কৃষ্ণাবতী পর্ব-১৯+২০

0
1747

#কৃষ্ণাবতী
#১৯ম_পর্ব

– একজন বিবাহিত মেয়ের পক্ষে আপনার এরকম প্রেম নিবেদনের কি উত্তর হতে পারে অর্জুনদা। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বিবাহিত। আমার কাছে এসব কেবলই পাপ।
কয়েক মিনিটের জন্য অর্জুন শান্ত চোখে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তারপর সে খানিকটা এগিয়ে আসে কৃষ্ণার দিকে। তার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় অর্জুন জিজ্ঞেস করে,
– কি বললে?
– আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার পক্ষে
– তুমি বিবাহিত? কথাটার মানে জানো?

কৃষ্ণার ঠোঁট জুড়ে ম্লান হাসি। কথাটার মানে তার ভালো করেই জানা। অর্জুনের কাতর দৃষ্টির বিপরীতে শান্ত দৃষ্টি রেখে মৃদু কন্ঠে বলে,
– আমার সাথে আপনার সম্পর্কটা হয়তো হাসি তামাশার নয়। আমার জীবনের সত্যতা নিয়ে মজা করার মতো মানসিকতা আমার নেই অর্জুনদা। আমি সত্যি ই বিবাহিত৷
– যদি তুমি বিবাহিত হয়ে থাকো তবে নিজেকে কিশোরী সাজিয়ে মানুষের সাথে ছলনা করার কি মানে দাঁড়ায়? আমি যতদূর জানি হিন্দু মেয়েদের বিবাহিত হবার প্রমাণ তার শাখা পলা এবং সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। জানতে পারি কোথায় তোমার সিঁদুর? কোথায় তোমার শাখা পলা?

অর্জুনের গলা কাঁপছে, চোখ জোড়া রক্তবর্ণ হয়ে রয়েছে। রাগে শিরা ফুলে উঠেছে মাথার৷ তার রাগ হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, গলা কাঁপছে তার। বুকে যেনো কেউ ভোঁতা ছুরি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছে। কৃষ্ণাকে ভালোবাসে সেটা অর্জুনের জানা আছে কিন্তু এই ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণা এতোটা প্রখর তা তার জানা ছিলো না। মনে হচ্ছে কেউ তার হৃদয়কে পায়ে পিষিয়ে ফেলছে। মাত্রই তো হৃদয়ের কোনো কোণে ভালোবাসার শুভ্র পুষ্প ফুটেছিলো। অর্জুনের নির্মম প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক কি করে দিবে বুঝে উঠতে পারছে না কৃষ্ণা। যেই মানুষের স্ত্রী হবার দাবি সে করছে সেই মানুষটিই চায় না তাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিতে। মানুষটি স্পষ্ট স্বরে বলে দিয়েছিলো যাতে কলেজের কেউ না জানে সে তার স্ত্রী। কৃষ্ণাকে নির্বাক দেখে আরোও ক্ষিপ্ত হয়ে যায় অর্জুন। কৃষ্ণার বাহুদ্বয় শক্ত করে ধরে অগ্নিকন্ঠে বলে,
– কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো? কেনো নিজের জীবনের এতো বড় সত্যি তুমি লুকিয়েছো? বলো উত্তর চাই আমার৷
-…. ……
– মেয়েরা তো কারোর চাহনী দেখলেই বুঝতে পারে, তুমি কি সত্যি বুঝো নি আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যি তোমার মনে হয় নি আমার মনেও তোমার প্রতি অনুভূতি জন্মাতে পারে। তবে কেনো এরুপ ছলনা করেছো তুমি, আমার যে উত্তর চাই কৃষ্ণাবতী
– আমি উত্তর দিতে বাধ্য নই অর্জুনদা, আপনি আমাকে ছলনাময়ী ভাবলে আমি তাই। তবে আমি কখনোই আপনার সাথে এরুপ কোনো আচারণ করেছি বলে আমার মনে নেই যেই আচারণ এটা নিশ্চিত করে যে আমি আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী।

