My First Crush part-15+16

0
216

#My_First_Crush
#পর্ব-১৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

‘আই অ্যাম সরি হৃদি! আমিই বোধহয় সবার থেকে লেট উইশ করলাম।’

আমি আলগোছে মাথা নেড়ে রাইয়ানকে বোঝালাম ব্যাপার না। আমার চোখ খুশিতে চিকচিক করতে লাগলো। রাইয়ান একটা চাকু এনে দিলো হাতে। আমি একটু ঝুঁকে কেকটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। এরপর আস্তে করে হাতে থাকা চাকুটা দিয়ে কেকটি কাটলাম। একটা টুকরো অভ্যাসবশত ভাবে রাইয়ানের মুখের সামনে তুলেই ইতস্তত বোধ করতে লাগলাম। খাইয়ে দেবো নাকি দেবো না? আমার মুখের ভঙ্গি বুঝতে পেরে রাইয়ানই আমার হাতে ধরে রাখা কেকের এক কোণায় অল্প একটু কামড় বসিয়ে খেয়ে নিলো। তারপর ছোট্ট একটা টুকরো নিয়ে খাইয়ে দিলো আমাকে। আর সেটি ছিল আমার জীবনে খাওয়া সবথেকে টেস্টি কেক। আমি মনে মনে খুশি হয়ে রাইয়ানের মুখের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম রাইয়ানের মুখের কোণায় ক্রিম লেগে গেছে। আমি মুখ চেপে হেসে রাইয়ানকে বললাম সেটা। রাইয়ান হাত দিয়ে সেটা মুছতে গেলো। তার হাতেও আগে থেকেই ক্রিম লাগানো ছিল। ফলে আবারো মুছতে গিয়ে ক্রিম লাগলো তার নাকে। আমি এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। শব্দ করে হেসে উঠলাম। রাইয়ান আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে কেক থেকে আরো একটু ক্রিম ভরে নিলো হাতে। লক্ষণ সুবিধার না দেখে হাসতে হাসতে দ্রুত পেছনে সরতে গেলাম আমি। কিন্তু রাইয়ান ধরে ফেললো আমাকে। তৎক্ষনাৎ আঙ্গুল দিয়ে আমার গালে ক্রিম লাগিয়ে দিলো। তারপর আবার লাগালো আমার নাকে। আর বলল, ‘ঠিক আছে এবার।’
আমি ঈষৎ মুখ ফুলিয়ে হেসে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিলাম। হঠাৎ টেবিলে ভালো ভাবে নজর পরতেই রাইয়ান একটি স্পার্কিং ক্যান্ডেল হাতে তুলে নিলো। বলল, ‘দেখেছো এটা ধরাতে তো মনেই নই। ওয়েস্ট করার দরকার কি! এখন ধরিয়ে নেই।’
আমি কিছু বলার আগেই রাইয়ান তাড়াতাড়ি ম্যাচ দিয়ে ক্যান্ডেল ধরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই উপরে উঠে ছড়াতে লাগলো আগুনের স্ফুলিঙ্গ। আমার শরীরে একটা কাঁপন সৃষ্টি হলো। একটি পুরনো বিভীষিকা ধাক্কা খেলো মাথায়। আমি তাড়াতাড়ি ঘুরে গিয়ে দু কানে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বললাম, ‘রাইয়ান, প্লিজ সরাও এটা, প্লিজ!’
আমার গলা ধরে এলো। চোখে মুখে অস্পষ্ট এক ভয়। মুহুর্তের মধ্যেই নিভে গেলো সেটা। রাইয়ান তাড়াতাড়ি সেটা হাত থেকে রেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
‘কি হয়েছে হৃদি? তুমি এমন ভয় পেলে কেন?’
আমি চোখ খুলে দেখলাম সেটা নিভে গেছে। আমার চোখে পানি দেখে এবার বেশ অবাক হলো রাইয়ান। চোখে মুখে তার প্রশ্নের ছাপ গাঢ় হলো। আমাকে সোফায় বসিয়ে একটা পানির গ্লাস হাতে দিলো সে। আমি অল্প একটু গলা ভিজিয়ে নিলাম। নাক টেনে স্বাভাবিক হয়ে সময় নিয়ে বললাম,
‘আমার বাবার বন্ধুর একটা ফাংশনে আমি, মা আর বাবা গিয়েছিলাম। ফাংশনটা ছিল একটা ফার্মহাউজে। সবকিছু খুব সুন্দরই চলছিল। আমি মা আর বাবা একসাথে হাসিমুখে ছবি তুলছিলাম, গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার ফোনে আমার ফ্রেন্ডের একটা কল আসে। সেখানে ঠিকভাবে নেটওয়ার্ক না আসায় আমি নেটওয়ার্কের খোঁজে একটু দূরে চলে যাই। ফিরে এসে দেখি ফার্মহাউজে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আমি ভেতরে যেতে চাই কিন্তু বাইরে থাকা লোকজন আমাকে আটকে রাখে। সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে খুব ভয়াবহ ভাবে আগুন লেগেছিল। আর সেই আগুনে আমার বাবা মা…..’
আমি থেমে যাই। আমার গলায় শব্দগুলো আটকে যায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পরে নোনাধারা। রাইয়ান আমার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দেয়। আমি নিজেকে সামলে বলি, ‘তারপর থেকে আগুন আমার খুব ভয় লাগে। আগুন দেখলেই শুধু মনে হয় সেখানে আমার বাবা মা জ্বলছে। মাঝে মাঝে অবস্থা গুরুতরও হয়ে যায়। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্যানিক অ্যাটাক হয়। এটা ডিপেন্ড করে আগুনের তারতম্যের উপর। একারণেই আমি আগুন যতটুক সম্ভব এভোয়েড করে চলি। আর ব্যাগে সবসময় মেডেসিন রাখি।’
রাইয়ান বলল, ‘আমি শুনেছিলাম আমাদের নেইবার হুডের একটা পরিবারে এমন ঘটনা ঘটেছে। সরি হৃদি আমি তখন….
আমি রাইয়ানকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ইটস ওকে রাইয়ান। আমি জানি তুমি তখন বাসায় ছিলে না। সামার ক্যাম্পে গিয়েছিলে।’

