ভালোবাসি তারে
১২.
তীব্র অপমান বোধে নিঝুমের সামনে আর যায় নি ঝুম। পরেরদিন পড়ার রুমে যাওয়ার সময় এমনভাবে নিঝুমের রুম পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল ঝুম, যেন সেখানে কোনো রুমই নেই। নিঝুম খেয়াল করে ব্যাপারটা। কাল কি হয়েছিল নিঝমের সে জানে না। শুধু রাগ হচ্ছিল তার। এমন রাগ, যা কোনো কিছু ধ্বংস করতেও দু’বার ভাববে না। শিরা-উপশিরার রক্ত উথলে উঠছিল। কপালের রগগুলো ব্যথা করছিল প্রচুর। তারপর যখন নিঝুম শান্ত হলো, তখন বুঝতে পারলো সে ভুল করেছে। ঝুমকে সরি বলবে বলেও ভেবেছে। কিন্তু কিছু একটা বাঁধছে তার। বলতে পারছে না।
অপরাধ বোধে নিঝুম একবার পড়ার রুমে গিয়ে দেখে এসেছে ঝুমকে। ঝুম খেয়াল করে নি। ঝুমের মলিন মুখ একদম ভালো লাগে নি নিঝুমের। মেয়েটাকে হাসি-খুশিই মানায়। নিঝুম ভেবে নেয়, সে ঝুমকে সরি বলবে। ঝুম যখন নিধাকে পড়ানো শেষে চলে যাচ্ছিল নিঝুম দ্রুত ডেকে উঠে,
— “ঝুম? একটু রুমে আসবে?”
নিঝুমের গলার স্বর শুনে ঝুম থমকে যায়। একবার ভাবে যাবে না। কিন্তু তার মনটা যে ভীষণ বেহায়া। ঠিকই চলে গেল নিঝুমের কাছে। রুমে ঢোকার আগে দরজায় টোকা দিয়ে ম্লান কণ্ঠে বলল,
— “আসতে পারি?”
নিঝুম নিষ্পলক তাকালো ঝুমের পানে। ঝুম যে কষ্ট পেয়ে কথাগুলো বলছে, তা বুঝতে বাকি রইলো না তার। নিঝুম শান্ত স্বরে বলল,
— “পার্মিশন নিতে হবে না ঝুম। আসো।”
কথার পিঠে আর কিছু বলে না ঝুম। ধীরে এগিয়ে যায় নিঝুমের কাছে। মাথা নত করে নিঝুমের এক হাত দূরত্বে দাঁড়ায়। নিঝুম একটা কাগজ এগিয়ে বলে,
— “তোমার জন্য এঁকেছি। দেখো তো কেমন হয়েছে।”
ঝুম কাগজটা নিলো ঠিকই, কিন্তু খুলে দেখলো না। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “কি হলো? খুলছো না কেন?”
ঝুম কিছু বলে না। কাগজটা খোলা তো দূরের কথা। নিঝুম এবার উঠে দাঁড়ালো। উঁচু গলায় বলল,
— “কি বলেছি?”
ঝুম এবারো চুপ। তার দৃষ্টি এখন নিঝুমের পায়ের দিকে। থ্রি-কোয়াটার পেন্টে নিঝুমের লোমশ পা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো ঝুম। এসব কি? পা কোনো তাকানোর জিনিস হলো? বারবার ওদিকেই চোখ যাচ্ছে কেন? ঝুমের নিজের ওপর রাগ হলো। নিজেকে গালাগাল করে প্রতীজ্ঞা করল আর তাকাবে না পায়ের দিকে। নিঝুম এবার কড়া গলায় বলল,
— “কিছু জিজ্ঞেস করেছি ঝুম? শুধু শুধু রাগাচ্ছো কেন?”
ঝুমের কান্না পেলো এবার। কাগজটা খুলে দেখলো সে। অবাক হলো। নিঝুম তার ছবি এঁকেছে। হাসোজ্জল ঝুমের সাদা-কালো স্কেচ। ঝুমের দুইপাশে বেণী করা। ছোট ছোট চুলগুলো কপালে এলোমেলো অবস্থায় পড়া। মুখে মিষ্টি হাসি। ঝুম মুগ্ধ হয়ে তাকায় স্কেচটার দিকে। নিঝুম অধীর অগ্রহে ঝুমের কিছু বলার অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঝুম কিছু বলল না। কিছুক্ষণ স্কেচের দিকে তাকিয়ে কাগজটা আবারো রোল করে নিলো। নিঝুম আশাহত হলো। কিছুক্ষণ নিজের মাঝে আমতা আমতা করে বলল,
— “সরি ঝুম।”
ঝুম অবাক হয়ে তাকায় নিঝুমের দিকে। শুকনো ঢোক গিলে। চোখ টলমল করছে তার। নিঝুম আবার বলে,
— “আমার কালকে ওসব বলা উচিত হয়নি। সরি!”
ঝুম কষ্টের মাঝেও হালকা হাসে। নিঝুমের মায়াময় চোখজোড়া যেন ঝুমের সব রাগ নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়েছে। নিঝুমের অস্থিরতা উপভোগ করছে ঝুম। আচ্ছা, ভালোবাসার মানুষের সাথে রাগ করা যায় না কেন? হয়তো সে ভালোবাসার মানুষ বলে। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে ঝুম মুচকি হেসে বলল,
— “আপনি যেন আমার কি?”
নিঝুম অবাক হয়। প্রশ্ন করে,
— “মানে?”
— “মানে, আপনি আমার ডাক্তার। ডাক্তারদের সাথে কি কেউ রাগ করতে পারে?”
ঝুমের কথা নিঝুম বোঝে না ঠিক। চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ঝুম বলে,
— “এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমার শাড়ির মতো আপনাকেও বিশ্রী দেখাচ্ছে। একদম সিগ্রেটের পঁচা গন্ধের মতো।”
বলে ঝুম খিলখিল করে হেসে উঠে। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ঝুম আবার বলল,
— “আমি তাহলে এখন আসি ডাক্তার?”
— “কালকে শহরে যাবো সবাই। শপিং করতে। সকাল, সকাল এসে পরবে কেমন?”
ঝুম মুচকি হেসে বলে,
— “আন্টি বলেছে বিকেলে।”
— “ওহ্!”
কথা বাড়ে না আর। কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। ঝুম যেতে উদ্যোগ হতেই নিঝুম বলে,
— “সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। আজ আর হেঁটে হেঁটে যেতে হবে না। ড্রাইভার চাচাকে ফোন করছি। গাড়িতে যাবে, ঠিকাছে?”
ঝুম মনে মনে আওড়ায়,
— “কেন? আপনি দিয়ে আসলে কি হবে? এত অলস কেন আপনি? সিগ্রেটখোর একটা!”
কিন্তু বাহ্যিক দিক দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকায় ঝুম। পরপরই চলে যায়। সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবারো কাজে মনোযোগ দেয় নিঝুম। এখন শান্তি শান্তি লাগছে নিঝুমের। বোঝা নেমে গেছে যেন।
_________________
মিষ্টি রোদের রৌদ্রমাখা বিকেল। মেঘলার বিয়ের শপিং করতে মলে এসেছে শাখাওয়াত শেখ বাদে জমিদার বাড়ির সকল সদস্য। মেঘলার বিয়ের শাড়ি কিনতে মিসেস সানজিদা প্রথমেই শাড়ির দোকানে গেলেন। নিঝুম একহাতে নিধার হাত শক্ত করে ধরে, অন্যহাতে ফোন চাপছে। দৃষ্টি তার ফোনেই নিবদ্ধ। ঝুম সবাইকে শাড়ি সিলেক্ট করে দিচ্ছে। হঠাৎ একটা শাড়ি চোখে পড়ে ঝুমের। বেগুনি রঙের শাড়ি। পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে নিলো ঝুম। অন্যের জন্য শাড়ি কিনতে এসে নিজের জন্য শাড়ি দেখা নিত্যান্তই অবাস্তবিক এবং বোকামি। সুতরাং, সেদিকে আর মনোযোগ দিলো না ঝুম। কিছুক্ষণ পর নিঝুম এসে ঝুমের পাশে দাঁড়ালো। স্মিত হেসে বলল,
— “ওই শাড়িটা মানাবে না তোমাকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা কিনতে পারো। ভালো লাগবে।”
নিঝুমের ইশারা অনুযায়ী শাড়িটির দিকে তাকালো ঝুম। কাজ তেমন না থাকলেও বেগুনি রঙের শাড়িটার চেয়ে সাদা রঙের শাড়িটাই দ্বিগুণ সুন্দর। চোখ ধাধানো সুন্দর। কিন্তু পুরোনো কথা মনে পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলল ঝুম। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলে উঠল,
— “আমি শাড়ি পড়া ছেড়ে দিয়েছি।”
নিঝুম থমকে যায়। অবাক নয়নে তাকায় ঝুমের দিকে। প্রশ্ন করে,
— “এমন বলছ কেন? তুমি না আমাকে ক্ষমা করেছো?”
ঝুম কিছুক্ষণ চুপ থাকে। পরপরই মুচকি হেসে বলে,
— “সত্যি! শাড়ি পরতে ভালো লাগে না আমার। তাই ছেড়ে দিয়েছি। শুধু শুধু কেনার কি দরকার?”
নিঝুম আর কথা বাড়ায় না। নিঃশব্দে ঝুমের কাছ থেকে সরে আসে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে নিঝুমের। দম বন্ধ অনুভূতি হচ্ছে।
শপিংমল থেকে বের হয়ে ফুটপাতে হাঁটছিল সবাই। একটু দূরেই গাড়ি পার্ক করা আছে। নিঝুম, ঝুম আর নিধা একসাথে হাঁটছে। আইসক্রিমের ঠেলা দেখে নিধা বলল,
— “ভাইয়ু, কোণ-আইসক্রিম খাবো।”
নিঝুম একবার নিধার দিকে তাকিয়ে তারপর ঝুমের দিকে তাকায়। বলে,
— “তুমি খাবে ঝুম? কোনটা?”
ঝুম বলল,
— “নিধা যেটা বলল সেটা।”
— “এখানে দাঁড়াও। নিয়ে আসছি আমি।”
নিঝুম চলে গেল আইসক্রিম আনতে। কিছুক্ষণ পর সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এলো। ঝুমদের খানিকটা দূরেই মেঘলা আর আকাশ হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। নিঝুম তাদের আইসক্রিম দিতে যেতেই একে অপরের হাত ছেড়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল তারা। নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হাসে। আইসক্রিম দিয়েই চলে আসে ঝুমের কাছে। ঝুম আইসক্রিম খেতে খেতে হঠাৎ বলল,
— “জানেন? আমাকে একটা ছেলে পছন্দ করে। সাগ্রত নাম। ভাবছি ওর প্রপোজে রাজী হয়ে যাবো।”
নিঝুম আইসক্রিম খেতে নিচ্ছিলো। এমন কথায় কেঁশে উঠল। বিস্ময় ভরা নয়নে ঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “কি বললে?”
ঝুম নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
— “যা শুনলেন। আচ্ছা, আপনি কি আইসক্রিমও খান?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
— “মানে?”
— “আপনার যে হারে সিগ্রেট প্রিয়! অন্যকিছু খাওয়ার সময় আছে নাকি আপনার? তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুম। নিঝুম হাসতে পারলো না। অস্থির অস্থির লাগছে তার। রাগ হচ্ছে। মাথা গরম হয়ে গেছে। কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিঝুম। তবুও রাগ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে ফেলল নিঝুম। ঝুমের সাথে আর একটিও কথা বলল না।
_______________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা