কে পর্ব-১১

0
1379

#কে!!
#১১তম_পর্ব

হঠাৎ একটা কাঠের হাতলে হাত লাগতেই খুলে যায় দরজাটা। দরজার ভেতরে ঢুকতেই একটা অন্ধকার গলি দেখতে পেলো। হাজারো কৌতুহল মনে মূহুর্তের মাঝে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। স্নিগ্ধ এর বাড়িটা বেশ বড় ও না আবার খুব ছোট ও না। এক তলা বাড়ি, উপরে ছাঁদ। এ বাড়িতে কোনো গুপ্ত রাস্তাও থাকতে পারে এটা কখনোই কল্পনা করে নি নীতি। অনেকটা খুফিয়া রাস্তা। মানুষের কৌতুহল পদে পদে বাড়ে, কোনো না জানা কিছু সামনে আসলেই সেটা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। যতক্ষণ রহস্য নিবারণ না হয় কৌতুহল কমে না। নীতির কৌতুহল হচ্ছে একটা সপ্তাহ এই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও এই রুমটার কথা সে জানতোই না। ধীর ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে নীতি। মিনিট পনেরো পরে একটা রুমে প্রবেশ করে সে। রুমটি বেশ অন্ধকার। খুব বাজে গন্ধ নাকে আসছে। যেনো অনেক ইদুর বা প্রানী মরে পড়ে আছে। মূহুর্তেই গা টা ঘুলিয়ে এলো নীতির। গন্ধ ঠিক কোথা থেকে আসছে বুঝে উঠছে না নীতি। আশেপাশে লাইট খুজে একটা লাইটের সুইচ খুজে পেলো। লাইটটি জ্বালাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে নীতির। কি দেখছে সে!! রুমের চারিপাশের দেয়ালে নীতির ছবি। একটি বোর্ড ঝুলছে এক কোনায়। কাছে যেতে দেখে বোর্ডটিতে অজস্র ছবি ঝুলানো। তার মাঝে তার বাবা,মা, নির্ভীকের ছবিও রয়েছে। বাকি ছবি গুলোতে ক্রস দেয়া। নীতি অবাক হলো যখন মার্ডারড ছেলেদের ছবি দুটো ও বোর্ডে ক্রস দেওয়া ছিলো। মাথাটা হুট করেই বন্ধ বন্ধ লাগছে নীতির। রুমটিতে অনেকগুলো মনিটর ফিট করা৷ মনিটরে এ বাড়ির সকল রুমের ছবি দেখা যাচ্ছে। একটি মনিটরে কারোর জি.পি.এস ট্রাক করা। একটি মনিটর শুধু অফ, বাকি সব গুলো চলছে। দুইটা মনিটরে নীতির বাসার সকল ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মনিটর গুলো কেনো সেট করা এখনো বুঝতে পারছে না নীতি। নীতির মা অচেতন অবস্থাতে বেডে শুয়ে আছে, বাবাকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। এই দৃশ্যগুলো দেখে মনটা হু হু করে উঠছে নীতির। ইচ্ছে করছে এখনই তাদের কাছে যেতে। সব মিলিয়ে কেনো যেনো ঘেটে গেছে নীতি। স্নিগ্ধ এর বাড়িতে এমন কিছু দেখবে কখনোই ভাবে নি নীতি। তবে কি স্নিগ্ধ তার আড়ালে ভয়ানক কিছু লুকিয়ে রেখেছে। নীতি রুমটি থেকে বের হলে পঁচা গন্ধটা আরো গাঢ় হচ্ছে। গন্ধ দূর করতে নাকে ওড়নাটা চেপে এগুতে লাগলো নীতি।

ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামতেই স্নিগ্ধ এর মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠলো। মোবাইলের দিকে তাকাতেই শিওর হয়ে গেলো বেসমেন্টের রুমে কেউ একজন প্রবেশ করেছে। মোবাইলের স্ক্রীন অন করে একটা এ্যাপে প্রবেশ করতেই দেখলো ঘরের কোথাও নীতিকে দেখা যাচ্ছে না। সাথে সাথেই মুখটা বেশ শক্ত হয়ে গেলো স্নিগ্ধ এর। চটজলদি গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলো সে।

