My First Crush part-11+12

0
239

#My_First_Crush
#পর্ব-১১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো আমার। পেটের মধ্যে খিদে রাজপথে মিছিলের মতো স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। পেট কি আর আমাদের মনকে অনুসরণ করে চলে। ঝড় হোক, সুনামি হোক বা আকাশ ভেঙেই পড়ুক পেট তো তার খিদে নিয়ে যথাসময়ে হাজির হবেই। কিছুক্ষণ পেটে হাত রেখে বসে বসে আর থাকতে না পেরে আমি মুখ ফুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। ডাইনিং এরিয়ার লাইট জ্বালানোই ছিলো। টেবিলের উপর দেখতে পেলাম একটা খাবারের প্যাকেট। চেয়ার টেনে বসে পড়ে সেই প্যাকেট থেকেই গ্রোগাসে খেতে শুরু করলাম আমি। গতকাল দুপুরেও পার্টির এক্সাইটমেন্টে ভালো ভাবে খাইনি। খিদে তো লাগবেই। আমি মুখ ফুলিয়ে নাক টেনে যখন খাওয়ায় ব্যস্ত তখন রাইয়ান আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালো আমার পেছনে। আমি টের পেলাম না। পেছন থেকে টেবিলে এক হাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আরেক হাত আমার মাথায় রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে রাইয়ান বলল,
‘এজন্যই বলে খাবারের উপর রাগ দেখিয়ো না।’

আমি ফোলানো মুখ নিয়ে ঝট করে রাইয়ানের দিকে তাকালাম। মিটিমিটি হেসে আবারো প্যান্টে দু হাত গুঁজে রুমে চলে গেলো রাইয়ান। আমার মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো। খানিক বিরক্তিও লাগলো নিজের উপর। রাগ করে এতো সাধার পরও না খেয়ে এখন আবার নিজের থেকেই কিনা খেতে এসেছি। কি একটা লজ্জা! তারপরই আমার চোখ পড়লো সামনে বরাবর গ্লাসের উপর। সেখানে দেখলাম আমার মুখের বেহাল দশা। চোখের পানিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেছে। কাজল লেপ্টে রয়েছে, লিপস্টিক উঠে উঠে গেছে। মানে ছোটখাটো একটা পেত্নী বললে কম হবে না। আমার মুখ আবারো কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। এই অবস্থায় আমি এতক্ষণ রাইয়ানের সামনে ছিলাম! আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। এই জেরিন না আসলেই কিপ্টা। একটু ওয়াটারপ্রুফ মেকআপ কিনতে পারলো না!
___________________________________________________

জিশান এসেছে শপিংমলে। নিজের জন্য বিশেষ কিছু কেনাকেটা করাই উদ্দেশ্য তার। একটা দোকানে ঢুকতে গিয়ে আবারো কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় বের হতে গিয়েই সে একজনের সাথে ধাক্কা খেলো। তাল সামলাতে সামলাতে পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলো জেরিন। শুধু মুখ থেকে স্কার্ফটা সরে গেলো। বড় বড় সানগ্লাস থাকা সত্ত্বেও জিশান চিনতে পেরে বলল,
‘তুমি?’
জেরিন বিগলিত হয়ে একগাল হাসলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো সে বোকার মতো হাসছে কেন? তৎক্ষনাৎ মুখের হাসি সরিয়ে ফেললো সে। জিশান কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
‘আবারো তুমি কিভাবে? আমি অনেকদিন ধরে খেয়াল করছি আমি যেখানেই যাই সেখানেই তুমি চলে আসো। এতো কো-ইনসিডেন্স তো হতে পারো না। এই তুমি কি আমাকে স্টক করছো?’
জেরিন গলায় জোর দিয়ে বলল,
‘মাথা খারাপ তোমার? আমি তোমাকে স্টক করতে যাবো কেন? এমন কি তুমি? আর আমি কি শপিংমলে আসতে পারি না!’
‘আসতে পারো কিন্তু আমি যেই স্টোরে যাবো সেখানেই কেন?’
‘কেন আমি এই স্টোরে আসতে পারবো না কেন? আমারও কেনাকাটার আছে। নাকি এই স্টোর তোমার নিজের?’
জিশান স্টোরের ভেতরে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
‘জেন্টস আন্ডারওয়ার স্টোরে তোমার কেনাকাটার আছে?’
স্টোরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে জেরিন থতমত খেয়ো গেলো। তৎক্ষনাৎ কিছু সাজিয়ে বলতে পারলো না। জিশান জেরিনকে টেনে এক সাইডে নিয়ে এলো।
বিরক্তির সাথে জিশানের হাত ঝটকা দিলো জেরিন। জিশান বলল,
‘এই খুলে বল। তোমার মতলবটা কি? তুমি আমাকে স্টক করছো কেন?’
‘তোমাকে আমি স্টক করেছি এর প্রমাণ কি?’
‘তাহলে তোমার হাতে বাইনোকুলার কেন?’
জেরিনের এতক্ষণে খেয়াল হলো হাতের বাইনোকুলার লুকাতে তো ভুলেই গেছে সে। তাড়াতাড়ি হাত পেছনে নিয়ে গেলো জেরিন। জিশান বলল,
‘কবে থেকে আমাকে স্টক করা শুরু করেছো? তুমি কি আমাকে লাইক করো?’
জেরিন হেসে ফেলার মতো মুখে একটা শব্দ করে বলল, ‘তোমাকে লাইক করবো আমি? নেহাৎ আমার ফ্রেন্ডের সংসার বাঁচানোর জন্য তোমার দিকে নজর রাখছি। নয়তো জেরিনের এতো ফাও সময় নেই। এখন কে জানতো আমার বান্ধবীর হাজবেন্ডের ছেলে বন্ধুই তার লাভ রাইভাল হবে।’
জিশানের চোখ মুখ হা হয়ে গেলো। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো যেন। সে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কি মনে হয় আমি…….’
জিশান আর কিছু মুখ দিয়ে বেরও করতে পারলো না। জেরিনের খেয়াল হলো সে পেটের সব কথা বলে ফেলেছে। আমতা আমতা করতে করতে সে বলল,
‘তু…তুমিই কি সেদিন রাস্তায় রাইয়ানের সাথে ব্রেকআপ করতে চাইলে না! আমার ফ্রেন্ডের সাথে ওর ভাব হচ্ছে বলে। আরে, সমস্যা থাকলে তুমি আর রাইয়ান আমার ফ্রেন্ডকে বিয়ের আগেই সবকিছু খুলে বলতে পারলে না?’
জিশান রেগে জেরিনের পেছনের পিলারে জোরে শব্দ করে হাত রাখলো। কেঁপে উঠলো জেরিন। জিশান দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগলো ,
‘আমি স্ট্রেইট পারসন। আমার শুধু মেয়েদের প্রতিই ইন্টারেস্ট। বুঝেছো?’
জেরিন তটস্থ হয়ে চোখ বড় বড় করে যথাআজ্ঞার ন্যায় মাথা উপর নিচে ঝাঁকিয়ে বোঝালো সে বুঝেছে।
___________________________________________________

