তোমার আমার চুপকথা পর্ব-০১

0
392

#তোমার_আমার_চুপকথা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়ের মেকি গার্লফ্রেন্ড হবার ফজিলতের থেকে দূর্ভোগের পরিমাণ যেনো একটু বেশিই। এই নির্মম সত্যিটা এই কিছুদিনের মাঝে আত্মিকার অস্থিমজ্জাও টের পেয়েছে। এখন এই মেকি সম্পর্কটা গলার কাটার মত লাগছে। এই ধরুন আজ রাইয়ানের অনুষ্ঠান রয়েছে। এই অনুষ্ঠান নিয়ে মোটেই মাথা ব্যাথা নেই আত্নিকার। থাকার কথাও নয়। কিন্তু তাকে এখানে সকাল থেকে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। কারণ সে অনুষ্ঠানের আয়োজকের প্রেমিকা। আয়োজক যদি চিন্তার কুয়াশায় ভিড়মি খায় তাকে লেবুর শরবত খাওয়ানোর দায়িত্ব তো আত্মিকার। ব্যাপারখানা অতিমাত্রায় বিরক্তিকর। কিন্তু করতে হচ্ছে। নয়তো যন্ত্রণাদায়ক সিনিয়রগুলো চিলের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। লেবুর শরবতটাও সে বাসা থেকেই বানিয়ে নিয়ে এসেছে। যে মেয়ে সকালবেলা নাস্তা করে আসার সময়ও পায় না সেই মেয়ে রান্নাঘরে যেয়ে লেবুর শরবত বানিয়েছে। নিজের কাজে নিজেই অবাক হয় আত্মিকা। ছোট বোন আনহা সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়। বিড়বিড় করে বলে,
“তুই কবে থেকে লেবুপানি খাওয়া শুরু করেছিস?”

উত্তর দিতে পারে না আত্মিকা। শুধু দাঁত কিড়কিড় করে বলে,
“যা পড়তে বয়। পড়ার নামে ঠনঠন শুধু পাকনামি?”
“আমি পড়ছি ই”
“বই কোথায়?”
“আমি মনে মনে পড়ি”

আনহার উত্তরের সাপেক্ষে ভাষা হারায় আত্মিকা। তাই চোখ পাকিয়েই বেরিয়ে আসে। ভার্সিটি এসেই রাইয়ানকে চিরুনী তল্লাশি করতে হয় তার। জনাব অনেক ব্যস্ত, হেব্বি ভিআইপি মানুষ কি না। তাকে পাওয়া যায় মানুষের ভিড়ে। তার কি সময় আছে! এই যে আত্মিকা তার জন্য নিজ হাতে লেবুর শরবত বানিয়ে এনেছে সেটা তার আদৌও মনে আছে কি না সেটাই সন্দেহ। অথচ এই মশাই কাল রাতে বিশেষ ভাবে ফোন করে আত্মিকা বলেছে, যেনো মহাশয়ের জন্য লেবুর শরবত আনা হয়। এই তো গতকালের কথা। আত্মিকা তার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিছানায় শরীর লাগাতেই মোবাইলের কর্কশ ধ্বনিতে গমগম করে উঠলো ঘর। অতি বিরক্তির সাথে ফোনটা হাতে নিতেই “রাইয়ান সাহেব” নামটা ভেসে উঠলো। আত্মিকা সুঁচালো চোখে ঘড়ির দিকে একবার তাকালো। এমন বেক্ষাপ্পা সময়ে কে ফোন দেয়? আত্মিকার একবার মনে হলো বাজুক। বাজতে বাজতে কেটে যাক। কিন্তু পরমূহুর্তেই ফোনটা ধরলো সে। বেচারা হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ফোন দিয়েছে। ফোন রিসিভ করা সাথে সাথেই ওপাশ থেকে গাঢ় স্বর ভেসে আসলো,
“দেরী হলো যে, কিছু করছিলেন?”
“তেমন কিছু না, হাল চাষ করছিলাম”
“হাল চাষ? রাত দুটোতে?”
“তাহলে ঘড়ি দেখেন আপনি?”
“সরি, ডিস্টার্ব করলাম তাই না?”

