My First Crush part-9+10

0
226

#My_First_Crush
#পর্ব-০৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

ফ্লোরিডাকে বলা হয় চির বসন্তের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য স্টেটগুলোতে যেখানে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচেই থাকে বেশিরভাগ সময়, সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকার শেষ স্টেট ফ্লোরিডায় বছরের প্রায় বারো মাসই থাকে বসন্ত। আবহাওয়া চমৎকার। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। এখানে চারপাশে সবুজের সমারোহ। পরিষ্কার ঝকঝকে পাকা প্রশস্ত রাস্তাগুলোর দুপাশে ছবির মতো সাজানো সারি সারি গাছ। গাছের ডালপালা জুড়ে সবুজ পাতার মেলা। সবকিছু এত সবুজ যে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনই এক সবুজে ঘেরা পাকা রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে চলছিলাম। রাস্তাটা খুব নির্জন। মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ছে না। আমি এসেছিলাম আমার কফিশপের জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনতে। এখন ফেরার জন্য গাড়ি পাচ্ছি না। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছি। আমার পরনে হালকা ম্যাজেন্ডা কালারের স্কার্ট। পায়ে হোয়াইট কালারের এক জোড়া স্নেকার্স। দু হাতে কিছু ব্যাগপত্র। হাঁটতে হাঁটতে আমি রাস্তার মোড়ে চলে এলাম। এমন সময় একটা ক্যাব রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে আমি হাত নাড়িয়ে থামতে ইশারা করলাম। কিন্তু থামলো না। অগত্যা কিঞ্চিৎ বিরক্তি আর হতাশ মুখে পেছনে ঘুরতেই দেখলাম আমার ঠিক বিপরীত মুখের রাস্তায় একটি গাড়ি গাছের সাথে সংঘর্ষ হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ধোঁয়া বের হচ্ছে গাড়ি থেকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। গাড়ির ভাঙা কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলাম সুদর্শন একজন ইংরেজ যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় সিটে পরে আছেন।
___________________________________________________

জেরিনের পাশ ঘেঁষে একটা বৃহদাকার কুকুর হেঁটে গেলো। তবুও জেরিনের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। অন্যসময় হলে সে লাফিয়ে আকাশে উঠে যেতো। কুকুর ভীষণ ভয় পায় সে। তবে আজ কথা ভিন্ন। আশেপাশের জাগতিক বিষয় ভুলে গিয়ে সে আজ ব্যস্ত একজনকে খুঁটিয়ে দেখতে। বেশ খানিক সময় ধরে সে জিশানকে ফলো করে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে গ্রে কালারের হুডি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে জিশান গাড়ি থেকে নেমে একটা অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর জেরিন দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটা গাছের পেছনে। আড়াল থেকেই জিশানের দিকে নজর রেখে চলেছে সে। এমন সময় জিশান ফোন কানে নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, রাইয়ান আমি তোর অফিসের নিচেই দাঁড়িয়ে আছি। তুই নিচে আসবি নাকি আমি আসবো?’
জেরিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ফোন রেখে জিশান যখনই বিল্ডিংয়ের ভেতর প্রবেশ করতে যাবে জেরিন তাড়াতাড়ি জিশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে আটকে বলল,
‘এই যে মিস্টার, থামো।’
সামনে দাঁড়ানো বব কাট চুলের মেয়েটির মুখে বাংলা শুনে জিশান চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে বলল, ‘সরি, তুমি?’
জেরিনের কাট কাট কথা, ‘কেন বন্ধুর বিয়েতে বুঝি দেখোনি! ব্রাইডালের একমাত্র ফ্রেন্ড বলতে ছিলো তো শুধু একজনই। নাকি বন্ধুর দিক থেকে কখনো নজরই সরাও না।’
এমন রসকষহীন কথা শুনে জিশান অন্যদিকে তাকিয়ে একবার নিজের চোখের মণি ঘোরালো। তারপর আবার জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তো, বলুন আমার বন্ধুর বউয়ের একমাত্র বান্ধবী, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?’
জেরিন একবার জিশানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছিলে?’
জিশানের সহজ উত্তর, ‘আমার বন্ধুর কাছে।’
জেরিন নাক ফুলিয়ে বলল,
‘তোমার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে। কোথায় একটু পার্সোনাল স্পেস দেবে তা না! যখন তখন ওদের বাসায় চলে যাচ্ছো।’
‘এটা ওদের বাসা?’
জেরিন আশেপাশে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। জিশান ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
আবারও বিল্ডিংয়ের ভেতর যেতে উদ্যত হলে জিশানকে থামিয়ে জেরিন বলল,
‘তুমি তো ভালোই! থামানোই যাচ্ছে না একেবারে। আর এসব কি ছোট মোটো প্যান্ট পড়ে বন্ধুর সাথে দেখা করতে আসো!’
‘আমার প্যান্টে কি সমস্যা? আমি কি জব ইন্টারভিউ দিতে এসেছি? এই তোমার মাথায় কি কোন সমস্যা আছে? থাকলে বলতে পারো আমার একটা সাইক্রিয়াট্রিস্ট বন্ধু আছে। আমি ডিসকাউন্টের সাথে পরে অ্যাপায়েন্টমেন্ট নিয়ে দিতে পারি। এখন আমার তাড়া আছে।’
জেরিন দাঁত কিড়মিড় করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জিশান ভেতরে চলে গেলো। জেরিন নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বলল, ‘বেশ, আমিও পুরোপুরি খতিয়েই দেখবো। কি চলছে না চলছে বের করে তবেই ছাড়বো। আমার ফ্রেন্ড আর তার হাসবেন্ডের লাইফে আমি কোন থার্ড পার্টি ঢুকতে দেবো না। জেরিনকে বোকা বানানো এতো সহজ না।’