কৃষ্ণার উত্তরে অর্জুনের মনটা আরোও ভেঙ্গে যায়। কৃষ্ণা একটা কথাও মিথ্যে বলে নি। সে কখনোই অর্জুনকে এটা বলে নি সে তাকে পছন্দ করে কিংবা তার অর্জুনকে ভালোলাগে। যতটুকু পেরেছে অর্জুনের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। কৃষ্ণাকে দোষ দেওয়াটা নিতান্ত বোকামি ব্যাতীত আর কিছুই নয়। অর্জুনের চোখ ছলছল করছে। কোথাও না কোথাও কৃষ্ণার অর্জুনের জন্য বেশ খারাপ লাগছে। সাথে এক রকম অপরাধবোধ হচ্ছে। সত্যি ই তো সে তো সবাইকে বলেছে সে অবিবাহিত। এখানে তার দোষ নেই এমনটা নয়। মাথাটা নিচু করে বিব্রত কন্ঠে অর্জুনকে বলে,
– বিশ্বাস করুন আমি সত্যি বুঝতে পারি নি এমনটা হবে। কাউকে ছলনা করাটা আমার মনসা নয়। গোপাল সাক্ষী আছেন। আমি তার ক্ষতি চাই না, তাই এই সত্যিটা গোপন করেছি। যে মানুষটার কারণে আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি তার ক্ষতি কি করে চাই বলুন তো।
– ভালোবাসো তাকে?

ক্ষুদ্ধ কন্ঠে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় অর্জুন। কৃষ্ণা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অর্জুনের প্রশ্নে। ভালোবাসা শব্দটার মানে কৃষ্ণার জানা নেই, তবে এটুকু সে জানে তার মাষ্টারমশাইকে দেখলে অজানা এক অনুভুতিতে মন কাবু হয়ে পড়ে। মাষ্টারমশাই তার কাছে এলে তার লজ্জায় গাল লাল হয়ে যায়। মাষ্টারমশাই এর মন খারাপ থাকলে তার বুকেও হাহাকার শুরু হয়। সে রাতে যখন মাষ্টারমশাই তাকে কাছে টেনেছিলো সেই অনুভূতি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি ছিলো। যখন কৃষ্ণা জানতে পারে দেবব্রত শুধু ঘোরের মাঝেই তাকে কাছে টেনেছিলো তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। এই অনুভূতিকে যদি ভালোবাসা বলে তবে সে মাষ্টারমশাইকে খুব ভালোবাসে। কৃষ্ণাকে চুপ করে থাকতে দেখে অর্জুন কাতর কন্ঠে বলে,
– বলো না কৃষ্ণাবতী? তুমি কি সে মানুষটাকে ভালোবাসো?
– হয়তো, হয়তো আমি তাকে ভালোবাসি। আসলে কি বলুন তো এতো কঠিন শব্দের অর্থ আমার জানা নেই। তবে আমার কাছে সে আমার পৃথিবী, আমার আপনজন, আমার অর্ধাঙ্গ।

অর্জুনের দৃষ্টি কৃষ্ণাতে স্থির। তার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু পুরুষের যে কাঁদতে নেই। রাগ হচ্ছে, কেনো ওই লোকটার পূর্বে সে কৃষ্ণাকে পায় নি। কেনো বিধাতা এমন করে। অর্জুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে দেবব্রত উপস্থিত হয়। পিছু পিছু সৌদামিনীও এসে উপস্থিত হয় সেখানে। অর্জুন তখনো কৃষ্ণার বাহু ধরে রয়েছিলো। অর্জুনের হাত থেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নেয় কৃষ্ণাকে। দেবব্রতের এরুপ আচারণে খানিকটা ভয় পেয়ে যায় কৃষ্ণা। দেবব্রত লোকটা খুব ই শান্ত। এরকম অস্বাভাবিক আচারণ তার কাছে শোভা পায় না। দেবব্রত এখন যেনো নিজের মাঝেই নেই। তীর্যক অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অর্জুনের দিকে৷ অর্জুনের কেনো যেনো মনে হলো দেবব্রত ই সেই ব্যাক্তি যার জন্য কৃষ্ণার হৃদয় এতোটা কাতর। অর্জুন নিজের ভাগ্যের নির্মমতার উপর বিদ্রুপের হাসি হাসে। দেবব্রত তখন কৃষ্ণার হাত নিজের মুঠোতে শক্ত করে ধরে রয়েছে। এরপর অর্জুন ঠান্ডা গলায় বলে,
– দু নৌকাতে পা দিয়ে কখনোই চলা যায় না দেব দা। যেকোনো একটা নৌকা বেছে নাও। এটা ভেবো না তুমি ভালোবাসো না বলে কেউ তাকে ভালোবাসবে না।

অর্জুন এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেলো। দম আটকে আসছে তার। বাহিরে বেড়োতেই চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। দেবব্রতের বুঝতে বাকি রইলো অর্জুন তাকে মুখের উপর হুমকি দিয়ে গেলো। সে কৃষ্ণাকে চায়। কৃষ্ণাও কি তাকে চায়! দেবব্রতের বুকটা কামড় দিয়ে উঠে, তবে কি হারিয়ে ফেলবে সে কৃষ্ণাকে। কৃষ্ণাকে হারানোর কথা ভাবতেই তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। হাত কাঁপছে তার। কৃষ্ণার দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকাতেই কৃষ্ণা তাকে বলে,
– আমি বাসায় যাবো মাষ্টারমশাই।

দেবব্রত আর কোনো কথা বলে না। কৃষ্ণার কথায় মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় সে কৃষ্ণাকে নিয়ে। চিন্তায় কুচকানো কপাল আবার সতেজ হয়ে উঠে। তার কৃষ্ণা অর্জুনের সাথে যায় নি। বরং তার সাথেই যাচ্ছে। তার বাড়িতে। সৌদামিনীর দৃষ্টি তখন ও দেবব্রতের দিকে। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে হেরে গেছে। কৃষ্ণাবতীর সাদা মনের কাছে সে হেরে গেছে। দেবব্রতের মনে কৃষ্ণাবতী তার নামের সিল বসিয়ে দিয়েছে। এখন সৌদামিনীর হাতে কিছুই নেই। তার নিচে নামতে পারবে না সে। এখন যদি সে দেবকে তার কাছে টানতে যায় এটা শুধু অন্যায় ই হবে না বরং পাপ হবে। এ পাপ যে সৌদামিনী করতে পারে না। কখনোই না________

১৬.
দেয়ালে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কৃষ্ণা। তার সামনে দেবব্রত। দুপাশে হাত দিয়ে কৃষ্ণাকে আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। তার চাহনী কৃষ্ণাতে স্থির। কৃষ্ণার বেশ অস্বস্তি লাগছে। দেবব্রতের সূক্ষ্ণ দৃষ্টি যেনো তাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আজ সে কৃষ্ণাকে অন্নার রুমে যেতে দেয় নি। হাত ধরে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে। তার এরুপ আচারণে অবন্তীকা দেবী প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দেবব্রতের মুখের কঠোরতার কারণে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন নি তিনি। কৃষ্ণা অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
– আমি ঘরে যাবো
– তুই কি বাগানে আছিস? নাকি আমি তোকে মাঝরাস্তায় রেখে এসেছি?
– আমি আমার ঘরে যাবো।
– আমার প্রশ্নের উত্তর মিললেই ছেড়ে দিবো। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।
– কিসের উত্তর?
– ভালোবাসিস অর্জুনকে?

দেবব্রতের অস্থির প্রশ্নে হা হয়ে তাকিয়ে পড়ে কৃষ্ণা। আজ সবার হলো টা কি সবাই তাকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করছে, একে ভালোবাসো তাকে ভালোবাসো। কি জ্বালা! কৃষ্ণার একটু রাগ ও হলো। মাষ্টারমশাই এর কি যায় আসে সে কাউকে ভালোবাসলে। মাষ্টারমশাই তো তাকে ভালোবাসে না, সে তো ওই দিদিমনিকে ভালোবাসে। দেবব্রত আবারো অস্থির কন্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো বল, ভালোবাসিস অর্জুনকে?
– তাতে কি আপনার কোনো যায় আসে? আমার তো মনে হয় না আমার অর্জুনদাকে ভালোবাসা কিংবা না বাসায় আপনার কিছুই যায় আসে না। তাহলে কেনো এই অহেতুক প্রশ্ন? আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?

কৃষ্ণার নির্বিকার প্রশ্নে দেবব্রত একটু হতচকিত হয়। কৃষ্ণা এভাবে প্রশ্ন করবে আশা করে নি। কৃষ্ণার উৎসুক চোখ তার দিকে স্থির। দেবব্রত কি উত্তর দিবে ভাষা খুজে পাচ্ছে না। দেবব্রতের নির্বাক চিত্ত দেখে কৃষ্ণা ম্লান হাসি দেয়৷ তারপর.……..………

চলবে

#কৃষ্ণাবতী
#২০ম_পর্ব

কৃষ্ণার নির্বিকার প্রশ্নে দেবব্রত একটু হতচকিত হয়। কৃষ্ণা এভাবে প্রশ্ন করবে আশা করে নি। কৃষ্ণার উৎসুক চোখ তার দিকে স্থির। দেবব্রত কি উত্তর দিবে ভাষা খুজে পাচ্ছে না। দেবব্রতের নির্বাক চিত্ত দেখে কৃষ্ণা ম্লান হাসি দেয়৷ তারপর অভিমানের স্বরে বলে,
– খুব কঠিন প্রশ্ন করে ফেললাম কি? এজন্য বুঝি চুপ করে আছেন! আমার ভুল, ক্ষমা করে দিবেন মাষ্টারমশাই। উত্তরটা আমার জানা তবুও বারে বারে একই প্রশ্ন করে বিব্রত করা। জানি আমাকে শুধু ঘোরের মাঝেই আপনার ভালোলাগে। আর অর্জুনদা কে আমি ভালোবাসি না। তার প্রেম নিবেদন আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। যেভাবেই হোক না কেনো আমাদের বিয়েটা তো হয়েছে। এখনো আপনার নামের সিঁদুর পড়ে রয়েছি। তাই এই সম্পর্কটাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। আর সত্যি বলতে এই বিয়েটা আমার জীবনের অকাট্য সত্যি। আমি আমার ঘরে যাচ্ছি মাষ্টারমশাই।

কৃষ্ণার গলা কাঁপছে। তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। কারণ কবি-সাহিত্যিকের ভাষায় সে দেবব্রতকে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসার অনুভূতিটা যতটা সুন্দর, এর বিরহের অনুভূতিটা ততটাই অসহ্যকর যন্ত্রণার। হয়তো অর্জুনদাও এই অনুভূতিটাই অনুভব করছে। তাইতো সে এতোটা ব্যাকুল ছিলো৷ কৃষ্ণা চলে যেতে ধরলেই দেবব্রত তার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। দেবব্রতের এরুপ আচারণে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় কৃষ্ণা। দেবব্রতের মানুষ এরুপ কাজ করতে পারে এটা শুধুই কাল্পনিক। তাদের মাঝামাঝি দূরত্ব এতটাই কম যে দেবব্রত উষ্ণ নিঃশ্বাস কৃষ্ণার মুখে আছড়ে পড়ছে। কৃষ্ণার চোখ দেবব্রতের চোখে স্থির। দেবব্রতের চোখে এক অন্য অস্থিরতা। মুখটা খানিকটা নামিয়ে কৃষ্ণার মুখের কাছাকাছি এনে শান্ত কন্ঠে দেবব্রত বলে,
– সব প্রশ্নের উত্তর কি এক কথায় দেওয়া যায়? আর যদি উত্তরদাতার প্রশ্নের উত্তর ই জানা না থাকে তবে! তবে সে কি করে উত্তর দিবে। আমি শুধু জানি তুই আমার। আমার একান্ত। তুই আমার সেই বাজে অভ্যাস, যা আমি চাইলেও ছাড়তে পারবো না। তুই আমার চোখের ক্ষুধা। কথাগুলো খুব কঠিন আমি জানি। তোর মোটা মাথায় তা ঢুকবে না। শুধু এটুকু জেনে রাখ, তুই আমার স্ত্রী, আমার অর্ধাঙ্গিনী। না তোর আমার থেকে মুক্তি আছে না আমার তোর থেকে।