আমি আবারো গ্লাসের পানিতে চুমুক দিলাম। আর রাইয়ান সহানুভূতির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
___________________________________________________

সকালের বাতাসে এক অন্যরকম আমেজ লুকিয়ে থাকে। গায়ে লাগতেই শরীর ও মন দুটোই হয়ে যায় ভালো। পরিবেশটা নমনীয়। চারপাশে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। এমনই এক সকালে রাইয়ান আর হৃদি বেরিয়েছে জগিং করতে। দুজনেরই গায়ে জগিং স্যুট। পায়ে কেডস। হৃদির চুলগুলো ঝুটি করে রাখা। রাইয়ানের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে সে ক্লান্ত। একটু পরপরই গতি থামিয়ে পিছিয়ে পরছে সে। রাইয়ান আরেকবার পেছনে ঘুরে হৃদিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘হৃদি এতো আস্তে আস্তে দৌড়ালে কিভাবে চলবে? আরো জোরে জোরে পা চালাও।’
হৃদি কোমরে হাত রেখে হাঁপিয়ে বলল,
‘আমি আর পারবো না। তুমি এতো জোরে জোরে দৌড়াও কিভাবে? তোমার নাগাল পাওয়া খুব কষ্ট রাইয়ান।’
‘কারণ তুমি নিয়মিত করো না তাই তোমার এমন লাগছে। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছো।’
রাইয়ান হৃদির দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো৷ হৃদির সাথে সাথে পায়ের গতি কমিয়ে দিলো সে। হৃদি বোতল ধরে ভাব নিয়ে বলল,
‘এতোটাও কম ভেবো না। আমিও আগে রোজ জগিং করতাম। তোমার পিছনে দৌড়ানো আমার পুরনো অভ্যাস।’
শেষের কথাটা হৃদি খুবই আস্তে আস্তে বলল। রাইয়ান বুঝতে না পেরে বলল, ‘কি?’
হৃদি তাড়াতাড়ি বলল, ‘কিছু না।’
হাঁটতে হাঁটতে একটা ব্রিজের উপর এসে পরলো তারা। পানির উপরে আকাশে প্রজ্বলিত সূর্যের দিকে হৃদির চোখ পরতেই রাইয়ানকে বলল,
‘কত সুন্দর লাগছে না সিনারিটা দেখতে? চলো রাইয়ান তোমার একটা ছবি তুলো দেই।’
রাইয়ান প্রথমে তুলতে চাইলো না। হৃদি বারবার বলায় রাজি হলো। ব্রিজের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দিলো। হৃদি তার ফোনটা নিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে একের পর এক ক্লিক করতে লাগলো। ছবি তোলা শেষ হলে রাইয়ান দেখতে চাইলো হৃদির ফোন। হৃদি দিয়ে দিলো। রাইয়ান ছবি স্লাইড করে করে দেখলো সবগুলোই হৃদির সেলফি। তার একটাও তুলেনি। রাইয়ান চোখ তুলে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি একটু দূরে সরে গিয়ে হাসতে লাগলো। রাইয়ান বলল,
‘দুষ্ট মেয়ে, আচ্ছা দাঁড়াও এবার আমি আরো তোমার উইয়ার্ড ছবি তুলে দিচ্ছি।’
হৃদি হাসতে হাসতে মুখে হাত রেখে ক্যামেরা থেকে যত দূরে সরতে চাইলো রাইয়ান ততোই ফোকাস করে তার ভিডিও করতে লাগলো। একসময় হাঁপিয়ে উঠে হৃদি এসে বসলো একটা কাঠের বেঞ্চিতে। রাইয়ানও এসে বসলো তার পাশে। হৃদি পানির বোতলের ছিপি খুললো। এক ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলো একটু। তারপর রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি নিবে?’
রাইয়ান না করলো। হৃদির চোখ পরলো রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ভ্যানগাড়ির উপর। হৃদি উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘রাইয়ান, চলো আইসক্রিম খেয়ে আসি।’
রাইয়ান বলল, ‘এতো সকাল সকাল আইসক্রিম কোথা থেকে আসবে?’
‘ঐ যে ওখানেই দাঁড় করানো। চলো নিয়ে আসি।’
‘এতো সকালে আইসক্রিম খাওয়া ঠিক হবে না। গলা খারাপ হতে পারে।’
‘হলে হোক। আমি কোথায় সিঙ্গার হতে যাবো!’
হৃদি রাইয়ানকে এক প্রকার জোর করেই রাস্তার ওপাশে নিয়ে গেলো। ভ্যানের কাছে গিয়ে দেখলো ওটা আসলে আইসক্রিমের ভ্যান নয়। অন্য কিছুর। গাছের আড়ালের জন্য স্পষ্ট বোঝা যায়নি। হৃদির মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।

এরপর বাসায় ফিরে যে যার মতো কর্মস্থলে চলে গেলো। রাইয়ান অফিসে যাবার কিছুক্ষণ পর কেবিনের দরজা ঠেলে বেন্থা এলো একটা কফি মগ হাতে। হাসি হাসি মুখ করে রাইয়ানকে বলল,
‘এসেই কাজ শুরু করে দিয়েছো?’
রাইয়ান স্মিত হেসে বলল, ‘তেমন কিছু না। গতকালের ফাইলগুলোই একটু দেখছিলাম। তুমি বলো তোমার কি খবর? গার্লফ্রেন্ডের সাথে সব ঠিকঠাক?’
বেন্থা একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আর ঠিকঠাক! গার্লফ্রেন্ড হলো এমন, তাদের কথা মেনে চললে সবই ঠিকঠাক থাকবে। শুধু নিজেদের পয়েন্ট অফ ভিউ রাখতে গেলেই যতো বিপত্তি।’
রাইয়ান আর বেন্থা দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো। বেন্থা বলে উঠলো, ‘কথায় কথায় কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেককাপ গরম নিয়ে আসি। তুমিও এক কাপ নিবে নাকি!’
রাইয়ান স্মিত হেসে বলল, ‘না ধন্যবাদ।’
বেন্থা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই জিশান আর অ্যালেন এসে ঢুকলো রাইয়ানের কেবিনে। রাইয়ান কিঞ্চিৎ অবাক হাসি দিয়ে বলল, ‘তোরা?’
জিশান বলল, ‘পাশ দিয়েই দুই ব্রো যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোর সাথেও দেখা করে যাই। নয়তো আবার কান্নাকাটি করবি।’
অ্যালেন বলল, ‘নিজের স্বভাব তোর উপর চাপাচ্ছে।’
জিশান বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করলো অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে। রাইয়ান হাসতে লাগলো। জিশান বলল,
‘এমনই যদি আমাকে পিন্চ মেরে কথা বলিস তাহলে আমি আর তোর সাথে ক্রাফট ফেস্টিভ্যালে যাবো না।’
রাইয়ান মৃদু অবাক স্বরে অ্যালেনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই ক্রাফট ফেস্টিভ্যালে যাবি।’
অ্যালেন মুখের হাসি প্রসারিত করে বলল,
‘হুম। শুনেছি ওখানে অনেক ইউনিক জিনিস উঠেছে। আমি হৃদির জন্য কিছু কিনতে চাই। আমার মনে হয় হৃদি এরকম জিনিস পছন্দ করবে।’
রাইয়ান আস্তে করে ফাইল বন্ধ করে অ্যালেনকে বলল,
‘অ্যালেন, তুই কি হৃদিকে নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস?’
অ্যালেন হেসে বলল, ‘আমাকে কখনো দেখেছিস কোন মেয়ের জন্য এমন বলতে?’
রাইয়ান ভ্রু ভাঁজ করে বলে ফেললো, ‘কিন্তু হৃদিই কেন?’
অ্যালেন ফিচেল হেসে বলল, ‘হৃদি হলে সমস্যা কি?’
‘তুই কি বুঝতে পারছিস না? ব্যাপারটা কতো উইয়ার্ড হয়ে যাবে না?’
‘কি উইয়ার্ড! হেই রাইয়ান, তুই এগুলো এতো গুরুত্ব দিচ্ছিস কেন? আজকাল কতো মানুষ বহুবছর একসাথে থেকেও আলাদা হবার পর নিজের এক্সের ফ্রেন্ডের সাথেই সম্পর্কে জড়ায়। তারপর আবার তিনজনে একসাথে হ্যাং আউটও করে। এখানে কত দেখলাম এমন! আর তোদের মধ্যে তো কিছু রিয়েলও না। তাহলে উইয়ার্ড লাগবে কেন? ব্রো সত্যি বলছি, হৃদিকে নিয়ে আমি খুবই সিরিয়াস। আমার ওঁকে খুবই ভালো লাগে! হৃদি এমন একটা মেয়ে যার সাথে থাকলে কখনো বোরিং ফিল হয় না। একটা জীবনে আর কি লাগে? খুবই কিউট একটা মেয়ে।’
অ্যালেনের কথাগুলো শুনতে কেন যেন ভালো লাগছিলো না রাইয়ানের। সে পাশ থেকে একটা ফাইল টেনে বলল, ‘তোরা এখন যা। আমার অনেক কাজ আছে।’
___________________________________________________

