কে পর্ব-১০

0
989

#কে!!
#১০ম_পর্ব

হঠাৎ দরজাটা ঠেলে কেউ ভেতরে আসতে দেখলে বেশ ঘাবড়ে যায় নীতি। একেই বেশ ঘেটে আছে, তার উপর অচেনা জায়গা। চোখ মুখ খিচে শুয়ে থাকাটাই বেশি সুবিধার বলে মনে হলো তার। মানুষটা নিঃশব্দে তার কাছাকাছি এসে পড়লে আরো ও ভয়ে শিটিয়ে যায় নীতি। লোকটা মৃদু কন্ঠে বলে,
– এতো ভয়ের কিছু নেই, আমি বাঘ না।

কন্ঠটি শুনেই এক লাফে উঠে বসে নীতি। লোকটি স্নিগ্ধ। আচ্ছা এই লোকটাই কেনো তার আশেপাশে থাকে। ব্যাপার টা বেশ খটকা লাগার মতো। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত যে সে বেঁচে আছে। আর স্নিগ্ধ তাকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু সে আছে টা কোথায়!! অবাক নয়নে মিনিট পাচেক দেখে মুখ ফসকেই বলে উঠে,
– আমি কোথায়?
– আমার আস্তানায়, কেনো ভয় হচ্ছে?
– ভ….ভয় পাবো কেনো? আমি তো
– মরতে বসেছিলে, আমি না থাকলে তো হয়তো ভেসেই যেতে
– কেনো বাঁচালেন?

নির্বিকারভাবেই কথাটা বলে উঠে নীতি। চোখে মুখে গভীর দুঃখের ছাপ ফুটে উঠেছে। একাকিত্ব তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। চাইলেও কেনো জানে নিজেকে আর ভালো রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ডুবন্ত মানুষ নাকি খড়কুটোকেও আঁকড়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু কথাটা হলো নীতি এই খড়কুটো ও খুজে পাচ্ছে না। চোখের কোনে এক বিন্দু শিশির কণা জমতে দেখে স্নিগ্ধ ধীর পায়ে তার কাছে এসে বসে। আলতো হাতে মুখটি তুলে ধরে। নীতির চোখে কোনের বর্ষণ যে তার এক দম সহ্য হয় না। নীতির চোখের পানি তার কাছে রক্তক্ষরণের মতো লাগে। কোমল কন্ঠে বলে,
– তোমাকে কাঁদার ই অধিকার আমি দেই নি। মরার তো দূরের কথা। আমার জীবনকে চোখের সামনে মরতে দেখতে পারবো না আমি। তাই বাঁচালাম। নীতি আমাকে কি এক বার ও ভরসা করা যায় না? আমি তো আছি। কাউকে দরকার নেই আমাদের। না হয় আমি তোমার, তুমি আমার হয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবো।
– স্নিগ্ধ
– হুম?
– আমার ভয় হয়
– কিসের ভয়?
– একা থাকার ভয়।
– আমি থাকতে তুমি কখনো একা থাকবে না। আমি তোমার পিছু কখনোই ছাড়বো না। মরে গেলেও না।
– এতোটা ভালোবাসো?

নীতির গলা আটকে আসছে। শব্দ গুলো যেনো সব গলাতেই দলা পেকে আছে। চোখ বারংবার ভিজে আসছে। সব থেকেও একাকিত্বের হাতছানি তাকে অন্ধকারের একটি বেড়াজালে আটকে দিয়েছিলো। স্নিগ্ধ না কাছে একটি খড়কুটোর মতোই। ভালোবাসা পাবার লোভে আজ তার আবেগের যেনো সীমা থাকছে না। স্নিগ্ধ হালকা ম্লান হাসি দিয়ে বললো,
– জানো নীতি, তুমি আমার কাছে অনেকটা যক্ষের ধনের মতো। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি তোমার থেকে একা।
– কেনো আপনার পরিবার?
– নেই, কেউ নেই আমার। জন্মদাত্রী মা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন জানো?

