অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৬৫+৬৬

0
895

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৫

একে অপরের সাথে দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি, হাসি-কান্নার মধ্যে দিয়েই নীলার হসপিটালের সুদীর্ঘ দিনগুলো অতিবাহিত হলো। প্রতিদিন হসপিটালে আসা অসংখ্য অপরিচিত মুখের মধ্যেও যেন এই কাপলযুগলকে আলাদাভাবে চেনা যায়। সকলের কাছে তারা অতি পরিচিত মুখ। হয়তো বা খুব সকালে উষ্ণ দীপ্ত সূর্যের কিরণে এক গর্ভবর্তী স্ত্রীর প্রতি প্রিয়তমের অগাধ ভালোবাসা চোখে পড়ে, বা কখনও হসপিটালের সামনের খোলা জায়গাটুকুতে দুইজনকে শালীনতার প্রেমময়ী কথোপকথনে ব্যস্ত দেখা যায়৷ আবার কখনও বা সবার থেকে খানিকটা সময় আলাদা হয়ে শেষ বিকেলের আদুরেঘন ভালোবাসায় এক পাগলামি স্বামীর প্রিয়তমাকে সযত্নে আগলে রাখতে দেখা যায়। হসপিটালের গুমট পরিবেশটাকেও যেন তারা হেলায় ফেলে দিয়ে নিজ দাপটে এগিয়ে চলেছে। তাইতো হসপিটালের বিগত দিনগুলোর জার্নিতে সাদিদ-নীলা দম্পতি আজ পরিচিত নাম।
আর এরিসাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলো মানবজীবনের এক চিরন্তন সত্য পরিবর্তনের ছোঁয়া।
এইতো যেমন নীলা সবে প্রেগনেন্সির সাইত্রিশ তম সপ্তাহ শেষ হয়ে আটত্রিশ তম সপ্তাহে পা দিয়েছে। তার ছোট্ট উঁচু পেটটা এখন আর সেই ছোট্টটি নেই। রোগা পাতলা শরীরে কেবলমাত্র পেটটাই যেন চোখে পরে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার সাথে সাথে নীলার মধ্যে ক্রমশ প্রি-এক্লাম্পসিয়া জনিত সমস্যাগুলোও প্রকট হচ্ছে। ডেলিভারির দিন যত এগিয়ে আসছে তার শারীরিক অবস্থা ততই যেন খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যেমন আজকের সারাটাদিন মোটামোটি ভালোভাবে কাটলেও রাতের খাওয়াদাওয়া করে ঘুমানোর পরে তার তলপেটে চিনচিনে একটা ব্যাথা শুরু হয়। সময় বাড়ার সাথে সাথে যা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এখনও অসহ্যকর সেই তীব্র ব্যাথাটা রয়েই গিয়েছে। নীলা এতক্ষণ মুখ বুজে সহ্য করার চেষ্টা করলেও এখন যেন সহ্যসীমার ক্রমশ বাহিরে চলে যাচ্ছে। নীলা ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। তার সারা শরীর ইতিমধ্যেই ঘেমে চুপচুবা। সাদিদ কেবিনের এসির পাওয়ারটা আরেকটু কমিয়ে দিলো। তাতেও যেন মেয়েটার অস্বস্তি বাড়ছে বৈকি কমছে না৷ সাদিদ তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

— ‘ পাখি একটু ছাড়ো আমাকে। ব্যাথাতো কমছে না৷ ডক্টরকে ডেকে আনি। ‘
— ‘ নাহ্ লাগ..বে না৷ ব্যাথা এ..মনিতেই সেরে যা..বে। কিন্তু আপনি যা..বেন না৷ ‘
— ‘ পাগলামি করে না সোনা৷ আমি যাব আর আসবো। ‘
— ‘ প্লি..জ না। ‘

নীলা অতিরিক্ত ব্যাথায় একপ্রকার কাতরাচ্ছে। কথাগুলো বারবার গলায় লেগে আসছে। সাদিদ উঠে যেতে চায়ছে। কিন্তু জেদি মেয়েটা সময়ে-অসময়ে বাচ্চাদের মতো জেদ ধরেছে।

— ‘ আচ্ছা যাব না। একটু ছাড়ো। ‘

সাদিদ বলতে বলতেই নীলাকে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো। সবসময় যেমনটা করে তেমনিভাবে প্রিয়তমাকে আদর আদরে পরিপূর্ণ করতে লাগলো। নীলা পেটে হাত চেপে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে চায়ছে। সাদিদ উঁচু পেটেটাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট অগণিত আদুরে চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ ব্যাথা কমেছে সোনা? ‘

নীলা প্রিয়তমের এই আদুরে কথার পরিবর্তে কেবল অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা ডানে-বামে করলো। সাদিদের মুখটা নিমিষেই যেন বিষণ্নতায় ছেয়ে গেল। যুদ্ধে হেরে যাওয়া সৈনিকের ন্যায় কাতর স্বরে বলে উঠল,

— ‘ এই ব্যাথা আদরেও কমে না? ‘

নীলা জলে ভেজা টলমলে এক রাজ্যের অসহায়ত্বভরা চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। অতঃপর আর ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে এবার ডুকরে কেঁদেই উঠল। সাদিদ আর নীলা কোনোরকম বারণ মানলো না। প্রিয়তমার কপালের মধ্যেখানে খুব দ্রুত আলতো করে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে কেবিনের দরজা খোলে বাহিরে চলে গেল।
সাদিদ অল্প কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যেই ইমারজেন্সিতে থাকা ডক্টরদের পুরো টিমসহ কেবিনে হাজির হলো। ডক্টররা নীলার অবস্থা দেখে দ্রুত এগিয়ে আসলো৷ নীলা ইতিমধ্যেই পেটে-পিঠে অসহ্যকর ব্যাথা নিয়ে কৈ মাছের মতো অনবরত কাতরাচ্ছে। ডক্টররা দ্রুত এসে তার ব্লাড প্রেশার চেক করলো। বরাবরের মতোই উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু আজকে যেন পরিস্থিতি বিপদসীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। শীতের হালকা আবহাওয়া তার সঙ্গে এসির হিমশীতল কেবিনে থেকেও যেন নীলার সমস্ত শরীর বিন্দু বিন্দু ঘামে চুবচুবা হয়ে যাচ্ছে। এমনিকরে চলতে থাকলে যেকোনো সময় ভয়াবহ বিপদ ঘটে যাওয়ার চূড়ান্ত সম্ভাবনা রয়েছে। ডক্টররা আসন্ন বিপদের আশংকা করে একে-অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। নীলার পাশে এতজন ডক্টর থাকা সত্বেও সাদিদ যেন বিন্দুমাত্র শান্তি পাচ্ছে না। নীলার পাশে বসে প্রিয়তমার ডানহাতটা শক্ত করে নিজের শক্তপোক্ত হাতের মুঠিতে চেপে ধরে অস্থিরতা মিশ্রিত লেগে যাওয়া ধরা গলায় বলে উঠল,

— ‘ ব্যাথা একটুও কমছে না পাখি? ‘
— ‘ নাহ্ ‘

বলতে বলতেই নীলার চোখের কোণ বেয়ে আবারও দুইফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। সাদিদ আলতো হাতে ভেজা গালটা মুছিয়ে দিয়ে ইমারজেন্সিতে থাকা ডক্টরদের উদ্দেশ্য এবার কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠেই বলে উঠল,

— ‘ ডক্টর, নীলাঞ্জনার এতো পেইন কেন হচ্ছে? এর আগে তো কখনও এতো যন্ত্রণা হতে দেখেনি। ‘
— ‘ স্যার, আমরা ইতিমধ্যে সিনিয়রের সাথে কথা বলেছি৷ সম্ভবত উনার এখনই অপারেশন লাগতে পারে। ‘
— ‘ মানে কি? এখনও তো ডেইটের অনেক দিন বাকি আছে। ‘
— ‘ সরি স্যার। কিন্তু এসব পেশেন্টের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময় বলে দেওয়া যায় না৷ অনেক সময়ই ডেইটের আগে বাচ্চা প্রসব হয়ে যায়। এখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। সম্পূর্ণটাই পেশেন্টের শারীরিক কন্ডিশনের উপর ডিপেন্ড করে। ‘

ডক্টরের মুখে এমন কথা শুনে সাদিদের মুখটা নিমিষেই যেন রক্তশূন্য ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। নীলার গালে রাখা ডানহাতটা মৃদুভাবে কেঁপে চলেছে।
সে অসহায় চোখে নীলার দিকে তাকালো। নীলাও ছলছল চোখে সাদিদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। অশ্রুকণাগুলোকে ছাপিয়েও যেন নীলার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। কিন্তু সাদিদ হাসতে পারলো না৷ নীলার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে তার ডানহাতটা শক্ত করে নিজের মুঠিতে আবারও চেপে ধরলো। এবং সেটা অবশ্যই পূর্বেকার থেকে দৃঢ়। নরম হাতটাতে নিজের পুরুষালী রুক্ষ ঠোঁটটা ছুঁইয়ে ভাঙা স্বরে বলল,

— ‘ কিছু হবে না লক্ষীটি। কিছু হবে না তোমার। আমি কিছু হতে দিবো না তোমাদের। ‘

নীলার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে আবারও কয়েক ফোঁটা অশ্রুকণা বেয়ে পড়ল। সাদিদের ধরে রাখা হাতটা নিজের মুখের সামনে এনে নিজের ভেজা গালে ছুঁইয়ে দিলো। একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষালী হাতটার উষ্ণ ছোঁয়া গালে ছুঁইয়ে দিতে দিতেই ব্যাথাজনিত কাতর কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমাকে কথা দিন বাবুর আব্বু, যদি ফিরে আসতে না পারি নিজের কোনোরকম অবহেলা করবেন না। আমি থাকি বা…
— ‘ পাখি? মার দিব কিন্তু। ‘

সাদিদের গম্ভীরস্বরের ধমকেও নীলা থামলো না। একটুও ভয় না পেয়ে নিজের অসমাপ্ত বাক্য পুনরায় সমাপ্তিতে লাগলো,

— ‘ ইশশ বলতে দিন না। যদি আর কখনও সুযোগ না আসে। ‘
— ‘ আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি নীলাঞ্জনা। ‘
— ‘ শুনুন না। নিজের কিন্তু অবহেলা করবেন না। বাবুকে দেখতে হবে না? আপনি ভেঙে পড়লে তাকে কে সামলাবে। ‘
— ‘ চুপ কর লক্ষীটি। প্লিজ একটু চুপ কর। আমি তোর এসব কথা সহ্য করতে পারছি না। ‘

সাদিদ নীলার হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে অনবরত তাকে নিষেধ করে যাচ্ছে। কিন্তু নীলা যেন আজকে বলতেই চায়। তার যে বড্ড ভয়, যদি আর কখনও এই কথাগুলো প্রিয় মানুষটাকে বলার সুযোগ না আসে!

— ‘ মেম প্লিজ আপনি একটু শান্ত হয়ে থাকুন৷ স্যার আপনাকেও এবার সরে যেতে হবে। উনাকে এখনই ওটিতে ট্রান্সফার করতে হবে৷ ‘
— ‘ একদম না। আমি ওকে ছেড়ে কোথাও যাব না। যা করার আমার সামনে থেকেই করুন। ‘
— ‘ স্যার প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন৷ আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই৷ যত দ্রুত সম্ভব উনাকে ওটিতে নিতে হবে। তাই আমাদের কাজে সহয়তা করতে প্লিজ কো-অপারেট করুন। ‘

ইতিমধ্যে নীলাকে রেগুলার চেক-আপ করেন যিনি, ডক্টর ফারজানা করিম এসে হসপিটালে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি ডক্টরদের সাথে সাদিদের লাস্ট কনভারসেশনটুকু শুনেই বলে উঠলেন,

— ‘ প্লিজ সাদিদ, এই মুহূর্তে পাগলামি করবে না। নরমাল ডেলিভারি হলে আমি অন্ততপক্ষে এই পারমিশনটুকু দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। প্লিজ আমাদের সময় নষ্ট করো না। ‘
— ‘ আমি এতসব বুঝতে চাই না৷ ওকে আমি একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে পারবো না। প্রয়োজন হলে আমি ওকে তোমাদের হসপিটাল থেকেই নিয়ে যাব। দরকার নেই এমন হসপিটালে থাকার যেখানে আমার পাখিকে দূরে সরিয়ে রাখবে। ‘

সাদিদের কন্ঠে তুমুল রাগের আভাস। ডক্টর ফারজানা করিম একটা হতাশাজনক শ্বাস ফেললেন। পূর্ব পরিচিত বলে সাদিদের জেদের পরিমাণ তার ভালোই জানা আছে। তাই বেশি না ঘেঁটে তাকে নীলার সাথে কিছু মুহূর্ত একা ছেড়ে দিলো। আর অপরদিকে ডিউটি নার্সদের বললেন অপারেশনের জন্য সবকিছু রেডি রাখতে। আর তারা ডক্টরদের মিটিং রুমে যাচ্ছেন। নীলার কন্ডিশন এবং মা-বাচ্চার দুইজনেরই সুস্থতার জন্য পরবর্তীতে কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেই জন্য এখনই একটা মিটিং করতে হবে।
রুমটা কিছু মুহূর্তের জন্য ফাঁকা হতেই সাদিদ নীলার ব্যাথাতুর শরীরটাতে আরেকটু মিষ্টি ভালোবাসার ব্যাথা দিতে প্রিয়তমার বুকে মাথা রাখলো। অতঃপর দুইহাতে নীলাকে আলতো করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।

— ‘ আপনি এমন পাগলামি করছেন কেন? এতে যদি বাবুর কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? ‘
— ‘ চুপ, কিচ্ছু হবে না। না আমাদের প্রিন্সেসের না আমার পাখির৷ তুমি একদম খারাপ চিন্তাভাবনা মাথাতে আনবে না। ‘

সাদিদ নিজে নীলাকে মৃদুভাবে শাসাচ্ছে আর অপরদিকেই সে নিজেই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। মুখে হাজার অস্বীকার করুক কিন্তু নীলাতো তার মনের কথাটা বুঝতে পারছে। কেন সে এতো ভয় পাচ্ছে। কেন নীলাকে চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না,

— ‘ কতক্ষণ এভাবে আটকে রাখবেন? ‘
— ‘ সারাজীবন। ‘

সাদিদের একরোখা জেদি স্বর। নীলা কান্নাজড়িত চোখে হেসে ফেলল। ইশশ কতো প্রশান্তি। সাদিদ মাথা তুলে নীলার মুখপানে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলো৷ নীলার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসিটুকু যেন খরা মরুভূমির মধ্যে এক পশলা বৃষ্টির জল। সাদিদের ঠোঁটের কোণে ও মৃদু হাসির রেখা দেখা দিলো। সে মাথা উঠিয়ে নীলার মুখোমুখি হলো৷ নরম গালগুলোতে আলতো করে ধরে নীলার চোখে চোখ রাখলো। এককথায় নিঃশব্দে যেন অনুমতি চাওয়া। নীলা চোখজোড়া বন্ধ করে সাদিদের ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে তাকে কাছে টানলো। যেন নীলাও নীরব সম্মতিসূচক বাক্য আওড়ালো। তাহলে হোক না কিছু আশ্লেষী ভালোবাসা স্থান-কালের উর্ধ্বে। আবার যদি কখনও ভালোবাসায় সেই পাগলামি করার সুযোগ না আসে? যদি প্রকৃতি নিজের কোমলতা ভুলে গিয়ে কঠোর হতে চায়? তাহলে যে এই পাগলামিগুলোই সারাজীবনের জন্য পুঁজি হয়ে থাকবে। যখন স্বপ্নের সুখ মুহূর্তগুলোকে নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে একান্ত প্রিয়জন ব্যতিত দীর্ঘ রজনী।
সাদিদের ভারী নিঃশ্বাস নীলার চোখে-মুখে উপচে পরছে। আর তিরতির করে তার পাতলা ঠোঁটগুলো কেঁপে চলেছে। সাদিদের চোখে আজ বিন্দুমাত্র নেশার লেশ নেই। কেবল রয়েছে প্রিয়তমাকে প্রবলভাবে ভালোবাসার আকাঙ্খা। আদুরে সুখে তার সবটুকু কষ্ট শুষে নেওয়া। সাদিদ সেটাই করলো। নীলার নরম গালগুলোতে হাত বুলিয়ে পুরুষালি রুক্ষ ঠোঁটে প্রিয়তমার কোমল ঠোঁটজোড়া পুরে নিলো। অতঃপর দৃঢ় গভীর আদুরে চুমুতে লিপ্ত হলো।
নীলার চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোটা সুখের অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। আর কি কখনও এই ভালোবাসাগুলো তার কপালে জুটবে? পাবে কি প্রিয়তমের শক্তপোক্ত শরীরের সেই আদুরে স্পর্শ? নাকি অভাগীর কপালে বেশি সুখ বিধাতা আর সহ্য করবেন না? কোনটা?
বুকফাটা কষ্টরা নীলার হৃদপিণ্ডে যেন চেপে বসেছে। সাদিদের আজকের আদরে তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? এটা কি আর কখনও এমন আদুরে ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট?
নীলা তার উত্তর খোঁজে পেল না। আর না আরেকটু ভালোবাসায় মুড়ানো আদর তার ভাগ্যে জুটলো!
কেবিনের দরজায় দাড়ানো নার্সের মৃদু খুকখুক কাশির আওয়াজে সাদিদ নীলার ঠোঁট ছেড়ে দিলো। তাকে নীলার থেকে সরে আসতে দেখেই নার্স বিনয়ীভাবে বলল,

— ‘ সরি স্যার, আপনাদের প্রাইভেট মোমেন্টে ইন্টারফেয়ার করার জন্য। কিন্তু উনাকে এখন নিয়ে যেতে হবে। আর লেইট করা যাবে না। ‘

সুপ্ত রাগটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই সাদিদ রাগীস্বরে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু নীলা এবার আলতো করে তার ডান হাতটাতে টান দিলো। অনবরত মাথা নাড়িয়ে তাকে কিছু না বলার জন্য বলছে। আদুরে মুখটা দেখে সাদিদের রাগটা মুহূর্তেই ধমে আসলো। প্রিয়তমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে তাকে নীরবে আশ্বাস দিলো।
তারা নীলাকে সি-সেকশনের জন্য ড্রেস চেইঞ্জ করিয়ে রেডি করাতে আসতেই সাদিদ রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। করিডোরে আসতেই পরিবারের প্রত্যেকটা চেনা মুখগুলোর সাথে চোখাচোখি হলো। ইতিমধ্যে দুই পরিবারের সবাই নীলার অবস্থার কথা শুনেই রাতের ঘুম হারাম করে হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। তাদের মধ্যে থেকে ছোট্ট শাদমান পর্যন্ত বাদ যায়নি। নিধি ঘুমন্ত ছেলেটাকেও কোলে নিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। সাদিদকে বের হতে দেখেই শায়লা রহমান এগিয়ে এসে বিধ্বস্ত মুখে দাড়িয়ে থাকা স্নেহের পুত্রকে জড়িয়ে ধরলেন৷ মাথার উশকো খুশকো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে স্নেহভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,

— ‘ চিন্তা করিস না বাবা। আমরা ফারজানার থেকে সব শুনেছি। দেখবি আল্লাহর রহমতে সব ভালো হবে। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে হবে? ‘