আত্মিকা হাসলো, মানুষটিকে মোটেই ওপাশ থেকে সরি বা লজ্জিত মনে হচ্ছে না। বরং তার কণ্ঠে ছলকাচ্ছে প্রফুল্লতা। আত্মিকা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“আপনি মোটেই সরি নন। বলে ফেলুন আজকে কেন ফোন করা হয়েছে?”
“কারণবিহীন ফোন করাটা কি অপরাধ হবে বেয়ান সাহেব? আর আপনিও যে খুব একটা অস্বস্তিবোধ করেন না আমার সাথে কথা বলতে আমি কিন্তু জানি সেটা”

রাইয়ানের প্রগাঢ় স্বরের বিপরীতে থমকে গেল আত্মিকা। তর্ক করার মতো যৌক্তক উত্তর খুজতে চাইলেও ব্যর্থ হলো সে। রাইয়ান তার বড় বোনের দেবর। সেই হিসেবে তাদের শুধু পরিচয় ছিলো। তারপর বের হলো মানুষটি কেবল তার বেয়াই নয় বরং তার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। রাইয়ান মানুষটি দেখতে চমৎকার। লম্বা, সুদর্শন পুরুষ। চশমায় আড়াল করা চাহনীতে এক অদ্ভুত মাদকতা যেনো। কথার মাঝেও বেশ চতুরতা ছলকায়। গুছিয়ে কথা বলে সে—বলা বাহুল্য ভার্সিটির সাংস্কৃতিক ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি সে। তবুও সৌম্য পুরুষটির প্রতি তার কখনোই আগ্রহ ছিলো না। কারণ মুখশ্রীর প্রেমে পড়ার মত মেয়ে আত্মিকা নয়। যদিও রাইয়ান তার পেছনে কম শ্রম দেয় নি। প্রেম নিবেদনও করেছিলো বেশ নিপুণতার সাথে। কিন্তু বেশ দূরত্ব ই রেখেছিলো সে। কিন্তু বিধিবাম। ঘটনার প্রেক্ষিতে সে হলো তার মিথ্যে বয়ফ্রেন্ড। মিথ্যে বয়ফ্রেন্ড হবার সুবাদেই রাইয়ানের সাথে তার বন্ধুত্বের সূত্রপাত। ব্যাপারটা এতো দূর গড়াবে সেটা কখনোই ভাবে নি। যার কবল থেকে বাঁচার জন্য এই মিথ্যে, সেই মানুষটি সারা ভার্সিটি রটিয়ে দিলেন রাইয়ানের গার্লফ্রেন্ড আত্মিকা। সেই থেকেই এখন অবধি মিথ্যের গাড়ি চলছেই। রাইয়ানের কাছে তার নম্বর প্রথম দিকে ছিলো না। কিন্তু একবার কথায় কথায় নাম্বার আদান প্রদান করে তারা। যতই মেকি হোক, প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার নাম্বার থাকবে না ব্যাপারটি অবাস্তব। সেই থেকেই মানুষটি হুটহাট করেই ফোন দেয়। প্রথম দিকে ব্যাপারটা সৌজন্যতার খাতিরে হলেও এখন তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতি রাতে এক দু ঘন্টা অহেতুক আলাপন হবেই তাদের। আত্মিকার দিক থেকে প্রথমে ইতস্ততবোধ থাকলেও মেকি সম্পর্কের বদৌলতে এখন ব্যাপারটা যেনো স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক হবার কথা নয়। তাই তো আত্মিকা তন্ময় কন্ঠে বললো,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মোটেও স্বাচ্ছন্দবোধ করি না এই অহেতুক খাজুরে আলাপে”
“কিন্তু অস্বস্তিবোধ ও হয় না আপনার। যাক গে, তর্ক না করি। বরং এই চিন্তাটি আপনি মাথা থেকেই ঝেড়ে ফেলুন। কারণ বয়ফ্রেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলবে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। আমি তো বলি আমার আপনাকে ঘন ঘন ফোন করা উচিত। দিনে অন্তত নিয়ম করে তিনবার”

রাইয়ানের কথায় হেসে উঠলো আত্মিকা। হাসির ধার না কমিয়ে বললো,
“এটা কি কোনো ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিবশন নাকি”
“আমার জন্য হয়তো তাই”
“ফ্লার্টিং করা ছাড়বেন না তাই না?”
“আমি সত্য বলি, আপনি ফ্লার্টিং হিসেবে নিলে আমার দোষ নেই। আমি কিন্তু সত্যি ই ভালোবাসি”

রাইয়ানের এমন কথায় মুহূর্তের মধ্যেই থমকে গেলো আত্মিকা। হাসি উবে গেলো। মানুষটি এভাবে অকপটে কি করে অদ্ভুত কথা বলতে পারে? লজ্জার বালাই নেই, জড়তা নেই। স্পষ্ট, জড়তাহীন কণ্ঠ। আত্মিকার মৌনতা দেখে কথা বদলালো রাইয়ান। হাসতে হাসতে বলল,
“ভালোবাসাটা আমার পক্ষ থেকে, আপনার নয়। তাই এতো ভাববেন না। আচ্ছা, যেজন্য ফোন করেছি, কাল আমার জন্য একটু লেবু পানি আনা যাবে?”
“কেনো?”
“আমার বন্ধুরা জানে আপনি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসেন”
“সেটার সাথে লেবুর শরবতের কি সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে, গভীর সম্পর্ক। এই যে আমাদের একটি অনুষ্ঠান আছে। আমি সকাল থেকে ঘাম জড়িয়ে কাজ করবো। যদি আমার পানিশূন্যতা দেখা যায়? আমি বেহুশ হয়ে যাই? একেবারে যাচ্ছে তাই ব্যাপার হবে। প্রেমিকা হিসেবে আপনার ও তো দায়িত্ব আছে তাই না? প্রেমিককে লেবুপানি দিয়ে সতেজ রাখা। তাই আনবেন বেয়ান?”

অথচ দেখো, সেই মানুষটি হয়তো জানেও না আত্মিকা এখানে এসেছে। এতোগুলো মেয়ের মাঝে মডেলের মত দাঁড়িয়ে আছে। আত্মিকার বিরক্তি বাড়লো। মানুষের ভিড় তার অপছন্দ। অথচ এই ভিড়তম স্থানে হাতে বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আসতে যেতে জুনিয়র সিনিয়র তার সাথে কথা বলছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথা বলতে হচ্ছে। অবশেষে না পেরে মেয়েদের ঠেলেই রাইয়ানের কাছে গেলো সে। রাইয়ান তাকে দেখে গদগদ স্বরে বলল,
“আপনি এসেছেন?”
“না আমি এখনো মগবাজারে। আর এটা আমার আত্মা”

আত্মিকার কন্ঠের কাঠিন্য দৃষ্টিগোচর হলো না রাইয়ানের। সে তার হাত থেকে ফটাফট বোতলটি নিয়েই বলল,
“একটু অপেক্ষা করুন, এদের কাজগুলো বুঝিয়েই আমি আসছি”

হ্যা, ব্যাস্ততা শুধু তার। আত্মিকার কাছে তো ইহজনমের সব খাজুরে সময় আছে। আত্মিকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“আমার ক্লাস আছে। মনে করে শরবত খাবেন। নয়তো বেহুশ হয়ে যেতে পারেন”

বলেই চলে যেতে নিলে হাতটা খপ করে ধরলো রাইয়ান। খুব বিনয়ী স্বরে বললো,
“আজ একটু বাঙ্ক করুন না, আমি কাজটি সেরেই আসছি। প্লিজ, যাবেন না”

“প্লিজ যাবেন না” কথাটিতে কিছু একটা ছিলো। খুব আকর্ষণীয় কিছু। খুব আন্তরিক কিছু। আত্মিকা বিমূঢ় হলো, না করতে পারলো না। ফলে মানুষটির ঠোঁট বিস্তারিত হলো। প্রফুল্ল স্বরে বললো,
“এক মিনিট”

এক মিনিট ঘন্টায় গড়ালো। মানুষটি ফাঁকা হলোই না। উলটো চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে মাজা লেগে এলো যেন আত্মিকার। অপরদিকে একটা নয় দুটো ক্লাস বাঙ্ক করতে হলো। হঠাৎ পাশে এসে বসলো পলি আপু। আপুটি রাইয়ানের বান্ধবী। কিন্তু অজানা কারণেই আত্মিকার খুব বিরক্ত লাগে তাকে। তার খুব নাক গলানো স্বভাব রয়েছে। এই যে সে পাশে বসেছে, সে চুপ থাকতেই পারে না। সুন্দর এসেই আত্মিকাকে বলে উঠলো,
“এমা, আত্মিকা যে, এখানে বসে আসো কেনো?”
“রাইয়ান সা… রাইয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম”
“সে কোথায়?”
“কাজ করছে”
“এ বাবা, প্রেমিকাকে বসিয়ে রেখে কাজ? তোমার ধৈর্য্য আছে বাপু। আমি হলে কখনোই বসে থাকতাম না। এই রোদের মধ্যে এভাবে বসে থাকা কি সহজ নাকি”

আত্মিকার বিরক্তি শানিত হলো। একেই সূর্যের প্রখরতায় মাথা টনটন করছে। উপরন্তু পলি আপুর অহেতুক টিপ্পনী। তাই নিয়ন্ত্রণ হারালো আত্মিকা। খুব শীতল স্বরে বললো,
“হয়তো ধৈর্য্য আছে বলেই আমি তার প্রেমিকা। আপনার নেই বলেই আপনার শত চেষ্টাতেও সে গলে নি”

আত্মিকার কথায় মুখ ভোঁতা হলো পলির। মুখ বাকিয়ে বললো,
“এতো অহমিকা ভালো নয়। মাত্র কয়েক মাস ই সম্পর্ক। বছর গড়ালে অহমিকা মানায়”

পলি আপুর কথাটায় নিজেও বাকহারা হলো আত্মিকা। নিজের উপর ও বিরক্ত ধরলো। সে অহেতুক ঝগড়া কেন করছে। আর এখানে অহেতুক বসে থাকার কি মানে? পলি তো ভুল কিছু বলে নি। সত্যিকারের প্রেমিক হলে তাও একটা যুক্তি দাঁড় করানো যেত, কিন্তু রাইয়ান আর তার সম্পর্ক তো মিথ্যে মিথ্যি। তাহলে এমন বোকামির কি মানে? মস্তিষ্কের প্রশ্নে মন নত স্বীকার করলো। ঠিক তখন ই রাইয়ান এল। অপরাধী স্বরে বলল,
“সরি, সরি, সরি। কান ধরছি আর হবে না এমন”

আত্মিকা কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। রাইয়ান অবাক হলো আত্মিকার চাহনীতে। এমনটা আগেও করেছে সে, কিন্তু আজ যেনো আত্মিকার মুখভাব আলাদা। পলি উঠে চলে গেলো। রাইয়ান তখন ধীর স্বরে শুধালো,
“কিছু হয়েছে আত্মিকা?”
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে”
“এখন তো বারোটা বেজে গেছে। এক কাজ করি। ক্যান্টিনে যেয়ে কিছু খেয়ে নেই। তখন কথা বলবো”
“কথাটা খুব জরুরি, তাই আশা করি আপনি শুনবেন”

আত্মিকার কাঠকাঠ কণ্ঠ আরোও একবার চমকালো রাইয়ান। কিছু বলার পূর্বেই আত্মিকা বলে উঠলো,
“মেকি সম্পর্কটার একটি মেকি ছাড়াছাড়ি প্রয়োজন। আপনি বরং কাল সকলকে বলে দিবেন আমার সাথে আপনার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। একেবারে কঠিন ব্রেকআপ যাকে বলে, কারণ হিসেবে আমার উপর-ই দোষ চাপিয়ে দিয়েন। আমি প্রতারক, ঠগ, টক্সিক ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আপত্তি নেই। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমিও দুঃখী দুঃখী মুখে বলবো, “আমার পক্ষে উনাকে ভালোবাসা সম্ভব হচ্ছিলো না৷ কারণ আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না”৷ ঠিক আছে রাইয়ান সাহেব?”……………

চলবে