কথাগুলো অস্ফুটস্বরে বললেও নীতির হৃদয়ে যেয়ে লাগছে। লোকটার চোখ ছলছল করছে। অশ্রুগুলো জমে বাধের মতো হয়ে আছে। এখনই যেনো চক্ষুজোড়াকে মুক্ত করে ঝড়ে পড়বে। লোকটার বুকের বেদনাগুলো আজ সকল বেড়াভাঙতে চাচ্ছে। নীতির বুকে ও অনুভব হচ্ছে তার কষ্টগুলো। অবাক নয়নে স্নিগ্ধ এর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নীতি আজ নাহয় অন্য কারোর বেদনার অংশীদার হোক। স্নিগ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
– আমি তোমাদের মতো কোনো পবিত্র সম্পর্কের ফসল নই। কেবল একটা ভূল ছিলাম। অপরিপক্ক বয়েসের অপরিণত ভালোবাসার ফল। যা একজনের কাছে কাম মিটানোর মাধ্যম ছিলো তো অন্যজনের কাছে ভালোবাসার প্রমাণ। আমার জন্মদাত্রী যখন আমার জন্মদাতাকে আমার অস্তিত্বের কথা বলেন তিনি সাথে সাথেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আমি তখন কয়েক মাসের ভ্রুণ। যখন তিনি আমাকে নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার জীবনের রিস্ক হবে বিধায় তিনি সেটাও করতে পারেন না। আমি দুনিয়াতে আসি। কিন্তু অবহেলার চরম পর্যায়ে আমার বেড়েউঠা হয়। আমার জন্য তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো বিধায় আমাকে বারংবার মেরে ফেলার চিন্তাও করেন। আচ্ছা নীতি আমার দোষটা কোথায় বলোতো? শেষমেশ আমাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর একা একা আমার বেড়ে উঠা। মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ ব্যাপারটা বয়সের সাথে সাথে আসে। কিন্তু ওই যে আমার আসল পরিচয়। যখন আমার মাতা-পিতার কথা জানতে পারতো আমাকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। এর পর মেয়েদের প্রতি এক রকম বিরক্ত জন্ম হয়। আমার রুক্ষ্ণ জীবনে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় তুমি এসেছিলে। তাই তোমাকে হারাতে আমি রাজী নই নীতি।
– বিয়ে করবেন আমাকে?

নীতির এমন কথায় চোখ যেনো বিস্ফোরিত রুপ ন্যায় স্নিগ্ধ এর। এমন কিছু নীতি বলবে যেনো কল্পনার বাহিরে ছিলো। অবাক চোখে বললো,
– বুঝে বলেছো তো?
– বলুন না বিয়ে করবেন?
– হ্যা কিন্তু
– এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্য, আমি কিন্তু ভেবেই বলছি।
– সত্যি তুমি আমার হবে নীতি? আমাকে কখনো একা ফেলে দিবে না তো?

মুচকি হেসে নীতি বলে,
– ডুবন্ত মানুষের কাছে খড়কুটোটাও অনেক বড় জিনিস। আপনি আমার কাছে আর আমি আপনার কাছে অনেকটা পরশ পাথরের মতো। আমি আর ওখানে ফিরে যেতে চাই না স্নিগ্ধ। আমাকে নিজের কাছে রেখে দিবেন?
– তুমি কথা দাও আমাকে ফেলে যাবে না?
– কখনোই না, কথা দিলাম
– যদি আমাকে ছেড়ে যেতে হয় তবে আমাকে মেরে ফেলো। আমি তোমার হাতে মরতেও রাজী থাকবো

স্নিগ্ধ এর কথা শুনে নীতি তাকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। স্নিগ্ধ ও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে তাকে। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে তার বাবুইপাখি।

সকাল ১১টা,
থানায় বসে রয়েছে নির্ভীক। ফারহানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল। সেন্ট মার্টিনের কোথাও নীতিকে না পেয়ে যেনো দিশেহারা হয়ে যান আদনান সাহেব, নির্ভীক এবং ফারহানা বেগম। ঢাকাতে ফিরেই থানায় রিপোর্ট করেন। কি লাভ হবে জানা নেই তবুও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? নীতির বাবা-মা নিজেদের দোষারোপ করছেন। তার মেয়ের হারিয়ে যাবার পেছনে নিজেদের গাফেলতি বলেই তাদের ধারণা।
– নির্ভীক তুমি এখানে?

হাবীবের কন্ঠ পেয়ে নির্ভীক পেছনে ফিরে। একটা কাজের জন্য এই থানায় এসেছিলো হাবীব। নির্ভীককে দেখে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে। কাঁপা গলায় নির্ভীক বলে,
– নীতিকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না হাবীব সাহেব
– কিহ!!!!

