গোধূলি বিকেলে তুমি আমি পর্ব-২৩+২৪

0
477

#গোধূলি_বিকেলে_তুমি_আমি❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৩
________________

স্তব্ধ হয়ে আছে পুরো ভার্সিটি। কারন ভার্সিটির মোস্ট পপুলার সিনিয়র ভাই শ্রাবণকে সবার সামনে গালে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছে আদ্রিজা। আশেপাশে সবাই জাস্ট নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিজা আর শ্রাবণের মুখের দিকে। তাঁরা জানে না আদ্রিজা আর শ্রাবণের মাঝে এমন কি ঘটলো। যার জন্য এইভাবে সবার সামনে থাপ্পড় বসিয়ে দিল আদ্রিজা শ্রাবণের গালে।’

কিছুক্ষন আগে,

হুট করেই শ্রাবণকে নিজের সামনে দেখে ভড়কে যায় আদ্রিজা। হতভম্ব গলায় বলেও সে ‘আপনি’ কিন্তু পরক্ষণেই বেশি না ভেবে পাস কাটিয়ে চলে যেতে নেয় আদ্রিজা। কিন্তু শ্রাবণ যেতে দেয় না গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বলে,

‘ দাঁড়াও।’

আদ্রিজা দাঁড়ায় না যা দেখে শ্রাবণ রেগে যায়। রেগে গিয়েই মুখোমুখি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সে আদ্রিজার সামনে। তারপর বলে,

‘ আমি তোমায় দাঁড়াতে বলেছি তুমি শুনতে পাও নি?’

উওরে এক বুক সাহস নিয়ে বলে উঠল আদ্রিজা,

‘ না শুনতে পাই নি। কে আপনি যে আপনার কথা শুনতে হবে আমায়। আর এভাবে রাস্তা আঁটকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন যেতে দিন আমায়।’

আদ্রিজার কথায় আরো রাগ উঠে শ্রাবণের ধমকের স্বরে বলে সে,

‘ তোমার বড্ড সাহস বেড়ে গেছে তাই না।’

শ্রাবণের কথা শুনে হাসলো আদ্রিজা। বললো,

‘ আমার যদি সত্যি সাহস থাকতো তাহলে আপনার অপমানের যোগ্য জবাব হিসেবে আপনার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতাম শ্রাবণ। কিন্তু আফসোস আমার মাঝে সেই সাহসটা নেই।’

আদ্রিজার কথা শ্রাবণের রাগ উঠেছে ঠিকই কিন্তু আপাতত সেই রাগটাকে দমিয়ে রেখে বললো সে,

‘ কাল রাতে তোমার সাথের ছেলেটা কে ছিল?’

শ্রাবণের কথা শুনে আদ্রিজা অবাক হলো, চরম অবাক হলো। বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে বললো,

‘ কোন ছেলে?’

‘ এখন তো ভাজা মাছটা উল্টে খেতেও পারবে না। কিন্তু কাল রাতে মাঝরাস্তায় টং দোকানে চা ঠিকই খেতে পারো।’

শ্রাবণের কথা শুনে এবার বুঝলো আদ্রিজা শ্রাবণ অভ্রের কথা বলছে। আদ্রিজার ভাবনার মাঝেই আবারও বলে উঠল শ্রাবণ,

‘ কি এবার মনে পড়েছে কোন ছেলে?’

‘ দেখুন অতিরিক্ত ফালতু কথা বলবেন না। আর আমার যার সাথে ইচ্ছে তাঁর সাথে বসে মাঝ রাস্তা কেন মাঝ রাতে বসে চা খাবো তাতে আপনার কি। আপনার আমার মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই তাই যেতে দিন আমায়। আপনি থাকুন না আপনার মতো।’

বলেই চলে যেতে নেয় আদ্রিজা। এরই মাঝে পিছন ঘুরে আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল শ্রাবণ,

‘ খুব তো বলেছিলে তুমি নাকি আমায় ভালোবাসো এই তোমার ভালোবাসার নমুনা।’

আদ্রিজা থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকালো সে। বিস্মিত গলায় বললো,

‘ আপনার প্রতি আমার ভালোবাসার নমুনা দেখে আপনি কি করবেন।’

