ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-১১

0
4219

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১১
রোকসানা আক্তার

বিকেল তিনটায় নাতাশা পিরোজপুর বাস স্টেশন এসে পৌঁছায়।বাস থেকে নেমে বাবার জন্য কিছু ফল,ভাই-বোনের জন্যে চিপস,চানাচুর, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে নেয়।আর মায়ের জন্যে সন্দেশ।নাতাশার মা সন্দেশ খেতে খুব ভালোবাসেন।
একটা সি.এন.জি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে।বাড়ির উঠোনে সি.এন.জি থামে।নাতাশা সি.এন.জি থেকে নামতেই গ্রামের কিছু মহিলা চিৎকার দিয়ে উঠে।দুপুর না গড়াতে গ্রাম্য মহিলারা একে-অপরের বাড়িতে গল্পগুজবের আসর বসায়।কেউ পুরনো আমলের গীত-পুঁথি তোলে।কেউ মাথায় উঁকুন খোজে।কেউবা পরিবারের কেলেংকারির কথা বলে বুক ভাসিয়ে চোখের পানি ফেলে ইত্যাদি।
নাতাশা সি.এন.জি থেকে মালপএ গুলো বের
ড্রাইভারকে ভাড়াটা দেয়।গ্রামের রুব্বান নাতাশার কাছে দৌড়ে এসে বলে,
-নাতু?ব্যাগগুলা আমার কাছে দে।
নাতাশা মুঁশকি হেসে বলে,
-কেমন আছিস রুব্বান?
-হ ভালা।তুই?
-আলহামদুলিল্লাহ।
-তোর সোয়ামী,হোই,ঝাঁ,ভাইসুর ওরা কেমন আছে?
-উনারাও ভালো আছেন রুব্বান।
-আইচ্ছা আগে ব্যাগগুলা আমার হাতে দে ত। একটু জিরাইয়া ঘরে বইসা কথা কমু।চল।
-আচ্ছা।
রুব্বান নাতাশার গ্রামের বান্ধুবী।তার সাথে নাতাশার শৈশব,কৈশোর কেটেছে।রুব্বানের এখনো বিয়ে হয়নি।বিয়ের জন্যে এসেও সম্বন্ধ বার বার মানুষের খোঁচায় ভেঙ্গে যায়।এই নিয়ে গ্রামে তুমুল ঝড়।না পারছে রুব্বানের মা-বাবা গ্রামের মানুষদের সামলাতে,না পারছে মেয়েকে কিছু বলতে।এমনিতেই মেয়ের মন ছোট।কে জানে কবে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে,আবার যদি নাও বসতে পারে!এ নিয়ে মা-বাবার রাতের ঘুম হারাম।
নাতাশা এক এক করে গ্রামের সবার সাথে সখ্য করে।হাসিমুখে কথা শেষ দেয়।অতঃপর ঘরে ঢুকে নিদ এবং নিতুকে জড়িয়ে ধরে।নিদ,নিতু নাতাশাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।তা দেখে রুব্বান বলে উঠে,
-হইসে তোমগো এত্ত ঢলাঢলি।বইনরে আগে একটখানি রেস্ট নিতে দে।তারপর নাহয় ইচ্ছামতন আদর করিস।
নিদ,নিতু মাথা নাড়ে।নাতাশা তার বাবার ঘরে যায়।নাতাশার বাবা বিছানার উপর শুয়ে আছেন।চোখবুঁজে ঠোঁট দুটোকে নড়চড় করাচ্ছেন।হয়তো,মনে মনে আল্লাহ,সুবহানাল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ছেন।নাতাশা বাবার বালিশের পাশে গিয়ে আলতোভাবে বসে।মাথায় হাত রেখে বলে,
-বাবা তোমার শরীর কেমন আছে?
নাতাশার বাবা নাতাশার কন্ঠধবনি শোনামাএই ছটফট বিছানার উপর পা গেড়ে বসে।আহ্লাদী মুখ করে বলে,
-মা তুই এসছিস?
-হু বাবা।
-কেমন আছিস মা তুই?
-আলহামদুলিল্লাহ, বাবা।
-তোর শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন আছে?
-উনারা ভালো আছেন বাবা।

