গোধূলি বেলায় প্রেম পর্ব-৪৫ এবং অন্তিম পর্ব

0
3849

#গোধূলি_বেলায়_প্রেম
#ফাবিহা_নওশীন

|অন্তিম পর্ব|

রীতি বিছানার মাঝখানে বসে আছে।কিছুক্ষণ আগেই সাদিবকে স্বপ্নে দেখেছে। কি সুন্দর সেই হাসি। চোখের সামনে এখনো তার হাসি মুখটা ভাসছে। অজান্তেই রীতির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।
শুভ্র সাদা পোশাকে সাদিবকে কত নির্মল ও পবিত্র লাগছিল।
রীতি উঠে কিচেনে গিয়ে কড়া লিকারে এক কাপ চা বানিয়ে ছাদে গেল। কিছুক্ষণ পরেই ভোরের আলো ফুটবে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে ঝাকে ঝাকে।
রীতি আজ সূর্য উঠা দেখবে। প্রতিদিন তো গোধূলি দেখে,আজ নাহয় সূর্য উঠা দেখবে। ঠান্ডা বাতাস বইছে।

.

কেন্দ্রে সাদিবের দূর্বিষহ দিন কাটছে। নেশাগ্রস্ত পাগল মানুষগুলোর সাথে একদম থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে পালিয়ে যেতে। এমন কড়া নিয়মের মধ্যে কখনো থাকে নি। কেউ অবাধ্য হলে মোটা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। একটু হেরফের হলেই কঠিন শাস্তি। মনো বিশেষজ্ঞদের দ্বারা কাউন্সেলিং চলছে। তবে এসবের মাঝে ভালো লাগে তাদের মোটিভেশান কথাগুলো শুনতে। নতুন করে বাচার আশা জাগে। তখন মনে হয় হ্যা আমি পারব।
সাদিব নিজের পরিবার আর রীতিকে খুব মিস করছে।
কিন্তু নিজের সাথেই নিজে প্রতিজ্ঞা করেছে সুস্থ হয়ে তবেই রীতির সামনে দাঁড়াবে। সেই পুরনো সাদিব হয়ে ফিরবে। আর সেই প্রতিজ্ঞার জন্য এখানে পড়ে আছে নয়ত এই জায়গায় থাকত না। যেবাবেই হোক পালাত।

.

রীতির মা সকাল থেকে খুব ব্যস্ত। উনার ভাই-ভাবিরা এসেছেন। তাদের সমাদরে ব্যস্ত নন। বরং তারাই উনার সাথে হাত লাগিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। রীতি শুধু দেখছে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছেনা।
আর না ওর এ-সবে কোনো আগ্রহ আছে। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে ঘর
জুড়ে পাইচারি করছে।

.

বিকেলে বাগানে ঘাসের উপর রীতি বসে আছে। আর ওর মা বারবার ডাকছে।
“উফফফ! এত ডাকাডাকি করছে কেন? শান্তিতে একটু বসতেও পারব না? যাব না আমি।”

আজ কেন জানি ওর খুশি খুশি লাগছে।
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে….
গান গাইতে গাইতে রীতির বেলীফুল গাছের দিকে চোখ গেল। উঠে দাড়িয়ে ভ্রু কুচকে গাছের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ফুল কেন ফুটে না? এই গাছ তুই কবে ফুল দিবি?”

“সময় হলেই দিবে। জোর-জবরদস্তি করবে নাকি?”
কারো মোলায়েম কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ঘুরে কয়েক হাজার বোল্ডের ঝাটকা খেল রীতি।
চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে সামনে থাকা কালো কোর্ট পড়া ছেলেটার দিকে।

রীতিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে ওর চোখের সামনে চুটকি বাজাল।
“কি এমন বোকার মতো চেয়ে আছো কেন?”

রীতি থতমত খেয়ে গেল।তারপর ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগল,”আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নাকি কল্পনা করছি?”

সাদিব ওর চোখের সামনে আবার চুটকি বাজাল।
রীতি আবারও ফ্যালফ্যাল করে সাদিবের দিকে চেয়ে আছে।
সাদিব ভেবেছিলো রীতি ওকে দেখে চমকে যাবে। কত খুশি হবে। খুশির কারণে আত্নহারা হয়ে কথা বলতে পারবে না। চোখে পানি চলে আসবে। কিন্তু না সে তো ক্ষনে ক্ষনে হারিয়ে যাচ্ছে।

রীতি সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“সাদিব আপনি কি এখানে আছেন? ”

সাদিব ওর কথা শুনে ভরকে গেলো।
তাই ধমকের সুরে বলল,
“এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তো?”

রীতি ধমক খেয়ে বলল,”ধমকাচ্ছেন কেন?আপনি সত্যি আছেন নাকি স্বপ্ন দেখছি? বলুন,বলুন।”

সাদিব হা করে চেয়ে আছে। তারপর মুচকি হেসে বলল,” বোকা মেয়ে আমি সত্যিই আছি। স্বপ্ন নয়। এই দেখো দাঁড়িয়ে আছি।”
তারপর ও সামনে পেছনে ঘুরে নিজেকে দেখাচ্ছে। রীতি উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“আপনি চলে এসেছেন? তারপর আপনি সত্যি আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন? ও আল্লাহ! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”

রীতি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে সাদিবকে জড়িয়ে ধরলো। হটাৎ করে দৌড়ে জড়িয়ে ধরায় সাদিব পরে যাচ্ছিলো।নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে তার প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরলো।
“এই মেয়ে ছাড়বে না? কেউ দেখবে তো।”
রীতি ওকে ছেড়ে দাড়িয়ে ওকে ভালো করে দেখছে। স্বপ্নে যেমন দেখেছিলো একদম তেমন। সেই হাসি,সেই মুখ, সেই উচ্ছ্বাস।
রীতির এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে সাদিব দুষ্ট হেসে বলল,”লুচু মেয়ে এভাবে কি দেখছো?”

রীতি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো। লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে লাগল।
সাদিব ফিক করে হেসে দিলো।

তারপর ওর হাত ধরে বলল,”চলো সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

ওরা দু’জন উপরে গেল।রীতির মা মেয়েকে দেখে বলল,”দেখো মেয়ের কান্ড।কখন থেকে ডাকছি।মেহমান এসে পড়েছে আর ও রেডি হয়নি এখনো।”

রীতিও গাল ফুলিয়ে বলল,”তুমি জানতে আজ সাদিব আসবে? সব জানতে। তাই তো এত আয়োজন।আমাকে বলো নি কেন?”

রীতির মা সাদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,”সামলাও। তোমার সারপ্রাইজের চক্করে ওকে কিছু বলি নি।”

সাদিব আলতো হেসে বলল,”রীতি যাও সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে এসো। তোমার জন্য বড় একটা সারপ্রাইজ আছে। নয়তো সেটাও মিস করে ফেলবে।”

রীতি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। কিন্তু ওর মা কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল।

সাদিব তিনমাস পর কেন্দ্র থেকে ফিরেছে। এখন আবার নতুন করে নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিং করছে। রীতিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কিছুই বলে নি।

রীতি শাড়ি পড়ে সেজেগুজে সবার সামনে হাজির। সাবিহা রীতিকে তৈরি হতে সাহায্য করেছে। রীতি সাদিবের মা-বাবাকে সালাম জানাল।
সাদিবের মা মুচকি হেসে রীতিকে নিজের কাছে বসিয়ে বলল,”তোমার হাতটা দেখি রীতি।”

রীতি কিছুই বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে দিল। সাদিবের মা হাসি প্রসারিত করে ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে রীতির হাতে পড়িয়ে দিল।
রীতি বড়বড় চোখ করে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর উপস্থিত সবার দিকে তাকাল। কারো চোখে-মুখে বিস্ময় নেই। এর মানে সবাই সবটা জানে। অথচ যার বিয়ে তার খবর নেই টাইপ।

সাদিব-রীতি ছাদে পাশাপাশি বসে আছে।
সাদিব রীতিকে আলতো করে ধাক্কা মেরে বলল,”কি মেডাম, আপনার অনুভূতি কি এই মুহুর্তে? ”

রীতি সাদিবের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো লজ্জায়।

“ওহে, লজ্জাবতী রীতিকা আধা আমার হয়ে গেছো। বিয়ে নামক প্রসেসটা হয়ে গেলে তুমি সম্পূর্ণ আমার। এখন সেই দিনের অপেক্ষায়। যার জন্য আমি এত কষ্ট করেছি।”

রীতি সাদিবের কথা শুনে মুখের দিকে তাকালো।
সাদিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”জানো ওই সব দিনের কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। কতটা কষ্ট করেছি।”

রীতি সাদিবের কাধে হাত রেখে বলল,
“সকল দুঃখের দিন শেষ। এখন আমাদের সুখের দিন। অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। অনেক সেক্রিফাইজ করেছি।আমাদের ভালোবাসার পথে অনেক বাধা এসেছে, দুঃখ এসেছে। অনেক কষ্ট পেয়েছি। সব শক্ত হাতে লড়াই করে জয় করেছি। তাই এখন আর কোনো দুঃখ নয়।”

“হুম, তোমার কয়েকদিন পরে ফাইনাল পরীক্ষা। তারপর আমাদের বিয়ে। উফফ, ভাবতেই ভালো লাগছে।”

রীতি সাদিবের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।

.

৫বছর পর। রীতি অফিস থেকে ফিরছে। রীতি বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আজ ও প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। রীতি গাড়ি থেকে নেমে দরজার সামনে যেতেই সাদিব পেছন থেকে ডাকলো।
রীতি ঘুরে তাকালো। কিন্তু সাদিব ওর কাছে এসে ওকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো।রীতি কিছু বুঝতে পারছে না। দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় রীতিও দৌড় দিল।

সাদিব রীতিকে দৌড়ে ভেতরে আসতে দেখে সাদিবের মা ওদের বলল,” তোরা দৌড়াচ্ছিস কেন?”

ওদের দু’জনের চোখ তখন রিদানের দিকে।রিদান ওদের দু-বছরের ছেলে। দাদার কোলে খেলছে।
সাদিব আর রীতি রিদানের দিকে এগুতেই সাদিবের মা দু’জনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় বলল,”তোদের সাহস তো কম না। বাইরে থেকে এসে এভাবে আমার ভাইয়ের কাছে আসছিস। যা ফ্রেশ হয়ে আয় আগে। এভাবে যদি আর রিদানের কাছে আসার চেষ্টা করিস তবে তোদের দুজনকে বাড়িছাড়া করব।”

সাদিব আর রীতি ধমকি খেয়ে বাড়ির বাকিদের দিকে তাকালো। সাবিহা সদ্য বিবাহিত। ও ওর বর নিয়ে বেড়াতে এসেছে। মারিয়া আপুর ছোট ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। অভির বোন অরি।
সবাই ওদের থমথমে মুখ দেখে মুখ টিপে হাসছে।
রীতি আর সাদিব নিজেদের রুমে চলে গেলো।
সাদিব রুমের ভেতরে গিয়ে বিছানায় বসে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রীতির গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সাদিবের গলা দাবিয়ে দিতে। দাতে দাত চেপে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই সাদিব ওকে দেখে আবারও হাসতে শুরু করল।

“আরে আপনি তো ভারী অসভ্য। আপনার জন্য ধমক খেলাম আর আপনি হাসছেন?”
রীতি গাল ফুলিয়ে বলল।

সাদিব আবারও হাসছে।
রীতি রাগে গজগজ করতে করতে বলল,”আপনার সাথে কথা নেই আমার।”

রীতি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে নিচে চলে গেল।

রীতির ফাইনাল পরীক্ষার পর দু-পরিবারের সম্মতিতে ওদের বিয়ে হয়।বিয়ের পরে বিসিএস পরীক্ষা দেয়।পাশাপাশি পড়াশোনাও শেষ করে।

রীতি গিয়ে রিদানকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। সাদিব রীতির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু রীতি পাত্তা দিচ্ছে না।
রিদানকে সাবিহার কাছে রেখে রীতি ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সন্ধ্যা নেমে আসছে। রীতি নিচের দিকে তাকালো। সাদিব রীতিকে যেমন কথা দিয়েছিলো তেমনই নতুন বাড়ির এক পাশে বেলীফুলের বাগান করেছে। সাদা বেলী ফুলগুলো দূর থেকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ফুলের জন্য সবুজ পাতা ঢেকে পড়েছে। রীতি মনোযোগ দিয়ে ফুলগুলো দেখছে।
তখনই সাদিব রীতির পাশে ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপ রাখলো। রীতি চায়ের কাপ দেখে সাদিবের দিকে তাকালো। ওর হাতেও চায়ের কাপ।
রীতির গালে চুমু খেয়ে বলল,” চা পাগলী তোমার জন্য নিজের হাতে চা বানিয়েছি।আর অভিমান করে থেকো না।”

রীতি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে বলল,”আপনার উপর কি আমি রাগ করে থাকতে পারি? আপনি যে আমার গোধূলি বেলার প্রেম।”

সাদিব রীতির হাতের উপর হাত রেখে হালকা হাসল।তারপর বলল,”অসাধ্য সাধন হয়েছে তোমার জন্য।তুমি আমার হাতটা ধরে রেখেছিলে তাই আজ আমরা এখানে এক সাথে গোধূলি দেখছি।”

দূর দিগন্তে রক্তিম আভা ফুটে আছে।গোধূলির শেষ সময়। কিছুক্ষণ পরে রক্তিম আভা মিলিয়ে যাবে। তারপর অন্ধকার নেমে আসবে। আবারো নতুন এক গোধূলির অপেক্ষায় থাকবে এই মানব-মানবী। তাদের প্রেম গাথা তৈরি করবে এই গোধূলি। হাজারো প্রেম-ভালোবাসা,রাগ,অভিমানের সঙ্গী এই গোধূলি বেলা।

“গোধূলি লগ্নে দূর প্রান্তে খোজে দেখো
পাবে আমায় সেই চিরচেনা রুপে।”

সমাপ্ত