আদ্রিজার কথা শুনে শ্রাবণ আবারও এগিয়ে আসলো আদ্রিজার দিকে। তারপর বললো,

‘ আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে ঠিক মতো পাঁচ’দিনও হয় নি এরই মাঝে নতুন সঙ্গী যোগাড় করে ফেলেছো। আবার আমার সামনে এসে নেকা কান্না দেখাও লজ্জা করে না তোমার।’

আদ্রিজার রাগ উঠলো, খুব রাগ উঠলো তবে নিজেকে দমিয়ে রেখে বললো সে,

‘ মুখ সামলে কথা বলুন শ্রাবণ।’

‘ সামলাবো না মুখ কি করবে তুমি? সেদিন তো একদম নেকা কান্না জুড়িয়ে দিয়েছিলি মনে হচ্ছিল যেন আমায় ছাড়া বাঁচবেই না আর আজ দু’দিনের মধ্যেই নতুন ছেলে নিয়ে মাঝ রাস্তায় হাসাহাসি ঢলাঢলি করতে লজ্জা লাগে না।’

শ্রাবণের এবারের কথা শুনে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে নি আদ্রিজা। কারন এবারের কথায় শ্রাবণ শুধু তাঁকে না অভ্রের মতো ভালো মনের মানুষটাকেও অপমান করেছে। অতঃপর আদ্রিজা রেগে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় শ্রাবণের গালে। সাথে আশেপাশে সবাই পুরো স্তব্ধ হয়ে যায় আদ্রিজার এমন কান্ডে।’

বর্তমানে,

গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ আদ্রিজার মুখের দিকে। সে কল্পনাও করতে পারে নি আদ্রিজা তাঁকে থাপ্পড় মারবে। এদিকে আদ্রিজা কাট কাট গলায় শ্রাবণকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল,

‘ ব্যস মিস্টার শ্রাবণ। অনেকক্ষণ যাবৎ আপনার বক বক শুনছি। কি ভেবেছেন কি নিজেকে খুব বড় ভাবেন আপনি। শুনুন সব মানুষকে নিজের মতো ভাববেন না। মেয়েদের মন নিয়ে খেলা, তাদের সাথে ঢলাঢলি করা এটা আপনার স্বভাব আমার নয়।’ আমার জীবন, আমি কার সাথে বসে চা খাবো, ঘুরতে যাবো এটা আমি দেখে নিবো। এটা নিয়ে আপনায় ভাবতে হবে না। কি ভেবেছেন কি আপনায় ভালোবেসে ছিলাম বলে যখন যা ইচ্ছে হবে তখন তাই বলে কথা শুনাবেন। অনেক শুনেছি আপনার কথা কিন্তু আর নয়। অনেক কিছু বলেছেন আমায় সব মুখ বুঝে সহ্য করেছি আমি কিন্তু অভ্রের মতো ভালো মনের মানুষকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বললে আমি সহ্য করবো না। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। নেক্সট টাইম উল্টো পাল্টা কিছু বলার আগে ভেবে বলবেন।’

বলেই জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক কোথাও না তাকিয়ে সোজা নিজের ক্লাস রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল আদ্রিজা। চরম রাগ হচ্ছে তাঁর, চরম রাগ। কত বড় সাহস অভ্রের মতো মানুষকে নিয়ে বাজে কথা বলে।’

অন্যদিকে,

শ্রাবণ পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড রেগে গেছে সে। আশেপাশে তাকালো শ্রাবণ। সবাই বেশ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। শ্রাবণ গালে হাত দিয়ে রাগে হন হন করে বেরিয়ে গেল ভার্সিটি থেকে।’

___

ক্লাস রুমের পাঁচ নাম্বার বেঞ্চটাতে বসে আছে আদ্রিজা। আর তাঁকে ঘিরে ধরে গোল হয়ে বসে আছে তাঁর বন্ধুমহলের সবাই শরীফ,সিফাত, তুলি বুশরা, আশিক, আর আরু। সবাই পুরো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁরাও শ্রাবণের ঘটনার সময় ছিল সেখানে। সাথে আদ্রিজার বলা কিছু কিছু কথা শুনেছে তাঁরা। তাঁর মানে আদ্রিজা যেদিন সত্যি বলেছিল সে কাউকে ভালোবাসে। আর সেই কেউ মানুষটা শ্রাবণ ছিল। তুলি গিয়ে বসলো আদ্রিজার পাশ দিয়ে তারপর বললো,,

‘ তুই ঠিক আছিস তো আদ্রিজা?’