হৃদি কফি মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন এক ধরণের কফি তৈরির রেসিপি ট্রাই করছিলো। এমন সময় বাইরে থেকে জেরিন দৌড়ে এসে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘ঐ হৃদি, বাইরে বাদামি চোখওয়ালা সেই একটা হ্যান্ডসাম ইংরেজ ছেলে এসেছে! তোর খোঁজ করছে।’
হৃদি কফিমেশিন বন্ধ করে বলল,
‘আমার?’
‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যা।’
‘কিন্তু এগুলো…’
জেরিন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি দেখছি তুই আগে যা।’
হৃদি গা থেকে এপ্রোন খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো। কফিশপের এক কোনার একটি টেবিলে দেখলো হোয়াইট কালারের ডেনিম জ্যাকেট গায়ে লম্বা, সুন্দর দেখতে একটা ইংরেজ ছেলে বসে আছে। হৃদি চিনতে পারলো না।

অ্যালেন বসে আছে বেশ অনেকখানি সময় হয়েছে। বব কাট চুলের মেয়েটি সেই যে দৌড়ে ভেতরে গেলো আর কারো কোন খবর নেই। অ্যালেন আবারো পাশে চোখ তুলতেই দেখলো হলদে ফর্সা ছিপছিপে গড়নের সেই মিষ্টি চেহারার মেয়েটি এগিয়ে আসছে। যে মেয়েটি সেদিন নির্জন রাস্তায় তাকে উদ্ধার করেছিল। অ্যালেনের চোখে আবারো সেদিনের দৃশ্যটি ভেসে উঠলো। সেদিন যখন আঘাত আর রক্তে জর্জরিত অ্যালেন ওমন জনমানবহীন রাস্তার মধ্যে অসহায় অবস্থায় পরেছিল, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল সে আর বুঝি বাঁচবেই না। আর তার মৃত্যুর খবরটাও ঠিক কখন তার প্রিয়জনরা পাবে কে জানে! মাথা কেটে খুব রক্ত পড়ছিল। ডান হাতটাও ব্যাথায় একদমই নাড়াতে পারছিল না অ্যালেন। যন্ত্রণায় শরীর অবশের মতো হয়ে আসছিল তার। ঠিক এমন সময় অ্যালেনের জন্য একটা অ্যাঞ্জেলের মতো মেয়েটি যেন এলো। ভাঙা কাঁচের জানালায় হাত দিয়ে বারবার বারি দিয়ে মেয়েটি মনে হয় অ্যালেনকে কিছু বলতে লাগলো। অ্যালেন পরিষ্কার কিছুই শুনতে পেলো না। যন্ত্রণায় কাতর ঝাপসা চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। দরজা আটকে গিয়েছিল। খুলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটির। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে মেয়েটি দরজা খুলতে সক্ষম হলো। নিজের দয়ালু হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে অ্যালেনকে গাড়ি থেকে বের করে আনলো। তারপর তার কাঁধে ভর দিয়ে অ্যালেনকে আস্তে আস্তে হাঁটতে বলে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো সে। তারপর আর অ্যালেনের খুব কিছু মনে নেই। সে ফিরে এলো বাস্তবে। মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ালে অ্যালেন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হাই, আমি অ্যালেন।’
হৃদি চিনতে পারছে না দেখে অ্যালেন স্মিত হেসে বলল,
‘তুমি বোধহয় প্রায়শই মানুষকে এক্সিডেন্ট অবস্থায় পেয়ে সাহায্য করো। তাই তোমার বিশেষ করে আর কিছু মনে নেই।’
এক্সিডেন্টের কথা শুনে এবার মনে পড়লো হৃদির। অবাক মুখে হেসে বলল, ‘ও তুমি সেই ছেলেটাই!

