আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৩৫+৩৬

0
520

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৫.

তিক্ত এক অভিজ্ঞতা হলো জসীমের। প্রথমবারের মতো গ্রামের কাউকে কোনঠাসা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে গেছে তার। রাগে সারা শরীর রিঁ রিঁ করছে। এতো দিন পরিকল্পনা করে অপেক্ষা করেছে খোর্শেদের শেষ দেখতে। প্রিতুস গ্রামের বিচারাচারে কখনোই যায় না। আজ সেও এসেছে। জসীম তাকে কথা দিয়েছে খোর্শেদের গলায় পাড়া দিয়ে আজই বিয়ে ঠিক করবে কুহেলী প্রিতুসের। শেষ মুহূর্তে এসে এতো গুছিয়ে পাল্টা জবাব দিবে খোর্শেদ তা জসীমের ধারনাতীত ছিল। রেজিস্ট্রি পেপারের সাইনের তারিখ একমাস আগের অর্থাৎ বিষয়টা এমন দাঁড়ালো বিয়ে করে তারপর স্বামীর সাথে গ্রামে ফিরেছে কুহেলী। তাহলে আবার বিচার কিসের! গ্রামের মানুষ আরো ক্ষুব্ধ হয়েছে জসীমের উপর। কোনো বিষয় না জেনে শুনে এতো বড় করার বদলে মানুষের চোখে তার জন্য বিরক্তি দেখে অসহ্য লাগছে সব। রেজিস্ট্রি পেপার দেখার পরেই তিনি রহমত আর পলাশকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন। গ্রামবাসীর অনেকেই যে যার মতো চলে গিয়েছে।

বিচার বসেছে শিমুলপাড়ার একদম শেষে বিশাল বটতলায়। গাছের নিচে চুপচাপ বসে এতোক্ষণ সবকিছু দেখছিল প্রিতুস। মানুষ একটু কমতেই অদূরে কুহেলীর দিকে চোখ পড়ে তার। কুচকুচে কালো শাল গাঁয়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হুর পরীর ন্যায় মেয়েটা। যে মেয়েকে পাওয়ার স্বপ্ন সে দিনে রাতে দেখেছে। জীবনে আর কোনো কিছু সে এতটা বেশি করে চেয়েছে কিনা মনে পড়ে না। তবে যা চেয়েছে তার আব্বা তাকে বলার আগে সামনে তুলে দিয়েছে। তবে এই পরীকে কেন দিতে পারলো না? হঠাৎ কি ভেবে যেন প্রিতুসের চোখে জল আসে। চেহারা শুকিয়ে রক্তিম নিষ্ঠুর হয়ে যায়। মাপা মাপা পায়ে দ্রুত হেটে কুহেলীর সামনে এসে দাঁড়ায় সে। প্রিতুস রাগান্বিত! কুহেলীর হাত খপ করে ধরে বলে,

‘ তোমার কি এমন লাগছে যেইটা আমার কাছে নাই এই শহরের পোলার কাছে পাইছো? তোমারে রানী বানাইয়া রাখতাম আমি কেন করলা বিয়া? আমি তোমারে ভালবাসি কইছিলাম না কেন করলা বিয়া? আমি মদ খাই, বাপের অবৈধ ব্যবসায় হাত লাগাই এল্লাইগ্যা? আমারে কইতা আমি ছাইরা দিতাম। তোমার লাইগা দুনিয়া ছাইড়া দিতাম দরকার হইলে কিন্তু তুমি আমারে ছাইড়া যাইলা কেন? ‘

প্রিতুসের আচরণে হঠাই ভড়কে যায় কুহেলী। মানুষটার চেহারা দেখলেই তার ঘৃণা হয় আর সে কুহেলীর হাত ধরে আছে! কুহেলী কিছু বলার আগেই সমারোহ এসে সজোরে ধাক্কা দেয় প্রিতুসের বুকে। প্রিতুস ছিটকে দু-তিন কদম পিছনে চলে যায়। সমারোহ হুঙ্কার ছেড়ে বলে,

‘ তোমার সাহস হয় কিভাবে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত দেয়ার? ‘

সমারোহকে সে পাত্তাই দিচ্ছে না যেন। গভীর চোখে তাকিয়ে আছে কুহেলীর দিকে। সে চোখে কেবলই রাগ। কুহেলী অস্বস্তিবোধ করে। প্রিতুস হু হা করে হেঁসে উঠে চিৎকার করে বলে,

‘ আমি তোমারে আগেও ভালোবাসতাম আর অহন ও বাসি। পামু না? দরকার হইলে তুইল্যা নিয়া যামু কইছি না? ‘

প্রিতুসের বলা কথায় চোখ মুখ ছোট হয়ে যায় সমারোহর। এই ছেলের সাহস দেখে সে হতভম্ব! কথা শেষ হতে না হতেই সমারোহ প্রিতুসের গালে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে এক ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়‌। প্রিতুসও রেগে গিয়ে মাটি থেকে উঠে কলার চেপে ধরে সমারোহর। এক প্রকার ধস্তাধস্তি হয়ে শুরু হয়ে যায় দুজনের মাঝে। দুজনই দুজনকে মারছে। তবে সমারোহর হাতে দু-তিনটে চর-ঘুষি খেয়েই প্রিতুসের নাজেহাল অবস্থা। রজব আর গ্রামের দুচারজন ছুটে আসে তাদের থামাতে। কুহেলী ঘাবড়ে যায় সমারোহর এই রূপ দেখে। শান্তশিষ্ট মানুষটা যে কিনা কারোর সাথে উঁচু গলায় কথা অবধি বলেনা সে প্রিতুসকে এভাবে মারছে! কুহেলী দৌড়ে গিয়ে সমারোহর পিছনে শার্ট খামচে মৃদু স্বরে বলে,

‘ প্লিজ থামুন এবার। বাড়ি চলুন। আমি এখানে আর দাঁড়াতে চাই না। ‘

সমারোহ প্রিতুসকে মাটিতে ফেলে হাত পিছন দিকে মচকে ধরে ছিল। এবার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে,

‘ কি যেনো বলেছিলি? তুলে নিয়ে যাবি না? সাহস থাকলে আসিস কেমন! কুহেলী বলল বলে বেঁচে গেলি নাহলে যে হাত দিয়ে আমার বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছিলি সে হাত মাটিতে পুঁতে রেখে যেতাম আজ। ‘

কুহেলী একটু সরে দাঁড়ায় সমারোহর কাছ থেকে। হতবাক হয়ে গিয়েছে সে সমারোহকে দেখে। সমারোহর গাল-ঠোঁট ফুলে গিয়েছে, হয়তো সামান্য কেটেও গিয়েছে। হাতে রক্ত মাখা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তর মতো চকচক করছে। শার্টের গলার দিকটায় দুটো বোতাম ছিঁড়ে গিয়েছে। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কুহেলীর দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরতে নিলেই পিছিয়ে আসে কুহেলী। সমারোহকে দেখে ভয় লাগছে তার। সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় কুহেলীর দিকে। তারপর একটু সামনে এগিয়ে শক্ত করে কুহেলীর হাত ধরে চলে আসে সেখান থেকে।

বিছানার এক কোনায় নড়াচড়া বিহীন বসে আছে কুহেলী। চোখের মনি সমারোহর অস্থিরতা মোড়ানো পদাচারণের পানে। সমারোহর মন মেজাজ ভীষণ রকম গরম। একবার চেয়ারে বসছে তো আরেকবার সারা ঘরে পায়চারি করছে। কুহেলী বসে বসে সমারোহর কান্ড দেখছে অবাক হয়ে। কিছু বলার সাহস নেই আবার এখান থেকে উঠে যাওয়ার সাহস ও নেই। অনেকটা সময় বসে থেকে কুহছলী না পাড়তে বলেই ফেলে,

‘ আপনি এতো বেশি রেগে গেলেন কেনো তখন? অযথা মারামারি করে নিজেও তো আঘাত পেলেন! ‘

কুহেলীর কথা মাটিতে পড়ার আগেই সমারোহ ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠে,

‘ ও সাহস দেখায় কি করে আমার জিনিসের প্রতি নজর দেয়ার? আমার কোনো জিনিসের প্রতি কারো বেশি ইন্টারেস্ট আমার মোটেই পছন্দ না‌। যেহেতু তোমার সাথে শরিয়ত মোতাবেক আমার বিয়েটা হয়েই গেছে তাই তুমিও এখন আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আর তোমার দিকে যে নজর দিবে তাকে এতো সহজে ছেড়ে দিব বলছো? ‘

সমারোহর কথায় কেবলই হিতাহিতজ্ঞান শূন্য মনে হয় কুহেলীর নিজেকে। আবার একপ্রকার আনন্দ ও হয়। অনুভূতিটা অদ্ভুত! বেশখানিকটা সময় চেয়ারে বসে কি সব যেন ভাবে সমারোহ। তারপর হঠাৎই কুহেলীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ ব্যাগ গোছাও। ‘

কুহেলী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

‘ ব্যাগ গোছাবো মানে? কার ব্যাগ? ‘

‘ আমরা কালই চট্টগ্রাম যাব। ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে তাকায় সমারোহর দিকে। কাল যাবে মানে? আরো কয়েকদিন থাকার কথা ছিল তার। এই মাত্র দু’দিন আগে এলো। ঝামেলার কারণে বাড়ির কারো সাথে ঠিক মতো সময়ও কাটাতে পারেনি আর এখনি চলে যাবে আবার! কুহেলী মুখ গুমোট করে বলে,

‘ আমি এখন যাব না। পরশুই তো এলাম‌।এখনই… ‘

সমারোহ চোখ গরম করে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় ভয়ে। মাথা নিচু করে মুখে কান্না কান্না ভাব এনে বাচ্চাদের মতো বলে,

‘ আমার একটুও আব্বা আম্মার সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে না? একবার গেলে আবার কতো অপেক্ষা করতে হবে আসার জন্য। ‘

সমারোহ একটু শান্ত হয় কুহেলীর কথায়। সত্যিই তো বলেছে মেয়েটা। সমারোহ কুহেলীর কপালে এসে পড়া ছোট চুলগুলো আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,

‘ কিন্তু ম্যাডাম আমার যে ছুটি নেই! ভেবেছিলাম তোমাকে বাড়ি দিয়ে যাব কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু এখন রেখে যাওয়া কি সম্ভব বলুন? ‘

সমারোহর গলা নরম হওয়ায় কুহেলী একটু স্বস্তি পায়। সমারোহর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো‌‌ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘ আর কয়েকটা দিন ছুটি নেয়া যায় না? ‘

‘ নেয়া গেলে কি আর বলতাম? ‘

মন খারাপ করে বসে থাকে কুহেলী। সমারোহ হঠাৎই কুহেলীর পায়ে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে নেশাতুর কন্ঠে বলে,

‘ উহঃ, মাথাটা খুব ব্যাথা করছে। একটু চুল টেনে দাও তো। ‘

সমারোহর কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠে কুহেলী। উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ মাথা ব্যাথা! ঔষধ এনে দেব? ‘

সমারোহ চোখ বুঁজেই ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে বিড়বিড়য়ে বলে,
‘ এই ঔষুধই যে আমার ক্ষতের কারণ! ‘

কুহেলী শুনতে পায়না সমারোহর কথা। অস্ফূটস্বরে বলে,

‘ কিছু বললেন? ‘

‘ আমার সবচেয়ে বড় ঔষধ আমার কাছেই আছে। আর কি ঔষধ আনবে? ‘

কুহেলী কনফিউজড হয়ে যায়। অবাক হয়ে ঠোঁট টিপে বলে,

‘ তাহলে খেয়ে নিন! কোথায় রেখেছেন বলুন আমি এনে দিচ্ছি। ‘

সমারোহ মুচকি হাসে। কুহেলী কপাল কুঁচকে সে হাসি দেখে। এতো সুন্দর করে কেউ কি করে হাসতে পারে? এতো সুন্দর বুঝি মানুষ হয়? ততক্ষণাৎ কুহেলীর চোখ পড়ে সমারোহর বুকের বাম পাশের তিলটার উপর। শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খোলা তাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিলটা। কুহেলী ঢোক গিলে চুপচাপ বসে থাকে। সমারোহর কথায় ঘোর কাটে তার, সমারোহ মিনমিনে গলায় বলে,

‘ এভাবে হা করে আমায় চোখ দিয়ে গিলে খেলে তো মাথা ব্যথা আরো বেড়ে যাবে ম্যাডাম! ‘

কুহেলী দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। সমারোহ হাসতে হাসতে শার্টের উপরের একটা বোতাম লাগিয়ে নেয়। কুহেলীর ইচ্ছা করে সমারোহর চুলগুলো সব টেনেটুনে ছিঁড়ে টাক বানিয়ে ফেলতে‌। অসভ্য লোকটার জন্মই হয়েছে বোধহয় তাকে লজ্জা দিতে। সমারোহ হেসে বলে,

‘ ওরে আমার লাজুকলতা’রে, এবার তাড়াতাড়ি চুলে হাত বুলিয়ে দিন তো। রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো একটু ঘুমাই এখন। ‘

আসর আজানের খানিকটা সময় পর ঘুম ভাঙ্গে সমারোহর। আড়মোড়ে উঠে চুপ করে বসে থাকে কিছু সময়‌। বিছানায় মোশারি লাগানো দেখে মুচকি হাসে‌‌। কুহেলীর পায়ে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন। মেয়েটা চুপিচুপি তার খেয়াল রাখে ঠিকই। বালিশের কাছ হাতরে ফোন নিয়ে কুহেলীকে কল করে সমারোহ। কুহেলী ফোন কেটে একটু পর চা হাতে ঘরে এসে অবাক হয়ে বলে,

‘ আচ্ছা আপনার মাঝে কি ঘুম বলে কিছু নেই? রাতে নাকি ঘুমোতে পারেননি আবার এক ঘন্টা হতে না হতেই উঠে গেলেন? ‘

‘ তুমি চলে না গেলে ঘুম ভাঙতো না। ‘

সমারোহর কন্ঠ বড়-ই স্বাভাবিক। কুহেলী মুখে ভেংচি কাটে। কতো সুন্দর করে লোকটা মানুষকে লজ্জা দিতে পারে। বিয়ের পর যেন পুরোই এক বেশরম নির্লজ্জ সমারোহকে দেখছে কুহেলী। আগের সমারোহ যতোই রাগী আর চাপা ছিল এই সমারোহ ততই অসভ্য। কুহেলীর ভাবনার মাঝে সমারোহ বিঘ্ন ঘটায়। হাই তুলতে তুলতে মাথা কাত করে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে বলে,

‘ উমমম, চা খাব না। টেবিলে রেখে কাছে আসো, আরেকটু ঘুমাই। ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে তাকায় সমারোহর কথা শুনে। চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়ে বলে,

‘ ঘুমাতে হলে এভাবেই ঘুমান। আমার আসতে হবে কেনো? ‘

‘ এভাবে তো ঘুম আসবে না। তোমার শরীর যেমন তুলোর মতো নরম! জরিয়ে ধরলেই আরামে চোখ বুজে আসবে। আল্লাহ মনে হয় তোমাকে তুলা দিয়েই বানিয়েছেন। আসো তো দ্রুত আসো, কুইক্! ‘

বলেই আবার হাই তুলে সমারোহ। কুহেলী কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ ঘুমোতে হবে না তাহলে। আসর নামাজ পড়ে কুঞ্জার সাথে ঘুরতে যান সেই কখন থেকে সে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য! ‘

‘ না পরে। ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাও আসো। ‘

‘ কখনোই না। আমার ঘুমানো লাগবে না। ‘

‘ বড্ড জেদি মেয়ে। স্বামী সেবা না করে তার ঘুমে বিঘ্ন ঘটাও? ‘

কুহেলী ঠোঁট চেপে হাসে সমারোহর কথায়। সমারোহ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। বিরক্তি নিয়ে বলে,

‘ ধুর, ঘুমাবো না চা দাও। ‘

কুহেলী হেঁসে চা নিয়ে দেয় সমারোহর হাতে। সমারোহ চা নেয়ার বদলে কুহেলী হাত চেপে ধরে। অন্য হাতে চায়ের কাপ মেঝেতে রেখে কুহেলীকে টান দিয়ে জোর করে বিছানায় বসিয়ে দেয়ে। কুহেলী অবাক হয়ে তাকায় সমারোহর দিকে। রেগে গিয়ে বলে,

‘ এই আপনি আমাকে ফাঁকি দিলেন? ‘

সমারোহ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে,

‘ ফাঁকি! সেটা আবার কিভাবে দেয়? চাইলে অন্য কিছু দিতে পারি। ‘

কুহেলী সমারোহর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় দ্রুত। সমারোহ গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার দিকে। কুহেলী মিনমিনে স্বরে খুব কষ্টে উচ্চারণ করে,

