#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ২৯
_______________________
– মা আমি বিয়ে করতে পারবো না মা। দয়া করে আমাকে জোর করো না।
– ক্যান পারবি না? ওই মাইয়ারে ছাড়া যহন থাকতেই পারবিনা তো বিয়া ভাঙছিলি ক্যান?
– আমি নিরুপায় ছিলাম মা। বিশ্বাস করো আমার কাছে যদি তখন একটুও সুযোগ থাকতো আমি তাকে আমার করে নিতাম।
– যা হওয়ার হইছে বাপ। ওরে ভুইলা জীবনডা আবার নতুন কইরা শুরু কর। তাছাড়া ওর তো বিয়া হইয়া গেছে। এতদিনে মনে হয় বাচ্চাকাচ্চাও হইয়া গেছে। ও তো তোর জন্য থাইমা নাই। তুই ক্যান ওর জন্য থাইমা থাকবি?
শিহাব নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। তার স্বর্ণলতার বাচ্চা হয়েছে এই কথাটা সে কিছুতেই মানতে পারছেনা। কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। শিহাবের স্বর্ণলতার গায়ে অন্যকারোর স্পর্শ, অন্যকারোর ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে তার বাচ্চা, এইটা সে কিভাবে মেনে নেবে? আজ তার একটা ভুলের জন্য সব হারিয়ে যেতে চলেছে৷ সেদিন যে সুখের আশায় ও চারুকে ছেড়ে দিয়েছিলো, চারু সে সুখের স্পর্শ অবধি পেলোনা। শিহাব যদি ছেড়েই দিয়েছিলো তাহলে ওকে পাওয়ার কথা ছিলো শাওনের। শাওনের সাথে সুখে থাকার জন্যই তো শিহাব ওকে ছেড়েছিলো তবে কেনো মধ্যবয়সী জামাল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হলো? সেখানে কি আদেও খুশি আছে শিহাবের স্বর্ণলতা?
– তোর লগে তো চারুর কোনোদিন সম্পর্ক আছিলো না বাপ। একটুখানি সময় দেখা। তুই ক্যান ওরে ছাড়তে পারতাছোস না?
{গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া}
– বিশ্বাস করো মা অনেক চেষ্টা করেছি স্বল্প পরিচয়ের সেই কিশোরীটাকে ভুলে যেতে। কি হাস্যকর কথা না, আমি আমার চেয়েও পনেরো বছরের ছোট একটা বাচ্চা মেয়েতে আটকে গেছি? যার সাথে আমার পরিচয় কিছুক্ষণের, কথাবার্তার মধ্যে কখনো কোনো ভালোবাসা সম্পর্কিত কথা ছিলো না, কখনো সে আমার জন্য গভীর অনুরাগ অনুভব করেনি কিন্তু তাকে পাওয়ার জন্যই আমার এমন অসীম অভিপ্রায়।
– আমি ওর চেয়েও সুন্দর মাইয়া আইনা দিমু তোরে। দুনিয়ায় কি ও-ই একমাত্র সুন্দর মাইয়া নাকি?
– আমি সুন্দরী মেয়ে চাইনা মা। আমাকে আমার মায়াবতী ফিরিয়ে দাও।
জমিদার গিন্নি আর কথা বাড়াতে পারছেন না। কে জানে ছেলেটা কবে এত গভীরভাবে চারুলতাতে আসক্ত হয়েছে। কবে চারুলতা পরিনত হয়েছে শিহাবের ভয়ানক আসক্তিতে? কথা বাড়াতে না পেরে তিনি উঠে চলে গেলেন। শিহাবকে এখন আর জোর গলায় দুটো কথা বলা যায়না পাছে সে আবার অনেক দূরে চলে যায়। জমিদার গিন্নি চলে যাওয়ার পর শিহাব বাইরে বেড়িয়ে এলো। হাটতে হাটতে চলে গেলো গ্রামের একেবারে মাঝখানে অবস্থিত সেই বটগাছের কাছে৷ এখানেই প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎ পেয়েছিল শিহাব তার স্বর্ণলতার। সেইসব স্মৃতি এখনো স্মৃতির পাতায় চির অমলিন। পুরনো সেই কথাগুলো মস্তিষ্কের একপাশে খুব যত্নে সাজিয়ে রেখেছে শিহাব। এতবছর পরেও নিজের ভিতরে তার স্বর্ণলতার জন্য ভিন্ন জায়গা,ভিন্ন অনুভব, ভিন্ন অনুরাগ। শিহাবের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে
হচ্ছে,
– ভালোবাসা আর কত কষ্ট দিবি তুই আমাকে? আমার এমন পাগলের মতো ভালোবাসা কি তোর চোখে পড়েনা? অন্যের সাথে কিভাবে সুখে আছিস তুই? একজন মানুষ যে প্রতিনিয়ত তোর জন্যই বেচে থাকে। আজও তোর অপেক্ষাতেই নিজের দিন গোনে। ফিরে আয় ভালোবাসা, ফিরে আয়। আর কত পোড়াবি আমাকে?
চোখের কোনে অশ্রু ভীড় করে। অব্যক্ত কষ্টগুলো আত্মপ্রকাশ করতে চায় কিন্তু এদেরকেও নিজের ভিতরে সযত্নে পুষে রেখে দিয়েছে শিহাব। স্বর্ণলতার প্রতি তার খুব অভিমান! সে ফিরে এলেই সকলে মিলে একসাথে নালিশ জানাবে তার কাছে। নিশ্চয়ই জানাবে। আচ্ছা স্বর্ণলতা কেনো তার হলোনা? বয়সের কারণে কি? এমন কতশত উৎভট প্রশ্ন শিহাবের মনে হানা দেয় রোজ, কিন্তু উত্তর মেলে না। গগন পানে চেয়ে সে বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
পরের জন্মে বয়স যখন ষোলই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
এই জন্মের দুরত্বটা পরের জন্মে
চুকিয়ে দেবো মনে থাকবে?
~(সংগ্রহীত)
★★★
চারুলতা খুবই সতর্কতার সাথে নিজের বোরকা পাল্টে নিয়ে অন্য এক বোরকা পড়ে নিলো। নিজের ব্যাগটা বদল করে ফেললো বান্ধবীর ব্যাগের সাথে। এখনই সুযোগ সকলকে ফাকি দিয়ে কলেজ থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার। একসপ্তাহ যাবত চারু এইদিনটার অপেক্ষায় আছে৷ শেষ পর্যন্ত সুযোগ হয়েই গেলো এখান থেকে পালানোর। যত দ্রুত সম্ভব শতভাগ সতর্কতা সাথে হামিদের সাথে দেখা করতে হবে৷ চারু কোনো ঝুকি নিলো না। চারু জানে ফোনের সাহায্য লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব, তাই ফোনটাও তার বান্ধবীর কাছেই রেখে দিলো। কলেজ গেইট থেকে বেড়িয়ে সোজা একটা রিকশা নিয়ে সেটাতে উঠে গেলো। রিকশা দিয়েই একেবারে বাড়িতে পৌছানো সম্ভব কিন্তু এবারেও চারু ঝুকি নিলো না। রিকশা থেকে নেমে সিএনজিতে উঠে গেলো। বাসার থেকে কিছুদুর আগেই সে সিএনজি থেকেও নেমে গেলো। কোনোভাবে কেউ যদি ওকে ফলোও করে বা ড্রাইভার গুলো যদি পুলিশের লোকও হয় তাও যেনো হামিদকে ধরতে না পারে তাই এ প্রচেষ্টা। চারু আজও পুরোপুরি ভাবে সাজিদকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। এতবার ঠকে এখন আর কাউকেই বিশ্বাস হয়না চারুর। মিথ্যা দ্বারা হৃদয়টা এমনভাবেই প্রতারিত হয়েছে যে সত্যকেও এখন মিথ্যা মনে হয়। চারু খুবই সতর্কতার সহিত এলোমেলো ভাবে চলে বাড়িতে পৌঁছে গেলো। কেউ যদি ওকে ফলোও করে থাকে তাও বুঝতে পারবেনা চারু ঠিক কোথায় গিয়েছে৷ নিজেকে ধাতস্থ করে ধীর হস্তে ক্রলিং বেল বাজালো চারু। কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা খোলা হলো। দরজাটা খুলেছে ফাতেমা।
চারুকে দেখেই ফাতেমা এক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা সত্যিই চারু তার সামনে।
– কেমন আছো ভাবি?
