প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-২৯+৩০

0
285

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২৯
#রাউফুন

সাদা রঙের ওয়াল পেইন্ট সেখানে সোনালি কারুকাজের বাহার। প্রিহান তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মালার দিকে। কিছুক্ষণ আগে প্রিহান মালাকে বাথরুম থেকে বের কোলে করে ঘরে এনেছে। এতো রাতে বাড়ির কাউকেই বিরক্ত করতে চাইনি প্রিহান৷ তাই কাউকেই ডাকেনি। মালা জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পরার ফলে মাথার ডান পাশে কে’টে গেছে। প্রিহান মালার ভিজে যাওয়া কাপড় বদলে দিয়ে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিয়েছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। ভালো ভাবে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়েও দিয়েছে যাতে ঠান্ডাটা কম লাগে। এরপর আধ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরেছে মালার। আরেকটু দেরি হলেই সে ডক্টর কে কল করতো। তবে তার মনে হয়েছে কা’টা যেহেতু গভীর নয় সেহেতু এতো রাতে কোনো ডক্টর কে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তাই সে নিজেই ড্রেসিং করিয়ে ব্যান্ডেজ করে অপেক্ষা করছিলো মালার জ্ঞান ফেরার। যখন তার জ্ঞান ফিরেছে তখনই সে মালার কাছ থেকে উঠে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে পরে। রাগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে সে। কেন এতো রাতে এতো ঠান্ডার মধ্যে ভিজলো তাও এতক্ষণ যাবৎ? কথা নাই বার্তা নাই এভাবে এরকম ননসেন্সের মতো কাজ কি করে করতে পারে সে? ভেবেছে টা কি যা খুশি করা যাবে এখানে? এরপর মালার গোঙানির আওয়াজে ঘুরে দাঁড়ালো প্রিহান।

প্রিহানের বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি তোলপাড় করে দিয়েছে মালার হৃদয়। ঠোঁট চেপে ঘোর গ্রস্থ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে প্রিহানের দিকে। রাগে, উত্তেজনায় জর্জরিত লাগছে মানুষটাকে। হঠাৎ ব্যাগ্র হয়ে ঝুঁকে এলো প্রিহান মালার দিকে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস মালার মুখশ্রীতে পড়ায় সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিহরণ। লোকটার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণ যেন বাইরের কুয়াশায় আচ্ছন্নতার ঘ্রাণ থেকেও সুন্দর, তার একান্ত নিজের। এটাতে সে বার বার ঘায়েল হয়েছে। তাই এই মুহুর্তেও সে নাক টেনে সেই ঘ্রাণ নিয়ে বিমোহিত হলো।

‘এই ষ্টুপিড গার্ল আমার শরীরের ঘ্রাণ কেন নিচ্ছো? খবর দার শরীরের ঘ্রাণ নিবা না।’

অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে পরলো মালা। চোখ তুলে তাকালো সে তার অনুরাগী সঙ্গীর দিকে। সে ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো প্রিহান ভীষণ রেগে আছে তার উপর। সে তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বললো,

‘আমি, আমি, আসলে মাথাটা কেমন ঘুরছিলো তাই মাথায় পানি দিতে গেছিলাম। ভালো লাগছিলো বলে একটু সময় নিয়ে মাথা ভেজাচ্ছিলাম এরপর কখন পরে গেছি টেরই পাইনি।’ প্রিহান তখনও নিরুত্তর। রাগ টা যেনো আআকাশচুম্বী কমতেই চাইছে না। মালার এরকম বোকার মতো কান্ডে তার মস্তিষ্ক ঠিক থাকবে?

‘আপনি ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি ইচ্ছে ক-করে করেছি নাকি এমন টা।’

‘এমনি এমনি করছিলে? আমার ঘুম যে ভারী তা জানো না? সেই মুহুর্তে তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। আমি যদি না উঠতাম তবে তুমি সারারাত ওখানেই পরে থাকতে ডেম ইট!’

অত্যন্ত জোড়ালো আর চেঁচিয়ে উঠলো সে মালার উপর। রাগে থরথর করে কাঁপছে প্রিহান। গলায়, কপালের রগ গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মালা ঘাবড়ে গিয়ে বেড সিটের সঙ্গে শিটিয়ে গেলো।

‘এখন ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি কি ভেবেছো এখন তোমার ঠান্ডা শরীর উষ্ণ করতে এই প্রিহান তোমার সাধ দেবে? নেভার এভার,এভার, এভার, এভার!’

মালা কদাচিৎ কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো প্রিহানের দিকে। তার রাগের জন্য এই কনকনে শীতে এখন গরম লাগছে কেমন যেন। লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এমন বেলাজ কথা শুনলে শুধু তার না অন্য একজন স্বাভাবিক মানুষেরও হয়তো একই অবস্থা হতো। দিন যতই যাচ্ছে ততই সে অবাক হচ্ছে লোকটার কথাবার্তা শুনে। একই সাথে তাকে নিয়ে ওয়ারিড আর অন্য দিকে রেগেমেগে মাঝখানে কি কথা বলে বসে থাকলো।

‘আ-আমার আপ আপনার উষ্ণতা লাগবে না।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ তা কেন লাগবে? মাথা কে’টে বসে আছো! থরথর করে কাঁপছো কম্বল মুড়ি দিয়েও। তাও বলছো লাগবে না। অদ্ভুত নারী জাতী তোমরা! ভাঙবে তবু মচকাবে না।’

বলেই প্রিহান কোম্বলের নিচে ঢুকে মালার ঠান্ডা শরীর নিজের বুকে চেপে ধরলো। বাহুবন্ধন দৃঢ় করে বলে,

‘একদম নরবা না। নড়লে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দেবো।না হলে ঠান্ডা পানির বাথরবে ফেলে আসবো! আমারই আসলে ভুল। এই মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি এখন আর কথায় শুনে না।’

এই কথা শুনে ঠোঁট এলিয়ে হেসে উঠলো মালা। প্রিহানের বুকে মালার ঠোঁট চেপে রাখা ছিলো বিধায় সে তা টের পেলো। সেও হাসলো এতে। কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘হয়েছে, হয়েছে, আমি কি হাসার কথা বলছি যে হাসছো?’

‘আপনি বুঝলেন কিভাবে আমি হাসছি!’

‘বুকে মুখ গুজে রাখা তাই! এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই হুহ্। আমি এখনো দ্বিগুণ রেগে আছি। নেহাৎ এখন আমার ড্রাগনফ্লাই’স এর শরীর ঠান্ডা না হলে কাছে আসা তো দূর কথায় বলতাম না।’

‘আচ্ছা।’ বলেই ঠোঁট চেপে ধরলো মালা। কি মুশকিল এই মানুষ টার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কেমন অদ্ভুত। সবকিছু আলাদা আলাদা। শুরু থেকে এখনো অব্দি সবকিছুই ছিলো ভিন্ন। আর সে? সে তো আরও কয়েক বছর আগেই মানুষটা কে মন দিয়ে বসেছিলো সেই ভার্সিটি লাইফে। শুধু মাঝখানে কিছু মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই পুরুষ মানুষকে দেখলে রাগ তরতর করে বেড়ে যেতো তার। তবে সেই ধারণা বদলে গেছে মালার প্রিহানকে কাছ থেকে দেখার পর।

সকালে প্রিহান কড়া হুকুম জারি করে গেছে যাতে মালা বাড়ি থেকে বেরোতে না পারে। ময়না, তার মা, দাদি, দাদা, তার বাবা সকল কে নজর রাখতে বলেছে। কাল রাতের কথা শোনার পর থেকে তার একটু পর পর ই এসে চেকিং করে যাচ্ছে। কি সাংঘাতিক তারা কেউ-ই জানেন-ই না বাড়িতে এতো বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। খোদেজা নিরবে কয়েক দফায় বকেছেন ছেলেকে। কেন তাদেরকে জানানো হলো না। তাদের কি জানা উচিত ছিলো না। মালা কি তাদের কেউ-ই না। এটুকু জানার অধিকার তো তারা রাখেন। মালা সবাইকে তাকে নিয়ে এতোটা অনুচিন্তন দেখে ভীষণ খুশি হয় মনে মনে। এমন একটা পরিবার কোথায় পাওয়া যায়? কতটা নিদারুণ ভাবে তাকে মেনে নিয়েছে যেখানে এই বাড়ির সু-পাত্রের জন্য দ্বিতীয় পাত্রী সে! অন্যান্য ফ্যামিলি তে কত রকমের কটাক্ষ শুনতে হতো যদি এমন ঘটনা ঘটতো। মেয়ে দ্বিতীয় পাত্রী আর ছেলে ফুল পাত্র। একই পৃথিবীতে কত রকমের বিরল প্রজাতির মানুষ বাস করে তাই না? এই পুরো পরিবার এতো কিছু তাকে দেবে সে ভাবতেই পারেনি।

কিন্তু আজকে তো তাকে বেরোতেই হবে এই পুরো পরিবারের কথা অমান্য করে। তাদেরকে আড়াল করেই বেরিয়ে যেতে হবে। যেভাবেই হোক। মালা সবাইকে ঘুমানোর কথা বলে। তার বিশ্রামের প্রয়োজন ভেবেই সকলেই বাইরে চলে যান। মালা আস্তে আস্তে উঠে দু তিনটা শাড়ি ইউস করে নিচে নামে। পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে জলদি একটা শপিংমল গেলো। তার হাতে বেশি সময় নেই।


‘প্রেমেতেই মত্ত এ জগত সংসার!
বস্তুত সবটাই মোহ!
উন্মাদনা!’

এই উন্মাদনায় আগুন রয়েছে এটা প্রশান্ত জানে। এটা কভু নিভবে না। পুতুল মুগ্ধ হয়ে তাকায় প্রশান্তর দিকে। আজ প্রশান্ত ভীষণ খুশি। পুতুল তার কথা রেখেছে। পুতুল আসার পর সে তার সামনে খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়েছে। প্রেম এমন এক জিনিস মানুষের অজান্তেই তা মানুষের মনের অন্তরালে গভীরভাবে চলে আসে।

‘আই মিস ইউ মাই ডল!’ স্বলজ্জে হাসলো পুতুল।

‘তুমি মিস করোনি?’

‘হ-হ্যাঁ করেছি তো!’

‘আচ্ছা কতটা?’

‘এত্তো গুলো!’

‘কত্তো গুলো!’

‘ধুর জানি না।’ বলেই খিলখিল করে হাসলো পুতুল। প্রশান্ত ও হাসি দেখে বুকের বা পাশে হাত রেখে আওড়ালো,

‘তোমার হাসি আর স্পর্শের অনুভূতি কিভাবে বর্ণনা দেবো আমি?’

‘পুতুল তোর হলো?স্কুলের দেরি হচ্ছে তো!’

‘হাহ্ হ-হয়েছে। আসছি দাঁড়া।এইযে আমি আসি মাহিয়া ডাকছে।’

‘আচ্ছা যাও।তবে আসার সময় কিন্তু আসবে না হলে আমি খাবো!’

‘খালি ইমোশনাল ব্ল্যা’ক’মেইল তাই না? আচ্ছা আমি আসবো।’ প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে এক ফালি হেসে উঠলো পুতুল। প্রশান্ত পুতুলের মিষ্টি হাসি খানা দেখে ‘হায়ে!’বলেই আবার তার বাম বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পরলো।

#চলবে

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব৩০
#রাউফুন

কোর্ট থেকে বিষন্ন মুখে বাড়ি ফিরলো প্রিহান। খোদেজা নিজের ছেলেকে দেখতেই কিছু একটা আন্দাজ করেছেন। তিনি এগিয়ে এসে ইশারায় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোকে এমন লাগছে কেন বাবা?’

‘কিছু না আম্মু। আমাকে একটু স্পেস দাও। খুব ক্লান্ত লাগছে। এক কাপ কড়া কফি পাঠিয়ে দিও ময়নাকে দিয়ে।’

ঘরে যেতে গিয়েও ফিরে এলো সে। খোদেজাকে শান্ত ভাবে শুধালো,

‘আম্মু মালা কি আজকে বেরিয়েছিলো?’

খোদেজা মাথা নেড়ে বুঝালেন, ”নাহ বেরোই নি সে।”

প্রিহান আর কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। খোদেজাও ছেলের মনোভাব বুঝে চলে গেলেন রান্না ঘরে। প্রিহান ঘরে গিয়েই দেখলো মালা শুয়ে আছে। কেমন অদ্ভুত লাগলো তার কাছে মালাকে। তবুও সে কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

মালা ইচ্ছে করে বন্ধ করে রাখা চোখ খুলে পেছন থেকে দেখলো প্রিহানকে। মানুষটার তো আজকে খুশির দিন তবে এমন চুপচাপ কেন? সে কি কিছু বুঝতে পারলো? বেশ বিচলিত হয়ে গেলো মালা। প্রিহান মোটেও নরমাল ছিলো না। আধ ঘন্টা পর প্রিহান বের হলো সে। বেশ সময় নিয়েই শাওয়ার নিয়েছে সে। কিছুতেই মন থেকে আজকের ঘটনাকে বের করতে পারছিলো না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখলো ময়না কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কফি নিতেই ময়না চলে যায়।

কফি নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো প্রিহান৷ ভেজা টাওয়াল নেড়ে রুমে আসলো। মালা আস্তে আস্তে উঠে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসলো৷ এরপর সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলো,

‘আচ্ছা আপনাকে এমন কেন লাগছে? কি হয়েছে আপনার?’

‘কিছু না! আচ্ছা তুমি আজকে কোথাও গেছিলে?’

‘ন-না! কোথায় যাবো? আমার প্রিয় আমাকে বেরোতে না করেছে আমি কি করে বের হয় বলুন তো?’

‘হ্যা তাই তো। বের হবে কেন! তাই তো! তবে আমি কি ভুল ভাবলাম?’

‘কি তাই তো, তাই তো করছেন? আজকের কেসটার কি হলো?’

‘কেন তুমি জানো না কি হয়েছে?’

‘ উঁহু! কেন কি হয়েছে?’

‘আমি জীবনে প্রথম বার হেরেছি কেস টা!’

‘কিন্তু আপনার তো জেতার কথা কেসটা। তবে আমাকে মিথ্যা কেন বলছেন?’

‘কি বললে?’

ততক্ষনে মালার মুখে হাত চলে গেছে। উত্তেজনায় একটা ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। ইশ! ঘাবড়ানো চোখে চাইলো সে প্রিহানের দিকে। ইগলের চোখে তাকিয়ে আছে প্রিহান। তবে কি তার সন্দেহ টাই ঠিক? মালা আজকে কোর্টে গেছিলো? সে তীব্র ভাবে বললো,

‘তুমি কি করে জানলে আমার জেতার কথা আজ? তোমাকে এই ব্যাপারে কেমন কনফিডেন্স লাগছিলো!’

‘ন-না মানে ফে-ফেসবুক! হ্যাঁ ফেসবুকে অনেকজন পোস্ট করেছে যে প্রিহান হাওলাদার আজকে অনেক বছর আগের কেস টা তার বুদ্ধি ও প্রমাণের ভিত্তিতে কি নিদারুন ভাবে জয়ী হলেন। সকল ধ’র্ষ’ক’দের আটক করা যায়নি। কয়েকজন পলাতক এখনো!’

প্রিহান শান্ত হলো কিছুটা। তবে মনের মধ্যে খচখচানিটা থেকেই যাচ্ছে। সন্দেহজনক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে। মালা কালো শাড়ীর সঙ্গে কালো খয়েরি ব্লাউজ পরেছে। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। মাথায় ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ টা খুলে ফেলেছে সে। তাই কা’টা’র দাগ ভীষণ বিশ্রি ভাবে দেখা যাচ্ছে। কেমন ডিসেন্ট, ইনোসেন্ট ফেস মেয়েটার। তার মুখে কোনো মিথ্যার পারদ থাকতে পারে কি? এই মেয়েটা কি তাকে মিথ্যা বলতে পারে?

‘আচ্ছা আপনি আজকে এতো বড় একটা কেস জিতেও এমন গোমড়া মুখে কেন বসে আছেন প্রিয়?’

‘না তো! জীবনে প্রথমবার মনে হচ্ছে জিতেও জয়টাই আমি খুশি না। হাকিম আংকেল? হাকিম আংকেল ধ’র্ষ’ক! আন্ট, জাকিয়া সবাই ভীষণ ভেঙে পরেছেন আংকেলের এরকম একটা কাজে। আংকেল যে এরকম ভাবে কারোর খু’ন করতে পারে আমাদের ধারণাও ছিলো না! আংকেল সহ আরও অনেকেই এখনো পলাতক জানো?’

‘উনি কোথায় থাকতে পারেন বলো তো?’

প্রিহান তখনো মালার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এতো কিছু শোনার পর সে মাত্র এই একটা কুয়েশ্চন করলো? অদ্ভুত না? সে দেখতে চাইলো মালার রিয়াকশন টা কেমন এখন!মেয়েটা এতো বড় একটা ঘটনার কথা শুনেও চমকালো না কেন?প্রথমবার কেউ এরকম ধুন্ধুমার কথা শুনলে চমকাবে মাস্ট! তবে কি মালা আগে থেকেই সব টা জানে? বা জানতো? প্রিহান নিজের ভাবনা লুকায়িত রাখলো। প্রিহানের চাহনিতে মালা বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই কিছু আন্দাজ করার চেষ্টা করছে প্রিহান। তাই সে জবাব দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,

‘আসলে ফেসবুকে অলরেডি অনেকে লেখালেখি করছিলো তো আজকের কেস টা নিয়ে তাই আমার শ’কট লাগেনি এখন। কিন্তু আমিও প্রথম বার যখন দেখেছি পোস্টটা তখন আমিও বিস্মিত হয়ে ছিলাম। আচ্ছা এটা বলুন কি করে প্রমাণ করলেন সব?’

‘হ্যাঁ, ওহ্ হ্যাঁ।’

‘আপনি শকট এখনো বুঝতে পারছি। তাই আবোল তাবোল ভাবনায় আছেন। তাও শুনতে ইচ্ছে করছে বলুন না।’

‘আমি তো ভেবেছিলাম আজকের কেস টা হেরেই যাবো। আমি কোর্টের ভেতরে যাবো ঠিক সে সময় একটা কালো বোরখা পরিহিত মেয়ে আসে। মেয়েটা সোজা আমার কাছে এসে একটা মেমোরি কার্ড দেই। আমি ভেতরে যাওয়ার আগে মেমোরি কার্ডে আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় টিই পাই। আমি যখন ফোনে মেমোরি কার্ড উঠিয়ে একটা ভিডিও দেখি সেখানেই ছিটকে পরে যায়। কয়েক জন আমাকে সামলাই সে-সময়। তবে কি কারণে এরকম হয়েছে আমি বুঝতে দেইনি কাউকে। এতো কিছুর মধ্যে ভুলেই গেছিলাম মেয়েটার কথা। মুহুর্তের মধ্যে যেনো মেয়েটা গা’য়ে’ব হয়ে গেছে। তুমি জানো মেয়েটার গায়ের গন্ধ, আর চোখ গুলো কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছিলো। আমার খুব আপন কেউ ছিলো মনে হচ্ছিলো বার বার।’

‘তাই?আপনি কি চিনতে পেরেছিলেন?কি ব্যাপার বলুন তো প্রিয় আপনি কি ওই মেয়েটার চোখ দেখে ফিদা হলেন নাকি?’

‘ধুর! আমি মজা করছি না মালা।ওই মেয়েটার চোখ গুলো ঠিক–!’

‘ঠিক কি?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো মালা।

‘কিছু না। ওরকম একটা নৃশংস ভিডিও সবার সামনে প্লে করাটাও টাফ ছিলো।যারা দুর্বল হার্টের ছিলো তারা বাহিরে গেলে ভিডিও টা সবার সামনে প্লে করা হয়৷ এরপরে এক লহমায় প্রমাণ হয়ে যায় কে কে ধর্ষণ করেছিলো। টোটাল চোদ্দ জনের ফেস আপসা ঝাপসা হলেও দেখা যাচ্ছিলো। এরপরে যখন হাকিম আংকেল এর ফেস টা এলো না মালা আমি ধপ করে বসে পরি৷ হ্যাঁ হাকিম আংকেল ই মেইন কাল’প্রিট। জানি না ভিডিও টা কে করেছে তবে আজকে যে মেয়েটা আমাকে সাহায্য করেছে তাকে খুঁজে পেতে হবে! তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে মালা?’

মালা নার্ভাস হয়ে যায়। সে যখন ভিডিও টা দেখেছিলো প্রথমবার সেও চমকেছিলো, ভয়ও পেয়েছিলো অনেক। যার দরুন কালকের ঘটনা টা ঘটেছে তার সাথে। আশ্চর্যের বিষয় হলো সে এখন চাইলেও অবাক হতে পারছে না। কারণ তার জানা আছে সবটা। হ্যাঁ সেই তো গেছিলো প্রিহানের কাছে মেমোরি কার্ডটা পৌঁছে দিতে।

ভিডিওতে ভি’ক্টি’ম মেয়েটা কে জানা যায়নি এখনো। তবে একে একে চোদ্দ জনের একজন ও বাদ রাখেনি মেয়েটাকে গণ ধ’র্ষ’ণ করায়। শেষে খুবই নৃশংস ভাবে তাকে মে’রে ফেলা হয়। মেয়েটা কথা বলতে পারছিলো না কিন্তু যখন মা’র’ছিলো না তাকে সে অনেক হাতে পায়ে ধরেছে, কাকুতি মিনতি করেছে যেনো তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পা’ষাণ লোকজন তাকে ছা’ড়ে নি। তার গ’লায় যখন ধা’রা’লো ছু’ড়ি চালানো হলো না? তখন গল গলিয়ে র’ক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসছিলো। মেয়েটার গ’লা টা কা’টার সময় ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হচ্ছিলো। এই দৃশ্য দেখেই মালা কাঁপছিলো। আর ওভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। কিন্তু সে জানতো না হাকিম আংকেল মানে জাকিয়ার বাবাই এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। সে তো আর হাকিম আংকেল কে দেখে নি কখনোই।

‘কি হলো মালা? কি ভাবছো বলো তো?’

‘না কিছু না। আচ্ছা জাকিয়া আপু কি সেদিনের ড্রামা টা জেনে শুনে করেছিলো বলুন তো?’

‘হ্যাঁ হতে পারে। সেজন্যই হীরের ক্লিপ হারানোর নাটক টা করে আর তোমাকে ফাসাই। যেনো আমার কোর্টে যেতে দেরি হয়। আমার মনে হয় ও আগে থেকেই জানতো এই ব্যাপারটা! আন্ট ও জানতেন জানো? আমি জাষ্ট আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম যে আন্ট, জাকিয়া এতো বড়ো একটা ক্রি’মি’নাল এর সঙ্গে থাকছিলো কি করে এতোদিন?’

‘ক্রিমিনাল হোক আর যায় হোক প্রিয়। ভালোবাসার কাছে সবকিছুই তুচ্ছ! হাকিম আংকেল কিন্তু, শোহিনী ফুপুর হাসবেন্ড আর জাকিয়ার বাবা! আর আমার মনে হয় জাকিয়া আপু হাকিম আংকেল কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। হইতো সেজন্যই এসব আড়াল করেছে আর নিজের বাবাকে বাঁচাতে চেয়েছে।’

‘যায় হোক না কেন, অপরাধী, অপরাধীই হয় মালা৷ সেটা হোক ছোট কিংবা বড় কোনো অপরাধ! বা অত্যন্ত আপন জনের অন্যায়। আমার কাছে সবার জন্য আইন কানুন একই। যেমন আমি আমার বোনকেও সেক্ষেত্রে ছাড় দিই নি। অন্যায়ের কাছে আমি কখনো আপস করিনি আর মিথ্যা আমার দু চোখের বা’লি।’

‘আপনার বোন? কি করেছিলো আপনার বোন?’

ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো প্রিহান। সে এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারবে না। তাই সে কোনো কিছু না বলেই চলে গেলো। মালা তার যাওয়ার পানে হা করে তাকিয়ে রইলো। প্রিহানের বোনের কথা উঠলেই এমন অদ্ভুত বিহেভিয়ার কেন করে? এটা তাকে জানতেই হবে।

রাত টা প্রিহানের কাছে দুর্বিষহ কা’টলো। যখনই চোখ বন্ধ করছিলো সে তখনি খু’ন করার দৃশ্য চোখে ভাসছিলো। একজন মানুষ এতোটা নগন্য, এতোটা নেক্কার কাজ কি করে করতে পারে? সে তো শুধু এই দৃশ্য টা দেখেই ঘুমোতে পারছে না। বাড়ির সবাই সবকিছু জানতে পেরে খুবই হতাশায় ভুগছেন। কেউই আশা করেনি তাদের বাড়ির জামাতা এরকম হতে পারে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে হাকিম রাজনৈতিক কাজ করতো যেগুলো বাড়ির কেউ-ই পছন্দ করতো না। কিন্তু তাই বলে একজন খু’নির সঙ্গে এতোদিন যাবৎ তাদের বাড়ির মেয়ে সংসার করেছে?

সকালের দিকে প্রিহান একটু ঘুমিয়েছে। মালা উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিলো। ভালো লাগছিলো না বলেই সে রান্না ঘরে গিয়ে সকল প্রকার কাজ করলো। আর বাড়ির পরিস্থিতিও অস্বাভাবিক এখন। কারোরই মন ভালো নেই কালকের ঘটনার জানার পর। সকাল দশটাই সবাই ব্রেকফাস্ট শেষ করেছে কোনো রকম। প্রিহান ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

ময়না, মালা, খোদেজা তারা তিন জন মিলে দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিলো সে সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ময়না গিয়ে দরজা খুলেই দেখলো একজন স্যুট, বোট পরা ভদ্রলোক মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে চেনার চেষ্টা করলো মানুষ টা কে। দাদি,দাদু, খোদেজা সবাই চিনতে পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আর মালা মানুষ টাকে দেখতেই দু কদম পিছনে পিছিয়ে গেলো। উনি এখানে?

#চলবে