#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
১২
🌸
মীরা মুবিন ভাইকে গিফট কি দিবে! সে তো জানতোই না মুবিন ভাইয়ের জন্মদিন কবে। তবে এখন যখন জেনেছে তাহলে কিছু একটা দেওয়া উচিত। কিন্তু তার হাতে কোন টাকা নেই। টাকা থাকলেও অনলাইনে কোনকিছু অর্ডার দিয়ে ফেলে। নয়তো মাহিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দের সব খাবার খেয়ে ফেলে। মীরা ভাবল, বাবার কাছে থেকে চেয়ে নিয়ে কোন গিফট কিনে দিবে।
“মুবিন ভাই আপনার গিফটটা আমি কিছুদিন পরে দিব। আপনি রাগ করবেন না হ্যাঁ।”
মুবিন লজ্জিত মুখে হেসে জানাল,পরবর্তীতেও মীরা যেন ভালো রেজাল্ট করে। ওটাই তাহলে তার গিফট হবে। মাহিমা টেবিলের নিচ দিয়ে মীরার পায়ে লাথি দিয়ে বলল,
“দেখলি, কী ভালোবাসা! বেচারা রীতিমতো তোর প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেছে।”
জায়িন পরেও চলে যেতে চাইলে ইভানও জোর করল। ফলে বাধ্য হয়ে জায়িন মুবিনকেও ওদের সাথে যোগ দিতে হলো। খেতে খেতে সবাই কত কথা বলছে। মাহিমার ঝাল লেগে গেলে সে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
“অনেক ঝাল। ভাইয়া এত ঝাল খেতে পারব না আমি।”
মাহিমাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওর সত্যিই অনেক ঝাল লেগেছে। চোখের জলে নাকের জলে একাকার। মুবিন তাড়াহুড়ো করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খাও।”
ইভান বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ পানি খা।”
আবির মাহিমার সামনে থেকে ঝাল ওয়ালা ওই খাবারটা নিয়ে এসে বলল।
“ঝাল লাগছে তবুও খেয়েছিস কেন? দাঁড়া তোর জন্য কেক আনতে বলি।”
পরিস্থিতি শান্ত হলো। মীরাও ঝাল ওয়ালা খাবারটা খাচ্ছে দেখে আবির ধমক দিয়ে বলল,
“তুইও এখন ঝাল লাগিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিবি।”
“না। আমি ঝাল খেতে পারি। আমার এটা খেতে মজা লাগছে।”
মাঝে মাঝে এই টেবিলে হাসির রোল পড়ছে। আশেপাশের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখছে। খাওয়ার সময়ও মীরা মাহিমা ছবি তুলতে ভুললো না।
“ইভান ভাই, নড়ো না। যেভাবে চামচ ধরে রেখেছ ওভাবে থাকো। অনেক সুন্দর লাগছে।”
ভাইবোন সবার ছবি তুলে মুবিনের ছবি তুলতে গিয়ে অনুমতি নিল মীরা।
“মুবিন ভাই, আপনার ছবি তুললে কি রাগ করবেন?”
মুবিন হেসে জানাল সে রাগ করবে না। কিন্তু জায়িনকে জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। প্রিয়া মীরার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“এটা কি আবিরের বন্ধু?”
মীরা ঠিক বুঝতে পারল না প্রিয়া আপু কার কথা বলছে। তাই সে জিজ্ঞেস করল,
“কোনটা?”
“ব্লু শার্ট।”
মীরা জায়িনের দিকে তাকালেই জায়িনও এদিকে তাকালো। মীরা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। ফিসফিস করে বলল,
“হুম। কেন আপু?”
“ছেলেটা কী হট দেখেছিস? সাথেরটা মনে হয় ওর ছোট।”
মীরা চোখ বড় বড় করে প্রিয়া আপুর দিকে দেখল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“ছি আপু! উনি তোমার ছোট হবে। আবির ভাই তো তোমার ছোট।”
“এক বছরের ছোট। আজকাল ছোটবড় ম্যাটার করে না। সিনিয়র জুনিয়র লাভ স্টোরি গুলোই বেশি ইন্টারেস্টিং হয়। ছেলেটার নাম্বার নিয়ে দিতে পারবি?”
“আপু না প্লিইজ! তোমার বর তোমার থেকে ছোট হবে এটা কেমন কথা। আর তাছাড়া উনাকে দুলাভাই হিসেবে আমার একটুও ভালো লাগবে না। তুমি উনাকে বিয়ে কোরো না। প্লিজ।”
“তুই কি পাগল মীরা! বিয়ে করব বলেছি? টাইমপাস তো করাই যায়।”
“না। প্লিজ।”
মীরা কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছে। সবাই একসাথে ওর দিকে তাকাল। প্রিয়া টেবিলের নিচ দিয়ে মীরার পায়ে পাড়া দিল। আবির জিজ্ঞেস করল,
“কী না করছিস মীরা?”
মীরা থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে এখন সে। তবুও কিছু তো বানিয়ে বলতে হবে। মীরা হাসবার চেষ্টা করে বলল,
“কিছু না ভাইয়া। এমনি বলেছি। কিছু না তো।”
প্রিয়া মীরাকে শাসালো। চোখ পাকিয়ে বলল,
“শয়তান মেয়ে! ওভাবে চেঁচালি কেন?”
“তুমি জানো না?”
“তুই এমন রিয়েক্ট করছিস যেন আমি তোর বয়ফ্রেন্ডের নাম্বার চাচ্ছি। চুপচাপ কাজটা করে দে। কোন কথা বলবি না।”
“আপু না প্লিজ। আমি পারব না। তুমি মাহিমাকে বলো।”
“তুই পারবি তোর ঘাড় পারবে।”
“উনি তোমার ছোট।”
“তাতে তোর এত সমস্যা কিসের? আমার সমস্যা না থাকলে তুই না করছিস কেন?”
মীরা রাগ করে বলল,
“ঠিক আছে। তোমার যা খুশি করো। আমি কিছু বলব না।”
বাড়ি ফেরার সময় চাচী, ফুপুদের জন্য খাবার প্যাকেট করে নিয়ে নিল। মীরা ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ও ফিরে আসতে আসতে সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে। মীরা ওদের ধরতে দৌড় দিয়েছিল। এমন সময় ঠাস করে একজনের সাথে বাড়ি খেল। তার মাথাটা লোকটার বুকে গিয়ে ঠুকেছে। মীরা কপালে হাত রেখে উপরের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে ছিটকে সরে গেল। জায়িন ভাইয়ের সাথেই ধাক্কা খেতে হলো! দুনিয়ায় আর মানুষ ছিল না। মীরা চুপসে যাওয়া মুখে বলল,
“সরি জায়িন ভাই, সরি। আমি দেখিনি। সরি।”
“হু।”
“আপনার লাগেনি তো? আমি সত্যি দেখিনি।”
“লেগেছে।”
জায়িনের শান্ত কন্ঠে কথাটা শুনে মীরা ঝট করে ওর মুখের দিকে তাকাল। অপরাধী মুখে বলল,
“অনেক লেগেছে? কোথায় লেগেছে? আমি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিইনি। সত্যি।”
“ওরা তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।”
মীরা ভাইবোনদের কাছে আসতে আসতে মনে মনে ওদের উপর রাগ হলো। ওরা তাকে ফেলে চলে এসেছে বলেই তো মীরা দৌড় দিয়েছিল। দৌড় না দিলে কি ধাক্কা লাগতো? জায়িন ভাইয়ের লেগেছে। মীরা তো ইচ্ছে করে ব্যথা দেয়নি।
🌸
মীরা মাহিমা দু’জন একই কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওদের দূরে কোথাও গিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরিবার মানলো না। ওরা দুই মেয়ে একা গিয়ে এখন কোথাও থাকতে পারবে না। আরেকটু বড় হোক। তখন দূরে থেকে পড়তে দিবে। পরিবারের কথার বাইরে ওরা যায়নি। এখানকার কলেজেই ভর্তি হয়েছে। ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসে কলেজে পা রেখে নিজেদের কেমন বড় বড় মনে হচ্ছে। যেন হুট করেই কত বড় হয়ে গেছে। আগের মতো এত বাধা নেই। আগে মতো পড়াশোনা নিয়ে এত চাপও দেয়না কেউ। মন চাইলেই কলেজ থেকে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে পারে। এভাবেই কয়েকমাস কেটে গেল। বাড়িতে একটুও পড়া হয়না। তাই ছোট চাচ্চু আবার মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শুরু করার কথা বললো। মীরাও রাজি হয়েছে। কারণ পড়তে না গেলে মুবিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয় না। মীরা মুবিন ভাইকে কেমন পছন্দ করে এটাই ভেবে পায় না। মুবিন ভাইয়ের কথা সে মাঝে মাঝে একেবারে ভুলে যায়। কেউ মনে করিয়ে না দিলে মনে পড়ে না। এটা মনে হয় তেমন ভালো লাগা না৷ মীরা বড় হয়েছে। সে এখন এই অনুভূতি গুলো কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছে।
🌸
মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় মীরা মুবিন ভাইদের বাসার নিচের ফুলগাছ থেকে ফুল চুরি করছিল। নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে তার দুই বিনুনিতে গেঁথে নিয়েছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। একটা কাঠগোলাপ ছিঁড়ে মাত্রই কানে গুজবে এমন সময় পিছনে কারো শব্দ পেয়ে চমকে তাকাল।
জায়িন চোখ মুখ কঠিন করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় মীরা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। হাতে ধরা কাঠগোলাপটা ঝট করে পেছনে নিয়ে লুকিয়ে ফেলল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বলল,
“ফুল ছিড়িনি ভাইয়া।”
জায়িন ভ্রু জোড়া সামান্য কুঁচকিয়ে মীরার বেণীতে গাঁথা ফুলের দিকে দেখলে মীরা ঠোঁট টেনে হাসল। বলল,
“চুরি করে ফুল ছিড়িনি। সত্যি। আন্টিকে বলে এসেছি।”
তিন মাস পর জায়িন আজ বাড়ি ফিরেছে। আর গেট দিয়ে ঢুকতেই এই ঘটনা ঘটলো। জায়িন তাকে কিছু না বলে চলে যেতে নিলে মীরা পেছন থেকে ডাকল। জায়িন ভাই তার কাছে এখনও রিকশা ভাড়ার সেই টাকাটা পায়। মীরা একদমই ভুলে গিয়েছিল। জায়িন ভাইয়ের সাথে দেখা হলেও টাকার কথাটা মনে ছিল না। কয়দিন আগেই মনে পড়েছে। কিন্তু তখন জায়িন ভাই বাড়িতে ছিল না। মীরা টাকাটা ব্যাগে নিয়েই ঘুরছে। জায়িন দাঁড়িয়ে গেলে মীরা এগিয়ে এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টাকা বের করে জায়িন দিকে ধরে বলল।
“ভাইয়া আপনার টাকাটা।”
জায়িন কপালে ভাঁজ ফেলে মীরাকে দেখছে। কিসের টাকা এটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে মীরা বলল,
“নিন।”
“কিসের টাকা?”
জায়িন ভাইয়েরও তাহলে মনে নেই। মীরা মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল,
“আপনার মনে নেই, ওইযে অনেকদিন আগে ওইদিন রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন না। ওইযে পড়ে গিয়ে আমি যে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। আপনি রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলেন। আপনাকে তো সেদিন ধন্যবাদ দিইনি। রিকশা ভাড়ার টাকা দিতেও মনে ছিল না। জানি অনেকদিন হয়ে গেছে। তবুও ধন্যবাদ ভাইয়া।”
মীরা জায়িনকে মনে করিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করছে। জায়িন চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্থির দৃষ্টিতে মীরার চোখে চোখ রেখে বলল,
“রিকশা ভাড়ার টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছ। কিন্তু আমি যে তোমাকে কোলে করে তিনতলায় উঠলাম। ওটা কীভাবে ফিরিয়ে দিবে? তোমাকে দেখে তো মনে হয় না আমাকে কোলে নিয়ে তিনতলায় উঠতে পারবে।”
মীরা হাঁ করে জায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ জোড়া মার্বেলের মতো জায়িনের মুখের উপর স্থির হয়ে আছে। জায়িন এমন কিছু বলবে মীরা হয়তো কল্পনাও করেনি। বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে উঠতে সময় লাগছে। জায়িন ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি নিয়ে বলল,
“মুখের ভেতর মশা ঢুকে যাবে।”
মীরা ঝুপ করে মুখ বন্ধ করে নিল। জায়িন ওকে হতভম্ব অবস্থায় রেখেই চলে যাচ্ছে। মীরা চোখ পিটপিট করে জায়িনকে চলে যেতে দেখছে। এটা কি সত্যি জায়িন ভাই? নাকি উনার ভূত!
চলবে…