#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-০৫
নিজের প্রিয় মানুষের ভেজা কন্ঠ কারোই ভালোলাগেনা। শাহবাজেরও ভালোলাগছেনা। প্রিয়াঞ্জনার ক্রন্দনসুর বুকে বিঁধছে। ঠিক যেন খেজুরের কাঁটার মতো। ফোনের এপাশ ওপাশ দুটো প্রাণ। নিরবতা। কেবল একপাশে ফোঁপানোর আওয়াজ। অপরজন নিশ্চুপ। বাইরে আজ রোদ উঠেছে। কড়া রোদ। টিনের চালটা চিকচিক করছে। গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেদিক পানেই চেয়ে আছে শাহবাজ।
“প্রিয়াঞ্জনা।”
“কি শাহ্?”
“আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো আজকের দিনে।”
“হুম”
“আজ শ্রাবণের চতুর্থ দিবস। তুমি পুরো একটা পাকা বুড়ির মতো কথা বলছিলে আমার সাথে প্রথম দিন। মনে পড়ে?”
ফোঁপানি থামে। কান্না থামে। প্রিয়াঞ্জনার স্মৃতিতে নাড়া দেয় প্রথম দিন। শাহবাজ জানে কি করে নিজের অর্ধাঙ্গীকে থামাতে হয়। গতকালকে জমি বিক্রির বায়না করে এসেছে। হাতে বেশ কিছু টাকা আছে। আচ্ছা, অর্ধাঙ্গীকে নিয়ে কি একটু ঘুরে বেড়ানো যায়? দুদিনের জন্য। এই সকল জাগতিক চিন্তা ভাবনা সবকিছু থেকে কিছুদিনের ছুটি কি নেওয়া যায় না? খুব বেশি স্বার্থপর সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে কি?
“ঘুরতে যাবে প্রিয়াঞ্জনা?”
“সত্যি, শাহ্!”
“তিন সত্যি।”
‘বাবা-মা আমাকে মানসিক ভাবে অনেক চাপ দিচ্ছে শাহ্! তারা চাচ্ছে আমি যেন ফুফাতো ভাই ফাহিম কে বিয়ে করি। এই অন্যায় আবদার তো আমি ম রে গেলেও মানবো না শাহ্।’ মুখে আসা কথাটাও বলেনা প্রিয়াঞ্জনা। তার শাহ্ দুশ্চিন্তা করবে। বাড়িতে কারফিউ জারি করেছে বাবা-মা, ভাই। একেকজন এসে বুঝিয়ে যাচ্ছে। যে ছেলে বাটপার। যে ছেলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যে ছেলের গলা পর্যন্ত ঋণ তার সাথে কি সংসার হয়? প্রিয়াঞ্জনা জবাব দেয়না। কেবল চুপ করে থাকে। তারা কি আর বুঝবে শাহ্ আর সে একপ্রাণ দুই দেহ! নিজের থেকে কি কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়া যায়! এসকল মানুষগুলো ঘর ভাঙতে পারে। ঘর গড়ার কারিগর তারা নয়।
“চুপ কেন প্রিয়াঞ্জনা।”
“কবে যাচ্ছি শাহ্?”
“আগামীকাল রওনা দিবো। তোমার বাবা-মা দিবে তো? জানো ওরা আমাকে বলে তোমাকে ছেড়ে দিতে। হা হা হা। নিজের থেকে নিজেকে কি কখনো আলাদা করা যায় প্রিয়াঞ্জনা?”
“আপনি ডেকেছেন আমি আসবোনা শাহ্! কখনো এমনটা হয়েছে?”
“তাহলে তাই কথা রইলো প্রিয়াঞ্জনা। অনেকদিন তোমাকে ভালোবাসা হয়না। একখানা উত্তপ্ত চুমু..
শাহবাজের কথা শেষ হয়নি তখনই প্রিয়াঞ্জনা বলে উঠে,
“কিসব বলছেন। বেশরম লোক!”
“নিজের বউকেই তো বলছি। কেমন একটা ব্যাপার না প্রিয়াঞ্জনা নিজের বউকে নিয়ে পালিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি!”
“আমি আপনার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই।”
“ধৈর্য্য ধরো।”
কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলেই ফোন রেখে দেয় প্রিয়াঞ্জনা। বারান্দার দেয়ালে মাথা এলিয়ে বসে। দৃষ্টি আকাশপানে। স্বচ্ছ আকাশ। দুয়েকটি পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। স্বামীর ভালো অবস্থায় পাশে থাকা আর মন্দ অবস্থায় নিজের সুন্দর জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যাওয়া মেয়েদের কি বলা উচিত? আত্মকেন্দ্রিক! অর্থলোভী! স্বার্থপর! একজন ছেলে যখন আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকে তারপাশে থাকা যাবে, তার সংসার করা যাবে আর অর্থ শূন্য হলেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে? একজন অর্ধাঙ্গিনী বুঝি এমনই হয়? নিজের সবটা উজাড় করে ভালোবাসলে তাকে কি কখনো ছেড়ে আসা যায়?
“আপা?”
প্রিয়াঞ্জনার পাশে বসে প্রীতি। এই বাড়িতে কেবল দুজন মানুষই প্রিয়াঞ্জনাকে বুঝে। সুমনা আর প্রীতি। প্রিয়াঞ্জনা প্রীতির কাঁধে মাথা রাখে। প্রীতি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এবার সে আর প্রাপ্তি ক্লাস নাইনে উঠেছে। বড়বোনকে খুব ভালোবাসে প্রীতি।
“তোর মন খারাপ আপা?”
প্রিয়াঞ্জনা জবাব দেয়না।
“আপা, জানিস। বাবা পারভেজ কাকার সাথে কথা বলেছে ফোনে। আমি শুনেছি। তোর আর ভাইয়ার ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলছিলো।”
পারভেজ হলেন প্রিয়াঞ্জনাদের পরিচিত এক উকিল। প্রিয়াঞ্জনা এসব নিয়ে এখন ভাবতে চায়না। আগে শাহ্ এর সঙ্গে ঘুরে আসুক তারপর এগুলো মোকাবেলা করবে। কিন্তু বাবা-মাতো জীবনেও যেতে দিবেনা। কিছুসময় পর মুখ খুলে প্রিয়াঞ্জনা।
“প্রীতি, আমি তোর শাহবাজ ভাইয়ার সাথে দুদিনের জন্য ঘুরতে যাবো।”
“তুই কি পাগল আপা! ভাইয়া আর বাবা জানতে পারলে কি হবে জানিস!”
একেই বোধহয় ভাগ্য বলে! নিজের স্বামীর সাথে ঘুরতে যেতেও কতকিছু মোকাবেলা করে যেতে হবে!
“তোকে জানিয়ে রাখলাম। আমি আগামীকাল ভোরবেলা বের হবো। ছোট একটা চিরকুট লিখে রেখে যাবো খাটের উপর। যখন সবাই আমাকে খুঁজাখুঁজি করে পাবেনা তখন তুই চিরকুট টা সবাইকে দেখাবি। এমন ভাব করবি যেন তুইও কিছু জানিস না।”
“সুমনা ভাবীকে বলবিনা?”
“না, বলবো না। আর খবরদার মায়ের চামচি প্রাপ্তির কানে যেন খবর না যায়। তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে।”
“আচ্ছা, আপা।”
জোহরা বিগত দুইদিন যাবতই প্রিয়াঞ্জনার সাথে কথা বলেন না। রাতে প্রিয়াঞ্জনা ডাইনিং টেবিলে খেতে যায়নি। সেদিনের পর থেকে সে আর ডাইনিং টেবিলে খাবার খায় না। ঘরে সুমনা ভাবী খাবার দিয়ে যান। আজ জোহরা খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছেন। প্রিয়াঞ্জনা ছোট একটা ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। তড়িঘড়ি করে তা খাটের নিচে লুকালো।
“ডাইনিং টেবিলে যাও না কেন?”
“এমনি”
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে প্রিয়াঞ্জনা। জোহরা বেগম বসেন প্রিয়াঞ্জনার পাশে। ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে ধরেন মুখের সামনে। মায়ের কিঞ্চিৎ ভালোবাসা পেয়ে চোখ ভিজে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। মুখ বাড়িয়ে লোকমা মুখে পুরে নেয়। ভাত খাওয়াতে খাওয়াতেই জোহরা বলেন,
“আমরা তোমার পরিবার প্রিয়া। কখনো কি তোমার খারাপ চেয়েছি? একটা বাটপার ছেলের সাথে জীবন কেন পার করবা?”
“ও বাটপার না মা।”
“এখনো ঐ ছেলের গানই গাঁও? তোমার কি লজ্জা নাই?”
“বাবা যদি এমন বিপদে পড়তো তুমি বাবাকে ছেড়ে দিতে মা?”
“ছিঃ! কি নিকৃষ্ট তুমি প্রিয়া! ঐ ছেলের তুলনা নিজের বাবার সাথে করছো?”
“ঐ নিকৃষ্ট ছেলেটাই বাবার বাইপাস সার্জারির সময় লাখ টাকার বেশি খরচ করেছে। ভাইয়া যখন শেয়ার বাজারে টাকা লাগিয়ে লস খেয়েছিলো তখন চারলাখ টাকা দিয়েছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমার পরিবারের চাহিদা মিটিয়েছে। এতিম মানুষটা নিজের পরিবারের মতো তোমাদের ভাবতো। আর তোমরা!”
“এগুলো করেছে নিজের বাবার পাপ ঢাকতে। এতকিছু বুঝিনা প্রিয়া। তুমি ফাহিমকেই বিয়ে করবা। তারপর আমেরিকা চলে যাবা। আমরা তোমার ভালো চাই।”
প্রিয়াঞ্জনা মায়ের পানে চেয়ে হাসে। চোখে চশমা, পরনে হালকা গোলাপির মাঝে সোনালি সুতার কাজ করা থ্রি-পিস, ফর্সা মুখ আর আধাপাকা চুলে খোঁপা করা মানুষটাকে বেশ ভালো করেই চিনে প্রিয়াঞ্জনা। এই মানুষটার জিদ সম্পর্কেও ধারণা আছে তার। এই যে মিষ্টি করে কথা বলছেন তার ভিতরে রয়েছে রাগী এক সত্তা। যে এখন নিজেকে দমন করে রেখেছে। জানেন রাগ দেখালে হিতে বিপরীত হবে। তাই মিষ্টি ব্যবহার। এসবের পিছনে রয়েছে নিজের ভাইয়ের মৃ’ত্যু’র প্রতিশোধ নেওয়া। শাহাদাত চৌধুরীর পাপের শাস্তি পাবে তার পুত্র শাহবাজ চৌধুরী।
“তুমি আমাকে কখনো বুঝলেনা মা।”
শেষ লোকমা প্রিয়াঞ্জনার মুখে তুলে দিয়ে জোহরা বেগম বললেন,
“আমি তোমার ভালোটাই চাই প্রিয়া। ফাহিমের সাথে আমি তোমার বিয়ে দিয়েই ছাড়বো। দেখি আমাকে কে আটকায়।”
প্রিয়াঞ্জনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠে চলে যান জোহরা। ‘আমিও দেখবো মা। আমাকে আর শাহবাজকে তোমারা কি করে আলাদা করো! আমিও তোমারই সন্তান। জেদ আমারো আছে।’
মনে মনে আওড়ায় প্রিয়াঞ্জনা।
কাকডাকা ভোর। হালকা মেঘ জমেছে আকাশে। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় মৃদু শীত পড়েছে। প্রিয়াঞ্জনা চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। এখন সোজা আরশীনগর যাবে। সেখানে শাহ্ অপেক্ষা করছে। রাস্তায় তেমন রিকশা নেই। মানুষজনও নেই। মেইন রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা রিকশা পায় প্রিয়াঞ্জনা।
আরশীনগর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাজ। সকল চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে এই দুদিন নিজের মতো বাঁচবে সে আর তার অর্ধাঙ্গী। নিজের জং ধরা মাথাকে সচল করতে হলে একটা ট্যুর প্রয়োজন। নিজের প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে কিছুদিন ঘুরে আসলে জীবন যেন আবার ছন্দোময় হয়ে উঠে। অনেক সময় মনে হয়, ‘না এটা তো ট্যুরে যাওয়ার উপযুক্ত সময় নয়! এত ভয়াবহ পরিস্থিতিও কেউ ট্যুরে যায়!’ কিন্তু সত্যি বলতে ঐ সময়টাই উপযুক্ত সময়। একটু আবহাওয়া পরিবর্তনই পারে জীবনকে নতুন করে সাজাতে।
প্রিয়াঞ্জনা দূর হতে দেখে তার পুরুষ কালো শার্ট, জিন্স প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে। আজ যেন সেই আত্মবিশ্বাসী বিজনেসম্যান শাহবাজ চৌধুরীর ঝলক দেখতে পাচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। যা গত বেশ কয়েকমাস প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্ এর মাঝে দেখতে পায়নি। প্রিয়াঞ্জনার রিকশায় উঠে পড়ে শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা আঁকড়ে ধরে শাহবাজের ডান ঊর্ধ্ববাহু। মাথা রাখে শাহবাজের কাঁধে। নিজেদের গাড়ি নিয়ে গতবার সিলেট গিয়েছিলো। গাড়িটা নেই। বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন এই দুই কপোত-কপোতীর গন্তব্য নরসিংদী ভেলা নগর বাস স্টেশন। সেখান থেকে সোজা সিলেট শহর।
(চলবে)….