তোমাতে আমাতে পর্ব-১৬

0
1785

#তোমাতে_আমাতে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট। ১৬

কাজের বুয়া অনেক্ষন আগে আমাকে ডেকে গেছে। ইমন আসছে টেবিলে বসে আছে। কিন্তু ওই ছবিটা আমার মাথা খারাপ করে দিছে। আমার চোখেই কেন পড়লো ছবিটা। উঠি উঠি করেও আর উঠতে পারছিনা। ঠাই এক যায়গায় বসে এলোপাথাড়ি অনেক কিছুই ভেবে চলেছি।
— আদৃতা….
ইমনের চিৎকারে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই। সচরাচর ও আমার নাম ধরে ডাকে না।
কিন্তু আজকে ডাকছে কেন?
হ্যা ও তো লাঞ্চ করতে আসছে। খাওয়ার সময় আমি অথবা মা পাশে না থাকলে ও ঠিক করে খেতে পারে না। মা বোধ হয় এতোক্ষনে শুয়ে পড়েছে।
— এখানে বসে বসে কি করছো তুমি? আমি কতক্ষন ধরে টেবিলে বসে আছি ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? আজকে লাঞ্চ স্কিপ করলাম।
ইমন কপালে হাত দিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
আমি হতবিহ্বল হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কপালের ওই সুক্ষ্ম ভাজটা আমার প্রতি ওর চরম বিরক্তি প্রকাশ করছে।
অনেক কিছুই বলতে চাইলাম কিন্তু মুখ দিয়ে শুধু এইটাই বেরোলো,
— এক্সট্রেমলি সরি। আসলে আমি..
— কি তুমি? ঠাইতো তুমি এক যায়গায় বসে ছিলা। খালাতো তাই বললো।
আমি ফ্লোরের দিকে তাকাই আছি। ওকে কি এক্সিউজ দেয়া যায় আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
— ইমন.. এই ইমন..
এই তুই না খেয়ে চলে এলি কেন?
মামনী ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করে। এদিক সেদিক তাকিয়ে,
ইমনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
— তোদের কিছু হয়েছে? দুজনের মুখ এমন ভার কেন?
— কিছুনা।
দুজনেই একসাথে বলে উঠলাম।
— কিছুই যখন হয়নি তখন ইমন না খেয়ে চলে এলে কেন?
আর আদৃতা তুমিওতো খেতে চায়নি। জোড় করে তুলে খাওয়াতে হয়েছে। যত রাগ সব কি খাওয়ার উপরেই!

ইমন মামনীর কথা শুনে আমার দিকে পিটপিট করে তাকাতে থাকলো। বিছানা থেকে উঠে খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে। এইরকম একটা অবস্থার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
এরপর টানতে টানতে আমাকে টেবিলে নিয়ে যায়।
— খাওনি কেন। হ্যা..
আমার সাথে এক্ষুনি খেতে বসো। নইলে ভালো হবে না কিন্তু।
মামনী হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে যায়। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, কবে যে এরা বড় হবে…।
আমি ইমনের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিলাম। ও আমার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। আমরা সমস্ত ভাবনা গুলিয়ে দেয়ার জন্য ঐ একজোড়া নীল চোখই যথেষ্ট।
— এইভাবে তাকাই আছো কেন? হা করো?
— না আমি খেয়েছিতো। খাবো না। তুমি খাও।
চোখগুলো রাঙ্গিয়ে আমার দিকে তাকায়। খাওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও একসাথে খেতে বসে যাই। ও যতবার আমার মুখে খাবার তুলে দেয় ততবার আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। ইদানীং কেন যেন আমি ওর চোখের ভাষা বুঝতে পারি বলে মনে হয়। ওর ঐ নীল চোখের গভীরে যেন আমার একক সত্তাই বিরাজমান। ভালোবাসি খুব তোমায়। বড্ড ভালোবাসি। দুচোখের কোনে যে জল জমা হচ্ছে। কোনরকমে আটকে সেখান থেকে চলে এলাম।