ফাতেমা এবার চারুকে ধরে হাউমাউ করে কেদে ফেললো। ঘটনার আকষ্মিকতায় কিছুটা চমকে উঠলো চারু। ফাতেমার কি হয়েছে? এভাবে কেনো কাদছে সে? ফাতেমা নিজে নিজে বিলাপ করতে শুরু করলো,
– আমারে মাফ কইরা দাও চারু। আমি এতদিন না বুইঝা অনেক অন্যায় করছি তোমার লগে। আমি জানি আমার অন্যায়ের মাফ নাই তাও তুমি আমারে মাফ কইরা দাও। আমি এতদিন ভাবতাম মানুষ সুন্দর হইলেই তার জীবন সুন্দর কিন্তু ওইদিন তোমার ভাই যহন আমারে তোমাগো ছোট কালের কথা কইলো। বড় হওয়ার পরের কথা কইলো, তোমার লগে ঘটা ঘটনার কথা কইলো আমার মইরা যাইতে ইচ্ছা করতাছিলো। এমন জনম দুঃখী মাইয়ারে আমি এত কষ্ট দিলাম ক্যামনে? আমি তো সবচেয়ে বেশি পাশানী। ও চারু তুমি আমারে মাফ করবা না বইন? আমি নাহয় বোকা ছিলাম, কিছু জানতাম না তুমি ক্যান আমার কথা ধইরা চইলা গেলা? বোকা মানুষগো কথা কি ধরণ লাগে? আহো তুমি ঘরে আহো। আমি আর কোথাও যাইতে দিমু না তোমারে। তুমি আমাগো সাথেই থাকবা আজকে থেকে।
চারু অনুভূতিহীনের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ফাতেমার এই কান্না তার এই আকুতি চারুর মনকে ছুয়ে যেতে পারলো না। কষ্ট হচ্ছেনা, মায়া হচ্ছে না, ভালোবাসার অনুভূতি হচ্ছেনা কিচ্ছুই হচ্ছেনা অথচ প্রথম দিকে চারু খুব চাইতো ফাতেমা তার সাথে ভালো আচরণ করুক, একটু ভালোবেসে মায়ের মতো আগলে নিক। মা আর বোনের পর ভাবি-রাই নাকি মায়ের দায়িত্ব পালন করে।
– তুমি বহো আমি তোমার জন্য পানি নিয়া আহি।
ফাতেমা চলে গেলো। ফাতেমার এমন আন্তরিকতার কারণ বুঝতে পারছে চারু। হামিদ সম্ভবত ফাতেমাকে সব জানিয়েছে আর আবেগী ফাতেমা অল্পতেই গলে গেছে। চারু সেসব নিয়ে মাথা ঘামালো না। হামিদের সাথে দেখা করাটা একান্ত জরুরি। কিছুক্ষণের মাঝেই ফাতেমা পানি নিয়ে এলো। চারু হামিদের কথা জিজ্ঞেস করতেই ফাতেমা জানালো হামিদ কিছুক্ষণের মাঝেই দুপুরের খাবার খেতে আসবে। চারু লতার কাছে গেলো। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। কি মিষ্টি দেখতে! লতা প্রিম্যাচুয়র বেবি। সাত মাস সতেরো দিনের মাথায় লতার জন্ম হয়। হামিদ আর ফাতেমার বিয়ের তখন মাত্র তেরো মাস। ঘুমের মাঝেই দাত বিহীন একটা মুচকি হাসি দিলো লতা। চারু অনুভব করলো এই মেয়েটার হাসিতে সত্যিই অদম্য মায়া লুকায়িত আছে। চারু নিজের ছোটবেলার একটা ছবি দেখেছিলো। নানু বাড়িতে তোলা ছবি। তারা ধনী ছিলো বিধায় শখের বসে চারুর ছোট মামা একটা ক্যামেরা কিনে নেন। সেটা দিয়েই চারুর ছবি তোলা হয়। চারুর সেই ছবিটি বর্তমানে লতার মতোই লাগে। দাত বিহীন হাসির একটা ছবি। এমনকি চারুও প্রিম্যাচুয়র বেবি ছিলো। দুজনের মাঝেই কি অদ্ভুত মিল। চারুর ভিতর হঠাৎই বিষাদে ছেয়ে গেলো। চারু অনুভব করলো তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। শেষ কবে সে কান্না করেছিলো তা মনে করতে পারছেনা কিন্তু আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চারু ঘুমন্ত লতাকে বুকের মাঝে চেপে ধরলো,
– মা গো, ফুপ্পির মতো হয়েছো ভালো কথা কিন্তু ফুপ্পির ভাগ্যটাকে নিজের ভাগ্য হিসেবে বরণ করে নিও না। তোমার বাবাটা খুবই ভালো। আমার বাবার মতো নয়। তোমাকে খুবই ভালোবাসে। যতদিন তোমার বাবা আছে, ততদিনে তোমার কিচ্ছু হবেনা দেখে নিও। তোমার জন্য হলেও তোমার বাবাকে একটি সুন্দর জীবন কাটাতে হবে। তুমি চিন্তা করো না, আমার অভিসপ্ত জীবনে তোমার বাবাকে আমি জড়াবো না। বাবার ছায়া মাথায় না থাকলে একটা মেয়ে যে কতটা অসহায় হয় সেটা কেবল একমাত্র একজন বাবার ছায়াহীন মেয়েই বলতে পারে। আমিও তেমনই এক মেয়ে। বাবা থেকেও বাবা ছিলো না আমার। তোমাকে এমন জীবন ভোগ করতে হবেনা মা। তোমার বাবা করতেও দিবেনা দেখে নিও।
আচমকা চারুর এমন আচরণে লতার ঘুম ভেঙে যায়। ফুপ্পিকে চিনতে দেরি হয়নি তার। তার ফুপ্পি কান্না করছে এইটাও সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে তাই এভাবে আচমকা ঘুম ভেঙেও সে কাদছেনা। সযত্নে চারুর চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। চারু স্তব্ধ হয়ে গেলো বাচ্চা মেয়েটার এমন আন্তরিকতায়। লতা চুপচাপ চারুর কপালে আলতো একটা চুমু একে দিলো। চারু অনুভব করলো তার ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। অনেক দিন পর এমন ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে। লতার মুখ দেখেই ভিতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছে। এইটাই সম্ভবত রক্তের সম্পর্কের বন্ধন।
– দেহো মাইয়া তোমারে ক্যামনে চিনা নিছে।
ফাতেমার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝড়ে পড়ছে। ফাতেমা শ্যামলা হলেও মুখটা মায়াবী। তাকে দেখে চারু একটু মুচকি হেসে বললো,
– রক্তের সম্পর্ক তো ভাবি। এভাবে কিভাবে ভুলে যাবে বলো?
ফাতেমা উত্তর দেওয়ার আগে বাসার ক্রলিং বেল বেজে উঠলো। প্রথমে দুইবার, তারপর একবার তারপর আবার দুইবার। ফাতেমা এবং চারু দুজনেই বুঝতে পারলো হামিদ এসেছে। এমন স্টাইলে বেল কেবল হামিদই বাজায়। ফাতেমা দরজা খুলে দিতেই হামিদ ভেতরে ঢুকলো। ফাতেমার হাসি মুখ দেখেই বললো,
– অকারণে হাসো ক্যান? ভুতে ধরছে? হাসবা না। হাসলে তোমারে কটু দেখতে লাগে।
ফাতেমার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো তথাপি কিছু বললো না। এখন এইসব তার গা সওয়া হয়ে গেছে। যথাসম্ভব স্বাভাবিক মুখ করে বললো,
– চারু আইজ আমাগো সাথে দেহা করতে আইছে।
হামিদ ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে আসলে সত্য বলছে নাকি বায়োনাট কথাবার্তা তবে ফাতেমার কথাটা বায়োনাট বলে মনে হলোনা। হামিদ দৌড়ে ছুটে গেলো ভিতরের দিকে। চারু তখনও লতাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হামিদকে দেখেই চারু একটু হাসলো। হামিদ ধীরপায়ে গিয়ে চারুর পাশে বসলো,
– কেমন আছস?
– আমি জেল পালিয়েছি। আমাকে কে সাহায্য করেছে জানো?
– তুই ক্যামনে জানতি সাজিদ তোরে জেল থেকে পালানোয় সাহায্য করবো? যদি না করতো? আমার কথা না শুইনা এত বড় ঝুঁকি ক্যান নিলি? এই বিশ্বাস ছিলো তোর আমার প্রতি?
– রাগ করো কেনো তুমি? আমার পরিকল্পনা তো সফল হয়েছে। নাজিমুদ্দিনকে খু*ন করার সাথে সাথে আমরা বসকে খোজার সব উপায় হারিয়ে ফেলি। সেটা আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো কিন্তু সংশোধন তো করতে হবে বলো। তাকে তো আমি এভাবে ছেড়ে দিতে পারিনা।
– যদি সাজিদ সাহায্য না করতো তাহলে?
– আমি জানতাম করবে। একমাত্র পুলিশের সাহায্যেই তাকে ধরা সম্ভব।
– যদি না করতো তো?
– ধুর বারবার এক কথা বলো কেনো? করেছে তো। আর যদি না করতো তাহলে আর কি? আমার ফা*সি হতো।
হামিদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। চারু সেটাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না। চারু জানে হামিদ তার জন্য এত উতলা কারণ হামিদ তাকে নিজের জীবন দিয়ে ভালোবাসে৷ হামিদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে চারুর এমন নির্বোধের মতো কাজকর্মে ওর উপর রাগ করার, ওকে শাসন করার।
– আমার কলিজাটা মনে হয় ছিড়ে যাইতাছিলো যহন তুই আমার কথা না মাইনা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কোনোকালেই পড়তাম না কিন্তু তুই নিজে যহন পুলিশের কাছে ধরা দিলি তহন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পইড়া শুধু তোর সুস্থতা কামনা করছি। তুই ভাবতেও পারবি না এই কয়টা মাস ক্যামনে কাটছে আমার। তোর কিছু হইয়া গেলে পর্যন্ত আমি খোজটা পাইতাম না।
হামিদের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হলেও সেখানে প্রকাশ পাচ্ছে রাগ, অভিমান, জেদ আর ভালোবাসা। আল্লাহ একজন মানুষকে কখনোই সম্পূর্ণ নিঃস্ব করেননা। একদিক খালি করলে আরেকদিক ঠিকই পূর্ণ করে দেন৷ হামিদ চারুর সেই পূর্ণতা। ভাগ্য করেই হামিদের মতো একটা ভাই সে পেয়েছিলো। কয়জন মেয়ে এমন ভাগ্য করে জন্মায় যাদের হামিদের মতো ভাই আছে?
– তোমার খুব অভিমান না আমার উপর?
হামিদ উত্তর দেয় না। আসলেই খুব অভিমান তার চারুর প্রতি। চারু হামিদের কাধে নিজের মাথাটা রাখলো। সবচেয়ে প্রশান্তির এবং ভরসার একটি জায়গা। এই জায়গাটা চারুর জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। দুনিয়ার কারোর সাধ্য নেই এখানে চারুর ক্ষতি করা। হামিদের জীবন চলে যাওয়ার আগে কেউ চারুর গায়ে একটা আচরও কাটতে পারবেনা চারুর বিশ্বাস।
– কিছু খাইছস? এহন কই থাকস?
– এস আই এর বাড়িতে।
– সে তোরে ক্যান সাহায্য করলো? আর তুই জানলিই বা কিভাবে সে তোরে সাহায্য করবো?
– বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। পরে বলি?
– না এহনই বল।
– আমার না তাকে ঠিক বিশ্বাস হয়না ভাইয়া।
– ক্যান?
– জানিনা। দুনিয়ার উপর থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে। কিছুক্ষণ আগে ভাবি কত ভালো আচরণ করলো আমার সাথে কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই দুনিয়ায় সম্ভবত তুমিই একমাত্র মানুষ যার উপর আমি শতভাগ বিশ্বাস রাখি। চোখ বন্ধ করেও বিশ্বাস রাখি।
– তাইলে আমার কথা সেইদিন শুনলি না ক্যান?
– এখনো জানো*য়ারটাকে খোজা হয়নি যে। তার সাথে অনেক হিসেব বাকি আছে।
– আমরা নিজেরা খুইজা নিতাম তারে।
– কি দরকার? পুলিশ তো আর এমনি এমনি আমাকে সাহায্য করছেনা। নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
– কেমন কৃতজ্ঞতা?
– সাজিদের প্রাক্তন স্ত্রী সায়মার সম্পর্ক ছিলো পুলিশ অফিসার হোসেনের সাথে। তার জন্যই সাজিদের সংসার ভেঙেছে৷ তার মেয়েটা মা হারা হয়েছে। হোসেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে তাই সাজিদের ইচ্ছে ছিলো তাকে খু*ন করা। কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে যায় সাজিদ। সায়মার প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো না কিন্তু তারা দুজনেই ছিলো বিশ্বাস ঘাতক আর এই বিশ্বাস ঘাতককে খু*ন করেছি আমি। তাই এ কৃতজ্ঞতা।
– সে কি সায়মারেও খু*ন করতে চায়?
– না। সায়মাকে বাঁচিয়ে রাখবে নিজের চোখে তার কষ্ট দেখার জন্য তবে ওই বাসায় গিয়ে আমি কিছুটা কনফিউশানে পড়ে গেছি। আমার মনে হচ্ছে আমি এতদিন যা দেখেছি, যা শুনেছি সব সত্যি নয়। এই সত্যির আড়ালেও আরো অনেক কিছু লুকায়িত আছে। আর আমি নিশ্চিত আমি সম্পূর্ণ সত্যি জানি না।
– কি দরকার জানার? তুই চাস বসরে খুইজা তাকে খু*ন করতে। নিজের কাজ হাসিল করবি আর চইলা আসবি। পুলিশের সত্য উদঘাটনের কি দরকার?
– সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছি তোমার সাথে। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।
– হুম বল।
– সপ্তাহ দুয়েক আগে সাজিদ আমাকে আমার কলেজে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমরা বুড়িগঙ্গা নদীর ব্রিজের উপর যাই। সেখানেই সাজিদ আমাকে প্রথম বারের মতো জানায় আমি যদি চাই সে আমাকে আইনের হাতে তুলে দেবেনা। আমি নিজের মতো আমার জীবন শুরু করতে পারি।
– আইনের হাতে তুইলা দিবো মানে? অসম্ভব! তুই জানস, তুই যেই খু*ন গুলা করছোস তার জন্য তোর ফা*সি হইতে পারে?
– জানি।
– জানস তো এহনো ওইহানে পইড়া আছস ক্যান?
– আমার জীবনের এমনিও কোনো মূল্য নেই। বেঁচে থেকে কি হবে।
চারুর কথাটা বলতে দেরি হলেও হামিদের তাকে সজোরে থাপ্পড় মারতে দেরি হলো না। যে মেয়ের মঙ্গল কামনায় দিন-রাত মসজিদে বসে থাকে সেই মেয়ে কি না নিজের মৃত্যু কামনা করছে। কতটা স্বার্থপর হলে মানুষ কেবল নিজের চিন্তাই করে, তার চারপাশের মানুষদের চিন্তা করেনা?
– মারলে কেনো?
– তোরে তো খু*ন কইরা ফেলা উচিত।
চারু আর কথা বাড়ালো না। সে সম্ভবত হামিদের চিন্তাভাবনা কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই সে সম্পর্কে কথা না বাড়ানোই শ্রেয়। ছোট থেকে হামিদের কাছে সে কত থাপ্পড় খেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। তাই শুধু শুধু এইটা নিয়ে মাতামাতি করে রগচটা হামিদের রাগ আরো বাড়ানোর ইচ্ছে হলো না চারুর।
– আমার কথাটা শোনো, অযথা রাগ দেখিয়ো না। আমি এমন এক গোলকধাঁধায় পড়ে গেছি যার থেকে বের হওয়া অসম্ভব প্রায়। পুলিশটার সম্পর্কে সত্য জানতেই হবে আমার। সেদিন কিছুক্ষণ ওই ব্রিজে থাকার পরেই আমি আর সাজিদ বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। বাসায় পৌছানোর পর আমি নিজের ঘরে চলে গেলেও সাজিদ নিচে থেকে যায়। আমিও ভুলে আমার ব্যাগটা নিচে ফেলে চলে গিয়েছিলাম সেটা নিতে এসেই আমি সাজিদ আর তার মায়ের কিছু কথোপকথন শুনি।
★
নিজের ঘরে ঢোকার পরই চারু বুঝতে পারলো পানি খাওয়ার সময় সে তার ব্যাগটা সোফায় রেখেছিলো। চারু আবার নিচে চলে যায় ব্যাগটা আনতে। সেই ঘরেই বসে ছিলো সাজিদ এবং নাজমা বেগম। তারা চারুকে নিয়ে পরষ্পরের সাথে কিছু কথা বলছে,
– শোন বাবা, আমি যা বলছি তা মেনে নে।
– এইটা কিভাবে হয় মা? চারুলতা এখন আমার দায়িত্ব তাই বলে আমি ওকে বিয়ে করে নিতে পারি না।
– এখন দায়িত্ব নিতে পারলে সারাজীবন দায়িত্ব নিতে পারবি না? এখন নাহয় তোর কাছে আছে কিন্তু কেস শেষ হলে তো তাকে চলে যেতে হবে। তোর ভাষ্যমতে, এই দুনিয়ায় ওর আর কেউ নেই তাই ওকে তোর সাথে থাকতে বলা হয়েছে কিন্তু এরপর ও কোথায় যাবে? একা সুন্দর একটা মেয়ে কিভাবে বাঁচবে? এখানে মেয়েরা একটু সুন্দর হলেই বাবা মায়ের চিন্তার শেষ থাকেনা আর চারুলতাকে সেখানে আগুন সুন্দরী বললেও ভুল হবে না।
– তাকে নিয়ে তুমি এত কেনো ভাবছো মা? সে কিভাবে থাকবে সেটা তার ব্যাপার।
– তুই যদি তাকে বিয়ে করিস তাহলে সমস্যা কোথায়?
– তুমি বুঝতে পারছো না মা। এমনটা হয় না। হতেই পারে চারুলতার অন্য কাউকে পছন্দ। সে কেনো আমাকে বিয়ে করবে?
নাজমা বেগম দমে গেলেন। আসলেই তিনি এমন কিছু ভাবেননি। চারুর পছন্দ থাকতেই পারে।
– মেয়েটার সাথে আমাদের কথা বলা উচিত সাজিদ।
– কোনো দরকার নেই মা। এইটা সম্ভব নয়।
সাজিদ নাজমা বেগমকে আর কথা বাড়াতে দিলো না। সে উঠে চলে গেলো তবে নাজমা বেগম এরপর থেকে প্রায় সময়ই সাজিদকে চারুর সম্পর্কে এইটা সেইটা বলতো৷ মানুষের মন সদা পরিবর্তনশীল। একটানা কারোর কথা নিয়মিত শুনলে মনের অজান্তেই তার জন্য মনের ভিতর একটা জায়গা ঠিক হয়ে যায়। সাজিদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না৷ একসময় নিজের মেয়ের কাছে যে মেয়েকে ঘেসতে দিতে ভয় পেতো সেই মেয়েকেই তার মা হওয়ার প্রস্তাব করে সাজিদ নিজে। চারু অবাক হয়নি। নিরুত্তর, অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে ছিলো সাজিদের দিকে। চারুর এই অবাক হওয়া না দেখে অবাক হয় সাজিদ নিজেই।
– আপনি খুবই অদ্ভুত চারুলতা।
চারু উত্তর দেয়না। কোনো অনুভূতিও ব্যক্ত করেনা। কেমন যেনো অনুভূতিহীন পাথরের মতো হয়ে গেছে সে।
– চারুলতা আপনি ভেবে জানাবেন। তবে হ্যাঁ আপনার উপর কোনো জোর নেই। আমি আমার ইচ্ছে জানিয়েছি আপনি আপনার ইচ্ছে জানাবেন৷ আপনার সম্মতিতেই সব হবে৷ আমি আসছি।
★
– এরপরই আমি সুযোগ খুজতে থাকি তোমার সাথে দেখা করার। সুযোগও পাই প্রায় একসপ্তাহ পর। আর এখন আমি তোমার সামনে।
– এখন কি করতে চাস তুই?
– আমি জানি না। তোমার কি মনে হয় আমার কি করা উচিত?
– তারে বিয়া করলে সে তোরে আর পুলিশের হাতে তুইলা দিবো না তাই তো?
– স্বার্থপরের মতো কথা বলো না। মৃ*ত্যুকে আমি ভয় পাই না।
– কিন্তু তোর মৃ*ত্যুর কথা শুনলে আমি ভয় পাই।
– আমার না নাজমা বেগমকে ঠিক সুবিধার লাগছে না।
– ক্যান?
– জানি না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমার মনে হচ্ছে নাজমা বেগম যেমন তিনি আমাকে তেমন দেখান না।
– আর সাজিদ?
– বুঝতে পারছিনা। তাকে আমি ঠিক যেমন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিনা তেমনি অবিশ্বাসও করতে পারছি না। লোকটাকে খুব ভালো মনে হয়। এতদিন তাদের বাসায় আছি সে চাইলেই সুযোগ নিতে পারতো কিন্তু কোনোদিন খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়নি পর্যন্ত উল্টো আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো।
– তোর মন কি চায়?
– আমার মন এখন কিছুই চায় না। আমি তাদের ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছিনা আবার অবিশ্বাসও করতে পারছিনা। আমার মনে হয় তারা নিজেদের একটা আবরণীর সাহায্যে ঢেকে ফেলেছে। যা দেখাচ্ছে সবটাই মিথ্যা। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এখানে কিছু একটা ঘাপলা আছে।
– এরা যহন এতদিনে কিছু করে নাই মনে হয় পরেও কিছু করবো না। তুই রাজি হয়ে যা। তুই তো বেঁচে যাবি, আর কি চাই?
– বেঁচে থেকে যদি আবারও কোনো এক নরকে গিয়ে পড়ি? এখন কোনো সম্পর্ক গড়তে খুব ভয় পাই আমি। ভীষণ ভয় পাই।
{গল্পের আসল লেখিকা শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া}
– কাল শিহাবরে দেখলাম টিভিতে। একটা হাসপাতাল বানাইতাছে। বেশ নামডাক। পোলাটাও ভালোই ছিলো। তার সাথে বিয়া হইলেই মনে হয় তোর জীবনটা সুন্দর হইতো। শুধু শুধু তুই তার সাথে বিয়েটা ভাঙলি।
চারু একটু চমকে উঠলো। সে কখনো হামিদকে বলেনি শিহাবের সাথে বিয়েটা সে ভেঙেছে তবে হামিদ কিভাবে জানলো। হামিদ সম্ভবত চারুর ভাবনা ধরতে পারলো,
– তোর ভাই আমি চারু। তোর মাথায় যদি বুদ্ধির পাহাড় থাকে আমার মাথায় কি বুদ্ধির ঢিবি থাকবো না?
– তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই। শিহাব নাজিমুদ্দিনের সত ছেলে। হিসেবে সে আমাদের ভাই হয়।
– শিহাবের মা আর আমাদের মা কি এক?
– না।
– শিহাবের বাপ আর আমাগো বাপ কি এক?
– না।
– শিহাবের বাপ কে সেটা কেবল তার মা-ই জানতো। শিহাবকে পেটে নিয়েই সে নাজিমুদ্দিনকে বিয়ে করে তাই শিহাবের বাবাও নাজিমুদ্দিন না। বাপও এক না মাও এক না তাইলে সে কিসের আমাগো ভাই?
– তার কথা এখানে কেনো টানছো? যা চলে গেছে সেটা গেছে।
– দেখ চারু, তুই কি করবি সেটা তুই জানস কিন্তু ভুইলা যাইস না তোর জন্যই আমার চিন্তা সবচেয়ে বেশি। তোর কোনো কষ্ট আমি দেখতে পারমু না। যা করবি ভাইবা চিন্তা করবি। খালি নিজের দিকটা না দেইখা আমার দিকটাও ভাববি। তোরে ভালো থাকতে হইবো চারু। আরো অনেক বছর বাঁচতে হইবো।
– তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?
হামিদের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো,
– না তো। কে কইছে আমি তোরে ভালোবাসি? নেহাৎ মা তোর দায়িত্ব আমারে দিয়া গেছিলো নইলে এমন পেত্নী, কে নিজের ঘাড়ে ঝুলাইতে চায়?
চারুর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো। সে জানে হামিদ তাকে খেপানোর জন্য কথাটা বলেছে কিন্তু তাও চারুর ভীষণ রাগ হলো। এতক্ষণ সে লতাকে কোলে নিয়েই বসে ছিলো, সাবধানে তাকে নামিয়ে দিয়ে বললো,
– দাঁড়াও রান্নাঘর থেকে লঙ্কাগুড়োটা নিয়ে আসি। ছোট বেলার কথা মনে আছে তো? এইবার এই লঙ্কা গুড়ো দিয়ে তোমাকে আমি গোসল করাবো। আবারও ছোটবেলার ফিল নাও।
_______________________
To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া
(১৮+ এলার্ট। রোজা রাখা অবস্থায় পর্বটা পড়বেন না)
#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Priya (স্নেহা)
#পর্বঃ৩০
_______________________
– আপনার কাছে পাঁচ মিনিট সময় আছে ভাবার জন্য। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তাহলে এখনি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে হবে।
কলেজ থেকে ফেরার সময় চারুর কথায় হকচকিয়ে গেলো সাজিদ। তার ঠিক বোধগম্য হলোনা চারু ঠিক কি বলতে কিংবা করতে চাইছে।
– আপনার কথার মানে বুঝতে পারলামনা চারুলতা।
– সোজা বাংলাতেই তো বললাম। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে চান তো এখনই কাজি অফিসে চলুন। আজই আমাদের বিয়ে হবে এবং আজ বিয়ে করেই আমরা বাসায় ফিরবো আর যদি এমনটা নাহয় তাহলে আর কখনোই আমাদের বিয়েটা হবেনা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।
– কিন্তু বিয়ের জন্য তো মা-কে প্রয়োজন। তাকে নিয়ে তারপর,,
– না। বিয়ে হলেই একমাত্র ওনি বিয়ের সম্পর্কে জানবে। তার আগে নয়।
– কিন্তু চারুলতা,,
– পাঁচ মিনিট থেকে অলরেডি দুই মিনিট পার হয়ে গেছে সাজিদ। আপনার কাছে আর তিন মিনিট সময় আছে।
চারু কিছুটা অদ্ভুত সেটা সাজিদ জানে কিন্তু তাই বলে চারু তাকে এমন গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে তা ছিলো সাজিদের কল্পনাতীত। সাজিদের মনে হলো এমনিতেই তার মা চায় চারুর সাথে ওর বিয়েটা হোক তাই তার আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। সাজিদ চারুর কথায় সম্মতি জানালো। চারুর ঠোঁটে দেখা মিললো দুর্ভেদ্য, রহস্যময়ী এক হাসির।
– আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি সাজিদ?
– শতভাগ পারেন।
– আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন?
– বিশ্বাস না করলে আপনাকে আমার জীবনসঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব করতাম না চারুলতা।
– তাহলে আমার সাথে চলুন।
– কোথায় যাবো?
– এক্ষুনি তো বললেন আমাকে বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস করেই নাহয় আমার সাথে কিছুক্ষণ চলুন।
সাজিদ চারুর দেখানো পথে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলো। বেশ অনেকটা দূরে একটা গলির সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বললো চারু।
– আপনাকে একজনের সাথে দেখা করাতে চাই সাজিদ। দেখা করবেন?
কথাটা বলে চারু সাজিদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না৷ চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। সাজিদও চারুর সাথেই নীচে নেমে গেলো। কিছুটা দূরেই সাজিদ একজন ছেলেকে দেখলো। বয়স সম্ভবত ২২-২৩। শুভ্র গায়ের রঙে শুভ্র রঙের শার্ট দারুণ শোভা পাচ্ছে। সাথেই পরনে একটি কালো রঙের জিন্স প্যান্ট। সবচেয়ে নজরকাড়া যেই ব্যাপারটা সেটা হলো চারুর সাথে তার মুখের অদ্ভুত রকম মিল। সত্যিই যেকেউ দেখলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য এরা ভাই-বোন। জমজ বললেও হয়তো কেউ অবিশ্বাস করবেনা। ছবিতে অনেকবার সাজিদ দেখেছে এই যুবকটিকে কিন্তু সামনাসামনি এই প্রথম,
– বিয়েতে আমি আমার পক্ষের সাক্ষী হিসেবে আমার ভাইকেই রাখবো। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
– আপত্তি থাকার কি আছে? কেমন আছো হামিদ?
– ভালোই আছি। আপনে কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ। তোমার মেয়ে আর স্ত্রী কেমন আছে?
– তারাও ভালাই।
– গাড়িতে উঠে পড়ো তোমরা দুজন। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। (চারু)
সাজিদ আর চারু সামনে বসে পড়লো আর হামিদ বসলো পেছনে। সাজিদ ভাবতেও পারেনি সে এখানে হামিদকে দেখবে।
– হামিদের সাথে কি আপনার রেগুলার যোগাযোগ ছিলো চারুলতা?
– না।
– মাঝে মাঝে হতো?
– না।
– তাহলে হামিদকে কিভাবে ডেকে নিলেন আপনি?