এদিকে জিশান রাইয়ানের কেবিনে ঢুকেই বলল, ‘রাইয়ান, তাড়াতাড়ি চল। অ্যালেন এক্সিডেন্ট করেছে।’
জিশান রাইয়ানকে নিয়ে সোজা চলে এলো হসপিটালে।
রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে জেনে এলো অ্যালেনের কেবিন নম্বর। সেখানে গিয়েই অবাক হলো দুজন। দেখলো হৃদি বসে আছে কেবিনের বাইরে। বরাবর হৃদিও সমান অবাক হলো রাইয়ানকে দেখে। এগিয়ে এলো ওদের দিকে। রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি এখানে?’
ঠিক তখনই একটা নার্স এসে হৃদিকে বলল,
‘তোমার বয়ফ্রেন্ডের কোন মেডিকেল হিস্ট্রি আছে?’
জিশান আর রাইয়ান দুজনেই একসাথে ভ্রু কুঁচকে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি দ্রুত অস্বীকার করে বলল,
‘না, না সে আমার বয়ফ্রেন্ড না। আমরা তো স্ট্রেঞ্জার। আমি রাস্তায় তাকে এক্সিডেন্ট অবস্থায় পেয়ে নিয়ে এসেছি।’
জিশান এবার নার্সের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনি আমার সাথে আসুন। অ্যালেন আমাদের বন্ধু। আমি আপনাকে বলছি।’

খানিকবাদেই ডক্টর বের হলো কেবিন থেকে। তার থেকেই জানা গেলো অ্যালেন ঠিক আছে। গাড়িতে থাকা এয়ার ব্যালুনের জন্য তেমন বড় কোন ক্ষতি হয়নি। মাথায় একটু চোট পেয়েছে। জ্ঞান ফিরতে খানিক সময় লাগবে। তবে হসপিটালে আনতে বেশি দেরি হলে ব্লিডিংয়ের জন্য আরো সমস্যা হতে পারতো।
এরপর রাইয়ান অ্যালেনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর রাইয়ানের সামনে এমন উইয়ার্ড সিচুয়েশনে পড়ার অস্বস্তির জন্য হৃদিও সেই ফাঁকে সেখান থেকে চলে এলো।
___________________________________________________

বিকেলের পড়েই পরিবেশে বাতাসের আধিক্য যেন একটু বেশি হয়ে গেলো। ফ্লোরিডায় আরেকটি চমৎকার বিষয় হলো এখানে প্রতিদিন বেশ কয়েকবার করে বৃষ্টি হয়। আর বৃষ্টি পনেরো মিনিটের বেশি কখনো থাকে না।
হৃদি ভাবলো বুঝি বৃষ্টি নামবে। বারান্দা থেকে জামাকাপড় নামাতে লাগলো সে। এমন সময় হৃদির কমলা রঙের ফুলতোলা একটা পাতলা স্কার্ফ হাত থেকে নিচে পড়ে গেলো। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ঠিক গিয়ে পড়লো একটা বড় গাছের ডালে। হৃদি উপর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেই তাড়াতাড়ি ছুটলো স্কার্ফ নামাতে। বিল্ডিং থেকে নেমে গাছটির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সে। যেই ডালটিতে স্কার্ফ বেঁধেছে সেটা বেশ ভালোই উঁচু বলা যায়। হৃদি কোমরে হাত রেখে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। অগত্যা প্যান্ট একটু টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলো গাছে। গাছের উপরে উঠে সেই মোটা ডালটিতে গিয়ে নামিয়ে নিলো স্কার্ফ। গাছে তো উঠে পরলো কিন্তু এখন নামতে গিয়ে দেখে আর নামতে পারছে না হৃদি।। নিচে তাকাতেই মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো তার। এতো উঁচু ডাল থেকে নামবে কিভাবে সে? হৃদি ভয়ে ভয়ে একবার নিচে তাকায়। আবারো চোখ মুখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলে। আস্তে আস্তে নামার জন্য ঘুরতে চেষ্টা করে সে। পড়ে গেলে কি হবে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ হাত ফসকে পড়েও যায়। দু হাত দিয়ে শুধু ডাল ধরে ঝুলতে থাকে। হৃদি কাঁদো কাঁদো স্বরে বিলাপ শুরু করে দেয়। নিচের দিকে একবার চোখ নিয়েই ভাবতে থাকে লাফ দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই আর৷ আরো একবার ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের মতো বলতে থাকে,
‘প্লিজ প্লিজ আল্লাহ এবারের মতো বাঁচিয়ে নিও। আমার হাত পা যেন না ভেঙে যায়। প্লিজ আল্লাহ প্লিজ!’
বিলাপ করতে করতেই হৃদি ভয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ডাল থেকে হাত ছেড়ে দিলো। ঠিক সেই সময়েই রাইয়ান এসে পেছন থেকে হৃদির কোমর জাপটে ধরে ফেলে নামিয়ে দিলো তাকে। অবাক হয়ে চোখ খুললো হৃদি। বেঁচে গেছে বলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। রাইয়ান বলল,
‘কি করছিলে?’
হৃদি হাতের স্কার্ফ দেখিয়ে বলল, ‘এটা উপর থেকে পড়ে ডালে বেজে গিয়েছিল। সেটা নামাতে গিয়েছিলাম।’
‘হেই, এটা নামাতে গাছে উঠা লাগে! এটা দিয়েই তো নামাতে পারতে।’
রাইয়ানের হাতের ইশারার দিকে তাকিয়ে হৃদি দেখলো গার্ডেনের দিকে বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষেই একটা লম্বা কাঠের দন্ডের মতো দাঁড় করানো। হৃদি বলল,
‘আমি খেয়াল করিনি।’
রাইয়ান ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসির রেশ ফুটিয়ে একবার মাথা নেড়ে ভেতরে যেতে উদ্যত হলো। তারপর আবারো থেমে হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বাসায় চলো।’
হৃদিও আস্তে আস্তে চলে গেলো রাইয়ানের সাথে।

এরপর রাত হলো। রাইয়ান তার স্টাডি রুমে বসে অফিসের কাজ করছিলো। এমন সময় দুটো কফির মগ হাতে হৃদি এলো সেখানে। একটা রাইয়ানের দিকে দিয়ে আরেকটা নিজে নিয়ে চেয়ার টেনে সেখানেই বসে পড়লো। সামনে বসে বসে রাইয়ানের কাজ দেখতে লাগলো হৃদি। এক ফাঁকে হৃদি জিজ্ঞেস করলো,
‘রাইয়ান, তোমার বন্ধু যার এক্সিডেন্ট হয়েছিল তার কি অবস্থা এখন?’
‘জ্ঞান ফিরেছে। এখন ঠিক আছে।’
হৃদি হড়বড় করে বলল, ‘তখন হসপিটালে নার্সের ওমন কথায় তুমি কিছু মনে করোনি তো?’
‘মনে করার কি আছে? তুমি তো ভালো কাজই করেছো। নার্সই ভুল বুঝেছে।’
রাইয়ান কিছু মনে করেনি শুনেই স্বস্তিতে বসলো হৃদি। রাইয়ান কফিতে একটা চুমুক দিয়ে হৃদির দিকে তাকালো। তারপর মগ রেখে বলল,
‘কিন্তু এই, আমি শুনেছি যেখানে এক্সিডেন্টটা হয়েছে ঐ জায়গাটা খুবই নির্জন। তুমি এমন জায়গায় একা একা কেন যাও? এটা কিন্তু সেফ না। ধরো, সেখানে কোন খারাপ দুষ্ট ছেলের দল তোমার পিছু নিলো তখন তুমি কি করতে?’
হৃদি ভাবনার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
‘তখন আমি পেছনে ঘুরতাম আর বলতাম…..
তারপর হঠাৎ মজার ভঙ্গিতে রাইয়ানের দিকে আঙ্গুল তাক করে হেসে জোরে বলে উঠলো,
‘স্ট্যাচুউউউ!’
রাইয়ান চাপা সুক্ষ্ম হাসির সাথে চোখ সরু করে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি হাসতে লাগলো। তারপর খানিক পর বলল, ‘আসলে আমি গিয়েছিলাম কফিশপের জন্য মালামাল কিনতে। শুনেছিলাম ওখানকার একটা শপে এখানকার তুলনায় স্বল্প মূল্যে
বিক্রি হয়। কিন্তু গিয়ে দেখি সেই একই৷ তেমন কিছু আনতে পারিনি। এসব ব্যবসায় বাজেট ম্যানেজ করাটা যে এতো কঠিন। আমি তো ঠিকমতো সামলাতেই পারি না।’
হৃদির মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো। রাইয়ান বলল,
‘বাজেট ম্যানেজ! নিয়ে আসো তো তোমার ফাইলটা।’
হৃদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল,
‘তুমি আমার হেল্প করবে?’
‘চেষ্টা করে দেখতে পারি।’
হৃদি আনন্দিত হয়ে চলে গেলো বাজেট সম্পর্কিত ফাইল আনতে। ফিরে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে এবার রাইয়ানের পাশে গিয়ে বসলো। রাইয়ান ফাইল খুলে সবকিছু ভালো করে দেখে নিলো একবার। তারপর হৃদিকে বলল,
‘একেক সময় একেক শপ থেকে ইনগ্রেডিয়েন্টস না কিনে তুমি কিন্তু একটা শপের সাথেই যুক্ত থেকে মালামাল কিনতে পারো। সবসময় তার থেকেই যদি কেনার কথা বলো তাহলে নিশ্চয়ই একটা ভালো ডিসকাউন্টের সাথে নির্দিষ্ট একটা এমাউন্ট ম্যানেজ করতে পারবে।’
অপচয় হচ্ছে এমন কিছু বিষয় বাদ দেওয়ার কথা বলে রাইয়ান বাজেট নিয়ন্ত্রণের আরো বেশ কিছু ট্রিকস হৃদিকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রোপার একটা বাজেট চার্ট তৈরি করে দিলো। হৃদি সব বুঝতে পেরে খুশি হয়ে উঠলো। আবারো কোন ফাজলামো করতে গেলে রাইয়ান কলম দিয়ে ওর মাথায় টোকা দিয়ে মনোযোগ দিতে বলল। এভাবেই কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে ওদের সামান্য হাসি ঠাট্টাও চলতে লাগলো আর কাজও।
___________________________________________________