আজ হৃদির কফিশপে কাস্টমারের সংখ্যা একটু বেশি।
কাস্টমারদের ভালো লাগার কথা চিন্তা করে বাইরেও টেবিল বসিয়েছে তারা। কাস্টমারদের অর্ডার ঠিকমতো সার্ভ হচ্ছে কিনা তা দেখায় ব্যস্ত জেরিন। হৃদি এতক্ষণ বাকি কাজ গুলো সেরে একটা কাগজ নিয়ে হিসাব কষতে লাগলো। একটা হিসাব ঠিকমতো মিলছে না তার। এমন সময় পেছন থেকে ব্রাউন জ্যাকেট আর হোয়াইট জিন্স পরনে অ্যালেন এলো সেখানে। স্বভাবতই তার হাসিমাখা মুখে বলে উঠলো,
‘আসতে পারি?’
হৃদি স্মিত হেসে স্বাগত জানালো অ্যালেনকে। অ্যালেন এসে হৃদির পাশে দাঁড়ালো। হৃদি তার হাতে থাকা কাগজে মনোযোগ দিলো। অ্যালেন বলল,
‘মনে হচ্ছে আজকে তুমি একটু বেশিই ব্যস্ত?’ কাস্টমারও বেশি।’
হৃদি বলল, ‘মাঝে মাঝেই তো এমন ব্যস্ত হবার সুযোগ পাই। নয়তো প্রতিদিন কোথায় আসে এতো কাস্টমার!’
কাগজের দিকে তাকিয়ে হৃদি আবারো চিন্তিত মুখে কিছু ভাবছে দেখে অ্যালেন বলল,
‘কি হয়েছে?’
হৃদি মাথা তুলে বলল, ‘একটা হিসাব মিলছে না।’
অ্যালেন হৃদির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে বলল, ‘দেখি।’
অ্যালেন গভীর মনোযোগের সাথে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে সব ক্লিয়ার করে ফেললো। হৃদি বলল,
‘তুমি তো দেখি ভালোই। আমি এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম আর তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই করে ফেললে!’
অ্যালেন মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ম্যাডাম, তুমি বোধ হয় জানো না, আমি আর রাইয়ান একই ইউনিভার্সিটির হলেও আমাদের মেজর ছিল কিন্তু আলাদা। রাইয়ান সাইন্স মেজরের আর আমি ম্যানেজমেন্টের স্টুডেন্ট।’
হৃদি উৎসাহের সাথে বলে উঠলো, ‘তুমি ম্যানেজমেন্টের স্টুডেন্ট! তার মানে তো নিশ্চয়ই তুমি এর সম্পর্কে অনেক কিছু জানো? আমারও না এটা নিয়েই পড়া উচিত ছিল। তাহলে অনেক সুবিধা হতো।’
অ্যালেন বলল, ‘পড়োনি তো কি হয়েছে! আমি কিন্তু তোমাকে এ ব্যাপারে হেল্প করতে পারি।’
হৃদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল,
‘সত্যি?’
পরক্ষণেই আশপাশের কাস্টমারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু এখন তো…..
অ্যালেন বলে উঠলো, ‘সমস্যা নেই। আমি ওয়েট করতে পারি। আমার হাতে তেমন কোন কাজ নেই। তুমি নিশ্চিন্তে নিজের হাতের কাজ শেষ করে নাও।’
হৃদি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘শিওর?’
অ্যালেন মৃদু হেসে বলল, ‘হুম।’
এরপর হৃদি কাউন্টারের ওখানে চলে গেলো। দরজার কাছের টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসলো অ্যালেন। সেদিকে ইশারা করে জেরিন হৃদিকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে রে?’
এরপর হৃদি জেরিনকে তার সাথে হওয়া অ্যালেনের কথোপকথন খুলে বলল। জেরিন উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘তাহলে তো ভালোই। এই অ্যালেন ছেলেটাকে আমার প্রথম থেকেই খুবই পছন্দ হয়েছে। কি সুন্দর ভালো নমনীয় স্বভাবের একটা ছেলে। জেন্টেল অ্যান্ড কাইন্ড। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। তোর ঐ রাইয়ানের মতো না, মুখটাকে সবসময় এমন সিরিয়াস করে রাখে দেখলে মনে হয় মাত্র যেন ঘুম থেকে উঠেছে।’
হৃদি একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলো জেরিনের দিকে তাকিয়ে। জেরিন পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, অ্যালেন হঠাৎ আমাদের এতো হেল্প করতে চাইছে কেন? আমার মনে হয় ওঁ তোর উপর ক্রাশ খেয়েছে।’
হৃদি ভ্রু ভাঁজ করে বলল, ‘কি সব হাবিজাবি বলিস! তোর এই স্বভাব এখনো গেলো না। কোন ছেলেকে কথা বলতে দেখলেই তার সাথে আমার ক্যামিস্ট্রি বানিয়ে ফেলিস। অ্যালেন আমার হাজবেন্ডের বন্ধু। আর আমি ম্যারিড। এগুলো না বকে কাস্টমারদের দিকে খেয়াল রাখ।’

কাজের চাপ কমতে কমতে অনেক দেরি হয়ে গেলো। রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ রেস্টুরেন্ট খালি হলো। এতক্ষণ বসে বসে হৃদির জন্য অপেক্ষা করলো অ্যালেন। সব কাস্টমার চলে গেলে হৃদি অ্যালেনের টেবিলে বসতে বসতে বলল, ‘সরি অ্যালেন, তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। তোমাকে বললাম আজ থাক তবুও তুমি গেলে না।’
অ্যালেন বলল, ‘সমস্যা নেই। আমার খারাপ লাগছিল না। সেই তো একা একা বোরিং-ই হতে হতো। এখানে থেকে সময়টা কাটলো। তোমার কাছে এখন ল্যাপটপ আছে?’
‘আমারটা তো নেই। জেরিনেরটা আছে।’
হৃদি জেরিনকে তার ল্যাপটপ দিতে বলল। জেরিন দিয়ে গেলে অ্যালেন সেটা অন করে বিজনেস আর ম্যানেজমেন্টের কিছু মেথড রিসার্চ করে বোঝাতে লাগলো হৃদিকে। স্টুডেন্ট সে বেশ ভালো ছিল। সহজ করে হৃদিকে অনেককিছুই ব্যাখা করে দিলো। সবকিছু ভালোভাবে বোধগম্য হওয়ায় হৃদিও খুশি। দুজনের মধ্যে কাজ নিয়ে অনেক কথাই হলো। একপর্যায়ে জেরিন এলো অ্যালেনের জন্য কফি নিয়ে। ট্রে সমেত রেখে দিলো সামনে। অ্যালেন ট্রে থেকে বেখেয়ালে কফির গ্লাস হাতে নিতে গেলে কিছু কফি ছিটকে পড়লো তার হাতে। কফি পড়তে দেখে কিছু উপলব্ধি করার আগেই অ্যালেন হাত জ্বলে উঠার মতো শব্দ করে উঠলো। পরক্ষণেই তার খেয়াল হলো কোন জ্বলছে না। হৃদি এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এটা কোল্ড কফি ছিল।’
হৃদি হাসতে লাগলো। অ্যালেনও হেসে ফেললো তার সাথে। হাসতে হাসতেই হৃদি একটা টিস্যু এগিয়ে দিলো অ্যালেনের কাছে। অ্যালেনও হেসে কিছু বললো সাথে। কাঁচের গ্লাসের বাইরে থেকে রাস্তায় গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে সেদিকটায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো
রাইয়ান। এরপর দৃষ্টি সামনে নিয়ে উঠিয়ে দিলো জানালার কাঁচ। পাশের সিটে পরে থাকা দুটো কাপ আইসক্রিমের প্যাকেট জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো।

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-১৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

বাসার পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে। প্রতিদিনকার মতো হৃদির উচ্ছ্বসিত কোন কথা বা মিঁয়োর সাথে দৌঁড়ঝাপের কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। সবকিছুই নিঝুম, নিস্তব্ধ। বিছানা ছেড়ে উঠে রুমের বাইরে চলে এলো রাইয়ান। লিভিং এরিয়ার এসে দেখলো সোফার কুশন কভার উঠিয়ে অস্থির ভাবে কি যেন খুঁজে চলেছে হৃদি। রাইয়ান গিয়ে ডাকলো,
‘হৃদি, হৃদি।’
হৃদি শুনতে পেলো না। একইভাবে সোফার উপরে নিচে খোঁজ চালাতে লাগলো সে। এবার রাইয়ান জোরে ডেকে উঠলো, ‘হৃদি!’
হৃদি সম্বিৎ ফিরে পাবার মতো বলল, ‘হুম?’
রাইয়ান বলল, ‘কি খুঁজছো?’
হৃদি চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘আমার আংটি খুঁজে পাচ্ছি না রাইয়ান।’
‘কিসের আংটি?’
‘যেটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। আমাদের বিয়ের।’
রাইয়ান হৃদির দিকে তাকিয়ে রইলো। হৃদির চোখে মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। কিছু সময়ের মধ্যে চেহারাই পাল্টে গেছে যেন। হৃদি আবারো ব্যগ্র হয়ে বাসার এদিক সেদিক, সকল কোণা, ড্রয়ার সব কিছু তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো। হৃদিকে দেখে মনে হচ্ছিল শুধু একটা আংটি নয় হৃদির জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু হৃদি খুঁজে পাচ্ছে না। রাইয়ানও হৃদির সাথে হাত লাগালো। বেডরুম, বাথরুম, ক্লজেট, কিচেন সবকিছু ভালো ভাবে সার্চ করেও কিছু পেলো না তারা। রাইয়ান ক্লান্ত হয়ে পরলো। কিন্তু হৃদির মধ্যে কোন ক্লান্তি নেই। উদ্বিগ্ন হয়ে সে শুধু খুঁজেই যেতে লাগলো তার আংটি। বিছানার চাদর উল্টে কিছু না পেয়ে হৃদি শঙ্কিত হয়ে মাথায় হাত দিল। রাইয়ান বুঝতে পারছিল না সামান্য একটা সোনার আংটির জন্য হৃদি এমন অস্থির হয়ে কেন উঠেছে। তবুও হৃদির এমন অবস্থা দেখে সে কাছে গিয়ে বলল, ‘হৃদি রিল্যাক্স।’
হৃদি বলে উঠলো, ‘আমি বুঝতে পারছি না আংটিটা আমার থেকে হারালো কিভাবে? আমি কখনো আংটি টা আমার আঙ্গুল থেকে খুলতামও না। সবসময় কাছে রাখতাম। কিন্তু আজ ওটা একেবারে হারিয়েই গেলো! এত বড় ভুল আমি কিভাবে করে ফেললাম!’
পরক্ষণেই বলল, ‘আচ্ছা রাইয়ান, চলো না আমরা পুলিশের কাছে যাই। হারিয়ে যাওয়া জিনিস পাওয়া নিয়ে তারা তো আমাদের হেল্প করতে পারে!’
রাইয়ান বলল, ‘হৃদি কি বলছো এসব! সামান্য একটা সোনার আংটির জন্য কে পুলিশের কাছে যায়? আচ্ছা ঠিকাছে, আমি তোমাকে এরকম আরেকটা আংটি এনে দেবো। ইনফ্যাক্ট আরো বেটার এক্সপেন্সিভ দেখে কিনে দেবো।’
হৃদি ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘রাইয়ান তুমি এসব কি বলছো! ওটা আমাদের বিয়ের আংটি ছিল। মোটেও সামান্য না। ওটা আমার কাছে সবথেকে দামী। আরো অনেক এক্সপেন্সিভ কিছুও ওটার কখনো রিপ্লেসমেন্ট হতে পারবে না।’
রাইয়ান বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে হৃদির মুখপানে তাকিয়ে রইলো। হৃদি কিছু ভেবে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ‘আমি বরং কফিশপে গিয়েও একবার দেখে আসি। সেখানেও থাকতে পারে।’
এই বলে হৃদি ড্রয়ারের উপর থেকে ব্যাগ নিয়েই দ্রুত বাইরে চলে গেলো। রাইয়ান কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।