দেবব্রত তখন কৃষ্ণার কপালে কপাল ঠেকায়। আবেশে কৃষ্ণার চোখ বুঝে আছে। খুব কাছে মাষ্টারমশাই তার। হাতপা জোড়া কাঁপছে রীতিমতো। মেরুদন্ড দিয়ে এক শীতল পরশ বয়ে যাচ্ছে। কি মনে করে কৃষ্ণার কপালে তার উষ্ণ ঠোঁটজোড়া ছুয়ে দিলো। কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
– আমি শুধু ঘোরের মাঝেই তোকে কাছে টানি না। ঘোর ব্যাতীত ও তোকে আমার ভালোলাগে। কিন্তু এই ভালোলাগাটা যেনো চিরস্থায়ী হয় তাই আমার যে সময় চাই।
– সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু যদি অপেক্ষার প্রহরে আমি ই বিলীন হয়ে যাই তাহলে
– আমি তোকে কোথাও বিলীন হতে দেবো না। তুই আমার।

বলেই কৃষ্ণাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে দেবব্রত। কৃষ্ণার চোখ থেকে টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সেও তার মাষ্টারমশাই কে আকড়ে ধরে। দেবব্রত কোমল স্বরে বলে,
– কখনো যদি তুই বিলীন হয়ে যাস, তবে আমার অন্তরাত্মাও বিলীন হয়ে যাবে। তুই আমার সেই নদী যার কবলে আমার ভাঙ্গন নিশ্চিত৷

দেবব্রত আরোও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। সে সময় চায়, কারণ দ্বিতীয় বার যখন কৃষ্ণাকে কাছে টানবে তখন যেনো কোনো দ্বিধা মনে না জন্মায়। কৃষ্ণার কিশোরী মনটাকে ভালোবাসার শুভ্রতায় সজ্জিত করতে চায় দেবব্রত৷ এজন্যই হয়তো শেক্সপিয়ার বলেছেন,
“Love looks not with the eyes, but with the mind, And therefore is winged Cupid painted blind”

দেবব্রত ও কৃষ্ণাকে মন থেকে ভালোবাসতে চায়। শুধু চোখের ক্ষুধা নয় তাকে সে মনের ক্ষুধাও বানাতে চায়______

এক সপ্তাহ পর,
দুপুর ১টা,
অন্না এবং কৃষ্ণা ক্লাসে বসে রয়েছে। একটু আগেই একটা ক্লাস শেষ হয়েছে তাদের। আজ ক্লাস করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে তারা। কিছুদিন পর টেস্ট পরীক্ষা। পড়ার চাপ যেনো দ্বিগুন বেড়ে গেছে। অন্না ক্লান্ত স্বরে বললো,
– আর কতো ক্লাস করবো রে, আজ মন্র হয় খাওয়াও হবে না।
– আর একটা ক্লাস এর পরেই বাড়ি চলে যাবো।
– তোর এতো ক্লাস করার এনার্জি আসে কোথা থেকে? সকালে উঠিস, ভোগ বানাস, ঠাকুরের আরতি করিস, তারপর মা-জ্যেঠীমাকে সাহায্য করিস, এর পর টানা ক্লাস। এতো এনার্জি কোথায় পাস?
– ওই মোবাইল থেকে চোখ সরালেই দেখবি জীবনটা সহজ। তোর মন তো পড়ে আছে ওই মোবাইলে।