‘ আমার হাত ছাড়ুন। ‘

‘ ধরেছি নাকি? ‘

‘ ধরেননি? ‘

‘ না তো। ‘

‘ ছাড়ুন নাহলে কামড় দিব। ‘

‘ দেও, ছাড়তে পারছি না। ‘

কুহেলী চোখ খোঁচ করে মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘ পারবেন না মানে কি? দেখুন… ‘

সমারোহ হাত ছেড়ে দিয়ে পরক্ষণে হঠাৎই কুহেলীর দুইপাশে হাত রেখে ওর উপর ঝুঁকে বলে,

‘ কি দেখবো? ‘

কুহেলী ভড়কে বিছানার দিকে হেলিয়ে পড়ে। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। বুকের বাপ পাশে যেন ঢোল পিটাচ্ছে খুব জোরে জোরে। উপায়ান্তর না দেখে হঠাৎই সমারোহর শার্ট খামচে ধরে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে বলে,

‘ আম্মা…! ‘

সমারোহ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কুহেলীর উপর থেকে দ্রুত সরে যায়। আর আসার সময় পায় না নাকি! দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। কুহেলী ততক্ষণে সরে গিয়েছে বিছানা থেকে। কুহেলীর দিকে রুদ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

‘ কাজটা খারাপ হলো না? ‘

কুহেলীর পেট ফেটে হাসি পায়। কোনো রকম ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলে,

‘ আপনি যেমন করলেন আমিও তো তাই করেছি। খারাপ হতে যাবে কোনো সমারোহ ভাইয়া! ‘

‘ হোয়াট, ভাইয়া? কে ভাইয়া? ‘ চোখ গরম করে তাকায় সমারোহ।

‘ কেনো, আপনি! নামাজ পড়ুন তাড়াতাড়ি, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি যাচ্ছি। ‘

‘ এই মেয়ে, ঘর থেকে এক পা ও যদি বাহিরে রেখেছো না তবে খবর আছে বলে দিলাম! কুহেলী, এই কুহেলী! ধুরো! ‘

সমারোহর কথা না শুনেই কুহেলী চলে যায়। সমারোহ ক্ষেপে নিজের চুল টেনে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘ একটা কথা যদি শুনে এই মেয়ে! ‘ তারপর উঠে নামাজ পড়ে বাহিরে আসে। কুঞ্জা উঠানে বসে ছিল। সমারোহ কুঞ্জার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

‘ কি পিচ্চি, কি করছো। ‘

চুল এলোমেলো করে দেয়ায় বিরক্ত হয়ে রেগে পেছনে তাকিয়ে সমারোহকে দেখে রাগ উধাও হয়ে যায় কুঞ্জার। মুচকি হেসে বলে,

‘ ভাইয়া আজকে রাতে মামাবাড়ি থাকবো। কত্তো মজা হবে জানেন! মামা আপনারে আর আপারে দাওয়াত দিছে। বসার ঘরে আছে যান কথা বইল্লা আসেন। ‘

সমারোহ মুচকি হাসে। হাসনাহেনা রান্নাঘর থেকে সমারোহকে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে উঠানে এসে বলে,

‘ শরীর কেমন আছে বাবা? কুহূ কইলো তোমার নাকি মাথা ব্যথা করতাছে? আম্মার কাছ থাইক্যা মলম নিয়া গেলো, এহন কমছে ব্যাথা? ‘

সমারোহ হতবিহ্বল হয় হাসনাহেনার কথায়। মাথা ব্যথার কথাটাও এসে বলেছে! বিনয়ের সহিত হেসে সে বলে,

‘ সেরে গিয়েছে এখন। ‘

‘ তাইলে ভালো। বসার ঘরে যাও বাবা অমি চা নাস্তা দিতাছি। ‘

‘ জি আচ্ছা। ‘

হাসনাহেনা চলে যায়। সমারোহ পকেট থেকে টিস্যু বের করে নিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বসার ঘরে যায়। কুহেলী মেয়েটা বড়-ই অবুঝ!

মৃদু কমলা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ জুড়ে। সূর্য মামা ক্লান্ত হয়ে মুখ লুকাচ্ছে আকাশের উষ্ণ বুকে। একটু বাদেই আকাশ হয়তো তাকে পুরোপুরি লুকিয়ে নেবে নিজের মাঝে। ঝুমঝুমিয়ে নেমে আসবে নিকষা কালো আঁধার। গ্রামের রাতগুলো বেশি ভয়ংকর। আঁধারের বুক চিরে পথ চলার অভ্যাস আছে কুঞ্জার তাও আজ দ্রুত পা ফেলে যাচ্ছে খোর্শেদ বাড়ির দিকে। খোর্শেদ কড়া করে বলে দিয়েছেন দৌড়ে বাড়ি গিয়ে রাত নামার পূর্বেই ফিরে আসতে। পড়ন্ত বিকেলেই কুহেলীর মামা বাড়ি চলে এসেছে সবাই। খোর্শেদ বাড়ি এখন ফাঁকা! নতুন জামাই বেড়াতে গেলে উপহার নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ আছে চট্রগ্রামে। সমারোহ তাই কুহেলীর মামা-মামী আর মামাতো ভাই বোনদের জন্য উপহার গুছিয়ে কুঞ্জাকে দিয়েছিল। কিন্তু তাড়াহুড়ো র মাঝে আসল জিনিস নিতেই ভুলে গেছে সে। তাই আবার বাড়ি যেতে হচ্ছে। সঙ্গে আছে রজব। নদী পাড় করে অপর পাশে আসতেই আকাশ কালো হয়ে যায়। অমাবস্যার রাত, তার উপর আকাশ ভর্তি মেঘের ভেলা। রজবের হাতের বড় হারিকেন দিয়ে জঙ্গলের পাশের রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। হেলেদুলে চলতে থাকে কুঞ্জা। হঠাৎই খুব জোরে কয়েক খন্ড পাথর এসে পড়ে কুঞ্জাদের উপর। বিকট আওয়াজ করে ফেঁটে যায় হারিকেন। কুঞ্জা বিচলিত হয়ে পড়ে। থমকে দাঁড়িয়ে ভয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। রজব ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘ কেডা, কেডা ঢিল ছুঁড়লি জঙ্গলের ভিতরেত্তে? হারিকেনটা ভাইঙ্গা ফেলাইলি! সাহস কত্তারা। কেডা ওইখানে? ‘

রজবের কথার প্রতিউত্তর আসে না কোনো। রাস্তাঘাট ফাঁকা, পিনপতন নীরবতা চারদিকে। কুঞ্জার বুক কেমন ধুকপুক করে। ভয়ে রজবের হাত খপ করে ধরে বলে,

‘ এই কাজ কেউ ইচ্ছা কইরা করছে বুঝো না? আমার ডর করতাছে। চলো বাড়ির দিকে দৌড় দেই। ‘

রজব বোকা মানুষ। অল্পেই অত্যাধিক পরিমাণে রেগে যাওয়া তার অভ্যাস। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলে,

‘ কইলেই হইলো নি? হারিকেন ভাইঙ্গা দিব আর আমি ছাইড়া দিতাম? নিশ্চয়ই গেরামের বিচ্ছু পোলাপান গুলার কাম এডি। দাঁড়া এক্ষনি মজা দেখাইতাছি। তুই দাঁড়া এনে কুঞ্জা। ‘

কথা শেষ হওয়ার আগেই হারিকেন মাটিতে রেখে লুঙ্গির একপাশ শক্ত করে ধরে জঙ্গলের দিকে চলে যায় রজব। কুঞ্জার খুব বিরক্ত লাগে। এমনেই রাস্তা ফাঁকা তার উপর মন কেমন যেন খচখচ করছে তার। সে কি একাই বাড়ি চলে যাবে? নাহ, যদিও ইচ্ছা করে এমন করে তাহলে তো রজব বিপদে পড়ে যাবে। কুঞ্জা দাঁড়িয়ে থাকে। এক মিনিট, দু মিনিট করে দশ মিনিটের উপর হয় রজব আসে না‌। ভয় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কুঞ্জার। রজব আসে না কেনো? কোথায় গেলো? সে কি একবার যাবে জঙ্গলের ভিতর? ছোট্ট মনটা ভূতের ভয়েও জব্দ হয়ে থাকে। দাদীমা যে বলেছে এই জঙ্গলে ভূত আছে। কেটে যায় আরো অনেকটা সময়। কুঞ্জা এবার স্থির থাকতে পারে না। মনে মনে আয়াতুল কুরসি, সূরা নাস , সূরা ফালাক পড়ে জঙ্গলের ভিতরে পা বাড়ায়। জঙ্গলের ভেতরটা এতোটা অন্ধকার যে বারবার শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যায় কুঞ্জার। রজবের নাম ধরে কয়েকবার চেঁচিয়েও কোনো সারা শব্দ পায় না কুঞ্জা। অনেকটা পথ হেটে এসেও চারিদিকের অতিরিক্ত স্তব্ধা মারা পরিবেশে ভাবিয়ে তোলে কুঞ্জার হৃদয়কে। কিছু একটা তো হয়েছে এখানে নাহলে রজব যাবে কই! এর চেয়ে দ্রুত বাড়ি গিয়ে সবাইকে বলুক। ফিরতি যাওয়ার পেছন ফিরতেই চমকে উঠে কুঞ্জা।

