দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-২৯+৩০

0
285

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ২৯+৩০
নীলাভ্র জহির

মানুষ বদলে যেতে সময় লাগে না। মুহূর্তেই প্রিয়তম মানুষগুলো সবচেয়ে ঘৃণার মানুষের পরিণত হতে পারে। কিন্তু যে বদলে যায় সে কখনো বুঝতেই পারেনা অপর মানুষটা তার পরিবর্তন সহজে মেনে নিতে পারে না। ভীষণ কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে ভেতরটা নিঃশেষ হয়ে যায়। রূপকের এই বদলে যাওয়া চিত্রার কাছে আকস্মিক কালবৈশাখী ঝড়ের মতন। এই ঝড়ের তান্ডবে তার সমস্ত কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রত্যেক দিন সকাল বেলা প্রচন্ড বমি আর মাথা ঘুরানো নিয়ে সে অসহায়ের মত বিছানায় পড়ে থাকে। রূপক একটিবারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকায় না। তার অসুস্থ স্ত্রী কিভাবে কষ্ট পাচ্ছে সেই জিনিসটা অনুভব করেনা সে। ভোরের আলো ফুটলেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। যখন সূর্য ওঠে তখন বাসায় ঢুকে ভাত খেয়ে চলে যায় দোকানে। এমনকি যাবার আগে একটি বার চিত্রার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। বিয়ের পর থেকে প্রত্যেকটা দিন চিত্রা কে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে সে বাড়ি থেকে বের হতো। বাজারে গিয়েও সারাক্ষণ ছটফট করত কখন বাড়ি ফিরে আবার তার বৌকে কাছে টেনে নিতে পারবে। সেই চিত্রা যেন ধীরে ধীরে তার চোখের বিষ হয়ে উঠেছে।

রাত্রি বেলা ঘুম ভেঙে গেলে আজ ঘুমের ঘোরে চিত্রা রূপকের বুকে নিজের মাথাটা ঠেসে দেয়ার চেষ্টা করল। তাকে বাধা দিলোনা রূপক। দীর্ঘদিন পর স্বামীর বুকে মাথা রাখতে পেরে পরম শান্তি অনুভব করল চিত্রা। দুই হাতে গভীরভাবে সে রূপককে জড়িয়ে ধরল। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল নীরবে। গত কয়েক দিনে একটিবারও তারা কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়নি। এমনকি ঘুমের ঘোরেও রুপক কখনো চিত্রার দিকে সরে আসেনি পর্যন্ত। আজ চিত্রা কিছুতেই রূপককে আর ছাড়বে না ভাবলো। সে পরম আবেগে জড়িয়ে রইল তার স্বামীকে। আচমকা রূপকের কী হলো কে জানে? চরম বিরক্তিতে চিত্রাকে সে বুক থেকে সরিয়ে দিল। আচমকা এভাবে পাশে সরিয়ে দেয়ায় প্রচন্ড কষ্ট পেলো চিত্রা। ভালোবাসার অপমান সবথেকে বড় অপমান। তার প্রতি এতটা রাগ এখনো পুষে রেখেছে রূপক। তবে মনে হচ্ছে সে কোন রাগ পুষে রাখে নি। বরং ক্রমাগত তার রাগটাকে ভেতরে ভেতরে বেড়ে শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে। চিত্রা নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার শব্দ রূপকের হৃদয়ে পৌঁছালো না। কেবল মাথার নিচের বালিশটা ভিজতে লাগল চোখের নোনা জলে। রূপকের হৃদয়টা যেন চরম নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। তার পাশে কেউ কাঁদছে তাতে কিছুই যায় আসে না তার।

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়ে সকালের দিকে শরীরটা আরো খারাপ হয়ে গেল চিত্রার। বিছানা থেকে উঠতে পারল না। রূপক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সকাল সকাল দোকানে চলে গেছে। সকাল দশটার দিকে জোসনা বেগম ঘরে ঢুকে চিত্রাকে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ও বউ তোমার কি হইছে? তিনি খেয়াল করে দেখলেন চিত্রা কথা বলতে পারছে না। অনেক কষ্টে চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে কেবল তার দিকে তাকিয়ে রইল। পরমুহূর্তেই আবার বন্ধ করে ফেলল চোখ। চেহারা ফ্যাকাশে আকার ধারণ করেছে। ভয় পেলেন জোসনা বেগম। তিনি দৌড়ে গিয়ে পাশের বাড়ির কর্তাকে পাঠালেন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে।