কৃষ্ণার কথা শুনে ভ্রু কুচকে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে অন্না বলে,
– সত্যি বলতে মনটা অন্যখানে পড়ে রয়েছে। ব্যাপারটা যদিও বেশ সিক্রেটিভ। কিন্তু যেহেতু তুই আমার বেস্টু তাই তোকে বলছি। আমার রিচার্জ ব্যাটারিকে এই সপ্তাহখানিক দেখছি না। তাই কলেজে আজকাল মন বসে না
– রিচার্জ ব্যাটারি? সে কে?
– নাম বললে চাকরি থাকবে না।

চোখ টিপ্পনী দিয়ে কথাটা বলে অন্না। কৃষ্ণা কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটি মেয়ে তার বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা খুব কর্কশ কন্ঠেই বলে,
– তুমি কি কৃষ্ণাবতী?
– হ্যা, কেনো বলো তো?
– তোমাকেই তো অর্জুন দাদা সবার সামনে প্রেম নিবেদন করেছিলো তাই নয় কি?
-……..

মেয়েটার এমন খাপছাড়া প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দিবে বুঝে উঠছিলো না কৃষ্ণা। কৃষ্ণাকে চুপ থাকতে দেখে অন্না নিজ থেকে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে,
– তোমাকে ঠিক চিনলাম না, কে তুমি?
– আমি মিতালী, অর্জুন দাদা আমার খুড়তোতো দাদা। কমার্সে আছি আমি তোমাদের সাথে
– কি হয়েছে একটু খোলসা করে বললে সুবিধা হয়!
– দাদা সেই রাতে ঘরে ফিরে নি। যখন ফিরেছে তার পর থেকে না ঠিকমত খাচ্ছে না ঠিকমত কারোর সাথে কথা বলছে। শুধু একটা চোখের ছবির সামনে মুখ বুঝে বসে থাকে।

মিতালীর কথা শুনে কৃষ্ণার মন খারাপ হয়ে যায়। আজ তার কারণেই লোকটার এই অবস্থা। কেনো বুঝলো না সে আগে, তাহলে হয়তো লোকটার পরিণতি এমন হতো না। কৃষ্ণাকে মিতালী কম কথা শুনায় নি। কিন্তু কৃষ্ণা কোনো কথাই বলে না। শুধু চুপ করে কথাগুলো শুনে যায়। অর্জুনদার অবস্থা শুনে অন্নার কেনো যেনো খুব কষ্ট হয়। বুকের মাঝে একটা আটকা যন্ত্রণা হতে থাকে। এই যন্ত্রণার কারণটা তার জানা, কিন্তু ফলাফল শুন্য_________

১৭.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অর্জুন। হাতে সিগারেট। সিগারেটটি জ্বলছে৷ পড়ন্ত বিকালে তার উদাস মনে এটা যেনো একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। ল্যাপটপে গাণ বাজছে, বেদনার গাণ।
“আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি
তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি ।।
তখনো কুহেলীজালে,
সখা, তরুণী উষার ভালে
শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা
উঠিতেছে ছলোছলি ।।
এখন বনের গান, বন্ধু, হয় নি তো অবসান-
তবু এখনি যাবে কি চলি ।
ও মোর করুণ বল্লিকা,
ও তোর শ্রান্ত মল্লিকা
ঝরো-ঝরো হল, এই বেলা তোর শেষ কথা দিস বলি ।।”

দেখতে দেখতে পনেরোটা দিন হয়ে গেছে। কৃষ্ণাবতী থেকে পাওয়া আঘাতটা এখনো তাজা। এখন আর ওই ক্যানভাসের চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে না তার। হঠাৎ কারোর উপস্থিতিতে বেশ বিরক্ত হয় অর্জুন। তার রুমে সবার আসা বারণ। বিরক্ত স্বরে বলে উঠে,
– মিতালী যা ঘর থেকে, আমাকে একা ছেড়ে দে
-………

অপরপাশ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বিরক্তির সাথে পেছনে ফিরে অর্জুন। পেছনে ফিরতেই দেখে.…………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি