#জোনাকি_প্রদীপ (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা
সারারাত একফোঁটা ঘুম আফনান কিংবা নীরা কারোরই হলো না। সকালে খাবার টেবিলে একবার নীরার দেখা পেয়েছিল, কিন্তু কথা বলা সম্ভব হয়নি। এই বাড়িতে সবাই ওর সাথে আগের মতোই ব্যবহার করলেও নীরার মা একটু অন্যরকম। তবে তিনি মন থেকে না হোক এই বিয়েটা যেন হয় সেটা যে চাইছেন, এটা আফনান জানে। তাই আপাতত সিংহ বিজয় হয়ে গেছে ধরা যায়। এটুকু স্বস্তি দিলেও বড় বাঁধাটা এখন নীরা নিজেই। গতকাল সন্ধ্যা নামার ক্ষণে মেয়েটার বাক্যবাণ যেটাই বলে। তাই স্বস্তি হাপিশ।
এই ইস্পাত-দৃঢ় মেয়েটা যেন তার হৃদয় নামক বস্তুটুকু পুরোটা পার্মানেন্ট কোল্ড স্টোরেজে রেখে দিয়েছে। বরফ গলার কোনো চান্সই নেই। আবার সেই কোল্ড স্টোরেজের চাবিটাও নিজের কুক্ষিগত মেয়েটার। আফনানের প্রধান কাজ হলো ওই চাবিটা হস্তগত করার, নইলে সিঁধ কাটতে হবে। মনে মনে ইতিকর্তব্য সাজিয়ে নিল সে৷
আফনান এসে বসল পুকুর পাড়ে। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। এই এক বছরে তেমন সময়ই করে উঠতে পারেনি, ইচ্ছেও হয়নি। নীরার সাথে কথা না বলতে পারলে কোনো লাভ নেই। কিন্তু মেয়েটা দূরে দূরে থাকছে কেবল।
***
ইরা এলো নীরার রুমে। দেখল একমনে কী যেন একটা লিখছে। ওকে দেখে সরিয়ে রাখল।
“কিছু বলবি ইরা?”
“আপু, সারাদিন ঘরে বসে আছ। চলো একটু হেঁটে আসি।”
“কেন? হাঁটতে গেলে কী হবে? আফনান ভাইয়ের সাথে দেখা হবে?”
ইরা অপ্রস্তুত হয়ে গেল,ইতস্তত করে বলল, “না না, কী যে বলো…”
“তুই আমার বোন, অথচ আমার পাশে নেই। এটুকুই আফসোস।”
“আপু, আমি…”
“কিছু বলতে হবে না। আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না৷ চল যাই। দেখি নতুন করে আবার কী বলে।”
যেতে যেতে নীরা বলল, “শাফিন ইদানিং ঘনঘন চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এত খাটাচ্ছিস কেন বেচারাকে?”
লজ্জায় ইরার গাল দুটো রক্তাভ হয়ে উঠল। কোনো উত্তর দিতে পারল না। নীরা আবার বলল, “শোন, শাফিন ভালো ছেলে। তবুও এখনই এর জড়িয়ে যাস না। তোদের বয়স কম। সামনে অনেক লম্বা জীবন পড়ে আছে৷ পড়ে কষ্ট পাবি।”
ইরা এবার কথা বলল, “আপু, আমরা আমাদের লিমিটটুকু জানি। তোমার বোন তো, তোমার মুখ কারোর কাছে নিচু করব না। শাফিনও তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।”
নীরা হেসে ইরার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “দিন দিন আরও সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস রে। একেবারে লাজুকলতা।”
বলেই এগিয়ে গেল পুকুর ঘাটে৷ যেখানে আগে থেকেই আফনান বসেছিল। নীরা এসেছে কিছু কঠিন কঠিন কথা বলে ওকে তাড়াতে।
***
“আজকে আরেকবার কম্পিটিশন হয়ে যাক। কী বলো?”