তার পিছনে একজন মানুষ অবয়ব দাঁড়িয়ে। আঁধারে তার চেহারা দেখা যায় না। কিন্তু উচ্চতা দেখে কুঞ্জা ঠাওর করতে পাথে এ রজব নয়। তাহলে কে! কুঞ্জা ভয়ে কান্না করে দেয় এবার। জড়সড় হয়ে বলে,

‘ কে আ-আপনি? ‘

মুখে ঠোঁটে জড়তা কাজ করছে তার। কথা ঠোঁট পর্যন্ত এসে আওড়িয়ে যাচ্ছে। কুঞ্জার ভীতু গলা শুনে যেন লোকটা হাসে। কুঞ্জার এই হাসিটুকু চেনা চেনা মনে হয়। কুঞ্জা আবারো বলে উঠে,

‘ কে আপনি? রজব ভাই কই? আপনি আমাদের চোখে চোখে রাখতে ছিলেন এতোক্ষণ? ‘

কুঞ্জার প্রতিউত্তরে লোকটার বিদ্রুপের হাসির শব্দ পায়। হৃৎস্পন্দন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় তার। কিছু একটা বাজে হবে এই আসঙ্কায় চিৎকার করে বলে,

‘ আমি এখনি গেরামের মানুষ ডাইক্কা আনবো কিন্তু! বলেন রজব ভাই কই? ‘

লোকটা এবারো নিশ্চুপ থাকে। তবে বড় বড় পা ফেলে কুঞ্জার দিকে এগুতে থাকে। কুঞ্জা চিৎকার করতে নিয়েও পারে না। অতিরিক্ত উত্তেজনায় গলা বসে গিয়েছে। কুঞ্জা কিছু উপায় না পেয়ে ভয়ে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করে। তার পিছন পিছন লোকটাও দৌড়ায়। কুঞ্জা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আল্লাহ্’র নাম নিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌড়ায়। পায়ের জুতা ছুড়ে ফেলে এদিক সেদিক। জঙ্গল খুব বড় নয়‌। যা কিছু যাক আজ তাকে অপর প্রান্তে পৌঁছাতেই হবে। অপরে প্রান্তে নদীর ঘাট, মাঝিরা আছে। বেঁচে যাবে সে!

কুঞ্জার অপর প্রান্তে পৌঁছানো আর হয়ে উঠে না। তার পূর্বেই বিশাল দেহের লোকটা আছড়ে ফেলে তাকে মাটিতে। চিৎকার করে উঠে কুঞ্জা। মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে থাকে লোকটা তাকে, বুকে-পেটে-পায়ে! ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে আর্তনাদ করে মেয়েটা তাকে ছেড়ে দিতে। জোরে জোরে আম্মা আপাকে ডাকে। কেউ তার চিৎকার শোনার জন্য নেই। আচ্ছা রজব ভাই কই গেলো? তার চিৎকার শুনে আসে না কেনো? চিৎকার করতেই থাকে কুঞ্জা। এই লোকটার হয়তো মায়া হয় না। পাংশুটে মুখ করে হাসে। কুঞ্জার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বিদঘুটে এই হাসি, কুৎসিত এই চেহারা! নিভু নিভু চোখের পাতায় নিমিষেই নেমে আসে আঁধার। চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে কুঞ্জা,

‘ আল্লাহ্! আল্লাহ আমারে রক্ষা করো আল্লাহ্। আম্মা তুমি কই? আপা, আমি বাড়ি যাব আমারে মারতাছে কেন? ‘

লোকটা কুঞ্জার কাছে এসে কোলে তুলে নেয় তাকে। কুঞ্জা পিটপিটে চোখে একপলক দেখে এই পাষান লোকটাকে। লোকটাকে সে চিনে! বহুবার দেখেছে তাকে। খুব সম্ভবত লোকটার নাম সোলাইমান। জসীমের সাথে তাকে প্রায়শই দেখা যায়। কুঞ্জা মলিন এক হাসি হেসে জ্ঞান হারায়।
চোখ মেলে তাকাতে নিজেকে অন্ধকার এক ঘরে আবিষ্কার করে কুঞ্জা। পানির ঝাপটা দিয়ে জোর করে জ্ঞান ফিরানো হয়েছে তার। হাত-পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। কুঞ্জা উঠে মাথায় হাত দিয়ে কিছু সময় বসে থেকে বুঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে। জায়গাটা চিনতে না পারলেও আঁধারের অস্পষ্টতা ভেদ করে দেখতে পায় জসীম আর পলাশকে। ঘৃণা হয় কুঞ্জার। হঠাৎ ক্ষেপে উঠে বলে,

‘ আমার আপারে কিচ্ছু করতে পারেন নাই দেইখা এখন আমারে তুইল্যা আনছেন? কাপুরুষের জাত! আপনাদের মুখে থুথু ফেলতে ইচ্ছা করতাছে আমার এখন। হাতটা ছাইড়া দেন খুন করবো আপনাগোরে। ‘

কুঞ্জার কথায় হেঁসে ফেলে পলাশ। দরজা আটকে দিয়ে কুঞ্জার ঠিক সামনে এসে মুখ চেপে ধরে বলে,

‘ বাইচ্চা থাকলে মাইরো সোনামনি। ‘

কুঞ্জা পলাশের মুখে থুথু মেরে দেয়। পলাশ রেগে সজোরে এক থাপ্পর বসায় কুঞ্জার গালে। কুঞ্জা বসা থেকে পড়ে যায়। ঠোঁট কেটে রক্ত বেড়িয়ে আসে। কুঞ্জার চুলের মুঠি ধরে পলাশ বলে,

‘ এমন জায়গায় তোরো রাখছিনা সারা দুনিয়া খুঁইজ্যা লাইলেও আজকা তোরে কেউ বাঁচাইতে পারবো না। তোর যতো তেজ আছে আজকা বাইর করুম। এর পর তোর বইনেরেও ধইরা আইন্না এক হাল করুম। গেরামের মাইনষের সামনে আমাগোরে বেজ্জতি করা! ‘

কুঞ্জা ফিক করে হেঁসে উঠে। পলাশের মুখ বিকৃত হয়ে আসে। ইচ্ছে করে কুঞ্জার মুখ থেতলে দিতে। জসীম এতোক্ষণ চেয়ারে বসে দেখছিলেন সব। কুঞ্জার ঠোঁটে হাসি তার সহ্য হয় না। চিৎকার করে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা সোলাইমান আর রহমতকে ডাকেন তিনি। তারা ভিতরে আসতেই জসীম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন,

‘ চাপাতি, দা রেডি রাখছোস? ‘

সোলাইমান মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, ‘ হো সব রেডি। ‘

‘ ছুরি আন একটা সোলাইমান। আর রহমত তুই নদীর ঘাটলায় যাবি। নজর রাখ কেউ এই মাইয়্যার খোঁজ করেনি। ‘

‘ আইচ্ছা। ‘

দুজনেই ছুটে জসীমের কথা মতো। কুঞ্জা ভয়ে চুপসে থাকে। কোনো মানুষের সামনে তাকে খুন করার সরঞ্জাম তৈরি করে রাখা হয়েছে। এর চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কি হতে পারে। কুঞ্জা এবার কাঁদতে শুরু করে ভয়ে। ছোট মানুষের ভয় বেশি! হঠাৎই কান্না থামিয়ে গলার সব জোর দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘ আমার আপা-আম্মা আপনেরে ছাড়বো না। এমন অন্যায় কাজ ধর্মে সইবো না। ‘

‘ ধর্ম কি জিনিস? ‘

‘ ছাইড়া দেন আমাকে। ‘

কুঞ্জার কথায় হেঁসে উঠে সবাই। কুঞ্জার নিজের প্রতিই ঘৃণা লাগে, কাকে কি বলছে সে! জসীম পৈশাচিক হাঁসি দিয়ে বলেন,

‘ ছাইড়া দিমু? আইচ্ছা তাইলে আয় আমার পা চাইট্টা জীবন ভিক্ষা চা। ‘

কুঞ্জার গাঁ গুলিয়ে উঠে। কি বিশ্রী মনমানসিকতার মানুষ এরা! আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়ার শিক্ষা সে পায়নি। জীবন দেয়া নেয়ার মালিক একমাত্র তিনি। কুঞ্জা কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,

‘ তোদের মতো নোংরা চরিত্রের মানুষের কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে মইরা যাওয়া ভালো। ‘

তেতিয়ে উঠে জসীম কুঞ্জার কথা শুনে। চিৎকার করে পলাশকে বলেন,

‘ এক আঙ্গুল মাইয়্যার তেজ কতখানি আইজা আমি দেহুম। চোখ দুইডা উডা এইডার। অন্ধ বানাইয়া ফেলা। ‘

পলাশ জসীমের কথা মতো ছুরি দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে কুঞ্জার। গড়গড়িয়ে রক্ত ঝড়ে চোখ থেকে। সদ্য কৈশোরে পা ফেলা চঞ্চলতা ঘেরা মেয়েটা মাটিতে পড়ে ছটফট করে। চিৎকার করে উঠে ‘ আল্লাহ ‘ বলে। তার পরণের যে জামাটা একটু আগে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছিল তা এখন রক্তে জর্জরিত! তার গলা ফাটানো চিৎকারে কাঁদে নিশাচরেরা, কাঁদে প্রকৃতি! আকাশ কাঁপিয়ে নামে মেঘেকন্যাদের অশ্রুধারা। তবু যেন সে চিৎকার এই মানুষগুলোর কানে পৌঁছায় না! সবাই হো হো মেতে উঠে হাসিতে। পলাশ শক্ত হাতে বুকে বিশাল থাবা মেড়ে ছিড়ে ফেলে কুঞ্জার জামা। কুঞ্জা তখন গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে। হাত দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে পলাশকে। পলাশ খুব জোরে চেপে ধরে কুঞ্জার হাত। পুরুষত্বের প্রগাঢ় ছাপ ফেলে কুঞ্জার শরীরে। জসীম, পলাশ আর সোলাইমান মিলে পরপর পাঁচবার ধর্ষণ করে মেয়েটাকে। মাটিতে কঁকিয়ে পড়ে থাকা কুঞ্জা তখন বোধজ্ঞানহীন, আধমরা।

কুঞ্জাকে মেরে কেটে টুকরো করে মাটিতে পুঁতে ফেলার কথা বলছে জসীম। জসীমের কথার ফাঁকেই রহমত হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে। সোলাইমানের দিকে তেড়ে বলে,

‘ রজবরে তুই মারোস নাই? ‘

সোলাইমান অবাক হয়ে বলে,
‘ না হেরে তো খালি অজ্ঞান কইরা মাইয়্যাডারে আনতে কইছিল। হেরে তো মারতে কয় নাই। ‘

রহমত সোলাইমানের কলার চেপে বলে, ‘ রজইব্বা তোর চেহারা দেখছে? ‘

‘ না কি হইছে? ‘

‘ হের জ্ঞান ফিরছে। নদীর ঘাটে চিল্লাচিল্লি কইরা মানুষ জোরো করছে। মাইয়্যারে খুঁজতাছে। হায়দার বাড়ির দিকেও আইতাছে সবাই। তাড়াতাড়ি লুকাইতে হইবো এরে। ‘

কুঞ্জার হাঁসি পায় ওদের কথা শুনে। চিৎকার করে হাসতে ইচ্ছা করে। হাসতে গিয়ে গড়গড়িয়ে রক্তবমি হয়। মরে যাবে এখন সে, মেরে ফেলা হবে তাকে। এই যন্ত্রণা থেকে মৃত্যু আনন্দের। সে মরবে কিন্তু এই নরপশুদের সাথে নিয়ে মরবে।

জসীম কি করবে না করবে মাথায় আসে না। মাটিতে পুঁতলে মানুষ জন টের পাবে। এর চেয়ে নদীতে ফেলে দেয়া যায়! নয়াহূরী নদীর স্রোত বেশি। সেখানে ফেলে দিলে হয়তো স্রোতের টানে লাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বহুদূর। খুঁজে পেতে পেতে লাশ পঁচে যাবে। জসীম দ্রুত সোলাইমানকে আদেশ দেন কুঞ্জাকে মেরে নয়াহূরী নদীতে ভাসিয়ে দিতে। গায়ে পলিথিন দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে দিতে। জসীম চলে যাওয়ার পর সোলাইমান ঘরের মাঝে পড়ে থাকা একটুকরো রশি পেঁচিয়ে ধরে কুঞ্জার গলায়‌। গাঁয়ের জোর কম থাকায় কুঞ্জাকে মারতে বেশি বেগ পেতে হয় না তাকে। গলায় রশি দিয়ে মারার সময় উম্মাদের মতো মাটি চাপড়ায় কুঞ্জা। আম্মা আব্বা আপার চেহারা ভাসে চোখের সামনে। মুহূর্তের মাঝেই ছোট্ট কুঞ্জার প্রাণভোমরা অত্যাচারে জর্জরিত দেহ ত্যাগ করে উড়ে যায় বিষাক্ত আঁধার ছাড়িয়ে অন্যজগতে।

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৬.

কুসুমের ন্যায় কমলা রঙের আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে‌। বিষন্ন প্রতিচ্ছবি মোড়ানো কালো মেঘের ছোঁয়ায় কালসিটে হয়েছে প্রকৃতির হৃদয়। ফজরের আজান-ধ্বনিতে কিছু সময় পূর্বে যে মুহুর্ত মুখরিত ছিল, সে বাতাসে এখন কেবলই বিষাদের তিক্ত গন্ধ। ক্লান্ত অবসাদের প্রগাঢ় বাস্তবতা! থেকে থেকে কান্নারা শব্দ করে থমথমে করছে পরিবেশকে। চারিদিক ভয়ংকর হয়ে ওঠে মানুষের আর্তনাদে! চোখের পাতা ভয়ে কাঁপে সকলের। এমন নৃশংস মৃত্যু শিমুলপাড়ায় কেন গোটা সদরে কখনো হয়েছে বলে গ্রামবাসীর মনে পড়ে না। দলে দলে গ্রামের লোকেরা জড়ো হয়েছে খোর্শেদ বাড়ির উঠোনে। কিন্তু উঠোনের ঠিক মাঝে সাদা কাফনে মোড়ানো কুঞ্জার মুখের কাপড় সরিয়ে দেখার সাহস কারো হয়না। যারা দেখেছে দুচারজন বমি করে অবস্থা খারাপ। বাচ্চাদের সরিয়ে রাখা হয়েছে সে স্থান থেকে। একটু আগেই এখানে এনে রাখা হয়েছে কুঞ্জার লাশ। হাসনাহেনা অল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞান হারিয়েছে কয়েকবার। খোর্শেদ ঘরের দুয়ারে মাটিতে বসে রয়েছে নিশ্চুপ। মৃত কুঞ্জাকে আনার পর থেকে হেলদুল নেই তার। কাঁদছেন না, নড়ছেন না, কিছু বলছেন না। তার নিষ্প্রাণ চোখদুটো কেবল ছটফট করতে থাকা কুহেলীকে দেখছে। কুহেলী যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। অতি শান্তশিষ্ট যে কুহেলীকে দেখলেই মন শান্ত হতো সে কুহেলীকে থামানোর সাহস হচ্ছে না কারো। কুঞ্জার কফিনের পাশে কুহেলীকে রমলা জাপটে ধরে রেখেছে। কাঁদছেন তিনি, সুর তুলে কাঁদছেন। রমলার দিকে চেয়ে কুহেলী থমথমে গলায় বলে উঠে,

‘ দাদিমা, কাঁদছো কেন? আমার বোন মরেনি তো! কুঞ্জা বাচ্চা মেয়ে, ওরে কেন কেউ মারবে? সবাই একে কুঞ্জা কেন বলতেছে? আমারে দেখতে দেও।কই দেখি কেমন বেয়াদপের মতো মরার ঢং করতেছে পাজিটা, দেখি! ‘

রমলা আরো শক্ত করে ধরে রাখে কুহেলীকে। কুহেলী কুঞ্জাকে দেখার আগেই পাগলামি শুরু করেছে। আর দেখার পর কি করবে ভাবতেই কলিজার পানি শুকিয়ে আসে রমলার। কুঞ্জাকে দেখে তিনি নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছেন। রমলা কাঁদতে কাঁদতে টানা গলায় বলেন,

