#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ১৪ |
মেয়েটা ভীষন অভিমানী! সে কোনো ভুল করলেই অভিমান করে মুখ টা ফুলিয়ে রাখতো। বেশিরভাগ সময় তার অভিমান হলে সে কথা বলা বন্ধ করে দিতো। বেশ খানেক সময় কথা বলতো না যতক্ষণ না তার রাগ ভাঙ্গবে। অবশ্য তার রাগ কেউ ভাঙ্গাতো না, সে নিজেই নিজেকে বুঝ দিয়ে নিজের রাগ ভাঙ্গাতো। বেশি রাগ উঠে গেলে সে নিজেকে কষ্ট দেওয়া শুরু করতো, সুইসাইড করার চেষ্টা করতো। যার জন্য সাগর অনেক বেশি কেয়ারফুল তার জন্য।
সাগর কথা বলার সময় বৃষ্টি অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। তার মনে পড়ে গেলো সেদিন সে কতটা ই না খারাপ ব্যবহার করেছিলো রাত্রির সাথে। ঘরবর্তী মানুষের সামনে অপমান করেছিলো সে, উঠতে বসতে কটু কথা শুনাতো সে। রাত্রি চুপ করে নিজের কাজ করতো। তার ভেতর খারাপ লাগা শুরু করলো। নিজের মধ্যে অপরাধী টাইপ ফিলিংস কাজ করতে লাগলো।
গভীর ভাবনায় ডুবে সে নিজে নিজে বলে উঠে,–“আমি আমার প্রথম সন্তান রাত্রি আপুকে দিয়ে দিবো।”
সাগর দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। সাগরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কারণে তার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। সে চমকে উঠে, কী বলে ফেলেছে সে?
সে আমতা আমতা করে বলে,–“না, মানে আমি বলতে চাইছিলাম আর কি…. ”
সাগর কোনো রিয়েক্ট করলো না।
সে বৃষ্টিকে বলে,—” তুমি বলেছো আমি যেনো তোমার সাথেও স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি, আমি করতেছি। আমি সাধারন স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করছি তোমার সাথে কিন্তু বিশ্বাস করো ভেতর থেকে আমি একটুও স্বাভাবিক নয়। দয়া করে, আমার এমন সাধারন ব্যবহার টা কে তুমি অন্য কিছু ভেবো না। আজ হোক কাল হোক তোমাকে বাচ্চা নিতেই হবে, না হলে হয়তো মা আমার আবারো বিয়ে দিবেন বাচ্চার জন্য। তাই আমি সম্পর্ক টা স্বাভাবিক করার জন্য স্বাভাবিক হচ্ছি তোমার সাথে। বুঝতে পারছো?”
বৃষ্টি মাথা নাড়ায়, সে বলতে চাইছে যে সে বুঝতে পেরেছে। তার ভেতর টা আবার কেঁপে উঠেছে তবে এবার তার নিজের জন্য। নিজের প্রতি নিজের মায়া আসছে। সে কী?আসলেই কী তার কোনো মূল্য আছে?
কাঁপা ঠোঁটে, ঝাঁঝালো গলায় সে বলে,
—” এটা কেমন কথা, বাচ্চা নাহলে আপনি আবারো বিয়ে করবেন? আপনি কি আসলেও মানুষ? আমাদের দুটো মেয়ের জীবন নষ্ট করে ফেলেছেন আপনি, আরো মেয়ের জীবন নষ্ট করতে চান? আপনাদের কাছে কি মেয়ে মানে কী বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন? আপনার প্রতি আমার যা অনুভূতি ছিলো তা এখন ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। ছিঃ, আপনি তো কাপুরুষ। আপনার এ পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।”
সাগরের রাগ উঠে গেলো, বার কয়েক সে বৃষ্টির কথাগুলো আওড়াতে লাগলো। তার জীবনে আছে কি? সবার কথা শুনছে সে তবুও কারো কাছেই ভালো নয়। এখন তার মনে হচ্ছে সে কেনো মেঝো ভাইয়ের মতো হলো না, বাহিরে কতগুলো অবৈধ রিলেশন করেও বউয়ের কাছে ভালো। বউকে খুশি করার জন্য পরিবারকে কাজের অজুহাত দিয়ে শহরে বাসা বাড়া নিয়ে থাকছে। কারো কথা না শুনে, নিজের মতো চলছে সবার কাছেই তো ভালো।
এজন্য পুরুষ মানুষের কখনো নারীর কথা শুনতে নেই। কারন শুনলেও সে সেই নারীর কাছেও ভালো থাকবে না বাকিরা তো বাদই। নিজের মতো চলা উচিত,নিজের বিবেক বুদ্ধি খরচ করে বাস করা উচিত।
আচমকা তার ভেতরের রাগ টা গলে গেলো, বৃষ্টি কি বলেছে, তার প্রতি বৃষ্টির ঘৃণা হচ্ছে?
তাহলে তো সেটা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট। বৃষ্টিকে এখন থেকে তার প্রতি ঘৃণা করতে দিবে,কখনোই তার এ ফিলিংস নষ্ট করতে দিবে না। সে এখন থেকে তার কাছে খারাপ ই হবে।
সে অতিরক্ত রাগী সুর করে বলে,
—“হ্যা,আমি কাপুরুষ। আমি বাচ্চার জন্য বারবার বিয়ে করবো। এবার খুশি?”
বৃষ্টির মুখে এবার স্পষ্ট ঘৃণার রেশ ফুটে উঠলো। চোখমুখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, যে এত ঘৃণা তার অন্য কারো প্রতি আর কখনোই হয় নি। তা দেখে সাগরের ভেতর টা শীতল হয়ে উঠলো। সে যা চাইছে সেটাই হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে এখন আর তাকে পাওয়ার আশা দেখছে না সে।
আরো খারাপ ব্যবহার করলে হয়তো বৃষ্টি কখনো তার মতো মানুষকে চাইবে না।
সে না চাইতেও ইচ্ছা করে বৃষ্টির কাছে গেলো, আর বললো,–” এবার তো তুমি সব জানো। আশা করি এখন আর কোনো বাঁধা আসবে না, আমরা হ্যাপিলি সম্পর্ক টা এগুতে পারি। আমি কেমন পুরুষ সেটা এখনই যেনে যাবে তুমি।”
বৃষ্টি প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। সাগর মনে মনে হাসলো,একদিন আগেও মেয়েটা ওকে কাছে পেতে চাইছিলো আর আজ? সাগর না চাইতেও বৃষ্টিকে বাজেভাবে স্পর্শ করলো, ওর হাত কাঁপছে। আর বৃষ্টি ছটফট করছে সরে যাওয়ার জন্য। সে আরো বাজেভাবে স্পর্শ করতে নিচ্ছিলো তখন দেখে বৃষ্টি কেঁদে দিয়েছে। সে সরে গেলো, বৃষ্টি অন্যপাশ হয়ে কাঁদছে। সাগর ভেতর থেকে প্রচন্ড কাঁপছে, তবুও শক্ত কন্ঠে বলে,–“আজ ছেড়ে দিলাম, নেক্সট টাইম কখনোই এমন হবে না।”
কথাটা কোনোরকম বলে সে ওয়াশরুমের দিকে ছুট দিলো। কল টা ছেড়ে বার কয়েক মুখে পানি দিতে লাগলো। ভেসিনের সামনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে চোখ পড়লো তার। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো সে। এ জীবনে আরো কত কী করতে হবে তাকে কে জানে?
