প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
১৮.+১৯
আদ্রর বুকের একদম মধ্যিখানে মাথা এলিয়ে রেখেছিল বেলা। কখন যে ঘুমিয়ে গেল! গভীর তন্দ্রার মাঝেও তার এক হাত আদ্রকে জড়িয়ে রেখেছে। অবাধ্য চুলগুলো ঢেকে আছে সম্পূর্ণ মুখশ্রী। ঠান্ডা বাতাসে বারবার কেঁপে উঠছে সে। আদ্র একটু ঝুঁকে সামনের জানালা দু’টো বন্ধ করে দিলো। বেলা অল্প নড়েচড়ে উঠলো। বুকে গাল ঘঁষে আরেকটু ঘনিষ্ট হলো। আদ্র মুচকি হাসলো। গভীর, নির্নিমেষ দৃষ্টে চেয়ে রইলো অনেক্ষণ। হাত বাড়িয়ে গালে পরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। অধর ছোঁয়ালো কপালে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এখন। কিছুক্ষণ পরই ন’টা বাজবে। আদ্র মৃদু স্বরে বেলাকে ডাকলো,
—“বেলা, উঠো। রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যাবে না?”
বেলা নিশ্চুপ। কিঞ্চিত ঠোঁট নড়ে উঠলো মাত্র। আদ্র স্বস্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কোমল স্বরে আবারও ডেকে উঠলো,
—“উঠবে না বেলা?”
বেলার অভিব্যক্তি শূণ্যের কোঠায়। আদ্রর সঙ্গে লেপ্টে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। একদম বিড়াল ছানার মতো। উষ্ণ নিশ্বাসগুলো শার্ট ভেদ করে শরীরে বিঁধছে। আদ্র ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আলতো করে বেলার ক্ষীণ বাদামী পাঁপড়িগুচ্ছে হাত ছোঁয়ালো। দায়সারা ভাবে নিষ্প্রভ স্বরে বললো, “আমি কিন্তু তোমাকে ডেকেছি বেলা। তুমিই ওঠোনি।”
বেলার চুল থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে নাসিকারন্ধ্রে ঠেকছে। ভালো লাগছে। আদ্র বেশ কয়েকবার জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিলো। বেলাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো আরও নিবিড় ভাবে। মেয়েটা সাথে থাকলে তার মস্তিষ্ক আর কোনো কিছু ভাবতে চায় না। প্রশান্তিতে চোখ বুজে আসে। বাতাসেও যেন প্রেমময় বার্তা ছড়িয়ে যায়। সময়ের খেয়ালই থাকে না।
–
বেলার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন রাত প্রায় দশটা বাজছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে নিজের অতি নিকটে আদ্রকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলো সে। দূরে সরতে নিলেই আদ্রর শক্ত পুরুষালি হাতের কঠিন বাঁধনে আটকা পরলো। আদ্র ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো। বেলাকে নিজের কাছে টেনে এনে তন্দ্রাঘোরে বললো,
—“নড়ে না বেলা। ঘুমাচ্ছি।”
আদ্রর চোখ তখনো বন্ধ। লোকটা তার দিকে না তাকালেও প্রচন্ড লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে ধরছে তাকে। অস্থির লাগছে। কথার অবাধ্য হয়ে বেলা তবুও সড়তে চাইলো। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো,
—“ক’টা বাজে?”
—“জানিনা। ঘুমাতে দাও।”
বেলা জোড় গলায় বললো,
—“বাসায় গিয়ে ঘুমাবেন। এখন ছাড়ুন। রাত অনেক হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে।”
আদ্রর হাত ঢিলে হয়ে গেল। বেলা সরে বসলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই স্ক্রীনে ভেসে উঠলো বড় বড় নম্বরগুলো। দশটা বেজে এক মিনিট। নোটিফিকেশনের আইকনে বাবার কল উঠে আছে। বেলার চিন্তা বেড়ে গেল। বাসায় গেলে নিশ্চিত বকা খেতে হবে। আড়চোখে আদ্রকে দেখলো সে। কাঁচা ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়ায় চোখগুলো লাল হয়ে আছে। কপালে বলিরেখা ফেলে চোখ ছোট ছোট করে রাখা। ক্ষীণ কাঁপছে হাতগুলো। শার্ট কুঁচকে আছে। বেলা জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি আমাকে ডাকেন নি কেন?”