সকাল ১১টা,
নিজের রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্ভীক। একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে। একটা সপ্তাহ কোনো খোজ পায় নি সে নীতির। ফারহানা বেগম হাসপাতালে ভর্তি। আদনান সাহেব পাগলপ্রায় হয়ে নীতিকে খুজছেন। একজন বাবার কাছে নিজের সন্তানের স্যাফটি সবকিছু। কিন্তু নীতি বেঁচে আছে না মরে গেছে তার কোনো খোঁজ ই মিলছে না। নির্ভীকের ভার্সিটিও যাওয়া হচ্ছে না। এই এক সপ্তাহ ১০ঘন্টা ঘুম হয়েছে কিনা সন্দেহ। খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। চুল উসখো খুসখো হয়ে আছে। চোখের নিচে কালির ছাপ পড়ে গেছে। নিজের অনুভূতিগুলোর স্পষ্ট উপস্থিতি টের পেয়েছে নির্ভীক। নীতি তার জীবনে শুধু ভালো বন্ধু নয়। এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। নীতির জীবনে অন্য কারোর প্রবেশ তাকে কেনো এতো বিচলিত করেছে আজ তার কারণ খুজে পেয়েছে সে। ভালোবাসে নীতিকে, এতোদিন এই অনুভূতি গুলো মনের একটা কোঠরে জমা ছিলো। নীতির অনুপস্থিতি তাকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছে নীতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য। একটিবার যদি কোনো ক্লু পেতো, তাহলে নীতিকে এখনই নিজের কাছে নিয়ে আসতো। সিগারেটের টানটা দিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
” নীতি কোথায় তুই? আমার পাগল পাগল লাগছে তোকে ছাড়া। একটি বার আমার কাছে আয়, একটিবার। কথা দিচ্ছি তোকে আর হারাতে দিবো না। প্লিজ নীতি। অজান্তেই তোকে ভালোবেসে ফেলেছি রে। তোকে বাদে খুব অসহায় লাগছে নীতি। বড্ড বেশি অসহায় লাগছে।”

চোখের কোনায় মনের ঝড়ের উকিঝুকি খেলছে। না চাইতেই মনটা হু হু করে উঠছে। একটা বার যদি খুজে পাওয়া যেতো নীতিকে, একটাবার শুধু একটাবার_________

হাতে কলমটা নিয়ে বেশ নড়াচড়া করছে হাবীব। মাথা পুরো ঘেটে ঘ হয়ে আছে। নীতি হাওয়ায় উবে গেলো? নীতিকে সেন্ট মার্টিন বাজারে দেখা গেছে। মানে সে সমুদ্রে ঢুবে যায় নি। তবে কি এটা ধরাই যায় নীতি ঢাকাতে এসেছে। কিন্তু এটা শুধুই একটা হাইপোথিসিস। নীতিকে লাস্ট যে পিচ্চি ছেলেটা দেখেছে, তার ভাষ্যমত নীতি খুব অসুস্থ ছিলো বিধায় দ্রুত ১২.৩০টার টেকনাফ যাবার শিপে তাকে তুলে দিতে সে তার বরকে সাহায্য করেছে। কেউ এতোটা সহজে নীতিকে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো এই জিনিসটাই মাথায় ঢুকছে না হাবীবের। হাবীব সেন্ট মার্টিন ছিলো না, সুতরাং সেখানের পুলিশের উপরই তাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। শিপ টেকনাফে আসার পর থেকেই নীতি যেনো হাওয়ায় উবে গেছে। চিটাগাং, কক্সবাজার সব জায়গায় অলরেডি মেয়েটির ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে হাবীব। বাট নো রেজাল্ট। কেনো যেনো নীতির এভাবে উবে যাবার পেছনে স্নিগ্ধ এর হাত থাকলেও থাকতে পারে বলে হাবীব মনে করছে। স্নিগ্ধ লোকটিকে কোনো কালেই সুবিধার বলে মনে হয় নি হাবীবের। কিন্তু হাতে কোনো ক্লু নেই। কিসের ভিত্তিতে স্নিগ্ধকে প্রশ্ন করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

অন্ধকার প্যাসেজে এগোতে এগোতে আরেকটি রুমের কাছাকাছি চলে এসেছে নীতি। রুমটি থেকেই যে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে এটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে নীতি। গন্ধের তীব্রতা বেড়েই যাচ্ছে। নীতির খুব খারাপ লাগছে। এখনই যেনো নাড়িভুড়ি উপড়ে বমি হবে। আজ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না নীতির। ছুটে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো। সব আগের মতো রেখে নিজের রুমের দিকে গেলো সে। বাথরুমে গিয়ে গড়গড় করে বমি করলো সে। মাথাটা ঘুরছে, খুব দূর্বল লাগছে। ওই রুমে কি আছে কৌতুহলটা নীতির মনকে আরো ঘোলাটে করে দিচ্ছে। অজানা ভয়গুলো মনে দলা পাকাচ্ছে। এখনো বাসায় ফিরে নি স্নিগ্ধ। আরেকটা বার কি ওই রুমটায় যাবে নীতি। দেখে আসবে কি আছে ওই রুমে। চোখ মুখে পানি দিয়ে খুব ভালো মোটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে অন্ধকার প্যাসেজে যাবার রুমের কাছে গেলো নীতি।
যেই রুমটা খুলতে যাবে অমনি শুনতে পায়,
– এখানে কি করছো তুমি?

স্নিগ্ধ এর কথাটা শুনা অবধি হাত আটকে যায়। চুরি করতে যেয়ে ধরা খাওয়া চোরের মতো ঘাবড়ে যায় নীতি। বুকটা ধুকপুক করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে মৃদু হেসে বলে,
– ঘর ঘুরে দেখছিলাম।
– এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?
– কেনো ঘরেই তো ছিলাম।
– আমি খুজে পেলাম না কেনো?