কফিশপে গিয়েও আংটি খুঁজে পেলো না হৃদি। তার মন খুবই খারাপ লাগতে লাগলো। মুখের হাসি আজ পুরোপুরিই গায়েব হয়ে গেছে তার। কোনকিছুই ভালো লাগছে না। জেরিনেরও আজ আগে থেকেই কফিশপে আসার কথা ছিল না। হৃদি আর সেদিন কফিশপ খুললোই না। ‘Closed’ লেখা কার্ড ঝুলানো দরজা বন্ধ করে কফিশপেই চুপচাপ বসে রইলো। দুপুর গড়িয়ে গেলে রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে চলে এলো। সেখানে কিছু বাচ্চারা নিজেদের আনন্দে খেলাধুলো করছে। একটা বেঞ্চ দেখে সেখানেই উদাস মনে বসে রইলো হৃদি। পার্কে থাকা টেডি মাসকটের সাথে বাচ্চারা খেলছিল। সেটি একসময় দুলতে দুলতে উদাসমুখের হৃদিকে দেখে থেমে গেলো। মজাদার অদ্ভুত অঙ্গিভঙ্গি করে হৃদির হাতে একটা হলুদ বেলুন দিলো। হৃদি দেখলো বেলুনটিতে একটা স্মাইলি ফেস আঁকা। টেডি বিয়ার তাকে হাত দিয়ে হাসার ইশারা করলো। টেডির দিকে তাকিয়ে মন খারাপের মধ্যেই স্মিত হাসলো হৃদি।
___________________________________________________

জেরিন আর জিশানের বারান্দাটা একদম পাশাপাশি। শুধু মাঝখানে একটা দেয়াল। সামনে খোলা। জেরিন এই মুহুর্তে দেয়ালের কাছে ঘেঁষে রেলিংয়ের উপর উবু হয়ে ওপাশের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছে। তার হাতে একটা ফোন। ফোনের ক্যামেরা অন করে সে জুম করে ভেতরে জিশানকে খুঁজে চলেছে। একটু আগে জিশানকে রাইয়ানের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছে সে। কি কথা বলছে সেটাই শোনার চেষ্টায় আছে জেরিন। জেরিন ক্যামেরা জুম করে দেখলো জিশানকে দেখা যাচ্ছে না। হাতটা আর ওদিকে যাচ্ছেও না। জেরিন ফোনটা পকেটে ঢুকালো। দেয়াল আগলে ধরে ওপাশের বারান্দার রেলিংয়ে পা তুলে দিয়ে আরো একটু আগাতে চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ পা ফসকে গিয়ে পরে গেলো বাইরে। সময়মতো দু হাত দিয়ে রেলিংয়ের গ্রিল ধরে ফেলায় সেখানেই ঝুলতে লাগলো আর ভয়ে চেঁচাতে লাগলো। জিশান তাড়াতাড়ি রুম থেকে ছুটে আসে। চারপাশে তাকিয়ে কিছু না দেখে জিশান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এমন শব্দ আসছে কোথা থেকে?’
জেরিন বলল, ‘আরে ও স্টুপিড, নিচে তাকাও নিচে।’
জিশান রেলিংয়ে হাত রেখে নিচে তাকিয়ে দেখলো জেরিন তার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলছে। জিশান একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
‘সবসময় সবার মাথায় উঠে নাচতে থাকা মিস জেরিন আজ হঠাৎ নিচে ঝুলছে কেন?’
‘মনের সুখে। ইডিয়ট, এটাও বুঝতে পারছো না। আমি পরে গেছি।’
জিশান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘এক মিনিট, তুমি আমার বারান্দার এদিকে আসলে কিভাবে?’
জেরিন থতমত খেলো। কথা কাটাতে বলল,
‘এখন কি এই প্রশ্নের সময়! তোমার মাথায় কি কোন বুদ্ধি নেই। আমাকে উঠাও আগে এখান থেকে।’
‘আমি কি তোমাকে উঠানোর সার্ভিসে আছি নাকি?’
‘তোমার মধ্যে কি মানবতা বলতে কিছু নেই?’
‘আগে ভালো করে ‘প্লিজ!’ বলো।’
জেরিন মুখটা ভোঁতা করে বলল, ‘প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!’
জিশান ওর হাত বাড়িয়ে দিয়ে জেরিনের হাত ধরলো। টেনে উঠাতেই যাবে তার আগে কিছু মনে পরার নাটক করে থেমে বলল,
‘একটু আগে যেন কি বলছিলে….স্টুপিড, ইডিয়ট, মাথায় বুদ্ধি নেই।’
জেরিন বিগলিত হয়ে বলল,
‘আরে ওটা তো আমি এমনি এমনিই বলে ফেলেছি। সিরিয়াসলি না।’
‘সরি বল!’
জেরিন মুখটা পেঁচার মতো করে আস্তে আস্তে বলল, ‘সরি!’
‘কি? কিছুই তো শুনতে পেলাম না।’
জেরিন এবার জোরে বলল, ‘সরি!’
জিশান হাত দিয়ে টেনে উঠালো জেরিনকে। বারান্দায় উঠে জেরিন খানিক হাঁপিয়ে নিলো। নিজের ঠাট বজায় রেখে আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘দরজা কোনদিকে?’
জিশান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেন?’
‘আমি যাবো কোনদিক দিয়ে?’
‘যেদিক দিয়ে এসেছিলে সেদিক দিয়েই চলে যাও।’
কথাটা বলেই জিশান ভেতরে চলে গেলো আর জেরিন আরেকবার রেলিং দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে জিশানের পেছন পেছন ডাকতে লাগলো।
___________________________________________________