নির্ভীকের কথায় হাবীব অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছায়। সব কিছু জানতে চাইলে নির্ভীক এতোদিনের সব ঘটনা হাবীব কে জানায়। নীতির রুমের ক্যামেরা, নীতির রুমে কারোর আসার আভাষ সব কিছু। সব শুনে হাবীবের যে খটকাগুলো ওই মার্ডার কেসে ছিলো আজ যেনো সেটা গাঢ় সন্দেহের রুপ নিচ্ছে। তবে কি নীতির কোনো ক্ষতি হতে চলেছে?

রাত ৮টা,
স্নিগ্ধ এবং নীতি বিয়ের পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। নীতির মনেই হচ্ছে না তাদের বিয়েটা হুট করে হয়েছে। স্নিগ্ধ প্রতিটি কাজ সুনিপুণ করে করেছে। কমতি ছিলো শুধু তার বাবা-মার, বন্ধুদের। মনে কোথাও যেনো একটা খারাপ লাগাও কাজ করছে। বাবা-মাকে না বলে বিয়েটা কি করা উচিত হয়েছে? কে জানে বুঝে উঠতে পারছে না। বন্ধুদের মাঝে নির্ভীককে আজ বেশ মনে পড়ছে। এতো সুখময় দিনে তাকেই জানানো হয় নি তার। পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে ভাবনার ছেদ ঘটে। মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
– এভাবে ধীর পায়ে হেটে আমাকে চমকে দেওয়াটা থামান। ভয় লাগে তো।
– আমি আছি তো নাকি

মাথায় উষ্ণ পরশ একে দিয়ে স্নিগ্ধ কথাটা বলে। নীতিকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে কানে মুখ লাগিয়ে বলে স্নিগ্ধ,
– তোমাতে হারাতে চাই বাবুইপাখি, অনুমতি আছে?

বাবুইপাখি কথাটা খুব পরিচিত লাগছে নীতির কাছে। কিন্তু কথাটা কি স্বপ্নে দেখেছিলো নাকি বাস্তবে সেটা বুঝতে পারছে না।
– কি ভাবছো?

চিন্তার ঘনঘটা মাথায় চাপতে থাকলে স্নিগ্ধের কিথাটা তাকে আবারো বিচ্যুত করে চিন্তা থেকে। মুচকি হেসে বলে নীতি,
– তাড়া কিসের আমি তো আছি তাই না?

স্নিগ্ধ কিছু বলে না। সে জানে নীতি এখন তার। তাই জোর করার কি মানে!! কিছু সময় নিতে তো অসুবিধা নেই।

এক সপ্তাহ পর,
বিয়ের এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখন নীতির সকাল, সন্ধ্যা হয় স্নিগ্ধকে দেখে। একটা অদৃশ্য আকর্ষণ কাজ করে স্নিগ্ধ এর প্রতি। বাসায় এখনো ফোন করে নি নীতি। না জানি বাবা-মা হয়তো পাগলের মতো রাকে খুজছে। কিন্তু তার কাছে ফোন ও নেই। স্নিগ্ধ তাকে ফোন কিনে দেয় নি। আর আগের ফোনটা সেন্ট মার্টিন রেখে এসেছে। স্নিগ্ধ যে কোথায় রেখেছে, জায়গাটা যে কোথায় সেটাও জানে না নীতি। তবুও এখানে এক সপ্তাহ এখানেই আছে সে। একটা সম্বোহনের মতো কাজ করে স্নিগ্ধের সঙ্গ। সব ভুলিয়ে দেয়। স্নিগ্ধ যদিও বাহিরে যাবার আগে নীতিকে আটকে দিয়ে যায়। তাই বাসায় ঘুরা বাদে কোনো কাজ নেই নীতির। আজ সেই কাজ ই করছিলো নীতি, হঠাৎ একটি রুমের দরজা দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হয় সে। দরজাটা কিভাবে খুলবে বুঝে পাচ্ছিলো না নীতি। হঠাৎ একটা কাঠের হাতলে হাত লাগতেই খুলে যায় দরজাটা। দরজার ভেতরে ঢুকতেই……….

মুশফিকা রহমান মৈথি