সাদিদ প্রতিউত্তর দিতে পারলো না। শুধু চোখগুলো ভীষণ জ্বলতে লাগলো। সেকি আগুনের উত্তাপের সমতূল্য তীব্র ব্যাথাজনিত কষ্টের লোকায়িত অশ্রুজলের কারণে? নাকি অন্য কিছু? সেটাতো ভাঙা হৃদয়ের প্রেমিক পুরুষই ভালো জানবে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নীলাকে স্ট্রেচারে করে কেবিনের বাহিরে আনা হলো। একে একে সবকটি আপনজন এসে ভালোবাসার আদরমাখানো দোয়া করে গেলেন। মমতাময়ী জননী সশব্দে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে সবসময়কার তীক্ষ্ণতা ভুলে নরমস্বরে বলে উঠলেন,

— ‘ ভয় পাস না মা। মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরণ কর। দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ‘

নীলা আলতো করে হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। শব্দগুলো যেন গলায় কাঁটার মতো এসে বিঁধেছে। কিছুতেই বেড়িয়ে আসতে চাইছে না।

— ‘ এবার ওকে যেতে দিন। ‘

ডক্টর ফারজানার কথায় প্রত্যেকটা চোখ তার দিকে ফিরে তাকালো। যেন ভীষণ ভয়ানক একটা কথা তিনি বলে ফেলেছেন। তাই ডক্টর স্বভাবসুলভ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ‘ আমাকে হাজার অপছন্দ হলেও এই মুহূর্তে ওকে আমাদের নিয়ে যেতেই হবে। এমনিতেই আপনাদের গুণধর পুত্রের জন্য এতটা সময় পেরিয়ে গেল। সত্যিই আর অপেক্ষা করা যাবে না। ‘

স্ট্রেচারটা অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যেতেই নীলা ঘাড় ফিরিয়ে একপলক সাদিদের দিকে তাকালো। আর মুহূর্তেই যেন বুকে কেউ শক্ত করে চেপে ধরলো। এতো কেন যন্ত্রণা হচ্ছে?
রক্তলাল চোখে সাদিদ একদৃষ্টিতে নীলার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখের পাতাও যেন পরছে না। নীলাও নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। কিন্তু হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো না। হয়তো বা দূরে রেখেই কষ্টগুলো খানিকটা ধামাচাপা দিতে চাইল। কিন্তু সাদিদ এগিয়ে আসলো৷ অসার হওয়া পা গুলো চালিয়ে নীলার একবারে নিকটে এসে দাড়ালো। নিচু হয়ে প্রাণপাখিটার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে, সবার সামনেই কপালের মাঝখানে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা দীর্ঘ উষ্ণ চুমু খেল।

— ‘ ভালোবাসি প্রাণপাখি। ভীষণ ভালোবাসি। ‘

আর সাথে সাথেই এতক্ষণের চেপে রাখা অশ্রুজলটুকু চোখের কার্ণিশ গড়িয়ে পড়ল। নীলা ঠোঁট চেপে ডুকরে আসা কান্নাটা আটকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। অতঃপর কাঁপা হাতটা দিয়ে সাদিদের চোখের কোণটা আলতো করে মুছিয়ে দিয়ে ভাঙা নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমিও। ‘

অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা বন্ধ হবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দুইজোড়া জলে টলমল চোখ কেবল একে-অপরের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল।
সাদিদ কারো সাথে আর কিচ্ছুটি না বলে থিয়েটার রুমের সামনের চেয়ারে মাথায় হাত চেপে বসে পড়ল। কেউ তার মুখখানা দেখতে পারছে না এটাই ভালো৷ নতুবা রক্তলাল চোখযুগল দেখলে যে কারোই আত্মা একবার হলেও ধক করে উঠবে। এরিমধ্য ওটি নার্স একটা পেপারে পেশেন্টের সাথে আসা লোকের থেকে সিগনেচার নিতে আসলেন,

— ‘ স্যার এটাতে আপনার একটা সিগনেচার লাগবে। ‘

সাদিদ মাথা না তুলেই গম্ভীরস্বরে প্রতিউত্তর করলো,

— ‘ কি এটা? ‘
— ‘ কিছু ফর্মালিটিস স্যার। অপারেশন চলাকালীন পেশেন্টের বা বেবির কিছু হয়ে গেলে সেখানে হসপিটাল কতৃপক্ষ দায়বদ্ধ থাকবে না৷ তাই আপনার সিগনেচার এখানে আবশ্যক। ‘
— ‘ আপনার সাহস কিভাবে হয় এই কথা বলার? ‘

সাদিদের বিক্ষিপ্ত রক্তলাল চোখে এমন উচ্চ গলায় হুংকার শুনে কর্তব্যরত মেডিকেল স্টাফ খানিকটা ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন। সাদিদ তাতেও থামলো না। আঙুল উঁচিয়ে শাসালো,

— ‘ খবরদার, খবরদার যদি আর একবার আমার পাখিকে নিয়ে এসব কথা বলেছেন তো। কিচ্ছুটি হবে না ওর। কিছু.. না। ‘

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে সাদিদের গলাটা মৃদুভাবে যেন কেঁপে উঠল। নার্স ভয়াতুর চোখে সাদিদের দিকে তাকাতে লাগলো। পেশেন্টকে সাথে নিয়ে আসা আপনজনদের থেকে এটা-ওটা তারা হরহামেশাই শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু এই লোক যেন সাক্ষাৎ এক অগ্নি লাভা। যাকে একটু ছুঁয়ে দিবার আগেই হাত ঝলসে যাবে।
কিন্তু তাকে যে নিজের দায়িত্ব পালন করতেই হবে৷ তাই সে একটুখানি আশার আলোর জন্য বাকি সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করেছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আরিফ মাহমুদ এগিয়ে আসলেন৷ পিতা হয়ে নিজ আদরের কন্যার জন্য তার মনটাও কেঁদে উঠছে। কিন্তু তারপরও সবাইকে যে এই মুহূর্তে ভেঙে পরলে চলবে না৷ এদিকে সাদিদ বিধ্বস্ত অবস্থায়, ঐদিকে মেয়ে আর নিজ আদুরে পিচ্চি বোনের অবস্থায় নার্গিস খাতুন আর নিধিও চাপা কান্না কেঁদে যাচ্ছে। কাউকে তো ফর্মালিটিসগুলো পূরণ করতেই হবে। তাই তিনি এগিয়ে এসে বিষণ্ণ গলায় বলে উঠলেন,

— ‘ আমি নীলাঞ্জনার বাবা। হাসবেন্ডের পরিবর্তে আমি সিগনেচার দিলে চলবে? ‘
— ‘ জ্বি চলবে৷ ধন্যবাদ আঙ্কেল। ‘

নার্স সিগনেচার করা পেপার নিয়ে চলে গেল। আরিফ মাহমুদ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বাম দিকে তাকাতেই সাদিদের সাথে চোখাচোখি হলো। সাদিদ একদৃষ্টিতে উনার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের নীরব ভাষায় যেন মনঃক্ষুণ্ন অভিযোগ। তার প্রাণপাখিকে নিয়ে এমনটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। রক্তলাল চোখের গভীরে জলে টলমল করা চোখগুলো এক আদুরে কন্যার চিন্তায় বিভোর বাবার নজর নড়ালো না৷ তিনি নিজেও চশমা খুলে চোখের কোণটা মুছে নিলেন। আজকে চোখে এতো পানি আসছে কেন?
বাহিরে কি আজ ধুলাবালি একটু বেশিই? নাকি প্রকৃতি তার আগাম নিষ্ঠুরতা জানাতে পূর্ব পরিকল্পনা শেষ করছে?

