#কৃষ্ণডাহুক – ০৩
আয়ানা আরা (ছদ্মনাম)
অস্বস্তি কাকে বলে তা আজ মীরা ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছে৷ তাকে ভিতরে যেতে বলে সবাই-ই চলে গিয়েছে! তবে কেউ তাকে সাথে করে নিয়ে গেলো না কেনো? যদি এইভাবে একাই ফেলে যেতো তবে আসতে বলেছিলো কেনো? আদ্রিকার উপর কিঞ্চিৎ অভিমান জমলো মীরার। গৃহে প্রবেশ করবে নাকি না ভেবে শেষ অব্দি গৃহের মাটিতে পা রাখলো। শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো মীরার৷ এখন থেকে সেও এখানেই থাকবে! এইখানে সে নিজের নতুন জীবনের সূচনা করবে! প্রয়োজন জিনিস কিনতে হবে মীরার তবে টাকা? তপ্তশ্বাস ফেললো মীরা। বড় বড় মুখ করে ভাড়ার কথা ঠিকই বলে দিয়েছে তবে এখন সে টাকা পাবে কোথায়? না আছে চাকরি আর না আছে সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা। শূন্য হাতে এখন সে কি করবে ভেবে কূল পাচ্ছে না।
বাড়িতে প্রবেশ করার পর মীরা লক্ষ্য করলো বাড়িটি বাহির থেকে যতটা আকর্ষণীয় ভিতর থেকে তার চেয়েও বেশ আকর্ষণীয়, পরিপাটি ও মনোমুগ্ধকর। মীরা প্রথমে ভেবেছিলো ভিতর দিক থেকে সাধারণ ডুপ্লেক্স বাড়ির মতো হবে! তবে না, এটি ভিতর থেকে কয়েকটা ফ্ল্যাটের মতো বিভক্ত। মীরা বুঝতে পারলো না কোথায় যাবে। কি করবে? তখনই হন্তদন্ত করে সিঁড়ি থেকে নেমে এলো আদ্রিকা। ভাব ভঙ্গিতে তার চিন্তিত। মীরার সন্নিকটে এসে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,’ আমাকে ক্ষমা করে দিও মীরা৷ আমার ভাই এতোদিন পরে দেশে ফিরেছে, তাই একটু বেশিই উত্তেজিত ছিলাম। তোমাকে সাথে করে নিতে পারি নি তবে আমার বন্ধুদের তো বলেছিলাম তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসতে! ‘
পরমূহুর্তে তেজপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে ঝাঁঝমিশ্রিত গলায় বলে,’ ফাজিলগুলো জেনে বুঝে তোমাকে একা রেখে দিয়ছে! সবকটাকে আজ উচিত শিক্ষা দিবো। ‘
মীরা মিহি হাসলো। আদ্রিকার মীরার হাত শক্ত করে বলল,’ এইখানের কর্ণারের ফ্ল্যাটটা বাদে সবগুলোতেই ভাড়াটিয়া থাকে। এর উপরে আমাদের বাসা। আমাদের পরিবারটা অনেক বড়, যৌথ পরিবার যাকে বলে। ‘
মীরা নিশ্চুপ থেকে শুনে গেলো আদ্রিকার প্রতিটা কথা। আদ্রিকা হাত ধরে তাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলো। মীরা অবাক হয়ে বাসাটা দেখতে লাগলো! এমন সুষ্ঠুভাবে বাসা বানানোর পরিকল্পনা সবার মাথায় আসে না। মীরা বাড়িটা দেখে মুগ্ধ হলো। সবকিছু পরিপাটি করে রাখা। এইটা ফ্ল্যাট হলেও, বেশ বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে। দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই হল রুম পরে। সবাইকে সোফায় বসে গল্প করতে দেখে মীরা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। তার হাত পা কাঁপছে মানুষগুলোকে দেখে! হয়তো নতুন পরিবেশের আসার জন্য তার মধ্যে ভয় কাজ করছে! হ্যাঁ তাই হবে হয়তো। মীরা শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিকার দিকে তাকালো। সে হাসি মুখে মীরাকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলো। সবার নজর প্রথমে মীরার দিকে না পরলেও যখন পড়লো সবার চোয়াল হা হয়ে গেলো মীরাকে দেখে। সেটা মীরার বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আদ্রিকার পানে নজর দিলো। আদ্রিকা তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ভয় না পাওয়ার জন্য আশ্বাস দিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,’ তোমরা এইভাবে তাকিয়ে আছো কেনো আমার দিকে? ‘
এক মাঝ বয়সী মহিলা গম্ভির স্বরে বলে উঠেন,’ ও কে আদ্রিকা? ‘
‘ মীরা? ‘ মীরার দিকে ইশারা করে বলল আদ্রিকা।
‘ আমি ওর নাম জানি না। কে ও? ‘
আদ্রিকা কোনো ভাব ভাবান্তর ছাড়া জবাব দিলো,’ ও তো আমার এক অনলাইন বান্ধুবি। ও পড়ালেখার জন্য ঢাকায় এসেছে। এইখানে ওর থাকার জন্য কেউ নেই। তাই আমি বলেছি আমার বাসায় থাকতে। ‘
মূহুর্তেই মাঝবয়সী মহিলার মুখশ্রী থেকে গম্ভির ভাবটা উবে গেলো। হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললেন,’ ওহ! তাই বলো। ভাবছিলাম তুমি কাকে না কাকে নিয়ে এসেছো। ‘
বলেই মীরার দিকে এক পলক তাকালেন। অপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলেন,’ তোমার নাম মীরা? ‘