– বলবো না।
সাজিদ কথা বাড়ালো না। সময় করে নাহয় জানা যাবে। এখন চারুকে ঘাটানোর অভিপ্রায় হলো না তার। সাজিদের ধারণা ছিলো না চারু আদেও তাকে বিয়ে করতে রাজি হতে পারে কিন্তু আচমকা এমন কিছু হওয়ায় কিছুটা ভড়কে গিয়েছিলো সে। চারুর অদ্ভুত ব্যাবহারে সাজিদের মনে কিছুটা ভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে। সে পারবে তো মেয়েটাকে আবার আগের মতো স্বাভাবিক করে নিতে। সাজিদ জানে একটু ভালোবাসা দিয়েই চারুলতাকে স্বাভাবিক জীবনে আনা সম্ভব কিন্তু সে কি এইটা করতে সক্ষম হবে? চারু কি আদেও তাকে ভালোবাসবে? না বাসলে ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। মোট কথা, চারুলতা নামের এই মায়াবতীকে ভালোবাসায় বাধতে হবে। বাধতেই হবে! কে জানে কখন মেয়েটার প্রতি অমোঘ এক টান সৃষ্টি হয়েছে মন পিঞ্জরায় কিন্তু টান যখন অনুভব হয়েছে মেয়েটাকে তখন নিজের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে একটা সুন্দর জীবন দেবে বলেই সাজিদ নিজের কাছে দায়বদ্ধ হলো। আজ যেই হাতটি সে ধরবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি সে হাতটা সে ধরে রাখবে বলে আবারও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো নিজেরই কাছে।
★★★
বিরহ দহনে দগ্ধ করবি আর কত আর,
তুই কি দেখিস না এ হৃদয়ের এত হাহাকার?
তোর বিরহে মোরে পুড়তে হবে আর কতকাল,
তুই কি দেখিস না এ হৃদয়ের সুপ্ত চিৎকার?
চারুর ছবিটি এই নিয়ে কমপক্ষে তিনবার একে ফেললো শিহাব। তিনবারই নিখুঁত আর স্পষ্টভাবে সে আঁকতে সক্ষম হয়েছে নিজের স্বর্ণলতাকে। উপরোক্ত বাক্যগুলো শুধুই শিহাবের দেওয়া তার ভালোবাসার, অতি আকাঙ্ক্ষিত স্বর্ণলতাকে। শিহাবের ভালোবাসার কষ্ট প্রকাশ করে যাচ্ছে এই শব্দগুলো কিন্তু শোনার জন্য শিহাবের স্বর্ণলতা কই? শিহাব ভিতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে৷ নেই! তার স্বর্ণলতা কোথাও নেই। তার দুঃখগুলো শোনার কেউ নেই তাকে ভালোবাসারও কেউ নেই। কেনো সে আটকে গেলো সেই কিশোরীতে? স্বল্পক্ষণের পরিচয়ই তো ছিলো। ভালোবাসা কেনো মুছে না গিয়ে দিনকে দিন আরো গভীর হয়? কেনো ভালোবাসার তৃষ্ণা মিটতে চায়না? শিহাবের আফসোস হয়, চারুলতা কেনো শুধুই তার আবেগ হলো না। আবেগ হলে নিশ্চয়ই এতদিনে ভুলে যেতো কিন্তু ভালোবাসা তো ভোলা যায় না। গভীর মায়ায় জড়িয়ে পড়তে হয় নিজের অনিচ্ছায়। এতটাই গভীর সে মায়া, যেখানে একবার পড়লে সেখানে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। চাইলেও আর সেই ভালোবাসা নামক অতল গহ্বর থেকে বের হওয়া সম্ভব না।
শিহাবের কিছুতেই শান্তি লাগছেনা। এই গ্রামে আসলেই নিরলসভাবে মস্তিষ্কটা শুধু শিহাবকে তার মায়াবতীর কথা মনে করায়। একটুখানি দুদণ্ড শান্তিতে বসার জো নেই। প্রেয়সীর বিরহে কি ভয়ংকর কষ্ট হয় তা কেবল এক ভালোবাসায় পাগল প্রেমিক পুরুষই বর্ণনা করতে সক্ষম। সে ছাড়া আর কারো সাধ্য নেই সে যন্ত্রণার কিয়দংশ অনুভব করার। শিহাব ব্যাগ গোছানো শুধু করলো, এ গ্রামে আর এক মূহুর্ত নয়। স্বর্ণলতার স্মৃতি যে বড্ড পীড়াদায়ক! শিহাবের ব্যাগ গোছানোর মুহূর্তেই ঘরে আগমন ঘটলো জমিদার গিন্নির। শিহাবকে জামাকাপড় গোছাতে দেখেই ভ্রু কুচকালেন তিনি,
– এইগুলা ব্যাগে ঢুকাইতাছস ক্যান বাপ?
– আমি আজ রাতেই গ্রাম ছাড়বো মা।
– আইজ রাইতে গ্রাম ছাড়বি মানে? ক্যান কি হইছে?
– কিচ্ছু হয়নি মা। তার স্মৃতি যে আমাকে বড্ড পোড়ায়। আমি মেনে নিয়েছি মা। যে ভালোবাসবে, ভালোবাসার আগুনে পুড়ে তাকে ছাই হতেই হবে। আমিও হচ্ছি! এই হওয়াটাই স্বাভাবিক বরং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
জমিদার গিন্নি ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিহাবের সামনে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে ওঠে অশ্রুজলে। শিহাব দেখেনা। জমিদার গিন্নি নিজের অজান্তেই অভিসাপ দেয় চারুকে। তার জন্যই ছেলেটার আজ এ দশা। আবার চারুকে অভিসাপ দেওয়ায় নিজ মনেই তওবা করেন। মেয়েটারই বা কি দোষ? সেও যে আরেক পোড়াকপালি, নইলে বাপের বয়সী একটা লোকের সাথে কি এমন মেয়ের বিয়ে হয়? কি ছিলো না এই মেয়ের মাঝে? রুপে গুনে অনন্য।
– শিহাব! একটা কথা কই বাপ?
– বলো মা। তোমার কি আমার অনুমতির প্রয়োজন আছে?
– তুই যাইস না। আমার কথা মান। বিয়া কইরা নে। দেখবি তারে ভুইলা গেছস।
– আমার মায়াবতীর জায়গা কেউ দখল করতে পারবে না মা। আমার হৃদয়ের সিংহাসন অনেক আগেই আমি তার নামে করে দিয়েছি। সেখানে অন্য কারোর বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ আমি মানতে পারবো না। এ যে আমার মায়াবতীর সাথে অন্যায় করা হবে।
– ওর মনে তো ঠিকই অন্যকেউ আছে।
– থাকুক। সে তো আর আমায় কথা দেয়নি তার মনের জায়গাটুকু শুধুই আমার।
– এমনে কইস না বাপ। দেখ কিছু মাইয়ার ছবি আনছি। অনেক সুন্দর। ওই মাইয়ার চেয়ে কম না। তোর নির্ঘাৎ পছন্দ হইবো। তুই খালি একবার দেখ।
শিহাব মুচকি হাসলো। কিছু বললো না, ছবিগুলোও দেখলো না। শিহাব জানেনা ভালোবাসা কি? কিন্তু শিহাবের কাছে ভালোবাসা মানেই স্বর্ণলতা, বিরহ মানেই স্বর্ণলতা, অপেক্ষা মানেই স্বর্ণলতা, কান্না মানেও শুধুই শিহাবের স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতাই তার ভিতরের সর্বস্ব দখল নিয়েছে, হৃদয় থেকে প্রতিফোটা ভালোবাসা শুষে নিয়েছে কিন্তু হৃদয়ের সেই খরার জমিনে সে ভালোবাসার ফসল ফলায়নি। অন্যায় করেছে স্বর্ণলতা, ঘোর অন্যায় করেছে কিন্তু এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাধ্য শিহাবের নেই। জমিদার গিন্নি নিশ্চয়ই অনেক বেছে বেছে শিহাবের জন্য মেয়ে দেখেছেন কিন্তু ওনাকে কে বোঝাবে শিহাবের মনের দখল অনেক আগেই শিহাব অন্য কারোর নামে করে দিয়েছে। চাইলেও শিহাব অন্য কাউকে আর সে জায়গা দিতে পারবে না। শিহাবের চিৎকার করে পুরো দুনিয়াকে বলতে ইচ্ছে করছে,
ভালোবাসি আমি যারে ও যারে,
এই জনমে আমি পাই যেনো শুধুই তারে।
যদি তারে না পাই,
এই দুনিয়ায় আমার আর কাউরে চাওয়ার নাই।
★
জমিদার গিন্নির কথা না মেনে রাতেই গ্রাম থেকে শহরে ফিরেছে শিহাব। সম্পূর্ণ রাস্তাতেই সে অনুভব করেছে তার স্বর্ণলতাকে। কি যাদু করলো কে জানে, শিহাবের নিজেকে বিরহে জর্জরিত কবি বলে মনে হয়। ভালোবাসায় ব্যর্থ এক কবি! শিহাবের অবশ্য আফসোস হয় না। থাক না কিছু ভালোবাসা গোপনে। সব ভালোবাসা কি প্রকাশ করতে হয়? চারুলতা কখনো জানবেও না শিহাবের তার প্রতি এ অদম্য ভালোবাসা। যদিও বা কখনো জানে তাও বোধহয় শিহাব হারিয়ে গেলো সে তাকে খুজবে না। এক মূহুর্তের জন্যেও শূন্যতা অনুভব করবেনা কিন্তু শিহাবের সর্বশ্ব সে দখল করেই নিয়েছে। শিহাব স্থির করলো, কাল সে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং সম্পন্ন করবে কিন্তু এও খেয়াল করলো সেই মিটিং-এ অংশ নেওয়ার মতো ভালো কোনো জামাকাপড় তার নেই। শিহাব বেড়িয়ে পড়লো নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। কিছু কেনাকাটা করার প্রয়োজন আছে।
★★★
– এইটা কোথায় নিয়ে এলেন? দেখে তো কাজি অফিস বলে মনে হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে কোনো সপিং মল।
– ঠিকই ধরেছেন।
– আমরা সপিং মলে কেনো এসেছি?
