছে। এখন উনাকে বাড়িতে নিয়ে আসতেছে।’
কী শুনলাম আমি? আমির কান স্তব্ধ হয়ে গেছে। হাত পা অনবরত কাঁপছে। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,
‘না। ওরা সবাই ভুল বলছে। আমার সানাফ ভাইয়ের কিচ্ছু হয়নি। উনি ঠিক আছেন।’
এতোক্ষণে আমাকে আটকানোর জন্য অর্ণব, মিলি, অথৈ, আপু সবাই গেইটের কাছে চলে এসেছে। আমি সবাইকে উপেক্ষা করে দৌঁড়াতে লাগলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে সানাফ ভাইয়ের কাছে পৌঁছাতে হবে। ওরাও আমার পিছন পিছন দৌঁড়াচ্ছে। এমন ঘটনা বিরল; বিয়ের কনে বেনারসি পড়ে রাস্তা দিয়ে ছুটছে। তখন লোকজন হয়তো হা করে তাকিয়ে দেখছিলো আমাকে। কতোক্ষণ দৌঁড়ালাম জানি না। তবে যতক্ষনে আমি সানাফ ভাইদের বাড়িতে পৌঁছালাম, ততক্ষণে সানাফ ভাইকে মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সানাফ ভাইয়ের আম্মুর জ্ঞান নেই। উনি বাড়ির ভেতরে। সাদ ভাইয়ার কানের পাশ দিয়ে রক্ত অঝর ধারায় ঝরছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। হয়তো উনিও আমার মতো হসপিটাল থেকে দৌঁড়ে এসেছেন।
সানাফ ভাইয়ের রক্তাক্ত চেহারার দিকে আমি এক মিনিট তাকালাম। তারপর ঝাপিয়ে পড়লাম উনার গায়ের উপর।
আর্তনাদ করে ডাকলাম,
‘সানাফ ভাই, সানাফ ভাই, সানাফ ভাই! উঠেন না? আপনি এসব অভিনয় করছেন, তাই না? আমাকে বোকা বানানোর জন্য, হ্যাঁ? আমি জানি এসব আপনি অভিনয় করছেন।’
এসব ভেবেই আবার হাসতে লাগলাম আমি। এতোক্ষণ আমাকে টেনে সানাফ ভাইয়ের কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সানাফ তাকাচ্ছে না আমার দিকে। চোখ খুলছে না। আম্মুকে ডেকে বললাম,
‘আম্মু দেখো, তোমার আদরের জামাই কেমন অভিনয় করছে? দেখছো? আজকেও উনার পক্ষে কথা বলবে তুমি?’
আম্মু নেই এখানে। আব্বু আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আমি আবারও সানাফ ভাইকে চেঁচিয়ে ডাকলাম,
‘সানাফ ভাই উঠুন। আমার কথা কি আপনার কানে যাচ্ছে না? কেন এভাবে সবাইকে কাঁদাচ্ছেন?’
নেই। সানাফ ভাইয়ের সাড়া নেই। সানাফ ভাই উঠছে না। আমার সানাফ ভাই আর নেই। কোথাও নেই!
নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আওয়াজ ছাড়লাম,
‘আল্লাহ, কেন তুমি আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলে? কেন? আমার আমার সানাফ ভাইকে আমার থেকে কেড়ে নিলে? কেন?’
তারপর আর কিছু মনে নেই আমার। যতক্ষণে আমার জ্ঞান ফিরে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে। হুমড়ি খেয়ে উঠে বসতে চাইলাম; কিন্তু হাতের ক্যানোলাতে টান খেলো। জ্ঞান ফেরার পর জানতে পারলাম- আমি আট চল্লিশ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম। আগের ঘটনাগুলো ঝাপসা ঝাপসা মনে হতে লাগলো৷ যখন মনে হলো সানাফ ভাই আর নেই, তখন বিকট চিৎকার দিলাম। সাথে সাথে আমার হাত পায়ে খিচুনি ধরে গেলো। মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হতে লাগলো। টানা পনেরো দিন আমি হসপিটালে কাটালাম। মানসিক চাপ। ডক্টর বলে দিয়েছেন আমি এমন চাপে থাকলে খুব শীঘ্রই মানসিক রোগীতে পরিণত হবো। আমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে বেশিরভাগ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখতো। যতক্ষণ জেগে থাকতাম সানাফ ভাইকে ডাকতাম। কিন্তু উনি আসতেন না।
আমার স্বাভাবিক হতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। ততদিনে সানাফ ভাইয়ের কবরের ভেজা মাটি শুকিয়ে গেছে। উনার এক্সিডেন্টটা বাইক এক্সিডেন্ট ছিলো। বিয়ে করতে আসছেন বাইকে চড়ে। সাদ ভাইয়া পিছনে ছিলো ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগায় সাদ ভাই ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। আর সানাফ বাইকের চাপায় পড়ে যায়। যার ফলে, স্পট ডেথ হয়। কথাগুলো সরাসরি কেউ আমায় বলেনি। পাছে অসুস্থ হয়ে যাই এই ভয়ে। কানাঘুষা যা শুনতে পেয়েছি, তাতে এটুকুই জেনেছি। কথাগুলো মনে হতেই আমার বুকের সেই ক্ষতটা তাজা হয়ে উঠলো। চলে গেলাম সানাফ ভাইয়ের কবরের কাছে। দূর থেকে দাঁড়িয়েই চোখের পানি মুখে উনার আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া করলাম।
__________
সময় তার নিজের গতিতে চলছে। সানাফ চলে যাওয়ার পর আমার পৃথিবী থমকে গেলেও, সময় কেটে গেছে পাঁচ বছর। এর মধ্যে আমার বিয়ের প্রস্তাব অনেক আসলেও আমি রাজি হইনি। সানাফ ভাইয়ের ঐদিনের কথাগুলো রেখেছি আমি। আমার মনে প্রাণে শুধু উনিই বিচরণ করতে চেয়েছিলেন। মানুষটা চলে গেছে কিন্তু উনার কথা ঠিকই রেখেছি।
আমাকে রাগিয়ে দিয়ে একদিন চিরকুট আর চকলেট পাঠিয়েছিলেন। সেটা উনি বেঁচে থাকতে আমি খুলে দেখিনি কখনোই; কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পর ঠিকই দেখিছিলাম। সেখানে লিখা ছিলো,
‘নিধি, কাল রাতের প্রেম নিবেদনটা আমি সত্যিই মন থেকেই করেছিলাম। তোকে ক্ষ্যাপানোর জন্যই মিথ্যে বলেছিলাম।’
চিরকুটটা পড়ে সত্যিই সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম।
এই পাঁচ বছরে সানাফ ভাইয়ের জন্য শ’খানেক চিঠি লিখেছি আমি। কিন্তু সেগুলো পড়ে দেখার জন্য উনি আর নেই। আমার আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় উনি সত্যিই নেই। আজও চিঠি লিখছি।
“সানাফ ভাই,
আপনাকে কখনোই প্রিয়, জান, প্রাণ কিছুই ডাকিনি। কেন জানি সানাফ ভাই ডাকটাই আমার কাছে ভালো লাগে। জানেন সানাফ ভাই? আপনার নিধি আর আগের মতো চঞ্চল নেই। আমি থমকে গেছি সানাফ ভাই। আমার চারপাশ থমকে গেছে। কেন এমন থমকে দিলেন আপনি? কেন? আপনি আমার কপালে চুমু খেতে চেয়েছিলেন, তাহলে সেটা না খেয়েই এভাবে পালিয়ে গেলেন কেন সানাফ ভাই?
আপনি জানেন আমার কতোটা কষ্ট হয় আপনাকে ছাড়া? আপনি তো চেয়েছিলেন আমাদের সন্তানদের জন্য হলেও যেন আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাই। আজ আমি গ্রেজুয়েট সানাফ ভাই। কিন্তু আমাদের সন্তান নেই। আপনিই নেই! কেন এভাবে ধোঁকা দিলেন আপনি আমায়? কেন? দু’টো পরিবার আপনাকে ছাড়া খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে। মানুষগুলো সব চূর্ণ বিচুর্ন হয়ে গেছে। আমি আর সইতে পারছি না সানাফ ভাই। আপনার উপর আমি খুব রাগ করতাম, সেটা যেমন ঠিক; তেমনি সেই রাগ উবে গিয়ে আপনার জন্য আমার মনের কার্নিশে যে অনুরাগের সৃষ্টি হচ্ছিলো, সেটা না উপলব্ধি করেই স্বার্থপরের মতো কেন চলে গেলেন?
ও সানাফ ভাই, আপনি জানেন না? আপনার নিধি আপনাকে ছাড়া নিঃস্ব! কোত্থাও কেউ নেই তার! কেউ নেই।
তবে, আপনি চলে যাওয়ার পর আমি একটা জিনিস বুঝেছি, কোনো কিছুই অতিরিক্ত চাইতে নেই। তাহলে সেটা মানুষ পায় না। আপনিও তো আমায় খুব করে চেয়েছিলেন, পেলেন না। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন সানাফ ভাই? আপনাকে আমি রোজ রাতে স্বপ্নে দেখি, কিন্তু ছুঁতে পারি না। আমার এই পৃথিবীত এখন দম বন্ধ হয়ে আসে, জানেন সানাফ ভাই?”
চিঠিটা লিখা শেষ করার আগেই পাঁচ বছর পূর্বের সেই অসুখ দেখা দিয়েছে আমার। হাত পা খিচুনি ধরে যাচ্ছে। আর কলম চালাতে পারছি না। মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। আমায় আজকেও আবার হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানি না এবার বেঁচে ফিরবো কিনা। আর ফিরলেও হয়তো উন্মাদ হয়ে ফিরবো। তারপর আমি হবো- সানাফ ভাইয়ের উন্মাদ নিধি।
.
(সমাপ্ত)