কফিশপে আরো কাস্টমার ছিল। তাই হৃদি আর অ্যালেন চলে এলো বাইরে। কফিশপের পাশে যে সরু লেনের রাস্তাটি সেখানেই হাঁটতে হাঁটতে হৃদি বলল,
‘তোমার শরীর এখন কেমন? আমি দুঃখিত, আমি আর তোমার কোন খোঁজ নিতে যেতে পারেনি।’
অ্যালেন স্মিত হেসে বলল, ‘ইট’স ওকে। তুমি এমনিতেও আরো বেশি কিছু করেছো।’
‘আরে না না এমন আর কি! তুমি তো এভাবে বলছো মনে হচ্ছে আমিই তোমাকে সারা রাস্তা ধরে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি। একটু আগাবার পরই সেখানে একটা শপ দেখতে পেয়েছিলাম। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করলে তারা এসে তোমাকে নিয়ে যায়। আমার ফোনে চার্জ ছিল না বলে আগে দিতে পারিনি।’
হঠাৎ অ্যালেন কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে হাতের প্যাকেটটি হৃদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা তোমার ব্যাগ। সেদিন তুমি আমার গাড়ির ওখানে ফেলে রেখে এসেছিল। পরে আমার লোক গাড়ি উদ্ধার করতে গেলে নিয়ে আসে।’
হৃদি প্যাকেটটা থেকে একটা ছোট্ট বিড়ালের সফট টয় বের করলো। দেখতে খুবই কিউট। সেদিন কিনে এনেছিল হৃদি। পরে যে সেটা কোথায় পরে গিয়েছিল হৃদির আর খেয়ালই নেই। হৃদি হাতে নিয়ে টয়টি দেখতে লাগলো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার। অ্যালেন বলল, ‘তোমার সফট টয়টা তো খুবই সুন্দর।’
হৃদি ওটা অ্যালেনের দিকে বাড়িয়ে বলল,
‘তোমার পছন্দ হয়েছে? তাহলে তুমি রেখে দাও।’
অ্যালেন প্রথমে ‘না’ বলল। হৃদি আরেকবার বলায় নিয়ে নিলো। সফট টয়টার দিকে তাকিয়ে বলল,
তুমি বিড়াল পছন্দ কর?’
হৃদি হেসে বলল, ‘হুম।’
‘আমারও খুব বিড়াল পছন্দ।’
হৃদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল,
‘সত্যি? বিড়ালরা কতো কিউট হয় তাই না!’
পছন্দের টপিক এক হলে আলাপ জমে ভালো। আর ভাবও হয় তাড়াতাড়ি। হৃদি আর অ্যালেনের ক্ষেত্রেও তাই হলো। বিড়াল নিয়ে নানা ধরণের কথা বলতে লাগলো তারা। হৃদি বলতে লাগলো,
‘আমার বাসায়ও একটা বিড়াল আছে। মিঁয়ো। যেমন কিউট তেমন দুষ্ট। ওঁকে পালা আর একটা বাচ্চা পালা সমান।’
হৃদি হাসতে লাগলো। অ্যালেন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। হৃদি তা লক্ষ করে নিজের মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘আমার মুখে কি কোন ময়লা লেগে আছে?’
অ্যালেন হেসে ‘না’ করে সহজ ভাবে বলল, ‘তোমার হাসিটা খুব সুন্দর।’
হৃদি ওর মুখের বাম সাইডের একটা হালকা বাঁকা দাঁত দেখিয়ে বলল, ‘এই বাঁকা দাঁতটার জন্য তাই না? আমারও তাই মনে হয়।’
হৃদি নিজের মনে হেসে উঠলো। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো এই ছেলেটার সাথে একটু আগেই পরিচয় হয়েছে তার। আর এতটুকু সময়ের মধ্যেই এগুলো কি বকবক করছে সে! হাসি থামিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেলো হৃদি। কথা ঘোরাতে বলল, ‘রাইয়ান আমাকে তোমার কথা অনেক বলেছে। তোমরা ইউনিভার্সিটি থেকে ফ্রেন্ড তাই না?’
অ্যালেন অবাক হয়ে বলল,
‘তুমি রাইয়ানকে চিনো?’
হৃদি হেসে ফেলে বলল, ‘চিনবো না কেন? আমিই তো রাইয়ানের স্ত্রী।’
এরপর হৃদি শুধু রাইয়ান, রাইয়ান নিয়েই সব কথা বলতে লাগলো। অ্যালেন ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারলো না। হঠাৎ করেই একদম চুপ হয়ে গেলো সে।
___________________________________________________

