#মনোভূমির_ছায়া
পর্ব – ১
লেখা – #মাহীরা_ফারহীন
কৃষ্ণ কালো মেঘ সারির আড়ালে ঢাকা পরেছে সূর্য। তমসাচ্ছন্ন আকাশ। আকাশের ক্যানভাসে তির তির করে আঁকাবাকা আঁচর দিয়ে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ চমকের আলো। প্রকৃতির এমন হিংস্র তান্ডব যেন কত দিন পর দেখছে ন্যাসভিলবাসি। দিনের বেলায় আঁধার নেমেছে শহরে। সকল শহরবাসী দ্রুত দোকান পাটের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। অনেকেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। আবার অনেকেই ছাতা মাথায় ছুটে চলেছে। তীব্র বৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝোড়ো বাতাস। টেনেসি লোকাল আবহাওয়া দপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা করছে। গাড়ির দরজা খুলে পানি জমা রাস্তায় পা রাখলেন জামান মালিক। গাল ভরা চাপ দাঁড়ি। ছোট ছোট চোখ। যত্ন নেওয়া ফিট দেহ। তার দ্রুত পদক্ষেপ রাস্তায় জমাটবদ্ধ পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলছে। বাড়ির কালো লোহার পাল্লাযুক্ত গেটের পাশে আসমানী রঙা লেটার বক্সের ওপর পানি জমে গিয়েছে।
গেট খোলার তীক্ষ্ণ লৌহ শব্দটা বৃষ্টির তীব্র শব্দে চাপা পরে গেল। ভেতরে ঢুকে ব্যস্ত পায় সদর দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন। পোর্চের ওপর ছাউনি থাকায় বৃষ্টির ঝাপটা থেকে কিছুটা রক্ষা পেলেন। কলিং বেল বাজাতে দেরি শুধু খুলতে দেরি নেই। যেন দরজার ওপাশেই চাতক পাখি বনে বসেছিল কেউ। দাঁড়িয়ে আছে ফর্সা, ছিপছিপে গড়নের একটি লম্বা মেয়ে। অতি নিখুঁত হাতে আঁকা সুন্দর চৌকোনা মিষ্টি চেহারা। চিকন কমলার কোয়ার মতো গোলাপি ঠোঁট। লম্বা পল্লব বিশিষ্ট চোখ দুটো বড় বড়। হালকা ঢেউ খেলানো চুলগুলো টানটান পোনিটেলে আবদ্ধ।
‘বাবা তোমার কাছে ছাতা ছিল না? এই অবস্থা কেন?’ অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল নিনা।
‘যেই বৃষ্টি বাপরে বাপ ছাতা মানে? যাই হোক রেইনকোট তো ছিলোই।’ বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন। দরজার সামনের এই করিডোরটায় ম্লান হলদেটে আলো জ্বলছে।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে পরলেন। বললেন,
‘একটা নতুন কে*সের তদ*ন্তে ব্যস্ত ছিলাম।’
কাঠের মেঝেতে বিছানো কার্পেট পানিতে ভিজে গেল। ঝরঝর করে পানিও পরল। রেইনকোট থেকে। যদিও বৃষ্টির পানিতে বাইরের সকল কাঁদা ধুয়েমুছে গিয়েছে।
‘জুতা তো খুলো। কার্পেট ভিজে যাচ্ছে!’ মনে করিয়ে দিল নিনা।
মি.মালিক জুতা দুটো খুলে রাখলেন। রেইনকোটটা খুলে নিনার হাতে দিলেন। দরজার পাশের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখল ও। ড্রইংরুমের একপাশের দেওয়ালে কাঁচের স্লাইডিং ডোর। বাগানে যাওয়ার দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হয় মূলত। কাঁচের দরজা ঝাপসা হয়ে আছে। বৃষ্টির পানির ধারা আঁকাবাকা পথে এগিয়ে যেতে যেতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। নিনা একটা টাওয়েল সহ এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। লিভিং রুমে দুটো ল্যাম্প সেড ম্লান হলদে আলো বিচ্ছুরণ করছে। এছাড়া সারা বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরপর কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে বিদ্যুৎ চমকানোর বিকট শব্দ।
‘ফাতেমাপা বাসায় নেই?’
‘আছে তো। আমার রুমের আলমারি গোছাচ্ছিলাম আমরা। উনি ওখানেই আছেন।’
‘ওহ।’ বলে পানিটা এক ঢোকে খেয়ে শেষ করলেন।
‘নতুন কী কে*স?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।
‘ন্যাশভিল হাই স্কুলের একটা ছেলে মা*রা গিয়েছে।’
‘তো? এখানে পু*লিশ ডাকার কী আছে? কিভাবে মা*রা গিয়েছে?’