স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল নীরা। আফনান আশা করেনি নীরা আসবে। আসলেও হয়তো খানিকটা গুটিয়ে রাখবে নিজেকে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল, মেয়েটা যখন নীরা সে এরকমই। সামনা-সামনি তীর-ধনুক প্রয়োগ করবে, আড়ালে গুটিয়ে থেকে নয়। সে বিষমাখা তীর হৃৎপিণ্ডে ধারণ করার জন্য প্রস্তুত হলো।
“কম্পিটিশন? তাহলে তো পুরষ্কার থাকবে। ফার্স্ট প্রাইজ কী?”
“কী হলে ভালো হয় বলো তো?”
“তুই।”
“জীবনটা ছেলেখেলা? একটা বাজি জিতে কাউকে পেয়ে যেতে চাও?”
“আমি তোকে সবসময়, সবকিছুতে চাই৷ তোকে ছাড়া আমার চলবে না নীরা।”
“না চললে নাই।”
“নীরা, আমি তোকে সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। যেদিন তোক আর সায়মনকে একসাথে দেখলাম আমার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল।”
“তবুও বলতে পারোনি। ভেবেছ আমি সুখে আছি। যখন দেখলে আমি সায়মনকে বিয়ে করিনি, তখন আবারও আমার সুখের দায় কাঁধে তুলে নিতে ছুটে এলে। তোমাকে আমি কখনো বলেছিলাম, আমি কীসে সুখী? নিজে নিজে ভেবে নিলে? তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, আমি সুখেই আছি। তার জন্য আমার বিয়ে করতে হবে না। তুমি ফিরে যাও।”
“ভালোবাসি বলেই ফিরিয়েছিলাম। ভুল করেছিলাম। এবার আমি ফিরব না নীরা। তোকে দুইবার ফিরিয়েছিলাম৷ তুই এখন আমাকে চৌদ্দ দ্বিগুণে আটাশ বার ফিরিয়ে দে। উনত্রিশ বারের সময় আমাকে গ্রহণ করবি! আমি জানি তুই আমাকে এখনো ভালোবাসিস।”
“ভালোবাসি, সেটা আমি একবারও অস্বীকার করিনি। তবে বিয়ে আমি করব না সে-ও আমি ভালো মতো জানি। তাই বৃথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই।”
“আমার সময় নষ্ট হচ্ছে কি-না আমি বুঝব আপাতত। চল ছিপ ফেলি। যদি আমি জিতি, তবে আমি তোকে একটা চিঠি দেব, তুই পুরোটা পড়বি। আর তুই জিতলে যা চাস পাবি, শুধু আমাকে চলে যেতে বলিস না আর তুই ফিরে যাস না।”
ওরা ছিপ ফেলল, সময় অতিবাহিত হচ্ছে, কেউ কথা বলছে না আর। ওদের সমস্ত মনোযোগ নিবন্ধ ওই পুকুরে। নীরা আফনানকে আর চায় না, তবুও ওর চিঠি পড়ার সুতীব্র লোভ হলো। তবে জিতল নীরাই।
“বল কী চাস?” গোমড়া মুখে বলল আফনান। ওর ইচ্ছে ছিল জয়ী হলে অন্তত চিঠিতে হলেও মনের অবস্থাটা ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু এখন…
“তোমার চিঠি।”
হেরেও অভিব্যক্তি উজ্জ্বল হলো আফনানের।
“তুই পড়বি? কিন্তু আমি তো হেরে গেছি।”
“তুমি বলেছিলে, আমি জিতলে যেকোনো উপহার চাইতে পারি। হার খুব কষ্টকর। তাই চাইছি হারলেও পুরষ্কারটুকু তুমি পাও। এর অন্য অর্থ কোরো না।”
“করব না। তবে যদি নিশ্চিত হতে পারি তুই চিঠিটা পড়বি, তবেই দেব। নইলে নয়।”
“পড়ব।”
আফনান ওর পকেট থেকে ভাজ করা একটা কাগজ নীরার দিকে এগিয়ে দিল।
“আগেই রেডি?”
“আজ এটা তোকে দিতামই। সেজন্য।”
“কিন্তু হারলে তো। এমন পারফরম্যান্স হলে কেমনে দিতে?”
