#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৭
এবার যেন সকলের চোখ খুলে নিচে গড়াগড়ি খাবে। কি লজ্জা! সকল প্রজা, দাসদাসীর সামনে কিনা তাদের রাণীকে…? নাহ এটা মানা যায় না। কিন্তু কেউ কিছু বলতেও তো পারছে না। অনেকে নিজের চোখ ঢেকে রেখেছে। তার সঙ্গে কানাকানি শুরু হয়েছে। রোজি হতবিহ্বল! এই সাধারণ মানুষের এতো বড় সাহস? অন্যদিকে প্রেমের বাঁধনে বেঁধে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঐশ্বর্য। যেন সে পাথরের ন্যায় এক মূর্তি। অনুভূতি বলতে সকলের সামনে শুধু লজ্জায় আসছে তার। অন্য কারোর দিকে চোখ মেলানোর মতো দুঃসাহস পাচ্ছে না সে। এই মানুষটার এতো দুঃসাহসিক কাজকর্ম দেখে ঐশ্বর্যের মাথা ভনভন করে ঘুরছে! এখন তার কি বলা উচিত? অথবা কি করাই বা উচিত? হঠাৎ নিজের হৃৎস্পন্দনের উপস্থিতি গভীর ভাবে উপলব্ধি করে ঐশ্বর্য। তা যেন লাফিয়ে এই মানুষটার মাঝে ঢুকে পড়বে। সেই মূহুর্তেই চোখজোড়ায় ভেসে ওঠে আবছা কিছু স্মৃতি। একটা জায়গায় অনেক কয়েকজন মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে। এতো মানুষের মধ্যে একটা পুরুষ আর একটা মহিলার এমনই কাছাকাছি আসার কিছু অস্পষ্ট দৃশ্য। চেহারা মস্তিষ্কে আর আসেনা। এসব দেখে তাল সামলাতে পারে না। পড়ে যেতে নেয় নিচে। প্রেমের হাতের বাঁধন তাকে বেঁধে রাখে। শক্ত করে ধরে রাখে। ঐশ্বর্য চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে। তার কর্ণকুহরে ভেসে আসে প্রেমের শীতল কন্ঠে।
“এখনো নিজেকে সামলাতে এই সাধারণ মানুষের প্রয়োজন হয় তোমার মহারাণী! এতো এতো প্রজা সামলাবে কি হতে?”
নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠে সামলে নেয় নিজেকে রোজি। অতঃপর ক্রোধে একাকার হয়ে ওঠে সে। বিড়বিড় করে বলে,
“এই প্রেমকে সহজভাবে নিয়ে আমি ভুল করেছি। এ ততটা সহজ নয় যতটা ওকে দেখায়।”
রোজি উদ্ভট শব্দ করে উঠল। সৈন্যদের ইশারা করে। তৎক্ষনাৎ সৈন্যরা তেড়ে যায় প্রেম আর ঐশ্বর্যের দিকে। তারপরেই প্রেমকে দ্রুত টেনে নিয়ে ছিটকে ফেলে নেয়। ঐশ্বর্যও টাল সামলাতে না পেরে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। সৈন্যদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,
“কুইন, আমাদের সকলের সামনে আপনার সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করেছে এই সামান্য মানুষ। এখুনি ওর মৃ’ত্যুর ব্যবস্থা করা হবে। আপনার হাতে ম’রেনি তো কি হয়েছে? আমাদের হাতে মর’বে।”
আর বিলম্ব না করেই সকলের সামনে দ্রুত পড়ে থাকা তলো’য়ারটা তুলে নিলো সেই সৈন্য। হিং’স্র দৃষ্টি প্রেমের দিকে নিক্ষেপ করল। তার দিকে এগিয়ে গেল। ধারা’লো তলো’য়ার ভালো করে হাতে ধরে নিল। ঐশ্বর্যের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এলো। নিশ্বাস ওঠানামা করতে থাকল। ভেতরে কেন যেন চাপা আর্তনাদ সৃষ্টি হচ্ছে। নিজের পরনে থাকা পোশাক খামচে ধরল। আর্তনাদ চাপতে না পেরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“থামো।”
সকলে চাইছিল প্রেমের মৃ’ত্যু হক। সকলের দৃষ্টি ছিল উৎসুক। ঐশ্বর্যের চিৎকারে তার উপর নজর পড়ল সকলের। আসলে তাদের কুইন কি চাইছে কিছুই তারা বুঝতে পারছে না। তবে রোজি হয়ত কিছুটা বুঝেছে। সে ছুটে এলো ঐশ্বর্যের কাছে। হাঁপিয়ে বলল,
“থামতে কেন বলছেন কুইন? ও আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করল তার কি শাস্তি হবেনা? এমনিতেই আমাদের রাজ্যে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছে। তার ওপর আপনার সঙ্গে এমন অসভ্য আচরণ!”
ঐশ্বর্য কিছু একটা বলতে উদ্যত হতেই প্রেম মেঝেতে পড়ে থেকে বলে উঠল,
“আশ্চর্য! আমি আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করলে সেটা অশ্লীল আচরণ হয় কি করে? আমি তো তোমাকে টাচ করিনি রোজি। ঐশ্বর্য আমার স্ত্রী! ওর সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। কেন? তোমাদের ডেভিল কিংডমে কি বিয়ের পরেও স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকে নাকি?”
ঐশ্বর্য কপালের টনক নড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রেমের দিকে তাকায়। ‘স্ত্রী’ শব্দটি শুনতেই আবারও বাড়ে হৃৎস্পন্দন। এই শব্দটির মধ্যে কি এমন রয়েছে? আর লোকটা তাকে তার স্ত্রী বলে কেন দাবি করছে? আশ্চর্য হয় ঐশ্বর্য। এমনটা তো তার জানা ছিল না? আধো আধো গলায় বলে,
“স্ত্রী?”
প্রেমকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না রোজি।
“এমন মিথ্যে কথা বিশ্বাস করবেন না কুইন। এই মানুষ আসার পর থেকে আপনাকে ভুলভাল কথা দিয়ে ভুলিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর এমন অশ্লীলতা!”
ঐশ্বর্য বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকলো। রোজি যেই বলল,
“তোমরা চেয়ে আছো কি? আ’ঘাত করো সেই তলো’য়ার দিয়ে। ছিন্ন’ভিন্ন করো দ্রুত!”
ঐশ্বর্য আবারও চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“কি হচ্ছে টা কি? আমি এ রাজ্যের রাণী সবার মতে তাই কিনা?”
সৈন্যগুলো মাথা নাড়ালো। আবার ঐশ্বর্য শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
“তবে আমার অনুমতি ছাড়াই একজনকে হ’ত্যা করার কথা ভাবো কি করে তোমরা?”
রোজি বিষয়টাকে ঘুরানোর চেষ্টা করে। আমতা আমতা করে বলে,
“কিন্তু কুইন…”
“আমি কি বলেছি ওকে আ’ঘাত করতে?”
ঐশ্বর্যের কটমটে কন্ঠ শুনে মাথা নাড়ায় রোজি। ঐশ্বর্য আগের মতোই বলে ওঠে,
“তবে? তুমি অনুমতি দেওয়ার কে রোজি?”
রোজি মাথা নুইয়ে ফেলে। ঐশ্বর্য এবার তার প্রগাঢ় কালো দৃষ্টি রাখে সৈন্যদের ওপর। দৃষ্টিটা বজায় রেখে এগিয়ে যায় তলো’য়ার হাতে ধরে রাখা সৈন্যের হাত থেকে তলো’য়ার ছো মেরে নিয়ে বলল,
“আমার অ’স্ত্র দ্বিতীয়বার স্পর্শ করলে আমি হাত কে’টে রেখে দেব।”
সৈন্যটিও এবার ঐশ্বর্যের পায়ে পড়ে। ঐশ্বর্য সরে দাঁড়ায়। প্রেম একনাগাড়ে ঐশ্বর্যের দিকে পলকহীন নজরে চেয়ে। মেয়েটা আসলে কি চাইছে সেটা বুঝতে পারছে না প্রেম। ঐশ্বর্য একনজর প্রেমের দিকে তাকিয়েই নজর সরিয়ে নিল। রোজি তবুও সাহস করে এগিয়ে কিছু বলার আগেই ঐশ্বর্য তা বুঝে নিয়ে বলল,
“এই মানুষের শাস্তি হবে। আমি ওকে শাস্তি দেব নিজহাতে। তবে আজ নয়। একটু একটু করে ধ্বং’স করব। বন্দি করে এই মানুষটাকে। খাবার, পানি কিছু যেন ওর কাছে পৌঁছায়। সেই সাথে কালকুট কারাগারে নিক্ষেপ করো। কোনো আলোও যাতে ওকে ছুঁতে পারে।”
প্রেম ছাড়া সকলের মুখে হাসির রেশ দেখা গেল। সকলে এটাই চেয়েছিল। একটু আগে সকলে ভেবেছিলো এই প্রেমকে হয়ত সে চিনতে পেরেছে। হয়ত ডেভিল কুইন ঐশ্বর্য নিজের আগের রূপে প্রেমকে দেখে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু ঐশ্বর্য তা মিথ্যে প্রমাণ করে দিল।
সৈন্যগুলো প্রেমকে টেনে দাঁড় করালো। টানতে টানতে ঐশ্বর্যের সামনে আনলো। ঐশ্বর্যের চোখজোড়া হঠাৎই প্রেমের চোখে পড়ল। থমকালো ঐশ্বর্য। একটা মানুষের চোখজোড়া কি সত্যিই এতোটা সুন্দর হয়? সত্যিই এতো ভাষা প্রকাশ করতে পারে? ঐশ্বর্য ঢক গিলে চোখ সরিয়ে ফেলতেই প্রেম হেঁসে উঠে বলল,
“ডেভিল কুইনও ভয় পায় বুঝি?”
তেতে উঠে আবারও তাকালো ঐশ্বর্য। আর বলল,
“কিসের ভয়?”
“আমার চোখে হারাবার ভয়। আমার ভালোবাসায় হারাবার ভয়।”
ঐশ্বর্য মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে কড়া গলায় জবাব দিল।
“তোমার মতো সামান্য একটা মনুষ্যকে ভয় পাওয়ার কোনো মানেই হয় না। আমি ডেভিল কুইন।”
“তাহলে আজকে আমাকে মার’লে না কেন?”
ঐশ্বর্য আগের মতোই অকপটে জবাব দিল,
“কারণ আমি তোমাকে একটু একটু করে শে’ষ করতে চাই। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাই। আমাকে অবহেলা করার শোধ তুলতে চাই। যেখানে যাচ্ছো সেখানে না পাবে খাবার আর না পাবে পানি। ভয় লাগছে না তোমার? এখনো হাসছো নির্লজ্জের মতো?”
প্রেম হেসেই জবাব দিল,
“হ্যাঁ হাসছি। পানি, খাবার কিছু লাগবে না। রাণী সাহেবা? শুধু আপনি এসে মাঝে মাঝে আমায় দেখা দিয়ে যাবেন। আমার চোখ জুড়ালেই হলো।”
ঐশ্বর্য চমকে তাকায়। তখনি তাকে নিয়ে চলে যাওয়া হয়। ঐশ্বর্য তাকিয়েই থাকে। প্রেম ঘাড় ফিরিয়ে তার বাকহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না ঐশ্বর্য তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
কালকুট কারাগার। আলো অবধি পৌঁছায় না। চারিদিক অন্ধকার। তবে আশেপাশে পাহারাদার থাকে বলে রয়েছে আলো। আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয় সবসময়। প্রেমকে রাখা হয়েছে সেখানে। কারাগারের এক কোণায় হাঁটু ভাঁজ করে চোখ বুঁজে বসে আছে প্রেম। বুঝতেই পারছে বা কারাগারে থেকে কি করে ঐশ্বর্যকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনবে! আর কি করে ফিরিয়ে আনবে তাও জানা নেই। জানা থাকার কথাও নয়। কারণ এটা ডেভিলদের মধ্যে প্রধান কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না। কথাটা মাধুর্য বলেছিল। আর প্রেম এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে ঐশ্বর্যকে আগের মতো করতে যা যা করতে হবে তার ব্যাপারে রোজি জানে। প্রেমের দুহাতে এবং দুপায়েও শিকল। পরনে থাকা শার্ট এবং প্যান্টও ধুলোয় মাখামাখি। একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা! যখন তার নাম কেউ উচ্চারণ করল তখন মাথা তুলে তাকায় প্রেম। আগুনের আলোয় দৃশ্যমান এক মুখ। কারাগারের ঠিক অন্যপাশে রোজি। মুখে বাঁকা হাসি। গা জ্বলে ওঠে প্রেমের। তবে কিছু বলে না। রোজি হাসি মুখ বজায় রেখে বলে ওঠে,
“কি দুঃখ! কি হতাশা! তাই না? কি ভেবেছিলে? প্রথমবার যখন কুইন নিজের রূপ করেছিল ওই অমাবস্যার রাতে সেই প্রথমবার যখন তুমি ছুঁয়ে তাকে আগের মতো বানিয়েছিলে। আবারও ঠিক কাজ করে ওকে ঠিক করে দেবে? এতোই সোজা নাকি?”
প্রেম তেজি সুরে বলে,
“যদি ব্যাপারটা সোজা হতো তাহলে তো হতোই। তোমরা যেমন এতো বছর তপস্যা করে ডেভিল কুইন পেয়েছো তখন বিষয়টা যে সোজা নয় আমি জানি।”
“তোমার বুকেরপাটা আছে বলতে হবে। সাহস করে তো এতোদূর অবধি এসেছো। কিন্তু মৃ’ত্যু কিছুই পাবে না।”
প্রেম আগের মতোই জবাব দেয়,
“কি পাব আর কি পাব না সেটা ভবিষ্যত বলবে। একটা কথা হয়ত খেয়াল করো নি। ঐশ্বর্য আমাকে আ’ঘাত করতে পারেনি। ও থেমে গেছে। অন্যকেও আঘা’ত করতে দেয়নি।”
রোজি এবার প্রেমের কথার মানে বুঝে চোখ ছলকে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
“কি বলতে চাইছো? তোমার জন্য এখনো উনার মনে কোনো বিশেষ অনুভূতি অবশিষ্ট রয়েছে? তাহলে বলব তুমি বোকা কিছুই নও। ডেভিলদের মনে এসব অনুভূতি থাকেনা। ভালোবাসা, প্রেম এসব ডেভিলদের জন্য নয়। এই রাজ্যে বিয়ে হয় শুধু এবং শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধি করার জন্য। আমাদের পক্ষ শক্তিশালী করার জন্য। কেউ কারোর পরোয়া করে না। কেউ কাউকে আ’ঘাত করতে দুইবার ভাবেনা। আমি নিজেই আমার ভাইকে হ’ত্যা করেছি। আমার বাবা আমার মাকে মে’রে ফেলেছে। এটাই আমাদের নিয়ম। নিষ্ঠুরতা! আর তোমাকে তো একটু একটু করে মার’তে চাইছে কুইন। তাই এই ব্যবস্থা! এর বেশি কিছু ভেবো না।”
প্রেম এবার উঠে দাঁড়ায়। রোজির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
“তুমি ভুলে যাচ্ছো ঐশ্বর্য তোমার রাণী হবার আগে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। সেই সাথে ও আমার স্ত্রী! আমাদের মানুষদের পৃথিবীতে একটা কথা খুব প্রচলিত! সেটা হচ্ছে, ভালোবেসেছিলাম বলে কোনো শব্দ নেই। হয় সে আমায় এখনো ভালোবাসে নয়ত সে কখনোই আমায় ভালোবাসেনি। আর এই কথাগুলো আগে না মানলেই এখন খুব মানি। আর এটাও জানি ঐশ্বর্যের ওই স্বচ্ছ চোখে ওই ভালোবাসার জোয়ার মিথ্যে নয়। শুধু তোমাদের শয়’তানি শক্তির স্তরে ঢাকা পড়েছে। আর তার থেকে বের হওয়ার উপায়ও আছে। সেটা তোমার জানা তাই না?”
চোখ দুটো সরু করে তাকায় রোজি। প্রেমকে সে যতটা বোকা ভেবেছে ততটা বোকা সে নয়। অনেকটা চালাক। তবে মনে মনে ভেবে নেয় প্রেমের কথায় দুর্বল বা ভয় পাওয়া যাবে না। গলা ঝেড়ে বলে ওঠে,
“জানা আছে। তুমি কখনোই জানবে না। আর মাত্র ৪ দিন বাকি কুইনের অভিষেকের। আর সেদিনই হবে তোমার অন্তিম সমাপ্তি।”
চলবে…
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৮
ইতিমধ্যে একদিন কেটে গেছে। একটা দিন একটা রাত! নির্জন আর অন্ধকার কারাগার। আলোর রেশ মাত্র নেই। নেই কোনো খাবারের ব্যবস্থা বা পানির ব্যবস্থা। সোজা হয়ে কারাগারের ভেতরে শেষদিকে শুয়ে প্রেম। নড়াচড়া নেই কোনো। উজ্জ্বল চেহারা আর তেমন নেই। উজ্জ্বল রঙ কেটে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ। খাবার ও পানির অভাবে চোখমুখ বসে গেছে। কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে আছে প্রেম। তাকানোর শক্তি অবধি নেই। জীবন যেন বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রেম তো ছোট থেকে রাজপুত্রের মতোই বড় হয়েছে। ছিল না কোনো অভাব। খাবারের অভাববোধ করেনি কখনো। আজ প্রথমবার এমন হচ্ছে। সহ্য করতে পারছে না। কোনোরকমে কাত হতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে আসতেই দুর্বল চোখ মেলে তাকায় সে। আগুনের আলোতে কারো হেঁটে আসা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য পা দেখা যাচ্ছেনা। পোশাকে আবৃত। প্রেম মাথা তুলে তাকাবার চেষ্টা করল। বড় শ্বাস নিয়ে নিলো শক্তি জোগাতে।
মাথা তুলে একটু তাকাতেই কালো পোশাকে আবৃত নারীটিকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল প্রেম। বর্তমান তার পরিচয় এই বিষা’ক্ত রাজ্যের বিষা’ক্ত রাণী। ঐশ্বর্য! হেঁটে এসে কারাগারের বিপরীত পাশে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। তার বাম হাতে আগুনের মশাল। আরেকহাতে বড়সড় থালা। থালার একপাশে রাখা পানির গ্লাস। প্রেম কোনোরকমে উঠে বসল এবার। আগুনের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠেছে স্বর্ণের মতো চেহারা। মোহময়ী দুটো চোখ যেন কত দিন পর দেখতে পেলো প্রেম। বুকের ভেতর অনুভূতির তরঙ্গ উঠতে থাকলো। তীব্র আকাঙ্ক্ষা হলো প্রেয়সীকে ছুঁয়ে দেখার। নিজের বাসনা চাপিয়ে রাখতে না পেরে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ালো সে। ধুলোমাখা শার্ট আর প্যান্ট বৃথা ঝাড়তে চেষ্টা করল। পারল না। দুলে উঠে এগিয়ে এলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ কেউ নেই পাহারা দেওয়ার জন্য। কিন্তু অন্যসময় তো কড়া পাহারা থাকে। আজ কেউ নেই কেন? প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল প্রেমের। কিছুটা সামনে হেঁটে থামলো সে। খাবারের মস্ত বড় থালায় খাবারদাবার চোখে পড়ল! সামনে থাকা বড় প্রাচীরের জন্য আর নিকটে যেতে পারল না প্রেম। সেখানেই দাঁড়িয়ে বলল,
“কি ব্যাপার রাণী সাহেবা? আমাকে না খাইয়ে মা’রছো তাতে শান্তি হচ্ছে না বুঝি? এখন নিজের খাওয়া দেখিয়ে মা’রতে চাও?”
“চুপ করো। যত্তসব আজেবাজে কথা।”
“আজেবাজে কি বললাম রাণী সাহেবা? এখানে নিশ্চয় আপনি আমায় খাওয়াতে আসবেন না। আপনারই তো কড়া নির্দেশ! এই প্রেম নামক মানুষটির কাছে যেন একটা পানির বিন্দুও না পৌঁছে।”
প্রেমের কথায় ঐশ্বর্য কিছু বলল না। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সেই চোখ দুটো সরু করে আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাবারের থালা নিচে রাখলো। অতঃপর কোথা থেকে যেন চাবি বের করে তাড়াতাড়ি করে বড় কারাগারের সামনে ঝুলে থাকা তালাটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রেম এবার বোঝার চেষ্টা করল মেয়েটার মনে কি চলছে? দুচোখে সবটা ঘোলা দেখছে। চারিপাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। শরীর খুব দুর্বল। ঐশ্বর্য তালা খোলা শেষে হাতে থালাটি তুলে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ার সময় প্রেম সামলেই ছিল গেটের। ঐশ্বর্যের মাথা গিয়ে ঠুকে যায় প্রেমের বুকে। হালকা সরে দাঁড়ায় সে। হাত দিয়ে দেয়াল ধরে। মাথাটা এবার ঘুরছে। সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ নিজেকে সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়তে নেয়। ঐশ্বর্যের এক হাতে আগুনের মশাল আরেক হাতে খাবার। বুঝতেই পারলো না এমতাবস্থায় কি করবে! সে নিজে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভরাট হাতেই প্রেমকে ধরার চেষ্টা করল। প্রেম না পেরে তার কাঁধ ধরে এবারের মতো সামলে নিল। একহাতে নিজের কপাল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বড় শ্বাস নিয়ে সেই দুর্বল চোখ খানি নিয়ে ঐশ্বর্যের পানে তাকাতেই ঐশ্বর্য অস্থির ভঙ্গিতে বলে উঠল,
“না খেয়ে কি অবস্থা হয়েছে দেখো! অতিরিক্ত দুঃসাহসিকতা দেখাতে গিয়েছিলে না? এটা তার ফল! একটু ভয় পেতে পারতে। ছেড়ে দিতাম। এখন তাড়াতাড়ি করে পানি খেয়ে নাও। সাথে খাবারগুলো। তাহলেই ঠিক হতে পারবে।”
প্রেমের চোখ ভরে এবার দেখা যায় বিস্ময়। খাবারের দিকে একবার চেয়ে বলে,
“হঠাৎ আমার জন্য খাবার? আমার জন্য তো খাবার আর পানি নিষিদ্ধ ছিল তাই না?”
ঐশ্বর্য ক্ষুদ্ধ হয়ে জবাব দেয়,
“না খেয়ে ম’রবে নাকি? একদিনেই তো অবস্থা কাহিল। কাল হলে তো দেখা যাবে আর নিশ্বাসই চলছে না। তখন?”
“তুমি তো সেটাই চেয়েছিলে। আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেক। সেই সাথে আমার র’ক্তের চলাচল আর হৃদয়ের স্পন্দন সবটা যেন বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে এখন আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এতোটা চিন্তা কেন?”
ঐশ্বর্য খাবার রেখে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“কারণ…”
একটা শব্দ বলে মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হয় না তার। কটমট করে প্রেমের দিকে চেয়ে তাকায়। আর বলে,
“তুমি খাবে?”
প্রেম ঐশ্বর্যের রাগের মাত্রা বাড়াতে আরো জোর দিয়ে বলে,
“না খেলে?”
তিরিক্ষি হয়ে চেয়ে রয় ঐশ্বর্য। প্রেম আবার টলমল করে টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে বসে পড়তেই তার সামনে পানির গ্লাসটা ধরে একহাতে প্রেমের ঠোঁট টিপে ধরে পানি খাইয়ে দেয় ঐশ্বর্য। রাগে গজরাতে গজরাতে বলে,
“দেহে শক্তি নেই তবে মনে জেদ ঠিকই আছে!”
প্রেম দুর্বল অবস্থাতেও পেছনে দুটো হাত রেখে উপর দিকে তাকিয়ে চোখ বুঁজে হেঁসে বলে,
“তোমার থেকেই তো শিখেছি জেদটা।”
ঐশ্বর্য খাবারের থালা এগিয়ে দেয়। তারপর চটপটে গলায় বলে,
“দ্রুত খাবার খেয়ে নাও। বেশি সময় নেই হাতে। কখন যেন প্রহরীরা চলে আসবে।”
“হঠাৎ আজ প্রহরীরা নেই কেন? আমি ভুল না হলে তুমি কিছু করেছো তাই না? যাতে খাবার পানি নিয়ে আমার কাছে আসতে পারো?”
ঐশ্বর্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে নিরব থাকে। উসখুস করে তবে জবাব দেয় না। প্রেম জানে ঐশ্বর্যই কিছু করেছে। মেয়েটার মন এখন দোটানায় পড়েছে। একদিকে এই রাজ্যকে নিজের রাজ্য ভেবে বসে আছে আর শয়*তানি শক্তিকে নিজের শক্তি। অন্যদিকে এসবের মাঝে চাপা পড়ে যাওয়া সেই ভালোবাসার অনুভূতি আগুনের মতো স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ছোটাছুটি করছে মনে। তাই তো এখনো তার নেত্রদ্বয়ে স্পষ্ট প্রেমের জন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এবার খাবারের দিকে চোখ রাখে প্রেম। খিদে পেয়েছে খুব। এ জীবনে এতোক্ষণ না খেয়ে সে কখনোই থাকেনি। দ্রুত হাত নিয়ে খাবার ছুঁতেই লক্ষ্য করল তার হাত ময়লা। থেমে গেল সে। খিদে সহ্য হচ্ছে না। পানি সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে তৃষ্ণায়। হাত ধোয়ারও কোনো সুযোগ নেই। ঐশ্বর্যের নজর এড়ালো না বিষয়টা। লোকটার নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে। এই নিষ্ঠুর মনে এতো মায়া জাগছে কেন তা জানা নেই নিষ্ঠুর রাজ্যের ভাবি রাণীর। শুধু মায়া জাগছে আর সেটা বেড়েই চলেছে। থামাথামি নেই কোনো।
ফট করে খাবারের ওপর হাত রাখলো ঐশ্বর্য। খাবার হাতে তুলে প্রেমের সামনে ধরল। প্রেম খাবার দেখে নিয়ে ভরাট গলায় বলল,
“খাবার দিয়ে এতো সেবাযত্ন করছো যে! আর তো মাত্র তিন দিন। তারপর তো তোমার হাতে অপেক্ষা আমার মৃ’ত্যু। তা হ’ত্যার আগে এতো যত্ন কিসের? শেষ যত্ন করছো?”
ঐশ্বর্যের কথাগুলো সহ্য হলো না। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আগের মতোই প্রেমের গাল টিপে ধরে খাবার তার মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ধমকে বলে উঠল,
“আর কোনো কথা বলবে না। নইলে খাবার নিয়ে চলে যাব। অভুক্ত থেকে যাবে বলে দিচ্ছি।”
প্রেম কিছু বলল না। মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকলো ঐশ্বর্যময় ঐশ্বর্যকে। অন্যহাতে ভালো করে আগুনের মশাল ধরে রেখে দিয়েছে সে। অনবরত ঘামছে। ঘামগুলো বেয়ে গাল থেকে থুঁতনিতে এসে পড়েছে। চিকচিক করছে তা। কি সুন্দর দৃশ্য! তারপর হঠাৎ মাথায় খেলে গেল এক বুদ্ধি। খাবার চিবাতে চিবাতে বলল,
“আর ৩ দিন পর তো তোমার অভিষেক। এর মধ্যে যদি আমি প্রমাণ করে দিতে পারি তুমি এই রাজ্যের নও। তুমি আমার স্ত্রী আর এরাই তোমার চিরশত্রু। যাদের ভরসায় তুমি থাকছো। তখন কি করবে?”
চাতক পাখির মতো চেয়ে রইল প্রেম ঐশ্বর্যের উত্তরের আশায়। তবে ঐশ্বর্য কিছু একটা ভেবে উত্তর দিতে গিয়েও আশানুরূপ কোনো উত্তর দিল না। বলল,
“কিছুই না।”
রোজি রোজ একবার করে প্রেমের নামে অনেক কথা বলে। প্রেম তার সাথে কি কি ব্যবহার করেছে সেসব বলে। অবহেলায় তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল সেসব নিয়ে রোজ কথা ওঠে। এটাও বলে প্রেম বাঁচতে ঐশ্বর্যকে অনেকভাবে বোকা বানাতে চেষ্টা করবে সে যাতে সফল না হয়। যদি সফল হয় তাহলে ডেভিল কুইনের ক্ষতি। ডেভিল কিংডমের ক্ষতি। ঐশ্বর্য তা চাইছে না। শুধুমাত্র চাইছে লোকটাকে মৃ’ত্যু আগ পর্যন্ত ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখবে। মায়াজালে জড়িয়ে গেছে এ মন! প্রেম ঐশ্বর্যের উত্তরে হতাশ হয়। আবারও বলে ওঠে,
“এরা তোমাকে বোকা বানাচ্ছে। আচ্ছা তুমি কখনো ভেবেছো? তুমি যদি এ রাজ্যের হও তবে তোমার মা-বাবা কোথায়? কারা তোমার জন্মদাতা?”
ঐশ্বর্য খাবার তুলে দিতে গিয়ে থমকে তাকায়। চোখের পলক আর পড়েনা। সত্যিই তো! তার মা-বাবা কোথায়? থাকার কথা তো। সে নিশ্চয় মা-বাবা ছাড়া জন্ম নেয় নি! তবে? প্রেমের দিকে সন্দিহান নজরে তাকায় ঐশ্বর্য। অস্ফুটস্বরে বলে,
“মা-বাবা!”
“হ্যাঁ মা-বাবা! আমি জানি তোমার মা-বাবা কে। উনারা অধির আগ্রহে বসে আছেন তোমার জন্য। তোমায় একটি বার দেখবে বলে। ক্ষণে ক্ষণে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তোমায় না দেখতে পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছেন।”
ঐশ্বর্য থম মেরে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে সামাল দিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে বলে,
“না। তুমি মিথ্যে বলছো। তোমার কথায় বিশ্বাস হয় না। খাবার দিয়েছি বলে এই নয় তুমি যা ইচ্ছা বলবে আর আমি বিশ্বাস করব। খেয়ে নাও যত তাড়াতাড়ি পারো। আমি চলে যাব।”
প্রেম বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। মেয়েটা নিজ সিদ্ধান্তে অটল। ওকে বোঝাতে গেলে প্রহরীরা এসে পড়বে। ভাবতে ভাবতে তার মাথায় খেলে গেল একটা বুদ্ধি। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্য চকিতে তাকালো। এমন পুরুষালি, গাঢ় দৃষ্টি ঐশ্বর্যের মনের কুঠুরিতে অস্থিরতা তৈরি করে। চেহারা ফ্যাকাশে হতে থাকলো প্রেমকে আরো বেশি এগোতে দেখে। আবারও কি এই মানুষটা তাকে আগের বারের মতো চুম্বন জাতীয় কিছু করে বসবে? অসম্ভব! ঐশ্বর্য পিছু সরতেই প্রেম তার হাত থেকে ছো মেরে আগুনের মশালটা নিয়ে নিচে ফেলে দিল। নিচে ছিল বস্তা জাতীয় কিছু। সেটার সঙ্গে আগুনের সংস্পর্শ আসা মাত্র তা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকলো। তাপে সবটা ঝলসে যেতে থাকলো। আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে আগুনের দিকে চেয়ে রইল ঐশ্বর্য। চিৎকার করে বলে উঠল,
“এটা কি করলে?”
প্রহরীরা সবে খেয়েদেয়ে শান্তিমতো চলতে চলতে আসছে। আয়েশ করে হাঁটতে হাঁটতে একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আজকের খাওয়াদাওয়া একেবারে জম্পেশ হয়েছে তাই না রে?”
“ঠিক। কুইন আমাদের আজকে খাবারের স্থানে বসিয়ে বেশি বেশি খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন অভিষেকের আনন্দে। স্বাদটাও দারুণ ছিল।”
এভাবেই চলছিল খাবারের আলোচনা। রাজমহল পেরিয়ে কালকুট কারাগারে যাবার সরু রাস্তায় ঢুকতেই গরম লাগতে শুরু করল তাদের। পথের মাঝখানে তারা পেয়ে গেল আগুনের আভাস। তারা ঘাবড়ে একে ওপরের দিকে তাকালো। আরো একটু এগিয়ে কারাগারের সামনে যেতেই দেখলো রীতিমতো দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে আগুন। তখন সকলের চোখ কপালে। প্রেমের কথা তাদের স্মরণে আসতেই তারা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল।
“আগুন!”
মহলের সকলে জড়ো হলো। ভালোই আগুন লেগেছে। কিন্তু তাতে কারোর কিছুই যায় আসেনা। সকলেই ডেভিল। তারাদের আগুনই শক্তি, আগুনই মুক্তি! কিন্তু সেই মানুষটার কি হলো? সকলের চিন্তিত। রোজি আর রোজির বাবারও ছুটে এলো। এই অবস্থা দেখে বলল,
“দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলো। ওই মানুষটা বেঁচে আছে নাকি ম’রে গেছে সেটা জানতে হবে। নয়ত শান্তি পাব না।”
রোজির কথায় চলল আগুন নেভানোর কাজ। আগুন নেভানো হলো। তোলপাড় করে খোঁজা হলো প্রেমের দেহ। পাওয়া গেল না। প্রহরী আর সৈন্যরা হতাশ হয়ে বলল,
“পেলাম না। হয়ত আগুনে পু’ড়ে ছাই হয়ে গেছে।”
তাদের এমন কথা শুনে রোজির দৃষ্টি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। ক্রোধ মিশিয়ে বলে,
“মূর্খের দল। আগুন লেগেছে মাত্র কিছুক্ষণ হলো। আর এই কারাগারের দরজাও খোলা। মানে বুঝতে পারো না? ওই মানুষ পালিয়েছে। আর তখন তোমরা কি করছিলে?”
সকলের মুখ হয় থমথমে। মাথা নুইয়ে ফেলে। একজন মিনমিন করে উত্তর দেয়,
“খাচ্ছিলাম।”
রোজি যেন এবার ক্রোধে আগুনের লাভার মতো ফেটে পড়বে। হুংকার দিয়ে উঠল এবার।
“তোদের কে বলেছে এতো আয়েশে খেতে? ওই মানুষ পালিয়েছে! কুইন জানলে কি হবে?”
“আ…আমরা এখুনি ওকে খুঁজে বের করব! চিন্তা করবেন না।”
রোজির রাগ কমেনা। হাত দিয়ে দেয়ালে আ’ঘাত করে বার বার। মহল, রাজ্য জুড়ে চলে তোলপাড়। এতো খোঁজাখুঁজির মধ্যে ঐশ্বর্য একবারও নিজের ঘর থেকে বের হলো না। নিজের বেশ প্রেমকে খুঁজে এবার সন্দেহ জাগলো মনে। নিচতলা থেকে খুঁজে উপরে যেই না যেতে নেবে তখনি সিঁড়ির থেকে এলো অদ্ভুত ধ্বনি! ঐশ্বর্য আস্তে আস্তে এক পা একপা করে নামছে। চোখজোড়া নিচের দিকে স্থির। কালো পোশাকে স্পষ্ট তাজা র’ক্ত। সেই সাথে দুহাতে লাল বর্ণের র’ক্ত টপটপ করে সিঁড়িতে পড়ছে। ঐশ্বর্যের ভাবান্তর নেই। সে নামছে। একটা যন্ত্রের ন্যায় চলছে। রোজি সহ সেখানকার সকলে বাকহারা হয়ে তাকায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। চোখমুখের রঙ পাল্টে গিয়েছে। রোজি কিছু বলতে উদ্যত হলেই ঐশ্বর্য থেমে থেমে বলে ওঠে,
“এতো খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। হ’ত্যা করেছি শেখ আনন প্রেমকে।”
চলবে…
#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৯
সকলে স্তব্ধ। একধ্যানে চেয়ে থাকে ঐশ্বর্যের হাসি বিহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে। মেয়েটার দৃষ্টি স্থির। নড়াচড়া বন্ধ। যেন সে নিজেই প্রচন্ড আশ্চর্য। হতভম্ব। রোজিও ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ ঐশ্বর্যের দিকে চেয়ে রইল। ঐশ্বর্যের বলা একটু আগের কথাগুলো অবিশ্বাস্য লাগল। বিশ্বাস হলোই না কিছুতেই! এ কি করে সম্ভব? তাদের রাণী সাহেবা কি সত্যিই নিজের আসল রূপে আর নিজের হিং’স্রতায় ফিরছে? রোজি এগিয়ে এলো। ঐশ্বর্যের ঠোঁটের পাশে আর গালেও লেগে থাকা সদ্য টকটকে লাল বর্ণের র’ক্ত চোখে পড়ল। রোজি ঝটপট করে বলে,
“কিন্তু কুইন কি করে? ওই মানুষটা তো কৌশলে কি করে যেন আগুন লাগিয়ে পালিয়েছিল। আর আমরা তাকেই খুঁজছি।”
ঐশ্বর্য হাতের মুঠো শক্ত আর চোখমুখ খিঁচে নিল। তেজ নিয়ে বলল,
“ভুল আমারই। আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম যে ও কারাগারে কেমন আছে আর কি করছে। সেটাই বড় ভুল ছিল। সেই ভুলের কারণে ওই সামান্য মনুষ্য আমার হাত থেকে আগুনের মশাল নিয়ে আগুন লাগিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। আমি ক্রোধে ফেটে পড়ি। আমি ওকে বলেছিলাম না পালাতে। কিন্তু ও সেটাই করেছে। আমার কথার অমান্য করার একটাই শাস্তি! মৃ’ত্যু। আর ওকে আমি সেটাই দিয়েছি যেটা ওর পাওনা। আমার ক্রোধের আগুন ওর বি’নাশ করেছে। আমায় অবহেলা করার ফল ওকে ধ্বং’স করেছে। আমার ক্রোধের আগুনে সে পুড়েছে। তাকে পুড়তেই হতো।”
কথাগুলো যখন রোজির কর্ণকুহরে গিয়ে বাজলো তার মনে বয়ে গেল আনন্দের জোয়ার। আনন্দে ছটফটিয়ে উঠল ভেতরটা। কতদিনের রাগ পুষে রেখেছিল! কতদিনের শখ ছিল প্রেমের মৃ’ত্যু দেখার! আজ তা পূর্ণ হয়েছে। এখনি যদি আনন্দে নেচে উঠতে পারতো কতই না ভালো হতো। কিন্তু ঐশ্বর্যের সামনে নাচা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। তার কুইনের চোখমুখ বলে দিচ্ছে রাগের তেজ এখনো কমেনি। সেই রেশ দেখা যাচ্ছে ঐশ্বর্যের চোখে। স্বচ্ছ চোখে আবারও নেমে এসেছে কালো অন্ধকার! পরিবেশ থমথমে। তবে ডেভিল কিংডমের সকলের মাঝেই চাপা আনন্দ বিরাজমান। তাদের কুইন ধ্বংসের সূচনা শুরু করেছে! শুধু আনন্দ আর আনন্দ! রোজি সাহস করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“জয় হক ডেভিল কুইনের! মৃ’তদেহ কোথায় আছে যদি বলতেন তাহলে দ্রুতই তাকে আমরা সরিয়ে ফেলে দিয়ে আসতাম। আমাদের রাজ্যে তার ম’রদেহ অবধি বেমানান।”
ঐশ্বর্য ভরাট গলায় জবাব দেয়,
“সেজন্যই তো ওকে জ্বা’লিয়ে দিয়েছি। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি একাই যথেষ্ট। এতোটাই উত্তপ্ত আগুনের লাভা তৈরি করেছিলাম যে অবশিষ্ট হাড়গোড়ও ছাই হয়ে উড়ে গিয়েছে। তোমাদের এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”
রোজি এবং রোজির বাবা একে ওপরের দিকে ইশারায় তাকালো। আসলে ঐশ্বর্য কোথা থেকে কি করে ফেলল সেটা বোঝাই যাচ্ছে না। সকলের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রোজির বাবা এবার মুখ খুললো। সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো।
“ক্ষমা করবেন তবে আপনার কর্মকান্ড সব আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চেয়েছিলাম যে আমাদের কুইনের অসম্মান করেছে তার শাস্তি আমাদের সামনে হক। কিন্তু হঠাৎ তার শাস্তি হয়ে যাওয়া মানতে পারছি না।”
ঐশ্বর্য ভ্রু কুঁচকায়। কপালে কয়েকটা দৃঢ় ভাঁজের উদ্ভব ঘটে। কাঠকাঠ গলায় বলে ওঠে,
“তোমার কি আমার শক্তি বা ক্ষমতায় সন্দেহ আছে?”
“না না একদম না। আপনি ভুল বুঝছেন কুইন। আমার কথার মানে এমন মোটেও ছিল না। আমি তো শুধু…”
রোজির বাবার কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না ঐশ্বর্য। নিজের র’ক্তমাখা হাতটা চোখের সামনে তুলে মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে গাম্ভীর্যের সাথে বলে,
“তবে আর একটাও কথা নয়। শেখ আনন প্রেমের ইতি ঘটেছে। সেই সাথে তার আলোচনার সমাপ্তিও যেন এখানেই ঘটে। সামনে আমার অভিষেক! সেখানে কোনো ত্রুটি চাই না। আয়োজন শুরু করো।”
রোজি মাথা নাড়ায়। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“অবশ্যই। আপনার অভিষেকের দিন কোনো ত্রুটি থাকবে না। রোজি আপনাকে কথা দিচ্ছে। আর আমি কুইনের জন্য চমকও রাখব।”
টনক নড়ে এবার ঐশ্বর্যের। রোজির দিকে দৃঢ় দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করে,
“চমক? কিসের চমক?”
“চমক চমক হিসেবেই থাক। অভিষেকের দিন আপনার সামনে আসবে। একটু অপেক্ষা করুন কুইন।”
ঐশ্বর্য আর বিষয়টা ঘাঁটালো না। সিঁড়ি থেকেই ঘুরে উঠে একপা একপা করে উঠে গেল। সে দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই সকলে মেতে উঠল আনন্দে। রোজি বিকট হেঁসে বলল,
“শেষ বাঁধাও কুইন নিজে সরিয়ে দিয়েছেন। এখন আর বাঁধা নেই। আর না রইল ঐশ্বর্যকে ডেভিল কুইন থেকে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসে পরিণত করার কোনো আশঙ্কা। এখন শুধু চমকের অপেক্ষা এবং অভিষেকের!”
কেটেছে বাকি তিনদিন। এসেছে সেই রাত। সময়টা নদীর স্রোতের ন্যায় বহমান। কেউ থামাতে পারে না। কারোর সাধ্য নেই। সময় আসবেই! প্রাসাদে বাজছে দামামা। আহ্বান করা হচ্ছে সকলকে। হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছে রাজ্যের সবাই। অন্য সকলের আনন্দের উৎসবে যেমন সুন্দর সুর ভেসে আসে এই সুর তার থেকে ভিন্ন। যেকোনো মানুষের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবার মতো সুর তোলা হচ্ছে বাদ্যযন্ত্রে। লাগাতার বাজানো দামামার সুরে নেই কোনো ক্লান্তি। শুধুমাত্র সুর তরঙ্গে রয়েছে ধ্বং’সের সংকেত।
সেই সুর পেরিয়ে প্রাসাদের সবথেকে বড় কক্ষ থেকে ভেসে আসছে গুনগুনিয়ে গানের শব্দ। চিকন কন্ঠস্বরের কন্ঠ হার মানিয়েছে সেসব বিকট শব্দের। চিকন সেই ঠোঁটজোড়া বিরবির করে চলেছে। নম্র ঠোঁট কালো রঙে আবৃত। আয়নার সামনে বসে থাকা সেই নারী নিজের গলায় জড়িয়ে নিল কালো রঙের ভারী হার। সকলে বলে, অলংকারে নাকি সেই কাঙ্ক্ষিত জনের সৌন্দর্য বাড়ে যেই জন নিজের শরীরের জড়িয়েছে সেই অলংকার। কিন্তু এখানে যেন বিষয়টা পুরোপুরি উল্টো। যখন অলংকার সেই নারী তার গলায় পড়ল তৎক্ষনাৎ বাড়ল সেই হারের সৌন্দর্য! হাতে পড়ে নিল হরেক রকম দামি পাথরের আংটি। কানে ভারি দুলটি পড়তে পড়তেই ডাক এলো তার। বিশ্বস্ত এবং কাছের রোজি এলো কক্ষে। ঐশ্বর্য তৈরি হচ্ছিল এতোক্ষণ। রোজির আগমনে আয়না থেকে পিছু ফিরে তাকালো সে। রোজি ঐশ্বর্যের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠল,
“আপনাকে আজকে অনন্য লাগছে। ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ!”
ঐশ্বর্য অদ্ভুত হাসি দেয়। নিজেকে একবার আয়নায় দেখে লম্বা পোশাক ঠিক করতে করতে বলে,
“অন্যদিন কি লাগে না বুঝি?”
“অবশ্যই লাগে। এতো যত্নে বানানো এতো সুন্দর মুখশ্রী অসুন্দর কারোর লাগতেও পারে না।”
ঐশ্বর্যের হাসি আর গাঢ় হয়। হরিণী চোখ দুটো হাসিতে ছোট হয়ে আসে। সামনে ফিরে বলে,
“হয়ত আজ আমার জন্য একটা বিশেষ দিন সেকারণেই আমাকে সুন্দর লাগছে বেশি।”
“তাই হবে। আমাদের হাতে আর সময় নেই। আপনাকে এক্ষুনি নিচে যেতে হবে। সেই সময় উপস্থিত।”
ঐশ্বর্য কথাটা শুনে একটু জানালার দিকে এগিয়ে যায়। অর্ধ থালার মতো যেই চাঁদের রঙ রূপালী বর্ণে চকচক করে সেই চাঁদের রঙ ধারণ করেছে রক্তিম বর্ণ। সেই বর্ণ দেখেই গা ছমছম করবে। চাঁদের যেন ভয়াবহ দশা। মনে হচ্ছে তাকেও কেউ র’ক্তাক্ত করেছে। ঐশ্বর্য চাঁদ মনোযোগের সঙ্গে দেখে নিয়ে বলে,
“তবে আসন্ন সেই সময়। আমি যাচ্ছি। তুমি যাও।”
রোজি ঐশ্বর্যের কথা মতো নেমে যায়। কিছুক্ষণ পর ঐশ্বর্যও যখন কক্ষের বাহিরে যেতে উদ্যত হবে তখনি তার দৃষ্টি পড়ে তারই বাম হাতে। চমকে ওঠে সে। সেই চিহ্নটা মুছে মুছে গিয়েছে। থতমত খেয়ে দ্রুত সেটা ঠিক করতে করতে বিরবির করে বলে,
“এখনি তো সব ভেস্তে যাচ্ছিল।”
আজ ঐশ্বর্যের অভিষেক। যখন চাঁদকে সূর্য গ্রাস করবে তখন হবে সেই ক্ষণ! ইতিমধ্যে চাঁদকে গ্রাস করছে সূর্য। তাই তো আকাশের অবস্থা ভালো নয়। কেমন যেন ঝিম ধরে রয়েছে চাঁদ। যেই মূহুর্তে চাঁদ পরিপূর্ণ সূর্যের কবলে পড়বে। গ্রাস করবে সূর্য তখনি ভ্যাম্পায়ার শক্তি সমস্ত গ্রাস করবে শয়*তানি শক্তি। ঐশ্বর্যের মাথায় চড়বে ডেভিল ক্রাউন!
ভরা রাজসভা। ঐশ্বর্যও উপস্থিত সেখানে। সকলে আগ্রহ নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখে চলেছে ঐশ্বর্যকে। সকলের মনোযোগ শুধু এবং শুধুমাত্র ঐশ্বর্য। রোজির বাবা উপস্থিত হলো। সকলের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আজ সেই মূহুর্ত। যার জন্য আমরা এতোগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। এসেছে সেই সময় যেই সময়ের পর জয় হবে শুধু আমাদের। আমাদের রাণীর মাথায় চড়বে সেই মুকুট। প্রাণ পাবে সেই মুকুট। তারপর তার ক্ষমতা আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমরা কি সকলে প্রস্তুত?”
ঐশ্বর্য হাসে। সেও খুশি। মনে টান টান উত্তেজনা। সেই মুকুটের ক্ষমতা তাকে টানছে। অতঃপর রোজির বাবার আদেশে আনা হয় সেই মুকুট। কালো কাপড়ে ঢাকা সেটি। ঐশ্বর্যের কাছে আনা মাত্র কৌতুহল বশত কালো কাপড়টি সরিয়ে নেয় সে। দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সেই মুকুট। ডেভিল ক্রাউন। হুবুহু ঐশ্বর্যের হাতে থাকা সেই মুকুটের চিহ্নের মতো মুকুট টি। তবে সেটির বর্ণ কেমন যেন ফ্যাকাশে, প্রাণহীন। নেই কোনো উজ্জ্বলতা! ঐশ্বর্যের কপাল কুঁচকে আসে। রোজি সেখানে তড়িঘড়ি করে বলে,
“বাবা, আর কিছুক্ষণ সময় কি অপেক্ষা করা যায় না? কুইনের জন্য চমক আসছে। বিশেষ একজন। আর উনার হাত থেকেই কুইনের অভিষেক হলে আশা করি কুইনেরও ভালো লাগবে!”
“কিন্তু তা কি হয়? হাতে সময় নেই। সূর্য চাঁদকে গ্রাস করছে। এটাই ঠিক সময়। দেরি করলে সময় যে পার হয়ে যাবে রোজি!”
রোজির বাবার কথায় রোজি হতাশ হয়। আর ঐশ্বর্য হয় বিরক্ত। তবে তার বিরক্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বিরক্তির অবসান ঘটে এক পুরুষালি কন্ঠে। ভীড় সরে যায়। ভীড় সরে সেই কন্ঠের মালিক হেঁটে আসে। মুখে প্রগাঢ় হাসি। বিকট তার কন্ঠস্বর।
“আর দেরি করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। আমি এসে পড়েছি রোজি!”
সকলের দৃষ্টি তখন সরে গিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত জনের ওপর পড়ে। লাল চোখজোড়া, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পরনে কালো পোশাক। এক চেনা পরিচিত মুখ। তবে ঐশ্বর্যের কাছে অচেনা। রোজির হাসি আপনাআপনি ফুটে ওঠে তাকে দেখে। এগিয়ে এসে বলে,
“স্বাগতম আপনাকে ওয়ারওল্ফ কিংডমের ওয়ারওল্ফ কিং অরুণ। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম!”
ঐশ্বর্যের দৃষ্টি এবার স্থির হয় সেই অরুণের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে চেনার চেষ্টা করে সেই অরুণকে। নামটা শোনা শোনা লাগছে। বার বার কানে বাজছে। কোথায় শুনেছে সে? আর ওয়ারওল্ফ শব্দটার সাথেও যেন সে পরিচিত!
ঐশ্বর্যের ধ্যান ভাঙে যখন সে সেই অরুণ নামক পুরুষটিকে নিজের নিকটে আসতে দেখে। নাক শিটকে খানিকটা সরে যায় সে। গায়ে অদ্ভুত গন্ধ লোকটার। অরুণের তাতে কিছু যায় আসে না। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শুধু ঐশ্বর্যের ওপর। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অরুণ আনমনে বলে ওঠে,
“সেই একই রকম সব। সেই দৃষ্টি আমার আজও মনে আছে!”
ঐশ্বর্য চমকে তাকায়। উৎসুক চাহনি নিয়ে চেয়ে বলে,
“কিছু বললেন?”
“নাহ কি বলব আমি? বলছিলাম যে শুরু করা যাক! সময় তো আসন্ন! তোমায় মুকুট আমিই পড়াব।”
ঐশ্বর্য তাকিয়ে থাকে পলকহীন চোখে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আগের মতো হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়। সেই সাথে বাদ্যযন্ত্র বাজানো! মুকুট নিয়ে এগিয়ে আসে দাসী। অরুণ সেটা হাতে নেয়। বাঁকা হেঁসে মুকুট নিয়ে ঐশ্বর্যের মাথার কাছে হাত রাখে! আর বলে,
“শুরু হক ধ্বং’সের অধ্যায়ের।”
ঐশ্বর্য না চাইতেও মুকুট টা নিজের মাথায় রাখার জন্য মাথা ঝুঁকে ফেলে। অরুণ তার মাথায় সযত্নে রেখে দেয় সেই মুকুট। তারপর বিজয়ের হাসি হাসে অরুণ। যখন ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে তার মাথায় মুকুটের আবির্ভাব তখন ঠোঁট বিস্তৃত হয় তারও।
চলবে…