.

নীলাকে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পরপরই সে আলতো করে ডক্টর ফারজানার হাতটা চেপে ধরলো৷ ডক্টর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তার দিকে তাকাতেই সে একেবারে নিচুস্বরে মিনতিপূর্ণ গলায় বলল,

— ‘ কথা দিন, আমার যাই হয়ে যাক না কেন বাবুকে কিছু হতে দিবেন না। তাকে নিয়ে কোনোরকম রিক্স নিবেন না? ‘
— ‘ নীলা এসব কি কথাবার্তা! ‘
— ‘ প্লিজ ডক্টর কথা দিন আমাকে। আমার বাবুটার যেন কিছু না হয়। ‘

গর্ভের সন্তানের জন্য প্রসূতি মায়ের এমন আকুতিভরা বাক্য শুনে ডক্টর স্থির দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজেদের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব নীলা। ‘

নীলার চোখের কার্নিশ বেয়ে আবারও একফোটা তপ্ত নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। শরীরের নিচের অংশটা ক্রমশ অবস অবস লাগতে শুরু করেছে। আর চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠতে লাগলো প্রিয় মুখগুলো। আর সবারও মধ্যে একান্ত কাছের প্রিয়তমের মুখটা। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি, রাগ-অভিমান, শাসন। একে-অপরের সাথে অতিবাহিত হওয়া সবগুলো সুখ মুহূর্ত বারংবার স্মৃতিপটে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে। যেন একেবারে জীবন্ত।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৬

রাতের শেষ প্রহর চলছে। কারো জন্য হয়তো এই সময়টা একান্ত নিজেদের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তের একটি। সারাদিনের ব্যস্ততম কর্মজীবনের পর ভালোবাসার মানুষটাকে একান্তে কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্খা প্রত্যেকটা নর-নারীর মধ্যেই বিরাজমান। হয়তো বা এই একই প্রহরের নিস্তব্ধ রজনীতে কেউ একসময় নিজের প্রিয়তমাকে আদুরে আদুরে পূর্ণ করেছে। তাকে নরম আদরের চাদরে মুড়িয়ে রেখে নিজে তৃপ্ত হয়েছে। হয়তো বা সেই সুখ মুহূর্তগুলোতে প্রবল আশ্লেষে ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে মুড়িয়ে রেখেছিল নিজের পুরুষালী রোমশ বুকটাতে৷ হয়তো বা কত নির্ঘুম রাত প্রেমময়ী কথোপকথনে তারা নিজেদের সুখস্বপ্নগুলো বুনেছে। কিন্তু আজ? আজ কালের বিড়ম্বনায় সেই একি প্রহরে এসে প্রিয়তমার নরম তুলতুলে শরীরটাকে সি-সেকশনের নাম করে কাটাকাটি করা হচ্ছে। যেই প্রেমিক পুরুষ আলতো করে ছুঁয়ে দেবার আগেও হাজার বার চিন্তা করে নরম শরীরটা নিতে পারবে তো? তার সেই আদুরে দিনগুলোকে হেলায় ফেলে দিয়ে তারা নরম শরীরটাতে অ্যানেস্থেসিয়াসহ সার্জারির নামে অনবরত কাঁচি চালাচ্ছে।
দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতেই লাল চোখজোড়া যেন আরও লালচে হলো। পুরুষালি হাতের মুঠিটা কি নিজ অজান্তেই অনেকটা কঠিন হয়ে গেল?
নাকি কার্নিশ গড়িয়ে পড়া ঐ বিন্দু পরিমাণ মুক্তো দানাগুলো সবটাই অযাচিত কল্পনা?

— ‘ ভাই আর লাগবো? ‘
— ‘ মনে হচ্ছে তো আর লাগবে না। তুই আর আমি দিলাম। ডক্টর দুই ব্যাগই বলেছে। ‘
— ‘ আমরা নিজ দায়িত্বে এক্সট্রা নিয়ে রাখি। মন্দ কি? ‘
— ‘ হুহ্। খারাপ বলিসনি৷ দেখি আমি অফিসে কল করছি৷ অন্ততপক্ষে আরও দুইজন ডোনার এসে হসপিটালে উপস্থিত থাকুক। যদি ইমারজেন্সিতে প্রয়োজন পড়লে কোনো সমস্যা না হয়। ‘

তানবীর শাহেদের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের চোখে-মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তারা এসে জড়ো হয়েছে। ক্রমস নিজেদের জায়গা থেকে তারা পায়চারি করছে। আর ক্ষণে ক্ষণে উৎসুক চোখগুলোর দৃষ্টি বন্ধ দরজারটার দিকে স্থির। যেন এই বন্ধ দরজাটার মতোনই তাদের দমটাও গলায় এসে বন্ধ হয়ে রয়েছে। দুশ্চিন্তায়-কষ্টে ক্রমশ আটকে যাওয়া গলা হতে কেবল একটাই নীরব প্রার্থনা ভেসে আসছে।

— ‘ আল্লাহ সহায় হোন। মা-বাচ্চা দুইজনকেই সহিসালামতে যেন দেখতে পাই। ‘

সকলের এতো করুণ আর্তি বোধহয় করুণাময় ফেরাতে পারেননি৷ তাই সব দিতে না পারলেও কিছু একটা বান্দার শূন্য হৃদয়ে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য পাঠালেন৷ সকল উৎসাহি চোখকে এক বিন্দু স্বস্তি দিতে ওটির রুমের বন্ধ দরজাটা আচমকা খোলে গেল।
দরজা খোলতে দেরি নেই আর সাদিদের হুড়মুড়িয়ে আসতে দেরি নেই। এতক্ষণের নীরব জড়সড় ছেলেটাকে হঠাৎ এমন ক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখে হাসিবুর রহমান ছেলের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরলেন৷ সাদিদের গলা কাঁপছে। যদি অপ্রত্যাশিত কিছু শুনতে হয় সেই ভয়ে তার শব্দগুলো একে-অপরের সাথে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একইসাথে তার শরীরটাও অনবরত মৃদুভাবে কেঁপে চলেছে। অবশেষে কন্ঠে রাজ্যের জোর চাপিয়ে ভাঙা গলায় সে বলে উঠল,