কটাক্ষ হেনে কথাটা বলেই সে চলে গেল হনহনিয়ে। আফনান তাকিয়ে রইল ওর যাওয়ার পানে। এই যে কিছুটা সান্নিধ্য পাওয়া গেল, এই অমূল্য ওর কাছে।
***
নীরা,
আমি যখন খুব ছোট, তখন আমার মা-বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়। একা একজন মায়ের তার শিশু সন্তানদের বড় করা কতটা ভয়ানক সংগ্রামের তার বিস্তারিত আমি আজ বলব না। শুধু এটুকু বলব, আমি সেই ছেলেবেলা থেকে মায়ের সাথে স্ট্রাগল করেছি। আমার জীবনে কোনো ভালো কিছুই সহজে আসেনি। এরমধ্যে তুই হাতছানি দিয়ে ডাকলি। আমি ভয় পেয়েছিলাম৷ আমার জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি, তার একটা অবশ্যই নিলয়। তখন তোরও বয়স খুব কম। আবেগে ভেসে যাবার বয়স। ক’দিন পরেই যদি তোর মোহ কেটে যায়! বন্ধুত্ব হারানোর শঙ্কা, সাথে তোর বয়স, আমার অর্থনৈতিক অবস্থান সবই তখন প্রতিকূলে। আমি তখন অনার্সে পড়ি, কিছু টিউশনি করা হয়। পায়ের নিচে শক্ত মাটি নেই। এখন এই বয়সে হয়তো তেমন করে কেউ মাথা ঘামাবে না, কিন্তু সেই সময় মস্তবড় ভুলই হতো।
বহুদিন পরে যখন তোকে আবার দেখলাম তোকে, এক চোখে কাজল নিয়ে হাঁটছিস, অনেক বদলে গেছিস৷ আমার প্রতি তখনও তোর একইরকম অনুভূতি আছে, তখন বুঝলাম ওটা শুধু মোহ ছিল না। সেদিন মনে হলো, কোনো মেয়ের আহ্বানেই কেন সাড়া দিতে পারিনি। আমি আসলে অবচেতনে তোকেই খুঁজতাম। পাইনি কোথাও বলেই জীবনে প্রেম হয়নি একটাও। সেবারই আমি বুঝলাম, আমিও তোকে প্রবলভাবে চাই। যতটা চাইলে অপ্রাপ্তিতে ভেতরটা পুড়ে ভস্ম হয়ে ছাই উড়ে যায়, ঠিক ততটা কিংবা তারও বেশি চাই। তুই আমাকে সেবার হাসিমুখে ফিরিয়ে দিলি। আমার সে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। একবারে একবারে কাটাকাটি ধরে নে নাহয়।
আমাদের বাড়িতে আমার সামনে যে আরেকবার এসে দাঁড়াল, সে একজন পরিপূর্ণ তরুণী। এবার আমি সত্যিই তোর সাথে অন্যায় করেছি নীরা। তখন আমার অবস্থা টালমাটাল, বাঁচা-মরার লড়াইয়ের মধ্যে ছিলাম। ভাবলাম যদি মরে যাই তোর পক্ষে আমার মতো একজনকে যে তোর মতো কাউকে বারবার ফিরিয়ে দেয়, তাকে ভুলতে পারা সহজ হবে। যখন সব ঠিকঠাক হলো, তখন ভাবলাম এবার সময় হয়েছে নিজের মনকে আরেকবার উন্মুক্ত করে দেবার। কিন্তু চাইলেই কি সব চাওয়া মতো হয়! আমার ক্ষেত্রে তো আরও নয়। আমার ভাগ্যই বিরূপ।
এবার আর তোর মুখোমুখি হবারই সাহস করতে পারলাম না। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ভেঙেচুরে গেছি। তোর আর আমার দুটো মনেই ক্ষত। এই ক্ষত আমরা এক না হলে সারবে না। একবার হাতটা ধরে দেখ, আমি তোর হাত কোনদিন ছাড়ব না। মনের কথা শুনব। তুইও একবার মনের কথা শুনে দেখ প্লিজ। আমি আজ আমার সমস্ত উৎসর্গ করে কথা দিলাম তোকে। যতদিন এই পৃথিবীর কোলে, অনন্ত নক্ষত্ররাজি আর ওই সুবিশাল দিগন্তের নিচে শ্বাস টানতে পারব, ততদিন তোর হাত ছাড়ব না। একবার একটা সুযোগ…
ইতি,
হতভাগ্য
আফনান।
চিঠি শেষ করে নীরা ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই নিতান্ত সাদামাটা একটা চিঠির ভাজের প্রতিটা অক্ষরে ভালোবাসা আর বিষাদ, হাহাকার আর আকুলতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নীরা সারাদিন আর ঘর থেকে বের হলো না। দুপুরে খেতেও আসেনি। রোকেয়া ডেকেছেন, ইলা এসে কয়েকবার ডেকেছে, সে দরজাই খুলে দেখার তাড়না অনুভব করেনি।