তুলির কথা শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রিজা তুলির দিকে। যা দেখে তুলি ভয় পেয়ে বললো,

‘ না থাক কিছু বলতে হবে না তোকে।’

বলেই আদ্রিজার পাশ থেকে উঠে চলে যায় সে সবার মাঝে তারপর বলে,

‘ এখন কিছু বলিস না ও পুরো রেগে আছে।’

তুলির কথা শুনে সবাই বেশ চুপ রইলো। হঠাৎই আশিক বললো,

‘ আগডুম বাগডুম
আজ আমাদের নিরিবিলি আফা রাগে ভুম।’

আশিকের কথা শুনে এবার আরু বললো,

‘ এই বাক সেই বাক
তুই আশিক এবার চুপ থাক।’

হুট করেই আশিকের কবিতার উওর হিসেবে আরুকেও কবিতা বলতে দেখে হতভম্ব হয়ে সবাই একসাথে বলে উঠল,

‘ মারো তালি।’

কিন্তু কেউ তালি মারলো না। উল্টো সবার কথা শুনে রাগী দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো আদ্রিজা। যা দেখে শরীফ বলে উঠল,

‘ না থাক তালি মারার দরকার নেই। তুই বোইন আজ শান্ত থাক।’

প্রতি উওরে আদ্রিজা কিছু বলে না। শুধু দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকায় সে।’

____

অফিসে নিজের রুমের ল্যাপটপে কাজ করছিল অভ্র। এমন সময় সেখানে খুশি মনে ছুটে আসলো লাবণ্য। হাতে তাঁর একটা কাগজ। লাবণ্য ছুট্টে এসে খুশি মনে বললো অভ্রকে,

‘ অভ্র আজ আমি খুব খুশি। খুব খুব খুব খুশি।’

হুট করেই নিজের রুমে ঢুকে লাবণ্যের এমন লাফালাফি দেখে হকচকিয়ে উঠলো অভ্র। তক্ষৎনাত ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বলে উঠল সে,

‘ কেন কি হয়েছে?’

উওরে খুশি মনে বলে উঠল লাবণ্য,

‘ অবশেষে আমার আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নটা পূরণ হলো অভ্র। আমার আমেরিকায় গিয়ে আমেরিকার বড় ভার্সিটিতে টিচার হওয়ার স্বপ্নটা অবশেষে পূরণ হলো। দু’দিন পরই আমার ফ্লাইট।’

লাবণ্যের কথা শোনার সাথে সাথে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল অভ্রের। নিশ্চুপ কন্ঠে বলে উঠল সে,

‘ আর ফিরবি না?’

অভ্রের কথা শুনে স্বাভাবিক গলায় বললো লাবণ্য,

‘ না।’

সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো অভ্রের। তবে কিছু বলতে পারলো না সে। অভ্রের রিয়েকশন দেখে মনে মনে হাসলো লাবণ্য তারপর অভ্রের সোজাসুজি সামনের চেয়ারে বসে বললো সে,

‘ তুই খুশি হোস নি অভ্র?’

উওরে গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বললো অভ্র,

‘ খুশি না হওয়ার কি আছে তোর এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। হুম খুশি হয়েছি আমি খুব খুশি হয়েছি।’

অভ্রের কথা শুনে লাবণ্য বুঝতে পেরেছে অভ্র রাগ করেছে তারওপর। কিন্তু আপাতত সেই রাগটাকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল সে,

‘ আমি চলে গেলে তুই আমায় মিস করবি অভ্র?’

‘ তোকে মিস করার কি আছে। অদ্ভুত। বোকা বোকা প্রশ্ন সব।’

‘ তাঁর মানে আমি চলে গেলে তুই আমায় মিস করবি না।’

লাবণ্যের কথার স্ট্রেট জবাব অভ্রের,

‘ না।’

এবার আর কিছু বললো না লাবণ্য কিছুক্ষন চুপ থেকে নিজের ব্যাগে হাত দিলো সে। তারপর নীল রঙের খামটা বের করে এগিয়ে দিল সে অভ্রের দিকে। তারপর বললো,

‘ এটা তোর জন্য?’

