নীলচে তারার আলো পর্ব-৩২+৩৩

0
870

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩২

অজানা এক ভালোলাগা ঘিরে ধরলো তাকে। কলেজ থেকে ফেরার সময় একবার সে এমন এক দৃশ্য দেখেছে। ঘটনা তার মনে গেথে গিয়েছিল। কিন্তু কখন শুভ্র এইভাবে তার শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে কল্পনাও করেনি সে। শুভ্র ছোট ছোট এই কাজ গুলো তার মনে বিশাল এক জায়গা দখল করে নিয়েছে। হিয়া নিজের অজান্তেই শুভ্র নামের এই চশমা পড়া, গম্ভীর, চুপচাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছে। যে ছেলে হিয়ার ছোট ছোট অনুভূতিগুলোর খুব খেয়াল রাখে তার আড়ালে।

শুভ্র শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করে উঠে দাড়িয়ে শার্টের হাতা ঠিক করে নিলো। শুভ্র তাকানোর আগেই হিয়া তার বিমোহিত দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। সামনের চুলগুলো অকারনেই কানের পিছে গুঁজে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” আমার আর কিছুক্ষণ লাগবে। চুলটা বেধেই চলে আসবো।”

শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হিয়াকে খোলা চুলেই অনেক মায়াবতী লাগছে। শুভ্র চাইলে হিয়াকে আটকাতে পারে কাছে এনে বলতেই পারে যে, আমার ভালো লাগে তোমার এই খোলা চুল। কিন্তু হিয়ার এই মায়াবতী রূপ দেখার একমাত্র অধিকার শুধু তারই আছে। অন্যকেউ তা দেখে বিমোহিত হোক, সে সেটা চায় না। নিজের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে সে হিংসুটে তো বটেই।
শুভ্র হাতে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালো তারপর বললো,” আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নীচে আসবে, নয়তো তোমাকে রেখেই আমি চলে যাবো।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে তাকালো। লোকটা কি একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না? সবসময় খালি হুকুম দিয়ে বেড়ায়। হিয়া মুখ কালো করে নিজের রুমে এলো। চোখের নিচে হালকা একটু কাজল দিয়ে, চুলে একটা খোঁপা করেই বেড়িয়ে এলো সে। ইউভিকে দারোয়ানের কাছে রেখে যেতে হচ্ছে। বদমাইশ ডাক্তার তো আর সঙ্গে করে নিয়ে যাবে না। নিজেই এনে দিয়েছে অথচ এমন ভাব ইউভি যেনো তার চিরো শত্রু।

শুভ্রের সাথে গাড়ি করে কোথাও যেতে হিয়ার একদম ভালো লাগে না। সারা রাস্তা কোনো কথা নেই চুপ চাপ বসে থাকা। কতটা বিরক্তিকর! তাই প্রতিবারের মতন এবারো বসে বসে হিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। গাড়ি জ্যামে আটকা পড়তেই শুভ্র হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া ঘুমে তলিয়ে আছে। ঘাড় কাত হয়ে আছে। শুভ্র সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে এসে হিয়ার ঘাড় সোজা করে দিতে দেখলো হিয়া ঘুমের মাঝেও নিজের ঠোঁটটা কামড়ে আছে। শুভ্র নিজেকে সামলে সরে এসে নিজের সিটে বসে পড়লো। চশমাটা চোখ থেকে খুলে মাথার চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে নিয়ে মুখ দিয়ে তিক শব্দ করে চশমাটা আবার পড়ে নিলো। ধীরে ধীরে নিজের উপর থেকে কন্ট্রোল যেনো সে হারিয়ে ফেলছে। আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে হিয়ার প্রতি।

শুভ্রের দাদাবাড়ি হিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে বিশেষ করে সরিষার মাঠগুলো। অর্ধেক রাস্তা এসে তার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভেঙে ভালোই হয়েছে এতো সুন্দর দৃশ্যগুলো নাহলে মিস করতো।

শুভ্র বাড়িতে এসেই প্রথমে নিজের দাদীর ঘরে এলো। তার দাদী প্রায় অসুখের এমন বাহানা দিয়ে সবাইকে একসাথ করে। এইবারের ঘটনা কি সেটাই শুভ্রর জানতে হবে। সবাই এলে মাইনুর শিক্ষকের এই বাড়ি যেনো তখন হৈ হৈ করে উঠে। তার দাদা শিক্ষক হলেও সেকালে তার এমন দোতলা বাড়ি যেমন সবার নজর কাড়তো এখনো সবার নজর আকর্ষণ করে বাড়িটি।

শুভ্র তার দাদী আকলিমা আক্তারের ঘরে ঢুকলো। ছেলের বউগুলো তাকে ঘিরে বসে আছে। তাদেরও বয়স কম হয়নি। তাদের মধ্যে শুভ্রের মা আকলিমা আক্তারের মাথার কাছে বসে আছেন। শুভ্রকে দেখেই তিনি হাতের ঈশারায় ডাকলেন। দাদীর পাশে বসেই শুভ্র এই নাটকটা ধরে ফেললো। তার দাদির ঠোঁটে হাসি, শুভ্রকে দেখে সে হাসি আরো প্রশস্ত হলো। আকলিমা আক্তার ভাঙ্গা গলায় ডাকলেন,” কি গো ডাক্তার সাহেব.., নতুন বউরে লগে আনো নাই?”