দিনের মধ্যে আমার সবথেকে প্রিয় মুহুর্তের কথা যদি বলতে চাই তাহলে বলতে হয় চোখ খোলার পর সকালের এই মুহুর্তটি। যখন আমি সদ্য ঘুম ভাঙা মুখ নিয়ে সামনে তাকাই আর দেখতে পাই বিছানার উপর ঘুমে মগ্ন রাইয়ানের নিশ্চুপ মুখটি। এই মুহুর্তটা খুব করে বিশেষ, কারণ আমি যতক্ষণ ইচ্ছে বিনা দ্বিধায়, বিনা জড়তায় রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি। আমি আনমনেই হেসে উঠলাম। দেখলাম রাইয়ান আমার দিক বরাবর পুরোপুরি কাত হয়ে শুতে গিয়ে তার এক হাত বিছানার বাইরে চলে এলো। আমি সোফা থেকে নেমে রাইয়ানের সামনে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। রাইয়ানের হাতটা খুব সাবধানের সাথে তুলে দিলাম বিছানার উপর। বসে বসে মুচকি হেসে রাইয়ানকে আরো কাছ থেকে দেখাটা উপভোগ করতে লাগলাম। চুপচাপ ঘুমন্ত রাইয়ানকে দেখতে কতই না ভালো লাগছে! আমার মনে হয় রাইয়ানের চেহারাটা এতো আকর্ষণীয় লাগার মূলে আছে তার এই ঘন কালো ভ্রু যুগল। যেগুলো নিজের দিকে নজর কেড়ে রেখে সবসময় তার মুখে একধরণের গাম্ভীর্যের ভাব ফুটিয়ে রাখে। আমি আঙ্গুল কাছে নিয়ে দুই ভ্রুর উপর দিয়ে আঁকার মতো করলাম। হেসে উঠলাম নিজে নিজেই। হঠাৎ আমার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এলো। খেয়াল করলাম রাইয়ানের সাথে এই পর্যন্ত আমার একটাও সেলফি নেই। সেটা না হয় এই সুযোগেই তুলে ফেললাম। আমি সোফার পাশ টেবিল থেকে ফোন আনতে গেলাম। এসে দেখি রাইয়ান আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পরেছে। আমি বিছানার পাশে আরো ঘেঁষে বসে দুজনের একসাথে সেলফি তোলার চেষ্টা করলাম। ক্লিক করতেই যাবো রাইয়ান তার মুখটা বাম দিকে নিয়ে গেলো। বিছানার পাশে যা একটু ফাঁকা জায়গা পেলাম সেখানেই এক পায়ে ভর দিয়ে কোনমতে উপরে উঠলাম। রাইয়ানের মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে ধরলাম। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুজনের চেহারা পুরোপুরি ক্যামেরায় আসছে না। অগত্যা আমি আরো একটু রাইয়ানের গালের কাছে মুখটা নিলাম। ঠিক এমন সময় রাইয়ান তার মুখটা আবারো সোজা করতেই আমার ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁটের খুবই হালকা ভাবে স্পর্শ লাগলো। কারেন্টে শক খাবার মতো করে ছিটকে উঠতেই পড়ে যেতে নিলাম আমি। তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে রাইয়ান আমার হাত ধরে আবারো টান দিতেই আমি গিয়ে পড়লাম তারই উপর। আমি শকড হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। রাইয়ানও চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে বলল,
‘কি হয়েছে?’
আমি গুটিশুটি মেরে বসে মাথা নেড়ে ইশারায় বোঝালাম কিছুনা। রাইয়ানের চোখ ঘড়ির দিকে পরায় কথা কাটা পড়ে গেলো। খেয়াল চলে গেলো অন্য দিকে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ওহ নো, আজকে আমার মিটিং আছে। দেরি হয়ে গেলো।’
রাইয়ান তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আর আমি চোখ মুখ কুঁচকে আস্তে করে নিজের মাথায় একটা টোকা দিলাম।

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-১০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অফিসের সবাই রাইয়ানের উদ্দেশ্য হাত তালি দিয়ে উঠলো। কোম্পানির প্রধান এগিয়ে এসে রাইয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘অসাধারণ! রাইয়ান তুমি আজকে একটা অসম্ভব কাজ করেছো। আমরা সবাই তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই প্রজেক্টটা আমরা বোধহয় পাবো না। কিন্তু তুমি যেভাবে দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি সামলে ফেললে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ইনভেস্টররা সবাই তোমার কথায় ইমপ্রেসড হয়েই তো ডিল ফাইনালাইজড করলো। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররাও পুরো শান্ত হয়ে গেছে। আজকের ক্রেডিট সব তোমার।’
রাইয়ান স্মিত হেসে তার বসকে বলল,
‘থ্যাংক ইউ স্যার। এটা আমার ডিউটি।’
‘না না এটার একটা সেলিব্রেশন করা দরকার।’
তারপর তিনি সবার উদ্দেশ্য বললেন,
‘কেমন হয় আগামীকাল রাতে কোম্পানির পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য একটা সেলিব্রেশন পার্টির আয়োজন করা হবে। ইনজয়!’
কোম্পানির সকল স্টাফ একসাথে শব্দ করে নিজেদের উল্লাস প্রকাশ করলেন। বস সরে যেতেই রাইয়ানের এক কলিগ বেন্থা রাইয়ানের কাঁধে হাত উঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘ব্রো, তুমি তো পুরো ফাটিয়ে দিয়েছো। বস কতো খুশি হয়েছে দেখেছো? আমরা প্রমোশনের পেছনে লাগি, আর প্রমোশন হলো উল্টো তোমার পেছনে লাগে। চালিয়ে যাও বস।’
বেন্থার কথায় রাইয়ান মৃদু হাসলো। বেন্থা বলল,
‘কালকের পার্টির জন্য কি প্লান? তুমিই তো পার্টির মধ্যমণি।’
রাইয়ান বলল, ‘বিশেষ কিছুই না। এটা আমার জন্য জাস্ট আরেকটা পার্টি। তুমি তো জানোই আমি এসব বিজনেস পার্টিতে তেমন একটা ইন্টারেস্টেড না। এটেন্ড করতে হয় তাই করি।’

পরদিন সকাল, হৃদি দরজার সামনে বসে বসে মিঁয়োকে আদর করতে লাগলো। মিঁয়োর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বোঝানোর গলায় বলল, ‘আমি বাইরে গেলে বেশি দুষ্টুমি করবে না মিঁয়ো। একদম শান্ত হয়ে থাকবে। সোফার উপর ছোটাছুটি করবে না। আর কিচেনে কিন্তু একদমই ঢুকবে না বুঝেছো?’
এমন সময় রাইয়ান এসে হৃদির মাথায় হাত রেখে হৃদির মতো করেই বলল, ‘তুমিও একটু শান্তভাবে থেকো বিগ মিঁয়ো। আবার কোন গাছের উপর উঠে পড়ো না।’
হৃদি ভ্রু সংকুচিত করে মাথার উপরে রাইয়ানের দিকে তাকালো। স্মিত হেসে বাইরে যেতে উদ্যত হলো রাইয়ান। হৃদি ডেকে বলল, ‘রাইয়ান, তুমি কি এখন তোমার অফিসে যাবে?’
রাইয়ান বলল, ‘হুম।’
‘আমিও এখন কফিশপে যাবো। আমাকে একটু নামিয়ে দিতে পারবে?’
মাথা নেড়ে সায় দিলো রাইয়ান। হৃদি খুশি হয়ে গেলো। বলল, ‘আমি ব্যাগ নিয়ে আসি।’
সোফার উপর থেকে ব্যাগ আনতে গেলো হৃদি। ব্যাগটা তুলতে গিয়ে একটু পাশে চোখ পড়তেই দেখলো সেখানে একটা পার্টির ইনভিটেশন কার্ড। যেখানে স্পাউস সহ রাইয়ানকে ইনভাইট করা হয়েছে। হৃদি কার্ডটা হাতে নিয়ে নাড়তে চাড়তে বলল,
‘এটা….’
রাইয়ান দেখে এগিয়ে আসলো। বলল, ‘আমাদের কোম্পানি থেকে দিয়েছে। আজকে রাতেই। আমি ম্যারিড শুনে স্পাউস সহ দিয়েছে। তুমি…..কি যেতে চাও?’
এভাবে হুট করে হৃদির সম্মতি জিজ্ঞেস করায় হৃদি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। রাইয়ানের কোম্পানি থেকে পার্টি! হৃদি আমতা আমতা করতে লাগলো। সে ভালো মন্দ কিছু বলতে যাবে তার আগে রাইয়ানই বলে দিলো,
‘আমার মনে হয় না গেলেও চলবে। বিজনেস পার্টি, সব বিজনেস রিলেটেড লোক। তুমি বোর হয়ে যাবে।’
হৃদিও মাথা নাড়তে নাড়তে সায় মিলাতে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
রাইয়ান বাইরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ কার্ডটির দিকে তাকিয়ে রইলো হৃদি। তারপর কার্ডটি ব্যাগে ভরে রাইয়ানের পেছন পেছন গেলো।
___________________________________________________

অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে কার্ডাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কোনটা ঠিক হতো না হতো এসব ভাবতে ভাবতে মাথায় মধ্যে ভাবনার একশো একটা প্যাচ সৃষ্টি করে ফেললাম আমি। রাইয়ান যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘আমি যেতে চাই কিনা?’ তখন আমার আসলে কি বলা উচিত ছিলো? আর আমি কিছু বলতেই বা পারলাম না কেন? ছাগলের মতো শুধু অ্যাঁ অ্যাঁ করছিলাম। না জানি রাইয়ান কি ভাবলো! আমার এরকম ভাব দেখেই কি সে মানা করে দিলো? নিজের বোকা সুলভ ভঙ্গিমার কথা মনে পড়তেই আমি টেবিলের উপর দু হাত টান করে মাথা গুঁজে ফেললাম। পেছন থেকে জেরিন এসে আমার হাত থেকে কার্ডটা টান দিয়ে নিয়ে গেলো। আমি সাথে সাথে মাথা তুলে তাকালাম। জেরিন বলল,
‘এটা কি?’
আমি মিনমিন করে তারপর ওঁকে সব কিছু খুলে বললাম। সব শুনে জেরিন কিছুটা শাসনের সুরে বলল,
‘রাইয়ান তোকে জিজ্ঞেস করলো আর তুই কিছুই বললি না!’
‘আমার কি হ্যাঁ বলা উচিত ছিলো?’
‘অবশ্যই। স্পাউস সহ যখন ইনভাইট করেছে তখন তুই যাবি না কেন? আর রাইয়ানই বা না করে দিলো কেন? যাক গে, তুই পার্টিতে যাবি। আরে এটাই তো সুযোগ আরো একটু দুজন দুজনের সাথে মেলামেশার। তবেই তো তুই রাইয়ানের পৃথিবীর সাথে এডজাস্ট হতে পারবি।’
জেরিনের কথা শুনে আমারও মনে হলো আমার আসলেই পার্টিতে যাওয়া উচিত। আর অন্য কিছুর জন্য না হলেও রাইয়ানের জন্য।

পার্টিতে যাবার সিদ্ধান্ত তো নিয়ে নিলাম, কিন্তু পার্টিতে যাবো টা কিভাবে সেটাই সবথেকে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে গেলো। জেরিন আমাকে নিয়ে একটা শপিংমলে চলে এলো। একটা ছোটোখাটো ড্রেস ধরিয়ে দিয়ে বলল পরে আসতে। আমি বললাম,
‘নতুন ড্রেস কেনার দরকার কি? আমার যেগুলো আছে সেগুলো দিয়েই তো চালানো যায়।’
জেরিন মুখ নিরস করে বলল,
‘তোর ড্রেস!’
তারপর আমার গায়ের দিয়ে ইশারা করে বলল,
‘এগুলো পরে যাবি এতো বড় পার্টিতে? আচ্ছা, তুই সবসময় এমন ঢিলাঢালা পোশাক পরোস কেন? ঢিলাঢালা জামা, প্যান্ট আর এক জোড়া স্নেকার্স, এই তো তোর গেটআপ! স্টাইলের ‘এস’ ও জানোস না তুই।’
‘কিন্তু এই ড্রেসটা তো অনেক ছোট।’
‘এরকম হাই ক্লাস পার্টিতে না এরকম ড্রেসই চলে।’
এই বলে জেরিন আমাকে ঠেলে ড্রেসিং রুমে পাঠিয়ে দিলো। আমি ড্রেসটি পরে অস্বস্তির সাথে বের হলাম। জেরিন বলল, ‘বাহ! ভালোই তো মানিয়েছে তোকে।’
আমি কাঁচুমাচু করতে লাগলাম। হাঁটুর দিকে জামা টানতে টানতে বললাম, ‘এটা আমি পরবো না। এটা অনেক ছোট।’
জেরিন আমাকে আরেকটা ড্রেস ধরিয়ে ভেতরে পাঠালো। এবারো আমি বের হয় খুঁত খুত করতে লাগলাম। এমন করে করে বেশ কয়েকটা ড্রেস টাই করা হয়ে গেলো আমার। যা বুঝলাম জেরিনের হাত থেকে আজ আর নিস্তার নেই আমার। শেষমেশ ওর জোরাজুরি আর আমার আপত্তির প্যাঁচফিরে একটা ড্রেস সিলেক্ট হলো। আমি ড্রেসটি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। কালো রঙের একটি সুন্দর ফ্রক। সিম্পল ডিজাইন। লম্বায় হাঁটুর খানিক নিচ অব্দি। কিন্তু সমস্যা হলো হাতা কাটা। আমি উসখুশ করতে লাগলাম। জেরিন বলল,
‘এবার আর না করতে পারবি না। আমি আর চেঞ্জ করতে দিবো না। এটাই ফাইনাল।’

এরপর জেরিন আমাকে ওর বাসায় নিয়ে গেলো। আয়নার সামনে আমাকে বসিয়ে বের করলো ওর মেকআপ ব্যাগ। মেকআপ আর তুলির ঝাড়ায় আমি হাঁচির পর হাঁচি দিতে লাগলাম। হেয়ার স্ট্রেইট মেশিন দিয়ে জেরিন আমার সোজা চুলগুলো নিচের দিকে হালকা কার্লি করে দিলো। সেগুলো দু পাশে সামনে দিয়ে দিলো। এরপর মানানসই হালকা মেকআপ, লিপস্টিক আর চোখের নিচে হালকা কাজল লাগালো। প্রস্তুতির সব পর্ব শেষ হয়ে গেলে আমাকে একটা বড় আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল,
‘বাহ, তোকে তো আজ দারুণ লাগছে রে হৃদি। রাইয়ান আজকে ইমপ্রেসড না হয়ে যেতেই পারবে না।’
আমি আয়নার দিকে ভালোভাবে তাকালাম। সত্যি বলতে দেখতে ভালোই লাগছে কিন্তু তবুও আমি কোমরে হাত রেখে খুঁত খুত করে বললাম,
‘ড্রেসটা একটু বেশিই টাইট জেরিন।’
জেরিন বলল, ‘এটাকে টাইট বলে না, ফিট বলে।’
এরপর জেরিন আমার সামনে ওর এক জোড়া উঁচু হাই হিল রাখলো। আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘এটাও পরতে হবে?’
‘তাহলে কি তুই এই ড্রেসের সাথে তোর স্নেকার্স পরার কথা ভাবছিস?’
‘এতো উঁচু পেনসিল হিল পরে আমি হাঁটবো কিভাবে?’
‘আরে হয়ে যাবে, টেনশন নিস না।’