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামার আয়োজন প্রকৃতিতে, তখন গাড়ির শব্দ আর হৈচৈ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা রেলিঙের বারান্দায় এসে দাঁড়াল নীরা। ওর ঘরটা দোতলায়। উঁকি দিয়ে দেখল বকুল ফুপু এসেছেন। নীরাকে দেখে হাত নেড়ে হাসলেন তিনি। কতদিন পরে স্বাভাবিক আচরণ করলেন তিনি ওর সাথে! সায়মন আর টুম্পাও এসেছে। নীরা এবার সিঁড়ি ভেঙে নামল।
বকুল ফুপু ওকে জড়িয়ে ধরলেন। ধরে রেখেই বললেন, “আমাকে এভাবে পর করে দিলি?”
“তুমিই তো রেগে চলে গেলে।”
“তাই বলে তুইও একবার কল দিতে পারবি না?”
“আচ্ছা ফুপু স্যরি। এসো, ভেতরে যাবে না? এখানেই সব আলাপ সারবে?”
“চল, চল, ভেতরে যাই।”
নীরার মন ভালো হয়ে গেল। বাবা আর ফুপু, দুজনের মধ্যে কী যেন একটা ব্যাপার আছে, এদের সংস্পর্শে এলেই মনে একটা স্ফুর্তির রেশ ছড়িয়ে পড়ে।
***
রাতে খাবার টেবিলে নীরা বসেছিল মা, চাচি আর ফুপুর সাথে। অতিথিদের আগেই খাওয়ানো হয়েছে। রাতে নীরার ঘরে এলেন বাবা আর ফুপু।
“ছেলেটার ব্যাপারে কিছু ভাবলি মা?”
“কী ভাবব বাবা?”
“দেখ, তোর মা ওকে খুব বাজে কথা বলেছে। ওর বাবা মায়ের ডিভোর্স নিয়ে বলেছে। তুই জানিস?”
“উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে জানি, কিন্তু এসব জানতাম না।”
“একটা ছেলে যে সবসময় ওই একটা কারণ থেকেই কষ্ট পেয়েছে, সেটা ওর সবচাইতে স্পর্শকাতর জায়গা। আফনান ভেবেছে, জীবনে টাকাপয়সা আসবে, কিন্তু ওই যে ওর বাবা, তাকে সে মুছতে পারবে না। সেজন্যই হীনমন্যতায় ভুগেছে। যেটা খুব স্বাভাবিক। তবুও দেখ, ও কিন্তু তোর মায়ের অসম্মান হোক এটা চায় না বলেই কাউকে কিচ্ছু বলেনি। তোর মা নিজের সব কথা আমাকে না বললে আমি জানতামও না।”
চিঠিতেও রোকেয়ার কথা কিছু লেখেনি আফনান৷
এবার বকুল বললেন, “দেখ নীরা, আত্মমর্যাদা আর ইগো দুটো আলাদা জিনিস। আমরা গুলিয়ে ফেলি। আত্মসম্মান যেমন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়, তেমনি ইগো কোনোদিন কাউকে সুখী হতে দেয় না। জেদ থাকা ভালো, কিন্তু অতিরিক্ত জেদ ভীষণ ক্ষতিকর। একবার ভেবে দেখিস।”
তারা বেরিয়ে গেলেন। রোকেয়া ওর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন , ভেতরে গিয়ে মেয়ের মুখোমুখি হবার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারেননি। নিজের কাছে, নিজের মেয়ের কাছে ছোট হয়ে গেছেন।
***
খুব সকালেই আজ নীরার ঘুম ভাঙল। যদিও গাঢ় হয়নি, ছাড়াছাড়া ঘুম। সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল আফনান গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা রিকশা এদিকেই আসছে। আফনানের সামনে থামলো। ইরা দ্রুতপায়ে নেমে এলো।
আফনান ততক্ষণে রিকশায় চড়ে বসেছে। নীরাকে দেখে বলল, “আরিফ গতকাল ধরা পড়েছে, বর্ডারের কাছে। আমাকে যেতে হবে। পরশু আবার আসব।”
“ওইদিকে সরে বসো।”
“কেন? তুই কোথায় যাবি?”
“ভূতের বাড়ি। যাবে না?”
“তুই যেখানে নিয়ে যাবি সেখানেই যাব।”
বলে একগাল হেসে সরে বসল আফনান। নীরা উঠল রিকশায়। এই রিকশাগুলো যথেষ্ট বড়। তিনজন বসা যায়। দূরত্ব রেখেই বসল ওরা। রিকশা চলতে শুরু করল।
“তোমাকে বাসে তুলে দিয়ে চলে আসব।”
“নীরা…”
“বলো।”
তবুও ইতস্তত করে আফনান বলল, “একবার তোর হাতটা ধরতে পারি?”
নীরা সপ্রতিভ ভঙ্গিতে নিজেই হাত ধরল আফনানের। দুটো মুখেই হাসি বিস্তৃত হলো। হাতে হাতে সংযোগে হ্যাপি হরমোন যেন আন্দোলিত হলো ওদের মনের প্রতিটি অলিন্দে। এই প্রাপ্তির সুখের কোনো মাপকাঠি নেই পার্থিব জগতে। এই সুখ আসে অন্য জগত থেকে।
পরিশিষ্টঃ
দুই সপ্তাহ আগে নীরার বিয়ে হয়েছে ধুমধাম করে। আরও একবার এই বাড়িটা সেজে উঠেছিল জমকালো হয়ে।
ইরা আর শাফিন চুটিয়ে প্রেম পর্ব সেরে নিচ্ছে, মানে অভিমানে খুঁনসুটিতে ওদের সময়টা কাটছে দারুণ।
ইলা অপেক্ষায় আছে একদিন কিশোর পাশাকে বিয়ে করবে। এখন তো প্রায় সমবয়সী, নতুন বই পড়লে সে কিশোরের চাইতে বয়সে বড় হয়ে যাবে, তাই পড়ে না। মনে মনে সে ওর সাথেই একই অনুপাতে বেড়ে উঠছে। কল্পনাতেই একটা সংসার হবে। এটাই ওর ভাবনা। তবে একটা বড় রহস্যের সন্ধ্যানে আছে, যদি সমাধান করতে পারে, তবেই না একটা কাজের কাজ হবে।
আর দুই মাস পরে আনিকার ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় আসবে। দুই প্রান্তে থেকেও নিলয়ের সাথে চুটিয়ে সংসার চলছে ওর। ঢাকায় এলেই সন্তান নিয়ে ভাববে ওরা।
রবিন আর শায়লা ছোট্ট রায়াকে নিয়ে স্বপ্নের মতো দিন কাটছে। আয়েশা তার ছেলে মেয়ে নিয়ে ভীষণ খুশি। তারা সুখে থাকুক, এটা ছাড়া পুরো জীবনে তিনি আর কিচ্ছু চাননি। নীরার সাথে তার জমে উঠেছে এরই মধ্যে।
সবাই ভালো আছে, তবুও রোকেয়া এখনো ঠিক ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি নিজেও চান, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন পারেন না। মেয়ের হাসি দেখে তার ভালো লাগে, আবার আফনানকে দেখলে ভালো লাগায় যেন মরিচা ধরে। নিজেকে তিনি বুঝতে পারেন না। তার মধ্যে যেন দ্বৈত সত্তার বাস। কে যে কী চায়, তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না। সবাই ভালো থাকুক, এর বিনিময়ে তিনি নাহয় খানিকটা অসুখী থাকলেন। মেনে নিয়েছেন তিনি এটা। মেনে নিলেও আফনানের সাথে খুব বেশি নমনীয় তিনি চাইলেও হতে পারেন না। তার হতচ্ছাড়া জামাই-ও অবশ্য কম ত্যাদড় নয়, ঠিকই হাসিমুখে জবাব দিয়ে দেয়। কোনো কটু কথা নয়, তবুও ঠিকই এসে লাগে।
***
নীরা কাজলের কৌটো বাড়িয়ে দিল আফনানের দিকে।
“এটা দিয়ে আমি কী করব? এখন আমি চোখে কাজল দিয়ে ঘুরব?”
“বিয়ে করে বুদ্ধিশুদ্ধি সব দারাজে সেল করে দিয়েছ নাকি? আমাকে দিয়ে দাও।”
“আমি? বলছিলাম কী, তোকে এক চোখে কাজল দিয়েই দারুণ লাগে।”
“বাজে কথা রাখো। এটা ধরো, আর চোখে দিয়ে দাও।”
“এলোমেলো হয়ে যাবে তো।”
“হলে হোক। আজ থেকে আমার এক চোখের কাজল তুমিই দিয়ে দেবে। তুমি আজ থেকে প্র্যাক্টিস করবে।”
“ইলাকে ডাকি?”
“আমি ইলাকে বিয়ে করেছি?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্!”
“সময় নষ্ট হচ্ছে।”
আফনানের হাত ভীষণভাবে কাঁপছে। চোখের কাছাকাছি গেলেই হাত কাঁপা শুরু হয়৷ কী অদ্ভুত! কাজল দিতে গেলে এমন হয় না-কি!
কাজল দিতে গিয়ে চোখের নিচেও লাগিয়ে ফেলল আফনান। নীরা রেগেমেগে মুখ ধুয়ে এলো।
“তুমি যতক্ষণ না শিখবে আমি আর কাজল দেব না চোখে।”
আফনান বলল, “একমাত্র বউয়ের আবদার যেহেতু, রাখতেই হয়।”
“এসব ঢং করবে না। কী পুতুপুতু কথাবার্তা শিখেছ।”
“বলার পর তুই যে রেগে তাকাস, এটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাই বলি।”
নীরা হেসে ফেলল। ওদের বাড়িতে এসেছে গতকাল। বাড়ির সামনে যে জোনাকির মেলা, সেটা সবসময় দেখে। ওর আজ যাচ্ছে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। নতুনত্বের স্বাদ নিতে। ভীষণ নিরিবিলি জায়গাটা।
এক মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল এখানে এসে। থোকা থোকা জোনাকির মেলা বসেছে। আলোর পসরা সাজিয়ে রেখেছে ওর৷ আজ ম্লান চাঁদের আলোয় আলো ছড়াবার দায়িত্ব নিয়েছে জোনাকিগুলো। হাজার হাজার ক্ষুদে জোনাকির প্রদীপ জ্বলছে নিভছে আবার জ্বলছে।
আফনান ফিসফিস করে বলল, “তোকে যে আমি পেয়েছি, এখনো স্বপ্ন মনে হয়।”
এই নিস্তব্ধ রাতের যেটুকু শব্দ তা ওই জোনাকি আর ঝিঝি পোকাদের। প্রকৃতির এই অপূর্ব অতীন্দ্রিয় রূপে ব্যাঘাত ঘটাবে না বলে নীরাও ফিসফিস করে বলল,
“পুরো জীবন স্বপ্নময় হোক। ভালোবাসায় জোনাকির আলোর মতো জ্বলতে থাকুক।”
পরিবেশটা এতই মনোহর যে ওরা ঠিক নিজের মধ্যে রইল না পুরোপুরি। আফনানের অধর নেমে এলো নীরার কপালে। ভালোবাসার বৃষ্টি যেন টুপ করে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে, জোনাকির জ্বেলে রাখা প্রদীপের রূপে। কাঠখোট্টা দুটো মানুষ জীবনের সব রঙ খুঁজে পেয়েছে সবে।
……….
সমাপ্ত