এখন যেনো ঘটনাটা আরো পরিষ্কার হলো তার কাছে। শুভ্র কিছু বলার আগেই তার তার ছোটো চাচার মেয়ে নিধি হিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,” এইযে আমাদের ডাক্তার সাহেবের বউ।”

হিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কারণ রুমে উপস্থিত সব মহিলারা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রের দাদী আস্তে করে উঠেতে চাইলেই শুভ্র তার হাত ধরে তাকে বসালেন। আকলিমা আক্তার উঠে বসে হাতের ঈশারায় হিয়াকে নিজের কাছে বসতে বললেন। হিয়া এগিয়ে গেলো। একবার শুভ্রের দিকে তাকাতেই দেখলো শুভ্রর দৃষ্টি তাকেই দেখছে। হিয়া একপাশে এসে বসলো। শুভ্রের দাদী অনেক কথা বললো তার সাথে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে অসুস্থ। কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি শুভ্রকে বললেন,” ডাক্তার সাহেব, ঘরে ছোট ডাক্তার কবে আসবো?”

” যার যখন আসার সময় তখন সে ঠিক আসবে।”, বলেই শুভ্র উঠে দাড়ালো। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার হিয়ার দিকে তাকালো দাদীর কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে চোখ গুলো রসগোল্লার মতন করে ফেলেছে সে।

শুভ্র এইখানে এসে যে কয়েকদিনের জন্য আটকে গেছে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে। তার বাবা আর চাচাদের দেখো। কারো মা অসুস্থ থাকলে এমন নিশ্চিন্তে আড্ডা দেয়, মানুষ? শুভ্র ধারণা প্রতিবছর এই নাটকের সূত্রপাত তার বাবার বুদ্ধিতেই হয় সঙ্গে তার দুই ভাই। নাহলে মায়ের অসুস্থতায় কেউ ক্যাপ সঙ্গে নিয়ে আসে? তিন ভাই ক্যাপ মাথায় উঠানে বসে আলাপ করছে। শুভ্রের চাচাতো ভাই বোন গুলো এখনো এসে পৌঁছায় নি। ছোট ছোট কয়েকটা এসেছে ঐগুলো এদিক সেদিক ছুটছে।

হিয়া প্রায় অনেক্ষন পর দাদীর ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিল তারপর বৈবাহিক জীবন নিয়ে এমন আলোচনা তাকে শুনতে হয়েছে যে লজ্জায় তার অবস্থা খারাপ। হিয়া খেয়াল করলো সবাই এইখানে শুভ্রকে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকে। ডাক্তার সাহেব ডাকটা তারা এক রাশ ভালোবাসা নিয়ে বলে। হিয়া বাড়ির নিচে পুরোটা খুঁজলো কিন্তু এই ডাক্তার সাহেবকে পেলো না। শুভ্র কি ঘুরতে বেরিয়েছে? গেটের বাহিরে আরো কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে মনে হলো।

হিয়া হাঁটতে হাঁটতে দোতলায় উঠলো। শুভ্র দোতলার লম্বা করিডোরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। রিমি হুট করে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু বুঝলো না সে। রিমিকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতেই রিমি হেসে উঠে বললো,” আহ্, কতো দিন পর তোকে দেখলাম। আমি একমাস হলো দেশে ফিরেছি অথচ তোর দেখা পাই নি।”

রিমি এইখানে কি করে এলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই চলে এসেছিস আমেরিকা থেকে?”

” এভাবে বলছিস কেনো আমি ফিরে আসায় তোর ভালোলাগে নি?”,

শুভ্র না সূচক মাথা নাড়ল। তারপর বললো,” তুই ফিরে এসেছিস তাতে আমার খুশি হওয়ার কি আছে বলতো? স্টুপিডের মতন প্রশ্ন।”

রিমি রেগে গিয়ে বললো,” তুই এত খারাপ কেনো বলতো? মুখের উপরে এভাবে বলে দিলি।” শুভ্র রিমির কাধেঁর উপর হাত রেখে বলল,” আমি তো এমনই।”
রিমি ফট করে হাতটা সরিয়ে মুখ কালো করে বললো,” তুই অনেক নিষ্ঠুর।”

শুভ্র রিমির মাথায় চুল টেনে বললো,” বেশি কথা বলিস। হটাৎ দেশে ফিরে এলি কেনো?”

রিমি শুভ্রের ছোট চাচার বড় মেয়ে। আমেরিকায় এতো বছর থেকেছে বলে তার জামাকাপড় ও সেইরকম। হিয়া শুভ্র আর রিমির এমন জড়িয়ে ধরার দৃশ্য দেখে বড় রকমের একটা শক খেলো। রিমির এমন পোশাক দেখেও হিয়ার মাথা ঘুরছে। সিভলেস কোমড় পর্যন্ত একটা টপ আর নিচে জিন্স প্যান্ট সঙ্গে হাই হিল। কে এই মেয়ে? শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেছে কেনো। কিভাবে কাছে কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দেখো। হিয়ার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো।

হিয়া কিছু না ভেবে এগিয়ে এসে শুভ্রের পাশে দাঁড়ালো। রিমি আর শুভ্র দুজনেই হটাৎ হিয়ার এমন আগমনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। হিয়াকে দেখে রিমি হেসে তাকালো। হিয়া এসেই শুভ্রের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। শুভ্র সেটা খেয়াল করলো। রিমি হেসে প্রশ্ন করলো,” হাই, তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া অনিচ্ছাকৃত হাসি মাখা মুখ নিয়ে বললো,” আমি ওনার ওয়াইফ।” বলেই একটা ঢোক গিললো। রিমি কথাটা শুনে যতটা অবাক হয়েছে শুভ্র তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হিয়ার দিকে তাকালো। বাহ্ ভালোই বুদ্ধি হয়েছে এই পিচ্চির।

রিমি বেশ অবাক হয়ে বললো,” বাহ্ কনগ্রাচুলেশনস।” বলেই আবার শুভ্রকে জড়িয়ে ধরতেই হিয়ার শাড়ির আচল শক্ত করে ধরলো। রাগে পুরো গা জ্বলছে। কথায় কথায় খালি জড়িয়ে ধরে। শুভ্রের থেকে সরে এবার হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,” আমি তো জানতামই না। ইস বড় কিছু মিস করে ফেললাম।”

হিয়া অনেক কষ্ট নিজেকে আটকে রেখেছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। শুভ্র হিয়ার চোখ মুখ দেখে অনেকটা আন্দাজ করে, মনে মনে হাসলো। রিমির ডাক পড়তেই রিমি পড়ে কথা হবে বলে চলে গেলো, হিয়ার মুখটা কালো হয়ে গেলো।

শুভ্র রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে হিয়ার রাগে ফুলে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হিয়া শুভ্রের দিকে মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। আজ পর্যন্ত সে কোনোদিন শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলো না, এর এই মেয়ে একবারে তার সামনে দুই দুবার জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার রীতিমত কাদতে ইচ্ছে করছে। কেনো জড়িয়ে ধরবে শুভ্রকে এই মেয়ে?

শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি হয়েছে কাদঁছো কেনো?”

শুভ্রের এমন রসিকতা শুনে হিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ভালো; ভালো, চালিয়ে যান।”

শুভ্র নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হিয়া রেগে চলে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার হাতটা ধরে নিজের কাছে আনতেই। হিয়া রেগে উঠে বললো,” ছাড়ুন, আমার হাত।”

” এতো রাগ করছো কেনো? আমার কথা আছে তোমার সাথে।”,বলেই শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়ার রাগে কিরমির করেছে তাও একটু শান্ত হয়ে বললো,” কি কথা?”

শুভ্র হিয়ার হাতটা ছেড়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো,” এটা একটু নিয়ে যাও।”

হিয়া রাগে বিস্ফোরিত হয়ে তাকালো। ইচ্ছে তো করছে কাপটা শুভ্রের মাথায় ভাঙ্গে। কি খারাপ…! মজা করছে তার সাথে। হিয়া কঠিন গলায় বলল,” পারবো না। কাপ মাথায় রেখে বসে থাকুন আপনি।” বলেই হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো হিয়া। শুভ্র হিংসুটে হিয়ার রাগান্বিত চেহারা দেখে হেসে ফেললো।

[ #চলবে ]

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৩৩

কাজের মেয়েটা হিয়াকে ঘর দেখিয়ে দিলো। হিয়া ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। এই জায়গাটা এতক্ষণ পর্যন্ত খুব ভালো লাগলেও এখন অসহ্য লাগছে তার। হিয়া মুখ কালো করে বিছানায় বসলো। রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়ে দিবাকে কল করলো। এতোক্ষণে দিবার বাসায় ফিরে আসার কথা। দিবাকে ফোন দিতেই দিবা ফোন ধরলো। হিয়া আজ কেনো কলেজে যায় নি সেটা প্রথমে বললো। দিবা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,” বাহ্, তাহলে কিছুদিন একসাথে থেকে প্রেম করে ফিরবি।”

” প্রেম? ঐ লোকটার সাথে? তোকে তো এখনো বলিনি
কি হয়েছে? একটা মেয়ে ছোট ছোট জামা পরে থাকে আর সুযোগ পেলেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ভাল্লাগছে না। আমি থাকবো না এইখানে।”,

” হ্যা, চলে আয়। নিজের বরকে শাকচুন্নির কাছে ফেলে চলে আয়। তারপর দখল করে নিবে তোমার বরকে। তখন বুঝবি কেমন লাগে?”