– বিয়ের সপিং করবেন না?
– প্রয়োজন নেই।
– প্রয়োজন আছে চারুলতা। বিয়ে তো দু একদিনের ব্যাপার না, সারাজীবনের ব্যাপার। ছোট্ট ছোট্ট কিছু স্মৃতি থাকা প্রয়োজন।
– এমন হঠাৎ বিয়েই সবচেয়ে বড় স্মৃতি। অতিরিক্ত স্মৃতির প্রয়োজন নেই।
– আচ্ছা বেশি কিছু কিনবো না। নিউ মার্কেটে আমার একজন পরিচিত বিক্রেতা আছে৷ তার কাছ থেকে শুধু একটা শাড়ি কিনবো। হামিদ তুমি বলো না।
– আমার কথা ও শুনে কোনদিন যে আইজ শুনবো?(হামিদ)
– আচ্ছা ঠিক আছে চলুন তবে মনে থাকে যেনো বেশি সময় যেনো না লাগে। (চারু)
– ঠিক আছে বেশি সময় নেবো না।
তিনজনই প্রবেশ করলো মার্কেটের ভিতর। সাজিদের ইচ্ছে পরিচিত সে দোকান থেকে দ্রুত একটা শাড়ি কিনে কিছু প্রসাধনী কিনে নেওয়া তাই সাজিদ সরাসরি সে দোকানের কাছে চলে গেলো যার পাশের দোকানেই শিহাব তার মায়ের জন্য একটা শাড়ি দেখছিলো। কাতান শাড়িতে বেশ সুন্দর ও মায়াময়ী লাগে জমিদার গিন্নিকে। শিহাব খুব পছন্দ করে মায়ের এমন মমতাময়ী রূপ। শাড়িটি দেখে কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো শাড়িটা তার মায়েরই জন্য তৈরি করা হয়েছে তাই শিহাব কোনো চিন্তাভাবনা না করেই শাড়িটি কেনার উদ্দেশ্যে দোকানটিতে যায়।
সাজিদ চারুর জন্য দেখছে লাল রঙের জামদানি শাড়ি। জামদানি শাড়িতে সে আরও একবার চারুকে দেখেছে তাই জামদানি শাড়ি কিনবে বলেই মনস্থির করলো। লাল শাড়িতে সত্যিই চারুকে অসম্ভব মানায়, অবশ্য চারুকে সবকিছুতেই মানাবে বলে সাজিদের ধারণা।
– আপনার কোন রঙ পছন্দ চারুলতা?
– আমার পছন্দের কোনো রঙ নেই। আমার জীবনটাই যেখানে বিবর্ণ সেখানে আবার পছন্দের রঙ!
– কোন শাড়িটি পছন্দ হয় দেখুন। যেটা পছন্দ হয় সেটাই কিনবো।
– আমার কোনো পছন্দ নেই সাজিদ। আপনার যা ভালো লাগে তাই কিনুন।
সাজিদ অসহায় দৃষ্টিতে হামিদের দিকে তাকালো। এমন দৃষ্টির অর্থ বোধহয় হামিদের কাছে সাহায্য চাওয়া।
– আমরা দুজন মিলাই পছন্দ করি। আমার চারুরে সবকিছুতেই মানাইবো। (হামিদ)
– হ্যাঁ সেটাই ঠিক হবে। দেখো তো লালটা ভালো হবে নাকি গোলাপি টা।
– বিয়ার জন্য হইলে লালটাই সুন্দর।
শিহাব মাত্রই শাড়িটি কিনেছে কিন্তু তখনই শিহাবের ফোনে একটি কল এলো। শিহাবের বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। কথাটা শুনে এক মুহুর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। কোনোমতে তড়িঘড়ি করে বের হতে চাইলো সেখান থেকে তখনই অনিচ্ছাকৃত ধাক্কা লাগলো এক মেয়ের গায়ে। শিহাবের মাথা সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে। তার মাথায় কিছুই আসছেনা সে মেয়েটার চেহারা না দেখেই কোনোমতে দুঃখিত বলে সেখান থেকে সরে আসে।
সাজিদ আর হামিদ মিলে শাড়ি কিনছে বেশ দেখেশুনে। চারুর বেশ দমবন্ধ লাগছিলো দোকানের ভিতর তাই সে বেড়িয়ে এলো কিন্তু দোকান থেকে বের হতে না হতেই কারোর সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে কলেজ ব্যাগটা মাটির পড়ে গেলো। ছেলেটাকে কিছু বলার আগেই সে কোনোমতে দুঃখিত বলে সেখান থেকে সরে যায়। চারু বুঝতে পারলো আসলেই ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিলো না, তাড়াহুড়োয় ছেলেটা খেয়াল করেনি৷ চারুকে দোকান থেকে বের হতে দেখে তৎক্ষনাৎ হামিদও বেড়িয়ে আসে। সে না বলে বের হওয়ার কারণে একপ্রকার ধমক দিয়েই চারুকে আবার দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলো।
কিছুটা দূরে গিয়ে হঠাৎই থমকে গেলো শিহাব। কেনো যেনো মনে হলো ধাক্কা খাওয়া মেয়েটির সাথে সে পূর্বপরিচিত। মেয়েটির শরীর থেকে অদ্ভুত এক সুগন্ধি বেড়িয়ে আসছিলো যা শিহাব পেতো চার বছর আগে নিজের স্বর্ণলতার শরীরে। নাহ! শিহাবের ভুল হয়নি, সে নিশ্চিত এইটা স্বর্ণলতার গায়েরই গন্ধ ছিলো। শিহাব পেছনে ফিরে তাকালো কিন্তু সেখানে দেখা গেলো না কাউকেই। শিহাব আরেকটু এগিয়ে এদিক সেদিক খুজতে শুরু করলো কিন্তু এরই মাঝে দ্বিতীয় বার কল এলো শিহাবের ফোনে। জমিদার সাহেবের রক্ত প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। ও নেগেটিভ রক্তের গ্রুপে এখন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছেনা কিন্তু শিহাবের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। তাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে বলা হলো নইলে বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। আঘা*ত গভীর, মৃ*ত্যুর আশংকা অবধি রয়েছে। শিহাবও হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলো মার্কেট থেকে আর এরই সাথে সে দ্বিতীয় বারের মতো হারিয়ে ফেললো নিজের স্বর্ণলতাকে। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে কিন্তু এত কিছুর ভীড়ে এই শূন্যতার কারণ খোজার বিশেষ সময় পেলো না শিহাব।
★★★
তিন কবুল পড়ার মাধ্যমে সাজিদকে নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলো চারুলতা। সাজিদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা সত্যিই চারুলতার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তবে চারুর মধ্যে কোনো রকম অনুভূতি দেখা যাচ্ছেনা। এমন একটা ভাব যেনো সব স্বাভাবিক। সিঁদুররাঙা জামদানি শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে চারু৷ মুখমন্ডলে প্রসাধনীর লেশমাত্র নেই তাও অপূর্ব স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। সাজিদ কাজিকে তার সম্মানি দিতে গিয়েছে। চারু আর হামিদ দাঁড়িয়ে আছে কাজি অফিসের বাইরে,
– আমরা কি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম চারু?
– জানিনা।
– যদি ভুল হয়?
– আমার সাথে যা খারাপ হয়েছে তারচেয়ে বেশি খারাপ হওয়ার আছে বলে আমি মনে করিনা। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে সাজিদ ও নাজমা বেগম কোনো না কোনোভাবে বসের সাথে সম্পর্কিত।
– মানে? তাইলে তুই সাজিদরে বিয়া করলি ক্যান?
হামিদ অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে কথাটা বললেও চারু খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো।
– বসের সাথে সম্পর্কিত মানে এই নয় তারা বসের দলে। আমার মনে হচ্ছে তাদের পরিবারটির সাথে কোনো না কোনোভাবে বস নামক সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিটির যোগসূত্র রয়েছে। আমার রহস্যের জট খোলার আগে এই পরিবারের রহস্য জানা প্রয়োজন।
– তারাও যদি খারাপ হয়?
– আমি মানষিক ভাবে প্রস্তুত। এখন আমি সব ধরনের ঘটনা সামলাতে পারবো। সহজে ভেঙে পড়বোনা আমি। আজ যেই চারুলতাকে তোমরা দেখছো তাকে অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি আমি। আমি এমনই এক চারুলতা যার ভিতরে হাজার ঝড় বয়ে গেলেও মুখে তার ছিটেফোঁটা অবধি প্রকাশ পাবেনা।
– আমি তাইলে ঠিকই ধরছিলাম। তুই অনুভূতিহীন না। তুই শুধু অনুভূতি গুলা লুকায়া রাখিস।
চারু কিছু না বলে মুচকি হেসে আকাশ পানে চাইলো। জীবনের এক নতুন মোর শুরু হয়েছে চারুর। কে জানে এই জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? তবে চারুর ভয় লাগছেনা, এই জীবন থেকে তার যেমন কিছু চাওয়ার নেই তেমনি কিছু হারানোরও নেই।
– চারু!
– হুম।
– সাজিদরে দেইখা মনে হইলো সে আসলেই তোরে চায় কিন্তু তুই খুব সহজেই তার প্রস্তাবে রাজি হইলি। দুনিয়ায় সহজের মূল্য নাই। সাজিদ যদি তোরে সহজে পাইছে ভাইবা অবহেলা করে?
– অবহেলা অনেক পেয়েছি। এই অবহেলার ভয়ে আমি নিজের লক্ষ্য থেকে সরতে পারিনা। তাছাড়া সাজিদ আমাকে অবহেলা করলে যে আমার কষ্ট হবে এমনটাও না। যদি আমি তাকে ভালোবাসতাম তাহলে বোধহয় কষ্ট হতো, যেহেতু ভালোবাসি না তাই কষ্ট হওয়ারও সুযোগ নেই।
– তুই নিশ্চিত ওরা বসের সাথে সম্পর্কিত?
– না। আমি শুধু অনুমান করছি।
– অনুমানের উপর ভিত্তি কইরা এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কি উচিত হইলো?
– শুধু অনুমান না। আমি অনেকাংশে নিশ্চিত তবে পুরো নিশ্চিত না। সবচেয়ে বেশি ঘাপলা আছে নাজমা বেগমের মাঝে। ভদ্রমহিলা আমাকে দেখলে একটু বেশিই ভালোবাসা দেখান। কথায় আছে না, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ” ব্যাপারটা ঠিক তেমনি। বসের সাথে সম্পর্ক থাক বা না থাক আমি নিশ্চিত নাজমা বেগম সুবিধার না।
– সাবধানে থাকিস চারু। তোরে নিয়া আমার চিন্তার শেষ নাই।
– হুম, চিন্তার চিন্তায় তোমার পেটের ভুড়িটাও কমে গেছে।
হামিদ একবার নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে চারুর দিকে তাকালো। চারু এখনো মুচকি হাসছে। প্রশান্তিকর দৃশ্য! এই দৃশ্য সামান্য থাকলে অন্তত চারুকে বকা যায়না। হামিদ মনে প্রানে চায় চারু ভালো থাকুক। সাজিদের সাথে বিয়ে তো হয়ে গেলো, এই বিয়ে কি চারুকে ভালোবাসার দিশা দিয়ে সুন্দর একটি জীবন উপহার দেবে নাকি চারুর অন্ধকার জীবনটা আরো বেশি অন্ধকারে ঠেলে দেবে? নাহ! চারুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। সব খবরাখবর রাখতে হবে। চারুকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে হামিদ নারাজ। কিছুক্ষন পরেই সাজিদ ফিরে এলো। ভাগ্য ভালো সাজিদের কাছে সবসময়ই নিজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকে তাই কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা মিটে গেছে।
– হামিদ তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি সত্যিই আমাকে আজ অনেক হেল্প করেছো।
– ধন্যবাদ লাগবো না আপনে শুধু আমার চারুরে দেইখা রাইখেন। আমার মা গত হওনের আগে ওর দায়িত্ব আমারে দিয়া গেছে। আমি পুরাপুরি পালন করতে পারি নাই। পারলে ওর জীবনটা অনেক সুন্দর হইতো। আপনের কাছে অনুরোধ যেইটা আমি পারি নাই সেটা আপনি কইরেন। আপনে হয়তো ওরে অনুভূতি শূন্য ভাবতে পারেন কিন্তু ওরে একটু ভালোবাসা দিয়েন দেখবেন ও নিজের সব ভালোবাসা আপনারারেই দিবো। ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব তার।
– তুমি চিন্তা করো না হামিদ। তোমার বোনের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার। আজ আমি যেই হাত ধরেছি, জীবন শেষ দিন অবধি সুখে, দুঃখে আমি এই হাত ধরে রাখবো। নিজের সবটা দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা করবো চারুলতাকে।
– আপনি খুবই অদ্ভুত সাজিদ। আমাকে আপনি সম্মোধন করেন আর আমার বড় ভাইকে তুমি।
– আপনারা দুজনেই আমার অনেক ছোট তবে হামিদের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব আছে। তাকে সহজেই তুমি সম্মোধন করা যায় আর আপনার চেহারায় এক ধরনের গম্ভীর্য আছে যা আপনার বয়সটা আড়াল করে আপনাকে অনেক বেশি ম্যাচুয়র দেখায়।
– আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার ভাই ইতিমধ্যেই এক বাচ্চার বাবা হয়ে গেছে।
সাজিদ এবং হামিদ দুজনেই মুচকি হাসলো। হাসির আড়ালেই চাপা পড়ে গেলো আরো অনেকগুলো প্রশ্ন। চারুলতার ভিতর থেকে অনিচ্ছাকৃত একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অপ্রাপ্তির খাতায় আরো একটা কিছু যোগ হলো। কি যেনো একটা পাওয়া হলো না। সেই অপ্রাপ্তির নাম কি শিহাব? এই অযাচিত প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারলো না চারুলতা নিজেও।
★★★
বধু বেশে চারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন নাজমা বেগম। আরও বেশি অবাক হলেন সাজিদকে পাশে দেখে। চারুলতা নাজমা বেগমের পা ছুয়ে সালাম করতেই তিনি হালকা বাধা দিলেন।
– এইসব কি মা? তোমার এই সাজপোশাক কেনো?
– মা আমি আর চারুলতা আজ বিয়ে করেছি।
নাজমা বেগম অবাক হলেও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।
– বিয়ে করেছিস? কখন? আমাকে জানালি না কেনো?
– আমরা দুজনেই এডাল্ট আন্টি। আমাদের অভিভাবক প্রয়োজন নেই।
নাজমা বেগমের মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেলো, সাজিদও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। সে ভাবতেও পারেনি চারু এমন একটা জবাব দেবে। চারু মূলত নাজমা বেগমকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইছে। তার আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
– এসো তোমরা ভেতরে এসো।
দুজনেই ভেতরে প্রবেশ করলো। চারু সোফায় বসলেও সাজিদ নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। কাগজপত্র গুলো আগে ভালো করে রাখা প্রয়োজন।
– তুমি কি আমার উপর কোনো কারণে রেগে আছো মা?
– না তো। রাগ করবো কেনো?
– না মানে আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করলে এর জন্য জিজ্ঞেস করলাম।
– না আন্টি আসলে হঠাৎ করেই,,
– থাক মা বলতে হবেনা। বিয়ে করে নিয়েছো ভালো কথা। আমিও চাইতাম তোমাকে আমার ছেলের বউ করবো। কি যে খুশি লাগছে আমার, তোমাকে বোঝাতে পারবো না মা।
নাজমা বেগমের খুশিটা স্পষ্ট। তিনি সত্যিই খুশি হয়েছেন। কোনো বায়োনাট কথা বা খুশি তিনি প্রকাশ করছেন না কিন্তু খুশি হওয়াটাই অস্বাভাবিক লাগছে চারুর কাছে। তিনি কেনো খুশি হবেন? না জানিয়ে বিয়ে করার কারণে একটু হলেও তো মন কষাকষি হওয়ার কথা।
★
দুপুর বেলা চারুর সকল জিনিসপত্র ছাদের সেই ঘরটার থেকে সাজিদের ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। মাঝে মাঝে দু একজন প্রতিবেশী এসে দেখে যাচ্ছেন চারুকে। মোটামুটি সকলেই প্রসংশা করছে চারুর। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার চারু যে এখানে এতদিন যাবত আছে তা তারা কেউই জানতো না। নাজমা বেগমও সবাইকে বলেছেন তিনি নিজেই সাজিদকে বিয়ে করিয়ে চারুকে ঘরে তুলেছেন। চারুও মোটামুটি হাসি মুখেই সকলের সাথে কথা বললো। সারাদিন ক্লান্তি শেষে চারু ঘরে যাওয়ার সুযোগ পেলো। ক্লান্তিতে শরীর অবসাদ হয়ে আসছে। শরীরে বিন্দুমাত্র জোর পাওয়া যাচ্ছেনা তার উপর আজ থেকে অন্য আরেকজনের ঘরে থাকতে হবে তাকে। অন্য আরেকজন পুরুষের সাথে থাকতে হবে। জামাল হোসেনের কথা মনে আসতেই ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে এলো চারুর। সাজিদও কি এমন ব্যবহার করবে? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। যা কিছুই হতে পারে। চারু লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই সাজিদকে দেখা গেলো। কিছু ফাইল নিয়ে কাজ করছে সে। চারুর সাথে চোখাচোখি হতেই একটু মুচকি হাসলো তবে চারু হাসলো না। অকারণ হাসা পাগলের লক্ষণ।
– রাতে কিছু খেয়েছেন চারুলতা?
– খেতে ইচ্ছে করছিলো না।
– অনেক সময় ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। সারাদিন নিশ্চয়ই সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আপনি তো আবার হাসতে পছন্দ করেন না।
কথাটা বলে হাসলো সাজিদ নিজেই তবে চারু হাসলো না। সাজিদ একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে এলো তবে চারুর কেনো যেনো খেতে ইচ্ছে হলো না।
– খেয়ে নিন চারুলতা।
– বিশ্বাস করুন আমার সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছেনা।
– ওইযে বললাম অনেকসময় ইচ্ছের বাইরেও অনেক কিছু করতে হয়। আমার কিন্তু অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো বউয়ের হাতে খাবার খাওয়া। এই আশায় আমিও আজ রাতে খাইনি।
– কেনো, আপনার প্রাক্তন স্ত্রী কি আপনার সেই আশা পূরণ করেনি?
সাজিদ কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। চারুর এমন উত্তর সে আশা করেনি।
– সায়মার কাছে এইসব ন্যাকামি মনে হতো চারুলতা। তার কাছে এসবের জন্য সময় ছিলোনা। আজকে আমাদের দিনে তার কথা না টানি?