লাবণ্যের কাজে চরম অবাক হলো অভ্র। খামটা হাতেও নিলো সে। তারপর বললো,

‘ এটার ভিতর কি আছে?’

‘ আছে কিছু একটা।’

লাবণ্যের কথা শুনে অভ্র খুলতে নিলো খামটা। সাথে সাথে লাবণ্য বারন করে বলে উঠল,

‘ আরে আরে এখনই খুলছিস কেন?’

‘ আহ্! এটার ভিতর কি আছে দেখবো না।’

‘ হুম দেখবি তো কিন্তু পরে। আমি যাওয়ার পর।’

‘ এমন কেন?’

‘ সেটা তুই খামটা খুলে জিনিসটা দেখলেই বুঝতে পারবি।’

অভ্র শুনলো লাবণ্যের কথা। তারপর খামটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

‘ ঠিক আছে।’

এরই মাঝে লাবণ্যের ফোনটা বেজে উঠল। তার বাবা ফোন করেছে। লাবণ্য ফোনটা না তুলে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ আমায় এখন যেতে হবে বাবা মায়ের সাথে শপিং এ যাবো পরে কথা হবে।’

উওরে অভ্রও বলে উঠল,

‘ ঠিক আছে।’

অতঃপর লাবণ্য উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন অভ্রের পানে তাকিয়ে থেকে বললো সে,

‘ খামটা খুলে দেখিস কিন্তু ভিতরের জিনিসটা।’

উওরে অভ্রও গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বললো,

‘ ঠিক আছে।’

লাবন্য বেরিয়ে গেল। তবে যাওয়ার আগে আরও একবার তাকালো সে অভ্রের দিকে। মুখ ভাড় করে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। লাবণ্য অভ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,

‘ আর কত মনের কথা লুকিয়ে রাখবি অভ্র। এবার তো মুখ ফুটে কিছু বল। তবে এবার আর চিন্তা নেই তুই না বললেও আমি ওই খামে ভরা চিঠিটায় লিখে দিয়েছি সবটা। কারন আমিও যে তোকে,

ভেবেও থেমে গেল লাবণ্য। মুচকি হেঁসে বেরিয়ে গেল সে অভ্রের রুম থেকে।’

____

ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বাড়ির সামনে একটা বড় কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চরম অবাক হলো আদ্রিজা। তবে বেশি না ভেবে চুপচাপ ঢুকে পড়লো সে বাড়ির ভিতরে। চলে গেল তাদের রুমের কাছে। পরক্ষণেই তাঁর ঘরের সামনেই অনেকগুলো মানুষের জুতো দেখে নিস্তব্ধ পায়ে এগিয়ে গেল সে ভিতরে। মনে মনে বললো,

‘ এখন কারা এসেছে তাদের বাড়ি?’

#চলবে…..

#গোধূলি_বিকেলে_তুমি_আমি❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৪
________________

মায়ের পছন্দ করা খয়েরী রঙের একটা শাড়ি পরে পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে আদ্রিজা। হুট করে এইভাবে পাত্রপক্ষের সাথে দেখা করতে বসতে হবে এটা ভাবি নি আদ্রিজা।’

কতক্ষণ আগেই ভার্সিটি থেকে ফিরে বাড়িতে নতুন মানুষের আগমন দেখে বেশ অবাকই হয় আদ্রিজা। আদ্রিজা বিস্মিত হয়েই এগিয়ে যায় রুমের ভিতরে এরই মাঝে আদ্রিজার মা এসে আদ্রিজাকে নিয়ে যায় তাঁর রুমে। তারপর বুঝিয়ে বলে আদ্রিজাকে পাত্র নাকি খুব ভালো তাঁর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ছেলে। আদ্রিজা শুরুতে পাত্রপক্ষের সামনে আসতে রাজি হয় নি কিন্তু পরে মায়ের জোরাজোরিতে রাজি হয় সে। আদ্রিজার মাই সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসে আদ্রিজাকে পাত্রের সামনে।’

বর্তমানে পাথরের ন্যায় চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে আদ্রিজা। একদমই অনুভূতি শূন্যহীন মানুষ লাগছে তাঁকে। তবে বর্তমানে আদ্রিজার খারাপ লাগার বিষয়টা এটা নয় তাঁকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে তাঁর খারাপ লাগার বিষয় হলো শ্রাবণ একমাত্র শ্রাবণ। ভীষণ জোরে কান্না পাচ্ছে আদ্রিজার। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে তাঁর,

‘ এমন কেন করলে শ্রাবণ? এইভাবে স্বপ্ন দেখিয়ে কেন ভেঙে দিলে।’

দীর্ঘ শ্বাস বের হলো আদ্রিজার। হঠাৎই পাত্রের মায়ের ডাকে হুস আসলো আদ্রিজার। বললো পাত্রের মা,

‘ তা মা তোমার নাম কি?’

উওরে আদ্রিজাও মহিলাটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

‘ জ্বী আদ্রিজা।’

‘ তা রান্না বান্না কিছু জানো তুমি?’

মহিলাটির কথা শুনে আদ্রিজা তাকালো তাঁর মায়ের দিকে। তারপর বললো,

‘ হুম।’

অতঃপর এইরকম টুকিটাকি আরো কিছু প্রশ্ন করলো পাত্রের মা। আদ্রিজাও চুপচাপ একে একে উওর দিতে লাগলো।’

____

গোধূলি বিকেল। সেঁতসেঁতে কাঁদায় জর্জরিত রাস্তাঘাট। দুপুরের দিকটায় বৃষ্টি নামায় এমনটা হয়েছে। এই বৃষ্টির চক্করে পাত্রপক্ষরাও বের হতে পারছিল না আদ্রিজার বাড়ি থেকে। কতক্ষণ আগেই বৃষ্টি থামার পরই পাত্রপক্ষ চলে গেছে আদ্রিজার বাড়ি ছেড়ে আর তাঁরা বের হতেই আদ্রিজাও জামাকাপড় পাল্টে তাঁর রুমে থাকা সেই বিড়াল ছানাটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নিজ মনে। ভালো লাগছে না কিছু। ছেলেপক্ষরা কিছু বলে নি তাদের আদ্রিজাকে পছন্দ হয়েছে নাকি হয় নি কিছুই বলে নি তাঁরা। তবে মায়ের কাছে শুনেছে রাতে নাকি ফোন করে বলবে তাদের। আদ্রিজার এই মুহূর্তে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই ওনারা কি বললো না বললো। যাকে ভালো বাসলো সেই তো ধোঁকা দিল। তবে আদ্রিজা মনে মনে চায় বিয়েটা যেন না হয়। আর বাকিটা ভাগ্যের লিখন। তাঁর ভাগ্যে আসলে কে আছে এটা ভেবেই মাঝে মাঝে কনফিউশান হয় আদ্রিজার। যাকে ভালোবাসলো সেই তো আপন হলো না। তাহলে কে আছে তাঁর জীবনে যে সত্যিকার অর্থেই তাকে ভালোবাসবে খুব করে। তাঁর সাধারণত্বকেই খুশি মনে একসেপ্ট করে নিয়ে স্বপ্ন বুনবে আনমনে। আধও কি কেউ আছে, আচ্ছা যে ছেলেটা তাঁকে দেখতে আসলো সেই ছেলেটা কি তাঁকে খুব ভালোবাসবে নাকি শুধুই,

বেশি ভাবলো না আদ্রিজা। কেমন যেন মাথার ভিতর সব উল্টো পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই আদ্রিজা তাঁর বিড়াল ছানার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠল,

‘ আচ্ছা কিটি (বিড়ালের নাম) বলতে পারিস এমন কে আছে যে আমায় ভালোবাসবে, আমি যাকে ভালোবাসলাম সে তো বাসলো না তাহলে কে হতে পারে বলতো যে আমায় ভালোবাসবে নাকি এমন কেউ নেই যে আমায় ভালোবাসবে। কি জানি, হয়তো আছে হয়তো নেই।’

এমন সময় হঠাৎই হনের শব্দ কানে আসতেই সাইডে সরে আসলো আদ্রিজা। পিছন ঘুরতেই আজও অভ্রকে দেখে খানিকটা অবাক হলো আদ্রিজা। আদ্রিজাকে দেখে আজও গাড়ি থামালো অভ্র। বললো,

‘ কোথায় যাচ্ছো?’

