#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২০
#রাউফুন
অন্তরিক্ষ তখন স্তব্ধ,শান্ত। অজস্র তারার ভিড়ে চন্দ্রপ্রভা। কনকনে বাতাস, পাতা নড়ছে মৃদু মৃদু।রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ কুকুরটি ডেকে চলেছে বহুক্ষণ হলো। এখনো শব্দ আসছে বাহির থেকে। মালার অন্তঃকরণ স্ফুলংকের মতো জ্বলছে। বার বার শুধু জাকিয়ার প্রিহানের হাত চেপে ধরার দৃশ্য চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে। মেহমানদের মধ্যে যদি অন্য কেউ তার স্বামীর হাত ধরে ঘুরতে পারে তবে প্রেক্ষিতে তো সে এরকম বিরুপ পোষন করতেই পারে। প্রত্যক্ষভাবে তার দোষ কোথায় এখানে? আনমনে কথাগুলো আওড়ে ক্ষান্ত হলো মালা। পাহাড়সম অভিমান নিজের স্থান দখল করে নিল ছোট মনের এককোণে। ডুবন্ত সাঁঝের হরিদ্রাভ-রক্তিমা আকাশের গহীনে নিষ্প্রভ নয়নে তাকালো সে। প্রিহান এখনো বাড়ি ফেরে নি। অথচ সে আজ ভেবেছিলো প্রিহান জলদি ফিরবে। সে সারাদিন কিছুই খাইনি। কাল রাত থেকে শুরু করে আজ রাত দশ টা বেজে গেছে অথচ সে অনাহারে। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাড়ির সবাই জানে সে বাইরে থেকে খেয়েছে৷ কিন্তু না সে খাইনি। এইতো সে রেস্টুরেন্ট থেকে নয়টাই বাসায় ফিরেছে সে। বাড়িতে খোদেজা খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেছে প্রিহান আসলে তার সঙ্গেই খাবে। অবশ্য এভাবে তার না খেয়ে থাকার খুব ভালো অভ্যাস আছে। আগে কত না খেয়ে থেকেছে সে। এমনো হয়েছে সে শুধু পানি খেয়েই দু’দিন থেকেছে। অনেক দিন পর মালা অনাহারে থেকেছে আজ। উচাটন মনে কি জানি কেন এতোটা জেদ চেপে বসেছে। সে গাড়ির আওয়াজ পেলো৷ সে বাইরের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো প্রিহান কে। সে আলতো পায়ে নিচে নেমে এলো। প্রিহান দরজায় নক করার আগেই মালা দরজা খুলে দিয়েছে। অবাক হলো প্রিহান। মালাকে দেখে ঠোঁট এলিয়ে বিস্তৃত হাসলো। মালাও বিনিময়ে হেসে প্রিহানের হাতের ব্যাগ নিয়ে নিলো। প্রিহান যেতে যেতে বললো,
‘কি ব্যাপার আজ দরজায় নক না করতেই খুলে দিলে। খুব বেশি মিস করছিলে নাকি?’
জবাব দিলো না মালা। সে আপনমনে প্রিহানের জুতো খোলায় মন দিলো। প্রিহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউই নেই ড্রয়িংরুমে। সে সুযোগ পেয়ে জড়িয়ে ধরলো মালাকে। মালা তবুও নিশ্চুপ। কোনো রিয়েকশন নেই। প্রিহান কিছুই বুঝলো না মালার এরকম আজব বিহেভিয়ার এর মানে কি। সে কি কিছু করেছে নাকি? ওহোহো সে তো ভুলেই গেছিলো কালকের কথা।
‘মহারানী কি কালকের বিষয়টি নিয়ে এখনো আপসেট?’
‘উঁহু!’
‘তাহলে কথা বলছো না কেন?’
‘কই?’
‘এই যে আমার সঙ্গে কেমন বিরুপ আচরণ পোষন করছো।’
‘না তো। এরকম কিছুই না।’
‘তাই?’
‘হুম!’
‘ওকে!’
বলেই প্রিহান রুমে চলে গেলো। মালার অভিমান আরও তড়তড় করে বাড়তে লাগলো। সে খাবার গরম করে টেবিলে সাজাচ্ছিলো। তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। সে দেখলো হুমকি দেওয়া আগুন্তক কল করেছে। সে রহস্যময় হাসি হাসলো। সে জানতো তাকে রাতেই কল করা হবে। সে ফোন টা রিসিভ করে রান্নাঘরে গেলো।
‘হ্যাঁ বলুন। আপনার ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম।’
‘এই মালা,তুমি আমার সঙ্গে ডাবল গেইম খেলার চেষ্টা করছো হ্যাঁ? ফাইলের কাগজ পত্র গুলো নকল ছিলো। তুমি নকল ফাইল টা কেন দিলে? তুমি কি জানো এর ফল কি হতে পারে?’
‘শিহহহ! আওয়াজ নিচে। আর আমি কিভাবে জানবো ওগুলো নকল কাগজ ছিলো। আলমারিতে একটাই ফাইল ছিলো আর সেটা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম কাল রাতে।’
‘তার মানে কি বলছো তুমি? ঠিক ফাইলটা তুমি দিয়েছো? তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি? আজকে কেস টা তাহলে তোমার স্বামীর ফরে থাকলো কেন? মশকরা পেয়েছো তুমি? ফাইল টা কেন বদলে দিলে?’
‘বললাম না চিৎকার করবেন না। আমি সত্যিই জানি না ফাইল পালটে গেলো কি করে। নিশ্চয়ই প্রিহান বুঝতে পেরেছিলো ওর পেপার গুলো নিয়ে রিস্ক আছে তাই হইতো ও নিজেই সেইফ কোনো স্থানে সরিয়ে রেখেছিলো। আমি তো আর জানতাম না কি ধরনের পেপার ছিলো।’
‘ঠিক আছে আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। এরপর প্রিহান কি কি করছে তার সমস্ত কিছুর ইনফরমেশন আমাকে দেবে। আর না দিলে বুঝতেই পারছো–!’
টুট টুট করে কে’টে গেলো ফোন টা। মালা পেছনে ঘুরেই দেখলো প্রিহান দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু টা ঘাবড়ে গেলো। মনের ভেতর একটা আশংকা হচ্ছে প্রিহান কিছু শুনে ফেললো নাকি সেই আশংকা।সে মেকি হেসে বললো,
‘আপনার ফ্রেশ হওয়া শেষ? আপনি বসুন আমি খাবার দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে দাও!’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মালা। যাক প্রিহান কিছু শুনতে পাইনি।
‘তুমি খেয়েছো?’
‘হ-হ্যাঁ!’
‘চলো বসো! আমার সঙ্গেও খাও একটু!’
‘না আমার পেট একদম ভরা। খাওয়া সম্ভব না। এরপরে যদি মো’টা হয়ে যায় তবে আপনিই আর আমাকে পছন্দ করবেন না।’
‘এরকম কোনো দিন যেনো না আসে যে তোমাকে আমার পানসে লাগছে।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রিহান বললো, ‘তুমি আসো আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য!’
‘আচ্ছা যান।’
‘রাগ কমেছে?’
‘কিসের রাগ। রাগ নেই তাই কমার প্রশ্নই আসছে না।’
কপাল চুলকে হাসলো প্রিহান। বেশ বুঝলো অভিমান টা বেশ জোড়ালো। তাই সে চলে গেলো। কিছু একটা ভেবে সে ঔশীর রুমে গেলো। মেয়েটার জন্য চকলেট এনেছে অথচ সে ব্যস্ততার জন্যই দিতে পারে না। ঔশীর রুমে গিয়ে দেখলো ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। সে আস্তে আস্তে চকলেট ওর বালিশের কাছে রাখলো। কপালে স্নেহের স্পর্শ এঁকে দিয়ে বেরিয়ে এলো। নিজের রুমে যাবে তখন তার মা খোঁদেজার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি ইশারায় ছেলেকে কাছে ডেকে ইশারায় বুঝালেন,
‘মালা খেয়েছে?’
‘মানে? ও কি তোমাদের সঙ্গে খাইনি আম্মু?’
ইশারায় বুঝালেন যে মালা খাইনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা হয়েছে মেয়েটার। না হলে মেয়েটা এমন মন ম’রা হয়ে কেন আছে। সারাদিন বাসায় ছিলো না। সকালেও খেয়ে বের হয়নি। বাইরে খেয়েছে কি না সেটাও জানা নেই তার। তাই তো ছেলের আসার অপেক্ষা করছিলেন। প্রিহান মাকে সহাস্যে বললো,
‘ঠিক আছে আম্মু। তুমি রুমে যাও আমি দেখছি ব্যাপারটা!’
তার মানে খোদেজা কথা না বলতে পারলেও ইশারায় খুব সুন্দর ভাবে কথা বুঝাতে পারে। আর বাড়ির সবাই এতো বছরে খুব ভালো ভাবেই বুঝেন।প্রিহান যা বুঝার বুঝে গেলো। মালা তাকে মিথ্যা বলেছে তবে। সে গটগট করে রান্না ঘরে গেলো। রান্না ঘর থেকে প্লেট ভর্তি খাবার নিয়ে নিজের রুমে গেলো। রুমে ঢুকে দরজা আটকে খাবারের প্লেট টা টি টেবিলে রাখলো।
‘শুনলাম তুমি সবার সঙ্গে খাওনি? আমাকে মিথ্যা কেন বললে যে খেয়েছো?’
মালা রান্না ঘর থেকে এসে চুপচাপ বসে ফোন ঘাটছিলো। প্রিহান রুমে এসেছে সে টের পেয়েছে কিন্তু চোখ তুলে দেখতে ইচ্ছে হয়নি। প্রিহান তাকে একবার বলেই আর বলেনি খাবার খাওয়ার কথা। মনে মনে অভিমান টা এতোই বেরেছে যে চোখ তুলে তাকাতে ইচ্ছে করেনি তার। কিন্তু প্রিহানের কথা শুনে চকিতে তাকালো সে।
‘আমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি মালা! আন্সার মি ডেম ইট!’
‘এমনি খাওয়া হয়নি।’ ভীত হয়ে উত্তর দিলো মালা।
‘এমনিতেই কেন খেলে না? যা জিজ্ঞেস করবো সত্যি কথা বলবে।’
‘হ্যাঁ আচ্ছা!’
‘আচ্ছা। আর আজ সারাদিন কি কি খেয়েছো?’
‘অনেক কিছু খেয়েছি!’
‘অনেক কিছু কি কি শুনি!’
‘এই আপনি কাটগড়ার আসামীদের মতো আমাকে এতো প্রশ্ন কেন করছেন শুনি? এতো উত্তর দিতে পারবো না। আপনি উকালতি আদালতে করুন আমার সঙ্গে না হ্যাঁ!’
‘আমাকে মিথ্যা কেন বললে?’ চেচিয়ে উঠে রেগেমেগে বললো প্রিহান।
‘আপনাকে কে বললো আমি খাইনি?’ ভয়ে ভয়ে বলল মালা।
‘তুমি কি ভেবেছো আমি জানতে পারবো না তুমি না খেয়ে থাকলে? তোমার মুখ শুকনো দেখে মা বুঝতে পেরেছেন তুমি খাওনি সারাদিন। আর রাতে আমার সঙ্গে খেয়েছো কিনা এটা জিজ্ঞেস করেছেন মা। আমি বুঝতে পারলাম উনাদের সঙ্গেও খাওনি।তারপর সবটা আমার কাছে পরিষ্কার হলো। কখন থেকে অনাহারে তুমি?’
‘গতকা’ল রাত থেকে।’ প্রিহানের রাগী ফেস দেখে আটসাট ভাবে জবাব দিলো মালা। এখন একটা মিথ্যা বলা মানে নিজের জীবন রিস্কে ফেলা। তাই সে বলেই দিলো।
‘তার মানে কাল রাতে তুমি আমার সঙ্গে খাওয়ার কথা বলেছিলে সবার কাছে। কিন্তু খাওনি। অথচ তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি সবার সঙ্গে খেয়েছো। আর এখন শুনলাম আজ সারাদিন বাসায় খাওনি। ওয়াও এখানে কি না খেয়ে থাকার কম্পিটিশন চলছে?’
‘আমআমার খিদে পাইনি তাই খাইনি।’
‘আমাকে কি তোমার পা’গ’ল মনে হয়? খিদে পাইনি তোমার? তাহলে তোমার মুখ এতোটা শুকনো লাগছে কেন? তারপর কন্ঠঃরোধ হয়ে আসছে কেন? গলার আওয়াজ হালকা শুনতে লাগছে কেন? বোকা পেয়েছো এডভোকেট প্রিহান হাওলাদার কে?’
‘হ্যাঁ খিদে পেয়েছে তো? এখনো খাবো না। কেন খাবো আমি? কেউ তো আমাকে মূল্যায়ন ই করে ন।’
‘কি বললে আবার বলো?’ অগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকালো প্রিহান।
‘খাবো না এখনো!’ কোনো মতে উচ্চারণ করলো মালা।
‘খাবে না তুমি মালা তাই তো?’
‘হ্যাঁ খাবোই না।’
‘আবার বলছি খাবে না কি খাবে না?’
‘বললাম তো খাবো না।’
‘ঠিক আছে মাই ড্রাগনফ্লাই’স! বড্ড জেদ তোমার। তুমিও প্রিহান হাওলাদার কে চেনো না৷ তোমার এই জেদ টা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এবার প্রিহান হাওলাদার এর জেদ দেখার জন্য তৈরি হয়ে নাও।’
আলমারি খুলে একটা উড়না আনলো প্রিহান। মালা শুধু প্রিহানের চালচলন অবলোকন করলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিহান মালাকে চেপে ধরে চেয়ারে বসালো। উড়না দিয়ে পেটের উপর দিয়ে নিয়ে দু-হাত শক্ত করে বাঁধলো।
‘এটা কি হচ্ছে? আমাকে বাঁধলেন কেন? এখন কি আমাকে বেঁধে খাওয়াবেন নাকি?’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি যদি জেদি হও তবে আমিও কম কিসে।’
না চাইতেও মালা হেসে ফেলে। হেসে দুই ঠোঁট কামড়ে ধরলো৷ মালার হাসি দেখে প্রিহান আরও চটে গেলো। প্রিহান ভাত মাখিয়ে জোর পূর্বক মালাকে খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষ হতেই মালার হাতের বাঁধন খুলে দিলো প্রিহান। শোয়ার সময় হলে মালা বিছানায় না গিয়ে নিচে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। তা দেখে মাথায় আ’গু’ন জ্বলছে প্রিহানের।এটা কি নাটক সিনেমা নাকি যে রাগ করে নিচে শুয়ে পরছে। সেও চাদর বিছিয়ে, বালিশ নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো।মালা চোখ ছোট ছোট করে তাকালে প্রিহান বলে,
‘তুমি কি ভেবেছো রোয়াব দেখিয়ে তুমি একাই ফ্লোরে ঘুমাতে পারো আমি পারি না।’
মালা দু হাতে মুখ ঢেকে স্বশব্দে হেসে উঠলো।প্রিহান রাগে-জিদ্দে বালিশ ছুড়ে মারলো মালার দিকে।
#চলবে