– হুম। তবে আপনার আশা রাখতে আপনাকে খায়িয়ে দিতেই পারি তবে আমি খাবো না।
– আমার জন্য নাহয় আজকে একটু কষ্ট করলেন।
চারুলতা কথা না বাড়িয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে বসলো।
– আপনার নিজের স্বামীকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন ছিলো না চারুলতা?
– স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার আগেই আমার বিয়ে হয় আর বিয়ের পর তার জঘন্য রূপ দেখে আর স্বপ্ন দেখাটা হয়ে ওঠেনি।
– দেখতে ইচ্ছে হয়না?
– সত্যি বলতে হয়না তবে ছোট বেলায় আমি নৌকায় চড়তে খুব ভালোবাসতাম। আমার ভাই সবসময় নৌকায় চড়লেও আমাকে কখনো নেয়নি। তখন মা বলতো আমার স্বামী নাকি আমাকে নিয়ে নদীতে জোৎস্না বিলাস করবে। এই শব্দটা আমার কাছে নতুন ছিলো তাই ভাবতাম সে আমাকে নিয়ে রাতের বেলায় নৌকায় উঠবে। অনেকদিন পর্যন্তই এ ইচ্ছে ছিলো আমার। অবশ্য অন্যান্য ইচ্ছের মতো এই ইচ্ছেও মরে গেছে অনেক আগেই।
– জোৎস্না বিলাস করবেন চারুলতা?
– আমার জানামতে ঢাকা শহরে এই মস্ত বড় বড় বিল্ডিংয়ের মাঝে জোৎস্না বিলাস হয়না।
– কে বলেছে হয়না? করলেই হয়। চলুন খাওয়া শেষ করে জোৎস্না বিলাস করবো।
চারুলতা কথা বাড়ালো না। খাওয়া শেষ হতেই সাজিদ চারুকে নিয়ে গেলো ট্যারেসে। সৌভাগ্যক্রমে আজ পূর্ণিমা। পূর্ণ চন্দ্র নিজের আলো ছড়িয়ে চারদিক মোহময়ী মায়ায় আবৃত করে দিয়েছে। চাঁদের নরম আলোয় ঢাকার এই মস্ত বড় বিল্ডিং গুলোও সুন্দর লাগছে। আসলেই কিছু জিনিস সবসময়ই আশেপাশের সবকিছুকে মায়াময়ী করতে সক্ষম। আকাশের চাঁদ পরিবেশকে মায়াময়ী রূপ দান করছে আর সেটার দিকে তাকিয়ে থাকা চারু মুগ্ধ করছে সাজিদকে। এই মেয়েটা সত্যিই অনন্যসাধারণ। হাজারো খারাপ কাজ করার পরেও হয়তো মেয়েটার প্রতি কেউ ঘৃণার অনুভব আনতে পারবেনা। এমন মায়াবী চেহারা কি আদেও ঘৃণা করা যায়?
– একটা কথা বলি চারুলতা?
– বলুন।
– বললে বিশ্বাস করবেন?
– বিশ্বাস করার মতো হলে করবো।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি চারুলতা। বিশ্বাস করেছেন?
– পুরোপুরি করতে পারছিনা। সে যোগ্যতা কি আদেও আমার আছে।
– আপনি নিজেও জানেন না আপনার মাঝে ঠিক কি আছে। হাজারো অস্বস্থির ভীড়ে এক টুকরো প্রশান্তি আপনি। আপনাকে হাজার বার ভালোবাসি বললেও আমি ক্লান্ত হবো না চারুলতা।
– গুছিয়ে কথা বলতে জানেন আপনি।
– আপনার চেয়ে বেশি সম্ভবত নয়।
– আমাকে ভালোবাসা সহজ না সাজিদ।
– আমি যে সেই কঠিন কাজ করে দেখিয়েছি চারুলতা। শেষ পর্যন্ত আপনার হাত ধরে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। আমার ভালোবাসা দ্বারা আপনার জীবনের বিষাদময় কাটাগুলো আমি দূর করে দেবোই চারুলতা।
– মিথ্যা আশা দেবেন না সাজিদ। আমি যে ভালোবাসা প্রচণ্ড ভয় পাই।
– আমি জানি না আপনার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি তবে আমি আপনাকে আমার সকল ভালোবাসা দিতে চাই। আমার ভালোবাসায় বিলীন হয়েই নাহয় আপনি ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা দেবেন।
চারু কোনো উত্তর দেয়না। দিতে ইচ্ছে হয়না। আসলেই চারুর বাঁচতে ইচ্ছে হয়। খুব করে বাঁচতে ইচ্ছে হয় কিন্তু বাঁচার জন্য তার কোনো কারণ নেই। আজ খুব করে ইচ্ছে করছে কারোর জন্য বাঁচতে।
– চারুলতা!
– হুম।
– আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি।
– পারেন।
সাজিদের ধারণা ছিলো চারু লজ্জায় মুখ লুকাবে কিন্তু এমন কিছুই হলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুমতি দিলো সে। অবশ্য সাজিদের আগেই ভাবা উচিত ছিলো সে অন্য কোনো মেয়ে নয় বরং চারুর সাথে আছে৷ এই মেয়ে তো ভিন্ন হবেই। সাজিদ এক হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো চারুকে। কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে সে কিন্তু চারুর মাঝে এমন কিছুই লক্ষণীয় নয়। সাজিদ ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলো চারুর। চারু বাধা দিলো না। চারুর বাধা না পেয়ে আরো একটু কাছাকাছি সে চলে গেলো। নিজের অধোর জোড়ার স্পর্শ দিলো চারুর কাধে। চারুর কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার জানা নেই কিন্তু নিজের ভিতর অন্য এক সাজিদকে অনুভব করছে সে। সেই সাজিদ খুব করে কাছে পেতে চায় তার কাছে বসে থাকা রমণীকে যার সাথে আজই সে আবদ্ধ হয়েছে এক পবিত্র বন্ধনে। কাধ ছাড়িয়ে সেই অধর জোড়া নেমে পৌছালো গলাতে। একের পর এক এলোমেলো স্পর্শ দিয়ে চললো সেখানে। নিজের অজান্তেই তার একহাত শাড়ির ভিতর দিয়ে জাপটে ধরলো চারুর কোমড়ে। আরেক হাতে মাথার পেছনে যেখান থেকে সে কাছাকাছি আনতে চাইছে অপরূপ সুন্দরীর এলোমেলো কেশ। নিজেকে মিশিয়ে নিতে চাইছে তার সাথে। ধীরে ধীরে দুই জোড়া অধর মিলিত হলো পরষ্পরের সাথে। সাজিদ এলোমেলোভাবে চারুকে চাইলেও চারু কেমন যেনো নিশ্চুপ। সে আবারও গভীর আবেগ নিয়ে অধর ছোয়ালো আরেকজোড়া অধরে। গভীর আবেগে প্রকাশ করতে চাইছে নিজ আকাঙ্ক্ষা কিন্তু পরক্ষনেই থেমে গেলো অপরদিকের নিশ্চলতা দেখে।
– কি হলো চারুলতা?
– কি?
– আপনি রেসপন্স করছেন না কেনো? আপনি কি আমাকে চান না?
– আমি কিছু অনুভব করতে পারছিনা সাজিদ।
মুহূর্তের মাঝেই এক ধাক্কা খেলো সাজিদ। মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,
– আপনি আমাকে ভালোবাসেন না চারুলতা। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।
– হুম বাসি না।
– তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করলেন?
– আগেই তো বলেছিলাম আমাকে ভালোবাসা ওত সহজ নয়। তবে আপনাকে আপনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবোনা সাজিদ। আপনি নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে পারেন। আমি বাধা দেবোনা।
– আমি আপনার দেহের দখল নয়, মনের দখল চাই। দেহের দখল তো সবাই নিতে পারে। মনের দখল না নেওয়া অবধি নাহয় আমি অপেক্ষা করলাম।
– করতে পারবেন?
– আমি জামাল হোসেন নই যে আমার কাছে শরীরই সব। আমি সাজিদ৷ আমি আপনাকে চাই চারুলতা। সম্পূর্ণ আপনিটাকেই আমার চাই।
– আমিটাকে পাওয়া যে এত সহজ না। এত অপেক্ষা সহ্য হবে তো?
– আমি অপেক্ষার বিষ পান করতে চাই চারুলতা। আমার আপনিটাকেই চাই। পুরোটা চাই।
– দেখা যাক!
– চারুলতা!
– হুম।
– আপনার শরীরে মোহনীয় বেলি ফুলের সুভাষ ভেসে আসে কেনো? আমি কি আপনাকে বেলি ফুল বলে ডাকতে পারি?
চারুর ভিতরটা হঠাৎই কেমন করে উঠলো। মস্তিষ্কের এক কোণে নাড়া দিলো ছোট্ট এক স্মৃতি, ছোট্ট এক অনুমতি বাক্য, “আমি কি তোমাকে স্বর্ণলতা বলে ডাকতে পারি?” চারুর জানা নেই হঠাৎই কেনো তার এ কথাটি মনে পড়ে গেলো। চারু অত্যন্ত সুকৌশলে নিজেকে সামলে নিলো। নাহ! শিহাবকে ভাববেনা সে। সে এখন অন্য কারো স্ত্রী। শিহাবকে ভাবা তার শোভা দেয়না। শিহাবকে সে স্বর্ণলতা ডাকার অনুমতি দেয়নি কিন্তু সাজিদকে দেবে। সাজিদই এর আসল হকদার।
– হুম ডাকতে পারেন।
সাজিদের ঠোঁটে ভালোবাসাময় প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
#শুভ্রা_আহমেদ_প্রিয়া
To Be Continued…
®শুভ্রা আহমেদ প্রিয়া