#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৩
#রাউফুন
সেদিনের পর থেকে প্রায় রোজই পুতুল মাহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতো যাতে মাহিয়া আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে পারে। প্রশান্ত ভাবতো পুতুল তাকেই একবার দেখার জন্য তার বাড়িতে আসে। মনে মনে খুশি হলেও বাইরে তার ভাবটা ফুটিয়ে তুলতো না। এদিকে রোজ মন মরা পুতুল কে ফিরতে দেখেও কিছু ঠাহর করতে পারে না। কিছু একটা হয়েছে যার জন্য পুতুল তাকে সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে যেতে চাই। না চাইতেও সে পুতুলের উপর দুর্বল হয়ে পরেছে। সেখান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। যা কিছুই হোক সে আর কিছুতেই নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে চাই না। পুতুল তাকে এড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই বোধহয় তার অনুভুতি টা আরও বেশি প্রবল হয়েছে। সে ঠিক করলো আজ পুতুল আসলেই তার সঙ্গে কথা বলবে। প্রথমদিনের মতো সাইকেল করে ওঁকে পৌঁছে দেবে। কিন্তু বিঁধিবাম সে আজকে বাড়িতে আসেনি। পুতুল আসলো তার পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বিকেলে। পুতুল এসেই মাহিয়ার সঙ্গে দেখা করে চলে যায় বাইরে। মাহিয়ার এভাবে নিঃস্বঙ্গতা প্রশান্তও খেয়াল করছে ইদানীং। তবে নিজের বোন বলেই বোধহয় এতোটা সংকোচ করছে কিছু জিজ্ঞেস করতে। সে জোর ও করেনি। পুতুল মাহিয়ার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাচ্ছিলো তখনই প্রশান্ত সাইকেল নিয়ে বের হলো।
‘পুতুল, এই পুতুল দাঁড়াও!’
পুতুল দাঁড়িয়ে পরলো। সে সাইকেল ঠেলে ওর সামনে গেলো। নিশ্চুপ পুতুল একবার প্রশান্তর দিকে তাকালো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে চাইলো। প্রশান্তও কম নয় সে আজকে জেনেই ছাড়বে পুতুলের কি হয়েছে।
‘আমি তোমার স্যার পুতুল। আমি তোমাকে দাঁড়াতে বলছি। স্যারের কথা অমান্য করার মতো অভদ্র নিশ্চয়ই তুমি নও?’
দ্রুত চলতি পা থেমে গেলো প্রশান্তর কথা শুনে।
প্রশান্ত ওঁকে আপাদমস্তক পরখ করে বলে,
‘কি হয়েছে তোমার? তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলছো কেন?’
‘কই!’
‘কই? তুমি নিজেই বলো তো বিগত তিন-চারদিন আমার সঙ্গে কতটা কথা বলেছো? পড়াতে যাচ্ছি সেখানেও চুপচাপ পড়ছো, এক্সট্রা কোনো কথা বলছো না। কেন এরকম করছো?’
‘এমনিতেই স্যার। আমি আসছি দেরি হচ্ছে আমার।’
‘এই আমি কি তোমাকে যেতে বলেছি? আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করো না।’
‘আপনাকে আমি কোথায় এড়িয়ে যাচ্ছি স্যার?’
‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো। তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?’
সারা শরীর কেঁপে উঠলো পুতুলের। মুহুর্তের মধ্যে মাহিয়ার সঙ্গে হওয়া ঘটনা টা তার মস্তিষ্কে জানান দিলো একটা পুরুষ কখনোই ভালো হতে পারে না। সবকিছুই ছলনা। প্রথমে সবাই সাধু প্রমাণ করতে চাইবে নিজেকে। কিন্তু একা পেয়েই নির্মম ভাবে ধ’র্ষ’ণ করবে। এরকম কিছুর স্বীকার হতে সে কিছুতেই চাই না। তাই যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে প্রশান্তর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যখন সে নিজেকে অদূরে নিয়ে যেতে চাইছে তখনই কিনা লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করছে তাকে সে ভালোবাসে কি না? চোখ ছলছল করে উঠতেই মাথা নত করে নিলো পুতুল। তার ভীষণ কষ্ট হয়েছে এই কদিন প্রশান্তর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে। মুহুর্তেই কি হলো হঠাৎই সে ডুকরে কেঁদে উঠে। প্রশান্ত বিচলিত হয়ে গেলো।
‘আরে আরে এই মেয়ে কাঁদো কেন? আমি তো তোমাকে বকিনি? দেখো তুমি নিজেই আমার সঙ্গে কথা বলো নি। আর এখন নিজেই কেমন কষ্ট পাচ্ছো। আমি কি কিছু করেছি বলো?’
কিছু বলতে পারলো না। প্রশান্ত ওর চোখের পানি মুছে দিতে গেলে দু কদম পিছনে পিছিয়ে গেলো পুতুল।
‘আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি চলো। এর প্রেক্ষিতে আর কোনো বারণ শুনতে চাই না। উঠো সাইকেলে।’
চুপটি করে সাইকেলে উঠে বসে পুতুল। সাইকেলের হাতলি শক্ত হাতে ধরলো পুতুল। আশ্চর্যজনক ভাবে আজও পুতুল অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। সেদিনের অনুভুতি ছিলো সুন্দর আর আজকের একই মানুষের সাইকেলে উঠে অনুভুতি টা ভোতা মনে হচ্ছে। প্রশান্ত প্যাডেল ঘুরিয়ে সাইকেল চালানোতে মন দিলো। সে চাইলো না এই মুহুর্তে তার ডলকে ঘাটাতে। আচ্ছা পুতুল কি কখনোই জানতে পারবে প্রশান্ত তাকে মনে মনে ডল ডাকে? তার নামটাকে ইংরেজি অভিধানে ভালোবেসে ডাকে? প্রশান্ত ভেবেছিলো আজও হইতো পুতুল তার কোমড় চেপে ধরবে। কিন্তু নাহ সে এমন কিছুই করেনি। বরং নিরবতা পালন করেছে পুরো রাস্তায়। প্রশান্ত নীরবতা ভেঙে শান্ত ভাবে বললো,
‘দেখো পুতুল, আমি তোমাকে নিয়ে এগিয়ে গেছি অনেকটা। সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তোমার কি হয়েছে আমি জানি না কিন্তু এখন আমি তোমাকে ছাড়া ভাবতেও পারিনা। তোমার ভাবনা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না, তোমার অভিমান, তোমার কান্না, তোমার বিরাগ, তোমার বেবি চুলগুলো কপাল গাল বেয়ে লেপ্টে থাকা, সবকিছু আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে তোমার সঙ্গে। আমি চাইলেও তোমার হাসি হাসি মুখটা ভুলে থাকতে পারি না। এটা আমার কি হলো বলোতো? এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না।’
‘আচ্ছা কতটা এগিয়ে গেছেন?’ বিমুঢ় হয়ে শুধালো পুতুল।
‘যতটা এগিয়ে গেলে আর ফিরে আসা যায় না পুতুল ততটাই।’
‘তাই? ততটাই এগিয়ে গেছেন যতটা এগিয়ে গেলে আমাকে বা’জে স্পর্শ করা যায়?’
বাড়ির সামনে আসতেই পুতুল নেমে দৌঁড়ে চলে যায়। প্রশান্ত হতবিহ্বল, হহতচকিত হয়ে পুতুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো! পুতুলের কেন মনে হচ্ছে যে তাকে সে বাজে ভাবে ছুঁতে চাই? আর সে এজন্য এই সম্পর্কে টা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে তো এমন কোনো ব্যবহার করেনি পুতুলের সঙ্গে! তবে হঠাৎ এধরণের আচরণের মানে কি? কোনো কারণে কি মেয়েটা ভেতর থেকে ভেঙে গেছে? সে বাড়ি গিয়ে মাহিয়াকে জিজ্ঞেস করলো পুতুলের কি হয়েছে কিন্তু মাহিয়া একদম নিশ্চুপ ছিলো।
•
‘আমি তাই ভাবছিলাম, বাইরে কেনো কোনো একজনও নেই। আপনারা সবাই খাচ্ছিলেন। আন্ট কি কোনো ভুল সময় এসে পরলো?’
কথাটা শুনতেই মালা দেখতে পেলো একজন দাম্ভিক মহিলা কথাটি বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করছেন। তিনি ভুল সময় আসার কথা বললেও তার মুখে বিব্রতবোধ এর কোনো চিহ্ন নেই। সবার দিকে ঘুরে ঘুরে দৃষ্টি পাত করছেন তিনি। তিনি যখন প্রিহানের দিকে তাকালেন, তার মধ্যে কেমন একটা ভীতি ভাব দেখা গেলো। মালা বুঝতে পারলো না তিনি প্রিহানকে দেখা মাত্রই এমন অবিচলিত, ওমন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন কেন? যেখানে তার মার্জিত, গম্ভীর কণ্ঠে মালার সমস্ত শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছিলো। তিনি তার মুখে একটা অহংকারী এক্সপ্রেশন নিয়ে আরও এগিয়ে এলেন। এবং তার তীব্র দৃষ্টি প্রিহানের দিক থেকে সরিয়ে নিলেন। হেঁটে খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।
কি ব্যাপার?’ কোনো রকম প্রচলিত কথা জিজ্ঞেস না করেই প্রিহান এই প্রশ্নটা করলো। মহিলাটি তার ফুপু শোহিনী। কোনো একটা কারণে সে তার ফুপুকে দেখতে পারে না। সবাই খাওয়া ছেড়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে,
‘কি ব্যাপার শোহিনী, হঠাৎ তুমি?’
‘ বাবা, আমি আপনার মেয়ে। আমি কি এখানে আসবো না? তাছাড়া জাকিয়া এখানে এসেছে প্রায় চার দিন হয়ে গেছে। ও বাড়ি যেতে চাইছে না ভাবলাম আমিই চলে আসি এখানে। আর শুনলাম আমাদের ঔশীর উপর দু দু-বার অ্যাটাক করেছে কেউ! তাই ভাবলাম ওঁকেও দেখে যায়।’
‘বাহ্ আন্ট যখন ওর উপর হা’ম’লা হয়েছিলো তখন তো আসেন নি? এতো দিন পর মনে হলো ঔশীকে আপনার দেখা উচিত!’
‘দেখো প্রিহান ভদ্রভাবে তো কথা বলতেই পারো! ভুলে যেও না আমি তোমার ফুপু হয়!’
‘আমি কিছুই ভুলিনি আন্ট। আপনি বোধহয় অনেক কিছু ভুলে যান।’ বলেই টেবিল ছেড়ে উঠতে চেয়েও পারলো না প্রিহান। তার হাত ধরে আছে মালা। তাই সে উঠতে পারলো না।
‘আচ্ছা আসো। এসেই যখন পরেছো ব্রেকফাস্ট করো আমাদের সঙ্গে।’ বললেন কুলসুম। রহমান সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ আসো খেয়ে নাও। তাছাড়া তুমি কি সত্যিই চিন্তিত ছিলে ঔশীকে নিয়ে! যদি থাকতে যখন আমার পাঁপাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটি হসপিটালে এডমিট ছিলো তখনই এসে দেখে যেতে।’
‘দেখুন বাবা আমি ঔশীকে নিয়ে সত্যিই চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু জাকিয়া আমাকে বলে যে ঔশী এখন ভালো আছে তাই আসিনি!’
‘হাহ্! কাউকে দেখতে আসার জন্য মনের ইচ্ছে টা থাকতে হয়। আর তার প্রতি মায়াটা থাকাও জরুরি যেটা তোমার মধ্যে নেই।’
বাবার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলতে চেয়েও বললো না শোহিনি। খোদেজা গিয়ে সমাদর করে শোহিনী কে টেনে চেয়ারে বসালো। শোহিনী বরাবরই খোদেজা কে দেখতে পারেননি। কারণ তার ভাই সে-সময় ওতো সুন্দর একজন মানুষ ছিলেন, তার ভাই কি করে খোদেজার মতো একজন বোবা মেয়েকে বিয়ে করছেন? কথা বলতে না পারা নিয়ে তিনি কম কটাক্ষ করেন নি নিজের ভাইয়ের বউকে। তবুও এখানে আসলে খোদেজা ছাড়া আর কারোর কাছেই পাত্তা পান না তিনি। অথচ তার বিয়ের পর থেকে কত নির্যাতন করেছেন খোদেজার উপর। তার নিজের বাবা-মা ই তো ঠিক করে কথা বলেন না তার সাথে। সেখানে খোদেজা সব কিছু ভুলে কতটা ভালো ব্যবহার করে। তিনি আড়ালে তপ্ত একটা শ্বাস ফেললেন।
‘মা আমি তোমাকে বলেছিলাম যে ঔশী ভালো আছে। তবুও তুমি এখানে কেন আসলে?’
কথাটা বলতে বলতেই জাকিয়া তার মায়ের দিকে এগিয়ে এলো। জাকিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিলো তার মায়ের এখানে আসাটা তার একদমই পছন্দ হয়নি।
তার মাকে তার ভরসা নেই। দেখা গেলো আজকেই এখান থেকে তাকে নিয়ে চলে যেতে চাইবে। কিন্তু সে তো যাবে না। এখানেই যে তাকে থাকতে চাই। না হলে খুব বড় কিছুর সম্মুখীন তার খুব প্রিয় একজন কে হতে হবে। সে থাকতে এটা কিছুতেই হতে দেবে না।
‘জাকিয়া, আমি এখানে এসেছি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে! আর তুমি আমার সঙ্গে ফিরছো!’
‘হ্যাঁ ফুপি জাকিয়া আপুকে নিয়ে যাবেন তো। আমার আবার উনার কিছু কিছু বিষয়ে এলার্জি।’
‘তুমিহ? তুমিই কি আমার একমাত্র ভাইপোর বউ? শুনেছি তুমি অত্যন্ত অভদ্র একটা মেয়ে! কোনো ম্যানার্স নেই কিভাবে কথা বলতে জানো না? রিসেপশনের দিন তুমি নাকি আমার মেয়েক ঝা’ড়ু পে’টা করেছো?’
‘ফুপি, আপনি প্রথম দিন আমাকে দেখলেন, কারোর সম্বন্ধে না জেনে শুনে তাকে নিয়ে এসব কথা বলাটা কি ঠিক?’
‘আমার জানা হয়ে গেছে তোমার সম্বন্ধে। জাকিয়া সেদিনের অপমানের পর তোমার এখানে থাকাটা কিন্তু মানায় না। আমি তোমাকে কিছুতেই এখানে থাকতে দেবো না।’
‘নো মম! আমি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না!’
#চলবে
#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৪ (বোনাস পার্ট)
#রাউফুন
প্রিহান ছোট থেকে ষোল বছর তার দাদা দাদির কাছেই মানুষ হয়েছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো প্রিহানের দাদা রহমান হাওলাদারের একজন অবৈধ সন্তান একবার হাজির হয় তাদের মধ্যে। সে-সময় রহমান সাহেব মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরেন৷ আর সেই সন্তানকে তিনি স্বীকৃতি দেন। সেই সন্তান হলো তার ছোট কাকা মাঝহারুল হাওলাদার। তিনি পৈতৃক অধিকার এর জন্য লড়েছেন। আর তার মা ছিলেন কোনো একজন জমিদারের কন্যা। মাঝহারুল হাওলাদার এর নানার ধনসম্পদ ছিলো অনেক। নানার বংশের কোনো পুত্র সন্তান না থাকাই সে অনুযায়ী অনেক ধন সম্পদ প্রিহানের সেই ছোট চাচা পান। কারণ তিনিই ছিলেন এক মাত্র উত্তরাধিকার। সে-সময় শুধু মাত্র পিতার পরিচয় নিয়ে মাঝহারুল হাওলাদার পাড়ি জমান বিদেশের বুকে।
প্রিহান শুনেছে তার ছোট চাচা এখন বাংলাদেশেরই কোনো এক স্থানে নিজের বসতিস্থল করেছেন। পরে জানা যায় তার দাদা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন কাউকে না জানিয়েই। স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ কতটা অবলীলায় মেনে নিয়েছিলেন তার দাদী কুলসুম। প্রিহানের ছোট দাদি মা’রা যান কলেরায়। তিনি মা’রা গেলে তার দাদিই নিজে পাঠান রহমান হাওলাদারকে। এমন কি নিজেও যান তার ছোট সতীন কে শেষ দেখা দেখতে। তখনই সামনে আসে তার ছোট দাদির ছেলে মাঝহারুল হাওলাদার। এরপর প্রিহানের বাবা নিজের পিতার দ্বিতীয় বিবাহের কথা জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন। না মানতে পেরে নিজের স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকতে চান। কিন্তু প্রিহান ছিলো তার দাদা দাদি অন্তপ্রাণ। তাই সে ষোল বছর পর্যন্ত দাদা দাদির কাছেই মানুষ হয়। এরপরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়। সে ষোল বছরে জানতেও পারেনি তার ছোট একটা বোন ছিলো। আর তারপর যখন জানতে পারে প্রিহান তার ছোট বোন আছে তখন সে বায়না করে তারা এক সাথে থাকবে। ছোট্ট প্রিহানের কথা ফেলতে না পেরে তারা এক সাথে থাকতে শুরু করে সব মান অভিমান ভুলে। সব ঠিক ঠাক চলে নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু, প্রিহান যখন সবে সবে এলএলবি পাশ করে তখনই জানতে পারে এক অগাধ সত্য। তার বোনের বিষয়ে। তার বোন শেবা, শেবা হাওলাদার। যে কি না এক চরম অন্যায়ে জড়িত হয় আর জীবনের প্রথম কেস টা সে নিজের বোনের বিরুদ্ধে লড়েছিলো।
‘প্রিয়? শুনছেন? কি ভাবছেন?’
‘হ্যাঁ,হ্যাঁ বলো শুনছি।’ হঠাৎ মালার আগমনে প্রিহানের ধ্যান ভাঙে। হালকা ধাক্কা দিতে সে অতীত থেকে ছিটকে পরে।
‘কখন থেকে ডাকছি। কোথায় হারিয়ে গেছিলেন!’
‘কিছু না বলো না। শুনছি আমি।’
‘আচ্ছা। আমার কিছু প্রয়োজনীয় কাজ ছিলো। আমি বাইরে যাচ্ছি। এখন বিকেল পাঁচটা বাজে৷ আমি রাত দশটাই ফিরবো।’
‘এতো রাত কেন হবে?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো প্রিহান।
‘সেজন্যই তো বলে যাচ্ছি প্রিয়। আমাকে প্লিজ একটু পিক করে নিয়েন রেস্টুরেন্ট থেকে।’
‘আচ্ছা মাই ড্রাগনফ্লাই’স। যাওয়ার আগে আমাকে কি কিছু মিছু দেওয়া যাবে?’
‘কিছু মিছু আবার কি?’
‘একটা, একটা, একটা কিছু দাও না!’
‘একটা কি শুনি? বাচ্চাদের মতো এমন ঠোঁট ফুলাবেন না তো। আমার অস্বস্তি হয়।’
‘কেন নেশা লাগে? তাইলে একটা চু’মু দাও না।’ প্রিহান ঠোঁট ফুলিয়ে এগিয়ে দিয়ে বললো।
‘আপনি না দিন দিন চরম লেভেলের বেহায়া হচ্ছেন। এখন দিনের বেলা, এখন ওসব হবে না।’
‘দাও না প্লিজ!’ প্রিহান মালার কাছে গিয়ে তার কোমড় চেপে ধরে কাছে আনলো।
‘আরে কি করছেন ছাড়ুন।’
‘আমারে ভালোবাসো না বুঝেছি।’ গাল ফুলিয়ে বললো প্রিহান।
‘আহারে আমার প্রিয় টা। আসছি খালি ঢং।’
‘দিলোই না। চলে গেলো। কি আর করার। বউয়ের চুমু আর জুটলো না কপালে।’ বিরবির করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো প্রিহান।
•
‘হ্যালো?’
‘এখন কেন ফোন করেছেন?’
‘তুমি টাকাটা ফেরত দিয়েছো?’
‘হ্যাঁ! আমি ওটা আপনার থেকে লোন হিসেবে নিয়েছিলাম। এখন টাকা হয়েছে তাই ফিরিয়ে দিলাম।’
‘তুমি যে আমার কন্যা সেটা তুমি স্বীকার করো আর না করো আমি করি। তুমি আমার একমাত্র কন্যা এটা তো তুমি অস্বীকার করতে পারো না। এটা তোমার মেনে নিতেই হবে।’
‘কিভাবে মানবো আমি? আমি কি বলবো যে মিসেস রাশেদা আমার স্যারোগেটস মাদার। টাকার প্রয়োজনে আমার মা স্যারোগেসির মাধ্যমে আপনার সন্তানের মা হয়েছিলো বিদেশে পড়াশোনা করা কালীন? এরপর সেই মহিলাকে তার বাবা-মা দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ায় আপনি সদয় হয়ে আমার মাকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু আমার দায়ভার নেননি। বাংলাদেশ আসার পর ভুলেই গেছিলেন, আপনি আমার মাকে বিবাহ করেছিলেন। ভুলবেন না কেন? আমার মাকে গ্রহণ করলে তো আপনার সংসার ভাঙবে।’
‘দেখো মালা, আমি তোমার মাকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তুমি যা জানো তার সবটাই সত্যি নয়৷ আমি তোমাকেও নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মা জোর করে তোমাকে আমার থেকে দূরে নিয়ে চলে এসেছে। তা না হলে তুমিই বলো, যেখানে আমার ওয়াইফ লিলি মা হতে পারবে না এটা ভেবেই স্যারোগেসির মাধ্যমে বাচ্চা নিতে চেয়েছিলাম সেখানে তোমাকে আমার থেকে কেন আলাদা করে দায় ভাড় মুক্ত হতে চাইবো? আসলে তোমার মা আমার স্ত্রী হওয়ার লিলি কে আর মানতে পারেনি। বিদেশী নারীরা স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মানতে পারলেও বাঙালি নারীরা পারে না৷ তাই তোমার মা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমাকে আমার থেকে আলাদা করে শাস্তি দিতে চাইছিলো। পরবর্তীতে আমি তোমাকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারো।’
‘বিদেশি কালচার, বিদেশি নারীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিলেন আপনি। একাধিক নারীতে মত্য ছিলেন তাই মা মানতে পারেননি। আর কেন গ্রহণ করবেন আমাকে? আপনার যদি বাচ্চার প্রয়োজন ই ছিলো তবে প্রথমেই আপনি আমার মাকে বিয়ে করে নিতেন। পরে কেন করলেন? আপনি মুসলিম হয়ে এই গুনাহ্ কেন করলেন? পবিত্র সম্পর্কের মাধ্যমেও তো বাচ্চার বাবা হতে পারতেন।
‘দেখো মা, আমি তোমার মা লিলিকে ভীষণ ভালোবাসতাম তাই দ্বিতীয় বিবাহ করতে চাইনি।’
‘স্যরি? উনি আমার মা নন।’
‘এতো দিন তুমি আমার কাছে থাকলে উনাকেই তুমি মা জানতে মালা।’
‘যায় হোক। আপনার টাকাটা আমি আপনাকে ফেরত দিলাম। আর আমার আরও কিছু বিশ্বস্ত গার্ড প্রয়োজন। যদি পারেন ব্যবস্থা করে দিবেন।’
‘এটা কোনো ব্যাপার না মাই ডটার। তবে তুমি তোমার অধিকারের টাকা ফেরত দিয়ে ঠিক করো নি। তুমি আমার কন্যা। আমার সকল সম্পত্তির মালিকানা এক মাত্র তোমার। আর তুমি টাকার অভাববোধ করছিলে বলেই তো নিয়েছিলে। আর এখন সেটা ফিরিয়ে কেন দিচ্ছো এটা বুঝতে পারছি না?’
‘হাসালেন। কন্যা কন্যা করে উদ্ধার করলেন একেবারে। অথচ কত যন্ত্রণাময় জীবন আমি পেয়েছি আপনার জন্য। আমি টে’স্ট টি’উ’ব বে’বি বলেই আমাকে পেটে ধরা মায়ের রোষপুর্ণ দৃষ্টি, মায়ের মা’র, মায়ের কতই না কটাক্ষ, কতই না চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয়েছে!’
‘প্লিজ এভাবে বলো না। তোমাকে লিলি একবার দেখতে চেয়েছে একবার ওঁকে ফেস করবে? তুমি হইতো জানো না এখন লিলির ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ চলছে। ওর শেষ একটা ইচ্ছে আমি পূরন করতে চাই প্লিজ মাই ডটার। আই বেগ ইউ প্লিজ কাম!’
মালা ফোন কে’টে দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কেন এমন বিদঘুটে জীবন সে পেলো। কেন? কেন? কেন? তার বিকট চিৎকারে তার সঙ্গে থাকা বডিগার্ড দুজন দৌঁড়ে এলো।
‘মেম কি হয়েছে?’
‘কিছু না!’ শান্ত হয়ে জবাব দিলো মালা।
‘মেম ওঁদের সবাইকে ট্র্যাস করা গেছে। আমরা ওঁকে আমাদের গোডাউনে বেঁধে রেখেছি। তবে ওঁদের মেইন লিড কে ধরতে পারিনি।’
‘এখানে কত জন আছে?’
‘মেম মোট চোদ্দ জন।’
‘আচ্ছা গুড। এখন মেইন জনকে ধরে কাল কোর্টে হাজির করতে হবে। পারবে?’
‘জানি না মেম। তবে–!’
‘তবে কি?’
‘আপনি যে ভয়েস রেকর্ডটা পাঠিয়েছিলেন ওটা কোনো ফিমেলের ভয়েস ছিলো। অনেক আগের বাটন ফোনের সাহায্যে ম্যাজিক ভয়েস অপশন অন করে ম্যাল ভয়েসে কথা বলেছে। বুঝতে পারছেন ঠিক কতটা চালাক-চতুর ব্যাক্তি!’
সবটা শুনে বাকা হাসে মালা। যত চালাক হোক না কেন মালা তাকে খুঁজে বের করবেই।ঠিক বের করবে মালা তাকে। সে কিছুতেই তার প্রিয়কে কেস হারতে দিতে পারবে না।কিছুতেই না।
#চলবে