” ভয় দেখাচ্ছিস কেনো, তুই? আমি এখণ কি করবো?”,

” তোর জায়গায় থাকলে তো আমি বরকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বরের সাথে রোমান্স করতাম। কিন্তু তোকে দিয়ে তো সেসব হবে না। তাই তুই এক বাটি পপকর্ন হাতে নিয়ে এইসব দেখ আর হজম কর।”

” কি করতে হবে আমাকে বল। এইসব আমি হজম করতে পারবো না।”, অনেক সাহস করে প্রশ্নটা করলেও উত্তরে দিবা যা যা বললো সেটা তাকে দিয়ে আসলেই সম্বব না। এতটা নিলজ্জ্ব সে হতে পারবে না। দিবার কথায় অপদত হা মিলিয়ে ফোনটা রেখে দিল হিয়া।

হিয়া চুপচাপ মোহনার পাশে বসে আছে। মোহনা কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে। সাড়া বাড়ি লোকজনে হৈ হৈ করছে কিন্তু হিয়া অনেকটা মন মরা হয়ে আছে। অনেক্ষন হলো শুভ্রকে আসে পাশে কোথাও সে দেখেনি। ওই মেয়েটাও তো নেই তাহলে কি দুজনে একসাথে আছে? এতোক্ষণে কয়বার জড়িয়ে ধরেছে শুভ্রকে? ভাবতেই রাগে গজগজ করতে লাগলো হিয়া। শুভ্রের তো তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। এতো রাত অথচ লোকটার কোনো খবর নেই।

হিয়া মোহনার কাছে নিজের ঘরটা জেনে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বাইরে সবাই গানের আসর বসিয়েছে, অন্য সময় হলে হিয়া আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো কিন্তু আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। হিয়া শাড়ির সেফটি পিন গুলো খুলে একপাশে রাখলো। এইখানে থাকতে হবে জানলে জামাকাপড় নিয়ে আসতো। এই শাড়ী পড়ে সে ঘুমাবে কি করে? হিয়া সবে শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলে শাড়ির প্রান্তভাগ কোমড়ে গুঁজে, কোমড়ের দুপাশে হাত দিয়ে দাড়ালো।

অনেক আগের দরজার হওয়ার কারণে একটু ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেলো। শুভ্রকে রুমে ঢুকতে দেখে হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।

শুভ্র রূমে ঢুকে এক মুহুর্তের জন্যে থমকে হিয়ার দিকে তাকালো। শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলার কারণে হিয়ার কোমড়ের অনেকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” আপনি আমার ঘরে কি করছেন?”

হিয়ার এমন প্রশ্নে শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” তোমার ঘর, আমার ঘর বলতে কিছু নেই। এখন থেকে তোমাকে আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে হবে।”,

” আমি আপনার সাথে থাকবো না।”, কঠিন গলায় বললো হিয়া। শুভ্রের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে খাপ ছাড়া গলায় বললো,” ইউ হ্যাভ নো চয়েজ। তোমার কাছে একটাই অপশন আছে আর সেটা হচ্ছে, আমি। এই কথাটা তুমি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তোমার জন্যেই ভালো।”, শেষের দিকটায় সিরিয়াস হয়ে বললো শুভ্র।

” আপনি আমাকে জোর করবেন?”,একটা ঢোক গিলে বললো হিয়া।

” নাহ্, জোড় করার হলে অনেক আগেই করতে পারতাম। আমি শুধু আমার করা ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি।”, বলেই একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো।

হিয়ার আরো রাগ হলো। একে তো সারাদিন লোকটার কোনো হদিস ছিলো না। এখন এসেছে, এসেই কড়া কড়া কথা বলছে তাকে। এতোই যখন তাকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাহলে তার প্রতি কোনো খেয়াল নেই কেনো লোকটার?

হিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমি আপনার সাথে থাকবো না।” বলে বেড়িয়ে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া রেগে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে, শুভ্র হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের সামনে এনে দাড় করাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র এখনো শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে অকারনেই শিউরে উঠলো সে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলটা এক টানে খুলে ফেলতেই হিয়া চোখ বুজে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। শুভ্র খুব স্বাভািকভাবেই বললো,” এবার যাও।”

শুভ্রের কথা কর্নগোচর হতেই হিয়া ফট করে চোখ খুলে তাকালো। তারপর কোমড়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রের শার্ট ছেড়ে ছিটকে সরে এসে কাধের আঁচলটা নামিয়ে দিলো। এতক্ষণ সে এইভাবে দাড়িয়ে ছিলো ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে এমন সময় রিমি ঘরে ঢুকে বললো,” তোমরা উপরে কি করছো? নিচে আসো, নিচে অনেক মজা হচ্ছে।”

হিয়ার এখন রিমিকে দেখলেই রাগ হচ্ছে। একটু যেই দূরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ডাকতে চলে এসেছে। হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া স্বাভাবিক ভাবে বললো,” আমি যাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

” তুই তো আসবি নাকি তোর ও ঘুম পাচ্ছে।”, বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।”
শুভ্র যাবে শুনে হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আচ্ছা এতক্ষণ ঘুরে এসেছে তাও শখ মিটেনি। রিমি চলে যেতেই হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো। আজ শুভ্রকে সে কোনোভাবেই নিচে যেতে দিবে না মনে মনে ঠিক করে ফেললো।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে হিয়াকে বিছানায় পা তুলে বসে থাকতে দেখে আড় চোখে তাকালো। এতোক্ষণ রূমে থাকবেনা বলে লাফাচ্ছিলো। এখন আবার বিছানায় ভদ্র বাচ্চা হয়ে বসে আছে। হিয়া কি চায় নিজে জানে কি?

শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে যাবে এমন সময় হিয়া হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে শুভ্রের সামনে এসে দাড়াতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হিয়া শুভ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো ঠিকই কিন্তু কি বলে আটকাবে এখনো ভেবে পায় নি। শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি সমস্যা?”

হিয়া একটু কেশে বললো,” কোনো সমস্যা নেই।”

” তাহলে এইভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”, বলেতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। তারপর বললো,” কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

” যেখানেই যাই তাতে তোমার কি? তুমি এই ঘরে কি করছো? তোমার রুম খুঁজে পাওনি?”, শুভ্রের প্রশ্নে হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর চুপ করে রইলো। শুভ্র হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যেতেই হিয়া এইবার দুই হাত মেলে শুভ্রেরর সামনে এসে দাড়ালো। শুভ্র হিয়ার এমন পথ আটকে দাড়ানোর কারণ খুঁজে পেলো না।

বিরক্তি নিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” আমার খুব খারাপ লাগছে। মাথাটা কেমন করছে।”,বলেই মাথা ঘুরানোর ভান ধরে পিছনে পরে যেতে নিলো। শুভ্র হকচকিয়ে উঠে এগিয়ে এসে হিয়াকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ তো ঠিক হটাৎ অজ্ঞান হলো কিভাবে? আসলে কি অজ্ঞান হয়েছে?

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকালো। হিয়া চোখ বন্ধ করে অজ্ঞানের ভান করেi আছে। শুভ্র হিয়ার মুখটা তুলে বললো,” কি হয়েছে তোমার?” হিয়া কোনো সাড়াশব্দ করলো না। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর ব্যাস্ত হয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো কয়েকবার। হিয়াকে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাতেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে হিয়ার কাছে এলো। তারপর গাল স্পর্শ করে বললো,” কি হয়েছে তোমার?”

হিয়া মাথাটা ধরে বললো,” জানি না। মাথাটা কেমন জানি করছে।”

শুভ্র অস্থির হয়ে বললো,” আচ্ছা, আমি আসছি।” বলেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে বেরিয়ে যেতেই হিয়া মুখ কালো করে উঠে বসলো। আরে যাকে আটকে রাখতে এতো কষ্ট সে কিনা বেড়িয়ে গেলো। হিয়া বসে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ওই শাকচুন্নির সামনে পড়লে যদি আটকে দেয়, যদি আসতে না দিলো শুভ্রকে। ভেবেই গাল গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে।

শুভ্র পানি আর ওষুধ হাতে ঘরে ঢুকতেই হিয়া হুড়মুড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লো। শুভ্র হিয়ার দিকে ওষুধ বাড়িয়ে দিতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। কিছু হয় নি, সে শুধু শুধু ওষুধ খাবে কেনো? হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাতেই শুভ্র ওষুধটা হাতে ধরিয়ে হিয়াকে উঠে বসালো তারপর অন্যহাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিল।

কি যন্ত্রণা! এমন ডাক্তার জামাই থাকা যে এত বিপদের সেটা কে জানতো। এবার এই ওষুধ খেতে হবে তাকে। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি ঠিক আছি তো। ওষুধ খেতে হবে না।”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই হিয়া বললো,” আচ্ছা খাচ্ছি।” ওষুধ খাওয়ার সময় হিয়া আঙ্গুলের ফাকে ওষুধটা শাড়ির আঁচলে ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা শুভ্রকে দিলো। শুভ্র গ্লাস হাতে উঠে যেতেই হিয়া ওষুধটা নিচে ফেলে দিলো। শুভ্র ফিরে আসতেই টেবিলের এক পাশে ওষুধটা চোখে পড়লো তার। তারপর অনেকটা আন্দাজ করে ফেললো সে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো তারপর বললো,” এবার কেমন লাগছে তোমার?”

হিয়া ধরা গলায় বললো,” অনেকটা ভালো।”
শুভ্র হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” তাহলে আমি নিচে গেলাম। তুমি চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।” বলে উঠে যাবে এমন সময় হিয়া শুভ্রের হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” না আপনি যাবেন না।” শুভ্রের কাছে এখন সবটাই পরিষ্কার। কিন্তু হিয়ার এমন অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করার পিছনের কারণটা কি?

শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে অন্যপাশে হাত রেখে বললো,” নিজেকে তুমি খুব চালাক মনে করো তাই না? এইসব কিসের জন্যে করছো? এই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়টা কি আমাকে আটকানোর জন্যে? এতক্ষণ তো আমার সাথে থাকবে না, এক ঘরে থাকবে না। এখন আবার আমাকে আটকানোর জন্যে এতকিছু করছো।”, বলতে বলতে শুভ্র হিয়ার একদম কাছে চলে এলো। শুভ্র এতো তাড়াতাড়ি সবটা ধরে ফেলবে হিয়া ভাবে নি। হিয়া নিজেকে বাঁচাতে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্র হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললো,” আর কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তুমি ঠিক কি চাইছো বলতো?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। বুকের ভেতটায় অস্থিরতা বাড়ছে। হাত পা হিম শীতল হয়ে গেছে। হিয়া চুপ করে রইলো। আসলেই তো সে কি চায়? নিজেকে তো কখন এমন প্রস্ন করেনি সে কোনোদিন। উত্তর টা তো তার জানা নেই।

