#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১৮|
রাত হয়ে গেছে।হসপিটাল নীরব,নিস্তব্ধ লাগছে।রীতি তখনো বেঞ্চির উপর কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে।সাদিব ওর সামনে এসে ওয়ান টাইম চায়ের গ্লাস ধরলো।চায়ের উত্তাপ রীতির মুখে পৌছাতেই রীতি কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো।তারপর সাদিবের দিকে তাকালো।সাদিব চায়ের দিকে ইশারা করে বললো,
—-“চা টা খাও ভালো লাগবে।”
রীতি চায়ের দিকে চেয়ে দেখে ধোঁয়া উড়ছে।রীতির এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না।এখনো ডাক্তাররা কিছু বলছেনা।রীতি সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে।পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর অদ্ভুত শব্দগুলো জানান দিচ্ছে ওর ক্ষুধা পেয়েছে।কিন্তু রীতির এখন কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না।বাবার একটা ভালো খবর না পেলে মুখে কিছু রুচবেনা।
রিমনের দিকে চেয়ে দেখে রিমনের হাতে বিরয়ানীর প্যাকেট।রিমন নিজের মতো করে খাচ্ছে।বাচ্চা ছেলে নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
—–“আমি চা খাবোনা।ভালো লাগছেনা।নিয়ে যান প্লিজ।”
সাদিব চায়ের কাপ সরিয়ে রীতির পাশে বসে বললো,
—-“তোমার বাবা ঠিক হয়ে যাবে।সেই সকালে খেয়েছো।সারাদিন না খেয়ে আছো।আন্টিও না খেয়ে আছে।এভাবে না খেয়ে থাকলে দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়বে।তখন মায়ের খেয়াল রাখবে নাকি বাবার?আমি তোমাদের জন্য খাবার এনেছি।আন্টিকে নিয়ে খেয়ে নেও।”
তখনই এক ডাক্তার এগিয়ে এলেন।সেদিকে চোখ পড়তেই রীতি উঠে এগিয়ে গেলো।সাদিবও রীতির পেছনে পেছনে গেলো।
সবাই হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
রীতির বড় মামা জিজ্ঞেস করলো,
—-“ডক্তর কি খবর?”
ডক্তর মুচকি হেসে বললো,
—-“উনি এখন ভালো আছেন।কিছুদিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।অতিরিক্ত স্ট্রেস এর জন্য এমন হয়েছে।আপনারা খেয়াল রাখবেন রোগী যাতে কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন না করে।কিছুদিন রেস্টে থাকতে হবে।আগামীকাল বিকেল কিংবা আগামী পরশু রিলিজ দিয়ে দেওয়া হবে।”
রীতির ছোট মামা বললো,
—–“জ্বি ধন্যবাদ।”
সাদিব রীতির দিকে তাকালো রীতির মুখে হাসি ফুটেছে।রীতির বড় দুই মামা সব ব্যবস্থা করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।আগামীকাল সকালে আসবে বলে জানিয়ে গেলেন।রীতির ছোট মামা থাকবেন।
সাদিব রীতিকে বললো,
—-“রীতি তোমার বাসায় চলে যাওয়া উচিত।”
রীতি অনেকটা চমকে সাদিবের দিকে তাকালো।
তারপর বললো,
—-“আপনার মাথা ঠিক আছে তো?আমার বাবা অসুস্থ আর আমি বাবাকে ছেড়ে বাড়িতে চলে যাবো?”
রীতির কথা শুনে সাদিব চুপ করে গেলো।রীতির ছোট মামা বললো,
—-“রীতি ও তো ঠিকই বলেছে।দুলাভাই এখন ভালো আছে।তুই সেই সকালে বেড়িয়েছিস।পরীক্ষা দিয়ে না খেয়ে দেয়ে এখানে বসে আছিস।অসুস্থ হয়ে পড়বিনা?আর তাছাড়া পরশু দিন তোর পরীক্ষা না?অসুস্থ হয়ে পড়লে পরীক্ষা কি করে দিবি?”