আমি রাইয়ান৷ লেখার শুরুটা বোধ হয় একটু নাটকীয় হয়ে গেলো। হৃদির মতো আমি অতো ভালো শব্দগুচ্ছ গুছিয়ে লিখতে পারি না। আসলে, আমি এসব কেন লিখছি আমি তাও জানি না। হয়তো মনকে শান্ত করতে। হয়তো হৃদির কথা রাখতেই! হৃদি বলেছিল যেসব কথা মনকে বিচলিত করে, হয়রানি করে সেসব অপ্রকাশিত শব্দ একটি সাদা পৃষ্ঠায় লিখে ফেলতে। আচ্ছা, একটা মানুষের জীবনে কি সবসময় সবকিছুই একদম পরিষ্কার, স্পষ্ট থাকে? নাকি মাঝে মাঝে চেনা দৃশ্যই দৃষ্টিকোণের সামনে আপনার আড়ালেই আস্তে আস্তে হয়ে উঠে অস্পষ্ট! কখনো কখনো আমরা নিজেদের নিয়ে বড্ড বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। নিজেকে চেনার মিথ্যে বিশ্বাসে নিজের কাছেই হয়ে উঠি অপরিচিত। মাঝে মাঝে একটি ক্ষুদ্র ঘটনার আবির্ভাব আমাদের সামনে সেই সত্য হয়ে ধরা দেয়। আর আমরা সেই মুহুর্তে শুধু অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকি।

হৃদি আমার স্ত্রী। যে নিজের বিয়ের আংটির জন্য রাতের গভীরতার কোন হিসেব না করে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে এখনও খুঁজে চলেছে। আজ সারাদিনের এই একটাই লক্ষ্য হয়ে আছে তার। খুবই উচ্ছ্বসিত স্বভাবের মেয়ে হৃদি। ওঁর মন খারাপ ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। মুখে ভেসে উঠে চিরাচরিত তার নম্র হাসি। ব্যতিক্রম হলো শুধু আজ। আজ সারাদিন হৃদিকে আমি হাসতে দেখিনি৷ আংটি হারানোর ফলে মেঘরাজ্যের যেই সুদৈর্ঘ্যের ভেলা তার মুখের পানে পাড়ি জমিয়েছে তা এখনো নিশ্চল। আজ আমার এই অ্যাপার্টমেন্টেও কোন হাসি ঝংকারের শব্দ শোনা যায়নি। ঠিক যেমন সেই দিনটার মতো, যেদিন সূর্যের আলো ফিকে হয়ে সানশাইন সরে গিয়ে দিনটা হয়ে উঠে মেঘলাটে, বিষন্ন। হৃদি বাইরের গার্ডেনে আংটি খুঁজছে। আরো অনেকক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে সে। ফিরে বসতে না বসতেই তার মনে পরেছে গতকাল বিকেলে সে একবার অ্যাপার্টমেন্টের সামনের গার্ডেনেও গিয়েছিল৷ তৎক্ষনাৎ পুনরায় বাইরে চলে যায় হৃদি। তার উদ্বিগ্নতাই বলে দিলো গতকাল পা রাখা কোন স্থানই বাদ রাখেনি সে। আমি ডাইনিং টেবিলে সাদা টিশার্ট আর কালো জিন্স পরে একাকি বসে ছিলাম। হঠাৎ বাইরে থেকে আসা বিকট বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে সজাগ হলো ইন্দ্রিয়। খানিক পর পর আকাশের গর্জে উঠা ধ্বনি বৃষ্টির জানান দিয়ে চলেছে। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে আমি বাইরে চলে এলাম। উদ্দেশ্য ছিল হৃদিকে ডাকতে যাওয়া। হৃদিকে পেলাম টেনিস কোর্টের ওখানে। তার গায়ে একটা ক্রিম কালারের টপস আর জিন্স। মাথার চুলগুলো খোলা। যা দু হাত দিয়ে কানের দু পাশে গুঁজে টেনিস কোর্টের চারপাশে একমনে আংটি খুঁজে চলেছে সে। হৃদিকে ডাকতে এসেও আর ডাকলাম না আমি। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তার সাথে সাথে আশেপাশে আমিও খুঁজলাম। আকাশের অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। একটু পরপর আলোকিত হয়ে কাঁপিয়ে তুলছে অন্ধকারকে। টেনিস কোর্টের পাশে একটা বেঞ্চ দেখে হৃদি স্থির হয়ে দাঁড়ালো। স্মৃতিতে ঝাপ দিয়ে ঠাওর করলো গতকালের ঘটনা। যখন মিঁয়োকে নিয়ে বাইরে এসে সে ঠিক এখানটাতেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। ওঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কাঁদা পানিতে পরে যাওয়ায় সেখানে হাত দেওয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পরেছিল হৃদির। আংটিতে নোংরা লেগে যাবে ভেবে হৃদি হাত থেকে আংটি খুলে এই বেঞ্চির উপরই রাখে। পাশে বসায় মিঁয়োকে। হাত ধুয়ে এসে মিঁয়োকে আবিষ্কার করে টেনিস কোর্টের পাশেরই এক গাছের কোটরের বড় গর্তে। তা দেখে হন্তদন্ত হয়ে হৃদি গাছের কোটর থেকে মিঁয়োকে শাসিয়ে তাড়াতাড়ি নামায়। মিঁয়োকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বেমালুম ভুলে যায় আংটির প্রসঙ্গ।

হৃদি তাড়াতাড়ি বেঞ্চের আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে দেখে। বাকি জায়গাগুলো আগেই খুঁজে রাখা। এমন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। যাকে বলে একদম ঝুম বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি শব্দে মুহুর্তেই জেগে উঠে অন্ধকার। ল্যাম্পপোস্টের উজ্জ্বল আলোতে বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ক্ষণিকের মধ্যেই ভিজিয়ে তোলে আমাদের। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সেখানেও কিছু না পেয়ে আশাহত হয় হৃদি। চোখ পরে সেই বৃহৎ গাছের কোটরে। ভ্রু সংকুচিত হয়। হৃদি গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছের কোটর অব্দি দৃষ্টি নাগাল পায় না। হৃদির ইতস্তত নেত্র আমার থেকে বারবার গাছের কোটরের দিকে যেতে থাকে। তার মুখের ভাব বুঝতে পারি আমি। আস্তে করে গিয়ে তার সামনে বসি। ইশারা করি কাঁধের দিকে। আমার গলা পেঁচিয়ে কাঁধে উঠে হৃদি। আমি উঠে দাঁড়াই। এবারে দৃষ্টির নাগালে আসলেও অন্ধকারে কিছু বোঝা কঠিন। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে গাছের কোটরের ভেতরে সোনালি কিছুর ঝিলিক চোখে পরে হৃদির। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে হৃদি তুলে নেয় সেটি। অবশেষে পুনরায় হৃদির হাতে এসে ধরাই দেয় আমাদেরই বিয়ের আমার নিছক হেয়ালিতে দেওয়া সেই নগন্য সোনার আংটি। হৃদির ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে উঠে। চোখে মুখে এক অনাবিল নির্মল হাসি। আমি একদৃষ্টিতে হৃদির মুখপানে তাকিয়ে থাকি। হৃদি ঠোঁট মেলে চোখে উথলে পরা সিক্ত আনন্দের সাথে হাত উঁচু করে আংটি টি বৃষ্টির পানির মধ্যে তুলে ধরে নাড়াতে থাকে। আমি এক ধরণের অস্থিরতা অনুভব করে দৃষ্টি নামিয়ে ফেলি। আমি সবসময় জানতাম আমি যেমনটা ভেবে রাখি তাই করি। কখনো আমার ভাবনার বাইরে আমি যাই না। এটাই আমি। কিন্তু সেদিনের সেই ঝুম বর্ষনের রাতে বৃষ্টি চরম অপছন্দ করা আমি হৃদিকে কাঁধে নিয়ে জবজবে ভিজে ঠিক সেই মুহুর্তেই প্রথম উপলব্ধি করি কিছু একটা পরিবর্তন আমার ভেতরে হয়েছে। সবকিছু অবিকল আগের মতো নেই। আমারই অলক্ষ্যে সর্বদা জাগ্রত মস্তিষ্কের অগোচরে খুবই নিঃশব্দের সাথে ভেতর গহ্বরের কিছু পূর্ব স্থান থেকে…….. সরে গেছে!

চলবে,