হিয়ার নিরবতায় শুভ্র হাত সরিয়ে এনে বললো,” প্রশ্নের উত্তরটা যেদিন দিতে পারবে সেদিন আমাকে আটকে রেখো।” বলেই হিয়ার ধরে রাখা হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে নিলো। কিন্তু হিয়া আরো শক্ত করে শুভ্রের হাত ধরে ফেললো। শুভ্রের বলা এই কথাগুলো কেনো জানি তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কিন্তু তার হাতের বাঁধন শক্ত শুভ্রকে সে যেতে দিবে না। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করলো,” কেনো আটকে রাখতে চাও আমাকে, হুম?”

হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে।

[ #চলবে ]

কাজের মেয়েটা হিয়াকে ঘর দেখিয়ে দিলো। হিয়া ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। এই জায়গাটা এতক্ষণ পর্যন্ত খুব ভালো লাগলেও এখন অসহ্য লাগছে তার। হিয়া মুখ কালো করে বিছানায় বসলো। রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা হাতে নিয়ে দিবাকে কল করলো। এতোক্ষণে দিবার বাসায় ফিরে আসার কথা। দিবাকে ফোন দিতেই দিবা ফোন ধরলো। হিয়া আজ কেনো কলেজে যায় নি সেটা প্রথমে বললো। দিবা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,” বাহ্, তাহলে কিছুদিন একসাথে থেকে প্রেম করে ফিরবি।”

” প্রেম? ঐ লোকটার সাথে? তোকে তো এখনো বলিনি
কি হয়েছে? একটা মেয়ে ছোট ছোট জামা পরে থাকে আর সুযোগ পেলেই ওনাকে জড়িয়ে ধরে। আমার ভাল্লাগছে না। আমি থাকবো না এইখানে।”,

” হ্যা, চলে আয়। নিজের বরকে শাকচুন্নির কাছে ফেলে চলে আয়। তারপর দখল করে নিবে তোমার বরকে। তখন বুঝবি কেমন লাগে?”

” ভয় দেখাচ্ছিস কেনো, তুই? আমি এখণ কি করবো?”,

” তোর জায়গায় থাকলে তো আমি বরকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বরের সাথে রোমান্স করতাম। কিন্তু তোকে দিয়ে তো সেসব হবে না। তাই তুই এক বাটি পপকর্ন হাতে নিয়ে এইসব দেখ আর হজম কর।”

” কি করতে হবে আমাকে বল। এইসব আমি হজম করতে পারবো না।”, অনেক সাহস করে প্রশ্নটা করলেও উত্তরে দিবা যা যা বললো সেটা তাকে দিয়ে আসলেই সম্বব না। এতটা নিলজ্জ্ব সে হতে পারবে না। দিবার কথায় অপদত হা মিলিয়ে ফোনটা রেখে দিল হিয়া।

হিয়া চুপচাপ মোহনার পাশে বসে আছে। মোহনা কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে। সাড়া বাড়ি লোকজনে হৈ হৈ করছে কিন্তু হিয়া অনেকটা মন মরা হয়ে আছে। অনেক্ষন হলো শুভ্রকে আসে পাশে কোথাও সে দেখেনি। ওই মেয়েটাও তো নেই তাহলে কি দুজনে একসাথে আছে? এতোক্ষণে কয়বার জড়িয়ে ধরেছে শুভ্রকে? ভাবতেই রাগে গজগজ করতে লাগলো হিয়া। শুভ্রের তো তার দিকে কোনো খেয়ালই নেই। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। এতো রাত অথচ লোকটার কোনো খবর নেই।

হিয়া মোহনার কাছে নিজের ঘরটা জেনে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। বাইরে সবাই গানের আসর বসিয়েছে, অন্য সময় হলে হিয়া আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো কিন্তু আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। হিয়া শাড়ির সেফটি পিন গুলো খুলে একপাশে রাখলো। এইখানে থাকতে হবে জানলে জামাকাপড় নিয়ে আসতো। এই শাড়ী পড়ে সে ঘুমাবে কি করে? হিয়া সবে শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলে শাড়ির প্রান্তভাগ কোমড়ে গুঁজে, কোমড়ের দুপাশে হাত দিয়ে দাড়ালো।

অনেক আগের দরজার হওয়ার কারণে একটু ধাক্কায় দরজাটা খুলে গেলো। শুভ্রকে রুমে ঢুকতে দেখে হিয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো।

শুভ্র রূমে ঢুকে এক মুহুর্তের জন্যে থমকে হিয়ার দিকে তাকালো। শাড়ির আঁচলটা কাধে তুলার কারণে হিয়ার কোমড়ের অনেকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো হিয়া বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। হিয়া গম্ভীর গলায় বললো,” আপনি আমার ঘরে কি করছেন?”