—-“মামা এক বছর পরীক্ষা না দিলে কিছু হবেনা।”
—-“এই যে বোকার মতো কথা বলছে।তোর কথাগুলো শুনে দুলাভাই খুশি হবে?ভুলে গেছিস দুলাভাইয়ের স্বপ্নের কথা? দুলাভাই তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে।তোর কি উচিত না তার স্বপ্ন পূরণ করা?এখন বাড়িতে যা রেস্ট নে।খাওয়াদাওয়া কর।আগামীকাল আবার আসবি সমস্যা কি?আজ আমি আর আপা থাকছি।তুই আর রিমন চলে যা।”
রীতির মা রীতির মায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো,
—-“হ্যা রীতি তোর মামা ঠিক বলছে।বাড়িতে চলে যা।সকাল বেলায় চলে আসিস।”
তারপর সাদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“বাবা তুমি একটু কষ্ট করে ওদের নিয়ে যাবে?”
সাদিব স্নিগ্ধ হেসে বললো,
—-“অবশ্যই কেনো নয় আন্টি।”
রীতির মামা বেশ ভরসা পেলেন না।এই রাতে ইয়াং একটা ছেলের হাতে ভাগ্নীকে ছাড়তে নারাজ।কিন্তু সেটা তো মুখে প্রকাশ করতে পারছেনা।
তাই তিনি দ্রুত বললেন,
—–“না না,ওর কষ্ট করতে হবেনা।আমি দিয়ে আসবো।আর তাছাড়া আমি তো যাচ্ছিই।”
রীতির মা রীতির মামাকে বললো,
—-“তুই কেনো যাবি?”
—-“আপা ঘুমানোর জন্য টুকটাক জিনিস বাড়ি থেকেই আনতে হবে।আমি ওদের দিয়ে আসি আর জিনিসপত্র নিয়ে আসি।”
—-“আচ্ছা তাহলে যা।”
রীতির মামা রীতি,রিমন,সাথে সাদিবসহ বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলো।
ফ্ল্যাটে ঢুকতেই কিছুক্ষণ পর দিয়া,দিয়ার মা,সাবিহা,সাবিহার মা,আরো বাসিন্দা সবাই চলে এসেছে ওর বাবার খবর জানার জন্য।দিয়ার মা দিয়াকে দিয়ে খাবার পাঠিয়েছে।মামার জোরাজোরিতে খেয়ে নিলো রীতি।রিমন ঘুমানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ছে।রীতি মামাকে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে।
রীতি জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে বললো,
—–“মামা তুমি আমাকে সাদিব ভাইয়ার সাথে একা ছাড়তে চাওনি তাই এসেছো তাইনা?এসব শুধুমাত্র বাহানা।”
ওর মামা রীতির কথা শুনে রীতির দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললো,
—-“ইন্টিলিজেন্ট গার্ল।ঠিক তাই।একটা ছেলের সাথে একা তোকে ছেড়ে দেবো পাগল নাকি।”
—-“বাট মামা উনি খুব ভালো,ভদ্র একটা ছেলে।সবাইকে খুব হেল্প করে।সবাইকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে।সবার বিপদে ঝাপিয়ে পড়ে।উনাকে নিয়ে একদম টেনশন করোনা।”
সাদিব দরজায় টুকা দিলো।সাথে দিয়া।রীতি আর রীতির মামা দুজনে ঘুরে তাকালো টুকা দেওয়ার শব্দে।
রীতির মামা ওদের দেখে মুচকি হেসে বললো,
—–“আরে তোমরা এসো।”
সাদিব ভেতরে ঢুকে মাথা চুলকে বললো,
—-“আপনাকে কি বলে সম্ভোধন করবো বুঝতে পারছিনা।রিমনকে ভাইয়ের মতো দেখি তাই আপনাকে মামাই বলছি।আপনি কি মাইন্ড করবেন?”
