#বিবর্ণ_বসন্ত
২য়_পর্ব
~মিহি
-‘বাবা বিয়ের রাতে আপনাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছেন?’
-‘মারতে চেয়েছিলেন। পরে সবাই ধরে আটকেছিল। তবে এতবছরের সংসারে বেল্ট-জুতোর আঘাত কম পড়েনি পিঠে। তবুও ঐ রাতটা ভাবলে আমার গা শিউরে উঠে। পরিবার-পরিজন সব ছেড়ে যার কাছে এলাম, সেই যদি বেল্ট হাতে মারতে আসে মনের কীরূপ অবস্থা হয় ভাবো।’
-‘কারণ কী ছিল মা?’
-‘আমি ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করিনি তাই। ওনার অপেক্ষা না করেই ক্লান্তিতে বিছানায় বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
অনামিকা নিশ্চুপ হয়ে গেল। এটুকু কারণে কেউ কাউকে বেল্ট দিয়ে মারতে আসতে পারে? এ কেমন অমানবিক কাজ! সোহরাবও কি পুরোপুরি তার বাবার স্বভাবটাই পেয়েছে?
-‘এই ভর্তায় এত মরিচ দিস না অনু, সোহরাব ঝাল খেতে পারেনা।’
-‘উনি তো খেয়েই আসবেন মা। ভর্তা তো শুধু সকালের জন্য করেছি।’
-‘ও ছোট মাছ ভর্তা পছন্দ করে খুব। ওর জন্য একটু তুলে রাখ।’
-‘আচ্ছা মা।’
-‘চল খেতে বসে যা। আমি রাহেলাকে ডেকে আনি।’
-‘ঠিক আছে মা।’
অনামিকা শাশুড়ি আর ফুফু শাশুড়ির জন্য খাবার বেড়ে নিজেও খেতে বসে পড়লো। সকাল থেকে গরমে আর কাজের চাপে শরীরটা নুইয়ে পড়েছে। একটু না খেলে যেন এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। তাই অপেক্ষা না করে এক লোকমা খাবার মুখে তুলল।
‘সে কী ছোট বউ! শাশুড়ি, ফুফু শাশুড়িকে ছেড়ে দিব্যি খেতে বসে গেছো! দেখছো ভাবী, এ মেয়ের তো আদব-লেহাজও নাই।’ কথাটা বলতে বলতে রাহেলা ধপ করে অনামিকার সামনে বসলো।
-‘মাফ করুন ফুফু। আসলে শরীরটা খারাপ লাগছিল তাই বসে পড়েছি। আপনাদের খাবার প্লেটে সাজিয়েই রেখেছি আমি।’
-‘তাতে কী? উদ্ধার করেছো আমাদের? বাড়ির বউ সবার শেষে খাবে। যাও উঠো।’
অনামিকা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সাজিয়া চেয়েছিল অনামিকা প্রতিবাদ করুক কিন্তু সকালে সাজিয়ার বলা কথাটাই সে মনে গেঁথে ফেলেছে।
-‘অনু, তুই বোস। খাবার টেবিলে একজনকে উঠে যেতে বলা অভদ্রতা ছোটো। তাছাড়া ও তো সব করেই খেতে বসেছে।’
-‘এত মাথায় তুলো না ভাবী পরে হাহুতাশ করে কুল পাবা না।’
-‘আচ্ছা দেখবোনে, তুই খেয়ে নে তো। সোহরাব নাকি তোর ওখানে যাবে আজ দুপুরবেলা তোকে রেখে আসতে।’
রাহেলা আর কিছু বললেন না। খেতে গিয়ে খাবার দেখে আবারো চোখমুখ কুঁচকালেন।
-‘এসব কী ঘাস রেঁধেছো? একটু মাংস করতে পারোনি?’
-‘মাংস পাইনি ফুফু সকালে, সোহরাব পরে এনেছে তাই রাঁধা হয়নি। দুপুরে রাঁধবো।’
-‘অতিথি আপ্যায়নের ন্যূনতম শিক্ষা নেই।’
খেতে বসে এত কটু কথা শোনার অভ্যেস নেই অনামিকার। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলেছে। এক মা ছাড়া তিন কূলে কেউ বেঁচে নেই। দারিদ্র্যের মাঝেও মাকে কখনো কষ্ট অনুভব করায়নি সে আর না মা তাকে। অথচ এখানে আসার পর থেকে কষ্ট ব্যতীত কিছু পাচ্ছে না সে।
সবার খাওয়া শেষ হলে প্লেটগুলো ধুয়ে অনামিকা নিজের ঘরে গেল। ছাদের চিলেকোঠায় গতরাতের কাপড়গুলো ঝোলানো ছিল। নিজের কাপড় রাখতেই দেখতে পেল তার ফুফু শাশুড়ির ওড়না নিচে ঝোপঝাড়ের মধ্যে। ওড়নাটা নিয়ে ঘরে দিতে এলো অনামিকা।
-‘ফুফু, আপনার ওড়না! ঝোপঝাড়ে পড়েছিল, ধুয়ে নিয়েন।’
রাহেলা সে কথা কানেই তুললো না। নতুন ওড়না তিনি ছাদে মেলেছেন, ঝোপঝাড়ে কেন যাবে? মেয়েটা মিথ্যে বলছে। গোসল সেরে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই অনুভব করলেন তার সারা গা চুলকাচ্ছে। ছটফট করতে করতে গা চুলকাতে লাগলেন তিনি। বাথরুমে ঢুকলেন হাতে গলায় পানি হাতে। আচমকা পা পিছলে সেখানেই পড়ে গেলেন। এদিকে চুলকানিও কমছে না। উপায় না পেয়ে চেঁচিয়ে সাজিয়াকে ডাকতে লাগলেন তিনি।
-‘ছোটো, কী হলো তোর? এমন বাথরুমে পড়ে আছিস কেন?’
-‘তোলো ভাবী আগে।’
রাহেলা বানুকে একা তুলতে না পেরে সাজিয়া অনামিকাকে ডাকলেন। দুজন মিলে রাহেলাকে তুলে বিছানায় বসালো। রাহেলা বানু তখনো গা চুলকাতে ব্যস্ত।
-‘শান্ত হয়ে বোস। গায়ে কী হয়েছে? গলা লাল হয়ে গেছে। পিঁপড়ে কামড়েছে?’
-‘না রে ভাবী। চুলকাচ্ছে। নির্ঘাত এই তোর বৌমা কিছু করেছে। ও আমাকে এই ওড়না দিয়েছে। ঐ কিছু করেছে।’
-‘ফুফু, আমি আপনাকে বলেছিলাম এটা ঝোপঝাড়ে পড়েছিল, ধুয়ে পড়তে হবে। আপনি কেন পড়লেন?’
-‘চুপ মেয়ে!’
-‘তুই চুপ কর ছোটো। বেশি বকিস তুই। কথা শোনা নাই, এখন বোঝ। অনু যা তো বরফ আন একটু। আর কালোজিরা দিয়ে তেল গরম করে আন।’
অনামিকা বরফ দিয়ে এসে তেল কুসুম গরম করলো। অনামিকার অবশ্য খারাপ লাগা উচিত তবে তার খারাপ লাগছে না। সে নিষেধ করেছিল তবুও তিনি কথা শোনেননি, এখন বুঝলো তো মজা। ঠোঁট টিপে হাসছে অনামিকা। সোহরাব এখনো আসেনি। কে জানে এতক্ষণ কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেল পিরিচে করে সাজিয়ার কাছে নিয়ে গেল অনামিকা।
-‘মা, এটা কুসুম গরম। এখন মালিশ করলে আরাম পাবে ফুফু। আমি মালিশ করে দিই?’
-‘তুই বরং দুপুরের রান্না বসা। আমি মালিশ করে দিচ্ছি।’
অনামিকা ঘর ছেড়ে বেরোতেই সোহরাবকে দেখতে পেল। সোহরাব হাসতে হাসতে একটা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকছে। অনামিকা ভ্রু কুঁচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটাকে সে বিয়েতে দেখেছিল কিন্তু পরিচয় মনে করতে পারলো না। অনামিকা সোহরাবকে জিজ্ঞাসা করার জন্য এগোলো কিন্তু সোহরাব পাত্তা না দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। অনামিকা অপমানবোধ করলো। স্ত্রীকে দেখেও না দেখে চলে যাওয়া নিতান্তই অপমান। রান্নাঘরে গিয়ে দুই গ্লাস শরবত বানালো অনামিকা। অতঃপর সোহরাবের ঘরের দিকে এগোলো।
-‘আরে অনামিকা, শরবত এনেছো? আমি মাত্রই তোমাকে বলতে যাচ্ছিলাম। তন্বী, শরবত নে। আর অনামিকা তন্বীকে চিনেছো? রাহেলা ফুফুর একমাত্র মেয়ে।’
তন্বী বয়সে সুমির সমান হবে। অনামিকাকে দেখামাত্র তন্বী সালাম দিল। ভাবী বলে জড়িয়ে নিলো। মেয়েটার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলো অনামিকা। শরবত খেয়ে তন্বী অনামিকার পিছু পিছু ঘুরতে লাগলো।
-‘তন্বী, যাও ঘরে বসো। এখানে গরম তো। আমি রান্না শেষ করি, তুমি বিশ্রাম নাও।’
-‘আহা ভাবী, আমি মোটেও বিশ্রাম করবো না। তোমার সাথে কত গল্প জমে আছে জানো?’
-‘তোমার মা বাথরুমে পড়ে গেছিল। যাও দেখা করে এসো।’
-‘সে কী! মা-ও না! আমি দেখে আসি ভাবী, থাকো।’
অনামিকা হাসলো। বাচ্চা একটা মেয়ে! একদম সুমির মতোই মিশুক। অনামিকা মুরগীর মাংসের তরকারি তুলে দিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করলো। উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। তরকারি নামিয়ে রাখতেই অনামিকার মনে পড়লো সোহরাবের ঘরে শরবতের গ্লাস দুটো রেখে এসেছে, ওগুলো এনে ধুয়ে রাখতে হবে। গরমের যন্ত্রণায় অনামিকা রান্নাঘরে দাঁড়াতে পারছে না। ইলেকট্রিসিটি তো যেন পূর্ণিমার চাঁদ, হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে। দ্রুত পায়ে সোহরাবের ঘরের দিকে এগোল সে।
‘রাইসাকে বিয়ে করলে এটলিস্ট এত ঝামেলা পোহানো লাগতো না আমার।’ সোহরাবের মুখে কথাটা শোনামাত্র অনামিকার পা থেমে গেল। কী বললো এটা সোহরাব? কে রাইসা? সোহরাবের প্রেমিকা? প্রেমিকা ছেড়ে তবে অনামিকাকে কেন বিয়ে করলো সোহরাব? প্রশ্নগুলো জট পাকাচ্ছে অনামিকার মাথায়। তাকে দেখামাত্র সোহরাব ফোনে কথা বলা থামিয়ে দিল। অনামিকা গ্লাসদুটো নিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
রাহেলা বানুর আজ আর যাওয়া হলো না। চুলকানিতে গলার অবস্থা শেষ আবার কোমড়ের ব্যাপারটাও শোচনীয়। দুপুরবেলা তন্বী তাকে খাইয়ে দিলো। অনামিকা সোহরাবের জন্য রাখা মাছভর্তাটা পাতে তুলে দিল। এক লোকমা মুখে নিতেই সোহরাব রাগী দৃষ্টিতে অনামিকার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই ভর্তাটুকু তুলে ময়লা ফেলার পাত্রে ফেলে দিল। অতঃপর বজ্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,’ভর্তা কি বরফ দিয়ে বানিয়েছো? একে তো ঠাণ্ডা তারপর পানসে। রান্নাবান্নাও পারোনা, মেয়ে হয়ে তবে পারোটা কী? শুধু খাওয়া?’
চলবে…