উওরে আদ্রিজাও বেশি না ভেবে বলে উঠল,

‘ তেমন কোথাও না ভালো লাগছিল না বাড়িতে। তাই আমার পুঁচকে বিড়ালটাকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম এই যা। তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘ আমি ওই সামনে যাচ্ছি অফিসের কাজে।’

‘ ওহ জান তাড়াতাড়ি নয়তো দেরি হয়ে যাবে।’

‘ হুম আসলেই দেরি হয়ে যাবে। এখন যাই বুঝলে পরে কথা হবে মিস ব্ল্যাকবেরি।’

উওরে আদ্রিজাও মুচকি হেঁসে বললো,

‘ ঠিক আছে।’

অতঃপর অভ্র আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল গাড়ি নিয়ে। আর আদ্রিজাও কিছুক্ষন অভ্রের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দেখে হাঁটা ধরলো নিজের মতো করে। সাথে হাঁটতে হাঁটতে আবারও বললো তাঁর বিড়াল ছানাটাকে,

‘ জানিস তো এই অারুর ভাই অভ্র মানুষটা ভিষণই ভালো। আমায় কতবার যে হেল্প করলো হিসাব নেই। তবে আজও বুঝলাম না উনি আমায় ব্ল্যাকবেরি কেন ডাকে, সেই প্রথম দিন থেকেই এই নামটায় ডাকে আমায়। কেন ডাকে বলতো কখনো জিজ্ঞের করা হয় নি তবে সেইভাবে কখনো সুযোগ মিললে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবো ওনায় কেন উনি আমায় মিস ব্ল্যাকবেরি বলে ডাকে।’

এইরকম নানা কিছু বলতে বলতে এগিয়ে চললো আদ্রিজা। আজ কেন যেন কথা না বলে থাকতেই পারছে না আদ্রিজা। পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি।’

কথাটা ভেবে আদ্রিজা নিজেই হেঁসে ফেললো। প্রেমে ছ্যাক খেয়ে মাথা বোধহয় পুরোপুরিই গেছে তাঁর।’

____

জমজমাট ক্যাম্পাস। ফুড়ফুড়ে বাতাস বইছে চারপাশে। সকালের সোনালি রোদ্দুরে ভরে গেছে ক্যাম্পাসের প্রতিটি রুমসহ লাইব্রেরির কর্নার-শর্নার সাথে মাঠের আনাচে কানাচের সব জায়গা। মানুষে ভর্তি আজ পুরো ক্যাম্পাস। বিষয়টা না যতটা সুন্দর তাঁর থেকেও চেঁচামেচির সোরগোলে যেন আরো বিরক্তকর। আর এসবের ভিড়েই নিজ ডিপার্টমেন্টের নিজ রুমের একদম শেষ বেঞ্চের আগের বেঞ্চটার জানালার ধারে চুপচাপ বসে আছে আদ্রিজা। মনটা ভীষণই খারাপ তাঁর কারন কালকের তাঁকে দেখতে আসা ছেলেপক্ষের নাকি তাঁকে পছন্দ হয়েছে আর আগামী পনের দিনের মাথাতেই পাত্রপক্ষ নিজ বাড়ির বউ বানিয়ে আদ্রিজাকে ঘরে তুলতে চায় দ্রুত। আদ্রিজা বুঝে না এত তাড়াহুড়োর কি আছে। ধীরে সুস্থেও তো করা যায় সবটা।’