‘ নারে দাদুমনি,দেখিস না লো। তুই সইতে পারতি না। মাইনষে এত জানোয়ার হয় কেমনে? এগুলোকে জাহান্নামেও ঠাঁই দিও না গো আল্লাহ! ‘

আর্তনাদ করে ওঠে বৃদ্ধ রমলা। কুহেলী শহরে চলে যাওয়ার পর কুঞ্জার সাথেই তার যতো গল্প! যে দাদুমনিকে রোজ পড়ালেখার জন্য বকাবাধ্য করেছেন, নিজের পাতের ভালো খাবারটা মুখে তুলে দিয়েছেন, দিনের পর দিন বুকে জরিয়ে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়েছেন আজ তার নিথর দেহ সামনে মাটিতে ফেলে রেখেছেন। চাইলেই বুকে টেনে নিতে পারছেন না! বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে রমলার। কুহেলীকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছেন না তিনি। কুহেলী নিজেকে কোনো রকম ছাড়িয়ে কুঞ্জার লাশের সামনে ছুটে গিয়ে কাফনের কাপড় সরিয়ে ফেলে। কুঞ্জাকে দেখা মাত্র আপনাআপনি হাত চলে যায় মাথায়। মাথা চাপড়ে মাটিতে বসে পড়ে কুহেলী। চেহারার বিভৎস রূপ দেখে মুখ সরিয়ে নেয় অনেকেই। দু-চারজন বাচ্চা যারা ছিল কাঁদতে শুরু করেছে। কুহেলী থ’মেরে থেকে হঠাৎ-ই চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ আমার বোন! আমার বোন কুঞ্জারে এত কষ্ট কে দিল? কত কষ্ট হইছে আমার বোনটার ! এই কুঞ্জা এই ওঠ, উঠে বস। তোর আপা কাউকে ছাড়বে না! উঠ কুঞ্জা, বল আমারে কে তোর গায়ে হাত দিছে। কুঞ্জা! আমার বোনের সুন্দর চোখ, আল্লাহ! আল্লাহআআ, দেখো কুঞ্জা উঠতাছে না, কুঞ্জারে! ‘

কুঞ্জার মাথা নিজের বুকের সাথে শক্ত করে ধরে চিৎকার করে কাঁদে কুহেলী। কি আবল তাবল বকছে সে জানে না। শুধু জানে সহ্য হচ্ছে না, কুঞ্জার পরিণতি সহ্য হচ্ছে না তার। পৃথিবীর কিচ্ছু সহ্য হচ্ছে না, কিচ্ছু না! আশেপাশে কে আছে না আছে কোনো হুঁশ নেই । সবাইকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করতেছে, সব্বাইকে! এই বুকে এতো যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না। কুহেলী নিজের বুকে হাত চেপে ধরে বসে থাকে। এতো কষ্ট হয়! স্বজন হারানোর বেদনা এতো! দলা পাকানো ব্যাথাগুলো গলা বেয়ে নেমে শরীর অবশ করে দিতে চাইছে। দম আটকে যাচ্ছে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কান গরম হয়ে এসেছে। পারছেনা কুহেলী। আর পারছে না। মনে হচ্ছে এই সময়টা আসার আগে মরে গেলে ভালো হতো।

সমারোহ স্তব্দা মেরে থাকে কুহেলীকে দেখে। এমন উদ্ভ্রান্ত অবস্থা বুঝি এর আগে সে কারো দেখেনি! দেখেছে, তবুও আজ অবাক হচ্ছে। কুঞ্জাকে খুঁজে না পেয়ে রাতে থানায় গিয়ে ডায়েরী না করেই ফিরে আসতে হয়েছিল সমারোহর। মিসিং ডায়েরী এতো অল্প সময়ে করা যায় না। তাই সকালে রজবকে নিয়ে গিয়েছিল থানায়। কুঞ্জার কথা শুনে দ্রুত ফিরে এসে দেখে বাড়িভর্তি মানুষের আনাগোনা। সকলের মাঝেই একটা চাপা আতঙ্ক বিদ্যমান। রজব দৌড়ে গিয়ে কুঞ্জার লাশের পাশে গিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে এতোক্ষণে। সমারোহ ধীরপায়ে এসে দাঁড়ায় কুহেলীর পাশে। কুঞ্জাকে দেখে থমকে যায় সমারোহ।

ডাক্তার হওয়ার সুবাদে অনেক মানুষের মৃত্যু সে দেখেছে। মারা যাবে যেনেও মানুষের চোখে মুখে ভীতি দেখে চোখ বুজে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেছে। কতো মানুষের দিকে তাকিয়ে পাষাণ হয়ে বলেছে আপনার প্রিয় মানুষটি নেই! অনেক স্বজনহারার চিৎকার শুনেও সে চুপ থেকে নির্দয় সেজেছে! তবে আজ কেন পারছে না? বুকে হঠাৎ কেমন চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। বুক ধুরধুর করে কাঁপছে সত্য মানতে। একটা বাচ্চা মেয়ের উপর কেউ কি করে এত নির্মম অত্যাচার করতে পারে। এই ছোট্ট রাজকুমারী মাত্র তিনদিনেই কতটা প্রিয় হয়ে উঠেছিল তার! সমারোহর চোখে মেয়েটা ছিল নিতান্তই বাচ্চা অথচ সমাজের চোখে এতো বড় হয়ে উঠলো কখন? এই তো, গতকাল সন্ধ্যায়ও কত খুনসুটি করেছে মেয়েটার সাথে। অথচ এই ছোট্ট পরীর নির্মল নিষ্পাপ হাসি ধর্ষকের বুককে কাঁপিয়ে তোলেনি। কি নিদারুন পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী মানুষ! সমারোহের চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমা হয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অশ্রু লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। কুঞ্জা তারও বোন। ওরা কি পারতো না আরো একটু সাবধান হতে! সমারোহ মৃদু কেঁপে ওঠে যখন কুহেলী তার পায়ের কাছে প্যান্ট খামচে ধরে। সমারোহ কুহেলীর দিকে তাকাতেই চোখের জল নাকের জল এক করে ফুঁসতে ফুঁসতে কুহেলী বলে,

‘ আপনি না ডাক্তার? আমার বোনরে ঠিক করে দেন। ওরা বলতেছে আমার কুঞ্জা মারা গেছে। মিথ্যা বলতেছে, আমি জানি। আমার বোনকে ঠিক করে দেন সমারোহ! ‘

সমারোহ কুহেলীর পাশে বসে কুঞ্জার মাথায় একবার হাত বুলায়। সমারোহ লক্ষ্য করে তার হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। এই প্রথম তার ভয় করছে কারো মৃত্যু দেখে। কিন্তু মৃত্যু তো সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর একটা মাধ্যম। এতে ভয় পেতে আছে কি! কুহেলী হঠাৎই সমারোহর শার্ট খামচে ধরে সমারোহর দিকে তাকিয়ে জোরে চিৎকার করে বলে,

‘ কেমনে পারলো ওরা, কেমনে পারলো? আমার বোনটা ব্যথায় চিৎকার করছিল। ওরা আমার আদরের বোনকে মেরে ফেললো? আমি রক্ষা করতে পারি নাই! ‘

কুহেলীকে পাগলের মত আচরণ করতে দেখে নিজেকে স্থির করতে পারে না সমারোহ। দু’এক ফোঁটা অশ্রু অবাধ্য হয়ে বেরিয়ে পড়ে চোখের কার্নিশ পেরিয়ে। সমারোহ এক হাতে কুহেলীর গালের অশ্রু মুছে দিয়ে মাথা জোর করে চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে। কুহেলী অনবরত কাঁপছে। ঠাওর করতে পারে না কি করবে সে। তাৎক্ষণিক সমারোহকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আশেপাশের মানুষদের দিকে তাকায়। হঠাৎই দাঁড়িয়ে হিংস্র হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

‘ কোন জানোয়ারের এত সাহস? বুকের পাটা থাকলে আমার সামনে আয়! তোদের কলিজা ছিড়া শকুনরে না খাওয়াইলে আমার শান্তি নাই! ‘

সমারোহ দ্রুত উঠে কুহেলীকে জড়িয়ে ধরে। কুহেলী জোরে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সমারোহর শক্তির সঙ্গে পেরে উঠে না। সমারোহ কুহেলীর মাথা চেপে ধরে রাখে বুকের সঙ্গে, শান্ত করার চেষ্টা করে। কুহেলী ধস্তাধস্তি করতে করতে একসময় সমারোহর বুকে শার্ট খামচে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার দরুন ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠে সে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেছে তার। খোর্শেদ হুহু করে কাঁদে কুহেলীর অবস্থা দেখে। একজন বাবার কলিজা ঠিক কতোটা ক্ষতবিক্ষত হয় আদরে বড় করে তোলা মেয়ের লাশ দেখতে? খোর্শেদের ভেতর অবশ হয়ে গেছে। তার কোনো অনুভূতি কাজ করেছেনা। কেবল চোখ দিয়ে হৃৎপিণ্ড খুবলে আসা রক্ত ঝড়ছে।

পুলিশের গাড়ি ততক্ষণে পৌঁছে গেছে খোর্শেদ বাড়ির সামনে। যে বৃদ্ধলোকটি কুঞ্জার লাশ পেয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। বৃদ্ধ শিমুলপাড়ার বাজারের এক দোকানদার। গতকাল শহর থেকে দোকানের প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন শিমুলপাড়ার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে যখন ভোররাতের একটু আগে ঘাটে ফিরেন। জঙ্গলের পাশের রাস্তা ধরে বাড়ি যাবেন বলে ঠিক করেন। হঠাৎ-ই এক লোককে অন্ধকারের মাঝে নদীর পাড়ে নৌকায় উঠতে দেখেন। লোকটা কেমন বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে লুকিয়ে নৌকাতে উঠছিল যেন তার সবার চোখের আড়াল হওয়ার ইচ্ছা! বৃদ্ধ গ্রামের পুরনো বলেই ধরতে পেরেছিলেন যে সেই লোকটা অন্য এক মাঝির নৌকা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। মূলত নৌকাচোর ভেবেই তাকে তাড়া করতে যান বৃদ্ধ ও তার ছেলে। কিন্তু চাদরে মোড়ানো লোকটা তাদের দেখেই নোকাতেই বস্তা ফেলে পালিয়ে যান। কৌতুহলবশত বস্তার মুখ খুলে কুঞ্জাকে চিনতে পারে তার ছেলে। তখন ফজরের আজান পড়েছে কেবলমাত্র। নিয়ে আসা হয় কু্ঞ্জাকে খোর্শেদ বাড়ি।

কুঞ্জার লাশ নদীতে ফেলতে পারেনি ভেবেই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে জসীমের। সোলাইমানের গর্ধভের মতো কাজের জন্য এবার বুঝি সবাই ধরা পড়ে যায়! খবর পেয়েছে পুলিশও নাকি গিয়েছে। তার মানে তদন্ত তো অবশ্যই হবে। ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক পায়চারি করে নিজের মনকে শান্ত করতে পারেন না জসীম। মনে মনে ভেবে নেন পুলিশকে বড় অঙ্কের টাকা খাইয়ে চুপ করাতে পারলেই হল, শান্তি। পরিস্থিতি বোঝার জন্য রহমত আর পলাশকে পাঠান খোর্শেদ বাড়ি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই কুঞ্জার লাশ নেয়ার জন্য চলে আসে লাশবাহী গাড়ি। লাশ পঁচার আগেই ময়নাতদন্ত করতে হবে। লাশ নেয়ার সময় কুহেলীকে সামলানো যাচ্ছিলো না বলে ঘরে নিয়ে এসে আটকে রাখে সমারোহ। হাসনাহেনার জ্ঞান ফেরার পর মরাকান্না করতে শুরু করেন উঠোনে বসে। সন্তানের মৃত্যু দেখা একজন মায়ের কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্টসাধ্য। প্রতিটা নিঃশ্বাস বিষাক্ত মনে হয় হাসনাহেনার। কাঁদতে কাঁদতে উঠানের শেষ প্রান্তে গিয়ে রজবের সামনে দাঁড়ায় হাসনাহেনা। হঠাৎ আক্রমণ করে বসেন রজবের উপর। খোর্শেদ রমলা গিয়ে আটকান হাসনাহেনাকে। পাগল হয়ে গেছে সে। রজবকে চেঁচিয়ে বলতে থাকেন,

‘ তুই কুঞ্জারে ফালাইয়া গেলি কেন? তোরে আমি ওর লগে পাঠাইছিলাম ওর খেয়াল রাখতে। তুই তো মরস নাই? আমার কুঞ্জা মরলো কেন তাইলে? জবাব দে আমারে ! ‘

খোর্শেদ ঝাড়ি দিয়ে চুপ করিয়ে দেন হাসনাহেনাকে। মেয়ের দুঃখে পাগল হয়ে আবোলতাবোল বলছেন তিনি। রজবকে বকতে বকতে আবার জ্ঞান হারান হাসনাহেনা। রজব গাঁ ভাসিয়ে কাঁদছিল। হাসনাহেনার কথায় রজবের কান্নার বেগ বাড়ে। সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ি মনে হয় তার। কেনো এমন হুটহাট চেতে যায় সে? তার জন্য তার বোন পৃথিবীতে নাই! ভাবতেই মরতে ইচ্ছা করে রজবের। কুঞ্জার জায়গায় ও মরতো! যদি কোনো একটা উপায় থাকতো সময়টা পিছিয়ে দেওয়ার? কুঞ্জা বেঁচে যেতো যদি? কষ্ট আর নিজের প্রতি অভিযোগের ভাড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে রজব।

কাঁদতে কাঁদতে মিয়িয়ে পড়ে কুহেলী। শরীরে আর কতো দেয়! সমারোহের পায়ে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। রমলা জায়নামাজে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন, ঘর তার শূন্য হয়ে গেলো। খোর্শেদ আর রজব পুলিশের সাথে থানায় যান। ফাঁকা নিস্তব্ধ বাড়ি ক্ষণে ক্ষণে হাসনাহেনার গুনগুন ক্রন্দনে মুখরিত হয়ে উঠে কেবল। ধীরে ধীরে আবার আঁধার ঘনিয়ে আসে। কোনো এক সঙ্গী হারা নিশাচরের ভয়ার্ত বেদনার কান্নার সুর তাল মিলায় হাসনাহেনার সাথে!

গোসল সেরে ছাদে এসে বসে নয়না। কলেজে উঠার পর রাতে গোসল করার একটা বাজে অভ্যাস হয়েছিল। যদিও এখন মায়ের বকুনিতে রাতে গোসল করা বাদ দিয়েছে তাও মাঝে মাঝে করলে শরীর হালকা লাগে। আকাশ আজ মেঘলা। ঝিরঝির বাতাসে শীতল আমেজ। পিছনের পাহাড়টা যেন কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়েছে। দুটো বুলবুলিতে নতুন বাসা বেঁধেছে তাদের বাগানের ছোট্ট ঘন ঢালের বনজুঁই গাছটাতে। রোজ ছাদে উঠে সেই বুলবুলির সংসার করা দেখে নয়না। বড্ড ভাব বর-বউয়ের। মাঝে মাঝে আবার অভিমান ও হয় বটে। নয়না যেন তাদের ভাষা পড়তে শিখেছে। আজ হয়তো দুজনের গভীর ঝগড়া হয়েছে। সন্ধ্যারাতেও কিচিরমিচির করছে। মুচকি হাসে নয়না। সে হাসি দীর্ঘস্থায়ী হয় না মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে। সৌরভ ছয়বার কল দিয়েছে, ফোনটা সাইলেন্ট। নয়না কল রিসিভ করে নরম গলায় বলে,

‘ আসসালামুয়ালাইকুম। ‘

‘ আলাইকুম আসসালাম। রিসিভ করতে ইচ্ছা করলো তাহলে? ‘

‘ ফোন সাইলেন্ট ছিল। ‘

‘ আচ্ছা! কি করছো? ‘

‘ ফোন দেয়ার কারণ? ‘

‘ তুমি! ‘

হাসে নয়না। সৌরভ বলতেই থাকে,

‘ আর কতো শাস্তি দিবে? ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছি। তুমি না করার পরও তোমার বাড়ি গিয়ে মানানোর চেষ্টা করেছি। হাতে পায়ে ধরেছি। আর কি করলে রাজি হবে তুমি? ‘

‘ কিছু করলেই না। আমি বিয়ে করবো না। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নয়না। সৌরভ থ’ মেরে থাকে। নয়না আবার বলে,

‘ তুমি আমাকে চেয়েছো তাই জোর করে বাচ্চাটাকে মেনে নেয়ার অভিনয় করছো। তুমি কখনোই তাকে চাও না। ‘

‘ হ্যাঁ চাই না। তো? তোমার জন্য তো সব মেনে নিচ্ছি। এটাই কি বড় নয়? তোমার সন্তান পৃথিবীতে এলে হয়তো তাকে দেখে মায়া হবে, ভালোবাসার সৃষ্টি হবে। এর পর তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না তাই না? আমি ওকে চাই বা না চাই তুমি চাও এটাই আমার কাছে এখন বড়। আর ওর বাবা হওয়ার সব দায়িত্ব আমি পালন করবো। ‘

‘ আমার চাই না এমন। তাহলে যখন তাকে ভালোবাসতে পারবে তখন এসো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ভেবে দেখবো। আপাতত আমি খুব ব্যস্ত আছি আমার সন্তান আর পড়াশোনা নিয়ে। ‘

‘ তোমার এখন চাকরি করার দরকার নেই। ‘

‘ সেটা আমি বুঝে নেব। ‘

‘ এতো চাপ তোমার শরীরের জন্য ভালো হবে না নয়না। প্লিজ একটু বুঝো আমি কি বলছি। ‘

‘ বুঝলাম। এখন রাখি? ‘

‘ এতো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছো ইদানিং যে আমার জন্য দুমিনিট সময় বের করতে পারছো না? ‘

‘ হ্যাঁ সত্যিই ব্যস্ত আমি। আর তুমি চার মিনিট হয়েছে কল করেছো। রাখছি, ভালো থেকো। ‘

ফোন কেটে সৌরভের নম্বর ব্লক করে দেয় নয়না। আজ কষ্ট হচ্ছে না। সব সয়ে গেছে হৃদয়ে। কোন মা তার সন্তানের অস্পষ্ট ভবিষ্যত জেনেও বিয়ে করতে যাবে? সৌরভ আজ বলছে এক কথা আর ভবিষ্যতে যদি ভালবাসা সৃষ্টি না হয়ে তার জায়গায় ঘৃণার হয়? কে বলতে পারে!

চা বানাতে বানাতে গুনগুন করে গান করছে সেঁজুতি। আজ তার মেজাজ ফুরফুরে। দুপুরে খাওয়ার সময় তার শ্বাশুড়ি এই প্রথম তার বেগুন-শুঁটকি রান্নার প্রশংসা করেছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই তিনি হালকাপাতলা লেগে থাকতেন সেঁজুতির পেছনে। সেঁজুতির তো মনেই হতে শুরু করেছিল তার শ্বাশুড়ি হয়তো তাকে অপছন্দ করে। তবে আজকের প্রশংসাতে ধারণা একটু বদলেছে।

চা বানানোর মাঝেই হঠাৎই হিরণ এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সেঁজুতির গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। চোখ মুখ ছোট হয়ে যায় সেঁজুতির। এটা হিরণ রোজই করে। বেহাইয়া লোক যে! সেঁজুতি রেগে গিয়ে বলে,

‘ আপনি এতো নির্লজ্জ কেন? এখন যদি মা এসে পড়ে? ‘

হিরণ মাথা উঁচু করে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ তো আসুক! ‘

‘ আসুক মানে? আজব তো? আপনার কি একটুও লজ্জা করবে না? মায়ের সামনে বউকে জড়িয়ে ধরে রোমান্স করছেন! ‘

‘ না তো! ‘ বলেই সেঁজুতির কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলে, ‘ বাবাও আগে এই কাজ করতো। মাঝে মাঝে তো আমাদের সামনেই মাকে কোলে নিয়ে নিতো। ‘

‘ আপনার গাঁয়ে আমি আগুন ধরিয়ে দেব যদি এক্ষুনি এখান থেকে না গেছেন তো! ‘

‘ আমি গেলে তো এক্ষুনি বকা খাবে মায়ের কাছে। ‘

নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে হিরণ। আর তাজ্জব বনে যায় সেঁজুতি হিরণের কথা শুনে। চোখ ছোট ছোট করে বলে,

‘ কি বলতে চান হে? আপনার আম্মাজান চায় তার ছেলে বাড়ি ফিরেই ফ্রেশ না রান্নাঘরে বউয়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে থাকুক? ‘

‘ না। মোটেই তেমন না। চায়ে কি দিচ্ছ তুমি? চিনি না লবণ? ‘

সেঁজুতি হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। ভাবনায় তলিয়ে থেকে ভুলে চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে দিচ্ছিল সে। ইশঃ এক্ষুনি কেলেঙ্কারি বেঁধে যেত। সেঁজুতি নিজের মাথায় হালকা করে বারি দিয়ে বিড়বিড় করে, ‘ উফঃ কি হয়েছে আমার! ‘

হিরণ হেঁসে ফেলে। ফট করে সেঁজুতির গলায় একটা চুমু খেয়ে বলে,

‘ আমার বউটা আমাকে ছাড়া দেখি একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারে না। ‘

সেঁজুতি চোখ গরম করে তাকায় হিরণের দিকে। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ মোটেই না। আপনি এসে ডিস্টার্ব করছেন তাই ভুল হয়েছে। ‘

হিরণ ইনোসেন্ট গলায় বলে, ‘ হ্যা এখন তো আমার দোষ হবেই! যতো দোষ নন্দ ঘোষ। তবে সোনা নন্দ ঘোষের কি করার তার বউটা যে বেশিই আদুরে! ‘

বলেই সেঁজুতির দিকে আগাতে নিলে পেছন থেকে হিরণের মা বলে উঠেন,

‘ কি করছিস তুই এখানে? কখন ফিরলি? সেঁজুতি তোমার চা বানানো হলো? ‘

হিরণ মাকে দেখেই ভড়কে গিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘ এই তো মাত্র মা। তোমার বউমা’ই তো ডাকলো আমাকে এখানে। ‘

হিরণের কথা শেষ হওয়ার আগেই সেঁজুতি অবাক হয়ে মুখ ফসকে বলে ফেলল,

‘ আমি ডেকেছি আপনাকে? ‘

হিরণ চোখ গরম করে তাকায় সেঁজুতির দিকে। সেঁজুতিকে অবাক করে দিয়ে বলে,

‘ হ্যা, তুমিই তো ডাকলে মাত্র। এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাও সব! কি দরকার বলো? ‘

সেঁজুতি চোখ খোচ করে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হিরণের মার এবার হাসি পায়। একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে তিনি বলেন,

‘ আমার ছেলে যে কতো সাধু আমার জানা আছে। তুমিই হয়তো ডেকেছো। যাকগে ঘরে যা তুই। ‘

হিরণ লজ্জা পেয়ে যায়। দ্রুত কেটে পড়ে সেখান থেকে। সেঁজুতির ইচ্ছা করে লোকটার চুল সব ছিঁড়ে টাক করে দিতে। চা বানিয়ে শ্বশুরমশাইয়ে ঘরে দিয়ে আসে সেঁজুতি। ঘুমানোর আগে তার চা না খেলে হয়ইনা। ঘরের সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। সেঁজুতি হিরণ ফিরলে একসঙ্গে খায়। টেবিলে খাবার গোছগাছ করে ঘরে হিরণকে ডাকতে এসে দেখে হিরণ জামা পাল্টে অন্য একটা সুন্দর শার্ট আর প্যান্ট পড়ে নিয়েছে। সেঁজুতি ভারী অবাক হয়ে বলে,

‘ এগুলো পড়ছেন কেনো? ‘

সেঁজুতিকে দেখে হিরণ মুচকি হেসে বলে,

‘ এসেছো? সোফায় তোমার জন্য একটা নতুন শাড়ি রাখা আছে পড়ে নাও। আজ তোমাকে নিয়ে বাহিরে ডিনার করবো। ‘

সেঁজুতি অবাক হয়ে যায়। থমকে গিয়ে বলে, ‘ এগারোটা বাজে এখন! ‘

হিরণ শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলে,
‘ হুম তো? ‘

‘ বাড়ির সবাইকে রেখে আমরা দুজন! মা কষ্ট পাবেন। ‘

হিরণ মুচকি হেসে সেঁজুতির সামনে এসে দাড়িয়ে কাঁধে চেপে ধরে বলে,

‘ তুমি মা কে এতো ভয় পাও কেনো বলো তো? মা-ই বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে। ‘

সেঁজুতির মুখ হা হয়ে যায়। হিরণ মুচকি হেসে সেঁজুতির নাক টেনে দিয়ে বলে,

‘ বাহিরে ডিনার করবো, আইসক্রিম খাব তারপর রিকশা ভ্রমণ করবো। যতোক্ষণ চাও ততক্ষণ! দেরি করলে কিন্তু প্ল্যান ক্যান্সেল। দ্রুত তৈরি হবে। নো সাজগোজ। ‘

সেঁজুতি হেসে ফেলে। চোখের কার্ণিশে এসে পানি জমা হয়। এতো সুখ জমা ছিল কি তার জন্য! হিরণ সেঁজুতির কপালে চুমু খেয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ তাড়াতাড়ি! ‘

চলবে.