রীতির মামা শব্দ করে হেসে বললো,
—-“আরে নো প্রব্লেম।মামাই বলো আই ডোন্ট মাইন্ড।”
সাদিব সংকোচ ঝেড়ে বললো,
—-“আমার মনে হচ্ছে একা এখানে রীতি আর রিমনের থাকা উচিত নয়।ওরা একা ভয় পেতে পারে কিংবা কোনো বিপদ হতে পারে।একা দুজনের থাকা রিক্স হয়ে যাচ্ছে না?”
রীতির মামা চিন্তিত ভংগীতে বললো,
—–“তুমি কথাটা ঠিক বলেছো।তাহলে উপায়?”
সাদিব রীতির দিকে চেয়ে বললো,
—-“রীতি তুমি দিয়ার সাথে থাকবে আজ রাতে।আর রিমনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।আমার সাথে থাকবে।কোনো সমস্যা হবেনা।”
রীতি ওর মামার দিকে তাকালো কি করবে সেটা জানার জন্য।রীতির মামা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—-“ঠিক আছে রীতি তুই দিয়ার সাথে গিয়ে থাক।আর রিমন সাদিবের সাথে থাকুক।রেডি থাকিস সকালে এসে নিয়ে যাবো।কোনো সমস্যা হলে ফোন করিস।”
—-“আচ্ছা মামা তুমি টেনশন নিওনা।”
সাদিব তখন বললো,
—-“আপনার আসতে হবেনা।আমি নিয়ে যাবো।”
.
রীতি দিয়ার সাথে শুয়ে আছে।ওর চোখে ঘুম নেই।ভাবছে বাবার কথা,বাবার স্বপ্নের কথা।কিন্তু রীতি তো তার উল্টো পথে হাটছে।এটা কি ঠিক হচ্ছে?রীতি তো নিজের মন সাদিবকে দিয়ে বসে আছে।যদিও একতরফা,তবুও কি ঠিক হচ্ছে?
“রীতি আপু তোমার যে এতো ইয়াং, স্মার্ট একটা মামা আছে আগে বলো নি তো?”
দিয়ার কথায় রীতি ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো।
তারপর দিয়াকে বললো,
—-“ওই আমার মামা মেরিড।তাও প্রেমের বিয়ে।কিছুদিন আগে একটা পুচকে হয়েছে।একদম চোখ দিবিনা, গেলে দেবো।”
দিয়া ডান হাত দিয়ে দু গালে আলতোভাবে ছুয়ে ছুয়ে দিতে দিতে বললো,
—-“নাউজুবিল্লাহ কি বলো তুমি এসব?আমি তো মামা হিসেবে বলেছি।অন্য কিছু মিন করিনি।ছিহ!ছিহ!”
দিয়া মনে মনে কঠিন ছ্যাকা খেলো।কিছুটা ক্রাশ খেয়েছিলো।
রীতি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো।সারাদিনের ক্লান্তির জন্য চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো।
সকাল বেলায় রেডি হতেই সাবিহা রীতি আর রিমনের জন্য খাবার নিয়ে এলো।
—-“আপু পটাপট খেয়ে নেও।মা পাঠিয়েছে।আর ভাইয়া রেডি কিছুক্ষণ পরেই আসবে।তোমরা নাস্তা করে নেও।”
রীতি আর রিমন খেয়ে নিলো।
তারপর সাদিবের সাথে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।সাদিব খেয়াল করছে রীতি কেমন উদাসীন ভাব দেখাচ্ছে।সাদিবকে কিছুটা এভয়েড করছে।ব্যাপারটা সাদিবের ভালো ঠেকছে না।রীতি কেনো ওর সাথে এমন করছে?
রীতি হসপিটালের সামনে গাড়ি আসতেই দ্রুত নেমে গেলো।ওদের রেখে আগে আগেই হাটা দিলো।সাদিব রীতির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে রিমনের হাত ধরে ভেতরে যাচ্ছে ভাড়া মিটিয়ে।
রীতি ভেতরে গিয়ে দেখে ওর মা ওর বাবার পাশে বসে আছে।ডাক্তার কিছু একটা চেক করছে।রীতি ভেতরে ঢুকে গেলো দ্রুত।ওর বাবার চোখ খোলা।
রীতি ওর বাবার পাশে বসে বললো,
—–“বাবা তুমি কেমন আছো এখন?জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?”
রীতির বাবা হাত তুলে রীতির গালে হাত রেখে বললো,
—–“আমি ঠিক আছি।ভয় পাস না।আমি আমার মেয়েকে সাকসেস না দেখে মরবোনা।আমি আমার দেখা স্বপ্নটা কি ছেড়ে চলে যেতে পারি?আমার মেয়ে অনেক বড় হবে।বড় চাকরি করবে?সবাই আমাকে বলবে ওই দেখো রীতির বাবা যাচ্ছে।আমি তোকে নিয়ে গর্ব করবো।কি পূরণ করবি তো আমার স্বপ্ন?”
রীতি মাথা নাড়িয়ে বললো,হ্যা পূরণ করবো।
তারপর পাশেই সাদিবকে দেখতে পেলো।সাদিবের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো চুপ করে তারপর নিজ মনে ভাবতে লাগলো,
—-“আমি কোন পথে হাটছি?বাবার বিরুদ্ধে যাচ্ছি?আমি বাবার স্বপ্নটা রেখে নিজে অন্য স্বপ্নে মেতে আছি?খুব অন্যায় করছি।আমি আর সে পথে হাটবোনা যে পথে আমার বাবা নেই।যে পথ বাবার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিবে।আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি,খুব।”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-১৯|
“কেনো এতো হারাবার ভয়,কেনো মনে সংশয়?ভালোবেসে তোকে দূরে হারাবো সে তো হবার নয়।”
গানের সুর ভেসে আসছে দূর অজানা থেকে।সাদিব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়ালো বেড থেকে তারপর ফ্রেশ হতে গেলো।।হসপিটালে যেতে হবে।রীতিদের জন্য ওর মা রান্না করেছে।সাদিব যাবে সেসব দিয়ে আসতে।
সাদিবের মা টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার সব গুছিয়ে নিয়েছে।এখন সাদিব আসার পালা।
সাদিব রেডি হয়ে বের হতেই সাদিবের মা বললেন,
—–“সাদিব আমি সব গুছিয়ে রেখেছি।তুই খেয়ে নে।তারপর নিয়ে যা।”
—-“না মা আমি এখন খাবোনা।দেরি হয়ে যাচ্ছে।আমি ওদের লাঞ্চ পৌছে দিয়ে বাড়িতে এসে খাবো।”
—–“না খেয়ে বের হবি।কতটুকু সময় লাগবে?খেয়ে যা কিছুটা।”
সাদিব ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,
—-“মা প্লিজ এসে খাবো।”
সাদিবের মায়ের আর কিছু বলার থাকলোনা।তিনি ছেলের কথা মেনে নিলো।
সাদিব হসপিটালে পৌছে কেবিনে উকি দিলো।রীতি বাবার সাথে গল্প করায় ব্যস্ত।
সাদিব দরজায় টুকা দিলো।সাদিবকে দেখে রীতির মা হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বললো,
—-“এসো বাবা।”
সাদিব ভেতরে ঢুকে রীতির দিকে একবার তাকালো।রীতির সাদিবের সাথে চোখাচোখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
—-“আন্টি মা আপনাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে।”
—-“আরে তোমার মা এসব কেনো করতে গেলো?আমরা বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিতাম।”
সাদিব টিফিন ক্যারিয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো,
—-“কি বলেন আমরা থাকতে আপনারা বাইরের খাবার খাবেন?”
রীতির মা ইতস্তত করে বললো,
—-“তোমাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”
—-“আন্টি এসব বলবেন না।আংকেল অসুস্থ এখন যদি আমরা এগিয়ে না আসি তবে কিসের প্রতিবেশী?আপনারা সংকোচ বোধ করবেন না।”
রীতি খাবারের প্লেট সাজাচ্ছে।সাদিব রিমনের সাথে মজা করছে।রীতির কেনো জানি মনে হচ্ছে সাদিব খেয়ে আসেনি।কিন্তু বলতে পারছেনা।আর নিজে বলতেও চাইছেনা।
তাই রীতি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—–“মা উনাকে সাধা উচিত।খেয়ে এসেছে কিনা।”
রীতির মা রীতির কথা ঠিক মনে করলেন।ছেলেটা এতটা পথ বইয়ে খাবার নিয়ে এসেছে ওদের জন্য।
—–“সাদিব এসো তুমিও বসো আমাদের সাথে।”
—-“না আন্টি সমস্যা নেই।আপনারা খেয়ে নিন।আমি বরং যাই।”
রীতির মা জোর দিয়ে বললেন,
—–“যাই বললে হবেনা আমাদের সাথে খেতে হবে।”
সাদিব মাথা নিচু করে নিচু কন্ঠে বললো,
—-“আমি খেয়ে এসেছি।”
রীতি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাদিব মিথ্যা বলছে।
রীতি চট করে বললো,
—-“আপনি মিথ্যা বলছেন কেনো?মিথ্যা কথা আপনাকে মানায় না।একদমই মিথ্যা বলবেন না।আমাদের সাথে খেতে বসুন।”
শেষের কথাগুলো একটু কড়াভাবে বললো।
সাদিব রীতির কথা ফেলতে পারলোনা।ওদের সাথে খেতে বসে গেলো।রীতির ছোট মামা কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে, কঠিন রহস্যের গন্ধ।
.
রীতির বাবা রীতিকে বারবার বলছে বাড়িতে চলে যেতে।আগামীকাল পরীক্ষা আছে তো।কিন্তু রীতি শুনতে নারাজ।
রীতির বাবা বুঝাচ্ছে ওকে বারবার।
—-“রীতি আজকে আমার রিলিজ দিবেনা।আগামীকাল সকালে আমি বাড়ি যেতে পারবো তার আগে নয়।আগামীকাল তোর পরীক্ষা আছে।বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসো।এখানে থাকতে হবেনা।”
—-“আহ বাবা তুমি পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করোনা।আমি সারাবছর কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছি?প্রচুর পড়াশোনা করেছি।রাতে বাড়িতে গিয়ে একটু পড়লেই হয়ে যাবে।আমি এখন বাড়িতে যাবোনা।”
রীতির বাবা আদুরে গলায় বললো,
—-“মা না ভালো।বাড়িতে গিয়ে একটু পড়ো।আমার আম্মিজান কত ভালো আমার সব কথা শুনে।”
রীতি বাবার কথা শুনে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।রীতির মা ধমক দিয়ে বললো,
—–“তুই এখানে কি করতে থাকবি?তোর কি কাজ এখানে?পরীক্ষা আছে বাড়িতে গিয়ে পড়তে বস।”
রীতি নাক ফুলাচ্ছে।রীতির এভাবে নাক ফুলানো দেখে সাদিবের হাসি পেলো।তবুও হাসিটা আটকে রেখে বললো,
—-“আপনারা কিছু না মনে করলে আমি একটা কথা বলতে চাই।”
রীতির মামার সাদিবকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে।সাদিবকে বললো,
—-“হ্যা হ্যা বলো।তুমি রীতিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছো তো?আমাদের কোনো সমস্যা নেই।”
সাদিব মামার কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,
—–“জ্বি না মামা।আমি রীতিকে নিতে চাইনা।রীতি বাড়িতে গেলেও পড়ায় মন বসাতে পারবেনা।ওর মন এখানেই পড়ে থাকবে।তারচেয়ে ওর এখানেই থাকা ভালো।রীতি তো এখানেই পড়তে পারে।বইপত্র নিয়ে এলেই তো হয়।”
রীতি চমকে গিয়ে সাদিবের দিকে তাকালো।নির্বাক সাদিবের দিকে চেয়ে আছে।
সাদিব রীতিকে বললো,
—-“তুমি চাইলে আমি তোমার বই নিয়ে আসতে পারি।”
রীতি ইতস্তত করে বললো,
—–“আপনি? না না আপনি কেন….”
