ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা ৬ষ্ঠ পর্ব

0
2305

#ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা

৬ষ্ঠ পর্ব

তূর্য এসে হন্তদন্ত হয়ে মোহর কে কোলে তুলে নিলো। হঠাৎ তার পাশের কোলাজের সেই বড় ফ্রেমটির উপরে চোখ গেলো। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে সে মোহরকে নিয়ে বেড় হয়ে গেলো। তারপর ডাক্তার কে কল করে ডাকালো। ডাক্তার এসে মোহরকে ভালোভাবে চেকাপ করে দেখলো। মোহরের তখনো জ্ঞান ফেরেনি।

ডাক্তার তূর্য কে বললো,

>>উনি প্রচন্ড টেনশনে আছেন। অনেক দিন ঠিকমত ঘুমাননি। হয়তো না খেয়েও আছেন। প্রচন্ড দূর্বলতা ও মানুষিক চাপে ভুগছেন।শারিরিক ভাবে আঘাত করবেন না। উনাকে যথাসাধ্য পারেন হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবেন।

>>আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।

ডাক্তার চলে গেলেন। মোহরের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো তূর্য।তূর্যের সকালে চেপে ধরায় গালে হালকা কালচে ছাপ বসে গিয়েছে। সেই সাথে একরাশ ক্লান্তির ছাপ তার মুখে। হাসতে ভুলে গিয়েছে মেয়েটা। অথচ মোহরের হাসির প্রেমেই পড়েছিলো তূর্য। সেই কলেজ লাইফ থেকে এখনো সে তূর্যের সাথে। ১বছরের প্রেম আর ৮বছরের সংসার। সুখে শান্তিতেই ছিলো তারা কিন্তু তিন বছর আগের সেই ঝড়টি সব নষ্ট করে দিলো। সেই সাথে বদলে গেলো তূর্য আর মোহরের ভালোবাসার সংসার টাও।তূর্য নিজেকে সামলে নিলেও মোহর পারেনি। তূর্য নিজেকে প্রতিশোধ এর আগুনে পোড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আর মোহর নিজেকে দিন দিন তূর্য থেকে গুটিয়ে নিতে। মোহরের প্রতি বড্ড অবহেলা করে সে। এক ঘরে থেকেও যেন ওরা নিজেদের থেকে অনেক দূরে সরে থাকে। অনেককে হারিয়েছে তূর্য এখন শুধু মোহরই আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। ব্যাল্কুনি তে গিয়ে একটি সিগারেট ধরায় এরপর টানতে থাকে। কিন্তু তার নিজের অজান্তেই তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তূর্যেরও একটা মন আছে যা পাথরে পরিণত। যা তূর্য কে আজকের তূর্যে রূপান্তরিত করে অমানুষ বানিয়ে ফেলেছে।

জোহরের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই মোহরের জ্ঞান ফিরলো। মোহর উঠে বসে একবার চারদিকে চোখ বুলালো। তার সামনেই তূর্য সোফায় বসে ল্যাপটপে ব্যস্ত। মোহর উঠে যেতে নিতে লাগলেই তূর্য বলে উঠলো,

>>শুয়ে থাকো উঠার প্রয়োজন নেই।

>>আমি নামাজ পড়বো।

>>আচ্ছা। নামাজ পড়ে একটু এসো কথা আছে।

>>আচ্ছা।

মোহর চলে গেলো। যাওয়ার আগে ওহীর রুমে গেলো দেখলো ওহী ঘুমুচ্ছে। তারপর সে নিজের রুমে গিয়ে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে নামাজ পড়ে নিলো। এরপর গেলো তূর্যের কাছে। তূর্য মোহর কে দেখে বললো,

>>এসো বসো।

মোহর গিয়ে তূর্যের পাশে বসলো। পরক্ষণেই একজন সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেলো। তূর্য ল্যাপটপ এক সাইডে রেখে দিয়ে খাবারের প্লেট থেকে খাবার তুলে মোহরকে খাইয়ে দিতে নিলো। মোহর কিছু টা অবাক হলো কিন্তু চুপচাপ খেয়ে নিলো। মোহরের খাওয়া শেষ হলে তাকে পানি খাইয়ে দিলো। তারপর তূর্য কে জিজ্ঞেস করলো,

>>তুমি খেয়েছো?

>>হুম।

তূর্য গ্লাস টা রেখে হঠাৎ মোহর কে জড়িয়ে ধরলো। মোহর এবার বেশ অবাক হলো। তার মধ্যে জড়তা কাজ করছে। এভাবে তূর্য তাকে কবে জড়িয়ে ধরেছিলো সে ভুলেও গিয়েছে। মোহর ও আর কিছু না ভেবে তূর্য কে জড়িয়ে ধরলো। তূর্য লক্ষ্য করলো তার শার্টের কাধেঁর একপাশ ভিজে যাচ্ছে। তার মানে মোহর কান্না করছে। তূর্য বাধন খুলে মোহরের চোখের পানি মুছে দিলো। এরপর তার কপালে একটি চুমু খেলো।

এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ গড়িয়ে গেলো।
ওহী এখন অনেক টা সুস্থ। এই সপ্তাহে সে একবার ও তূর্য কে আর দেখেনি। মোহরের সাথে গল্প করেই দিন কাটে তার। মোহর ও এখন বেশ স্বাভাবিক। তূর্য যথাসাধ্য মোহরকে ভালো রাখার চেষ্টা করছে। আর এদিকে ওহীকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা করছে।
আনাস সাহেব ও এখন খানিকটা সুস্থ হয়েছেন। অগ্নি যথাসম্ভব পারছেন তাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করছে। আর ওহীর খোঁজ ও চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাও বিফলে সব।
ওহী এতদিনে একবার ও বাসাই কল করতে পারলো না। তাকে এখানে কেন এনে আটকে রাখা হয়েছে তাও সে জানেনা। মোহর কে এসব জিজ্ঞেস করলে মোহর বরাবরই তা এড়িয়ে যায়।

ওহীর ইদানীং মনে হচ্ছে সে হয়তো মা হতে যাচ্ছে। এই মাসে ডেট মিস গিয়েছে আর ইদানীং বমি ও হচ্ছে।
সে ব্যাল্কুনি তে বসে বসে এসব ভাবছিলো। মোহর দু’কাপ কফি নিয়ে এসে তার পাশে বসলো।

>>কি ভাবছো?

>>না তেমন কিছুনা আপু। আমার মনে হচ্ছে আমি হয়তো কন্সিভ করেছি। কিন্তু এখনো শিউর নয়।

এই কথা টি শুনে মোহরের ভেতর টা ধুক করে উঠলো। মোহর উঠে পড়লো। তারপর চলে গেলো। মোহরের আচমকা এভাবে চলে যাওয়া টাই ওহী ভীষণ অবাক হলো।
মোহর নিজের রুমে এসে আলমারি খুলে কি যেন খুঁজতে লাগলো। তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। অবশেষে সে পেয়ে গেলো। সে চোখ মুছে আলমারি টা তালা মেরে আবারো ওহীর কাছে ফিরে এলো।
মোহর এসে ওহীর হাতে একটি প্রেগন্যান্সি কীট ধরিয়ে দিয়ে বললো,

>>যাও চেক করে আসো।

ওহী সেটি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। তারপর চেক করে দেখলো রেসাল্ট পসেটিভ। খুশিতে ওহী কেঁদেই দিলো। দৌড়ে এসে মোহর কে জড়িয়ে ধরলো।

>>আপু সত্যিই আমি কন্সিভ করেছি। আমি মা হতে চলেছি।

ওহীর খুশি দেখে মোহরের মনেও অনেক আনন্দ হচ্ছে। সেও ওহীকে জড়িয়ে ধরলো।

>>জেনে খুশি হলাম। আল্লাহ তোমার উপর রহমত করুক।

ওহী মোহর কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জোরে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে তার। মোহর ওহীকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। তারপর এক গ্লাস পানি এনে তাকে খাইয়ে দিলো।

>>এই মেয়ে কাঁদছো কেন এভাবে? তুমি কি খুশি নও?

>>না আপু আমি অনেক খুশি। কিন্তু এই খুশির খবর টা অগ্নি কে দিতে পারছিনা। খুব ইচ্ছে হচ্ছে অগ্নিকে বলতে সে বাবা হতে যাচ্ছে কিন্তু…

>>উঁহু একদম কাঁদবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো আমি তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করবোই।

এই কথাটি শুনে যেন ওহী কিছু টা সাহস পেলো। ওহী কিছু টা স্বাভাবিক হওয়ার পর মোহর আর ওহী আবারো গল্প জুড়ে দিলো।
মোহর ওহীকে বললো,

>>অগ্নিকে বুঝি খুব ভালোবাসো?

>>হ্যাঁ খুব। সেই ছোট থেকেই।

এই কথাটি বলে ওহী কিছুটা লজ্জা পেলো।
আর মোহর কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

>>ছোট থেকে মানে?

>>মানে খুব ছোট থেকেই অগ্নি আর আমি একসাথে। বড় হওয়ার পরেও আমরা একসাথে। অগ্নির বাবা আর আমার বাবা খুব ভালো বন্ধু ছিলেন তাই সে সুবাদে তার আর আমার বিয়ে টা তখন থেকেই ঠিক ছিলো।

ওহীর কথায় মোহরের কিছুটা খটকা লাগলো, সে আবারো প্রশ্ন করলো,

>>আচ্ছা অগ্নি ছাড়া কি কাউকে কখনো ভালোবেসে ছিলে? কারো সাথে কি সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলে?

>>এর প্রশ্নই আসেনা। অগ্নিকে ছোট থেকেই ভালোবাসতাম। তাই একমাত্র সেই ছিলো আমার জিবনে। আর অন্য কেউ আসার বা কারো সাথে সম্পর্কে জড়াবার তো কারণই নেই।

ওহীর কথায় মোহর উঠে দাঁড়ালো। ওহীর হাত ধরে বললো,

>>চলো আমার সাথে।

তারপর ওহীকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।

>> কিন্তু কোথায় আপু?

>>চলো ওহী তুমি আজ সব কারণ জেনে যাবে আমার সাথে এসো।

মোহর ওহীকে নিয়ে লাইব্রেরি তে ঢুকলো। তারপর ওহীকে দেওয়ালের সেই বড় ফ্রেমের ছবিটির সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।
ওহী এক পলক সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। সেই মানুষটা তার অনেক চেনা। নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে পানি এসে গেলো।

চলবে……

#Razia_Binte_SuLtan