জেরিনের হাতে পুরো রেডি হয়ে আমি পার্টির উদ্দেশ্য বের হলাম। হাই হিল পায়ে সাবধানে ক্যাব থেকে নেমে আস্তে আস্তে গেটের দিকে আগাতে লাগলাম আমি। হাতের সুন্দর কারুকার্য খচিত পার্স থেকে একটা ছোট আয়না বের করে আরেকবারের মতো দেখে নিলাম নিজেকে। তারপর জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স ফিল করালাম। কনফিডেন্সের সাথে গেটে থাকা গার্ডদেরকে ইনভিটেশন কার্ড দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটা বড় ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। ভেতরে গিয়ে দেখলাম সব বড় বড় নামীদামী গোছের লোক। মেয়েগুলোও এত স্টাইলিশ আর সুন্দর। দেখতেই কত কুল লাগছে! খানিক মুহুর্তের জন্য ঘাবড়ে গেলাম কিছুটা। তারপর আবারো জোরে শ্বাস টেনে স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। এমন সময় রাইয়ানকেও দেখতে পেলাম সেখানে। তিন চারটে লোকের সাথে স্মিত হাসির সাথে আলাপ করে যাচ্ছে। সাদা স্যুট পরনে দারুণ লাগছে তাকে। সেই মুহুর্তে রাইয়ানের সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেলো। রাইয়ান কিঞ্চিৎ অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। পাশের লোকটি ডাক দেওয়ায় আবারো তাকে হাসিমুখ করে ফেলতে হলো। তাদের কথার মাঝে রেখে বেচারা আসতেও পারছে না। আমি ঠোঁট টিপে হেসে সেখানে দাঁড়ানো কিছু মেয়েদের সাথে কথা বলতে লাগলাম। এমন সময় একজন ওয়েটার এসে আমাকে গ্লাসে সাজানো বিয়ার সাধলো। আমি তাড়াতাড়ি মানা করে দিলাম। সে এগুলো আমার পাশ থেকে নিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। কি সাংঘাতিক জিনিস! এর একটুপর একজন স্যুট প্যান্ট পড়া লোক এসে আমাকে ডাকলো,
‘বিউটিফুল লেডি!’
আমি পাশে তাকাতেই সে আমাকে ডান্সের জন্য অফার করলো। আমিও প্রত্যাখান করে দিলাম। সে চলে গেলে মনে মনে বললাম, ‘আমি ডান্স করবো আমার হাসবেন্ডের সাথে। তোমার সাথে কেন করবো? হুহ!’
মনে হচ্ছে রাইয়ান দূর থেকে শুধু আমার দিকেই নজর রাখছে। এই সব বিষয়ও দেখলো সে। সেই লোকগুলোর কথা শেষ হলে সে আবারো আমার দিকে আসতে নিলো। কিন্তু মাঝপথে তার বস এসে একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে আবারো তাকে আটকে ফেললো। আমি আবারো মৃদু হাসলাম। ব্যাপারটা বেশ মজারই লাগছে আমার কাছে। প্রথমত এখানে এসে আমি তাকে অবাক করে দিলাম। আবার সে তার কৌতূহল মেটানোরও সুযোগ পাচ্ছে না। ব্যাপারটাকে চলতে দিয়ে আমিও সেখান থেকে সরে ঘুরে ঘুরে আলাপ করতে লাগলাম। যতটা অস্বস্তিকর লাগবে বলে মনে হয়েছিল আমার মতো মিশুক মেয়ের কাছে এদের সাথে কমিউনেট করাটা অতোটাও কঠিন বলে মনে হলো না। শুধু হাঁটতেই আমার একটু সমস্যা লাগছে। পা ব্যাথা হয়ে আসছে। এমন সময় স্টেজে উঠে রাইয়ানের বস কিছু বলার জন্য সবাইকে এটেনশন দিতে বলল। সবাই স্টেজের কাছাকাছি যেতে লাগলো। সেই উদ্দেশ্যে আমিও কাছে যাবার জন্য খানিক এগোতেই হঠাৎ হাই হিল বাঁকা হয়ে গিয়ে পার্টির মাঝখানে পাশের টেবিল নিয়ে লজ্জাজনক ভাবে পরে গেলাম। মুখ থেকে মৃদু চিৎকারও বের হয়ে গেলো আমার। পার্টির মধ্যে এতো এতো মানুষ! সবার নজর আমার দিকে চলে এলো। রাইয়ান তাড়াতাড়ি চলে এলো আমার কাছে। আমাকে ধরে বলল,
‘তুমি ঠিক আছো?’
কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে আবার কিছু কিছু মেয়েরা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। রাইয়ানের এক কলিগ আস্তে করে বলে উঠলো,
‘ইনি না রাইয়ানের স্ত্রী।’