নাতাশার বাবা দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছেড়ে জোরে নাতাশার মাকে ডাকতে থাকেন।
-কইগো তুমি?দেখে যাও কে এসছে।
নাতাশার মা মাথার ঘোমটা টেনে তড়িঘড়ি রুমে আসে।নাতাশাকে দেখে মুখে ঝিলিক হাসি দেয়।বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নেয়।আর টলমল চোখে বলে,
-নাতাশা!!
নাতাশা বিছানা থেকে উঠে তার মাকে জড়িয়ে ধরে।আর বলে,
-মা তোমাদের দেখতে খুব ইচ্ছে হয়েছে।
-ভালো হয়েছে তুই যে এসছিস।অনেক খুশি আমি মা।তো জামাই বাবাজী কই?সে কি আসে নি?
-মা উনি একটু অফিসের কাজে ব্যস্ত।যখন ফ্রী হবেন তখন ইনসাল্লাহ চলে আসবেন।
-আর কবে!.
এ বলেই নাতাশার মা দৃঢ় দম ছাড়েন যেন অনেক দিনের বেদনা এখনো ফুরোয় নি।বেদনার রেশ এখনো আছে।তাগাদা দিয়ে বলেন,
-মা তুই তোর বাবার সাথে কথা বল।আমি কিছু নিয়ে এসছি।
-আরে মা কিচ্ছু লাগবে না।আমি খেয়ে এসছি।
-আবার মাইয়া কথা কয়!
রুব্বানের হাতে থাকা ফল,চানাচুর,বেনানা ইত্যাদির দিকে ইঙ্গিত করে নাতাশা তার মাকো বলে,
-মা?এই জিনিসগুলো নাও।রুব্বান এগুলা মাকে দে।
-এই নেন খালাম্মা।আপনের মাইয়া জামার বাড়ির মধুর হাড়ি আনছে।হিহিহিহি।
-তুই না রুব্বান!(নাতাশার মা)
-আরেহ খালাম্মা একটু মজাই তো করলাম।
-জানি তা।আর শোন?তুইও আজ বাড়ি যাইস না।নাতাশার সাথে একলগে খাওয়াদাওয়া করবি।মনে থাকবে?
-কিন্তু খালাম্মা বেশিক্ষণ এইহানে থাকলে ত মা বকবে।বাইত এহনো অনেক কাজ পইড়া রইছে।
-আরেহ রাখতো এত্ত কাজ।তোর মাকে আমি সামলামু।
-হু,রুব্বান থাইকা যা।(নাতাশা)
-আইচ্ছা,তুই যেহেতু কইছস তাইলে আর আপওি নাই।
তারপর নাতাশার মা নাতাশাকে টুকিটাকি কিছু খাবার দিয়ে রান্নাঘরে রান্না করতে চলে যান।নাতাশা রুব্বানের সাথে কিছুক্ষণ অব্দি কথা বলে কোহিনুর বেগমকে কল দেয়।
-হ্যালো আসসালাম-ুআলাইকুম, মা?আমি একটু আগে বাড়ি এসে পৌঁছেছি।
-আলহামদুলিল্লাহ। খুশি হলাম।চিন্তায় ছিলাম অনেক।এমনিতে রাস্তায় কোনো সমস্যা হয়নি ত?
-নাহহ, মা।
-শুকরিয়া। তোমার মা, বাবা কেমন আছেন?
-ভালো।
-সবার খেয়াল রাখবা।
-আচ্ছা,মা।
-বাবাকে ওখানে ডাক্তার দেখাবা।
-জ্বী,মা।
-ভালো থেকো তাহলে।মা পরে আবার কল করবো তোমায়।বাসায় তোমার চাচা শ্বশুর এসছেন।
-সমস্যা নেই মা।আপনি উনাকে সময় দিন।
-আচ্ছা।বিদায়
-বিদায়

কিরে?শাশুড়ীর লগে ত তোর হেব্বি মিল!
-হু।দোয়া কর রুব্বান।আমার শাশুড়ী আলহামদুলিল্লাহ লাখে একজন।
-দোয়া করি বনু।

ওদিক দিয়ে,নীর অফিসের ডকুমেন্টস তৈরীতে ল্যাপটপে টাইপিং করছে।বারংবার কল বাজছে নীরের।নীর রিসিভ করছে না।ডলি এক গাল বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটা সোফার উপর ছুড়ে ফেলে,আর ধপাস করে বসে পড়ে।মনে মনে নীরকে একশো টা গাল দিতে থাকে।আর বলে,
-এই ছেলেটা এত্ত খারাপ ক্যান?একটা মানুষ যে এত্তবার কল দিচ্ছে একটু রিসিভ ত করবে?এ’কি কোনো রোবট নাকি কোনো মানব!দাৎ!

