#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-০৩]
~আফিয়া আফরিন
বরপক্ষকে তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসানো হয়েছে। বাড়ির বাইরে বিয়ের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। তবুও ঘরের ভেতর শোরগোল লেগেই আছে। জুহি সবাইকে পাশ কাটিয়ে মিমির ঘরে পা বাড়াবে সেই মুহূর্তে পেছন থেকে তার নানু আঞ্জুমান বেগমের ডাক পড়ল।
‘এই জুঁই, শুইন্যা যা তো। এমনে সক্কলের সামনের তে পালাইয়া পালাইয়া থাকস ক্যা? দেহি, এমনে আয়।’
জুহি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নানুর কাছে এগিয়ে যায়। তার পাশে বসে সামান্য হাসে। আঞ্জুমান বেগম তাহেরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তোমাগো এই একটা কাহিনী বুঝলাম না বউ। বড়ো মাইয়াডারে এমনে রাইখা ছোটোটার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলা কেন? মাইনসে তো বড় বোনের দোষ ধরবো এহন। এই মাইয়াডার আর বিয়া হইবো?’
তাহেরা কিছু বলার আগেই জুহি মুখ খুলল। নানু তাকে ডেকেছে মানে এসব কথা শোনাবে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। তাই প্রস্তুতি নিয়েই বসেছে।
‘আমি তো বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি না নানু। যখন বিয়ে করা দরকার মনে হবে তখন করব। আপাতত, আমি নিজের মত ঠিক আছে। এভাবেই থাকতে চাই। কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের জীবনের পোড়াদহন দেখতে চাই না। আর মামা মামীকে দোষ কেন দিচ্ছ? আমি নিজে থেকে বিয়ে না করলে কি তারা জোর করে আমায় বিয়ে করাবে?’
আঞ্জুমান বেগম গর্জে উঠে বললেন,’এই যে মাইয়া দুনিয়ার ঘাড়ত্যাড়া, এক্কেরে মায়ের মতো হইছে। তার উপরে বংশের রক্তই তো শরীরে, প্রতারক আর বেইমানের রক্ত। তোর মা যেমনে নিজের জীবনডা শেষ করছে, শেষক্ষণে দেখা গেল তুইও তোর জীবন ওই ভাবেই শেষ করলি। তখন, দায় কেডা নেবো?’
জুহি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বেশ রুক্ষ গলায় বলল, ‘আমার দায় আমি কাউকে নিতে বলি নাই। নিজের টা নিজে বুঝে নিব নয়তো মরে যাব। তবুও, আমার দায় আমি কারো হাতে তুলে দেব না। যথেষ্ট বড়ো হয়েছি, নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে। কিন্তু তুমি আমার মাকে নিয়ে আর কটুক্তি করো না। আমার মা তো তোমারই মেয়ে, মিনিমাম তার মান সম্মানটুকু রেখে কথা বল।’
আঞ্জুমান বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘ওমন মেয়েকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হয়।’
জুহি আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। নিজের ঘরে চলে এলো। নিজের মায়ের সমন্ধে একটা কটু কথাও সে শুনতে পারে না, দম বন্ধ একটা পরিস্থিতি এটা। মায়ের উপর বড্ড বেশিই অভিমান তার, এভাবে ছেড়ে কেন চলে গেল? আরেকটু সময় পাশে থেকে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো? ক্ষতি না, বরং জুহির জীবনটা বেশ গোছানো হতো। মা থাকলে কেউ আর একটা বাজে কথা শোনানোরও সুযোগ পেত না।
মায়ের একটা মাত্র ছবি জুহির কাছে, তাও অনেক বছর আগের। বেশ যত্নে তুলে রেখেছে। ছবিটা সাথে থাকলে মনে হয়, মা পাশে আছে। সেই ছোট বেলার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার নির্ভয় দেয়, ভরসা দেয়। জুহি আলতো করে মায়ের ছবিতে হাত বুলায়। এই তো মা, তারপরও কেন সবাই বলে তার মা নেই? শরীরী উপস্থিতিকেই মানুষ থেকে যাওয়া বলে, অথচ মানুষটা যে মনের ভেতর লেপ্টে থাকে সেটা কেউ খালি চোখে দেখতে পায় না।
জুহি মায়ের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরল। মা মা গন্ধ ঠিক পাওয়া যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতো হাঁক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এই সমাজে সেটাও সম্ভব না।
মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জুহি ফিরে এলো অতীতে। যখন এই বাড়িতে এসেছিল তারা।
স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে জুহির মা শারমিন ইসলাম বাবার বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন, ভাইয়ের কারণে। এই কথা যখন আন্জুমান বেগমের কানে গিয়েছিল, তখন থেকেই তিনি শারমিনের উপর ক্ষ্যাপা। একে তো তিনি পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিলেন, পরিবার থেকে মা-বাবা কেউ মেনে নেয়নি বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল রাশেদ চৌধুরীর সাথে। খুব সুখের সংসার গড়ে উঠেছিল দুজনের। ছিল না কোন অশান্তি, ছিল না কোন অভিযোগ, আর ছিল না কোন অভাব। রাশেদের সংসারে গিয়ে শারমিনের বারবার আফসোস হতো, মা-বাবা মানলেন না কেন? রাশেদ কতোটা ভালো মানুষ, তাদের মেয়ে কতটা ভালো আছে এটা একবারও দেখলেন না।
অবশেষে তাদের ঘর আলো করে জুহির জন্ম। আবারও সুখের দিন শুরু হয়। কিন্তু এত সুখ বোধহয় শারমিনের কপালে সইল না। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়লেন রাশেদ সাহেব। স্ত্রী সন্তানকে মুহূর্তেই তাচ্ছিল্য করলেন। এরই মধ্যে শারমিন এর বাবা নুরুল তালুকদার মারা গেলে, শারমিন খবর পেয়ে দেখতে আসে। সেখানে এসেও এক অজানা লজ্জা আড়ষ্ট করে রেখেছিল তাকে। যেই মানুষের জন্য বাবা-মা ত্যাগ করেছিল, সেই মানুষটা তার জীবনে এখন ক্ষণস্থায়ী।
তারপর কোনো একদিন হঠাৎই রাশেদ বিয়ে করে নিয়ে এলেন। শারমিন চুপচাপ স্বামীর ঘর ছাড়ল, মনের বেদনা মনেই লুকিয়ে রাখল। জুহিকে নিয়ে উঠল বাবার বাসায়। এই বাড়িটা তো তার নিজেরও বাড়ি। শুধুমাত্র পরিস্থিতির বিবর্তনের কারণে এই বাড়িটাকেও সে নিজের বলে দাবি করতে পারে না। এই সময় লোকে লোকারণ্য ছিল এই বাড়ি, তারপর সবাই নিজেদের মতো সম্পত্তির ভাগ নিয়ে কোথায় কোথায় চলে কে জানে?
নিজের বাড়িতে থেকেও নিজেকে এই বাড়ির আশ্রিতা মনে হতো শারমিনের। তার কারণ আন্জুমান বেগম, তিনি প্রতিমুহূর্তে কটাক্ষ করতেন। কারো বারন কানে নিতেন না। শারমিনের জীবন এতোটাই অসনীয় হয়ে গেল, সে শেষ পর্যন্ত মেয়ে রেখেই আত্মহত্যা করল। শুধুমাত্র সকলের উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখে গিয়েছিল,
—“আমি জীবনে ভালোবাসা পাইনি, আমার মেয়েটাকে একটু ভালোবাসা দিও!”
কথা রেখেছেন ভাই আফসার তালুকদার। জুহির জীবনে মা-বাবা ব্যতীত কোন অভাব অপূর্ণ রাখেন নাই তিনি এবং তার স্ত্রী। কিন্তু সমাজ থেকে যদি একটা কথা সেই ছোট থেকে জেনে গিয়েছিল যে সে এতিম। তার মা-বাবা কেউ নাই। মামা মামী কি আর মা-বাবার অভাব পুরণ করতে পারে?
শারমিনের আকস্মিক মৃত্যু জুহির ছোট্ট হৃদয়টাকে একদম ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। হাসি কান্না সব ভুলে গিয়ে একে বারে নিঃস্ব হয়ে গেছে মেয়েটা। বর্তমানে বুকফাটা দুঃখেও জুহির কান্না পায় না, অতি আনন্দও সে হাসির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেনা। অশান্ত মেয়েটা একদম শান্ত স্থির হয়ে গেল, তার ভেতরকার সেই শান্ত স্বভাবটা আজও বহাল। আজও মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে মেপে মেপে দুটো কথা বলে। কারো কথা বিশেষভাবে পাত্তাও দেয় না। মানুষ শুধু দুর্বল জায়গায় খোঁচাতে পারে, খুব প্রয়োজনে কেউ পাশে থেকে আগলে রাখতে পারেনা।
এসএসসি পরীক্ষার পর আফসার তালুকদার জুহীকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মাহিদও তখন ঢাকায়, তবে জুহি নিজের মতো আলাদা থাকতে চাইল। সব মিলিয়ে দিনকাল ভালোই চলছিল। মামা মামীর কথাও ভীষণ ভাবে মনে পড়ত। তারা কখনো নিজের ছেলেমেয়েদের থেকে জুহিকে আলাদা করে নাই।
জীবনের অন্যরকম একটা পরিচ্ছেদে এলো, এরপরও নিত্যসঙ্গী হিসেবে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস ছিলই। এখনো আছে, জুহি সবকিছু নিয়েই ভালো আছে।
কিন্তু মাকে নিয়ে কোনো কটু কথা তার সহ্য হয় না। বাবাকে তার একেবারেই যে মনে নেই এমন নয়, মনে আছে তবে ঝাপসা। ওই ঝাপসা স্মৃতিটুকুও জুহি রাখতে চায় না। এই সামান্য ঝাপসা অস্পষ্ট স্মৃতিও তাকে দিনশেষে খুব পীড়া দেয়।
.
.
‘জুহি, এই জুহি? তাড়াতাড়ি বের হয়ে আয়। মিমি কিন্তু বলে দিয়েছে তোকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তাড়াতাড়িই আয়!’
দরজা ধাক্কাধাক্কির আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে জুহির। চোখের কোণা আলতো হাতে মুছে নেয়। দুঃখগুলো যে একান্ত তার ব্যক্তিগত, এই দুঃখ কাউকে দেখানো যাবে না।
জুহি দরজা খুলে মাহিদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মাহিদ জুহিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে সোজা বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে এল। জুহি আর রা করলনা। নিজের দুঃখে স্বার্থপর হয়ে সে কিছুতেই এই মানুষগুলোকে কষ্ট দিতে পারে না। এই অধিকার তার নেই।
নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। জুহিকে আর কেউ কিছু বলল না। তখন শাশুড়ি মাকে তাহেরা সামলে ছিলেন।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতেই জুহি মামাকে বলল সে আজকেই ঢাকা ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আফসার তালুকদার নারাজ, সে কিছুতেই জুহিকে আজকে ফিরে যেতে দিবে না। মেয়ের কথা সব সময় মানতে হবে, মেয়েটা মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি?
মামার কড়া ধমকের কাছে জুহি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। মামার কথা মেনে নিয়ে রয়ে গেল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কনে বিদায়ের অনুষ্ঠান শুরু হল, সাথে তো একেকজনের কান্নাকাটি চোখের পানি ফ্রী-ই বলা যায়। জুহি একবার গিয়ে মিমির সাথে আর ওর জামাইয়ের সাথে দেখা করে এসেছিল, তারপর আর যাওয়া হয় নাই।
ছাদে উঠতেই রাফিকে দেখতে পেল। রাফি জুহিকে দেখা মাত্রই হেসে বলল, ‘ভালো আছেন ম্যাডাম?’
জুহি কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘খারাপ থাকার কোন কারন তো দেখছি না আমি।’
জুহির বাঁকা উত্তর শুনে রাফির মস্তিষ্ক পুনরায় ফাঁকা হয়ে গেল। কথা বলার মত আর কিছুই খুঁজে পেল না। এই মেয়েটাকে জানার এক আকাশ কৌতুহল তার। এখন জুহির নানুর কথাগুলো রাফিও শুনেছিল। তারপর থেকেই কৌতুহল আরো দ্বিগুণ হয়ে বেড়েছে।
ধীরকণ্ঠে রাফি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনি সব সময় এরকম কাঠখোঁট্টা হয়ে থাকেন কেন? এইতো আমাকে দেখেন, আমি কিন্তু সব সময় চিল মুডে থাকি। সব সময় হাসি মজা আর ফুর্তিতে থাকি।’
জুহি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘পাগল চিনেন আপনি? যারা পাগল তারা সব সময় এইরকম চিল মুডে থাকে। তারা কারণে অকারণে সব সময় আপনার মত হেসে হেসে বেড়ায়। আমি তো ভাই খুব সাধারন মানুষ, আপনার মত পাগল হলে হয়তো সারাক্ষণ হাসতেই থাকতাম।’
রাফি বোকা বোকা হাসি দিয়ে মাথার চুল এক হাতে পেছনে সরিয়ে দিল। রাফির সেন্টিমার্কা হাসি দেখে জুহিও মনে মনে আর না হেসে পারল না।
কনে বিদায় পর্ব শেষ। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যারা থাকার তারা থেকে যাচ্ছে আর বাদ বাকিরা সব চলে যাচ্ছে। আগামীকাল বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে জুহি যাবে কিনা তাহেরা জিজ্ঞেস করতে এলেন। জুহি এক বাক্যে না করে দিলে তাহেরা আর তাকে ঘাটাল না।
রাত বাড়ছে। ভয়ংকর নিস্তব্ধ রাতে আলোর সূত্রর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না আজ। নিস্তব্ধ রাতের স্মৃতির অংকুর ডানা পালা মেলে দেওয়ার আগেই উপর থেকে জুহির কর্ণকুহরে ভেসে এলো রবীন্দ্র সংগীত। এই বাসায় গান কে গাইছে? গানের সুর শুনে কোন রেডিও অথবা টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠিত হওয়া কোনো গান বলে তো মনে হচ্ছে না। এটা তো বাস্তব সুর! মনের মহিমা মাধুরি মিশিয়ে এত সুন্দর গান কে গাইতে পারে? গানটা লক্ষ্য করে জুহি ছাদের দিকে পা বাড়াল।
যত সামনে এগোচ্ছে গান আরো তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে,
—“আমার পরান যাহা চায়,
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও, সুখের সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।”
.
.
.
চলবে….