বাবা ফোন করেছিল কালকে ইশিতা আপুদের বাসায় যাবে সবাই। অবশ্য আজকেই বাসায় যেতে বলেছিল কিন্তু ইমন কিছুতেই রাজী হয়নি। একেবারে কালকেই যাবে। একা একা রুমে ভালো লাগছিলো না। উল্টাপাল্টা চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে এই ইউশা মেয়েটার কথা জিজ্ঞাস করতে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছিলোনা। বড্ড এলোমেলো লাগছে।
হাটু ভাজ করে দুইহাতের উপর মাথা রেখে বসে আছি। খোলাচুলগুলো এলোমেলো হয়ে এদিক সেদিক উড়ে যেতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর রুমে ইমনের পায়ের শব্দ পেয়ে মাথাটা উঁচু করে তাকালাম।
— ঘুমাওনি।
বলেই ও ওর ফোনটা সাইডটেবলে রেখে ওখান থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেললো।
তারপর আমার পাশে বসে কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
— কিগো মহারাণী কথা বলবেনা। রাগ করেছো?
— উঁহু…
— তাহলে অভিমান করেছো?
— কোনটাই না।
— তাহলে আমার মত এত সুদর্শন একটা পুরুষ পাশে বসে থাকতেও তুমি ফ্লোরের দিকে তাকাই আছো! হুয়াই!
আমি ওর দিকে ঘাড় ঘুরায়ে বললাম,
— তাহলে কি করবো গলা জড়িয়ে ধরবো?
— সেটা করলেতো একটু সুবিধা হতো। নইলে যা করার আমাকেই করতে হবে। কি আর করবো বলো? কপাল খারাপ!
আমার গালদুটো ধরে ও ওর মুখের সামনে ধরে।
আমি ওর চোখের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছি।
ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,
— কি হয়েছে তোমার? আমাকে বলো? একটিবার বলো কি হয়েছে?
চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিলাম।
— ছাড়ো আমার ভালো লাগছে না। অস্বস্তি হচ্ছে।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু ও আমার কোমড় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মাথাটা নিচু করে গাঢ়ভাবে আমার ঠোটে চুমু খেল বেশ খানিক্ষন সময় নিয়ে। ফিসফিসিয়ে আবার বললো,
— ভালোলাগার মত কিছুতো এখনো হয়নি। সবেতো শুরু।
কোন কিছু বোঝার আগেই ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিছানায় ফেলে দিলো। একজন আরেকজনের নিঃশ্বাস স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছি। চরম উত্তেজনায় একজন আরেকজনের মাঝে হারিয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো। হয়তোবা এটাই ভালবাসা প্রকাশের শেষ পর্যায়।

আমরা রেডি হয়ে আমাদের বাসায় সকালেই পৌছে যাই। ওখানেই ব্রেকফাস্ট শেষ করে আমরা ইশিতা আপুদের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। মা, বাবা, চাচ্চু আর ভাইয়া একগাড়িতে। আমি ইমন আর ছোট মামা আর কাজিন ইশান এক গাড়িতে বসি। গাড়ীটা একটা প্রকান্ড দোতলা বাড়ীতে এসে থামে।ওখানে পৌছোতে অলমোস্ট হাফ এন আওয়ার লাগে। শহর থেকে একটু দূরে কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি পরিবেশে বাড়ীটি তৈরি করা হয়েছে। বাড়ীটার সামনে বেশ খানিকটা যায়গা জুড়েই গার্ডেন।বাড়ীটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পুরোনো আমলের তৈরী। তবুও চোখ ফিরানো অসম্ভব। প্রথম দেখাতেই যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। ইশিতা আপুর বাবা আর ভাইয়া এসে আমাদের রিসিভ করে ভেতরে নিয়ে যায়। সবার সাথে একে একে পরিচয় করাই দেই। আমার সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং লাগছে এনারা তিনভাই এখনো একসাথেই থাকেন। বাড়ীটা জুড়েই কেমন যেন একটা শৈল্পিক ছোয়া বিরাজমান। ইশিতা আপুর মা আর চাচীরা এসে একগাদা নাস্তা দিয়ে গেছে।
একটুপর ইশিতা আপুকে নিয়ে আসা হলো একটা পিংক কালার শাড়ী পড়া। সিম্পল সাজে। দেখতে ভালোই লাগছিলো। যদিও আমি জানতাম আপুকে দেখলে সবারই প্রছন্দ হবে। আপু খুবি ভালো মনের মানুষ ও। হঠাৎ করে আপুর পাশে আরেকটা মেয়েকে এসে দাড়াতে দেখি। গায়ের রঙ ফরশা, বেশ লম্বা চেহারায় একটা চপলতা আছে। আমার কেন যেন মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি? মনে করতে পারিছি না। উফ এত অস্বস্তি হচ্ছে কেন?
আমি ইমনের দিকে তাকালাম,
ওর চোখের দৃষ্টিবলে দিচ্ছে ওর কিছু একটা হয়েছে। কপালের সুক্ষ্ম ভাজটা আমার টেনশনের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার মেয়েটার দিকে তাকালাম সে নিচে তাকাই আছে। আন্টি এসে পরিচয় করাই দিলো,
— এ আমার ছোট বোনের মেয়ে ইউশা। ডাক্তারি পাশ করে এখন আপাতত একটা ক্লিনিকে জব করছে।
আমি চমকে উঠে মেয়েটার দিকে তাকাই!
আন্টি আবারো বলতে লাগলো ভাইয়াকে দেখিয়ে ইউশা ইনি তোমার হবু দুলাভাই, আর এরা হচ্ছে তোমার বোনের হবু ননদ আর ননদের স্বামী।
মেয়েটি চোখতুলে একবার ইমনের দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। মূহূর্তেই মুখটা কালো বানিয়ে ফেললো। বিস্ময়ে আমি দুই চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। মেয়েটা কারো সাথে আর কোন কথা না বলে দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।
বুকের চিনচিনে ব্যাথাটা বাড়তে লাগলো। কিছুতেই চাইতে পারছিলাম না। চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। একটুপরেই আমি সেন্স হারাই। সেন্স ফিরলে সবাইকে রেখে ইমন আমাকে বাসায় নিয়াসে।
ব সারা রাস্তা ওর সাথে আমি একটা কথাও বলিনি। যদিও পুরো রাস্তা ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল আমি ওর বুকে মুখ গুজে ছিলাম।
চলবে…