সাদিব আশ্বাস দিয়ে বললো,
—-“কোনো সমস্যা হবেনা।তোমার কি বই লাগবে বলে দেও।সাবিহা অথবা দিয়াকে দিয়ে তোমার রুম থেকে আনিয়ে নেবো তারপর এখানে নিয়ে আসবো।”
রীতির আইডিয়াটা পছন্দ হলেও রীতি আর সাদিবের হেল্প নিতে চাইছেনা।গতকাল থেকে অনেক করেছে।তাছাড়া রীতি চাইছে সাদিবের থেকে দূরে থাকতে।
রীতির মা বললো,
—–“গতকাল থেকে তুমি অনেক খাটছো আমাদের জন্য।আর কষ্ট করোনা।”
রীতি সাথে সাথে বললো,
—–“মা ঠিক বলেছে।আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা।আমি কিছুক্ষণ পরে গিয়ে নিয়ে আসবো।”
রীতির কথা শুনে সাদিবের মুখটা ছোট হয়ে গেলো।রীতি শুনে এসেছে মুখ ছোট হয়ে যাওয়ার কথা।তখন ভাবতো মুখ আবার ছোট কিভাবে হয় আজ দেখতে পাচ্ছে।সাদিবের মুখটা আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে ছোট লাগছে।
রীতির মামা ব্যাপারটা বুঝে বললো,
—–“সাদিবের যখন সমস্যা নেই,আমাদের আপত্তি করা উচিত নয়।রীতি তোকে যেতে হবেনা।চাবি দে আর কি বই লাগবে বল।কুইক।”
রীতি মামার কথা ফেলতে পারলোনা তাই সাদিবকে দায়িত্ব দিয়ে দিলো।
.
সাদিব সাবিহাকে নিয়ে রীতিদের ফ্ল্যাটের তালা খোলে রীতির রুমে গেলো।প্রথমে রীতির রুমের বাইরে দাড়িয়ে থাকলেও পরবর্তীতে কিছু একটা মনে করে রীতির রুমে গেলো।
সাবিহা রীতির বইয়ের নাম অনুযায়ী সেল্ফে রাখা অসংখ্য বইয়ের সাথে নাম মিলাচ্ছে।
সাবিহা একটা বই টান দিতেই একটা ডায়েরি নিচে পড়ে গেলো।ডায়েরিটা পড়ে খোলে গেলো।সাদিব না চাইতেও ডায়েরির দিকে চোখ গেলো।ডায়েরির পেজটায় কিছু লেখা বাট তার উপর কলমের ঝড় বয়ে গেছে।লেখার উপর কাটাকাটি করেছে।
সাদিব কৌতুহলবশত ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো।ডায়েরিতে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলো তাতে লেখা নামটা রাহি আর আশেপাশে আরো কয়েকটি নাম।
একদম নিচে লেখা ফিনিশড।সাদিবের মাথায় আগাগোড়া কিছু ঢুকছেনা।
ডায়েরি কাত করতেই কয়েক পাতা উল্টে গেলো সেখানে নাম দেখে সাদিবের চোখ কপালে।
সাবিহা আর সাদিবের নাম লেখা আর তার উপর কাটাকাটি করেছে কলম দিয়ে নিচে একই শব্দ লেখা ফিনিশড।
সাদিব মনে মনে ভাবছে হচ্ছেটা কি?এভাবে ওদের নাম কেটেছে কেনো।তারপর মুচকি হাসি দিলো।রীতি হয়তো নিজের রাগ ঝেড়েছে।কিন্তু পরের পাতায় নিজের নাম দেখে আরো একবার চমকে গেলো।গতকালের তারিখ দেওয়া।রীতি বেশ যত্নসহকারে সাদিবের নামের উপর কলম চালিয়েছে।
সাবিহার কথায় সাদিব তাড়াতাড়ি ডায়েরি রেখে দিলো।
সাবিহা বললো,
—-“ভাইয়া নে।এইগুলা নিলেই হবে।”
সাদিব সাবিহার হাত থেকে বইগুলো নিয়ে নিলো।কিন্তু ওর মাথায় একটা কথাই ঘুরছে রীতি ওর নাম কেনো কেটেছে?ওর অপরাধ কি?
.
রীতি বাবার পাশে বসে বসে পড়ছে।সাদিবের আনা বই খোলে বসেছে বাবাকে খুশি করার জন্য।সাদিব রিমনের জন্য ফার্স্ট ফুড থেকে খাবার এনেছে।রিমন বসে তাই গিলছে।বাবা অসুস্থ তাই ওকে এসব খাবার খাওয়া নিয়ে বকা শুনতে হচ্ছে না।
সাদিব রীতির পাশে ফ্রুটোর বোতল রেখে বললো,
—–“মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিও।”
রীতি বই থেকে চোখ সরিয়ে সাদিবের দিকে গভীর দৃষ্টি দিলো।রীতি যতই চাইছে নিজেকে সাদিবের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে আর সাদিব বারবার ওর কাছে আসছে নানান অযুহাতে।সাদিব রীতির দিকে তাকাতেই রীতি চোখ ফিরিয়ে নিলো।গভীর ঝিলের মতো গভীর চোখের দিকে বেশীক্ষণ না তাকিয়ে থাকাই শ্রেয়।
সাদিব রীতিকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে ওর নামের উপর কলমের এতো অত্যাচার কেনো হয়েছিলো কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারছেনা।কারণ সাদিব প্রথমত কারো পারমিশন ছাড়াই ডায়েরিতে হাত দিয়েছে।এটা অনুচিত কাজ।এই অনুচিত কাজের জন্য সাদিব খুবই লজ্জিত।তাই রীতিকে আর জিজ্ঞেস করা হয়না।
সাদিব সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।সাদিব যেতেই রীতির যেনো কেমন ফাকা ফাকা লাগছে।মনে হচ্ছে কি যেনো নেই।রীতির অস্থিরতা যেনো বেড়েই চলেছে।রীতির অস্থিরতা কেউ খেয়াল না করলেও রীতির মামা ঠিকি খেয়াল করলো।
রীতির পাশে এসে বসে বললো,
—-“কিরে ঘটনা কি?বাড়িওয়ালার ছেলে ভাড়াটিয়ার মেয়ের এতো কেয়ার কেনো করছে?”
রীতি হটাৎ করে মামার মুখে এ কথা শুনে চমকে গেলো।মামার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই মামা ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—-“ঘটনা কি?কিছু চলছে নাকি?”
রীতি মামার কথা শুনে নির্বাক হয়ে গেলো।রীতি আমতা আমতা করে বললো,
—–“মামা কি বলছো?উনি সবার প্রতিই কেয়ারফুল।আমরা উনাদের ভাড়াটিয়া তাই উনি এটাকে দায়িত্ব মনে করেন।আর কিছু নয়।তুমি এসব ভাবা বাদ দেও।”
রীতির কথা শুনে রীতির মামা ব্যাপকভাবে হতাশ হলেন।রীতি একবার মামার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে মামা আদো ওর কথা বিশ্বাস করেছে কিনা।রীতির মনে হচ্ছে মামা কনফিউজড।
রীতির মামা রীতির মায়ের সাথে কথা বলছে।
—-“আপা তোমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে সাদিব,ছেলেটা অনেক ভালো।নম্র,ভদ্র।অনেক হেল্প করছে আমাদের।”
রীতির মা মৃদু হেসে বললো,
—-“সাদিব এমনিতেই খুব ভালো।অনেকদিন দেখছি তো।অনেক দায়িত্বশীল।আমার রীতির জন্য যদি এমন একটা ছেলে পেতাম।তাহলে নিশ্চিন্ত হতাম।”
রীতির মামা কিছু একটা ভেবে আলতো করে হাসলো।
সাদিব বাড়িতে ঢুকতেই বাবার গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনলো।সাদিবের বাবা গম্ভীর,রাগী,কিছুটা অহংকারী মানুষ।সাদিব বাবার ডাক শুনে বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালো।
সাদিবের বাবা সোফায় বসে চা খাচ্ছেন।সাদিবকে দেখে বললো,
—-“বসো।”
সাদিব বাবার কথামতো বসলো।
সাদিবের বাবা চায়ের চুমুক শেষ করে বললো,