রাইয়ান লিভিং এরিয়ার সোফায় বসে ফাইল দেখছিল।সামনে টিভি অন করে রাখা। সেখানে একটা কমেডি শো চলছে। রাইয়ানকে দেখে মনে হচ্ছে না তার সেদিকে কোন খেয়াল আছে। তার সমস্ত মনোযোগ এখন ফাইলের দিকে। টিভির ভলিউম মোটামুটি পর্যায়ে রাখা। তবুও ডাইনিং টেবিলে বসা হৃদির কানে তা পরিষ্কারই শোনাতে লাগলো। সেখানে বসে বসে ছুরি দিয়ে আপেলের খোসা ছাড়াচ্ছিল সে। এমন সময় টিভিতে চলা একটা কথা হৃদির মনোযোগ আকর্ষণ করলো। কমেডি শো তে একজন কমেডিয়ান পৃথিবীকে কমলালেবুর সাথে তুলনো করে জোক বলে যাচ্ছে। হৃদি আস্তে আস্তে পেছনে টিভির দিকে তাকালো। দেখলো রাইয়ান এখনো ফাইলেই মনোনিবেশ করে আছে। আস্তের উপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এমনিতেও তার সেই মাতাল হবার রাত নিয়ে হৃদি অনেক এমবারেসড হয়ে আছে। এখন এই জোকস শুনে যদি রাইয়ানের আবারো সেই গানের কথা মনে পড়ে যায়! হৃদি আরও এমবারেসড হয়ে যাবে। নিজেকে এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর জন্য হৃদি কিছু ঠিক করলো। সোফার সাইড টেবিলেই টিভি রিমোট রাখা। হৃদি আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে নামলো। নিচু হয়ে মেঝেতে বসে আস্তে আস্তে এগিয়ে সোফার পেছনে গেলো। নিচ থেকে একবার রাইয়ানের মাথার দিকে তাকিয়ে সাইড টেবিল থেকে রিমোটটা হাতে নিলো সে। সোফার পেছন থেকে হাত উঁচু করে টিভির ভলিউম আস্তে আস্তে একদম কমিয়ে দিলো। এরপর আবারো জায়গা মতো রিমোটটা রেখে দিয়ে আগের মতোই পা টিপে টিপে চেয়ারে গিয়ে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো হৃদি। হাসিমুখে আবারো আপেল ছিলতে বসলে হঠাৎ তার কানে এলো,
‘Fish want to fly
Bird’s want to swim,
Like a orange,
The world is round;
Which I want to
Eat, eat, eat……’

হৃদি ঝট করে পেছনে তাকালো। এটা তো তারই গলা। ভেসে আসছে রাইয়ানের ফোন থেকে। রাইয়ান হাত উঁচু করে ফোনটা নাড়িয়ে দেখালো। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে হৃদির দিকে ঘুরে মিটিমিটি হাসতে লাগলো সে। হৃদির মুখ হা হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে বলল,
‘তুমি আমার ভয়েস রেকর্ড করেছো?’
রাইয়ান মনে করলো কিভাবে সেদিন এক ফাঁকে ফোন বের করে হৃদির গান রেকর্ড করেছিল সে। পাছে হৃদি না আবার পরবর্তীতে অবিশ্বাস করে সেজন্য।

হৃদি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো রাইয়ানের দিকে। রাইয়ানের ফোন ধরার চেষ্টা করে বলল,
‘রাইয়ান, এটা বন্ধ কর।’
রাইয়ান বন্ধ করলো না। রেকর্ড চলতেই লাগলো। রাইয়ানের হাত থেকে আবারো ফোন নেওয়ার চেষ্টা করলো হৃদি। রাইয়ান ফোন সহ হাত উঁচু করে ফেললো। হৃদি কয়েকবার লাফিয়ে লাফিয়ে ফোন ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু রাইয়ানের লম্বা হাতের সাথে পেরে উঠলো না। এক হাত থেকে অন্য হাতে ফোন নিয়ে যেতে লাগলো রাইয়ান। একসময় হৃদি ক্লান্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে পেছনে ঘুরলো। বুকে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। রাইয়ান ফোন দেখিয়ে বলল,
‘এই ওয়ান অ্যান্ড অনলি মাস্টারপিস গানটা তো আমি জীবনেও ডিলিট করবো না। ভাগ্যিস রেকর্ড টা করেছিলাম।’
রাইয়ান হাসতে লাগলো। হৃদি চোখ সরু করে তাকালো রাইয়ানের দিকে। তারপর হঠাৎ পুরোপুরি ঘুরে রাইয়ানের পেছনে ইশারা করে বলল, ‘রাইয়ান, তেলাপোকা!’
রাইয়ান বাচ্চাদের মতো ভয়ে লাফিয়ে উঠে পেছনে তাকালো। এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো হৃদি। রাইয়ান মাথা নেড়ে বলল,
‘আচ্ছা!’
রাইয়ানের ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে হৃদি তাড়াতাড়ি দৌড় দিলো। পেছন পেছন সোফার চতুর্দিকে তার অনুসরণে ছুটতে লাগলো রাইয়ানও। দুজনের হাসি কথায় মুহুর্তেই রাইয়ানের এতদিনকার নির্জন বাসাটি মুখরিত হয়ে উঠলো। বস্তুতে সঞ্চারিত হতে লাগলো প্রাণ।

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-১২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