ডাক্তার এসে চিত্রাকে ভালোভাবে পরখ করলেন। চিন্তাগ্রস্থ মুখে জোসনা বেগমকে তিনি বললেন, ওনার শরীর খুবই দুর্বল। খাওয়া-দাওয়া করে না নাকি?
জোসনা বেগম চুপ করে রইলেন। গত কয়েকদিন ধরে চিত্রা নিয়ম করে খাবার খাচ্ছে না। তাদের স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব’র ফলাফল এটা।
ডাক্তার বললেন, এতে ওনার বাচ্চার জন্য খুবই রিস্ক হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাটা পুষ্টি পাচ্ছে না। এতে করে বাচ্চা যেমন অসুস্থ হয়ে জন্ম নিতে পারে তেমনি ওজনও কম হবে। পরবর্তী জীবনে গিয়ে দেখা যাবে অসুখ-বিসুখ সারাক্ষণ লেগেই আছে। এ সময় আসলে গর্ভবতী মায়ের অনেক ভালো ভালো খাবার খাওয়া দরকার। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। তাছাড়া উনি নিজেই যদি এভাবে অসুস্থ হয়ে যায়, ওনাকে নিয়েই তো আপনাদের টানাটানি হয়ে যাবে। বাচ্চা তো অনেক পরের কথা। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি। ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দিব। এগুলা নিয়মিত খাওয়াবেন। আর পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন। প্রত্যেকদিন খাবারে মাছ মাংস দুধ ডিম এগুলো রাখার চেষ্টা করবেন।

জোসনা বেগম চুপ করে রইলেন। মনে অশান্তি থাকলে কি আর খাবার খেয়ে কাজ হয়। তিনি ভালোমতোই বুঝতে পারছেন তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের মাঝে বড় ধরণের অশান্তি চলছে। গত কয়েক দিনেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে চিত্রাম দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগছে? চোখের নিচ কালো হয়ে গেছে।
ডাক্তারি চিত্রাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেন, দেখুন এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। এই সময়টা সবাই পার করে। আপনার মা আপনার শাশুড়ি তারাও তো মা হয়েছেন। আপনি ভেঙে পড়বেন না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করুন। শরীরটাকে সুস্থ করে তুলুন। নয়তো পরবর্তীতে এর ফল আপনার বাচ্চাটা ভোগ করবে। সবসময় অসুস্থ থাকবে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমার কথাগুলো।

চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। ডাক্তার সাহেব শুধু শরীরের অসুখটাই দেখলেন? মনের অসুখটা দেখলেন না। তার মনের অসুখ সারাতে পারে একমাত্র রূপক। সেই রূপক যখন অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে এই অসুখ সারবে না কখনো। বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিচ্ছে তার সন্তান।
ডাক্তার জোসনা বেগমকে বললেন, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে আপনার পুত্রবধূর চেকআপ করিয়ে আনবেন। এ সময় নিয়মিত চেকআপ করতে হয়। যে কোন সমস্যা থাকলে তাহলে জরুরি ভিত্তিতে কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে। আর এমনিতেই উনি অপুষ্টিতে ভুগছে। আজ কালকের মধ্যে ওনাকে একবার চেকআপে নিয়ে যাবেন। বাচ্চাটা সুস্থ আছে কিনা সেটা জানা দরকার।

জোসনা বেগম নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লেন। ডাক্তার চলে গেলে বারান্দার খুঁটি ধরে কাঁদতে কাঁদতে জোসনা বেগম বললেন, জানিনা আমি কোন পাপ করছিলাম। কোন পাপের শাস্তি পাইতাছি। আমার পোলার সংসারে অশান্তি। কি জন্য এত তাড়াহুড়া কইরা আমি খোঁজ খবর না নিয়ে তারে বিয়া দিয়া দিলাম। বিয়া হইতে না হইতে মাইয়া পোয়াতি হইল। সংসারে অশান্তি শুরু হইল। পোলার আমার কপালটাই খারাপ।

চিত্রার দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই মুহূর্তে মনে মনে মৃত্যু কামনা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
জোসনা বেগম থালায় ভাত তরকারি নিয়ে এসে বললেন, উইঠা খাইয়া লও। এমনে পইরা থাইকো না। কোন দিকে যে যামু আমি। আমার হইছে মরন জ্বালা।

উঠতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল চিত্রা। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। তবুও হাত ধুয়ে ভাত খেতে বসলো। খাবার মুখে দিয়ে বমি এল ভেতর হতে। একদমই খাবার খাওয়ার মত শক্তি কিংবা রুচি কোনটাই নেই। তবুও খেতে হবে। তার নিজের জন্য নয় বরং অনাগত সন্তানের জন্য। ডাক্তার যে কথাগুলো বলে গেছেন সেগুলো এখনও কানে বাজছে চিত্রার। নিজের অপরাধে একটা নিষ্পাপ শিশুকে সে কষ্ট দিচ্ছে। জোর করে কয়েক লোকমা ভাত মুখে পুরে দিয়ে বসে রইল চিত্রা। আবারো মাথা ঘুরাচ্ছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

দুপুরের পরপর রূপকের গলা শুনে ঘুম ভাঙলো চিত্রার। সে পাশ ফিরে দেখল তার পাশে দাড়িয়ে রয়েছে রূপক। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। জোসনা বেগম তাকে বলে যাচ্ছে ডাক্তার কি কি বলেছে। রূপক সব শুনে চিত্রাকে বলল, ওষুধ সব আইনা দিছি। ভাত খাওনের পর ওষুধ গুলা খাইতে হইবো।
চিত্রা ওঠার চেষ্টা করল। রূপক সাহায্য করলো তাকে। ছলছল চোখে চিত্রা রূপকের দিকে তাকায়। কতদিন পর রূপক তাকে স্পর্শ করেছে। সে রূপকের বুকে হেলান দিয়ে বসে। পরম শান্তি শান্তি লাগে তার।
রূপক বলল, আমি ডাক্তারের ঐখানে গেছিলাম। সব শুনছি। এখন তুমি যদি এইরকম কইরা আমার পোলাডার জীবনটা নষ্ট কইরা দাও কেমনে হইব? তোমার কি মনে হয় না এই সময় তোমার বুইঝা শুইনা চলা উচিত?
চিত্রা চুপ করে রইলো। আর মনে মনে বলল, আপনি আমারে ক্যান এভাবে কষ্ট দিলেন এতদিন। আপনি আমারে এমনে কষ্ট না দিলে আমার শইলটা ভালই থাকতো। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না।
রূপক বলল, ভাত খাইয়া লও। বইসা থাইকো না। শইলে একটু আলো বাতাস লাগাও। ওষুধ কোনটা কোনটা খাইতে হইবো আমি দেখাইয়া দিতাছি।

রূপক চিত্রাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এইটুকু ভালোবাসার স্পর্শেই যেন চিত্রার শরীরে অনেক শক্তি ফিরে এসেছে। সে বেশ বুঝতে পারল ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর নাই। সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করে চিত্রা উঠে ভাত খাওয়ার চেষ্টা করল। আবারো তার পাশে এসে বসল রূপক।
চিন্তিত মুখে বলল, তোমারে একখান কথা কই। আমি ঝামেলা পছন্দ করিনা। তোমার লগে কোন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি করার ইচ্ছা আমার নাই। কিন্তু আমি চাই তুমি নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। ভালো কইরা চলা ফেরা করো, নামাজ-কালাম পড়ো। আমাগো বংশের মধ্যে আমি প্রথম বাবা হইতেছি। আমার পোলা সবার আদরের মণি হইবো। তুমি তারে কোন কষ্ট দিও না। তারে যেই ভাবে সুস্থ সবল কইরা দুনিয়াতে আনা যায় তুমি সেই চেষ্টা করো। এই সময়ে তার শরীর তুমি খারাপ কইরা দিও না। ডাক্তার নাকি কইছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে চেকআপ করাইতে। কাল সকালবেলা মারে নিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাইবা। ডাক্তার আপা যা যা কইব মন দিয়ে শুইনা সে অনুযায়ী কাজ করবা।

চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তর দিল, আচ্ছা ঠিক আছে।
তোমার লাইগা ফল ফ্রুটস আনছি। ওইগুলা খাইবা। শইলে এখন ভিটামিনের দরকার আছে।

চিত্রা ফ্যালফ্যাল চোখে রূপকের দিকে তাকিয়ে রইল। তার শুকনো চোখের দিকে তাকিয়ে যেন হঠাৎ করেই রূপকের মনে বড় মায়া হয়। মুহূর্তেই একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে রূপক চোখ ফিরিয়ে নেয়। বুকটা চিন চিন করে ওঠে চিত্রার। কতদিন পর যেন একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়েছে তারা। মনে হচ্ছে মাঝখানে কেটে গিয়েছে যুগের পর যুগ। যেন শতবর্ষ তারা একে অপরকে দেখে নি এভাবে। মাত্র কয়েকদিনের দূরত্ব তাদেরকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে যোজন যোজন দূরে।

রূপকের পাশে বসে বেশ খানিকটা ভাত খেয়ে নিতে পারল চিত্রা। খাওয়া শেষে রুপক তাকে দেখিয়ে দিলো কোন ওষুধ গুলো কখন নিয়ম করে খেতে হবে। রূপকের গলা আজকে বেশ ঠান্ডা। চিত্রা বারবার ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকাচ্ছে। বলার মতো কোন কথা নেই কিংবা শক্তি নেই মুখ ফুটে কিছু বলার। তার নিষ্প্রাণ চোখ বলে দিচ্ছে রূপকের বাড়ি ফেরায় কতটা আনন্দিত হয়েছে সে।

দোকানে যাওয়ার আগে রূপক চিত্রাকে বলল, তোমার লাইগা কিছু আনতে হইবো? কিছু খাইবা?
চিত্র ঘাড় বেঁকিয়ে রূপকের দিকে তাকালো। তারপর মাথাটা দুদিকে নাড়ায়। ইশারায় বোঝাতে চায় সে কিছু খেতে চায় না। তবে রূপকের এই প্রশ্নে অসম্ভব খুশি হয়েছে সেটা তার শুষ্ক মুখের হাসি দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
রূপক বেরিয়ে গেল দোকানের উদ্দেশ্যে। মনে মনে খুশি হল চিত্রা। তার অসুস্থতা যেন দুজনকে আবারো এক করে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কয়েকদিনের সৃষ্টি হওয়া অমোঘ দূরত্ব। চিত্রা নিজের পেটের ওপর হাত বোলায়। তার মনে হচ্ছে এই সন্তানের উছিলায় সবকিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে। একটা সন্তান সত্যিই স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে অনেক বড় সেতুবন্ধন। সে সব সময় শুনে এসেছে বাচ্চার জন্য টিকে আছে সংসার। মুরুব্বীরা সবসময়ই বলে একটা বাচ্চা নিলে স্বামী আর কখনো ছেড়ে যায়না। এই সমাজে একজন সন্তান সংসার টিকিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার। এতদিন সেটা শুনে আসলেও কখনো বিশ্বাস হয়নি কথাটা। আজ নিজেকে দিয়ে সে বেশ উপলব্ধি করলো কথাটা হারে হারে সত্যি। অনাগত সন্তানের প্রতি হঠাৎ করেই তার ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়ে গেল। পেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে আপন-মনে চিত্রা বলল, তোর এই দুঃখিনী মায়ের পাশে তুই থাকিস বাবা।

রূপক বাড়ি ফেরার সময় বিশাল এক ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরলো। বাজারের থলেতে রয়েছে লম্বা লম্বা বেগুন, আলু ও মশলাপাতি। বাড়িতে ঢুকেই জোসনা বেগমকে বলল, মা তুমি তো খুব মজা কইরা বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ রান্ধ। আইজ রান্না করবা। বাজারের সবচাইতে বড় ইলিশ মাছটা আনছি। নির্মলের ক্ষেতের টাটকা বেগুন আনছি। নেও ভালো কইরা রাইন্ধ।
জোসনা বেগম তার ছেলের মুখের দিকে খানিকক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেকে ভীষণ হাসি খুশী দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন, এত বড় মাছ আনছিস আজকে। কি ব্যাপার?
বড় মাছ কি আনতে ব্যাপার লাগে? খাইতে মন চাইলো তাই কিইনা আনলাম।
জোসনা বেগম আর কোন প্রত্যুত্তর’ করলেন না। বটি নিয়ে এসে তিনি মাছ কাটতে বসে গেলেন। চিত্রা কে ডাকতে ডাকতে বললেন, ও বৌমা দেইখা যাও।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। উঠানে কুপি নিয়ে বসেছেন জোসনা বেগম। তার সোনালী আলোয় ইলিশ মাছের গা চকচক করছে। চিত্রা মাছ দেখে চোখ বড় বড় করে রূপকের দিকে তাকালো। হাসি হাসি মুখ রূপকের। মনে হচ্ছে ভালো কোন খবর আছে। কিন্তু সেটা জানতে সাহস পেল না সে।
ঝিঝির ডাক কান ভারি করে তুলছে। রুপক পিড়ি নিয়ে বসে মায়ের মাছ কাটা দেখতে লাগলো। পাশেই দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল চিত্রা। তার খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে বাবা রাত করে মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরতেন। মা যখন বসে মাটিতে মাছ কাটতেন তখন বাবা চিত্রা কে ডেকে পাশে বসিয়ে মাছ কাটা দেখাতেন। আর বলতেন, দেখো কত বড় মাছ লইয়া আইছি। আমার মাইয়া খাইবো। আমার পরি আম্মা খাইবো। সেই দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠতেই হুহু করে কান্না এসে গেল চিত্রার। খুব ছোটবেলায় সে মাকে হারিয়েছে। আর সেই সঙ্গে হারিয়েছে বাবার আদর স্নেহ। মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবাটা ধীরে ধীরে কেমন যেন অসহায়ের মত হয়ে গেল। তার হৃষ্টপুষ্ট বাবা শুকিয়ে হয়ে গেল কাঠ। তার মা মরেছে ডায়রিয়ায়। মায়ের মৃত্যু তার বাবা সোহরাব উদ্দিন মেনে নিতে পারেননি। মানুষ শুধু শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়না। মানসিকভাবেও পঙ্গু হওয়া যায়। সোহরাব উদ্দিন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। স্ত্রীকে হারানোর শোকে তিনি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে এতটাই ভেঙ্গে পড়লেন যে কোন কাজেই আর মন দিতে পারলেন না। ছোট্ট মেয়েটাকে মানুষ করার জন্য সবাই তাকে আরেকটা বিয়ে করতে পরামর্শ দিতে লাগলেন। কিন্তু তিনি নিজের স্ত্রীর স্মৃতি ভুলে অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না। শোকে দুখে ধীরে ধীরে কেমন যেন মানুষটা পাথর হয়ে উঠলো। সেই থেকে শুরু তার কর্মহীন জীবন। অনেক কষ্টে মাঝে মাঝে দু’একদিন কামলা দিয়ে যা ভাত তরকারি জুটত, তাই দিয়ে এই মেয়েটাকে তিনি মানুষ করেছেন। বাবার প্রতি তাই অনেক কৃতজ্ঞ চিত্রা। তবে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের মত তার ছোটবেলা কিংবা কৈশোর সুখকর হয়নি। স্কুলে পড়াশোনা করেছে অনেক কষ্ট করে। সেই পড়াশোনাও বেশি দূর করতে পারেনি। পড়াশুনায় বেশ মেধাবী ছিল চিত্রা। তবে সুপ্রসন্ন হয়নি তার ভাগ্য। সেসব কথা ভেবে এখন কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আনমনে গালে হাত দিয়ে বসে চিত্রা এসকল কথাই ভাবছিল। রূপকের ডাকে তার সম্বিৎ ফিরলো।

রূপক বলল, আমারে এক খিলি পান দেও তো।
চিত্রা বারান্দা থেকে আরেকটা কুপি জ্বালিয়ে নিয়ে শাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকলো। গ্রামের মহিলারা বিয়ে হতে না হতেই পান খাওয়া শুরু করে। তার এখনও সেই অভ্যাস হয়নি। তাই তার ঘরে পানের বাটা থাকেনা। জ্যোৎস্না বেগমের পানের বাটা থেকে সে রূপকের জন্য এক খিলি পান তৈরি করল। আজকে তার মনটা বড় ভালো। কারণ গত দুদিনে ভালো ভালো খাওয়া আর দুশ্চিন্তা কমে যাওয়ায় শরীরটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। রুপকের আচরণও আগের থেকে স্বাভাবিক। গত কয়েকদিন আগে হওয়া ঝড়টা ধীরে ধীরে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে ছিল সেটা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। যদিও এখনও তার সঙ্গে খুব একটা ঘনিষ্ঠ হয়নি রূপক। তথাপি রূপকের স্বাভাবিকতাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করছে চিত্রা। সে পানের খিলি নিয়ে এসে রূপকের হাতে দিল।
জোসনা বেগম বললেন, পোয়াতি মাইয়ার তো একবার বাপের বাড়ি ঘুইরা আসা দরকার। সবাইতো যায়। ছয় মাসে গিয়া একবার নাইওর দিয়ে আসা উচিত। তোর শ্বশুর কি ওরে নিয়া যাইবো?
– সেইডা আমি কেমনে কমু? তার মাইয়া তার তো কোনো হুস নাই।
– তোর ফুপু শ্বাশুড়ীও তো একবার খোঁজ নিলোনা। মেলাদিন হইয়া গেল। তুই দেখছস। আমরা সাইকেলের আশায় বইসা থাকলে কচুডা পাইতাম। এরা সাইকেল দেওয়ার ভয়ে একবার মাইয়ার লগে যোগাযোগ করল না।
– যোগাযোগ করছি আমি। কয়েকদিন আগে যোগাযোগ করছি। ওর ভাইয়ের লগে। সব ডিসমিস কইরা দিছি।
– কি ডিসমিস করছোস?
– সম্পর্ক। ও আমার লগে যা করছে তার পরে ওর লগে সম্পর্ক রাখার কোন মানে হয়না।
– ও তোর লগে আবার কি করছে?
জোসনা বেগম মাছ কাটা বন্ধ করে তার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।
রূপক পান চিবোতে চিবোতে পানের পিক ফেলল মাটিতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ঐগুলা তোমার শুনতে হইবো না। বাদ দাও।
– ওর লগে তোর ঝামেলা হইছে। এই ঝামেলার জের ধইরা তুই তোর বউয়ের লগে এই কয়দিন ঝগরা করছিলি?
রূপক এক সেকেন্ডের জন্য চিত্রার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আসলে ঝামেলাটা তো চিত্রার সঙ্গেই হয়েছে। সেই ঝামেলার জের ধরেই চিত্রার ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়েছে। এই কথাটা সে মাকে বলতে পারবেনা। সে চায় না তার ব্যক্তিগত কষ্টের কথা শুনে তার মা ও কষ্ট পাক। কারণ তার স্ত্রী গর্ভবতী। মা জানতে পারলে তার স্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। যেটা তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আবারো একবার পানের পিক ফেলল রূপক।
জোসনা বেগম বললেন, তাদের মাইয়া পোয়াতি। খোঁজ খবর তো নেওয়া উচিৎ। তোর ফুপু শ্বাশুড়ী ও কোনদিন দেখতে আইলো না। কেমন মানুষ তারা? মাইয়াডার শইল্যের কি অবস্থা দেইখা তো যাওয়া দরকার।
– আর মাইয়া। তারা মাইয়ারে আমার কান্ধে চাপাইয়া দিয়া জন্মের মত বাইচা গেছে। তাদের ঘাড় থাইকা আজাব নামছে। কিসের লাইগা দেখতে আইবো তারা।

অনেকক্ষণ ধরে রূপকের এই কথাগুলো চিত্রা মুখ বুজে হজম করছে। কষ্ট হচ্ছে তার। সবসময় জোসনা বেগমের এ ধরনের কটুক্তি শুনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু রূপকের মুখ থেকে কোনদিনও এমন কথা শুনতে হবে কখনো আশা করেনি।
চিত্রা নিঃশব্দে তার ঘরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে মাছ কাটা বন্ধ করলেন জোসনা বেগম। এসব হচ্ছেটা কি? এতদিনেও তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমছে না। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েও ভেতরে ভেতরে যেন কিছু একটা ধীরে ধীরে কয়লার আগুনের মত বেড়ে উঠছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে কি হয়েছে? কি এমন বিষয় নিয়ে এমন মনোমালিন্য হচ্ছে রুপক- চিত্রার? এসব ভাবতে ভাবতে জোসনা বেগম আবারো মাছ কাটতে মনোযোগ দিলেন।
রূপক এবার নিজের ঘরে এলো। বিছানায় শুয়ে আছে চিত্রা। ঘর অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে মৃদু আলো আসছে। তাতে আন্দাজ করা যায় চিত্রা ঠিক কোন জায়গাটায় শুয়ে আছে। তার পাশে এসে দাঁড়াল রূপক। বলল, আমার মায়ে মাছ কাটতেছে আর তুমি আইসা এইখানে শুইয়া পড়লা। মাছ না কাটলেও অন্তত মাছ ধুইতে আমার মায়েরে একটু সাহায্য করতে পারতা। অনেকদিন ধইরা দেখি কোন কাম কাজই করো না। সারাক্ষণ শুইয়া বইসা কাটাও। পোয়াতি হইলে কি একবারেই কাম কাজ বন্ধ কইরা শুইয়া থাকতে হইবো নাকি?

চিত্রা বেশ অবাক হল। একই সাথে তার বুকের কোথায় যেনো কেটে কেটে ছিদ্র হয়ে যেতে চাচ্ছে। যেই রূপক নিজেই তার মায়ের কাছে অনুরোধ করেছিল যেন চিত্রাকে সে বিশ্রামে থাকতে দেয়। অথচ আজ সেই রূপক তাকে এত বিশ্রী ভাবে কথা শোনাচ্ছে। একটা ছোট্ট ঘটনা কীভাবে যেন তাদের দুজন মানুষের সম্পর্কটাকে ভয়াবহভাবে বদলে দিল। একই সঙ্গে বদলে দিল তার ভালোবাসার মানুষের মন মানসিকতাকে। ভালোবাসাটা কি এখনো আছে নাকি সেটাও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে?

ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল চিত্রা। অন্ধকারে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে ধপ করে পড়ে যাচ্ছিল। শব্দ শুনে সেটা রূপক আন্দাজ করতে পেরেছে। সঙ্গে সঙ্গে রাগত স্বরে রূপক বলল দেইখা শুইনা চলতে পারো না। বেয়াক্কেলের মতো আচরণ করো কেন? এমন চলাফেরা দেখলে মেজাজ খারাপ হইয়া যায়।

চিত্রা কোন উত্তর দিল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে শাশুড়ি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বললো, আম্মা আমি কল থাইকা পানি আইনা দেই।
আরে না। এই সময় পানির ভারি বালতি তোলার কোন দরকার নাই।
জগে কইরা আনি।
দরকার নাই। আমার মাছ কাটা শ্যাষ। তুমি এইখানে খাড়াও। আমি পানি লইয়া আসি।
জোসনা বেগম হারিকেন ও একহাতে বালতি নিয়ে গেলেন পানি আনতে। চিত্রা বসে রইল স্তব্ধ মুখে। মন খারাপ হয়ে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েও কেন যেন হচ্ছে না। রূপকের ভিতরে ধীরে ধীরে ভেঙে ভেঙে পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ টা কি আর আগের মতো কোনদিনও হবে না? যার পরম ভালোবাসায় চিত্রার সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হতো, তার আকস্মিক পরিবর্তন তো মেনে নেয়ার মত না। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই এই ভয়টা পেয়েছিল চিত্রা। সব সময় তার মনে শঙ্কা ভর করতো এই বুঝি তার কপাল থেকে সুখ চলে যায়। চরম সুখের মুহূর্তে তার মনে হতো এত সুখ তার কপালে সইবে তো? আজ সত্যিই মনে হচ্ছে তার কপালে এত সুখ সইবে না। আর তাই তো দুজন মানুষ পাশাপাশি থেকেও বাড়ছে দূরত্ব। ভালোবাসা পাওয়ার পর তা হারিয়ে ফেললে মানুষ কি নিয়ে বাঁচে? সুখের স্মৃতি নিয়ে দুঃখের সাগরে ভেসে থাকে। এ কেমন জীবন এর লীলাখেলা?

এমন সময় জোসনা বেগমের ক্রুদ্ধ গলা শোনা গেল। তিনি চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন, আরে আরে বিলাইটা মাছ নিয়া যাইতাছে।
চিত্রা সম্বিৎ ফিরে সামনে তাকিয়ে দেখল একটা বিড়াল এসে প্রায় মাছে মুখ দিচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে স্বতন্ত্র হয়ে বিড়ালকে তাড়িয়ে দিল। জোসনা বেগম বালতি রেখে রেখে দৌড়ে এসে বললেন, তোমারে আমি বসাইয়া রাইখা গেলাম। আর তুমি ধ্যান করতে বইছো। কোন দিকে চাইয়া ছিলা? বিলাই আইসা মাছে মুখ দিয়া ফেলছে। আমি না দেখলে নিয়া দৌড় দিত। তুমি কি কানা নাকি। কাণ্ড কারবার কিছুই বুঝতাছি না।

চিত্রা অপরাধীর মত মুখ করে মাথা নিচু করে রইল। জোসনা বেগমের কথা থামল না, আমার পোলা এত টাকা দিয়া বাজারের বড় মাছটা নিয়ে আইছে। এই মাছ তুমি বিলাইরে খাওয়াইতা। আমি না থাকলে তোমাগো সংসারের যে কি হইব? আজকালকার মাইয়াগো মন মতিগতি কিছু বুঝিনা। দুইদিনের সংসারে কি অশান্তি শুরু করছে। পোলার মনে আমার শান্তি নাই। এদিকে তুমি আছো উদাসীন হইয়া। মন মতি গতি কোন দিকে থাকে বুঝিনা। সংসারে কোন মন নাই।

এমন সময়ে রূপক বেরিয়ে এসে জানতে চাইল কি হইছে? চিল্লাইতাছো ক্যান?
– চিল্লামু না কি করমু? বিলাই আইসা মাছে মুখ দিছে। কামড় দিয়া নিয়া যাইতো। এত সাধ কইরা বাজারের সবচাইতে বড় মাছটা নিয়া আইছস। তোর বউরে বসাইয়া রাইখা আমি গেছিলাম কলে পানি আনতে। তার চোখের সামনে দিয়া বিলাইডা আইছে। তার মন কোন দিকে ছিল আল্লাই জানে।

