নীড়
রেশমী রফিক
২৭।।
শারারদের বাসায় এবারই প্রথম আসা হলো তুবার। এর আগে বোনের বিয়ের পর এই এলাকায় এসেছে কয়েকবার, সাইফুলদের বাসায়। দুই-একটা বাসা পরেই শারারদের এই বাড়িটা। গলির মুখে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে লাল সিরামিকের এই বাড়িটা। দোতলায় খোলামেলা বারান্দা। ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে যেমন বারান্দাগুলো আপাদমস্তক গ্রিল আটকানো থাকে, অনেকটা খাঁচার মতো, এই বারান্দাটা অমন নয়। কাঠ দিয়ে কারুকাজ করা কোমর সমান রেলিঙ। উপরের অংশটুকু ফাঁকা। রেলিঙয়ের ওপাশে কতগুলো গাছ-গাছালির টব। তাতে কয়েক ধরনের ফুল ফুটে আছে। স্বভাবতই গলিতে ঢুকলে এই বারান্দায় চোখে চলে যায় সবার। তুবারও গেছে। সাইফুলদের বাসায় ঢুকতে এবং বের হতে প্রতিবারই এই বাড়িটা আর বারান্দাটা দেখেছে। একটু অন্যরকম বলেই নজর কেড়েছে। তাই বলে কখনো তুবার জানা হয়নি, এই বাড়িতেই শারার থাকে। আজ যখন গাড়িটা থামল বাড়ির বাউন্ডারির ভেতর, বের হয়েই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল ভীত দৃষ্টিতে। তখনই বারান্দাটা চোখে পড়েছে। অবাক বিস্ময়ে ওর মুখটা হাঁ হয়ে গিয়েছিল নিজের অজান্তেই। শারার ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
– হাঁ করে আছ কেন? বাড়িঘর জীবনে দেখোনি?
তুবা বিস্ময়টা তখনই গিলে ফেলেছে। চোখও নামিয়েছে। শারারকে আর উত্তর দেয়া হয়নি। হতভম্ব ভঙ্গিতে একবার তাকিয়েছিল কেবল। শারার তাকায়নি ওর দিকে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কথাটা বলেছে। তার চোখমুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। তুবার সাহস হয়নি কথা বলতে। ততক্ষণে শফিকুল চৌধুরীর উপস্থিতি বাড়ির ভেতর নীরব হুটোপুটির সৃষ্টি করেছে। ছেলে-বৌ দুজনকে নিচতলায় দাঁড়াতে বলে তিনি একাই দোতলায় গেলেন। পরক্ষণেই তার আদেশ অগ্রাহ্য করে শারার নড়ে উঠল। ধুপধাপ পা তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় চলে গেল সে। খানিকবাদে কোনো একটা দরজা ধড়াম করে বন্ধ হবার শব্দ শোনা গেল। হতবাক তুবা একাই দাঁড়িয়ে রইল জবুথবু হয়ে। চারপাশে বাড়ির তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরা ছড়িয়ে-ছিড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের চোখে কৌতুহল আর ত্রস্ত ভঙ্গি। কিন্তু ওর নিজেকে মনে হলো সার্কাসের কোনো প্রাণী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে খেলা দেখাতে। চারপাশে দর্শক উন্মুখ ভঙ্গিয়ে তাকিয়ে আছে। অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। শফিকুল চৌধুরী একটু পরই নিচতলায় নামলেন। ছেলেকে দেখতে না পেয়ে কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেন। একজন উত্তর দিল,
– ভাইজান উপ্রে চইল্লা গেছে।
শফিকুল চৌধুরীর কপালে ভাঁজ পড়ল। তবে এই নিয়ে তিনি কথা বাড়ালেন না। তুবাকে নির্দেশ দিলেন তাকে অনুসরণ করতে। অতঃপর শ্বশুরের পিছু নিয়ে তুবা চলে এসেছে বড়সড় একটা ঘরে, যেখানে অপার কৌতুহল আর বিস্ময় আটকে রাখা কঠিন। ঘরের সাথেই বারান্দাটা। কাচের টানা দরজার ভেতর থেকে বারান্দার আসল সৌন্দর্য দেখে সে তাৎক্ষণিকভাবে মুগ্ধ। শফিকুল চৌধুরী ওকে বসতে বলেননি। কেবল বসার ঘরে ঢুকিয়েই আবার চলে গেছেন। তাই সে টানা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কাচের ওপাশে অভূতপুর্ব স্বর্গ দেখে স্থান-কাল-পাত্র বেমালুম ভুলে বসেছে।
খানিকবাদে শারার ঢুকল ঘরে। চোখমুখ তখনো থমথমে। তবে বিরক্তিটা নেই। সরাসরি তুবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। নিচু সুরে বলল,
– তোমার সমস্যা কী? একটু পর পর হাঁ করে থাক কেন?
