বিধ্বস্ত অনুভূতি পর্ব-০২

0
4154

#বিধ্বস্ত_অনুভূতি
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-২

“আপু! ইট দিয়ে পিঠে বাড়ি খেয়েছেন কখনো?স্বামীর বেল্টের আঘাত?ওহ্ আপনার তো এখনো বিয়েই হয়নি।”

বিয়ের প্রায় সতেরো মাস পরের একটি ঘটনা।
তন্দ্রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল, সামনের বাসায় এসেছে এক পিচ্চি মেয়ে। সেই মেয়ে সারাদিন বারান্দায় এসে তন্দ্রাকে ডাকতো।
তন্দ্রা মাঝেমধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ের সাথে জুড়ে দিতো খেজুরে আলাপ।
এমন একদিন বৃষ্টির বিকেলে তন্দ্রা মেয়েটার সাথে কথা বলছিল সাথে বারান্দায় লাগানো টবে পানি দিচ্ছিলো। শাশুড়ি মা নতুন মরিচ গাছ এনেছে সেগুলো লাগাচ্ছে। আলগোছে ওড়না বেধেছিল ঢিলে গেছে। হাতে মাটি তাই সে ওড়না ঠিক করতে পারেনি।বারান্দায় আর কেউ ছিল না।শুধু সামনের ফ্ল্যাটে টুসি।কাজ শেষ করে যখন ফিরে আসবে তখন দেখে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে অনির। চোখে মুখে রাগের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে।
তন্দ্রা তাকিয়ে মুচকি হাসতেই হাত টান দিয়ে ঘরে নিয়ে এলো।
বারান্দায় থেকে একটা আস্ত ইট এনে আঘাত করলো তন্দ্রার পিঠে।একবার নয় দুই বার নয় পুরো তিন বার।
দরজার কাছ থেকে তার ননদ বলছিল,

“বাইরের মানুষরে বুক দেখায় ঘুরে?এত কুড়কুড়ানি?বিয়ের এই কয়দিনেই পরকীয়া শুরু?”

অনির মা বলল,

“আজ থেকে বারান্দায় যাওয়া বন্ধ। তাই তো বলি টুসির লগে এত কিসের খাতির?আরে সব তো ওর মামার সাথে ফষ্টিনষ্টি করার ধান্দা।”

কেউ এগিয়ে এসে ধরলো না।
তন্দ্রা কাটা মুরগির মতো বার দুয়েক
মুখ দিয়ে শব্দ করে জ্ঞান হারায়।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করে।
পিছনের দিকে তার ফুলেছে অনেকটা।
হয়তো হাঁড় ভেংছে?বাবার বাড়ি কল দিতেও দিলো না।
কারণ তারা আগেই দু হাত উপরে তুলেছে।
বিয়ের পর স্বামীর সংসার সব।
প্রথম শাড়ি নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে তন্দ্রা রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যায়। তখন তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই বাড়িতে আসো,দুই চারদিন থাকো তবে চলে যাবা। কেউ যেন জিজ্ঞেস না করতে পারে কয় দিনের জন্য এসেছো?কবে চলে যাবা?এর আগেই চলে যাবা।
স্বামীর অধিকার আছে বউকে শাসন করার। আর একটু আধটু মার ওসব ব্যাপার না।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেই শাশুড়ি আদেশ দিলেন যেন তার মেয়ের রুম জলদি গোছানো হয়ে যায়। কারণ তার সাত মাস পোয়াতি মেয়ে আসবে আজ।
তার সেবা যত্নে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।
নাস্তা বানিয়ে তন্দ্রা নিজ হাতে সব গুছিয়ে রাখলো।
দুপুরের রান্না করে আজ আগ বাড়িয়েই নিজে খেতে বসেছে।
হোক দু একদিন অনিয়ম।
শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত মেখে তেঁতুল দিয়ে খাচ্ছে। ঠিক তখন অনির বোন এবং বোন জামাই এলো।
তাদের আপ্যায়ন করতে করতে হয়তো সবাই ভুলেই গেছে মেয়েটা পোয়াতি।

দুপুরে খাওয়ার পর তন্দ্রাকে তার ননদ স্বামী বিশ্রাম নিতে বললেন। কারণ সেও গর্ভবতী। প্রতি উত্তরে তার শাশুড়ি বললেন,

“এখনকার সব পোলাপান পেট কেটে বের কেন করতে হয় জানো?এই যে এই সময় সারা দিন শুয়ে বসে কাটায় বলে। যদি একটু খেটেখুটে খায় তাহলে ব্যায়াম হয় আর বাচ্চাও সুস্থ থাকে।”

“মা! আপনার মেয়েও তো এক সময় পার করতেছে। আপনি তো তাকে আজ হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন। এই যে বিদুৎ নেই বাতাস করতেছেন আর ভাবীকে বলছেন এই গরমে রান্নাঘরে কাজ করতে?বিষয়টা আপনিই বলুন।”