হিয়ার এমন প্রশ্নে শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকালো তারপর শীতল কণ্ঠে বললো,” তোমার ঘর, আমার ঘর বলতে কিছু নেই। এখন থেকে তোমাকে আমার সাথে আমার ঘরে থাকতে হবে।”,

” আমি আপনার সাথে থাকবো না।”, কঠিন গলায় বললো হিয়া। শুভ্রের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে খাপ ছাড়া গলায় বললো,” ইউ হ্যাভ নো চয়েজ। তোমার কাছে একটাই অপশন আছে আর সেটা হচ্ছে, আমি। এই কথাটা তুমি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে তোমার জন্যেই ভালো।”, শেষের দিকটায় সিরিয়াস হয়ে বললো শুভ্র।

” আপনি আমাকে জোর করবেন?”,একটা ঢোক গিলে বললো হিয়া।

” নাহ্, জোড় করার হলে অনেক আগেই করতে পারতাম। আমি শুধু আমার করা ভুলটা শুধরে নিতে চাইছি।”, বলেই একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেললো।

হিয়ার আরো রাগ হলো। একে তো সারাদিন লোকটার কোনো হদিস ছিলো না। এখন এসেছে, এসেই কড়া কড়া কথা বলছে তাকে। এতোই যখন তাকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাহলে তার প্রতি কোনো খেয়াল নেই কেনো লোকটার?

হিয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমি আপনার সাথে থাকবো না।” বলে বেড়িয়ে যেতে নিলো। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে দাড়িয়ে শীতল দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়া রেগে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে, শুভ্র হিয়ার কোমড় জড়িয়ে নিজের সামনে এনে দাড় করাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র এখনো শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে অকারনেই শিউরে উঠলো সে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে হিয়ার কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলটা এক টানে খুলে ফেলতেই হিয়া চোখ বুজে শুভ্রের শার্টের অংশ খামচে ধরলো। শুভ্র খুব স্বাভািকভাবেই বললো,” এবার যাও।”

শুভ্রের কথা কর্নগোচর হতেই হিয়া ফট করে চোখ খুলে তাকালো। তারপর কোমড়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রের শার্ট ছেড়ে ছিটকে সরে এসে কাধের আঁচলটা নামিয়ে দিলো। এতক্ষণ সে এইভাবে দাড়িয়ে ছিলো ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে এমন সময় রিমি ঘরে ঢুকে বললো,” তোমরা উপরে কি করছো? নিচে আসো, নিচে অনেক মজা হচ্ছে।”

হিয়ার এখন রিমিকে দেখলেই রাগ হচ্ছে। একটু যেই দূরে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ডাকতে চলে এসেছে। হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া স্বাভাবিক ভাবে বললো,” আমি যাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

” তুই তো আসবি নাকি তোর ও ঘুম পাচ্ছে।”, বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলো। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।”
শুভ্র যাবে শুনে হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আচ্ছা এতক্ষণ ঘুরে এসেছে তাও শখ মিটেনি। রিমি চলে যেতেই হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো। আজ শুভ্রকে সে কোনোভাবেই নিচে যেতে দিবে না মনে মনে ঠিক করে ফেললো।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে হিয়াকে বিছানায় পা তুলে বসে থাকতে দেখে আড় চোখে তাকালো। এতোক্ষণ রূমে থাকবেনা বলে লাফাচ্ছিলো। এখন আবার বিছানায় ভদ্র বাচ্চা হয়ে বসে আছে। হিয়া কি চায় নিজে জানে কি?

শুভ্র তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বের হয়ে যাবে এমন সময় হিয়া হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে শুভ্রের সামনে এসে দাড়াতেই শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হিয়া শুভ্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তো ঠিকই কিন্তু কি বলে আটকাবে এখনো ভেবে পায় নি। শুভ্র একটা ভ্রু তুলে বললো,” কি সমস্যা?”

হিয়া একটু কেশে বললো,” কোনো সমস্যা নেই।”

” তাহলে এইভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”, বলেতেই হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। তারপর বললো,” কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

” যেখানেই যাই তাতে তোমার কি? তুমি এই ঘরে কি করছো? তোমার রুম খুঁজে পাওনি?”, শুভ্রের প্রশ্নে হিয়া অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো। তারপর চুপ করে রইলো। শুভ্র হিয়াকে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে যেতেই হিয়া এইবার দুই হাত মেলে শুভ্রেরর সামনে এসে দাড়ালো। শুভ্র হিয়ার এমন পথ আটকে দাড়ানোর কারণ খুঁজে পেলো না।

বিরক্তি নিয়ে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” আমার খুব খারাপ লাগছে। মাথাটা কেমন করছে।”,বলেই মাথা ঘুরানোর ভান ধরে পিছনে পরে যেতে নিলো। শুভ্র হকচকিয়ে উঠে এগিয়ে এসে হিয়াকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরলো। এতক্ষণ তো ঠিক হটাৎ অজ্ঞান হলো কিভাবে? আসলে কি অজ্ঞান হয়েছে?