মাথা নিচু চিত্রার। পানিতে চোখ ভিজে যাচ্ছে। ছলছল চোখে ঝাপসা দেখছে সবকিছু। রূপক বলল, থাউক এত রাতে আর চিল্লাচিল্লি কইরো না। বিলাই মাছ নিয়া গেলে কি আর করতাম। খাওয়া হইতো না। না হইলে না হইত।
হ, কইলেই হইলো। কত টাকা দিয়া ইলিশ মাছ নিয়া আইছোস।
আর টাকা। জীবনটাই শেষ হইয়া যাইতাছে। টাকা দিয়া কি করমু।
জোসনা বেগম আর কিছু বললেন না। তবে এটুকু বুঝতে পারলেন যে চিত্রার কারণেই তার ছেলের জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিত্রা যেমন সংসারে অমনোযোগী নিশ্চয়ই তেমনি তার ছেলের প্রতি উদাসীন। হয়তো কোনো আচার-আচরণে তারা সে তার ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছে। তাই কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার ছেলেটা।
জোসনা বেগম মাছ নিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের সামনে রাখা শানের ওপর ধুতে লাগলেন। মাছ ধুতে ধুতে তিনি বললেন, যন্ত্রণার মধ্যে পড়ছি আমি। কোন দিকে যামু বুঝতাছি না।
– তোমার কোথাও যাইতে হইবো না মা। যেদিন মন চাইবো আমিই চইলা যামু কোন একদিন।

কথাটা বলে রূপক আবারও গিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল চিত্রা। তার অশ্রুসজল চোখ থেকে টপ করে এক ফোটা জল মাটিতে পড়ল। এক ফোঁটা জলে হয়তো মাটি ভিজে না। তবে তার বুক ভিজে যাচ্ছে। বুকের ভীতর তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। এত কষ্ট নিয়ে কি করে বেঁচে থাকা যায়। নিজেকে তার মনে হচ্ছে নর্দমার কীট। সে সংসারের উপযোগী নয়। একটা কাজ ভালোমতো করতে পারেনা। কিভাবে শাশুড়িকে খুশি করতে হয় তাও জানে না। সংসারী মনোভাব কেমন হওয়া উচিত তাও বুঝতে পারেনা চিত্রা। তার জীবনটা কষ্টে কষ্টে কেটে যাচ্ছে। মা-মরা মেয়েদের জীবন হয়তো এমনই হয়। সংসারের ভালো-মন্দ তারা বুঝতে শেখে না। বাউন্ডুলে বাবার সংসারে নিজের মত সে সময় কাটিয়েছে। কোনদিনও হয়তো রান্না হয়েছে, কখনো হয়নি। সংসারের কোনো কিছুই বুঝতে শেখেনি চিত্রা। তার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার। আর ফুফুর সংসারে সে ছিল একজন মেহমান মাত্র। কিংবা বলা যায় কাজের মেয়ে। ভাবিদের আদেশ মেনে কাজ করতো। তবে কাউকে খুশি করতে হয় কিভাবে সেটা চিত্রার জানা নেই। আর তাই আজ নিজের সংসারে এসে সে একেবারেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পর্যায়ে পরিণত হয়েছে। প্রথম থেকেই জোসনা বেগম তাকে পছন্দ করছে না, এখন স্বামীও তার প্রতি অসন্তুষ্ট। এই সংসারে তার আর কিছু রইল না। কেবল মুখ বুজে সহ্য করে পড়ে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই তার।

খুঁটির মত দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। জোসনা বেগম বিড়বিড় করে দুঃখ কষ্টের কথা বলছেন। কোন কথাই তার কানে ঢুকছে না। যেন সে শুনতে পারছে না কিছুই। জোসনা মাছ ধুয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। আর কোন শব্দ শোনা গেল না। বারান্দায় বিছানো পার্টির ওপর এসে বসল চিত্রা। খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে জ্বলজ্বল করছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তার ইচ্ছে করছে একটা তারা হয়ে যেতে। যদি পারত সে নিজেও নক্ষত্র হয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করত। একদম একা। সে কাউকে কষ্ট দিতে পারত না। তাকেও কেউ কষ্ট দিত না। কি এমন হতো সে যদি মানুষ না হয় নক্ষত্র হয়ে জন্মাত?

চলবে..