তুবা মুখ বন্ধ করে ফেলল। চোখটাও আবার নামিয়ে ফেলল। আতঙ্ক ফিরে এসেছে। মাথার ভেতর হাজারও দুশ্চিন্তা আর জল্পনা-কল্পনা ফিরে এসেছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এই মুহূর্তে ওদের বাসায় কী হচ্ছে। যথাসময়ে বাসায় না ফিরলে কী কী হতে পারে, তা অনুমান করতে চেষ্টা করছে। সবটাই জানা আছে। ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট সময়ের পর কয়েক মিনিট পার হলেই শেফালি চলে যান বারান্দায়। উঁকি মেরে রাস্তায় দেখার চেষ্টা করেন তুবার রিকশাটা এসেছে কি না। যতক্ষণ না তুবা ফেরে, তিনি পায়চারি করতে থাকেন। এভাবে খানিকটা সময় পার হবার পর তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। তিনি প্রথমে দিদারুল সাহেবকে তলব করেন। অনুরোধ করেন যেন রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারও খানিক পর না ফিরলে তিনি তুবার বান্ধবীদের বাসায় কল করতে শুরু করেন। যতগুলো বান্ধবী সবারই বাসায় নম্বর তার ডাইরিতে লেখা আছে। সেখান থেকে সিরিয়াল অনুসারে একেকজনকে কল করেন। আজকের পরিস্থিতি যা হবে, তা হলো দিদারুল সাহেবকে যখন শেফালি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে বলবেন, তিনি চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে তুবার নম্বরে কল করবেন। বলা বাহুল্য, মোবাইলে ওকে পাওয়া যাবে না। ফোনসেট আসলে কোথায়, তুবা জানে না। ব্যাগের ভেতর রেখেছিল নাকি ড্রেসের পকেটে, মনে নেই। ব্যাগে থাকলে ওটা এতক্ষণে হামলাকারীদের দখলে। তারা নিশ্চয়ই ব্যাগ ঘেঁটেছে। এরপর ফোন পেয়েছে। লক করা বিধায় হয়তো ফোন খুলতে পারবে না। তবে মোবাইলটা গুম করে ফেলতে পারে। সিমকার্ড ফেলে দিলেই হয়। সেক্ষেত্রে কল করলে মোবাইল বন্ধ থাকবে। যদি ফোনটা খোলা থাকে, হয়তো কেউ রিসিভ করবে। এরপর দিদারুল সাহেব ঘটনা একটু হলেও আঁচ করতে পারবেন। অন্তত এটুকু বুঝতে পারবেন, মেয়ে বিপদে পড়েছে। তারপর তিনি কী করবেন, তুবার ধারণা নেই। হয়তো ওই লোকদের কাছ থেকে লোকেশনটা জেনে নিতে পারেন। এরপর স্বর্ণপাতার থালায় গিয়ে খোঁজ করলেই সবটুকু জানবেন। এরপর? তিনি কি মেয়েকে নিতে আসবেন এই বাসায়?
আর যদি কোনোভাবে দিদারুল সাহেব মোবাইল বন্ধ পান, অথবা কোনো খোঁজ বের করতে না পারেন, শেফালি নিশ্চিতভাবেই মেয়ের বান্ধবীদের কাছ থেকে জানতে পারবেন, তুবা আজ কোচিংয়ে যায়নি। স্কুলের পর পরই কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। এই খবরটা কেবল উর্মি জানে। আসার আগে ও জিজ্ঞেস করেছিল। উর্মি শারারের কথাও জানে। তবে পরিচয় জানে না। দু-একজন বান্ধবী এতটুকু জানে, তুবা একটা ছেলের সাথে প্রায়ই দেখা করতে যাচ্ছে। তারা বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল। তুবা আগেভাগে কিছু বলতে চায়নি। ওদেরকে শুধু এটাই বলেছে,
– তোরা যেমন ভাবতেছিস, কাহিনি সেরকম না। যার সাথে দেখা করতে যাই, অবভিয়াসলি একটা ছেলে। কিন্তু সে আমার বয়ফ্রেন্ড না। এখানে অন্য কাহিনি আছে। তোদেরকে অবশ্যই বলব। জাস্ট একটু সময় দে। কাহিনিটা পুরাপুরি শেষ করেই নাহয় বলি একবারে। এখন বললে তোদের কিউরিসিটি মিটবে না।
তুবার এখন মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। শারারের বিস্তারিত পরিচয়টা না বলুক, অন্তত দিবাপুর শ্বশুরবাড়ির কেউ এটা বলতে কী সমস্যা ছিল বান্ধবীদের, ভেবে পাচ্ছে না। দিবাপুর দেবর হয় সম্পর্কে, এতটুকু বললেও চলত। তাহলে আজ উর্মি কোনো একটা সুত্র ধরিয়ে দিতে পারত শেফালিকে। এখন কী করবে সে? কীভাবে ওর বাবা-মা খুঁজে পাবে ওকে?
চট করে মনে হলো, শারারের বাবা-ই ওদের বাসায় কল করবেন। তিনি একজন মুরব্বি। নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওকে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন, ওই নরকস্থল থেকে, হাজারও লোলুপ দৃষ্টির কবল থেকে ওকে উদ্ধার করে এনেছেন। এবার নিশ্চয়ই ওর বাবা-মাকে খবর দিয়ে আনাবেন। অথবা পাশের বাড়ি থেকে দিবাপুকেও ডেকে আনতে পারেন। মনের মধ্যে খানিকটা আশার আলো জ্বলতেই তুবা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল,
– হে আল্লাহ! আংকেল যেন আমাদের বাসায় কল না করে, বাবা-মাকে যেন কিছু না জানায়। আংকেল যেন দিবাপুকে ডেকে আনে। তাহলে দিবাপু কোনো না কোনোভাবে ওকে এই বাসা থেকে উদ্ধার করতে পারবে। তারপর বাসায় কল করে মাকে বুঝাতে পারবে যে, কোনো একটা কারণে স্কুলের পর পরই তার কাছে চলে এসেছিল তুবা। সে আর ফিরতে দেয়নি। একটু পর সাইফুল ভাইকে দিয়ে পাঠাবে। এতটুকু হলেই আজকের এই বিপদ মাথা থেকে নেমে যাবে একদম। এই বিপদক্ষণে আপুই একমাত্র ভরসা। তবে সমস্যা হচ্ছে, দিবাপু খুব সহজে মানবে না। বাবা-মাকে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝাতে রাজি হবে না। তাকে মানাতে হলে হাতে-পায়ে ধরতে হবে। তাতে তুবার আপত্তি নেই। দরকার পড়লে সারারাত সে আপুর পা ধরে বসে থাকবে। তাছাড়া, সাইফুল ভাই আছে। উনিও নিশ্চয়ই ওর পক্ষ নিয়ে আপুকে বুঝাবেন।
তুবার মনে হলো, বুক থেকে ভারী পাথর আচমকা সরে গেল। বুকটা খালি হয়ে যাওয়ায় লম্বা নিঃশ্বাস নিল সে। মনোবল খানিকটা বাড়ল। হাত-পায়ের কাঁপুনি বন্ধ হলো। সে মিনমিন করে শারারকে বলল,
– শারার ভাই, দিবাপুকে একটু ডেকে আনবেন প্লিজ?
শারার ঘুরে তাকাল। অবাক সুরে বলল,
– কেন?
– কেন আবার কী? সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি এখনো বাসায় যাইনি। না জানি কী চলতেছে ওখানে। আম্মাকে তো চিনেন না আপনি। আমাকে আজকে কচুকাটা করে ছাড়বে। এজন্য দিবাপুকে ম্যানেজ করা লাগবে। দিবাপু একবার লিড দিলেই ঝামেলা শেষ।
– দিবাপু কী লিড করবে?
