অনুর উপাখ্যান পর্ব : ৬

0
1866

গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ৬

— কি অইলো কেউ কথা কও না ক্যা ?

— ভায়ে, আমি লবন দেই নাই, বিশ্বাস করো তুমি ।

— মামা, আমি ও লবন দেই নাই । আমারে মাইরেন না মামা । আমি ক্যান লবন দিমু ? রিনা ভয়ে বলে উঠল ।

শাশুড়ি মা কোনো কথা বললেন না ।মুখ কালো করে ঘরে চলে গেলেন । আমি মারুফকে এক প্রকার জোড় করে ঘরে নিয়ে আসলাম । কারণ, আমি চাচ্ছিলাম না মারুফ শাশুড়ি মাকে কিছু বলুক । উনি এতটাই বয়স্ক যে, কেনো জানি হাজার রাগ থাকলে ও উনার মুখের দিকে তাকালে আমার কেমন যেনো মায়া লাগে ! এই মায়াই যে আমার বৈশিষ্ট্য । আর এ জন্যই বুঝি আমার জীবনে এত কষ্ট । হোক না কষ্ট; সব সহ্য করব, শুধু মারুফ যদি একটু ভালো ব্যবহার করে তাতেই খুশি আমি ।

— তুমি আমারে নিয়া আইলা ক্যা ? ডাইলে লবনটা মায় দিছে না ? ক্যান দিলো তা একবার তারে জিগাইতে দিলা না ক্যা ?

— হ্যাঁ, সবাই বুঝতে পারছি যে, ডালে লবন মা ই দিয়েছেন । তবুও আপনি মাকে কিছু বইলেন না । বুড়ো মানুষ, সবার সামনে লজ্জা পাবেন । তাই আপনাকে নিয়ে এসেছি । আপনি যে সত্যটা জানতে পেরেছেন এতেই আমি খুশি ।মাকে কিছু বলতে হবে না ।

— কিন্তু, আর একটু অইলেই তো মাইর টা তুমি খাইতা । এইটা জাইন্না ও তুমি মায় রে কিছু কইতে দিলা না !

— থাক, বাদ দেন তো । আপনি ঠিক থাকলে আমার আর কিছু লাগবে না ।

এই প্রথম মারুফের চোখে আমি খুশির ঝিলিক দেখলাম । আজ আর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েনি সে । অনেক রাত পর্যন্ত দুজনে গল্প করলাম । আমি ঢাকা যাব বললাম । রাজি হয়েছে নিয়ে যেতে । গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যাবে বলল । মন টা অনেক ভালো লাগছে এখন । আল্লাহ্ বুঝি এবার সত্যি আমার প্রতি সহায় হয়েছেন ।

— কাইল দুপুরের পরে রেডি থাইকো, তোমারে ডাক্তার আপার কাছে নিয়া যামু । পরে কিছু কেনাকাডা করমুনে । কি খাইবা তুমি ? রাজবাড়ি মাঠে চটপটি, ফুচকা বেচে, খাইবা ?

— সত্যি ! হ্যাঁ, খাব । ইসস ! এখনই খেতে মন চাচ্ছে আমার । একটা কথা শোনেন , আমি না আজকে অনেক খুশি ।

— হ বুঝলাম । অহন আহো ঘুমাই ।

আলহামদুলিল্লাহ, ভালো লাগছে এখন । অনেক, অনেক দিন পর আজ শান্তির ঘুম ঘুমাবো ।

চোখে সকালের আলো পড়তেই অনু চোখ মেলে তাকালো । সর্বনাশ ! সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা । রিনা আলনা থেকে কাপড় নিচ্ছে, আলনার ঐ পাশে শাশুড়ি মা দাড়িয়ে আছে দেখে নি সে ।

— এ্যাই রিনা , দরজা কে খুলল ? আর তুমি এই ঘরে কেনো ঢুকেছো ?

— নানি খুলছে । আমারে ময়লা কাপড় নিতে কইল ধোয়ার জন্য ।

— কিন্তু, দরজা তো ভিতর থেকে লক দেয়া ছিল !

— লক ছিল তো কি অইছে বউ ? চাবি আমার লারো আছে না ? আমি খুলছি কেওড়, কি অইছে ?

শাশুড়ি মা কে দেখে চমকে উঠলাম ! উনি কি সুস্হ মানুষ ? ছেলে, বউ ঘুমিয়ে আছে আর উনি চুপ করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলেন ?একটু লজ্জা ও করল না উনার ? রাগে, দু:খে কেমন যে লাগছে । নূন্যতম প্রাইভেসি নেই ! বেড রুমটা ও ছাড় দেয় না । এর চেয়ে তো দড়জা খুলেই ঘুমানো ভালো দেখছি !

মায়ের কথা মারুফ সবই শুনল চুপ করে । কিন্তু, কিছুই বলল না । আজ সে বাহিরে যাবে না । আরাম করে একটু ঘুমাচ্ছে । অনু তাই মারুফকে কিছু বলল না শাশুড়ি মায়ের বিষয়ে ।মারুফ সারাদিন বাসায় থাকবে, তাকে সময় দিবে । এটা শুনেই অনু অনেক খুশি । শাশুড়ি মায়ের যন্ত্রনা থেকে অন্তত বাকি দিন টুকু রেহাই পাবে আজ ।

নাস্তা করে আমরা দুজন বসে গল্প করছি । এই প্রথম এভাবে দুজন সময় কাটাচ্ছি । মনে হচ্ছে আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে । সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে অনু এটাই চেয়েছে মনে মনে । অনুর বিশ্বাস বাবু হলে নিশ্চই আরো পাল্টে যাবে মারুফ । স্বামী ঠিক থাকলে আর কিছুই যে লাগবে না তার । এই হলো নারী জাত, কত সহজেই মন গলে যায় ! আসলে একটা স্ত্রীকে খুশি করতে কী লাগে ? টাকা ? গহনা ? না, একটু ভালোবাসা, সম্মন ও বিশ্বস্ততা । আর যে কোনো পরিস্হিতিতে স্ত্রীর পাশে থেকে তাকে আগলে রাখা । সত্যি বলছি এগুলো পেলে আর কিছুই লাগবে না সুখি হতে ।

— কই বউ বাইর অউ না ক্যা ? হারা দিন গরো কেওর দিয়া কি করো ?

— মা আসেন, দরজা তো খোলা আছে । ভিতরে আসেন ।

— কইতাছি বেলা অইছে রানতে যাও না ক্যা ? খালি কি হুইয়াই থাকবা ? খাওন লাগতো না ?

— ক্যা ? অনু রানতো ক্যা ? বুয়া আছে না ? লীমা আছে না ? হেগো কন রানতে । দ্যাহেন না অনুর শইলডা ভালা না ? রানতো গেলেই বমি করে ।

— হেইডাই তো কইতে চাই তোমারে , অসুক্কা মাইয়া রে বউ এর বাপে কোন আক্কলে বিয়া দিছে ?

—অসুক্কা মানে ? বাচ্চা প্যাডো থাকা মানে কি অসুক্কা ? এই সময় এমন তো লাগবোই । মা আমনে জানেন না ? আর সীমারে তো আমনে এই সময় কত আদর করছেন । আমিও তো কত আদর করছি সীমারে ।

— সীমার লগে তুলনা করো ? কি কই তোমারে মারুফ বুঝ না ক্যা ? তোমার বউ, বাচ্চা প্যাডো লইয়াই বিয়া বইছে । বউ এর বাপে তোমার লারো তারে গছায় দিছে ।

— মা ! এগুলো কি বলেন আপনি ? আপনার কি মাথা ঠিক আছে ? এত বড় অপবাদ কেনো দিচ্ছেন আমাকে ? খবরদার ! আমর সন্তান নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বলবেন না আপনি । অনেক সহ্য করেছি আপনার অত্যাচার । কিন্তু , আর না ।

— মারুফ, আপনি কিছু বলেন না কেনো ? এত বড় কথা বলল, আর আপনি চুপ করে আছেন !

— আমনে মা এ গুলান ক্যান কইতাছেন ? কী সমস্যা আমনের ? কী চান আমনে কন তো ?

— আমি একা কই না, সবতেই কইতাছে এই কতা । বড় বউই তো কইল এই কতা : বিয়ার লগে লগে কারও বাচ্চা প্যাডো আহে না । বাচ্চা বিয়ার আগেই ধরছে । আর এই লাইগ্গা তোমার দারে বিয়া দিছে বুঝছো ।

— মা , আমনে কি কইতাছেন বুইঝা কন তো ? আমনে কি হাসা কইতাছেন ?

— তয় কি আমি, বড় বউ মিছা কতা কই ? আমরা এহন পর তোমার ? দুই দিন অইছে বিয়া করছ, অহন বউ সত্য অইয়া গ্যাছে ? আর আমরা মিথ্যুক ?

