#জলফরিং
#রোজা_ইসলাম
#পর্ব ২
—” কিরে ইরা ফিরা এভাবে বসে আছিস কেন! যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবি কাউকে? ”
সত্যি ইরা রাদকে কাছে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো নিশ্চিত৷ সেদিনের পর আরও সাতটা দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে রাদ একটা টেক্স পর্যন্ত করেনি। ইরাও আর যেচে ফোন দেয়নি৷ কিন্তু কষ্ট গুলো আর চেপে রাখতে পারছে না ও৷ যখন তখন বেহায়ার মতো চোখ দিয়ে অশ্রু চলে আসে। খেতে পারে না। ঘুমাতে পারেনা। পড়াশোনায় বিরক্তি চলে এসেছে। কোনও রকম ভার্সিটিতে ক্লাস করে বাড়ি ফিরে। চোখ মুখের অবস্থা নাজেহাল। এসব বাড়ির সবার চোখে পরছে৷ যার জন্য কড়া প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওকে। কিন্তু ওর শুধু কান্না পাচ্ছে কিন্তু কারো সামনে কান্নাটুকু কাঁদতে পারছেনা। এ কেমন দমবন্ধ যন্ত্রণা। যা কাউকে বলাও যায়না সহ্য করাও যায় না!
আবারো চোখ টলমল করে উঠলো ওর। কোনও রকম নিজেকে সংযত করে পাশে বসা আদনানকে একনজর দেখে মলিন স্বরে বলল,
—” কি হবে আমার। তোর অপেক্ষা করছিলাম তোকে কাঁচা চিবিয়ে খাবো বলে। ”
আদনানের দৃষ্টি তখন অন্য কোথাও। হাঁ করে ক্যান্টিনের দরজায় তাকিয়ে থেকেই ইরা উদ্দেশ্য করে তড়বড় কণ্ঠে বলল,
—” রাখ তোর খাওয়াদাওয়ার। ঐ দেখ আগুন সুন্দরী এক্কেবারে। দেখনা!আমার সাথে মানাবেনা বল? ”
ইরা ভ্রু কুঁচকে পিছনে ফিরে ক্যান্টিনের দরজায় তাকালো আগুন সুন্দরী বলতে কাউকে চোখে না পরলেও। যাকে চোখে পরেছে তাতে ও হতভম্ব, বিমূঢ়, বাকরুদ্ধ। রাদ ওর দিকেই গম্ভীরমুখে তাকিয়ে দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ! ইরা দ্রুত সামনে ফিরলো৷ বক্ষস্পন্দনের মাত্রা বেড়েছে, বুক ধুকপুক করছে৷ মস্তিষ্কে প্রশ্নের রাশি তৈরী হচ্ছে। রাদ এখানে ওর সাথে দেখা করতে এসেছে? না এটা হতেই পারেনা। রাদ জানে মীতি এই কলেজেই পরে৷ তাই ওরা কখনওই ভার্সিটিতে দেখা করেনা। মীতি দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হতে দুদণ্ড সময় লাগবে না। আসলে ভয় মীতি’তে না ভয় আদি’তে।
আদি কখনও ওর এবং রাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারে, তাহলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত। আদি কখনোই ওর রাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না। না বাড়ির কাউকে মানতে দিবে। আর আদির না মানে না। সেটা কখনোই হ্যাঁ-তে পরিনত হতে পারেনা। ছেলেটা বড্ড কড়া স্বভাবের। তার প্রথম সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত! তবে আদি’কে ইরা কখনোই ভয় পায়নি। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে ভয় ওকে জেকে ধরছে। আদির ভয়! অন্যদিকে রাদ। যার জন্য হাজার ভয় সেই মানুষটাই করে নয় ছয়৷ কোথায় যাবে ও! প্রেম কেন করে মানুষ? এত প্যারা এক সাথে নিতে? রাগে মাথায় আগুন ধরে গেলো ইরার। কিন্তু রাগ দেখানোর মানুষটাও নেই৷ অভিমানে আর পিছনে তাকায় না ইরা! ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বলল,
—” আদনান চল আজ চলে যাই ক্লাস করতে আজ ভালো লাগছেনা। বাদর গুলোতো আসেওনি আজ! ”