“মেয়ে আমার কয় মাস পর আজ আসছে! এই সময় একটু সেবাযত্ন না করলে চলবে?তোমার বাড়িতে কি বসে খায়?নিশ্চয়ই না।নিজের কাজ নিজেই করে। এখানে তো একটু আরাম করবেই।”

মুচকি হেসে দু পাশে মাথা দুলায় আফসানার স্বামী শিশির। এরপর বলল,

“আপনার মেয়েকে তার পারসোনাল ডক্টর বেড রেস্ট দিয়েছে। সে হেঁটে গিয়ে আমার বৃদ্ধা মাকে ওষুধ অবধি দেয় না তো নিজের কাজ কী করবে?”

এই কথায় আফসানা বেশ ক্ষেপে উঠেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবে পাল্টে যাচ্ছিলো। এদিকে তন্দ্রা জানে এসবের জন্য তাকেই দায়ী করা হবে।
হলোও তাই। অনির বাড়ি আসতে না আসতেই তার কাছে বিচার চলে গেলো।গমগমে চোখে অনির তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভেতরে যাও।”

“ওমা ও কি কথা?আফসানা একটু কাবাব খেতে চেয়েছে তোর বউয়ের হাতের। এটুক বুঝি আমার মেয়ের জন্য তোর বউ করতে পারবে না?এজন্যই…………

কথা শেষ করার পূর্বে অনির তন্দ্রাকে রান্নাঘরে চলে যেতে বলে। পুরো সময় নীরব দর্শকের মতোন চেয়েছিল শিশির।
এজন্যই কথায় কথায় মানুষ বলে,

” আমার ছেলেটা আর মানুষ হইলো না, সারাদিন বউয়ের আঁচল ধইরা রাখে। শালা হারামী একটা। না হইলে বউয়ের কাপড় শুকাতে নিয়ে যায়?
আর এদিকে আমার মেয়ের জামাইটা সোনার টুকরো ছেলে। কপাল কইরা জামাই পাইছে। যা বলে আমার মেয়ে তাই শোনে।”

বিকেলবেলার এই সময়টা তার মায়ের সাথে কথা বলে তন্দ্রা। বাবা-মা বেঁচে আছেন।নিয়ম করে পুরো দিনে এটুক সময় বড্ড শান্তি পায় তন্দ্রা।

“তন্দ্রা খাইছো?”
“হ্যাঁ মা।”
“শরীলডা এখন কেমন?”
“ভালো মা।”
“জামাই কি এখনো মারধর করে?”

“না মা!প্রতিদিন কেন জিজ্ঞেস করো?”

“মা গো!তোমার গালে ওই থাপ্পড়ের দাগ আমি ভুলবার পাড়ি না।”

“না মা এখন আর মারে না।”
“ডিম, দুধ কিছু কিছু খাইয়ো।না খাইলে বাচ্চার পুষ্টি আসবো কই থেকে?”
“হুম।”

“আমারো ইচ্ছা হয় তোমারে আমার কাছে এনে রাখি। কিন্তু তোমার ছোটভাবীর আট মাস চলে। তারে নিয়াই পারি না।সারাদিন পিছ পিছ ঘুরে। সে তার বাপের বাড়িও যাবে না। তার তো আবার মা নাই।মায়ের আদর আমার কাছ থেকেই পোষায় নেয়। তোমারে আনলে আবার তার ভাগে সময় কম পড়লে সে কান্নাকাটি করব।এই শেষ সময় কী আর এসব করা যায়?তার’চে আল্লাহ্ ভালোয় ভালোয় কিছু দিলে তারপর তোমারে আনবো। তখন সে তার বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো।”

“সমস্যা নেই মা।আমি এখানেই ঠিক আছি।আর তাছাড়া এ সময় আমাকে এই বাড়ি থেকে ছাড়বে তোমার মনে হয়?”

“শোনো মা! শ্বশুরঘরে বৌ মানুষ গাছের মতোন। শিকড় দিয়ে গাছ যেমন মাটিকে আটকে রাখে,তেমন করে মাটি কামড়ে থাকতে হয়। ধৈর্য্য ধরো। সব ঠিক হবে।”

মায়ের শেষ কথাটা তন্দ্রার কানে বাজছে।কথা শেষ করে ফোন রেখে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ডান হাতে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে।
গুনগুনিয়ে গান গায়। হুমায়ূন আহমেদের গান,

“ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই
হাত ভর্তি চান্দের আলো ধরতে গেলে নাই
হাত ইশারায় ডাকে কিন্তু মুখে বলে না
আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না”

আপনমনেই হেসে উঠে তন্দ্রা বলল,

“আর এই শ্বশুরঘরের মাটিই যদি দুই ভাগ হয়ে যায়?তখন শিকড় কোথায় ফেলবো গো মা? কার মাটিই কামড়ে ধরবো?”

চলবে।