আজকের দিনটি খুব সুন্দর। আবহাওয়া নরম, উঞ্চ। রোদ উঠেছে, কিন্তু রোদের তাপমাত্রা মানানসই। জামা কাপড়ের একটা বড় লাগেজ টেনে টেনে বারান্দায় নিয়ে এলো হৃদি। কবাটে জায়গা না হওয়ায় কম প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র এটাতে রেখে দিয়েছিল সে। লাগেজের চেইন খুলে ভেতরের জিনিসপত্রগুলো হৃদি নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো। এমন সময় একটা পত্রিকা হাতে রাইয়ান এলো সেখানে। হৃদিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কি করছো এগুলো?’
হৃদি মাথা তুলে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই ব্যাগের উপর পানি পড়ে গেছে। কিছু ভিজে গেলো কিনা দেখছি। তাহলে রোদে শুকাতে দেবো।’
‘পানি পড়লো কিভাবে?’
‘মিঁয়ো কেবিনেটের উপর রাখা কাঁচের জগ এটার উপর ফেলে দিয়েছে।’
রাইয়ান বলল, ‘তোমার মিঁয়ো আজকাল খুব বেশি ছোটাছুটি করে।’
হৃদি ঠোঁট ফুলিয়ে কাজের মাঝে বলল, ‘হুম।’
তারপর হঠাৎ কিছু মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মিঁয়োকে পথে আনার জন্য আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে?’
রাইয়ান উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি?’
হৃদি বাঁকা হেসে বলল, ‘আজকে লাঞ্চে মিঁয়োকে ভেজিটেবল সালাদ খেতে দেবো। আর আমরা ওঁকে দেখিয়ে দেখিয়ে মুরগীর রান খাবো।’
রাইয়ান মাথা নেড়ে মুখের ভাষা হারানোর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। হৃদি হাসতে লাগলো। হৃদির মাথায় হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে রাইয়ান বলল,
‘তুমি অনেক ফানি।’
চাঁপা হাসির সাথে লাগেজের ভেতর চোখ পড়তেই রাইয়ানের নজর আটকে গেলো। কাপড় চোপরের মধ্যে থেকে মাঝারি সাইজের সেই পান্ডা সফট টয়টা বের করলো রাইয়ান। অবাকের সাথে প্রশ্ন করলো,
‘এটা এখানে আসলো কিভাবে?’
হৃদি মিষ্টি করে হেসে বলল,
‘আমি নিয়ে এসেছি। দাদীমা আমাকে বলেছিল তুমি ছোট থাকতে সবসময় এটা ধরে ঘুমাতে। বড় হওয়ার পরও তুমি এটাকে ফেলে দাওনি। তাই নিয়ে এলাম। তুমি খুশি হওনি?’
রাইয়ান মিথ্যে হেসে কথা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় অন্যমনষ্কে হাতটা নাড়াতেই তার হাত থেকে পুতুলটা নিচে পড়ে গেলো। হৃদি তাড়াতাড়ি রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে দেখলো ওটা একদম গিয়ে পড়েছে রাস্তার মাঝ বরাবর। নিঃশ্বাস না ফেলেই যেন হৃদি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলো। হৃদির এমন অবস্থা দেখে রাইয়ানও ছুটলো তার পেছন পেছন। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে হৃদি রাস্তায় চলে এলো। হঠাৎ হৃদি দেখলো একটা বড় গাড়ি আসছে পুতুলটির দিকে। প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো সে। হৃদিকে থামাতে রাইয়ানও পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো। বারবার ডাকতে লাগলো, ‘হৃদি, হৃদি!’
গাড়ি অনেকটা কাছাকাছি চলে এলো। পুতুলটা বুকে জড়িয়ে সেখানেই চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো হৃদি। রাইয়ান স্তব্ধ হয়ে পড়লো। যখন দেখলো গাড়িটা সময়মতো থেমে গেছে, তখন ক্লান্ত মুখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো রাইয়ান।

হৃদি বসে আছে সোফার উপর। তার শরীর ঘেঁষেই পাশে কিউট দেখতে পান্ডাটা রাখা। বা হাত খানিকটা উঁচু করে আছে সে। সেখানে কনুইয়ের দিকে চামড়া ছিলে গেছে। একটা ফার্স্ট এইড বক্স টেবিলের উপর রেখে হৃদির পাশে বসলো রাইয়ান। সিরিয়াস মুখে একবার হৃদির দিকে তাকিয়ে ওর বা হাত টেনে নিজের দিকে নিলো। তুলোতে মেডিসিন নিয়ে হৃদির হাতে লাগিয়ে দিতে লাগলো সে। হৃদি মুখে মৃদু শব্দ করলো। আড়চোখে একবার তাকালো রাইয়ান। মেডিসিন লাগানো শেষ হলে কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো, ‘তোমার কি মাথা খারাপ? তুমি জানো, তুমি আজকে মরে যেতেও পারতে! এটা কি এমন জিনিস যে এর জন্য তোমাকে রাস্তার মাঝখানে গাড়ির মধ্যে এভাবে দৌড়ে যেতে হবে?’
হৃদি স্মিত হেসে বলল, ‘কারণ এটা তোমাকে তোমার বাবা দিয়েছিল। তুমি প্রকাশ না করলেও আমি জানি, এটা তোমার জন্য অনেক স্পেশাল। এভাবে কিভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি!’

রাইয়ান থমকে গেলো। আঘাত লাগা জায়গাটিতে মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিতে লাগলো হৃদি। রাইয়ান হৃদির মুখপানে তাকিয়ে রইলো।
___________________________________________________

অ্যালেন জিশানকে নিয়ে রাইয়ানের জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিলো। এই মুহুর্তে তারা আছে রাইয়ানের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নিচে। খানিক বাদে বাদামী রঙের শার্ট আর ব্লু জিন্স গায়ে নিচে এলো রাইয়ান। ড্রাইভিং সিটে অ্যালেন বসা। জিশান বসে আছে পেছনে। রাইয়ান গিয়ে বসলো অ্যালেনের পাশের সিটে। বসে থাকার কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরও রাইয়ান খেয়াল করলো অ্যালেন গাড়ি স্টার্ট করছে না। রাইয়ান হাত দিয়ে ইশারা করলো। অ্যালেন গাড়ি স্টার্ট করতে নিলো। তখনই উপর থেকে হৃদি এলো নেমে। রাইয়ানের বন্ধু সহ সবাইকে গাড়িতে দেখে থমকে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। পরক্ষণেই একটা সৌজন্যতামূলক হাসি দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে হাই বলল সবাইকে। অ্যালেন জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি বাইরে যাবে এখন?’
হৃদি আস্তের উপর বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘গাড়িতে উঠো, আমরা তোমাকে নামিয়ে দেই।’
রাইয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো অ্যালেনের দিকে। হৃদি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে বলল, ‘কিন্তু আমার রাস্তা তো বিপরীত দিকে পরবে।’
‘সমস্যা নেই। আমাদের অতো তাড়া নেই।’
অ্যালেন গাড়ি থেকে নেমে হৃদির সামনে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। হৃদি বুঝতে পারলো না কি করবে। রাইয়ানের বন্ধু বলে কথা! রাইয়ানের দিকে একপলক তাকিয়ে ইতস্তত করতে করতে হৃদি উঠলো গাড়িতে। অ্যালেন হৃদির দরজা লাগিয়ে দিয়ে রাইয়ানের কাছে এসে তাকে গাড়ি ড্রাইভ করতে বলল। রাইয়ান কিঞ্চিৎ অবাক হলেও বসলো ড্রাইভিং সিটে। অ্যালেন বসলো রাইয়ানের জায়গায়। গাড়ি চলতে শুরু করলো। অ্যালেন গাড়ির আয়নায় হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি ব্রেকফাস্ট করেছো?’
হৃদি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে তার আগেই অ্যালেন বলল, ‘তুমি না করে থাকলে আমরা কোন রেস্তোরাঁর সামনে আগে গাড়িটা থামিয়ে নিতে পারি।’
হৃদি বলল, ‘না না, আমি ব্রেকফাস্ট করেই বের হয়েছি।’
অ্যালেন বলল, ‘তোমার কফিশপের কফি খুবই ভালো। আমার তো একবার খেয়েই খুবই ভালো লেগেছে।’
হৃদি মৃদু হেসে বলল, ‘থ্যাংকস।’
রাইয়ান জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই গিয়েছিলি ওর কফিশপে?’
হৃদি এবার তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে। সে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল।’
জিশান বুঝতে পারলো না কি চলছে। ওঁ একবার রাইয়ানের দিকে একবার অ্যালেনের দিকে তাকাতে লাগলো। দেখতে দেখতে হৃদি যেখানে যেতে চাইছিলো সেখানটায় চলে এলো। হৃদি গাড়ি থামাতে বলে নিচে নামলো। হাসিমুখে হৃদিকে বাই জানালো অ্যালেন। রাইয়ান বিভ্রান্ত মুখে অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে রইলো। হৃদি চলে গেলো। রাইয়ান গাড়ি ঘুরিয়ে নিজেদের গন্তব্যে নিয়ে এলো। জিশান গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘অ্যালেন, তুই তো একটা লম্বা ট্রিপ থেকে ফিরে এসেই এক্সিডেন্ট করলি। তারপর পড়ে রইলি হসপিটালের বেডে। আমরা এখন পর্যন্ত কোন ইনজয়ও করতে পারলাম না। চল, আজকে তিন বন্ধু মিলে পুরো ফাটিয়ে দিবো।’
রাইয়ান ও অ্যালেন নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। জিশান গাড়ির দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই দেখলো হৃদি যেখানে বসে ছিল সেই সিটে একটা ফোন রাখা। জিশান সেটা বের করে দেখিয়ে বলল,
‘হৃদি মনে হয় ভুলে ফোন রেখে গেছে।’
অ্যালেন বলে উঠলো, ‘এখন কি হবে?’
রাইয়ান বলল, ‘সমস্যা নেই, আমার কাছে দে। আমি ওঁকে পরে দিয়ে দেবো।’
অ্যালেন বলল, ‘না হয় তোরা ভেতরে যা। আমি ওঁকে ফোনটা দিয়ে আসি। বেশি সময় লাগবে না।’
রাইয়ান আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, ‘হেই, তুই ওঁর এতো কেয়ার করছিস কেনো?’
অ্যালেন মৃদু হাসলো। খানিক সময় নিয়ে এরপর বলল,
‘আমার মনে হয় হৃদি খুবই প্রীটি একটা মেয়ে। আমার ওঁকে খুব ভালো লেগেছে।’
রাইয়ানের মুখ হা হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে বলল,
‘এই, তুই বোধহয় জানিস না হৃদি আমার……’
অ্যালেন রাইয়ানকে থামিয়ে বলল,
‘তোর স্ত্রী তাই তো! আমি জানি। কিন্তু তুই না হৃদিকে পছন্দ করে বিয়ে করিসনি! তোদের বিয়ে না নরমাল না?’
অ্যালেনের মুখে এই কথা শুনে রাইয়ান অবাক বিস্মিত মুখে তাকালো জিশানের দিকে। অ্যালেনের পেছন থেকে জিশান কানে হাত দিয়ে নিঃশব্দে সরি বলল। ইশারায় বোঝালো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে তার। রাইয়ান আবারো অ্যালেনের দিকে তাকালো। অ্যালেন বলতে লাগলো, ‘তাহলে তোদের ডিভোর্সের পর আমার হাতে তো চান্স আছেই তাই না! তাহলে আর সমস্যা কি?’

রাইয়ান কিছু না বলে গটগট করে ভেতরে চলে গেলো।
___________________________________________________

মিঁয়োকে কোলে নিয়ে সোফার উপরে বসে আছে হৃদি। রাত বাজে সবে সাড়ে আটটা। রাইয়ান বলেছিল তার আজ অফিসে একটা মিটিং আছে। আসতে দেরি হতে পারে। কিন্তু রাইয়ান যখন সময়ের আগেই চলে এলো, হৃদি খানিক অবাক হলো। ঘরে ঢুকে কোন কথা না বলেই সোজা রুমে চলে গেলো রাইয়ান। গা থেকে ফর্মাল শার্ট প্যান্ট খুলে একটা উলের পাতলা সোয়াটারের মতো পোশাক পড়ে নিলো। তারপর চলে গেলো স্টাডি রুমে। হৃদি বুঝতে পারলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। রাইয়ানের মন মেজাজ খুব একটা সুবিধের নেই আজ। প্রায় অনেকক্ষণ পর এক গ্লাস পানি নিয়ে সে আস্তে আস্তে গেলো রাইয়ানের কাছে।
রাইয়ান ল্যাপটপ খুলে মুখ শক্ত করে বসে ছিল। হৃদি ওঁর সামনে গ্লাস রেখে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। অনেকক্ষণ কিছুই বললো না। দেখলো রাইয়ানের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। তাই আস্তে আস্তে ডেকে বলল, ‘রাইয়ান, খেতে চলো।’
রাইয়ান না তাকিয়েই বলল, ‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
হৃদি বলল, ‘কেনো?’
দেখলো রাইয়ান কোন জবাব দিচ্ছে না। তারপর আবার কিছু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে রাইয়ান?’
রাইয়ান সাথে সাথেই কিছু বলছে না দেখে হৃদি ভাবলো রাইয়ানের বুঝি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। হৃদি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠার কথা ভাবতেই হঠাৎ রাইয়ান অভিযোগের সুরে বলতে লাগলো,
‘আমাদের কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার মি. অ্যাডাম নিজেকে কি ভাবে কে জানে! নিজে লেট করে আসায় ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং ক্যান্সেল হয়ে গেলো আর সে কিনা আমাকে বলে আমার গাফিলতির জন্যই ক্যান্সেল হয়েছে। আমি নাকি ক্লায়েন্টকে ধরে রাখতে জানি না। নিজে কখনো কোন কাজ ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারে না আর সে কিনা আমাকে কথা শোনায়। নেহাৎ কোম্পানির একজন শেয়ারহোল্ডার বলে তাকে কিছু বলতে পারছি না। এখন কিছু বলতেও পারছি না আবার নিজেকে শান্ত করতেও পারছি না। আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে।’

হৃদি মৃদু হাসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে রাইয়ানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা সাদা কাগজ আর কলম রাইয়ানের সামনে রেখে বলল, ‘তাহলে বাঁচাও মাথা ফাটা থেকে।’
রাইয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো হৃদির দিকে। বলল,
‘মানে?’
হৃদি মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘তুমিই না বললে তুমি কিছু বলতে পারছো না বলে নিজেকে শান্ত করতেও পারছে না। তাই এখানে বলে দাও। নিজের মনের এমন যত কথা যেগুলো তোমাকে বিচলিত করে, জ্বালাতন করে, শান্তি দেয় না সেসব তুমি লেখে ফেলো। দরকার হলে লিখে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দাও। তবুও লিখবে। তাহলেই দেখবে মনটা হালকা হয়ে যাবে। মনের মধ্যকার চাপটাও একটু কমবে।’
রাইয়ান হেসে উড়িয়ে বলল,
‘সিরিয়াসলি?’
হৃদি জোর দিয়ে বলল, ‘হুম, আমিও এমনটাই করি। এন্ড ট্রাস্ট মি, এটা খুবই এফেক্টিভ। মাঝে মধ্যে মনের কথা মন থেকে বের হওয়া দরকার। সেটা যদি কাউকে বলা না যায় তাহলে লিখে করলাম। নয়তো এমনটাই লাগবে ‘মাথা ফেটে যাচ্ছে!’
হৃদি কাগজের মাঝখানে কলম দিয়ে শিং গজানো একটা মাথামোটা কার্টুনের মতো আর্ট করলে। এরপর উপর লিখে দিলো মি. অ্যাডাম। এরপর ওটার মুখের উপর কলম দিয়ে ক্রসের মতো কেটে দিলো। এরপর রাইয়ানের দিকে বাড়িয়ে ধরলো কলম। রাইয়ান প্রথমে কলমের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর আস্তে আস্তে কলমটা ধরলো সে। হৃদির দিকে তাকালো। হৃদি ভ্রু উঁচিয়ে করতে ইশারা করলো। এরপর রাইয়ানও গাঢ় করে কার্টুনটার মুখের উপর কেটে দিলো। পরপর আরেকবারও এমন করলো। এরপর বেশ কয়েকবারই এমনটা করে শেষমেশ আনমনে মৃদু হেসে ফেললো রাইয়ান। হৃদিও হাসলো, এরপর বলল,
‘এবার তো খেতে চলো।’
রাইয়ান বলল, ‘না হৃদি, সিরিয়াসলি আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি খাবো না। আমার অনেক কাজ আছে। সেগুলো করতে হবে।’
এরপর আর কি করার হৃদিকে চলে আসতে হলো। ল্যাপটপ অন করে কাজ শুরু করলো রাইয়ান। হৃদি পুরোপুরি চলে গেলে আবারো কার্টুন আঁকা কাগজটার উপর একটা কলম নিয়ে রাইয়ান সেখানে লিখলো, ‘তুমি একটা স্টুপিড,’ ‘ইডিয়ট।’ ‘তোমার পাগলাগারদে যাওয়া উচিত মাথা মোটা।’ এরপর কাগজটা দলামোচরা করে দূরে রাখা ডাস্টবিনের দিকে নিশানা ছুড়লো। কাগজটা নিশানা বরাবর ডাস্টবিনে গিয়ে পড়লে তবেই শান্তি পেলো সে।