মায়ের কথা শুনে মারুফ চেহারার রং পাল্টে গেল । মুহুর্তেই তার চেহারায় সেই আগের মারুফকে দেখতে পেল অনু ।

—অনু, তোমার ব্যাগ রেডি করো । আমি গাড়ি নিয়া আহি । এহনি ঢাকা যামু আমরা ।তোমারে তোমার বাপ-মার কাছে দিয়া আসমু ।

— শোনেন আমার কথা, আমাদের বিয়ের দুই মাস পার হয়ে গেছে বাচ্চা পেটে আসা কি অস্বাভাবিক ? আপনি কি ওদের কথা বিশ্বাস করেছেন ? শুধু এটুকু বলেন । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, প্লিজ বলেন ।

— তোমারে যা বলছি তাই করো , বেশি কথা বাড়ানো দরকার নাই । আমার মাথা বিগরানোর আগে চলো তোমারে দিয়া আহি ।

ও আল্লাহ্ এ আমার কি সর্বনাশ হলো ! আমি কি করব এখন ? কীভাবে বিশ্বাস করাব তারে যে, এগুলো সব মিথ্যে । আমি কোনো পাপ করি নি । আমার সন্তান পবিত্র । মারুফই তার বাবা। আমাকে কোনোদিন এ কথা শুনতে হবে কল্পনাও করতে পারি নি । আমার তো আর কিছু রইল না । আমার মরা উচিত । এত বড় অপবাদ নিয়ে আমার বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না ।

অনু ঘরের দড়জা বন্ধ করে আলনা থেকে তার একটা সুতির শাড়ি নিল । বিছানায় উঠে শাড়িটা প্যাঁচিয়ে সিলিং ফ্যান এর সাথে আটকে ফাঁসি নেয়ার ব্যবস্হা করল । কিন্তু, হঠাৎ তার মন কেমন করে উঠল । আত্মহত্যা তো মহাপাপ । আমি আল্লাহ্ কে এত ভালোবাসি, অথচ শেষ পর্যন্ত জাহান্নামে যাব ? আচ্ছা, কেনো আমি মরতে চাচ্ছি ? যে মানুষটা মায়ের কথায় নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে, তার জন্য মরবো ! আর আমার সন্তান ? সে কি দোষ করেছে ? আমার এভাবে মরে যাওয়া মানে প্রমান হবে আমি দোষি । কিন্তু, আমি তো কোনো দোষ করি নি । কেনো মরব আমি ? মোটেই না । আমি আমার সন্তানকে জন্ম দিব । কিন্তু, এই জানোয়ার পরিবারে আর থাকব না । মারুফের মতো একটা অমানুষের সংসার আর আমি করব না ।

ফ্যান থেকে শাড়ি খোলার চেষ্টা করছি , কিন্তু পারছিনা । ফ্যানের সাথে আটকে গেছে । বাধ্য হয়ে শাড়ি রেখে লাগেজ গোছানো শুরু করলাম । আজ কেনো জানি কান্না থামানোর ইচ্ছে করছে না । প্রান ভরে কাঁদি আজকে । এটাই আমার শেষ কান্না হবে । বিয়ের শাড়ি বাদ দিয়ে বাকি কাপড় গুলো নিলাম ।বিয়ের শাড়িটা কে অভিসপ্ত মনে হচ্ছে । থাকুক এটা, মারুফের দ্বিতীয় বিয়েতে কাজে লাগবে । দড়জায় শব্দ পেয়ে অনুর কান্নায় বাধা পড়ল ।মারুফ এসেছে ।

— কই রেডি অইছো ? ফ্যানের দিকে তাকিয়ে প্রায় চেচিয়ে উঠল সে । এইডা তুমি কি করতে গেছো !

— শাড়িটা খুলতে পারছি না, খুলে দেন ।

— ফাঁস লইতে চাইছ ক্যান ? ফ্যান থেকে শাড়ি খুলতে খুলত জিজ্ঞেস করল মারুফ ।

— কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মরতে চেয়েছি । কিন্তু , আর এই কাজ করব না । আমি কেনো মরব ? আমি কি কোনো পাপ করেছি যে মরব ? আমি আমার সন্তান জন্ম দিব । আপনি ঢাকা চলেন । আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন । আল্ট্রাসনোগ্রাম করাব । রিপোর্ট আপনি নিজে চোখে পড়বেন যে, আমার পেটে কতদিনের বচ্চা । তারপর আপনি আসবেন । আর হ্যাঁ, শুধু এটুকুই না আরও প্রমান দিব আপনাকে । পেপারে পড়েছিলাম ঢাকা মেডিকেলে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সন্তানের বাবা কে, তা বের করা যায় । কান খাড়া করে শোনেন : আমি আমর সন্তান ঠিকই জন্ম দিব । পরে ডিএন এ টেস্টের মাধ্যমে প্রমান দিব যে, এটা আপনারই সন্তান । যত টাকাই লাগুক এর জন্য সমস্যা নেই, প্রমান আপনাকে আমি দিবই । কিন্তু, আপনার সাথে আর আমি সংসার করব না । কোনো ভাবেই না ।

— চলেন এবার বের হই, রেডি আমি ।

— আমার একটা কথা হুনবা ?

— না, শুনবো না । যা বলার আমার আব্বু আম্মুর সামনে বলবেন ।

চলবে…

✍? নায়না দিনা