মীরা জোরপূর্বক হাসলো, নাজুক স্বরে বলল,’ জ্বী। ‘
মহিলা মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন,’ মাশাল্লাহ! নামটার মতোই সুন্দর তুমি। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো, এসো এইখানে বসো তুমি। ‘
মীরা অপ্রস্তুত হাসলো মহিলার দিকে তাকিয়ে। তিনি মীরার হাত খপ করে ধরে সোফায় জোরপূর্বক বসিয়ে দিয়ে কাউকে আদেশের সুরে বললেন,’, সাহিদুন! জলদি সবার জন্য চা নিয়ে এসো। বাসায় মেহমান এসেছে তার জন্যও আরেক কাপ চা এনো। ‘
মীরা বুঝতে পারলো মহিলাটি বাড়ির সহায়তাকারীকে আদেশ করেছেন। নতজানু হয়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো তাকে পর্যবেক্ষণ করে কয়েকজোড়া অচেনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। নড়েচড়ে বসলো মীরা। মার্জিয়া বেগম অস্থির হয়ে বললেন,’ মীরা মা সমস্যা হয়েছে কোনো? ‘
মীরা চট জলদি দুপাশে মাথা নাড়িয়ে নত হলো। মার্জিয়া বেগম নিশ্চিন্তে রান্নাঘরে গেলেন।
তার যেতেই এক গম্ভির পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো মীরার কর্ণকুহরে! নিজের এই ছোট জীবনে সে প্রথমবার ইয়ামিনের কণ্ঠস্বরের প্রেমে পড়েছিলো! এই পুরুষটারও কণ্ঠস্বর কেনো ইয়ামিনের মতো? তার এই কালো অতীত কি তার পিছ ছাড়বে না কোনোদিন? মীরা আড়দৃষ্টিতে তাকালো পুরুষালি কণ্ঠের পুরুষটির দিকে। তিনি মীরার দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে।
‘ আদ্রিকা? তোর যে কোনো অনলাইন ফ্রেন্ডও আছে তা মাত্র জানলাম। ‘
মীরা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো! তবে কি সে এখন ধরা খেয়ে যাবে যে সে আদ্রিকার বান্ধুবি না! সত্য কখনো আড়াল হয় না। যতই মিথ্যা বলা হউক না কেনো সত্য একদিন না একদিন সবাই জানবেই! মীরার মনে কিঞ্চিৎ ভয় হানা দিলো! তারা যদি জানতে পারে সত্যটা তবে কি তারা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে? তখন সে যাবে কোথায়? মীরা ভীতু নয়নে আদ্রিকার দিকে তাকালো। আদ্রিকার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই সে সোজাসাপ্টা বলল,’ সবকিছু কি তোমাকে বলা যায় নাকি ভাইয়া? ‘
আদ্রিক থতমত খেলো। বিরক্ত হয়ে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বলে,’ আমি তোর বড় ভাই! আমাকে বলবি না তো কাকে বলবি? ‘
আদ্রিকা উপহাসের সুরে বলল,’ আচ্ছা মানলাম তবে মীরার ব্যাপারে জানার তোমার এতো কিউরিসিটি কেনো হু? সামথিং রং? ‘
আদ্রিকার কথায় আদ্রিক ও মীরা দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে। আদ্রিক ইতস্তত হয়ে উঠে দাঁড়ায়, কর্কশ গলায় বলে,’ ফাজিল! বড় ভাইয়ের সাথে কেউ উপহাস করে? ‘
আদ্রিকা উত্তর দিলো না। আদ্রিক ও এই প্রসঙ্গে কথা না বলে হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়। আদ্রিকের যেতেই আদ্রিকার চাচা বলে উঠেন,’ আদ্রিকের কথায় মাইন্ড করো না। ও না আসলে এমনই বেপোরয়া ধরণের। মনে নিও না, মীরামা। ‘
মীরার মনটা আনন্দে ভরে উঠে! এই বাড়িতে প্রবেশের পর থেকেই সকলে তাকে ‘মীরামা’ বলে চলেছে। মাতৃপিতৃহীন এক মেয়ের কাছে এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে যে তাকে কেউ ভালোবেসে, আদর করে মা ডাকছে! মীরা মুচকি হেসে বলল,’ মনে নেইনি আংকেল। ‘
আদ্রিকের চাচা হাসলেন! কিছুটা অভিমানি সুরে বললেন,’ আংকেল? এখন থেকে যেহেতু এই বাড়িতে থাকবে সেহেতু ওদের সবার মতোই আমাকে কিন্তু বাবা ডাকতে হবে নয়তো খুব রাগ করবো কিন্তু! ‘
মীরা চমৎকার হাসলো! আনন্দে চোখ উপচে জল গড়িয়ে পড়লো। সকলে বিষ্ময়পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো মীরার উপর। আদ্রিকের চাচা অনন্ত হুমায়ূন বললেন,’ এ কি! কাঁদছো কেনো, মীরামা? ‘
মীরা তড়িৎ নিজের চোখের পানি মুছে বলল,’ মা-বাবা না থাকায় এতো ভালোবেসে কেউ ডাকেনি আমায়। তাই খুশিতে কান্না পেলো। ‘
মীরার কথায় আরেকদফা অবাক হলো সবাই। অনন্ত হুমায়ূন মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’ আমাকে তুমি তোমার বাবার মতোই ভেবো, মীরামা! ‘
‘ কে এই মেয়ে? কোথাথেকে এসেছে? ‘
বলতে বলতেই নেমে এলেন এক ব্যক্তি। তার কণ্টস্বর অনুসরণ করে সকলে তার দিকে তাকালো! সকলের চেহেরা বিষ্ময়ে, কৌতুহলে হা হয়ে গেলো….
চলবে?