— ‘ প্রাণপাখি। মানে.. আমার ওয়াইফ কেমন আছে? ‘

সিনিয়র নার্সটা কয়েক মুহূর্ত থমকালেন। যে আশাটুকু পরিবারের মানুষগুলোকে দিতে এসেছিলেন সাদিদের একটা প্রশ্নে যেন তাতে ভাঁটা পরেছে৷
তিনি হয়তো বা ভেবেছিলেন সবাই এখন বাচ্চাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হবেন৷ এই ভেবে কিছুটা সাহস করেই এসেছিলেন৷ কিন্তু তেমন যে কিছুই হলো না। পাগলাটে বর এখনও তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে আঁকড়েই পরে রয়েছে।
নার্সের থতমত খাওয়া গম্ভীর চেহারা দেখে যেন সাদিদের আত্মায় পানি শুকিয়ে যাবার জোগাড়। যেটুকু জোর এতক্ষণ গলায় ছিলো এখন যেন সেটিও বিলুপ্তির পথে।

— ‘ সমস্যা কি আপনার? আই সেইড হাউ ইজ সি? হুয়াই ডোন্ট ইউ সে সামথিং? ‘

সাদিদের গম্ভীর রাগীস্বরে ডিউটিরত নার্স বিষম খেয়ে বলতে শুরু করলেন,

— ‘ সরি। বাট আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন খুব একটা ভালো হয়। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আর তার পার্লস রেটও আচমকা ডাউন করেছে৷ ডক্টররা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘

হসপিটালের এতো এতো কৃত্রিম লাইটের মধ্যে থেকেও যেন সাদিদের নিকট সবকিছু মুহূর্তেই ঘোর নিকষ কালো অন্ধকার। নার্সের মুখ হতে বের হওয়া বাক্যগুলো যেন কানে গরম শিশা ঢালার সমতূল্য। সে মুখ ফোটে আর কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। পা টলমলিয়ে সেখানেই দাড়ানো থেকে পরে গেল।
শাহেদ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে আদরের ছোট ভাইটাকে একপ্রকার ঝাপটে ধরলো।

— ‘ নিজেকে সামলা সাদি। এরকম ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে? ‘
— ‘ ভাইয়া উনাদের একটু বলবে, আমাকে যেন গভীর তন্দ্রায় যাবার কোনো মেডিসিন দেয়। না.. না একেবারে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে এমন কিছু দিলে আরও ভালো৷ ‘
— ‘ চুপ। এমন পাগলামি করলে মার খাবি কিন্তু। ‘
— ‘ আমিতো পাগলই ভাইয়া। বড্ড উন্মাদ। প্লিজ এই পাগলটাকে চিরনিদ্রায় যাবার ব্যবস্থা করে দাও। ওকে এই অবস্থায় আমি সহ্য করতে পারছি না ভাইয়া। আমার পাখিটা একা কিভাবে এতোটা কষ্ট সহ্য করছে? আমি যে কিছুই করতে পারছি না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বোধহয় ভালো ভাইয়া। প্লিজ একটু সহায় হও। একটু দয়া করো ‘

শাহেদ আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলো না৷ বোন সমতূল্য ছোট্ট মেয়েটার জন্য প্রচন্ড চিন্তা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সাদিদের এমন পাগলামিতে রেগে গিয়ে গালে সজোরে এক থাপ্পড় দিয়ে বসলো। কিন্তু সাদিদ এতেও ভাবলেশহীন। দুনিয়ার যাবতীয় ব্যাথা-যন্ত্রণা তার এখন আর গায়ে লাগছে না। প্রিয়তমা যে নিজের অসার হওয়া শরীরটার সাথে সাথে তার দেহেও অসারের বীজ বপন করেছে।
বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিটা যেন নিমিষেই পাল্লা দিয়ে কয়েকদাপ বেড়ে গেল। নার্গিস খাতুন, শায়লা রহমান শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। নিধি জড় মুর্তির ন্যায় ঘুমন্ত ছেলেটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। চোখের পলকও যেন পরছে না। হতভাগা দুই বাবাও এবার চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ যেটুকু আশা নিয়ে নিজেদেরকে উপরে উপরে শক্ত রেখেছিল, এখন সেসব যেন বানের জলে ভেসে গেল।
নার্স বোধহয় চারপাশের এমন ভয়াবহ করুণ আর্তিতে নিজের বাক্যটা সমাপ্ত করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে পুনরায় বলল,

— ‘ আরে সবাই এতো ভেঙে পরছেন কেন? সুখবর আছে যে। বাড়িতে লক্ষ্মি পা দিয়েছে। ভগবান আপনাদের ঘরে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মি পাঠিয়েছেন। মিস্টার সাদিদ, মেয়ের বাবা হয়েছেন। কনগ্রাচুলেশনস। ‘

নার্সের অতি উৎসাহে এমন সুখবরেও যেন সাদিদের মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে যেন প্রাণহীন এক জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
নার্সের শেষোক্ত কথোপকথনের মধ্যেই আরেকজন নার্স সাদা একটা তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে নব্য রাজকন্যাকে নিয়ে হাজির হলো।

— ‘ এই যে আপনাদের পরিবারের ছোট্ট মণি। ‘

শায়লা রহমানই প্রথম কান্না চেপে এগিয়ে আসলেন। ছোট্ট শরীরটাকে পরম যত্নে কোলে নিয়ে এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেললেন,

— ‘ আমার সাদির মেয়ে। কই গো দেখে যাও। ঠিক যেন আমাদের ছোট্ট সাদি। ‘

শায়লা রহমান নাতনিকে কোলে নিয়ে অনবরত আপনমনেই বকবক করে চলেছেন। কষ্টকে যেন খানিকটা সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া। একে একে সবাই নিজেদের ভেঙে যাওয়া হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসলো। ছোট্ট প্রাণটাকে মন ভরে দেখে যেন কিছুমুহূর্ত বর্তমানের সব অন্ধকার ভুলে গেল। যেন নার্সের পূর্বেকার কথাগুলো সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। এক চিরাচরিত রূপকথার ন্যায় মিথ্যা-বানোয়াট।
সবাই সদ্য আগমন হওয়া ছোট্ট সোনামণিটাকে স্নেহের আদর দিলো। প্রাণভরে দীর্ঘজীবি হওয়ার আশীর্বাদ দিলো। অতঃপর মেয়ের অতি কাছের মানুষ তার বাবার নিকট তাকে নিয়ে গেল।