শুভ্র চিন্তিত হয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকালো। হিয়া চোখ বন্ধ করে অজ্ঞানের ভান করেi আছে। শুভ্র হিয়ার মুখটা তুলে বললো,” কি হয়েছে তোমার?” হিয়া কোনো সাড়াশব্দ করলো না। শুভ্র হিয়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর ব্যাস্ত হয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো কয়েকবার। হিয়াকে ডাকতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হিয়া আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাতেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে হিয়ার কাছে এলো। তারপর গাল স্পর্শ করে বললো,” কি হয়েছে তোমার?”

হিয়া মাথাটা ধরে বললো,” জানি না। মাথাটা কেমন জানি করছে।”

শুভ্র অস্থির হয়ে বললো,” আচ্ছা, আমি আসছি।” বলেই শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে বেরিয়ে যেতেই হিয়া মুখ কালো করে উঠে বসলো। আরে যাকে আটকে রাখতে এতো কষ্ট সে কিনা বেড়িয়ে গেলো। হিয়া বসে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা ওই শাকচুন্নির সামনে পড়লে যদি আটকে দেয়, যদি আসতে না দিলো শুভ্রকে। ভেবেই গাল গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে।

শুভ্র পানি আর ওষুধ হাতে ঘরে ঢুকতেই হিয়া হুড়মুড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লো। শুভ্র হিয়ার দিকে ওষুধ বাড়িয়ে দিতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। কিছু হয় নি, সে শুধু শুধু ওষুধ খাবে কেনো? হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাতেই শুভ্র ওষুধটা হাতে ধরিয়ে হিয়াকে উঠে বসালো তারপর অন্যহাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিল।

কি যন্ত্রণা! এমন ডাক্তার জামাই থাকা যে এত বিপদের সেটা কে জানতো। এবার এই ওষুধ খেতে হবে তাকে। হিয়া শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,” আমি ঠিক আছি তো। ওষুধ খেতে হবে না।”

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই হিয়া বললো,” আচ্ছা খাচ্ছি।” ওষুধ খাওয়ার সময় হিয়া আঙ্গুলের ফাকে ওষুধটা শাড়ির আঁচলে ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে গ্লাসটা শুভ্রকে দিলো। শুভ্র গ্লাস হাতে উঠে যেতেই হিয়া ওষুধটা নিচে ফেলে দিলো। শুভ্র ফিরে আসতেই টেবিলের এক পাশে ওষুধটা চোখে পড়লো তার। তারপর অনেকটা আন্দাজ করে ফেললো সে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে বসলো তারপর বললো,” এবার কেমন লাগছে তোমার?”

হিয়া ধরা গলায় বললো,” অনেকটা ভালো।”
শুভ্র হা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” তাহলে আমি নিচে গেলাম। তুমি চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।” বলে উঠে যাবে এমন সময় হিয়া শুভ্রের হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” না আপনি যাবেন না।” শুভ্রের কাছে এখন সবটাই পরিষ্কার। কিন্তু হিয়ার এমন অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করার পিছনের কারণটা কি?

শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে অন্যপাশে হাত রেখে বললো,” নিজেকে তুমি খুব চালাক মনে করো তাই না? এইসব কিসের জন্যে করছো? এই অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়টা কি আমাকে আটকানোর জন্যে? এতক্ষণ তো আমার সাথে থাকবে না, এক ঘরে থাকবে না। এখন আবার আমাকে আটকানোর জন্যে এতকিছু করছো।”, বলতে বলতে শুভ্র হিয়ার একদম কাছে চলে এলো। শুভ্র এতো তাড়াতাড়ি সবটা ধরে ফেলবে হিয়া ভাবে নি। হিয়া নিজেকে বাঁচাতে কিছু বলতে যাবে এমন সময় শুভ্র হিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললো,” আর কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তুমি ঠিক কি চাইছো বলতো?”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো। বুকের ভেতটায় অস্থিরতা বাড়ছে। হাত পা হিম শীতল হয়ে গেছে। হিয়া চুপ করে রইলো। আসলেই তো সে কি চায়? নিজেকে তো কখন এমন প্রস্ন করেনি সে কোনোদিন। উত্তর টা তো তার জানা নেই।

হিয়ার নিরবতায় শুভ্র হাত সরিয়ে এনে বললো,” প্রশ্নের উত্তরটা যেদিন দিতে পারবে সেদিন আমাকে আটকে রেখো।” বলেই হিয়ার ধরে রাখা হাতের বাঁধন খুলে ফেলতে নিলো। কিন্তু হিয়া আরো শক্ত করে শুভ্রের হাত ধরে ফেললো। শুভ্রের বলা এই কথাগুলো কেনো জানি তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে কিন্তু তার হাতের বাঁধন শক্ত শুভ্রকে সে যেতে দিবে না। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করলো,” কেনো আটকে রাখতে চাও আমাকে, হুম?”

হিয়া নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় বললো,” জানি না।”, বলেই কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থেকে আবার বললো,” ওই মেয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরলে আমার ভালো লাগে না।”, শুভ্র খেয়াল করলো হিয়ার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা মুক্ত তার গাল বেয়ে গড়িয়ে শাড়ী ভিজিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রের সামনে নিজের অনুভূতির এমন অভিব্যক্তিতে লজ্জা আর রাগে চোখ ভিজে এসেছে মেয়েটির।

[ #চলবে ]