বেলির কথা পর্ব-২১

0
289

#বেলির_কথা (২১)

.
বেলি এখন অনেকটা গম্ভীর হয়ে গেছে।হয়তো সময় পাল্টাতে পাল্টাতে এমন হয়।বেলিরা গ্রামে পৌছে গেছে। বেলি হেনাকে গাড়ি থেকে নামতে বলে।

হেনা কিছু না বলে ধুপধাপ পা পেলে বিরক্তি নিয়ে নামে।তারপর আগে আগে হাটা দেয়।

বেলি হাসনাতকে বলে,
‘মেয়েটা এমন করে কেন বুঝিনা।’
‘বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আপনার শুধু এই এক কথা।’
‘হুম এখনো ছোট বয়স।হয়তো তাই।’

বেলি কি মনে করে কথা ঘুরায়।
‘এখন দেখবেন আমার আম্মা দৌড়ে এসে কিভাবে ঝাপটে ধরে আমাকে।কি শান্তি লাগে আমার।আমার মনে হয় আমার আম্মা ছোট হয়েই আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে।’

হাসনাত হাসে।আর বলে,
‘সত্যিই মিরা তোমাকে ওর মায়ের থেকেও বেশি পছন্দ করে।’

দরজার সামনে অপেক্ষা করে আছে মিরা আর শহিদ।যখনি মা বলেছে আজকে ও ফুফি আসবে মিরার আর অপেক্ষার শেষ নেই।শাহেদ আর মিতুর দ্বিতীয় সন্তান মিরা।বেলির মা।মিরাকে বেলি আম্মা নয়তো পাখি বলেই ডাকে।মিরা দেখতে একদম বেলির মায়ের মতো হয়েছে।

মিরা দূর থেকে হেনাকে দেখতে পায়।মিরা শান্ত হওয়ায় হেনার সাথেও ভাল বন্ধুত্ব যদিও হেনার মিরাকে ও তেমন পছন্দ না।তবে শহিদ হেনার সাথে কথা বলেনা।এমন বদরাগী মেয়ে তার পছন্দ নয়।

মিরা দৌড়ে যায়।
‘ফুফি এসে গেছে।’

মিরার চিল্লানিতে বেলির মন আনন্দে নেচে উঠে।এইতো তার আম্মা।মিরা গিয়ে ঝাপটে বেলিকে জড়িয়ে ধরে।
‘তোমাকে কত মনে পড়েছিল ফুফি।’
‘আমার ও আমার মায়েদের মনে পড়ছিল বলে ছুটে এসেছি।’

শহিদ বেলিকে হাসনাতকে সালাম করে।বেলি শহিদকে জড়িয়ে ধরে।শহিদকে জড়িয়ে ধরলে বাবা আছে, সেটা ভেবে বেলি শান্তি পায়।
.
হাসনাত মিরাকে কোলে নেয়।
‘কেমন আছো আম্মু।’
‘ভালো আছি।’

হেনা মিরাকে নিজের বাবার কোলে দেখে রাগ করে আরো আগে আগে হাটে।মিতু দরজার বাইরে মাথা এগিয়ে দেখে বেলিরা আসছে কিনা?তখন দেখে হেনা আগে আসছে। মিতু তাড়াতাড়ি হেনার কাছে যায়।
‘কেমন আছো আম্মু টা?’
‘ভাল নেই।’
‘কেন?’
‘বাবাই মিরাকে কোলে নিয়েছে কেন?আমাকে কোলে নিলে আর হাটতে হতোনা।’
‘মিরা ত ছোট তাই।তুমি ত বড় হচ্ছো?’
‘জানি আমি। কেউ আমাকে এত আগের মত ভালবাসে না।’

মিতুর অবাক লাগে।বেলির মেয়ে এমন কিভাবে হয়?
তবুও মিতু বলে,
‘আসো আমি ই কোলে নিই?’
‘এসেই পড়েছি তার আর দরকার নেই।’
.
বেলি মিতুকে সালাম করে।হেনাকে বলে,
‘মামিকে সালাম করেছো?’
হেনা চুপ
‘কিছু বলছি।আসো সালাম করো?’

হেনা আসে না।বেলি হেনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘সালাম দিলে কেউ ছোট হয়ে যায় না বড় হয় যে।’
‘পারব না দিতে?’
‘রাগ ফেলে দাও।নইলে কপালে অনেক দুঃখ আছে।’

মিতু এসে বলে,
‘থাক আর বলিস না।বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।’

বেলি চুপ করে থাকে।
হেনা এসে শাহেদ আর মিতু দুজনকেই সালাম করে।
.
আজ সারাদিন বেলিদের অনেক মজায় কাটলো।মিতু বেলিকে বলে,
‘তুই আসবি শুনে তোর আম্মায় তোর ভাইকে আর বসতে দিচ্ছেনা।ফুফি কি পছন্দ করে?কি খায়?খালি বকবক করেই যাচ্ছে।মেয়েটা এত তোর পাগল।’

বেলি হাসে।
.
বেলি হাসনাতকে নিয়ে বিকেলের দিকে বের হয়।উদ্দেশ্য মায়ের কবর জেয়ারত করবে।হাসনাত ছেলে হওয়ায় প্রতিদিন নিজের বাবা মায়ের কবরের পাড়ে দাঁড়ায়।বেলির যে সে সুযোগ হয়ে উঠেনা।

বেলি হেনা আর মিরাকে নিয়ে মায়ের কবরের পাড়ে দাঁড়ায়,
‘আম্মা দেখো আমার দুই মা কে নিয়ে প্রতিবারের মত আবারো এসেছি।আমি চাই তোমার মতো আমি ও ভাল মা যেন হতে পারি।মেয়েকে মানুষ করতে পারি।’

হেনা চুপ করে থাকে।মায়ের এমন কান্ডে সে চরম বিরক্ত।কিন্তু মিরা ফুফির কান্না দেখে নিজেই কেঁদে ফেলে।ছোট হাত দিয়ে কান্না মুছে দেয়।বেলি হেনা মিরা দুজনকেই জড়িয়ে ধরে।
.
.
একদিন থেকেই বেলিরা চলে আসে।মিরা প্রতিবারের মতো ফুফি ফুফি বলে কান্না করে।বেলি ও কাদে।
হেনার স্কুল রয়েছে।ছুটির সময় না হয় আবার আসবে।
.
প্রতিদিনের মতো হাসনাত কলেজে আগে যায়।বেলি হেনাকে সহ নিয়ে পরে আসে।কলেজের পাশেই হেনার স্কুল। হেনাকে স্কুলে দিয়েই বেলি কলেজ যায়।

হেনার স্কুলে তার নিজের কোনো ফ্রেন্ড নেই।কেউ তার সাথে ভাল করে কথা বলতে চায়না।তাই হেনা সবার উপর বিরক্ত।একা একা বেঞ্চে বসে।প্রথম প্রথম স্কুলে গেছিল তখন অনেক ফ্রেন্ড ছিল।কিন্তু হেনা কারো সাথে ভাল ব্যবহার করত না মারামারি করত বলে আস্তে আস্তে এখন তার সাথে কেউ ই কথা বলেনা।বেলিকে অবশ্য এসব বলে ও না।তাই বেলি এসব জানেনা।

হেনা বেঞ্চে বসে রাগে ফুঁসছে।তবুও সে ক্লাসমেট রাইসাকে ডেকে বলে,
‘এই আমার পাশে বসো?’

রাইসা তখন অন্যজনকে বলে,
‘এই তুই যা ওর পাশে বস?’
হেনা তখন বলে,
‘ওকে বলেছি?তোমাকে বলেছি।ও যে কালো।আমার কালো মানুষ পছন্দ না।ভুতের মতো লাগে দেখতে।’

হেনার এমন কথায় মেয়েটি কষ্ট পায়।মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেলে।তখন রাইসা বলে,
‘তুই একায় থাক।আমার কালো ফ্রেন্ড ভাল।’
‘কিহ আমি ভাল না?তবে রে?’

হেনা গিয়ে রাইসার খাতা ছিঁড়ে ফেলে।রাইসা তখন হেনার ও খাতা ছিঁড়ে দেয়।হেনা রাইসার গালে থাপ্পড় দেয়।রাইসা ও হেনা কে দেয়।দুজনের মারামারি তে ক্লাস টিচার চলে আসে।

ক্লাস টিচার এসে এদের থামায়।তখন পুরা ঘটনা সবার থেকে শুনে।বেলিকে স্কুলে ডাকা হয়।
টিচার রা বেলিকে নম্রভাষায় বাচ্চার এমন বিহেভের কথা বলে।খুব সহজে বেলিকে দোষারোপ করা হয়।একজন মা শিক্ষা দেয়নি বলে মেয়ে এমন হয়েছে এমন ইঙ্গিত করা হয়।অপমান এ বেলির কান্না চলে আসে।প্রিন্সিপাল বলেন,
‘আপনি ও একজন টিচার।আমি আপনার হাসবেন্ড কে ডাকিনি এজন্য একজন বাচ্চা মায়ের থেকেই বেশি শিখে।আশা করি বাচ্চাকে বুঝাবেন?’

বেলি ক্ষমা চেয়ে নেয়।তারপর হেনাকে নিয়ে স্কুল থেকে বের হয়।হাসনাত বেলির জন্য অপেক্ষা করছিল।তিনজনেই প্রতিদিন একসাথে বাসায় যায়।
‘কি সমস্যা?টিচার কেন ডাকলো?’

বেলি চুপ করে আছে।
‘বলো?’
‘জানিনা।’

হাসনাত হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মামনি তুমি বলো?রেজাল্ট খারাপ হয়েছে?’

হেনা ও চুপ করে আছে।
বেলি বলে,
‘বাসায় চলুন?’

বাসায় গিয়ে বেলি হেনার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
শান্তস্বর এ বলে,
‘মায়েরা সন্তানদের স্কুলে কেন পাঠায় জানো?’

হেনা চুপ।
‘কারণ সন্তানরা মানুষ এর মত মানুষ হবে বলে।বই পড়ে নীতি, ব্যবহার শিখবে বলে এইজন্য।মারামারি করার জন্য তো নয়।এমন হলে স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।যে মেয়ে স্কুলে গিয়ে ভাল কিছু শিখতে পারেনা সে মেয়েকে ঘরেই মানায়।’

হাসনাত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।বেলি হাসনাতের দিকে তাকায়।
‘আপনার মেয়ে কবে বড় হবে বলুন তো আমায়?ওর বয়সী সেখানে অনেক মেয়েই আছে কই তারা তো এমন নয়?তাহলে?সত্যিই কি আমি মেয়ে শিক্ষা দিতে জানতেছি না?আমি সারাজীবন শিখিয়েছি আদব-কায়দা।আর মেয়ে সবকিছুর উলটা!’

বেলি হাসনাতকে সব খুলে বলে।হাসনাত হেনার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘এসব ঠিক না মামনি।তোমার জন্য দেখলে না টিচাররা তোমার আম্মুকে বকেছে?’

হেনা তখন ব্যাগ ছুড়ে মারে,তারপর বেলির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি আসলেই আমার মাম্মাম?নাকি রাইসার?আমার মাম্মাম হলে আমাকে বকতে না।’

বেলি তখন বলে,
‘অন্যায়কে অন্যায় বলতে হবে।তুমি আমার মেয়ে বলে অন্যায় করে যাবে আমি কিছু বলব না,ভাবলে কি করে?’
‘অথচ আমার ফ্রেন্ড এর মায়েরা ওদের কে কত ভালবাসে।আর তুমি আমাকে ভাল ই বাসো না।’
‘ওরা কি তোমার মতো দুষ্টুমি করে ভালবাসা পায়?’
‘আমি যা করি বেশ করি।’

হাসনাত হেনাকে টেনে বলে,
‘তুমি এখনো অনেক ছোট ভুলঠিক তুমি কিভাবে বুঝবে বলো?’

বেলি ছোট করে বলে,
‘যে সন্তানকে পেয়ে পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে গেলাম।যাকে আগলে রেখেছি এমন ভাবে যে, কোনো আঘাত তাকে ছুতে পারেনি।আর সে মেয়ে বলে কিনা আমি তাকে ভাল ই বাসিনা?’

হাসনাত হেনাকে বুঝায় কিন্তু হেনা বুঝতে রাজিনা।
বেলি এসে বলে,
‘ফের যদি তুমি স্কুলে গিয়ে মারামারি করো তাহলে মাইর একটা ও নিচে পড়বে না।সব তোমার পিঠে পড়বে।’

হেনা তখন রুমে চলে যায়।বেলি ও চুপ হয়ে যায়।সকলে ফ্রেশ হয়ে নেয়।বেলি হাসনাত নামাজ পড়ে নেয়।হেনা ও নামাজ শিখেছে।তবে পড়তে চায়না।

বেলি খাবার রেডি করে হাসনাতকে ডাকে।কিন্তু হেনা আসেনা।বেলি তখন বলে,
‘আপনি খেয়ে নিন।আমি পরে খাইয়ে দিব ওকে?’

হাসনাত বলে,
‘এত চিন্তা করিও না।আল্লাহ চাইলে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
.
বেলি প্লেটে করে ভাত নিয়ে হেনার পাশে বসে।
‘উঠো ভাত খেয়ে নাও।’
‘খাব না।’
‘না খেলে আর কখনো ভাত খেতে দিব ও না।’
‘তা দিবে কেন?তুমি কি আমাকে ভালবাসো?’
‘হ্যা বাসি না।উঠো খেয়ে নাও?’

বেলির জুরাজুরিতে ও হেনা উঠেনা।জেদ করে বেলির হাতে ধাক্কা দেয়।তবে বেলি প্লেট শক্ত করে ধরায় ভাতগুলো পড়ে না।পড়লে কতগুলো ভাত নষ্ট হয়ে যেত এইভেবে বেলি ঠাস করে হেনার হাতে দুইটা চ*ড় দেয়।

হেনা কেঁদে উঠে।তখন বেলি জোর করে হেনাকে বসায়,তারপর ভাত খাইয়ে দেয়।তখন হেনা কেঁদে বলে,
‘আমি ব্যাথা পেয়েছি,তুমি ভাল মাম্মাম না।তুমি খারাপ মাম্মাম।’

বেলির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।অথচ মায়েদের ও ব্যাথা হয়,ব্যাথা পায় সেটা কি সন্তান রা বুঝে?

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

#তাহরীমা