—-“শুধু অন্যের উপকার করে বেড়ালে হবে?নিজের কথা,নিজের পরিবারের কথা তো ভাবতে হবে।তুমি আমার একমাত্র ছেলে।তোমার তো সব বুঝে নিতে হবে।তোমার অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে।এমবিএ করছো,প্রতিদিন তো আর ক্লাস হয়না।যেদিন অফ থাকে ঘুরে না বেড়িয়ে ব্যবসায়ের কাজ করতে পারো।আমাকে সাহায্য করতে পারো।সামনের মাসে নতুন বাড়ির কাজ ধরবো।আমি আর একা কত।কিছু দায়িত্ব নেও।”
সাদিব নিচু গলায় বললো,
—-“বলো কি করতে হবে?আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”
—-“যাক তাহলে দায়িত্ব নিতে চাইছো।তোমাকে আমি পরে জানিয়ে দেবো কি করতে হবে।তবে অন্যের জন্য নিজের এনার্জি নষ্ট করোনা।অসুস্থ ছিলো হসপিটালে নিয়ে গেছো ঠিক আছে।কিন্তু না খেয়েদেয়ে তাদের সাথে দিনরাত লেগে থাকা কি ঠিক হচ্ছে?”
সাদিব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।এনার্জি নেই শরীরে, ভালো লাগছে না।তাই চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।
.
পরেরদিন সকালে রীতির বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।রীতি গেছে পরীক্ষা দিতে।আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-প্রতিবেশী,কলিগ সবাই একে একে দেখতে আসছে রীতির বাবাকে।
এই কয়েকদিনে সাদিব রীতির ফ্যামিলির অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে।সাদিবও সাথে গিয়েছিলো আনার জন্য।
রীতি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে বাবাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে গেলো।তাড়াতাড়ি ফাইলপত্র রেখে ফ্রেশ না হয়েই বাবার পাশে বসে পড়লো।
রীতির মা রীতিকে বকাবকি করে ফ্রেশ হতে পাঠালো।
রীতি ফ্রেশ হয়ে এসে নিজের চশমা খোজে পাচ্ছেনা।সারা রুমে খুজেও চশমা পাচ্ছেনা।রীতি রুমের বাইরে এসে দেখে সাদিব সোফায় বসে রীতির চশমা নেড়েচেড়ে দেখছে।
রীতি সাদিবের সামনে গিয়ে বললো,
—-“আমার চশমা আপনার কাছে কেনো?চশমা দিন।”
সাদিব উঠে দাড়িয়ে রীতির দিকে চশমা এগিয়ে দিলো।রীতি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেই সাদিব সরিয়ে নেয় চশমা।
রীতি চোখ বড়বড় করে সাদিবের দিকে তাকায়।
সাদিব মুচকি হেসে বললো,
—-“পারলে নিয়ে নেও।”
রীতি বারবার চেষ্টা করেও সাদিবের কাছ থেকে চশমা নিতে পারছেনা।বারবার চেষ্টা করে হতাশ হলো।কিছুতেই চশমা নিতে পারছেনা।
সাদিব রীতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে।রীতি সাদিবের দিকে একবার চেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।
সাদিব পেছনে থেকে বললো,
—-“কি ব্যাপার চশমা নিবেনা?”
রীতি গম্ভীরমুখে বললো,
—–“প্রয়োজন নেই আমার চশমার।আপনি রেখে দিন।”
রীতি নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
সাদিব চশমা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।রীতির কাছ থেকে এমন ব্যবহার একদম আশা করেনি।রীতির অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ উদঘাটন করতে পারছেনা।
“তুই কি গোধূলির মিছিল হবি?
রাঙা আলোয় আমায় রাঙাবি?
তুই কি আমার আধার রাতের সঙ্গী হবি?
আঙুলে আঙুল রেখে শিশির ভেজা
রাতে একাকি পথ চলবি?”
চলবে….!!