আদ্রর নির্লিপ্ত উত্তর, “ডেকেছি। তুমি ওঠোনি।”
বেলা চুপ হয়ে যায়। মনে মনে আওড়ায়, “কখন ডাকলো? আমি শুনিনি কেন?”
গাড়ির ইনার লাইটটা বন্ধ ছিলো। আদ্র জ্বালিয়ে দিলো তা। এসি ছাড়লো। গরমে কপাল, গলা, ঘাড় খুব বাজে ভাবে ভিঁজে গেছে তার। চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। গাড়ির স্টেয়ারিং এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে বেলার দিকে হঠাৎ ঝুঁকে পারলো সে। বেলা বড় বড় চোখে তাকালো। তার কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই সীটবেল্ট লাগিয়ে সরে এলো আদ্র। সামনের রাস্তাগুলো ভাঙ্গা। বেলা ধাক্কা খেতে পারে। ব্যথা পেলে আবার?
গম্ভীর স্বরে বললো,
—“তুমি এখনো ছেলেটার নাম বলোনি বেলা।”
বেলা ওড়নার কোণা মুচড়ামুচড়ি করছে। ধীর কণ্ঠে বললো,
—“বলবো না।”
—“কেন?”
—“আপনি মারপিট করবেন।”
আদ্র ভ্রু কুঁচকালো, “সেটা তো আমি এমনিতেই করবো।”
—“এমন কিছুই করবেন না আপনি। পরে আপনার ক্ষতি হলে?” বেলা উৎকণ্ঠা হয়ে বলে উঠলো।
রেগে গিয়ে মুখ থমথমে করে ফেললো আদ্র। লোকটা অল্পতেই রেগে যায়।
–
নাস্তা খেতে খেতে ফোনে কথা বলছিল আদ্র। কথা শেষ হতেই রেখা বেশ আগ্রহী কণ্ঠে বললেন,
—“আদ্র জানিস কি হয়েছে?”
কথাটা বলার সময় চোখ বড় বড় করে রেখেছিলেন রেখা। আয়াজ পরোটা মুখে পুরে ঠাট্টার স্বরে বললো, “না বললে কিভাবে জানবে মা?”
রেখা চোখ পাকিয়ে তাকালেন। ধমক দিয়ে বললেন, “তুই চুপ থাক।”
তারপর আবার আদ্রর দিকে চেয়ে বললেন,
—“আদ্র, ফোন রাখ। আমার কথা কি শুনছিস তুই?”
আদ্র ফোন রেখে দিলো। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, “শুনছি, বলো।”
রেখা উৎসাহিত হলেন। চোখ জ্বলজ্বল করে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,
—“বেলাকে পরশু যারা দেখতে এসেছিল, তাকে কে যেন থাপ্পড় মেরে মেরে গাল থেকে রক্ত বের করে দিয়েছে। ছেলের তো বেলাকে অনেক পছন্দ হয়েছিল। সায়েদ ভাই মানা করা সত্ত্বেও বিয়ের জন্য জোড় দিচ্ছিলো নাকি! এখন গালের ব্যথায় নড়তে পারছে না। বিয়ের জন্য মানাও করে দিয়েছে। এটা কে করতে পারে বলতো! তবে ভালোই হলো। ছেলেটাকে আমার একটুও ভালো লাগেনি।”
আয়াজের গলার খাবার আটকে গেল যেন। বিষম খেতে খেতে দ্রুত গ্লাস থেকে পানি পান করলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সে। আদ্রর মুখাবয়ব পর্যবেক্ষণ করলো। আদ্র তখন শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উত্তর দিলো, “ওহ্! জানতাম না তো।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
প্রিয় বেলা
১৯.
তিন বান্ধবীকে নিয়ে আজ শাড়ি পরেছিল বেলা। অনেকটা সখের বসেই। ভার্সিটির ক্লাস বাঙ্ক করে মেলায় ঘুরেছে অনেক্ষণ। এরপর বিকাল গড়ালে করিম চাচাকে ঠিকানা দিতেই তিনিও চলে এলেন তাকে নিতে। বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে বেলা রিকশায় উঠে বসে। শাড়ির আঁচল সামলে কোলে গুটিয়ে রাখে। আবহাওয়া আজ বেজায় করুণ। ঘন কালো মেদুর ঢাকা পরেছে সমগ্র অন্তরীক্ষে। সকাল থেকেই বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব। কিন্তু আসছে না। অল্পসল্প উৎকট অনল বিদ্যমান। তবে ঝড়ো বাতাস নেই। রাস্তার অন্যধারে অচেনা গাছের ডগায় কিশলয় গজিয়েছে। নতুন পাতায় ভরে গেছে গাছটা। বেলা মোবাইলের পাওয়ার বাটন চেপে সময়টা দেখে নিলো। দেড়ি হয়নি। সময় মতো টিউশনে যেতে পারবে বলে ক্ষীণ শান্তি মেললো অন্তরস্থলে। হঠাৎ কে যেন একলাফে উঠে পরলো রিকশায়। বেলা চমকিত হলো। নেত্রপল্লব বিস্তর হয়ে বড় বড় হলো বাদামী রঙা চোখের মণি। করিম চাচাও একটু ভড়কে গেলেন। রিকশা থামালেন তক্ষুণি। তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকিয়ে অচেনা, মাক্স পরিচিত সুঠাম দেহি আদ্রকে দেখে চিনতে পারলেন না। গলায় তেজ নিয়ে খ্যাঁক করে উঠলেন,
—“এ্যাঁই, এ্যাঁই, কেহ্ আফনে? রিশকায় উটছেন ক্যান? মাইর খাওনের সখ জাগছে নাকি? নামেন রিশকা থেইকা। নামতাছেন না ক্যান?”
মাক্সের আড়ালে আদ্রর মুখাবয়ব বোঝা গেল না। তবে দৃশ্যমান চোখজোড়া অল্প বিব্রত হলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“আমি আদ্র চাচা। আপনি রিকশা চালান।”
শুনে ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। অবাক স্বরে বললেন,
—“এইডা আফনি স্যার? আমারে ডাকতে পাইরলেন না? ডাকলেই তো রিশকা থামাইতাম আমি। কি ডর পাইছিলাম জানেন?”
আদ্র হাসলো যেন,
—“আপনাকে ভয় পাওয়ানোর জন্যই এমন করেছি চাচা।”
এবার করিম চাচাও একটু হাসলেন। রিকশা ধীর গতিতে চালাতে শুরু করলেন। বেলা কথা বলছে না। তখন ভীষণ ভয় পেয়েছিল সে। বুকের বা’পাশটা এখনো ধুকধুক করছে। আশঙ্কায় জড়জড়িত মুখ। ভীতুগ্রস্ত। আদ্র মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ বেলাকে দেখল। প্রশ্ন করলো,
—“ভয় পেয়েছ বেলা?”
বেলা জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে রইলো। রিকশার হুঢ উঠানো। স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। খোলামেলা হওয়ায় ভালোও লাগছে খুব। করিম চাচা একটু ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,
—“হুঢ-টা কি নামাই দিমু স্যার?”
—“এখন তো রোদ নেই। পরিবেশটা ভালো লাগছে। নামাতে হবে না।”
করিম চাচা মাথা দোলালেন শুধু। আদ্র নিচু হয়ে বেলার কানের কাছে ঝুঁকলো। মৃদু স্বরে আবার প্রশ্ন করলো,
—“রাগ করে আছো?”
বেলা মলিন কণ্ঠে বললো, “না।”
—“মিথ্যা বলা শিখে গেছ তুমি।”
প্রতিউত্তরে একটু গম্ভীর হয়ে কথাটা বললো সে।
বেলার উষ্ণ বাম হাত আঁচলের আড়ালে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো। মেয়েটাকে শাড়িতে দারুণ লাগছে। চুলগুলো এলোমেলো খোঁপা করা। কিছু চুল আদ্রর গলায় বারি খাচ্ছে। খোঁপায় ফুল নেই। ডান হাতে অনেকগুলো চুড়ি পড়া। লাল রঙের। আদ্রর দেওয়া। তা দেখে সে অবাক হলেও বোঝার উপায় হলো না। চমকে যাওয়ার রেশ মাত্র নেই। খুশি হয়েছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। চোখের ভাষা অস্পষ্ট। এই সাধারণ বেলা থেকেই দৃষ্টি সরাতে পারছে না আদ্র। অনিমেষ, অপলক হয়ে চেয়ে আছে বেহায়া চোখজোড়া নিয়ে। অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে খুব। প্রচন্ড অবাধ্য হয়ে ভুল কিছু করে ফেলতে তাড়া দিচ্ছে চতুর মন। আদ্র চোখ সরিয়ে নিলো দ্রুত। মেয়েটা তাকে এমন ভাবেই বুঝি মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে? শ্বাসকার্য অস্থিরতায় অবিন্যস্ত হয়ে গেছে সেই কবে।
বেলা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিল। আদ্র অন্যদিকে তাকাতেই বিষাদশান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনাকে মানা করা সত্ত্বেও ওই ছেলেকে মেরেছেন কেন?”
প্রশ্ন শুনেও ওর দিকে তাকালো না আদ্র। কপালের চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো, “বেয়াদবি করছিল। তাই মেরেছি।”
বেলা বিমূঢ় হয়ে তাকালো, “কি বেয়াদবি?”
—“তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরানোর বিশ্রীরকমের বেয়াদবি।” একটু চুপ করে আবার বললো, “তবে সময়ের অভাবে চড় ছাড়া কিছু করতে পারিনি। কাল থেকে তাই শান্তি পাচ্ছি না।”
কি নিঃসঙ্কোচ অকপটে বলা কথাটি। বেলা আশ্চর্য হয়ে পিটপিট করে তাকালো। কিছু বলতে পারলো না। সময় গড়ালো। স্টুডেন্টের বাসার প্রায় কাছাকাছি চলে এলো রিকশা। আদ্র হঠাৎ শীতল গলায় বললো,
—“তুমি আর শাড়ি পরবে না বেলা।”
বেলা বুঝে উঠতে পারলো না। অবাক হলো। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
আদ্র কিভাবে যেন তাকালো তখন। দুজনের নেত্রজোড়া মিলিত হলো। অনুরাগ স্বরে বললো,
—“আমি বেসামাল হয়ে যাবো।”
আদ্রর ধারালো চোখের তীক্ষ্ণতা আর পুরুষালি কণ্ঠের পিঠে নেতিয়ে গেল বেলা। শাড়ি খামচে ধরলো। দৃঢ় লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ বুজলো সে।
–
ছাত্রীকে পরাতে পরাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে গর্জন শোনা যাচ্ছে। কি ভয়াবহ তা! রিকশায় উঠতেই আকাশটা কেঁদে উঠলো খুব জোড়ে। করিম চাচা দ্রুত তাগাদা দিয়ে বললেন,
—“তাত্তাড়ি পলিথিনডা টাইনা লও মা। নাইলে ভিঁজ্জা যাইবা।”
বেলা শুনলো। হুঢের এককোণে চেপে রাখা পলিথিন জাতীয় পর্দাটা টেনে নিজের শরীর ঢেকে নিলো। শাড়ির কুঁচিগুলো একটু ঝাঁকিয়ে অবশিষ্ট পানির রেশ কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। করিম চাচাকে বললো,
—“আপনিও তো ভিঁজে যাচ্ছেন চাচা। এখানে কোথাও রিকশা একটু দাঁড় করান। বৃষ্টি কমলে নাহয় যাবো।”
ইতিমধ্যে কাক ভেঁজা হয়ে গেছেন করিম চাচা। পুরাতন শার্টের পিঠের দিকটা বাজেভাবে ভিঁজে গেছে। কপাল বেয়ে পরা পানিগুলো একহাতে মুছে তিনি বললেন,
—“ভিঁজ্জা তো গেছিই মা। অভ্যাস আছে। এহন দাঁড়াইলে তোমার দেড়ি হইবো।”
বেলা আর দিরুক্তি করলো না। পর্দার ফাঁক গলিয়ে বৃষ্টির ছিঁটে আসছে। কাপড়ের হ্যান্ডব্যাগটা ভিঁজে গেছে অনেকাংশ। তা কোলে নিয়ে সাবধানে রাখলো বেলা। মেলা থেকে আদ্রর জন্য একটা ঘড়ি কিনেছিল সে। হঠাৎ-ই চোখ পরে গিয়েছিল। আদ্রর হাতে মানাবে খুব। তবে তাকে দেওয়ার সাহস হয়নি তার। ব্যাগ থেকে ঘড়িটা বের করে আলতো হাত বোলালো সে। মনে দ্বিধা কাজ করলো। ঘড়িটা কি আদ্রর পছন্দ হবে?
দৈবাৎ তেজস্বী এক সিএনজির তান্ডবীয় ধাক্কায় উপর হয়ে পরলো রিকশা। করিম চাচা রিকশা থেকে পরে গেলেন। হাতে ব্যথা পেলেন একটু। বেলা ছিটকে উঠলো। কর্কশ, অসমতল রাস্তায় ঘঁষা খেল প্রচন্ড ভাবে। হাতে, পায়ে, উন্মুক্ত কোমড়ে আঁচড় পরে গেল শতসহস্র। আদ্রর দেওয়া লাল চুড়িগুলো ভেঙ্গে গেছে কয়েকটা। হাতে বিঁধলো তা। থুতনি, কপাল ফেটে রক্ত গড়ালো। ডান গালটার বুঝি চামড়া আর নেই। ছিঁলে একাকার। শাড়ি হাঁটুর নিচ অব্দি উঠে গেছে। আঁচল সরে গেছে ক্ষীণ। চোখে ঝাপসা দেখছে। হ্যান্ডব্যাগটা যে কোথায় পরে গেল! আদ্রর জন্য কেনা ঘড়িটা বোধহয় বৃষ্টির পানিতে নষ্টই হয়ে গেছে। কমদামি তো! বেলা খুব মিলিয়ে ঝুলিয়ে কিনেছিল।
আদ্র তখন ক্লাবে। আর মাত্র ছয়দিন আছে নির্বাচনের। বেশিদিন নেই। নির্বাচনের জন্য মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়েছে। আদ্র সে নিয়েই কথা বলছিল। কথার মাঝে ফোনটা বেজে উঠে তার। করিম চাচা কল দিয়েছেন। আদ্র একবার দেখে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। আবারো কল দিতেই দায়সারা ভাবে ফোন উঠালো সে। রিসিভ করে বললো,
—“আমি একটু ব্যস্ত আছি চাচা। পরে কথা বলি?”
ওপাশ থেকে তীব্র কান্না ঝংকার তুললো। হাউমাউ করে কেঁদে করিম চাচা বললেন,
—“আমারে মাফ কইরো স্যার। আমি তুমার কতা রাইখতে ফারি নাই।”
এর মাঝে তন্ময় বলতে নিলো, “ভাই, আমার মনে হয় পাশের এলাকায় বেশি–।”
হাতের ইশারায় তন্ময়কে থামিয়ে দিলো আদ্র। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন ফোনে। করিম চাচা আবারো বললেন, “রিশকার পিছন দিয়া কে জানি ধাক্কা দিছিলো। আমি ব্যথা না পাইলেও বেলা মার অবস্তা ভালা না। আমি হাসপাতালো নিয়া আইছি তারে। তুমিও চইলা আসো।”
আদ্র বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির পায়ে কাউকে কিছু না বলেই বৃষ্টির মাঝে বেড়িয়ে পরলো ক্লাব থেকে। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
—“কোন হাসপাতাল চাচা? আমি আসছি। ওকে একটু দেখুন তো। ও কি কাঁদছে? কাঁদতে মানা করবেন।”
_________________
চলবে~