আজ হুট করেই কোনো এক বিশেষ কারনে ক্লাস অফ ভার্সিটির। যার দরুন ডিপার্টমেন্টের সব ছেলেমেয়েরাই বর্তমানে মাঠে। ক্লাসে তেমন কেউ নেই বললেই চলে। আদ্রিজার ক্লাস রুমেও কেউ নেই। পুরো রুম ফাঁকা। তাঁর বন্ধুমহলের সবাই বর্তমানে নিচে আছে। তাঁকেও যেতে বলেছিল কিন্তু আদ্রিজা যায় নি। হুট করেই এত দ্রুত বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে বিষয়টা যেন মেনে নিতে পারছে না আদ্রিজা। আজ যদি শ্রাবণ তাঁকে ধোঁকা না দিত তাহলে হয়তো বিষয়টা অন্যরকম হতো। আপাতত বেশি ভাবলো না আদ্রিজা। হয়তো তাঁর ভাগ্যে কালকের দেখা ছেলেটাই ছিল। ছেলেটার নামটা যেন কি ছিল? হুম মনে পড়েছে আদনান। ছেলেটার চেহারাও ঠিকভাবে দেখে নি আদ্রিজা, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে কাল একটু ঠিকভাবে তাকালো উচিত ছিল ছেলেটার দিকে। যাগ গে বিয়ে তো হয়েই যাবে তখন না হয় দেখে নিবে।’

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো শরীফ,সিফাত, তুলি, বুশরা, আশিক আর আরু। আশিক তো দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

‘ বাড়ির সামনে খাঁচায় বন্দী এক ঝাঁক টিয়া,
কিছুদিনের মাথাতেই আমাদের আদ্রিজা আফার হইবে বিয়া।’

‘ উঠান ভর্তি বালু, কইছে খালু,
আদ্রিজা আফার বিয়ায় গিফট দিমু এক কেজি আলু।’

আশিকের কবিতায় চরম বিরক্ত হলো আরু। কিন্তু চাইলেও এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারলো না আর। কারন একটাই ওই যে বিয়ে ভাঙার শর্ত। তবে চাইলেই কি আরু চুপ থাকতে পারে আশিকের এমন কবিতা শুনে তাই গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ খালি আলু কেন, পটল, সরিষা, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ, আদা, সয়াবিন তেল সব দিস।’

আরুর কথা শুনে আশিক আরুর দিকে তাকিয়ে গলা ঝাড়া দিয়ে বললো,

‘ আমি জানি আরু ছুনা তুমি ভিতরে ভিতরে রেগে যাচ্ছো তাইরে নারে না,
কিন্তু যতই রাগো আমি থামমু না না থামমু না না।’

আরু কন্ট্রোল করলো নিজেকে। মনে মনে বললো কন্ট্রোল ইয়োর সেল্ফ আরু। তুই শুনিস নি আশিকের ওই থার্ড ক্লাস কবিতা। এই বলে আদ্রিজাকে উদ্দেশ্য করে বললো আরু,

‘ তুই কি বিয়েটায় রাজি আছিস আদ্রিজা?’

উওরে এতটুকু বলা আদ্রিজার,

‘ রাজি না হওয়ার কি আছে।’

‘ কিন্তু তোর চোখ মুখ তো বলছে না তুই রাজি।’

‘ সবক্ষেত্রেই যে রাজি হওয়াটা জরুরি এমনটা তো নয়। যেখানে আমার রাজি হওয়া বা না হওয়ার কোনো গুরুত্বই মেটার করে না। সেখানে রাজি হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

‘ তুই কি আঙ্কেল আন্টির ওপর রেগে আছিস?’

‘ না রাগ করবো কেন? ওনারা তো আমার ভালো জন্যই করছে।’

‘ তুই বিয়েতে রাজি না হলে বল, আশিকের মতো কোনো হাবলাকে দিয়ে আমার মতো তোর বিয়েটাও ভেঙে দিবো।’

আরুর কথাটা বুঝতে আশিকের দু’সেকেন্ড সময় লাগলো। পরক্ষণেই বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,

‘ তুই আমাকে হাবলা বললি আরু।’

‘ এ বাবা তোকে হাবলা বলার এত বড় সাহস আমার আছে নাকি। এখন তুই চুপ থাক। আদ্রিজার কথা শুনতে দে।’

বলেই আদ্রিজার দিকে তাকিয়ে বললো আরু,

‘ এখন তুই বল আদ্রিজা?’

আরুর কথা শুনে আদ্রিজা খানিকটা অবাক হয়ে বললো,

‘ কি বলবো?’