স্নিগ্ধের নির্বিকার প্রশ্নে মাথা ঘাম জমতে লাগে নীতির। ভয় হচ্ছে, স্নিগ্ধ কি অনেক আগেই বাসায় এসে পড়েছিলো? তবে কি স্নিগ্ধ বুঝে গেছে বেসমেন্টে গিয়েছিলো নীতি। আমতাআমতা করে মিনমিনিয়ে বললো,
– তুমি কখন এসেছো?
– মিনিট পনেরো। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুজেও তোমাকে পাই নি। কোথায় ছিলে তুমি?
– বা…বাথরুমে, শরীরটা ভালো লাগছিলো না। তাই আর কি

নীতির কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে, নীতির আড়ষ্টভাব দেখে তীর্যক চোখে তার দিকে তাকায় স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধকে হঠাৎ করেই ভয় লাগছে নীতির। একবার জানতে চেয়েছিলো নিচে এমন বেসমেন্ট বানিয়ে রেখেছে কেনো। সেখানের ঘরে নীতির ছবিই বা কেনো। স্নিগ্ধ তাকে ভালোবাসে এ কথা নীতির অজানা নয় কিন্তু ওই রুমের মনিটর, ছবির বোর্ড, ফাইলের পর ফাইল সবকিছুর মানে টা কি। নীতির বাসার ফুটেজও বা কেনো সেখানে। প্রশ্নগুলো করতে যেয়েও করা হলো না নীতির। সব প্রশ্ন গলাতেই আটকে গেলো।
– তোমার কি শরীর ভালো লাগছে না?

স্নিগ্ধ এর কথা মাথা তুলে তাকায় নীতি। ভীত স্বরেই বলে,
– আমি একটু বাসায় যাবো। বাবা-মাকে জানানো হয় নি আমি এখানে। উনারা খুব চিন্তা করছে।
– যারা তোমার কথা চিন্তাই করে না তাদের কাছে কেনো যাবে তুমি?

স্নিগ্ধ এর শক্ত কন্ঠে বলা কথায় কেমন যেনো তাজ্জব হয়ে যায় নীতি। কন্ঠটা বেশ কড়া, এবং শিরদাড়া নিয়ে ঠান্ডা আবেশ দিতে যথেষ্ট। নীতি আর কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে গেলো। মুখ থেকে ভয়েজ বের হচ্ছে না তার। স্নিগ্ধ লোকটাকে এতোদিন যে বিশ্বাসটা করেছিলো আজ যেনো সেই বিশ্বাসের মাঝে ফাটল ধরছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ ই সেই ব্যাক্তি যে তার রুমে ক্যামেরা ফিট করেছিলো। তবে কি ছেলেগুলোকেও স্নিগ্ধ ই খুন করেছে!! ব্যাপারটা মনে হতেই বুকের ধুকপুকানি যেনো আর বেড়ে গেলো নীতির। স্নিগ্ধ আস্তে করে হাতটা ধরে নীতিকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলো। নীতি কাঠের পুতুলের মতো তাকে অনুসরণ করছে, ভয়ে বুকটা ঠান্ডা হয়ে আসলেও মুখে তা প্রকাশ করছে না।

রাত ১টা,
স্নিগ্ধ গভীর ঘুমে মগ্ন, রান্নার বাহানায় হালকা ঘুমের ডোজ দিয়ে দিয়েছিলো নীতি তাকে। স্নিগ্ধ এর ড্র‍য়ারে ঔষধটা পেয়েছিলো সে। ধীরে ধীরে উঠে এলো নীতি, যাতে স্নিগ্ধ টের না পায়। ধীর পায়ে হেটে অন্ধকার প্যাসেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। রুমটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীতি। হাত কাঁপছে, কিন্তু কৌতুহল তাকে বারবার রুমে প্রবেশ করতে বলছে। রুমটিতে একটা ছোট তালা, পাথরের সাহায্যে সেটা ভাঙ্গা যাবে। নাকে ওড়নাটা বেধে ধীরে ধীরে পাথরটি ভাঙ্গলো নীতি। কাঁপা হাতে রুমটি খুলে যা দেখলো তাতে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়৷ বরফ হীম ঘর, বরফের এক একটা বক্স। কাঁপা হাতে বক্সের মুখগুলো খুলতেই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যাবার জোগাড়। বক্সের ভেতরে জমে আছে কিছু লাশ। খুব সুন্দর করে লাশ গুলো শুয়ে আছে। মুখে কোনো দাগ নেই, কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। অথচ তারা সবাই মৃত। প্রায় ৮-৯ টা তার সমবয়সী মেয়ের লাশ সেখানে, একজন পুরুষের লাশও রয়েছে। মাথা যেনো ঘুরছে নীতির। স্নিগ্ধ ই কি তবে এগুলো করেছে।
– তুমি তো দেখছি সব জেনে গেছো বাবুইপাখি

কথাটা শুনতেই……..

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি