অনুর উপাখ্যান পর্ব : ৭

0
1972

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৭

এতদিন পর বাসায় যাচ্ছি, আমার তো খুশি হওয়ার কথা । কিন্তু, অঝোরে কাঁদছি আমি । বিয়ের দিন বিদায়ের সময় ও মনে হয় এতটা কাঁদিনি, যতটা আজকে কাঁদছি ।আশ্চর্য় জীবন ! মাত্র দু’টো মাস; তাতেই এত কষ্ট পাচ্ছি ? সৃষ্টিকর্তা যদি আমার মনে এত মায়াই দিবেন, তবে মায়া করার মানুষটাকে ও কেনো যোগ্য করে দিলেন না ? আমার এত মায়া শেষ পর্যন্ত অপাত্রে গিয়ে পড়ল । দোষ তো আমারই কেনো এত মায়া করতে গেলাম ? কেনোই বা করব না ? আমি কি বাবার বাড়িতে ফেরত যাব এ চিন্তা করে বিয়ে বসেছি ? আশা তো ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই থেকে যাব ।

— কি অইলো এত কানতাছো ক্যা ? শরীরের ক্ষতি অইবো না ? এহন কান্না বন্ধ করো ।

— আপনার কি সমস্যা ? আপনি চুপ করেন ।

— আমার সাথে এই ভাবে কতা কইতাছো ক্যান ? আমি কী কইতে চাই হুনবা তো ?

— বলেছি না যে, শুনবো না আমি ।

— না, এহনই হুনো প্লিজ । আমার ভুল অইয়া গ্যাছে । মার কথা বিশ্বাস করা উচিত অয় নাই । তুমি কান্না থামাও । আমি আসলে গাড়ির কতা কইয়া ডাক্তার জামিল ভাইয়ের লগে দ্যাহা করতে গেছিলাম । তারে সব ভাইঙ্গা কইলাম ।তোমার শেষ কবে মাসিক হয়ছিল সব । জামিল ভাই কইছে তোমার কোনো দোষ নাই । তুমি যা কইছো তাই সত্য । এই সময়ের মধ্যে বাচ্চা প্যাডে আসা স্বাভাবিক ।মারুফের কথা শুনে অনুর কান্নার গতি যেনো আরও বেড়ে গেলো । অভিমানে আরও জোড়ে কাঁদছে সে।

— অহন একটু থামো প্লিজ । তোমগো বাড়িত যাইতাছ চোখ ফোলা দেখলে সবাই জিগায়বো না কি হইছে ? কান্না থামাও প্লিজ ।

— হুনো তোমারে ইচ্ছা কইরা আজক্যা নিয়া আসছি । কারণ, আমগোর বাড়িত তোমার অনেক কষ্ট অইতাছিল । জামিল ভাই কইলো তোমারে যেনো ঢাকা দিয়া আসি । তোমার এহন যত্ন দরকার । তাই নিয়া আইলাম । কিছুদিন থাকো এইহানে । শরীর একটু বালা অইলেই আমি নিয়া যামু নে ।

— সত্যটা যে আপনি জানতে পেরেছেন তার জন্য আলহামদুলিল্লাহ ।

— কি অইল ? এহন কান্না থামাও ।

—আপনি থামেন তো ,আমাকে আমার মতো থাকতে দেন । ড্রাইভারকে গাড়ি আস্তে চালাতে বলেন, ঝাকি লাগছে আমার ।

বাসার গেটে গাড়ি থামতেই ভাইয়া বের হয়ে আসলেন । আমাকে দেখে তো খুশিতে চিৎকার ! আম্মু তো কেঁদেই দিলেন । আব্বু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । আব্বুর চোখ দেখে এখন আরও বেশি কান্না পাচ্ছে ।তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে আব্বুর সবচেয়ে আদরের মেয়ে আমি । সেই আদরের মেয়েটাই যে অপাত্রে পড়েছে এটা আব্বুর বুঝতে আর বাকি নেই ।

মারুফকে সবাই বেশ সম্মানের সাথেই গ্রহন করল । মেয়ের জামাই বলে কথা ! যেমনই হোক যত্ন তো করতেই হবে ।আম্মু তাড়াহুরো করে খাবার রেডি করছেন । আমি আমার রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম । অনেক ক্লান্ত লাগছে । ঝিনু এসে পাশে বসল ।

— কিরে শরীর কি বেশি খারাপ ? আপু, তোর চোখ ফোলা কেনো ?

— এমনি , এখন কিছু জিজ্ঞেস করিস না । অনেক বেশি কেঁদে ফেলছি । আর কাঁদতে পারব না ।

— তোর কপালে যে কান্না আছে সেটা তোর বিয়ের দিনই বুঝেছি আমি । তোর বাসা থেকে এসে সব বলে দিয়েছিলাম আব্বু আম্মুকে ।

— কেনো বলতে গেলি ? আব্বু নিশ্চই কান্না করেছেন ? যে কারণে আমি কিছু বলি নি ।

— বারে, আব্বুর জানতে হবে না তোরে কেমন বাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন ?