— ‘ দেখ আব্বা, একেবারে তোর মতো হয়েছে। মাশাল্লাহ কি সুন্দর? কি বড় বড় চোখ করে তাকায়। দেখ একবার৷ নিজের মেয়েকে কোলে নে৷ ‘

শায়লা রহমানের এতো উৎসাহী গলার পিছনেও সাদিদের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে স্থির মাথা নুইয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে। তার যেন এই মুহূর্তে শ্বাস নেওয়াও বারণ। প্রিয়তমা বিহীন এই পৃথিবীর বুকে সাদিদের নামটাও সে দেখতে অনিচ্ছুক। বড্ড বিতৃষ্ণা তার!
শায়লা রহমান আরও কিছু বলছিলেন। কিন্তু হাসিবুর রহমান তাকে হাত ধরে নিঃশব্দে টেনে আনলেন। ইশারায় এই মুহূর্তে চুপ করতে বলছেন। কিন্তু তিনিও যেন এবার অতিরিক্ত চিন্তায় তালগোল হারিয়ে বসেছেন। কান্না মিশ্রিত কপট রাগীস্বরে বলে উঠলেন,

— ‘ নীলা মামণির জন্য চিন্তা কি শুধু তোর একার হচ্ছে? আমাদের কষ্ট হচ্ছে না? তাই বলে এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার কি দোষ? তার মুখ দেখতে তোর কেন এতো অনীহা? এসবে এই বাচ্চাটার কি হাত? ‘

শায়লা রহমান রাগ-ক্ষোভে আরও অনেক কিছুই ছেলের উদ্দেশ্য বললেন। কিন্তু ছেলে তার একটি শব্দও বিপরীতে উচ্চারণ করলো না। একেবারে নিঃশব্দের প্রতিউত্তর। এতো নিস্তব্ধতায় যেন গা ক্রমশ শিউরে উঠছে।

____________

কোলের বাচ্চাটা অনবরত নিজ জোরে চেঁচিয়ে নিজের খিদের কথাটা জানাচ্ছে। নিজ ভাষায় বোধহয় মায়ের বিরুদ্ধে হাজারো কষ্টেভরা অভিযোগও জানাচ্ছে। মা কেন তাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে? ছোট্ট প্রাণটার যে এতো খিদে সহ্য করার মতো শক্তি নেই। মা কি ছোট মানুষটার মনের কথা বুঝে না? না বুঝলে এতোদিন কিভাবে ঠিক সময়মতো খাবার পৌঁছে দিতো৷ এতোদিন তো মা একটু পর পর ভারি মজাদার জিনিস তার জন্য পাঠাতো৷ কিন্তু ভালো আম্মাটা আজ হঠাৎ এতো পঁচা হয়ে গিয়েছে কিভাবে?

— ‘ ডক্টর আর কতক্ষণ? ছোট্ট মানুষটা যে খিদের যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছে না। ‘
— ‘ সরি মেম। আমরা এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না৷ আপনারা বরং মায়ের দুধের বিকল্প অন্য কিছু খাওয়ান। তাছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না৷ তাই আবারও সরি। ‘

নার্গিস খাতুন আর শায়লা রহমান অশ্রুসিক্ত চোখে একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। এই রাজকন্যাটা কি এতোই হতভাগ্য নিয়ে জন্মেছে যে, জন্মের পর মায়ের অমূল্য সুধাটুকু পান করার সুভাগ্য তার হবে না?
কিন্তু করার যে কিছু নেই। ঐদিকে মেয়ের মা এখনও জীবন-মরণের পথে লড়াই করে যাচ্ছে। আর এদিকে ছোট্ট প্রাণটা কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পরছে৷ আর যে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা ফরমূলা মিল্কের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু সোনামণিটার যেন তাতেও ঘোর আপত্তি। মা যদি তার সাথে রাগ করতে পারে তাহলে সেও মায়ের সাথে রাগ করবে৷ নিজ কান্নার বাক্যেতে যেন সে নিজের জোর আপত্তি জানাচ্ছে। মা খাবার না দেওয়া পর্যন্ত সে কিচ্ছুটি খাবে না। একেবারে জেদি বাপের জেদি মেয়ে।
নিধি, শায়লা রহমান, নার্গিস খাতুন একে একে সবাই ছোট্ট জেদি মেয়েটাকে খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করলো। কিন্তু সবাই নিজ চেষ্টায় বিফল।
একদিকে খিদের যন্ত্রণায় অনবরত কান্না করে যাচ্ছে অপরদিকে ফরমূলা মিল্কটা মুখেও নিচ্ছে না। এ যেন সব কূল হারিয়ে দিশেহারা হবার অবস্থা।

— ‘ দাদু মণি আমার, একটু খাও। এভাবে কান্না করে না। গলাটা ভেঙে যাচ্ছে। ‘

না কিছু বলে কয়েই লাভ হচ্ছে না। ছোট্ট মেয়েটা একবিন্দু পানীয়ও মুখে তুলছে না।
নিধি চিন্তাগ্রস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করলো। এবং অদূরে হসপিটালের মেঝেতে হাটু ভেঙে বসা সাদিদের দিকে তার চোখ পড়ল। যে এতক্ষণ একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। না ছোট্ট মেয়েটার দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছে।
এতদিন নীলা এবং পেটের বাচ্চাটার প্রতি সাদিদের অত্যাধিক কেয়ার পরিবারের কারো নজর এড়ায়নি। নীলার মৃদু ব্যাথাতেও সাদিদ যেই হারে চিন্তিত হয়ে পড়ত এটা নিয়ে তারা একসময় দুষ্টুমি করে হাসাহাসি পর্যন্ত করেছে। নীলা তখন লজ্জায় জড়সড় হয়ে থাকলেও সাদিদ নির্বিকারভাবে নিজ কাজ সমাপ্ত করতো৷ নীলার ক্ষেত্রে যেন দিন-দুনিয়াকে পরোয়া করার তার সময় নেই৷ কে কি ভাবলো আর কি না ভাবলো এটা সে বিগত দিনগুলোতে একপ্রকার পাত্তা না দিয়েই কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ নিজের মেয়ের এতক্ষণ কান্নার পরেও সেই সাদিদ কিভাবে নীরব থাকতে পারে? এটাই ভাবার বিষয়! তাই কিছু একটা ভেবে নিধি শায়লা রহমানের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ মা, বাবুকে আমার কাছে একটু দেন। ‘

দিশেহারা হয়ে শায়লা রহমান আর কোনো পাল্টা প্রশ্ন করলো না। অঝোরে কান্না করা ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিধির কোলে তুলে দিলো। নিধি তোয়ালে মুড়িয়ে ছোট্ট শরীরটাকে নিজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এবং একপ্রকার বিনা কোনো বাক্যে ব্যয়ে বাবার কোলে আদরের মেয়েকে তুলে দিলো।
সাদিদ এতক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে বসা ছিল। তাই আচমকা বাবুকে কোলে দেওয়াতে চোখ তুলে কিছুটা হুড়মুড়িয়ে উঠল। কিন্তু নিধি তাতে মাথা ঘামালো না। বরং বোনের ন্যায় সামান্য আদেশ মিশ্রিত গলায় বলল,

— ‘ নিজের মেয়েকে ধরো। কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলছে। তোমাদের মতোই পাঁজি হয়েছে। সবসময় জ্বালাতন। ‘

সাদিদ কয়েকপলক ফ্যাল ফ্যাল করে নিধির মুখপানে তাকিয়ে রইল। যেন আচমকা ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি।
তার হতবিহ্বল চাহনি দেখে নিধি আবারও একইস্বরে বলল,

— ‘ আরে ধরো। ছেড়ে দিলাম তো। ‘

এবার যেন সাদিদের হুঁশ ফিরেছে। মানে কি? তার কলিজার টুকরোটাকে নিধি ফেলে দিবে!
সিংহের খাঁচায় যেন অসময়ে শেয়ালদের দুষ্টুমি। সাদিদ ভস্ম করা দৃষ্টি নিয়ে নিধির দিকে তাকালো। অতঃপর এক ঝটকায় মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরল। আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়েটা বুকে জড়িয়েই সে সামনে হাঁটা দিলো।
তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিধি এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায় থেকেও নিচুস্বরে হেসে ফেলল। কেবল সে নয়। উপস্থিত সবার মুখেই ক্ষীণ হাসির রেখা।
শাহেদ ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নিধির দিকে এগিয়ে এলো। তাকে নিচ থেকে তুলে খানিকটা রাসভারী স্বরেই বলল,

— ‘ তুমি মজা করার আর টপিক পেলে না? এখনইতো তোমাকে ভস্ম করে দিতো। ‘

শাহেদের কথায় আবারও সবাই একবার কান্নামিশ্রিত চোখে মৃদু হাসল। ইশশ কি ব্যাথা সেই হাসিতে! বুকে কি নিদারুণ আঘাতের ফলে এই হাসির রেখাটুকুর সৃষ্টি হয়। সেটা যদি কাউকে বুঝানো যেত!

.

সাদিদ সবার কোলাহল থেকে একটু দূরে ভিজিটরদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ারে মেয়েকে নিয়ে এসে বসলো। এতক্ষণ বুকের সাথে ছোট্ট শরীরটা জড়িয়ে রেখেছিল। যার ধরুন রাজকন্যাটার মুখশ্রীটা নজরে পরেনি। এবার পড়ল। নিজের বলিষ্ঠ হাতটাতে ছোট্ট রাজকন্যাটাকে আঁকড়ে ধরে তার মুখ ফুটে সর্ব প্রথম একটাই বাক্য বের হলো,

— ‘ মাশাল্লাহ। ‘

মেয়ে কি বুঝলো সেটা বুঝা গেল না, কিন্তু পিচ্চি একেবারে চুপ। এতোক্ষণের ঝাঁসির রাণী যেন এখন ঘরের আদরের ছোট্ট দুলালী। কান্না ভুলে সে ডাগর ডাগর চোখে সাদিদের মুখপানেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখের ভাষায় যেন সাদিদকে জানিয়ে দিচ্ছে এই মুখ আমার খুব চেনা। খুব যেন কাছের কেউ।
সাদিদ ছোট্ট কোমল কপালটাতে আলতো করে স্নেহের চুম্বন আঁকলো। অতঃপর সেই চির-পরিচিত স্নেহময় ডাক,

— ‘ প্রিন্সেস? ‘

এইতো মেয়ে বুুঝতে পেরেছে। এতক্ষণ যেই চেনা-অচেনার ধোয়াশাতে ছিল এটা মাত্রই এই সম্বোধনের সাথে সাথে কেটে গেল। এটাই তো বাবা৷ যে নাকি সময়ে-অসময়ে প্রিন্সেস ডেকে ডেকে তার শান্তির ঘুম উড়িয়ে দিতো। কিন্তু বেশ মজা লাগতো তখন। আর মায়ের সাথে বাবা যখন ছোট্টদের মতন ঝগড়াঝাটি করতো কি হাসিটাই না পেত তার। কেবল মুখফুটে বলতেই পারতো না।
মেয়ে তার বাবার মুখপানে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। আর ধীরে ধীরে পিচ্চির ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হলো। ইশশ নবজাতকের মুখে সেই মিষ্টি হাসির রেশটুকু কতটাই না মধুর!
সাদিদের ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হতে গিয়েও হতে পাড়ল না। নিজেকে তার বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। মেয়ের হাসিতে বাবা হয়ে তার মুখ ভারাক্রান্ত কেন?
কিন্তু সে যে অসহায়। তাই সেই অসহায় বাবা আদরের কলিজার টুকরোটার এক বিন্দু হাসির বিনিময়ে অজস্র স্নেহের আদর দিলো৷ ছোট্ট মুখটার কানায় কানায় তখন বুকে পাথর চেপে এক বিধ্বস্ত বাবার স্নেহময় উষ্ণ পরশ।
মেয়ে ততক্ষণে খিদে ভুলে গেল। ভুলে গেল এতক্ষণের কান্না। কেবলমাত্র ঘন আঁখি পল্লবের মধ্যে দিয়ে বাবার মুখটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিটা এখনও বহমান।
সাদিদও কলিজার টুকরোটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন এতো দেখেও তৃপ্তি হচ্ছে না। সাদিদের নিজেরই বোধহয় নজর লেগে যাবার অবস্থা। যেমনটা ঠিক সেই নিষ্ঠুর মেয়েটার ক্ষেত্রে হতো। সেই একই মায়া, একই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। যা হতে চোখ ফেরানো দায়।
সাদিদ ছোট্ট কপালটাতে আবারও প্রবল স্নেহময় চুমু খেয়ে মেয়ের মুখপানে তাকিয়েই ধরা গলায় বলে উঠল,

— ‘ মায়ের মতো মায়াবতী হয়েছিস! নিজেদের মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে চাস। যেমনটা তোর নিষ্ঠুর মা করেছে। মায়ায় জড়িয়ে এখন ছেড়ে যেতে চাচ্ছে। তোর মা নিষ্ঠুর প্রিন্সেস। বড্ড মায়াবতী এক নিষ্ঠুরমনের অধিকারিণী সে! ‘

#চলবে…