কথাটা বলতে বলতে ও আড় চোখে পিছনে তাকালো রাদ আছে নাকি দেখতে। রাদ আছে এখনও দাঁড়িয়ে আছে তবে এবার দৃষ্টি ফোনে নিবদ্ধ পাশেই একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরী মেয়ে! কিন্তু কে এই মেয়ে? রাদ কী ওকে ঠকাচ্ছে? নতুন কাউকে পেয়েছে বলেই ওর সাথে এতো দুরত্ব? ইরার বুক ধ্বক করে উঠলো৷ না রাদ আর যাই হোক এত নিচু কাজ করবেনা ওর সাথে! ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদনানের দিকে তাকালো ছেলেটা উত্তর দিচ্ছেন না কেন৷ পাশে তাকিয়ে দেখে আদনান নেই। কই গেলো ছেলেটা? ইরা টেবিল থেকে কোলাকোলার বোতল হাতে নিলো গলাটা শুকিয়ে গেছে রাদের সাথে মেয়েটাকে দেখে। তৃষ্ণা মেটানোর দরকার। বোতলে এক চুমুক দিতেই ফোন বেজে উঠলো। আদি কল করেছে দেখে নাকে মুখে উঠে গেলো কোক৷ কোনরকম ধাতস্থ হয়ে দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো৷ আদি লেট কিছুই পছন্দ করেনা! পাংচুয়াল অনেক! ইরার ক্ষীন কণ্ঠ,
—” হ্যালো…!”
আদি শান্ত স্বরে বলল,
—” ক্লাস আছে আরও? ”
—” না নেই। ”
আদির সন্দিহান কণ্ঠ,
—” কিন্তু ক্লাস’তো দুটোয় শেষ হয় তোমার?”
ইরা আমতা আমতা করে বলল,
—” না মানে, আজ আমার ভালো লাগছেনা চলে যাবো৷ ”
—” আমি মীতিকে নিতে এসছি। এসো এক সাথে যাবো!”
—” ঠিক আছে!”
আদি ফোন কেটে দিলো। ইরার ফোনে আবার আদনানের কল এলো। ইরা রিসিভ করে রুক্ষস্বরে বলল,
—” বল?”
—” শোন আগুন সুন্দরীর খোঁজে বেরিয়েছি। তুই বাড়ি চলে যা। ”
ইরার রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
—” মেয়ে বাজ কোথাকার! ইতর একটা তুই! ”
আদনান দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
—” দ্রুত বৌবাজ হয়ে যাবো। তারপর বৌ সব ইতরামি ছুটিয়ে দেবে। ব্যাপার না বিউটিফুল!”
ইরা হেসে দিলো! ফোন রেখে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো। পিছনে তাকিয়ে সূক্ষ্মভাবে চোখ বুলালো আশেপাশে নাহ, রাদ নেই। কতদিন পর দেখলো অথচ একটু চোখ ভরে দেখতে পারলোনা। রাদ কেমন ওকে দেখেও একটা কল বা টেক্স দিলো না। ও সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে ও আর এই সম্পর্কটাই রাখবে না৷ না থাকবে এই বদের সাথে সম্পর্ক না থাকবে কোনও কষ্ট!
ভেবেই আশাপাশে রাদকে খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে গেলো ক্যাম্পাস থেকে৷ না এই বদকে আর দেখা যাচ্ছেনা। গেট পেরিয়ে দেখলো আদি অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে৷ চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসলো ও। মীতি ওকে দেখে হাসলো। ওর কোনও পতিক্রিয়া দেখালো না। মীতি গাল ফুলিয়ে বাইরে তাকালো। মেয়েটা পারে শুধু ওর সাথে রাগ দেখাতে। আদি বিনাবাক্য ব্যয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে ততক্ষনে৷
_______
ইরাদের গাড়ি দৃষ্টির বাহিরে যেতেই রাদ গিয়ে কাশিশের গাড়িতে বসলো। কাশিশির রাদের বেষ্টফ্রেন্ড! পাশেই সে বসে। রাদকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে কাশিশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
—” তোর মতো ঘাড়ত্যাড়া প্রেমিক পুরুষ আমি আর দুটো দেখিনি! কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস! ”
রাদ শান্ত কণ্ঠে বিরবির করলো,
—” ভীতু প্রেমিকার এটাই যোগ্য!”
কাশিশ কিছু বলতেই নিচ্ছিলো৷ তার আগেই গাড়িতে একটা মেয়ে উঠে বসলো!
—” স্যরি! লেট হয়ে গেলো একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে গিয়ে। ”
কাশিশ আর কিছু বলল না রাদকে। পিছনে তাকিয়ে বলল,
—” ইটস ওকে, রাহা বেবি! ”
রাহা ফোঁস করে উঠে কাশিশের ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে! ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
—‘ আমি আপনাকে বলিনি রাদ ভাইকে বলেছি!”
কাশিশ আর কিছু বলল না। শুধু বাঁকা হাসলো। এদিকে এদের কথায় কোনও পাত্তা না দিয়ে সেই কখনই রাদ কার স্টার্ট দিয়েছে এবং ভাব খানা এমন সে ড্রাইভ করতে মহা ব্যাস্ত। অথচ চোখে শুধু ইরার শুকনো মুখটা বারবার ভেসে উঠছে! শুকনো ঢোক গিলে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
________
আজ আকাশ ভরা তাঁরার মেলা.. থালার মতো চাঁদ’টা মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলতে ব্যাস্ত! রাত প্রায় বারোটার উপরে। সবার ঘুমের সুযোগ নিয়ে ইরা ছাদে দাঁড়িয়ে। ম্যাসেজ বক্সে বড়সড় একটা ম্যাসেজ লিখেছে রাদের উদ্দেশ্যে। আশপাশের খোলা স্নিগ্ধ বাতাস ওর খোলা চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। চোখ বেয়ে পরছে অশ্রুধারা। আশেপাশে ল্যাম্পপোস্ট এবং চাঁদের আলোয় অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী হয়ে উঠেছে আরো বেশি মোহনীয়। ঠিক তখনি কানের এলো ফিসফিসিয়ে ডাক ওর নাম ধরে,
—” ইরা..!”
ইরা চিৎকার করে উঠলো ভয়ে। খোলা ছাদে চিৎকারের শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো যেন বারকয়েক। ইরা তৎক্ষনাৎ ফোন লুকিয়ে পিছনে ফিরে চাইলো। সাহসা ওর বুকে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। সম্মুখে আদি দাঁড়িয়ে তুখোর তার চোখের দৃষ্টি৷ ইরার ফোন লুকানো আদির বাজপাখির ন্যায় চক্ষু এড়িয়ে যেতে পারলো না। ইরা শুধু দোয়া করছিলো আদি যেন ফোন না চেক করতে চায়। কিন্তু ওর সকল দোয়া জলাঞ্জলী দিয়ে! আদি গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠলো,
—” এখানে কী করছিস এত রাতে?”
আদির তুই করে বলায়। ইরার বুঝতে বাকি রইলো না। আদি প্রচণ্ড রেগে আছে। মাত্রাধিক রেগে থাকলেই আদি তুই করে বলে ওকে। তাছাড়া এভাবে কখনোই তুই-তোকারি করেনা সে! আজ কপালে প্রচুর খারাপি আছে। ইরা ভয়ে কাঁদতে ভুলে গেলো। চোখ মুখ ফাঁটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো! একটা শব্দ বলতে অক্ষম বাক্যহারা প্রাণ যেন। ওকে আরো ভয় পাইয়ে দিতে আদি ধমকে বলে উঠলো,
—” ফোনটা দেখি তোর, এদিকে দে এক্ষুণি!”
ব্যাস ভয়ে জ্ঞান হারাবার জোগাড় হলো ইরার। এখন কী করবে ও? আদি ফোন দেখলে এখন সর্বনাশ হয়ে যাবে!
চলবে,