তুবা কন্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ল। আতঙ্ক উবে যাওয়ায় আবার আগের মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফিরে এসেছে তার মধ্যে। দুই হাত নেড়ে বলল,
– আহ, আপনি এত টিউবলাইট কেন? সহজ কথাটা বুঝতেছেন না? আচ্ছা শোনেন। আমি বলতেছি আপনাকে। আপু যদি আম্মাকে বুঝিয়ে বলে, মানে মিথ্যে করে বলবে যে, আমি স্কুল ছুটি হবার পরই আপুর কাছে চলে গেছি। আপুর বাসায় ছিলাম সারাদিন। এরপর বিকেলে ফিরতে চাইলেও আপু দেয়নি। বলছে, রাতে খেয়েদেয়ে এরপর যাব। সাইফুল ভাই নামিয়ে দিয়ে আসবে আমাকে। তাহলে মনে করেন আম্মা একদম ঠান্ডা। নাইলে আজকে বাসায় যাওয়ার পর আমার খবর হয়ে যাবে একদম।
শারারের চেহারা দেখে মনে হলো, এমন আজব কথা সে জীবনেও শোনেনি। অথবা তুবা যে ভাষায় কথা বলছে, সেই ভাষা কস্মিনকালেও শিখেনি। কথা বুঝবে কী? তবু কোনোমতে বলল,
– কী খবর হবে?
– কী খবর মানে? আম্মা পুরা সানডে মানডে ক্লোজ করে দিবে আমার। এমন মাইর দিবে! আমার আর দুনিয়া দেখা লাগবে না মাইরের চোটে। আপনার গার্লফ্রেন্ড খুঁজে দেয়ার যে মাগনা চাকরি আমি নিছি, যে কারণে আজকে এত কাহিনি হলো, সেটা এখানেই শেষ। ও, শোনেন। ভালো কথা মনে পড়ছে। আজকের পর আপনার সাথে আমার দেখা হবার পসিবিলিটি একদম জিরো। মানে দিবাপুকে ম্যানেজ করতে না পারলে তো আমি পুরাই গন কেস। ধোলাই দেয়ার পর আম্মা জীবনেও আমাকে আর বাসা থেকে বের হতে দিবে না। আর এই তল্লাটে মানে দিবাপুর শ্বশুরবাড়ির আশপাশে যাওয়া এই জীবনে শেষ। আর যদিও দিবাপু ম্যানেজ হয়, তাহলেও আমি আর এই ভেজালে নাই। আমার আজকে কলিজা শুঁকিয়ে গেছে। বুঝছেন? সো, আর দেখা হইতেছে না। যেটা বলতেছিলাম, আপুর বিয়ের অ্যালবাম আনার কথা ছিল না আজকে? আমি কিন্তু অ্যালবাম আনছিলাম। আপনাকে তখন মিথ্যা কথা বলছিলাম। মানে একটু টেনশনে রাখতে চাইছিলাম আর কী। এত সহজে আপনার পছন্দের মেয়েকে খুঁজে পেলে তো জমল না, এইজন্য। যাই হোক, সেই কাহিনির লেঞ্জা এখন আরেকদিকে চলে গেছে। আপনি এক কাজ করেন। আমি আপনাকে অ্যালবাম দিয়ে যাই। আপনি ওই মেয়েটাকে খুঁজে এরপর একটা চিহ্ন দিয়ে রাখবেন ছবিতে। এরপর অ্যালবামটা কোনোভাবে দিবাপুর বাসায় দিয়ে আসবেন। ভাবখানা এমন যেন, আজকে আমি দিবাপুর বাসায় আসছি, অ্যালবাম নিয়ে। এরপর ভুল করে রেখে চলে গেছি। পরে দিবাপু আবার আমাদের বাসায় অ্যালবাম ফেরত পাঠাবে। তখন আমি ছবি ঘেঁটে আপনার দেয়া চিহ্ন অনুসারে মেয়েটাকে চিনতে পারব। অবশ্য আমার চিনেই বা কী লাভ? আমার তো আর আপনার সাথে দেখা হবে না। আচ্ছা, শোনেন। আপনি নিজেই কোনোভাবে দিবাপুর কাছ থেকে জেনে নিবেন মেয়েটা কে। পারবেন না? আরে যাহ, অ্যালবাম কই? ও আল্লাহ, আমার স্কুলের ব্যাগ?