নীরের কাজ সম্পূর্ণ হলে মোবাইলটা হাতে নেয়।ডলি কল করেছে।নিজে এখান থেকে আবার কল ব্যাক করে।।
-কেন কল দিয়েছিস,বল!
-তুই কি কোনো মানুষ?ক ত আমারে!
-কেন?
-এইযে এতটা বার কল করছি তুই রিসিভ করলি না!আমি কি এতই তুচ্ছ প্রাণী!?
-তা আবার কেমন কথা ডলি!
ডলি ব্যাঁ ব্যাঁ করে কেদে দেয়।
-আরেহ কান্না করছিস কেন?
-তুই যখন আমার কল রিসিভ করস না,তখন আমার মনটা ছোট হয়ে যায়।চারদিক থেকে কষ্টের কণা জমা হয়ে বুকটা হীম হয়ে যায়।তুই ত বুঝিস না!
-ডলি? আমি কতবার বলবো আমি যখন ব্যস্ত থাকি তখন কল রিসিভ করতে পারি না।।
-আমি এতকিছু জানি না। আমি শুধু জানি তুই আমার কল অনলি রিসিভ করবি.।আর সেটা যখনই হোক অর যে সময়ই হোক!ডু ইউ আন্ডার্সটেন্ড?
-এতটা অধিকার চাচ্ছিস?তুই কি আমার ঘরের বউ নাকি?
-ক’দিন পর ত হয়ে যেতে পারি।জাস্ট নাউ, ওয়েট ফর ইউর এন্সার!
-কিসের এন্সার?
-কালকের এন্সার! আই মিন আমি যে কাল তোকে প্রপোজাল করলাম তার এন্সার।তো এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস এ ব্যাপারে।
নীর চুপ হয়ে থাকে।এরফাঁকে অফিসে ম্যানেজার প্রবেশ করে।নীর ডলিকে কিছু একটা বলে কল কেটে দেয়।
-জ্বী বল, মুহিত?
-স্যার আমাদের কোম্পানির অর্ধেক শতাংশ আয়ের উপর কর ধার্য হয়েছে।আর সেটা মালবী কোম্পানির কারণেই।ওরা আমাদের কোম্পানির আয়ের ব্যাপারে উস্কানিমূলক তথ্য প্রদান করেছে।
-আমি বুঝছি,মুহিত।মালবী কোম্পানি ইদানীং বেশি বাড়াবাড়ি করছে।তার একটা বিহেভ করা উচিত!
-হু,স্যার!আমিও তাই ভাবছি।
তারপর নীর ম্যানেজার মুহিতকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে কথা সম্পূর্ণ করেন।রাত ৮ টায় নীর অফিসে বন্ধ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা করে।
বাসায় এসে রুমে ঢুকতেই চারপাশটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতে থাকে নীরের।নিস্তব্ধ রুমে সামথিং মালপএের অনুপস্থিত আন্দাজ হয় নীরের।
ওয়ারড্রবের উপর থাকা সোফিজটা নেই।সোফিজটা নাতাশার ছিল,সে শখ করে ওয়ারড্রবের উপর রেখেছিল।ড্রেসিং টেবিলের উপর স্কিনের কিছু প্রডাক্টও দেখতে পাচ্ছে না নীর।
নীরের মনে সন্দেহ জমে।সে তড়িঘড়ি ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে।নাতাশার জামাকাপড় রাখা ড্রয়ার টা হাতাতেই চোখদুটো ছানাবড়া। এখানে নাতাশার কাপড়চোপড় গুলোও নেই!তাহলে বাসায় কি কোনো চোর-টোর এসেছে নাকি?যে রুম থেকে অনেকগুলো মাল উধাও!
এসব ভাবনার মাঝে কোহিনুর বেগম নীরের রুমে টোকা মারে।খাল খেচকি দিয়ে বলেন,
-নীর আছিস রুমে?
-হু,মা।ভেতরে আসো।
কোহিনুর বেগম ভেতরে আসেন।নীরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-নীর?নাতাশা চলে গেছে।
নীর খানিক হতভম্ব হয়।জিজ্ঞাসু সূচক বাক্যে বলে,
-কোথায় গেছে?
-তাদের বাড়ি।
-ওহ।
-নাতাশার বাবার শরীর নাকি ভালো না তাই আর কি।
-ওউউ।
-আর তোকে বলারও সময় পায়নি।আমাকে বলেছে তোকে বলে দিতে।
-ভালো।
-তুই কিছু মনে করেছিস?
-নাতো?কেন এ কথা বললে?
-এইযে ভার হয়ে কথা বলছিস!
-বাদ দাও।আর কিছু বলার আছে?
-নাহহ।
-আচ্ছা।তাহলে আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।
এ বলেই নীর বাথরুমের দিকে চলে যায়।কোহিনুর বেগম খানিক্ষন ছেলের দিকে তাকিয়ে চলে আসেন।আর মনে মনে বলেন,
-নাতাশা ভালোই করছে ওকে বলে যায়নি।যার জন্যে তার সময় হয়না, নাতাশাকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি বেড়াতে যায়না।তাকে বলে ও কি!

নীর বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানার উপর বসে।রুমটায় আজ কেন জানি নিষ্প্রাণ অনুভূতি হচ্ছে।কোনো এক প্রাণীর অনুপস্থিতিতে।যাকে এ ক’টা দিন রুমের আশপাশ দেখত,যার পা চলার শব্দ সারা রুম নেচে উঠত,যার কন্ঠধবনির সুর বিরক্তিমাখা মুখটাও কান পেতে শুনতো।আজ সেই মানুষটি নেইই।
নীরকে চারদিক থেকে কেননজানি একাকীত্ব ভর করতে থাকে।নীর কোনোমতে রাতের খাবার শেষ করে রুমে ঢুকতেই বিছানার দিকে তাকায়।হয়তো গতকাল ঠিক এসময় একটা প্রাণী এই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। যার গরম শরীরের আভায় মনটা ক্ষান্ত হয়েছিল।কিন্তু আজ….!!.
নীর যদিও নাতাশার কথা এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে, তবুও এমন ভাবনা তার মনটাকে ঘিরে ধরে।
অতঃপর নীর শোবার জন্যে বিছানায় আর পা বাড়ায়নি।সোফার উপরই শুয়ে পড়ে।

নাতাশা রুব্বানের সাথে গল্প শুরু করে দিয়েছে।তাতে ভাগ নীতু এবং নিদের।
রুব্বান হুট করে বলে উঠে,
-দুলাভাইকে তোর কেমন লাগে রে?
নাতাশা চুপ হয়ে যায়।চোখগুলোতে পিটপিট ভাব এনে হাই তুলতে তুলতে বলে,
-এই আর কি ভালো।
-দোস?যহন ওর নানির বাইত আইছিলো,ছেমরা রে ত আমার কাছে সেই লাগছিল।সালা একটা লাল আপেল।এত্ত সুন্দর।আর সেই লাল আপেল তোর সোয়ামী,মানে এহন আমার দুলাভাই।ভাবতেই পুরা শরীল কাঁটা দিয়া উঠে।
পাশ থেকে নিতু বলে উঠে,
-আপু জানো?বিয়ের পরদিন ভাইয়াকে আমরা দেখতে পাই নি।কত আশা নিয়ে গিয়েছিলাম।ভাবছিলাম ভাইয়ার সাথে মজা করবো,আড্ডা দিবো,আড্ডার আমেজে আচার,চাটনি,চকোলেট খাবো।কিন্তু…
নিতু মুখে ফোলা ভাব এনে মনটা খারাপ করে ফেলে।নাতাশা তা লক্ষ করে মুঁচকি হেঁসে বলে,
-নিতু?আমাকে না তোর ডগ দেখাবি?এখনও যে দেখালি না?
-ওহ,, হ্যাঁ হ্যাঁ আপু দেখাচ্ছি।বসো।
লাফ মেরে নিতু অন্যঘরে চলে যায় ডগ আনতে।

চলবে….