ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-১০

0
4049

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১০
রোকসানা আক্তার

সকালে নীর কোটের টাই ঠিক করতে করতে হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলায়।অফিসের তাড়ায় বিছানার উপর শার্ট,প্যান্ট, গেন্জি সব ছড়িয়ে রেখে দেয়।ওসব ঠিকঠাক জায়গায় রাখার হুঁশ নেই নীরের।নাতাশা বিছানার উপর এমন বিশৃঙ্খল দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়।মুখে বিরক্তি ছাপ এনে দাঁতগুলো কটমটাতে থাকে।খচখচ গলায় বলে,
-বাসায় কি জামাকাপড় গোছগাছ করার জন্যে মাইনে চাকরানী ঠিক করা আছে নাকি?

নীর আগের দৃষ্টি বজায় রেখে বলে,
-কালকের যত্ন মনে হয় বেশ কাজে হয়েছে।এজন্যে গাঁয়ে এখন প্রবল জোর।
নাতাশা এবার খুব ক্ষেপে উঠে।সামথিং মুখে বুলি গাথলেই যে জোর বেড়ে যায় এমনত না।অসহ্যকর মানুষের অসহ্যকর কথাবার্তা। নাতাশা মুহূর্তে না দাঁড়িয়ে থেকে হনহন বাইরে চলে যায়।নীর নাতাশার রাগ বুঝতে পেরে মুখে হাসি টানে।
নাতাশা সোফার উপর বসে।কোহিনুর বেগম নাতাশাকে দেখে কাছে আসে।কপালের সিদ্ধি ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
-নাতাশা?জ্বর এখন কেমন?
-জ্বী মা ভালো।
-এরকম তাপমাত্রা ভালো ঠেকছে না।ক্ষণিকে শরীর কাঠপোড়া,আবার ক্ষণিকে হীম শীতল।ভালো কোনো ডাক্তার দেখাতে হবে।
-আরেহ মা নাহ নাহ!প্রেসক্রিপশনের ঔষুধগুলো রেগুলার খেলে জ্বর সেরে যাবে।আর মা ওই ব্যাপারে কি কিছু ভেবেছেন?
-কোন ব্যাপারে?
-ওইযে বাড়িতে…!
-ওহ তোমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা?
-হু।
-নাতাশা আসলে নীরের নাকি অফিসে খুব ব্যস্ত।তাই ভাবলাম ক’দিন পর যদি যেতে তাহলে আর-কি ভালো হত।
-মা?উনি যদি না যেতে চায় তাহলে আমিই যাবো।কারণ,মায়ের জন্যে,অসুস্থ বাবার জন্যে ভীষণ মায়া হচ্ছে।হুট করে কাউকে দেখার তীব্র ইচ্ছেটা রিজেক্ট হলে মনকে সায় দেওয়া যায় না।এমনকি পরেও যেতে ইচ্ছে করবে না।
-হু, বুঝলাম আমি তা।যখন যেটা ইচ্ছে হয় তখন খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক।আচ্ছা আমি নীরের সাথে আবার কথা বলে দেখবো।
-নাহ মা লাগবে না।আমি একাই যেতে পারবো।
কোহিনুর বেগম চুপ হয়ে যান।নিহান ড্রাইনিং-এ এসে বসে।তার একটুপর নীরও।নিহান নাতাশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-নাতাশা তোমার শরীর কেমন আছে?
-জ্বী ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ।
-হু।আসো একসাথে নাস্তা করি সবাই।
নাতাশা ড্রাইনিং এ ভালো করে তাকিয়ে দেখে শিরিন শাহ এবং ফাহাদ এখনো নাস্তা করতে আসেনি।নাতাশা হাই তুলতে তুলতে বলে,
-ভাইয়া,ভাবী এবং ফাহাদ কি নাস্তা করবে না?
-তোমার ভাবী?হা হা হা হা..সে এখনো ঘুমচ্ছে।খুব নাকি মাথাব্যথা করছে।
-ওউ আচ্ছা।আর ফাহাদ?
-সে বাথরুমে।
রহিমা খাতুন চা-নাস্তা টেবিলের উপর এক এক করে দিয়ে যায়।নাস্তা শেষ করে নীর অফিসে চলে যায়।
নাতাশা রুমে এসে রুমটা গোছগাছ করতে থাকে।নীরের শার্ট,প্যান্ট,গেন্জি সব ঠিকঠাক মতো রেখে মনে মনে বকতে থাকে।গোছগাছ শেষ হলে নাতাশা বেলকনিতে দাড়ায়।চারপাশের পরিবেশটা আনমনে দেখতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর কোহিনূর বেগম ভেতরে ঢুকে নাতাশার কাছে আসেন।নাতাশার দিকে উনার ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
-নাতাশা?তোমার মা কল দিয়েছে?কথা বলো।