এরপর রাইয়ান পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার কাজ নিয়ে। গভীর রাত পর্যন্ত একটানা কাজই করে গেলো সে। ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা, বারোটা এরপর ধীরে ধীরে দুইটার ঘরে গিয়ে ঠেকলো। অবশেষে সব কাজ শেষ করলো রাইয়ান। ল্যাপটপ বন্ধ করে, ফাইলপত্র গুছিয়ে রেখে স্টাডি রুম থেকে বের হয়ে এলো। লিভিং এরিয়ার লাইট বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ হাত থমকে গেলো তার। দেখলো সুইচের পাশে একটা হলুদ রঙের ছোট্ট চিরকুট আটকানো। সেখানে লেখা,

‘আমাকে বন্ধ করার আগে পেছনে ঘুরে মাত্র সাত কদম আগাও আর ফ্রিজের দরজাটা একটু খুলো প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!’

একটা কিউট অনুরোধ করা মুখের ইমুজিও আঁকা সেখানে। রাইয়ানের ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম কৌতূহলী হাসির রেশ ফুঠে উঠলো। ধীরে ধীরে ফ্রিজের কাছে গেলো সে। ফ্রিজের দরজা খুলে দেখলো সেখানে একটা প্লেটে বড় একটা চারকোণা সাইজের স্যান্ডউইচ রাখা। যার উপরে ঝিড়ি ঝিড়ি করা চিজ দিয়ে একটা সেড মুখের ইমুজি বানানো। পাশে নীল রঙের চিরকুটে লেখা,

‘মাইক্রোভেনের উঞ্চ তাপে আমার মন খারাপ ভাব গলিয়ে দাও! গলিয়ে দাও!’

তারপর একটা করুণ মুখের ইমুজি। রাইয়ানের ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো। ওভেনে স্যান্ডউইচের প্লেট রেখে ওভেন অন করে দিলো সে। চিজ গলে গিয়ে সেড ইমুজি পুরোপুরি মিশে গেলো। রাইয়ান বের করে আনলো প্লেট। সেই সময় তার পায়ের কাছে দুলতে দুলতে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো মিঁয়ো। রাইয়ান দেখলো মিঁয়োর গলার ফিতায় একটা গোলাপি রঙের চিরকুট আটকানো। যেখানে লেখা,

‘আমি আমার প্রিয় খাবার তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। এবার তা খেয়ে আমাকে আমার বড় মনের পরিচয় দিতে দাও। হুহ!’

নিচে একটা ফু দেওয়া মুখের ইমুজি। রাইয়ান এবার হেসেই ফেললো। চিরকুটের পেছনে উল্টে দেখলো বাম দিকে এরো চিহ্ন আঁকা। রাইয়ান বামে তাকালো। দেখলো একটা কাঁচের মিনি ফ্লাক্সে দুধ ভরা। রাইয়ান সেটা হাতে নিলো। দুধ আর স্যান্ডউইচ নিয়ে টেবিলে এসে বসলো। টেবিলের মাঝখানে একটা টমেটো সসের বোতল। তার গায়েও একটা সাদা রঙের চিরকুট। লেখা,

‘এমনিতে তো আমি খাবারে এক্সট্রা ফ্লেভার যোগ করার কাজ করি কিন্তু তুমি আমাকে স্মাইলি ভাব আনার জন্যও ব্যবহার করতেই পারো।’

নিচে একটা স্মাইলি ইমুজি। রাইয়ান মৃদু হেসে স্যান্ডউইচের উপর সস দিয়ে তেমনই একটা স্মাইলি ইমুজি আঁকলো। এরপর খাওয়া শুরু করলো।
সবশেষে রুমে ঢুকে দেখলো আয়নার গায়ে আরো একটা সবুজ রঙের চিরকুট লাগানো। সেখানে লেখা,

‘তোমারই প্রতীক্ষায় একদম পরিষ্কার, ঝকঝকে, তকতকে হয়ে আছি। এবার দেখো তো ভালোভাবে। হাসিমুখে যখন এতো ভালো লাগে তখন আবার মন খারাপ করো কেন? হুম?’

এরপর একটা বাঁকা চোখের চাহনি ইমুজি। রাইয়ান হেসে সোফার উপর ঘুমিয়ে থাকা হৃদির কাছে এলো। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা গায়ে ভালো করে টেনে দিলো। হাসিমুখে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল, ‘পাগল!’

চলবে,