‘ কি বলবি মানে এটা বলবি তুই এই বিয়েতে রাজি কি না। রাজি না হলে বল বিয়েটা যেভাবে হোক আমরা মিলে ভেঙে দিবো।’

উওরে আদ্রিজার বলে উঠল,

‘ না। আমি রাজি। কি দরকার উটকো ঝামেলা করার। তার চেয়ে তোরা প্রস্তুতি নে, বিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি।’

আদ্রিজার কথা শুনে আশিক খুশি হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,

‘ উড়ে মামা,
জামাই রাজি, বউ রাজি
এইবা আমি ডাকমু কাজী।

‘ কতদিন পর খামু বিয়া,
বাসর সাজামু আমার আরু ছুনারে নিয়া।’

‘ আরু ছুনা তুমি আর কইরো না ভ্যান ভ্যান।’
বিয়া খামু সাথে নাচমু ধেনোর ধ্যান ধেনোর ধ্যান!’

মারো তালি,

কাম সারছে এতক্ষণ আরু নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও এবার আর পারলো না। রাগে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো তাঁর। তক্ষৎনাত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে আশিকের দিকে তেঁড়ে যেতে বললো আরু,

‘ শালা আজকে তোর মারো তালি বার করছি দাঁড়া তোর থার্ড ক্লাস কবিতার গুষ্টি তুষ্টি।’

হুট করেই আরুকে চেঁচাতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠল আশিক,

‘ এটা কিন্তু কথা ছিল না শর্ত ছিল কিন্তু,

‘ তোর শর্তের নিকুচি করছি, বান্দর পোলা।’

বলেই দৌড়ে গেল আরু আশিকের দিকে। আর আরুর কাজে আশিকও ভয় পেয়ে পিছনে দৌড়ে যেতে যেতে বললো,

‘ ভিতর থেকে ঘাবড়ে গেছি, আরু ছুনা দৌড়ে আসছে তাও তাও
চারপাশে কিছু দেখি না ভাই মোরে কেউ বাঁচাও বাঁচাও।’

বলেই আশিক দৌড়। আর আরু সেও চললো আশিকের পিছন পিছন। আজ আর আশিকের নাক আস্তো থাকবে না। আরু ফাটিয়েই ছাড়বে।’

এদের কান্ডে আদ্রিজা বাদে বাকি সবাই উচ্চ স্বরে হেঁসে দিয়ে বললো,

‘ এঁরা দুজন আর ঠিক হবে না।’

____

সন্ধ্যার সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগে। রাত হচ্ছে ধীরে ধীরে। সোফায় বসে সবেমাত্র টিভিটা অন করে দেখছিল আরুর মা। এমন সময় আরু এসে বসলো মায়ের পাশে। তারপর সোফায় শুয়ে কোলে মাথা রাখলো মায়ের। তারপর বললো,

‘ আচ্ছা মা মেয়েদের কি বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের না করলে হয় না?’

হুট করেই মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে খানিকটা চমকে উঠলো আরুর মা। টিভির ভলিউমটা কম করে রিমুটটা পাশে রেখে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন উনি,

‘ হঠাৎ এমন কথা কেন মা।’

উওরে নিশ্চুপ কন্ঠ নিয়ে বলে উঠল আরু,

‘ আদ্রিজার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মা আর কিছু দিনের মাথাতেই আদ্রিজাকে বউ করে পাত্রপক্ষরা নিয়ে যাবে তাদের সাথে।’

আরুর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো আরুর মা,

‘ কবে হলো এসব?’

‘ কাল।’

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো অভ্র। আরুর শেষের কথাটা শুনে বললো সে,

‘ কি হয়েছে কাল?’

হুট করেই অভ্রের কন্ঠ শুনে আরুর মা আর আরু দুজনেই হকচকিয়ে উঠে তাকালো অভ্রের দিকে। আর আরু বললো,

‘ তেমন কিছু না ভাইয়া ওই আদ্রিজা আছে না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে কাল দেখতে এসেছিল। পাত্রপক্ষের নাকি ওকে পছন্দ হয়েছে খুব শীঘ্রই বিয়েটা হয়ে যাবে আদ্রিজার।’

‘আদ্রিজার বিয়ে’ কথাটা শুনতেই যেন মন মস্তিষ্ক সব আঁটকে গেল অভ্রের। বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে নিশ্চুপ কন্ঠে বললো সে,

‘ ব্ল্যাকবেরির বিয়ে?’

#চলবে….