‘ওর পরিবারের বদ্ধ ধারণা এটা আ*ত্মহ*ত্যা যদিও ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট এটা একটা খু*ন।’
‘ওহ। কোন গ্রেডের?’ ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিনা। ল্যাম্পের পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও।
‘সিনিয়র গ্রেড।’
এবার দ্বিগুণ আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘নাম বলো।’
‘টনি ওর নাম।’
‘কী?!’ এবার নিনার চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘পুরো নাম কী?’
‘টনি গ্রেউড।’ মি.মালিকের চেহারায় হতভম্ব ভাব। নিনার চেহারা নিমিষেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হঠাৎ পরিবেশের শীতলতা গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত মুখে কোন কথা জুটলো ন। মি.মালিক চিন্তিত স্বরে বললেন,
‘বাই এনি চান্স এটাই কী তোর সেই টনি নামক ফ্রেন্ডটা?’
‘তুমি শিওর যে ওর নাম টনি গ্রেউড?’
‘হ্যা অবশ্যই! ন্যাশভিল হাই স্কুলের সিনিয়র গ্রেডের ছাত্র।’
অদ্ভুত এক ক্লেশপূর্ণ বাতাসের ধাক্কা অনুভব করল।
নিনা ধপ করে সোফায় বসে পরল। মি.মালিক ওর কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললেন,
‘নিনা এভাবে ভে*ঙ্গে পোরিস না। ও তো আসলে…বলতে বলতে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন না ঠিক কী বলা উচিৎ। আসলেও কারো চলে যাওয়ার কষ্ট ঘোচানোর মতো কোন বাক্য হয় না। তার প্রকৃত প্রতিশেধক একমাত্র সময়। সময়ের সাথে সাথে সকল ঘাই একদিন শুঁকিয়ে যায়। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে একজন বয়স্কা মহিলা নেমে এলেন। চেহারায় বয়সের হালকা ভাজ পরেছে। চোখ জোড়া মায়াভরা। বড় একখান আবায়া মতো কাপড় পরেছেন। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা। উনি বোধহয় অন্য কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তবে নিনাকে এভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে থেমে গেলেন। পরমুহূর্তে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে গেলেন নিনার কাছে। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
‘কী হয়েছে মা?’
গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে গিয়েছে। তবুও নিজেকে আঁটকে রাখল। এত সহজে চোখের জল ফেলে না ও। ফাতিমাপার দিকে তাকিয়ে স্তিমিত স্বরে বলল,
‘আমি..ঠিক আছি।’
তারপর বাবার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল,
‘ও…..কিভাবে মানে?’
মি.মালিক প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলা আরম্ভ করলেন,
‘আজ ভোর বেলায় নিজ কামরায় ওর ডে*ড ব*ডি পাওয়া যায়। বাড়ির কেয়ারটেকার পুলিশে খবর দেয়।’
‘কিভাবে? কি হয়েছিল ওর সাথে!?’ অধৈর্য কন্ঠে বলল।
‘ধারণা করা হচ্ছে বি*ষক্রিয়া। ওকে অটো*পসির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ওর পরিবার সাফ জানিয়ে দিয়েছে অটো*পসি পর্যন্তই তারা এগোবেন। ওকে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই তাদের।’
‘মানে কী? কেন?’
‘তাদের ধারণা এটা খু*ন নয়।’
‘কী আশ্চর্য! কিন্তু কিভাবে হলো এসব? খুলে বলো।’
ফাতেমা আপা উঠে গেলেন নিনার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে। নিনা উদাসীন চোখে ক্লেশ, উত্তেজনা ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। ফাতেমা আপা পানি সহ ফিরে আসতেই, নিনা পানিটা পান করে খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখল। বাইরে গুরগুর করে আকাশ গর্জন করল।
মি.মালিক একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করলেন,
‘ গতকাল অর্থাৎ এগারো তারিখ সন্ধ্যায় ঘটেছে সমস্ত ঘটনা। আমাদের সন্দেহের তালিকা বেশ লম্বা। দুপুরে স্কুল থেকে আসার কিছুক্ষণ পর ওর বন্ধু অরল্যান্ডো এসেছিল। ওর হাতে স্টার বাক্সের দুটো স্ট্রবেরি শেইক ছিল। ও বিকেলে যখন বেরিয়ে যায় ঠিক সেই সময়ই টনির বোন এমিলিও বেরিয়ে যায়। সাড়ে ছয়টার দিকে ওর কেয়ারটেকার মিস ম্যারি বেরিয়ে যান। সন্ধ্যার পর ঠিক আটটা বারোর দিকে ইভান নামের একটা ছেলে আসে ওর বাড়িতে। ইভানের সঙ্গে টনির খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো না।’
‘হুম এটা জানি। তবে তুমি ইভানের কথা কিভাবে জানো?’ জিজ্ঞেস করল নিনা।
‘গ্রেউড বাড়ির সিসিটিভি তে বাকিটা রেকর্ড হয়েছে তাছাড়া সেখানে ইনভে*স্টিগেশন শেষে ন্যাশভিল হাই স্কুলে গিয়েছিলাম জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সেখান থেকেই বাকিটা জানলাম।’
‘ওহ।’ ছোট করে বলল নিনা।
‘এরপর ইভান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই গ্রেউড বাড়ির সিসিটিভি বন্ধ হয়ে যায়। এবং বন্ধ হওয়ার পূর্বের প্রায় সতেরো মিনিটের ফুটেজ মুছে দেওয়া হয়েছে।’
‘ওয়েট! তখন বাড়িতে টনি ছাড়া আর কেউ ছিলো না? আর সিসিটিভির যন্ত্রপাতিতে কারো হাতের ছাপ ছিলো না?’