— বলতো আমি কেনো তোর মতো এত কঠিন হতে পারি না ? এমন হলে তো আর এভাবে কপাল টা পুড়তো না । বড় আপু , তুই সবকিছুতেই কেমন কঠিন ভাবে কথা বলিস ! কিন্তু, আমি কেনো এত নরম মনের হলাম ?
ওহ শোন, বড় আপুকে ফোন দিয়ে বল আসতে । কাল সকালে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন।

— ওয়েট, এখনি কল করে আসছি । আজই আসতে বলি ?

— হ্যাঁ, বল । আজকেই যেনো আসেন ।

মারুফ ড্রয়িংরুমে বসে আছে । অনু সেই যে ঐ ঘরে ঢুকছে আর বাইর অইতাছে না ক্যা ? আল্লাহই জানেন, সবকিছু কি কইয়া দিতাছে নাকি ? ধুর বালা লাগতাছে না কিছু ।

— অনু, এ্যাই অনু কই তুমি ? এদিকে আসো ।

— কী হলো ? ডাকেন কেনো ? কিছু লাগবে ?

— না, কী করো তুমি ? কার লগে গল্প করো ?

— শরীর খারাপ লাগছে, তাই শুয়ে ছিলাম ।আপনি ফ্রেশ হন । খাবার রেডি । আব্বু আপনার জন্য বসে আছেন ।

— আইচ্ছা গামছা টা দাও ।

খাবার টেবিলে সবাই এক সাথে বসেছি । আম্মু আমার পাশে বসেছেন । কত দিন পর আম্মুর হাতের রান্না খেলাম ! ইস এত স্বাদ লাগছে সবকিছু । যে খাবার টা বেশি মজা লাগছে আমার, আম্মু সেটা বেশি করে আমাকে তুলে দিচ্ছেন । পেট ভরে খেলাম আজকে ।আব্বু মারুফকে খাবার তুলে দিচ্ছেন । মারুফ গদগদ সুরে বলল :

— আম্মু, আমনের রান্না অনেক মজা হয় । অনুও ঠিক আমনের মতো রান্না করতে পারে । অনু রানলে আমি পেট ভরে খেতে পারি ।

— ওমা ! এ আমি কী শুনছি আপু ? তোর বর দেখি শুদ্ধ করেও কথা বলতে পারে ! কী দুলাভাই ? এখন তো ভালো ভাবেই কথা বলছেন । তয় আমনের বাড়িত এমন কইরা কতা কন ক্যা ?

ঝিনুর কথায় সবাই হেসে দিলো । মারুফ মনে হয় একটু লজ্জা পেলো । আব্বু সেটা খেয়াল করলেন । ঝিনুকে ধমকে থামতে বললেন ।

— থাক আব্বু, ওরে বলতে দেন । ঝিনু আমার এক মাত্র শালিকা । ওতো বলবেই ।

বুইড়া খাটাস, শালিকা কি রে ? বোন বলতে পারিস না ? মনে মনে ঝিনু ইচ্ছে মতো মারুফে বকে যাচ্ছিল । অনু খেয়াল করল ঝিনুর আচরণ । ইশারায় থামতে বলল ঝিনুকে । বাধ্য হয়ে ঝিনু চুপ থাকল ।

বিকেলে বড় আপু দুলাভাই আসলেন । আপুর ছেলেটা মাশা আল্লাহ এত কিউট হয়েছে ! অনু মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মনে মনে দোয়া করছে আমার বাবুটা ও যেনো এমন হয় ।বাসার সবাই আজকে খুশি । এত দিন পর সবাই একসাথে হয়েছি, পুরো বাড়ি যেনো মেতে উঠেছে । মারুফ, দুলাভাই ও ভাইয়ার সাথে বসে টিভি দেখছে । আম্মু পিঠা বানাচ্ছেন । আর আমরা তিন বোন বসে গল্প করছি ।

সবার এত খুশির মুহূর্তে অনু নিজের কষ্ট গুলো আড়াল করে রাখলো । আজ সে কিছুই বলবে না । মারুফ কাল চলে গেলে পরে সবাইকে জানাবে সবকিছু । এখন শুধু খুশির গল্প হোক অনু এটাই চাচ্ছে ।

— আপু, তুই যে কত সুন্দর হয়ে গেছিস জানিস ?

— হু, তোরে বলছে ? শরীর এত খারাপ আমার ! সুন্দর হলাম কীভাবে রে ?

— তুই বিশ্বাস করিস না ? সত্যি বলছি তুই আরও বেশি সুন্দর হইছিস ।বড় আপু, আপনি বলেন তো আমি সত্যি বলছি না ?

— হ্যাঁ, ঝিনু সত্যি কথাই বলছে । তোর গায়ের রং যেনো আরও বেশি খুলেছে !

— আলহামদুলিল্লাহ ।

— ঐ তোর যদি নজর লাগে ? আয় আমি বুকে থু থু দিয়ে দেই । হি হি হি

— যা বদ ! খালি ফাজলামো করিস । আমারটা আমি দিয়ে নিতে পারব ।

— তোরা পারিস ও । এখনো বড় হলি না তোরা ! বড় আপু হাসছেন ।

মারুফের মুড বেশ ফ্রেশ লাগছে । কারণ , তাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করে নি । তাই সে বেশ খুশি । অনুর উপর সে বেশি খুশি যে, সে তারে কারো কাছে ছোট করে নি ।

— অনু, আমি আইজ খুব ভয় পাইছিলাম । তুমি যদি সব কইয়া দাও ?

— না, কিছু বলি নি আমি । কিন্তু, বলতে তো হবেই তাই না ? তবে আপনি যাওয়ার পর বলব, কাজেই টেনশন করবেন না ।এখন ঘুমান ।

— ঘুমামু ? তুমি কাছে আইবা না ? আহো এদিকে আহো ।

অনু তাকিয়ে দেখছে লোকটার মুখের দিকে । কেনো জানি এ মূহূর্তে তার প্রতি কোনো মায়া কাজ করছে না তার । নিজেকে খাদ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না এখন ।

বড় আপু, দুলাভাই, মারুফ সহ ডাক্তারের কাছে এসেছি । আপুর শাশুড়ি ও নাকি উনাকে দেখাতেন, এবং উনার কাছে আপুর ছেলের ডেলিভারি হয়েছে । আপুর মতে উনি খুবই ভালো একজন ডাক্তার । সব চেক করে ডাক্তার জানালেন যে, বাচ্চা সুস্হ আছে । আলহামদুলিল্লাহ । আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট আমি মারুফের হাতে দিয়ে বললাম, ভালো করে পড়েন । কারণ টা শুধু আমরা দু’ জনই বুঝলাম । বড় আপু, দুলাভাই কিছুই টের পেলেন না ।

বিকেলে মারুফ চলে গেল বেশ খুশি ভাবে । তার খুশির কারণ সেই জানে । এবার অনু শান্তির নি:শ্বাস নিলো । আম্মু ও আমরা তিন বোন বসলাম কথা বলার জন্য ।

— এবার বলো তো মা কি হয়েছে ? তুমি যে কান্না করতে করতে আসছো তা আমরা বুঝতে পারছি । তোমার আব্বু কষ্টে ঠিক মতো ঘুমাতে পারে নি । জামাই ছিল বলে কিছু জিজ্ঞেস ও করতে পারি নি । বলো মা কী হয়েছে ?

সবকিছু শুরু থেকে বললাম । শুনে আমার সাথে আম্মু ও কাঁদছেন । ঝিনু তো পারলে আমার শাশুড়ি মা কে এখনি পিটাতে যাবে ।

— আম্মু, আমি আর ঐ বাড়িতে যাব না ।

— হ্যাঁ, মা আমিও তোমাকে যেতে দিব না । এত অমানুষদের কাছে তোমাকে আর দিব না ।

— অনু, মারুফ তো এখন ভালে আচরণ করছে, তাই না ? বড় আপু জিজ্ঞেস করলেন ।

— হ্যাঁ, দু’দিন ধরে ভালো ব্যবহার করছে ।

— তুই কী কখনো মারুফকে কারো সাথে হাতে নাতে ধরছিস খারাপ কাজ করার সময় ?

— না, তা না । আমি কোনো প্রমান পাই নি এখনো । এসব কথা বড় ভাবি বলেছেন । আর এলাকার কয়েক জন মহিলা বলেছেন । তবে সে ড্রিং করে এটা দেখেছি ।

— তাহলে কেনো মানুষের কথা শুনে বলছিস যে, আর যাবি না ? মারুফকে সময় দে শুধরানোর । বাচ্চা হলে বাচ্চার মুখ দেখলেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে ।

— রেনু, তোমার কথা ঠিক না , যে ছেলে ড্রিং করে; সে মেয়ে মানুষের কাছে ও যায় । অনুর আর ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না । আমি চাই না অনু আবার ঐ বাড়িতে যাক ।আম্মু বললেন ।

— আম্মু, তুমি এভাবে আর বলবা না । যাবে না মানে ?

— অনু শোন, তুই যদি মারুফকে ডিভোর্স দিস, তবে মানুষ কি বলবে চিন্তা করেছিস ? আমরা কি শ্বশুড় বাড়িতে মুখ দেখাতে পারবো ? তোর ডিভোর্স হলে তোর ছোট বোনটা কে ভালে জায়গায় বিয়ে দেয়া যাবে ? আর তোর বয়স কত এখন ? সতেরো ? তোর বাকি জীবন পড়ে আছে । সারাজীবন কী তুই একা থাকতে পারবি ? তোকে তো অবশ্যই আবার বিয়ে দিতে হবে । তখন তোর বাচ্চাটার কী হবে ? আর যার সাথে আবার বিয়ে হবে, সেই লোক যে ভালো হবে তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে ?

চলবে….

✍? নায়না দিনা