তুবার বিস্ফারিত চোখের দিকে বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে শারার। যেন তুবাকে সে চিনেই না। এই প্রথম দেখা হলো। এই মেয়ে এতক্ষণ ধরে কী কথা বলল, তার কানে ঢুকেনি। ঢুকলেও মাথা কাজ করেনি। যে ঝামেলা পার করে আসতে পেরেছে বাসা অবধি, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। (চলবে)
নীড়
রেশমী রফিক
২৮।।
ঠিক তখন শফিকুল চৌধুরী বসার ঘরে ঢুকলেন। পেছনে তার স্ত্রী, লুৎফুন্নেসা। তাদের পায়ের শব্দে তুবা চমকে উঠল। বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো ঘুরে দাঁড়াল সে। চোখমুখে আতঙ্ক ফিরে আসতে শুরু করেছে আবার। তবে আগের মতো কঠিন অবস্থা হবে না বোধহয়। শারার তখনো টনক নড়েনি। সম্ভবত তুবার কথাগুলো শুনে একদফা অজ্ঞান হবার প্রস্তুতি চলছে তার। তাতে ভেটো দিলেন লুৎফুন্নেসা। কয়েক কদম এগিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ছেলেকে বললেন,
– তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘরে যা। কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হ। গোসলও সেরে ফেল। সারাদিন কই কই ছিলি কে জানে। দেখে মনে হচ্ছে ঝড়ে পড়ছিলি। যা আব্বা। আমি টেবিলে খাবার দিতে বলছি।
শারার ধাতস্থ হলো। তুবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলেছে সে। মায়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। তবে মায়ের নরম কোমল কণ্ঠ শুনে আরও একবার বিস্মিত হলো। আসলে হচ্ছেটা কী আজ? আব্বু-আম্মু এমনকি তুবা সবাই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে যেন কিছুই হয়নি। তবে কি আসলেই কিছু ঘটেনি? সবটাই কি ভ্রম? তাহলে তুবা এই বাসায় কেন? ওর পরনে বিয়ের শাড়ি থাকবে কেন? নাহ, আম্মুর কথাই ঠিক। ঝড়ের কবলে পড়ে মাথা জ্যাম হয়ে আছে। ঠিক করে কিছুই ভাবতে পারছে না। কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে, পরে দেখা যাবে। আপাতত ফ্রেশ হওয়া দরকার। আচ্ছা, তুবা কি এখানে থাকবে? ঝড় তো ওর উপর দিয়েও গেছে। জামাকাপড়ের ঠিক-ঠিকানা নেই। শাড়িটা কোনোরকমে পরে আছে। চুলের দুই বেণি অগোছালো। মাথায় ঘোমটা দেয়া ছিল শুরুতে। এখন ঘোমটা নেই। হয়তো অসাবধানতায় পড়ে গেছে। পায়ে কাঁদামাখা কেডস। এটা পরেই বসার ঘরে কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। চকিতেই শারার মায়ের দিকে তাকাল। ওর মা, লুতফুন্নেসার পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বাতিক আছে। অনেকটা শুচিবাইগ্রস্ত বলা চলে। বাড়ির প্রতিটি কোণ প্রতি বেলায় পরিস্কার করা হয় তার নির্দেশে। মূলত এই বাড়িতে কর্মচারির সংখ্যা, বাড়ির সদস্যদের তুলনায় বেশি এজন্যই। একেকজনকে একেক স্থান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
লুৎফুন্নেসার দৃষ্টি সরাসরি তুবার পায়ের দিকে। শাড়ির নিচে ময়লা কেডস খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। তার শান্ত দৃষ্টি দেখে শারারের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বুঝাই যাচ্ছে, আজ তুবার কপালে ভালোরকমের শনি আছে। আচানক এই বিয়ের জন্য নয়, ঘর নোংরা করার অপরাধে। তুবার সেই খেয়াল নেই। থাকবে কী করে? শারারের মায়ের মেজাজ-মর্জির খবর তো তার কাছে নেই। সে পড়ে আছে নিজের মায়ের মেজাজ কীভাবে ঠান্ডা করবে, তা নিয়ে। ওকে এখান থেকে সরানো দরকার। মায়ের কপালে দু’পাশের রগ ফুলতে দেখে শারার সতর্ক হলো। নিচু সুরে বলল,
– তুবা চলো।
বলেই শারার সামনে পা বাড়াল। তুবাও পা বাড়িয়েছে। কিন্তু লুৎফুন্নেসার হুঙ্কারে তাকে থামতে হলো।
– অ্যাই মেয়ে! কোথায় যাচ্ছ তুমি? দাঁড়াও এখানে।
শারার আমতা-আমতা করে বলল,
– আম্মু, ওর একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার।
– সেটা আমি বুঝব, আব্বা। তুই যা ঘরে।
– আম্মু, ও…
– তুই যা। ওর সাথে কথা আছে আমার।
– পরে বললে হয় না?
– শারার! তোকে যেতে বলেছি আমি!
লুৎফুন্নেসা সবসময়ই ছেলেকে ‘আব্বা’ সম্বোধন করেন। কখনো নাম ধরে ডাকেন না। কিন্তু আজ ডেকেছেন। এর মানে হচ্ছে, আজ তিনি ক্রোধের চুড়ান্ত সীমানায় চলে গেছেন। শারার মনে মনে প্রমাদ গুনল। অসহায় ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকাল সে। শফিকুল চৌধুরী কী বুঝলেন, কে জানে। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
– লুৎফা, ওরা মাত্রই এসেছে। ফ্রেশ হোক। খাওয়া-দাওয়া করুক। এরপর যা কথা বলার, বলো।
লুৎফুন্নেসা ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন,
– কী বলতে চাইছ তুমি? এই মেয়ে খাওয়া-দাওয়া করবে? আমার বাসার ডাইনিং টেবিলে বসে?
– অবশ্যই। সারাদিন না খেয়ে আছে ওরা।
– ওরা নয়। বলো, ও। এই মেয়েটার সাথে আমার ছেলেকে মেলাবে না। শারার বাইরে থেকে এসেছে। ও অবশ্যই ফ্রেশ হবে। খাওয়া-দাওয়া করবে। কিন্তু এই মেয়েকে আমি ভেতরে ঢুকতে দেব না।
– কী আশ্চর্য! ভেতরে ঢুকতে দেবে না কেন?
– কেন দেব?
– কেন দেবে না, তাই বলো। মেয়েটা তো অপরিচিত কেউ না। আমাদের সাইফুলের…
– মেয়েটা পরিচিত-অপরিচিত যাই হোক, তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
– লুৎফা, সিনক্রিয়েট করো না বাচ্চাদের মতো। বাসায় ফিরেই আমি তোমাকে সবটা বলেছি। বলিনি?
– তাতে কী? এই বদমাশ মেয়ের জন্য আজ আমার ছেলের উপর আঁচ এসেছে। ওর জন্য আমার ছেলের অসম্মান হয়েছে। এই সম্মান উদ্ধার করতে তোমার যা করা দরকার, করেছ। সেটা বাইরের ব্যাপার। কিন্তু এই বাড়িতে শুধু আমার নির্দেশ চলবে। আমার কথামতোই সবটা হবে। আর আমার কথা এটাই, ওর এই বাড়িতে জায়গা হবে না। এই বাড়ির চৌকাঠ মারানোর যোগ্যতা ওর নেই।
– বুঝেশুনে কথা বলো। লিগ্যালি এই বাড়ির বউ সে।
– বুঝেশুনেই বলছি। ওসব লিগ্যালিটি ধামাচাপা দেবার টাকা তোমার আছে, তাই না?
– ধামাচাপা দেবার কথা আসছে কেন?
– তাহলে তুমি কী করতে চাও? ওকে অ্যাকসেপ্ট করে নেবে? ধুমধাম করে পার্টি করে সবাইকে জানাবে, এই ফকিন্নির বাচ্চাকে আমরা বউ করে এনেছি?
তুবা হাঁ করে কথা শুনছে। শারার হতভম্ব। কিছুটা বাকরুদ্ধও। বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনে তার মাথা ঘুরছে। শফিকুল চৌধুরী চাপা সুরে বললেন,
– মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ, লুৎফা।
তখনই তুবা বলে উঠল,
– আপনি কি আমাকে গালি দিলেন?
শারার চট করে ওর হাত ধরল। আলতো চাপ দিয়ে চুপ থাকতে নির্দেশ দিল ইশারায়। কিন্তু ততক্ষণে সে বলে ফেলেছে কথাটা। তাতে লুৎফার রাগের আগুনে যেন ঘি পড়ল। তিনি ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
– ফকিন্নির বাচ্চা খুব ভদ্র একটা গালি, বুঝেছ মেয়ে?
তুবার চটাং-চটাং উত্তর,
– কিন্তু আমি ফকিন্নির বাচ্চা নই। আমার বাবা-মাও ফকির না।
শারার ওর হাতের উপর চাপ বাড়াল। তুবা পাত্তা দিল না। নয়তো ইশারা বুঝেনি। লুৎফুন্নেসা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
– তোর বাপ-মা যে কোন লেভেলের ফকিন্নি, সেটা সাইফুলের বিয়ের সময়ই জানা হয়ে গেছে আমার। তোর কাছ থেকে নতুন করে শোনার দরকার নেই। আমার ভাই-ভাবিকে নিশ্চিত পাগলা কুকুর কামড়েছিল। এজন্যই থার্ড ক্লাস ফালতু একটা ফ্যামিলি থেকে বউ এনেছে। তাদের জায়গায় আমি হলে তোর বোন কোনোদিনই সাইফুলের বউ হতো না।
তুবাও সমান তেজে উত্তর দিল,
– মুখ সামলে কথা বলবেন। আমার ফ্যামিলি সম্পর্কে আপনি আসলেই কিছু জানেন না। সাইফুল ভাইয়ার আব্বু-আম্মু জানেন। এজন্যই তারা আমার আপুকে পছন্দ করেছে।
লুৎফুন্নেসা ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন তুবার গালে। গলা চড়িয়ে বললেন,
– তারা তোর আপুকে পছন্দ করেছে, নাকি পছন্দ করতে বাধ্য হয়েছে তোর আপুর নাটকের কারণে, সেটা আমার জানা আছে। তোদের মতো মেয়েরা কত ধরনের পলিটিক্স করতে পারে…
শফিকুল চৌধুরী ধমকে উঠলেন,
– লুৎফা, তুমি কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছ।
লুৎফুন্নেসা ফুঁসে উঠলেন,
– লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছি মানে কী? এই ফাতরা ছেমড়িকে আমি অ্যাকসেপ্ট করব, তুমি ভাবলে কী করে? আবার ওকে বাড়ির ভেতর এনে ঢুকিয়েছ!
শারার হতভম্ব ভঙ্গিতে বাবা-মা আর তুবার ঝড়ো কথোপকথন শুনছে। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত, ভাবতে পারছে না। ঠিক তখন তুবাকে বলতে শুনল,
– আপনার মা এত অসভ্য মহিলা কেন? উনি কি সবসময়ই এরকম ভাষায় কথা বলেন? উনাকে আপনি সহ্য করেন কীভাবে?
পরক্ষণে লুৎফা হামলে পড়লেন ওর উপর। ক্রোধে প্রায় লাগামহীন হয়ে গেছেন তিনি। কী করছেন, কিছুই তার ধর্তব্যে নেই। তুবার চুলের মুঠি ধরে তিনি টানতে লাগলেন দরজা বরাবর। মুখ দিয়ে অশ্রাব্য সব গালি আর কথাবার্তা বের হতে লাগল,
– হারামজাদি, তোর সাহস কত্ত বড়। তুই আমাকে অসভ্য বলিস! তুই নিজে কী? ধামড়ি মাগি তুই আমার বাড়িতে এসে গলা উঁচু করে আমাকেই অসভ্য বলতেছিস। তুই আর তোর ফ্যামিলির মতো নিকৃষ্ট আমি এই দুনিয়াতে আর একটাও দেখিনি। তোর বোন সাইফুলকে ফাঁসিয়েছে আর তুই ধরেছিস আমার ছেলেকে। তোর মা তোদেরকে এইসব শিখিয়েছে, তাই না? আর তো কোনো যোগ্যতা নেই তোদের। এইজন্য পার করার সুবিধা না পেয়ে ছলাকলা শিখেছিস তোরা। তুই জানিস আমি কে? তুই জানিস তুই কোনদিকে হাত বাড়িয়েছিস? বদমাইশ ছেমড়ি। আমার ছেলের দিকে আর একবার হাত বাড়িয়ে দেখ। তোকে আমি…
লুৎফার কথা শেষ হবার আগেই তুবা ছিটকে গেল। শারার হেঁচকা টানে ওকে সরিয়ে ফেলেছে। মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছেন শফিকুল চৌধুরী। এবারে তিনি এমন একটি কাজ করলেন, যেটা সম্ভবত তার আর লুৎফুন্নেসার বিবাহিত জীবনে এই প্রথম। স্ত্রীর গায়ে কখনোই হাত তোলেননি তিনি। এই বাড়ির অধীনস্ত কর্মচারীরা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি এমন কিছু ঘটতে পারে চোখের পলকে। শারার কেবল বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রতিক্রিয়া দেখানোর শক্তি বোধহয় আগেই হারিয়ে ফেলেছে সে। তবু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুবার হাত শক্ত ধরে চেপে ধরল। তুবা কঁকিয়ে উঠতেই ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকাল। ইশারায় চুপ থাকতে বলল। কিন্তু তুবা অবুঝ। সে প্রায় চেঁচিয়ে বলল,
– আমার হাত ছাড়েন, শারার ভাই। আমি ব্যাথা পাচ্ছি।
নিমেষেই শারার অগ্নিমুর্তি ধারণ করল। চোখ লাল। যার মানে দাঁড়ায়, ”তোকে একবার বাগে পেয়ে নিই। কীভাবে সাইজ করতে হয়, বুঝবি তখন।” তবে হাত মুঠ পাকিয়ে নিজেকে শান্ত করল। কারণ শফিকুল চৌধুরী এখানে উপস্থিত আছেন। তার সামনে মোটামুটি নিরীহ হয়ে থাকতে বাধ্য হয় সে। শফিকুল চৌধুরী বললেন,
– ওর হাত ছেড়ে দাও, শারার।
তুবা হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শারারের ইচ্ছে নেই ছাড়ার। কিন্তু বাবার নির্দেশ অমান্যও করতে পারবে না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে তুবার হাত ছেড়ে দিল। শফিকুল চৌধুরী এবার ছেলেকে নির্দেশ দিলেন ঘরে যেতে। শারার গোয়ারের মতো বলল,
– আমি এখানেই থাকতে চাই। তুবার সাথে যা কথা বলার, আমার সামনে বলো তোমরা।
শফিকুল চৌধুরী কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। তারপর স্ত্রীর দিকে ঘুরে বললেন,
– খুব বেশি বাড় বেড়েছে তোমার, লুৎফা। আমার উপস্থিতিতে তুমি ছড়ি ঘোরানোর সাহস পাও কোথা থেকে? আমি এই মেয়েকে নিয়ে এসেছি। আমিই ওদের বিয়ে দিয়েছি। যা করেছি, বুঝেশুনেই করেছি। তোমার মতো চার দেয়ালের ভেতর বসে আল্লাহ-আল্লাহ করে দিন পার করি না। দুনিয়া চড়িয়ে খেতে হয় আমাকে। বুঝেছ? অতএব, এখন থেকে আমার উপর দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবে না। তোমাকে ডেকে এনেছি, কারণ তুমি শারারের মা। আরেকটু পর সাইফুল আসবে ওর বউকে নিয়ে। ওদেরকে খবর দেয়া হয়েছে। এই ঘরে বসে আলোচনা হবে। এখানে অবশ্যই আমি লিড দেব। তোমাকে কোনো মাতব্বরি করতে বলা হয়নি। আর যদি মনে করো, মাতব্বরি না করে থাকতে পারবে না, দ্যান গেট লস্ট।
লুৎফুন্নেসার চোখের পলক পড়ল না। যে গালে তাকে থাপ্পড় মারা হয়েছে, সেখানে হাত রেখে স্থির দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
(চলবে)