বৃষ্টি নিরবে শব্দহীন ভাবে কাঁদছে। চোখ দিয়ে মুক্তোর দানার মতো জল গড়িয়ে পড়ছে। শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে, সাগরকে নিজের করার যে ইচ্ছা টা হয়েছিলো আজ সেটা মন-মষ্তিষ্ক থেকে একদম চলে গেলো। সে কখনোই সাগরকে ভালোবাসবে না। সাগর একটা চরম বেয়াদপ ছেলে। ওর মতো ছেলেকে সে আর কখনোই জীবনে চাইবে না। কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করে বলে উঠে,–“বেয়াদপ। সাগর বেয়াদপ ছেলে।খুব খারাপ সে। অতি মাত্রায় খারাপ।”
সাগর শব্দ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বৃষ্টি সাথে সাথে নিজেকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লো। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদার ফলে যে হেঁচকি উঠছিলো বৃষ্টির সেটা সাগরের কানে স্পষ্ট আসছে। সাগর হালকা হেসে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বৃষ্টির রাগ টাকে আরেকটু বাড়াতে ওকে কম্বল সহ জড়িয়ে ধরলো, বৃষ্টির ভেতর টা রাগে ফেটে পড়লো। সে ধস্তাধস্তি করলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। কিন্তু সাগর ছাড়ে নি, তাই সে হার মেনে হাল ছেড়ে দিলো। সাগর যখন টের পেলো বৃষ্টি ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে ধীরে ওকে ছেড়ে দিয়ে সরে গেলো। সোজা ব্যালকনি তে চলে গেলো, পকেট থেকে সিগারেট টা বের করলো, প্রতিদিনের তুলনায় আজ হয়তো টান টা বেশিই হয়ে যাবে।
★★
সিলেটে সাত দিন কাটিয়ে, বাড়ী ফেরার উদ্দেশ্য রওনা দিলো সাগর আর বৃষ্টির। ওদের ট্রিপ স্বাভাবিক না হলেও অস্বাভাবিক ও ছিলো না। মোটামুটি ভালো ছিলো ট্রিপটা। সাগরের মন-মষ্তিষ্কে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক আর শান্ত হয়েছিলো। কারণ বৃষ্টি এখন নিজ থেকেই ওর থেকে দূরত্ব বজায় চলছে। যাক বৃষ্টিকে নিয়ে আপাতত ওর টেনশন নেই,টেনশন হচ্ছে রাত্রিকে নিয়ে। না জানি ওই মেয়ে উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসেছে নাকি? মায়ের থেকে তো সে প্রতিটা সময়ের আপডেট নিয়েছে মা বলেছে রাত্রি নাকি ঠিক আছে। তবুও মায়ের কথাবার্তা শুনে সে আন্দাজ করলো মা তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে। যাই হোক, রাত্রি ঠিক থাকলেই চলবে। মেয়েটার হাসিমুখ ছিনিয়ে নেওয়ার একমাত্র কারণ ই যে সে।
আর ওদিকে রাত্রি নিজেকে একদম গুছিয়ে নিয়েছে। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্কুলে থাকে, সন্ধ্যায় কিছু বাচ্চাকে টিউশনি করায়। সে টিউশনি টা করাতে চাইছিলো না, কিন্তু কিছু বাচ্চার বাবা-মার জন্য পারে নি। তারা এমনভাবে রাত্রিকে জোর করছিলো যে সে না করতে পারে নি। স্কুলের প্রতিটা ক্লাসে রাত্রির নাম শুনলে বাচ্চাদের হই হই লেগে যায়। সব বাচ্চা রাত্রি বলতে পাগল। এ নিয়ে অফিস কক্ষে বেশ কানাঘুষো চলছে, সাতদিনে কেউ কীভাবে এত প্রিয় হতে পারে বাচ্চাদের কাছে?
রাত্রি বাচ্চাদের এমনভাবে পড়ায় যেনো সবাই তার নিজের বাচ্চা। সবগুলো বাচ্চাকে দেখলে তার ভেতর টা কেমন করে উঠে, ভেতর টা অস্থির হয়ে উঠে। ইচ্ছা করে সবগুলো বাচ্চাকে নিয়ে চলে যেতে। তার সবচেয়ে প্রিয় হলো শিশু ক্লাসের বাচ্চাগুলো।
সে শুধু ভাবে সবগুলো বাচ্চা এত কিউট কেনো? হোয়াই? পড়ানোর সময় সে সবসময় একটা না একটা না বাচ্চাকে কোলে নিবেই। সবগুলো বাচ্চা এমন ভাবে ওর সাথে ব্যবহার করবে যেনো সে তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রাত্রি প্রায় প্রতিদিন পালা করে বাচ্চাগুলো থেকে একটা একটা চুমু খায় আর দেয়।
রাত্রির প্রতি হেডস্যার অনেক খুশি। তাদের স্কুলের সুনাম চারপাশ থেকে ভেসে আসছে। বাচ্চাদের প্রতিও সার এখন মুগ্ধ। এইতো কালকের ঘটনা,
অফ পিরিয়ডে সব স্যার রা অফিসে বসে ছিলো, তখন ক্লাস ফোরের স্টুডেন্ট ক্যাপ্টেন এসে বলে,–” স্যার আসতে পারি?”
–“হ্যা,আসো,আসো। আলেয়া( দপ্তরি) গিয়ে বলেছে তো যে তোমাদের পরের বিষয়ের স্যার আজ ক্লাস নিবে না। আসলে উনারী বাড়ী থেকে জরুরী তলব এসেছে তাই উনি চলে গিয়েছেন।”
বাচ্চাটি সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলে,–“জ্বি, স্যার। উনি বলেছেন।”
স্যার আদেশের সুরে বলেন,–” আচ্ছা,তাহলে এখন গিয়ে সবাই চুপচাপ বসে থাকো। কোনো আওয়াজ করো না। ঠিক আছে?”
–“স্যার বলছিলাম কি, ইকবাল স্যার তো ক্লাস নিবেন না। তাহলে উনার পরিবর্তে রাত্রি ম্যামকে না হয় পাঠিয়ে দিন আমাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য। স্যার ক্লাসের সবাই এটাই চাইছে।”
হেডস্যার অবাক হয়ে গেলেন ওদের কথায়, মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছিলো না। যে বাচ্চারা ক্লাসের সার গেলেও তারা ক্লাস করতে চায় না। সবাই হইচই করতে থাকে, তারা নিজ থেকেই বলছে অন্য জনকে ক্লাস নেওয়ার জন্য! এটা কি স্বপ্ন? তার ভেতরটা খুশিতে টগবগ করে উঠলো। তিনি রাত্রির দিকে তাকাতেই, সে মাথা নাড়িয়ে উঠে গেলো। সব বাচ্চারা দরজার আড়ালেই ছিলো,সবাই হইহই করে চিল্লাতে লাগলো। অফিসের সব স্যার তো অবাক হয়ে ছিলেন। রাত্রি হাসিমুখে ছেলেটার মাথা ভর্তি চুলগুলে হাতিয়ে দিয়ে খুশিমনে ক্লাস করতে গেলো।
কাল ছুটির সময় স্যার তাকে বলে দিলেন আজ যেনে সে তাড়াতাড়ি যায়। আজকে স্কুলে নাকি স্কুল পরিদর্শক আসবে। তাই সকাল থেকেই রাত্রি তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে। সাগরের মা এসে তাকে তৈরি হতে দেখে বলে,–“আজ এত তাড়া কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি স্কুলে?”
রাত্রি শাড়ির আঁচলে সেইফটি পিন মারতে মারতে বললো,–“না মা। আজ পরিদর্শক আসবে, সব দেখতে। স্কুল কেমন চলছে?পরিবেশ কেমন,বাচ্চারা কেমন এসব দেখতে আর কি।”
সাগরের মা মাথা নেড়ে বলে,–“ওহ। আচ্ছা সাবধানে ক্লাস করাস, এরা খুব খারাপ হয়। কোনো ভুল দেখলেই চাকরী থেকে বের করে দিবে। ”
রাত্রি বলে, –“আচ্ছা মা।”
রাত্রি চলে যাচ্ছিলো, শাহিনুর বেগম আবারো বলে উঠে,–” আরে দাড়া। টিফিন নিবি না? ”
–“ওহ,সরি ভুলে গেছি।”
রাত্রি ফিরে এসে টিফিন টা ব্যাগে ভরতে লাগলো। তখনই শাহিনুর বেগম বলে উঠে,–“শুন, কাল ছুটি নিয়ে নিস, শিফাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।”
রাত্রি আচ্ছা মা বলে বের হয়ে গেলো। শাহিনুর বেগম চেয়ে আছেন তার যাওয়ার দিকে। মেয়েটা এত ভালো কেনো? তিনি কত খারাপ বিহেভ করেছেন তার পরেও সে এতটা স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করে! বিশেষ করে উনার সাথে, যেনো তিনি তার সত্যিকার অর্থে মা।
চলবে!