নাতাশা কোহিনুর বেগমের থেকে ফোনটি হাতে তুলে নেয়।কোহিনুর বেগম রুম থেকে চলে যান।নাতাশা কানের কাছে ফোনটা গুঁজে “হ্যালো” বলে।ওপাশ থেকে নাতাশার মা কাঁদো মুখে বলেন,
-নাতাশা?তোর বাবার শরীরটা ভালো ঠেকছে না।মা যদি একটু জামাইকে সঙ্গে নিয়ে এসে যেতি তোর বাবা খুব খুশি হতেন।কাল থেকে শুধু তোর কথাই বলতেছে তোকে একফাঁক দেখতে।

নাতাশার সারা শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যায়।মনে ধীরস্থির ভাব এনে বলে,
-মা বাবার কি হয়েছে?
-জানি না মা।কেমন জানি ছটফটানি ভাব। উওেজিত হয়ে বারংবার তোর কথাই বলে।তোর স্বামীর যদি আসার সময় না হয় তাহলে মা তুই তোর শাশুড়ীর সাথে কথা বলে আজই চলে আয়।
পাশ থেকে নিদ বলে উঠে,
-হ্যাঁ আপু চলে এসো।
নাতাশা নিজেকে সায় দিতে না পেরে তার মাকে বলে,
-মা,আমি আজই আসছি।বিশ্বাস করো মা বাবাকে দেখার জন্যে মনটা খা খা করেছিল।

কথা শেষ করেই নাতাশা তার শাশুড়ীর কাছে যায়।ফোন হাতে দিতে দিতে বলে,
-মা আমার বাড়ি যেতে হবে।বাবার শরীরটা নাকি খুব অসুস্থ।
-অসুস্থ হলে বলো ঢাকায় নিয়ে আসতে।এখানে ভালো ডাক্তার দেখানো যাবে।গ্রামে ভালো কোনো চিকিৎসাও নেই।
-মা,এখন বাবা আসবেন না।তাছাড়া বাবার গাড়ির জার্নি প্রেসার বেড়ে যায়।নির্মল শ্যামলে নীরবে কাটবে শরীরটাও ভালো থাকবে। হয়ত আমাকে ক’দিন না দেখতে পেয়ে মনের অস্বস্তিতে শরীরটা অসুস্থ হয়ে গেছে।বাবা আমায় কখনো একা ছাড়েন না।আমি নিজেও জানি না বাবা এ ক’দিন আমায় না দেখতে পেয়ে কেমন আছেন!প্লিজজ মা বারণ করবেন না।

কোহিনুর বেগম নাতাশার দিকে ভালোভাবে পরখ করে বুঝতে পারেন নাতাশার চোখ,গাল,নাকের ঢগা লাক হয়ে গেছে।মেয়ে তার বাবাকে খুবই ভালোবাসে।কোনোমতে আর বারণ করতে পারেননি আশ্বাস দিয়ে বলেন,
-আচ্ছা যাস।তবে,গাড়ি একটা নিহান এবং একটা নীর নিয়ে গেছে।যাওয়াটাই তো মুশকিল।
-মা আমি আমি বাসে যাবো।
-চিনতে পারবি?
-মোবাইলে লোকেশন দেখে দেখে চলে যাবো।আর যদি ভালোভাবে না চিনতে পারি তাহলে লোকদের জিজ্ঞেস কর জেনে নিবো।
-নাহ নাহ বউমা তার দরকার নেই।আমি তোমার সাথে নজির ভাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
পরক্ষণে কোহিনুর বেগম মিশিতাকে ডেকে আনেন।
-খালাম্মা ক্যান ডাকছেন?
-নজির ভাইকে একটু ডেকে আনতো?
-আইচ্ছা খালাম্মা।
নজির পাইপ দিয়ে ফুলগাছে পানি দিচ্ছিল।মিশিতা নজিরের সামনে গিয়ে বলে,
-চাচা?খালাম্মা কইছে একটু যাইতেন।

নজির ফুলগাছে ব্যস্তমনে পানি দিচ্ছে।মিশিতার কথায় কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ না করে নিজমনে পানিই দিচ্ছে।
-কি হইলো চাচা,শুনবার পারসেন?
নজির এবার খেঁকখেঁক করে বলে উঠে,
-বিরক্ত করিস না তো।দেখবারই তো পারছিস ফুলগাছে পানি দিতাছি।
-চাচা?খালাম্মা কইছে এহনই যাইতেন।
-পারুম না।আপারে যাইয়া কইস আমি আমড়া পোলের ওখান থাইকা এককাপ চা খাইয়া হ্যারপর যামু।যা!

মিশিতা বিরক্তি ভাব নিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রাখে।আর পেছন ঘুরে চলে আসতে আসতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
-এই একনাগাইড়্রা মানুষ গুলা হুতুমের হাড্ডিসার।এগুলারে দিয়া কোনো কামই হয় না।এগুলা না হুনে মালিকদের কথা,না হুনে অন্যের কথা।কিন্তু মাস শেষে বেতনের লাইগা জলদি হাত পাইতা রাখে!
মিশিতা ভেতরে ঢুকে কোহিনুরকে বলে,
-খালাম্মা, নজির চাচা পরে নাকি আইবেন।
-কেন?
-আমড়া পোলের ওইহানে চা খাইতে যাইবেন।
-উফস!এই নজির ভাইকে নিয়া আর পারছি।নিজের যখন যেটা মন চায় সেটাই করে।দাৎ।
কোহিনুর বেগম কিচেনে চলে যায়।নাতাশা বিছানার উপর বসে বসে জামাকাপড় ব্যাগে ঢুকচ্ছে।রহিমা পাশে দাড়িয়ে বলে,
-আপা, আপনে চইলা যাইবেন খুব মায়া লাগতাছে।আবার কবে আহিবেন আপা?
-তা বলতে পারছি না। কপালের ললাট –দেখি কি হয়!
-আপনের কথা বুঝবার পারলাম না আপা,আবার কন।
-কিছু না।আচ্ছা একটু কষ্ট করে বেলকনি থেকে যদি আমার তোয়ালে টা এনে দিতেন।
-সমস্যা নাই আপা,সমস্যা নাই। আইনা দিতাছি।

নজির চা শেষ করে মুখে একগাল পান ফুরে ভতর ভতর পানের চিপটি পালাতে থাকে।দোকানদারকে দশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বলে,
-করিম ভাই?এই নেন দশ টাহা।
দোকানদার করিম দশ টাকা হাতে নিয়ে ভড়কে যায়।কটু দৃষ্টি দিয়ে বলে,
-কি ভাই?এইটা তো চায়ের টাকা দিলা। আর পানের টাকা কই?
-আরেহ ভাই, এহন রাহো ত।পরে দিয়া দিমু।
-এইরকম আর ক’দিন।ভাড়াতে ভাড়াতে তিনশো টাকার মতো দেনা করছো তা দেবারই তো খবর নাই।
-আরেহ মিয়া এত কথা কও কা।রাহো ত।পরে দিয়া দিমু সব।গেলাম।
নজির দোকানদার করিমকে পাস কেটে চলে আসে।
বাসায় এসে গলা ছেড়ে কোহিনুর বেগমকে ডাকতে থাকে।কোহিনুর বেগম চোখের চশমা ঠিক করে সামনে এসে বলে,
-আপনাকে এখন একটু যাএাবাড়ি যেতে হবে।
-যাএাবাড়ি যাইতে হবে!আপা কেহ আইবো টাইবো নাকি?
-না, যাবে।
-কে?
– আমার ছোট বউমা।
-নাতাশা মা?
-হু।
-হঠাৎ বাড়ি যাইবে?
-নাতাশার বাবার শরীরটা খারাপ।তাই।
-ওহ আইচ্ছা।
নাতাশা ব্যাগ নিয়ে নিচে আসে।কোহিনুর বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-মা আমি এসছি।
-একটু এদিকে আয় নাতাশা?
কোহিনুর বেগম নাতাশার হাত টেনে নিজের রুমে নিয়ে যান।আর নাতাশার হাতের মুঠির মধ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন,
-কিছুতো কিনে দিতে পারি নি।মা তুমি পিরোজপুর নামার পরই বাসার জন্যে কিছু ফল-মিষ্টি কিনে নিও।হু?
-কিন্তু টাকাটা দেওয়ার কি দরকার ছিল!
-সমস্যা নেই মা।নাও।দেরী করো না লেট হয়ে যাচ্ছে।

কথা শেষ করেই বাহিরে বেরিয়ে যান কোহিনুর বেগম।নজিরকে বলেন,
-নাতাশাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিন।
-আইচ্ছা আপা।আহেন মামণি।
নাতাশার হাত থেকে ব্যাগটা এগিয়ে নেন নজির।নাতাশা নজিরের পেছন পেছন হাঁটা ধরে।কোহিনুর বেগমও আসছেন পিছু পিছু।কোহিনুর বেগমের চোখে পাবি চলে আসে।নাতাশাকে আজ বিদায় দিতে উনার কেনজানি বুকটা ভারি হয়ে যাচ্ছে।টলমল চোখের পানি চোখের কোটরে আসতেই চশমার ফাঁক দিয়ে তড়িঘড়ি কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নেন।গেইটের বাহিরে নাতাশা পা রাখতেই পেছনের দিকে ঘুরে তাকায়।মুখে স্মিতভাব এনে বলে,
-মা চলে যাচ্ছি।আপনার খেয়াল রাখবেন।ওষুধপাতি ঠিকমতো খাবেন।
-আচ্ছা মা টেনশন নিও না,খাবো।
-আর মা আপনার ছেলেকে বলে দিয়েন যে আমি চলে যাচ্ছি।
-হ্যা নাতাশা বলবো।
এরইমধ্যে নজির একটা সি.এন.জি রিজার্ভ করে নেয়।নাতাশাকে সি.এন.জি তে উঠে জানলার ফাঁক দিয়ে গেইটের দিকে তাকায়।কোহিনুর বেগম এখনো দাড়িয়ে আছেন সি.এন.জি এর দিকে তাকিয়ে।নাতাশা হাত দিয়ে “বিদায়” শব্দ বলতেই সি.এন.জি স্টার্ট হয়ে যায়।কোহিনুর বেগম ভারাক্রান্ত মনে নাতাশাকে বিদেয় দিয়ে গেইট বন্ধ করে বাড়ির দিকে চল যান।

চলবে..