লজ্জায় আমার মুখ পাথর হয়ে গেলো। মাথার মধ্যে থেকে ঝাঁজ বের হতে লাগলো যেন। রাইয়ান আমাকে ধরে উঠালো। গা থেকে নিজের ব্লেজারটা খুলে আমাকে পরিয়ে দিলো। এরপর আমাকে নিয়ে এলো বাইরে। সারা রাস্তা গাড়িতে আমরা দুজন কেউ আর কোন কথা বললাম না। রাইয়ান একমনে ড্রাইভ করে গেলো, আর আমি তাকিয়ে রইলাম বাইরে। বাসার মধ্যে ঢুকে ভাবলেশহীন অবস্থায় এগিয়ে যেতেই আবারো কার্পেটের সাথে পা বেজে হালকা হোঁচটের মতো খেলাম আমি। রাইয়ান দাঁড়িয়ে ছিল দরজার ওখানেই। সেখান থেকেই মৃদু জোরে বলে উঠলো,
‘হৃদি আস্তে।’
এগিয়ে আসতে আসতে আমার পায়ের দিকে খেয়াল রেখে বলল, ‘কি যে কর।’
নিজের প্রতি নিজের ক্ষোভে আর লজ্জায় আমি পুরো জর্জরিত হয়ে ছিলাম। কিছু একটা চেপে ছিল বুকের ভেতর। যেটা খুব করে বের হয়ে আসতে চাইলো। আমি অফিসের সবার সামনে রাইয়ানের নাক কেটে ফেলেছি।
আমার মনে হচ্ছিল রাইয়ান আমাকে নিয়ে লজ্জিত বোধ করছে তবুও রাইয়ান আমাকে কিছু বলছে না এই ব্যাপারটা যেন আমার মধ্যে চাপা সেই অদ্ভুত অনুভূতিটাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। যার দরুনই আমি রাইয়ানকে শক্ত মুখে বলে উঠলাম,
‘ইট’স ওকে রাইয়ান। তুমি আমাকে কথা শোনাতে পারো। আমি আজ তোমাকে এমবারেসড করেছি।’
কথা বলতে বলতে আমার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসতে চাইলো। রাইয়ান বলল,
‘আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?’
‘তাহলে বলছো না কেন? তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো তোমার ওয়াইফ কতোটা ইউসলেস। সামান্য বিজনেস পার্টিও ঠিকভাবে এটেন্ড করতে পারে না। তোমাকে এমবারেসড করে।’
‘হৃদি আমি এমন কিছুই ভাবছি না। তুমিই নিজে নিজে একেকটা অনুমান করে নিচ্ছো।’
আমি অভিমানী সুরে গলার জোর বাড়িয়ে বললাম,
‘তুমি এমনটাই ভাবছো। এর জন্যই সকালে তুমি আমাকে ঠিকমতো কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই নিজ থেকে না করে দিয়েছো। কারণ তুমি আমাকে এমনটাই ভেবেছিলে। তুমি আমাকে নিয়ে এমবারেসড ফিল করো। একারণেই তুমি আমাকে নিয়ে পার্টিতে যেতে চাওনি।’
রাইয়ান এবার রুক্ষ হয়ে উঠলো। আঙ্গুল উঠিয়ে বলল,
‘এই, এবার কিন্তু তুমি বেশি বেশি বলে ফেলছো। আমি ‘না’ তোমার জন্য করেছিলাম। আমি চাইনি ওখানে অপরিচিত মানুষদের মধ্যে গিয়ে তোমার কোন ধরণের অস্বস্তি বোধ হোক। কোন রকম খারাপ লাগুক। তোমার কথা ভেবেই আমি বলেছিলাম হৃদি।’
আমি গা থেকে রাইয়ানের ব্লেজার খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে অভিমানী স্বরে বললাম,
‘থাক, আর কিছু বলতে হবে না তোমাকে।’
রাইয়ানের হাতে ব্লেজার ধরিয়ে দিয়ে ধপধপ পা ফেলে দ্রুত চলে যেতে লাগলাম। রাইয়ান পেছন থেকে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো,
‘হৃদি, হৃদি!’
আমি পেছনে ফিরে অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে কাতর স্বরে বললাম,
‘তুমি আমাকে একটুও বোঝো না রাইয়ান।’

রাইয়ান অস্ফুট স্বরে আবারো ডাকতে গেলো, ‘হৃদ…..

কিন্তু তার আগেই পাশের আরেকটা রুমে গিয়ে আমি দরজা বন্ধ করে ফেললাম। এই রুমগুলো এখনো ঠিকভাবে সাজানো হয়নি। কোন বেড নেই। শুধু একটা ডিভান রাখা। আমি সেখানেই বসে পরে হাঁটুতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার অশ্রু মাখা মুখটি গুঁজলাম। প্রায় অনেকক্ষণ পর অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করে আমাকে ডাকতে এলো রাইয়ান। পার্টি থেকে তো কিছুই খেয়ে আসিনি আমরা। রাইয়ানের ডাকার উত্তরে আমি কিছুই বললাম না। চুপ করে রইলাম। দরজার খটখটানি বাড়তেই থাকলে মাথা তুলে বিরক্তি স্বরে বললাম, ‘আমি খাবো না রাইয়ান, তুমি চলে যাও।’
খানিকপর নিজে খেয়ে এসে আমাকে আবারো খাওয়ার জন্য ডাকতে লাগলো রাইয়ান। আমি আর কিছুই বললাম না। একসময় কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধলো মাঝরাতে।

চলবে,