‘না টনি ছাড়া আর কেউ বাড়িতে ছিলো। আর ফি*ঙ্গার প্রিন্ট গুলো সংগ্রহ করেছি কিন্তু সেগুলোর রি*পোর্ট আসতে তিন চার দিন সময় লাগবে।’
নিনা কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ উদাসীন চোখে সেন্টার টেবিলের পায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘ঠিক পৌঁনে নয়টা হতে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সিসিটিভি বন্ধ ছিল। এরপর আবার ঠিকঠাকই চালু করা হয়েছে।’ মি.মালিক নিজে থেকেই বললেন। এ কথায় নিনা আবার মুখ তুলে চাইল।
‘ওয়েট ব্যাপারটা তো অদ্ভুত! বাড়িতে কেউ ঢুকে থাকলে, ঢুকার ফুটেজ টা নাহয় মুছে ফেলেছে কিন্তু বের হওয়ার পূর্বে ক্যামেরা অন করে দিয়ে যাবে কেন? ইট মিনস সে অন্য কোন পথে বের হয়েছে। কিন্তু অন্য পথে বের হতে পারলে সে পথে ঢোকাও যায়। তাহলে প্রথমত তার সিসিটিভি বন্ধ করা বা ফুটেছ মুছে দেওয়ার তো কোন দরকারই ছিলো না৷’
‘হুম সেটা অদ্ভুত সত্যিই। কিন্তু এই কারণেই তো ওর পরিবার শক্ত ভাবে দাবি করছে টনি সুই*সাইড করেছে।’ ভাবালু স্বরে বললেন মি.মালিক।
‘তার মানে অটো*পসি করার পর ওরা আর কোন তদ*ন্ত আগাবে না?’ ব্যথিত কন্ঠে বলল নিনা।
‘না। এখন ব্যাপারটা আসলে খুবই ঘোলাটে। ঘটনাটাকে আসলেই চাইলে আত্ন*হ*ত্যাও ধরা যায়। কারণ ওর গায়ে কোন আঘা*তের চিহ্ন ছিল না তবে ধারণা করা হচ্ছে ওর শরীরে বি*ষ গিয়েছে। বাড়ির বাকি সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। তাই ওর পরিবার না চাইলে তো আমাদেরও কোন কথা থাকে না।’
আবারও বেশ কিছুক্ষণের মৌনতা। বাইরে ঝোড়ো বৃষ্টির তান্ডব এখনো থামেনি। ঝমঝম করে বৃষ্টি পরার শব্দ ছাড়া কোন শব্দই যেন কানে আসছে না। ফাতেমা আপা নিনার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন নিঃশব্দে।
নিনা নিজেকে সংযত করে আবারও জিজ্ঞেস করল,
‘আর কিছু হয়নি? ওর ব*ডি যখন পাওয়া গিয়েছিল সেখানে কিছু পাওনি?’
‘ওহ হ্যা। মিস ম্যারির কথা অনুযায়ী সে ভোরে বাড়িতে ঢোকার পর সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল। শুধু ড্রইং রুমে টেবিলের ওপর অবশিষ্ট স্ট্রবেরি শেইক সহ একটা কাঁ*চের গ্লাস রাখা ছিল। তবে টনির লা*শ পরেছিল ওর নিজ কামরায়। বিছানার ওপর। সেখানেই একটা ভা*ঙ্গা ব্রেসলেট পরেছিল। টনির বোন এমিলির কথা অনুযায়ী সেটা ইভান দানিরের ব্রেসলেট। ওর কামরায় বাকি সব স্বাভাবিক থাকলেও আরেকটা জিনিস অদ্ভুত ছিল। ওর গিটারের সবগুলো স্ট্রিং কা*টা ছিল।’
‘ওয়াট! সবগুলো স্ট্রিং কাটা ছিলো? মানে কী? ওই গিটারটা ওর সবচাইতে প্রিয় জিনিস ছিলো।’
‘গিটার, সিসিটিভির যন্ত্রপাতি থেকে হাতের ছাপ নেওয়া হয়েছে। তবে ব্রেসলেটে কোন হাতের ছাপ নেই।’
‘আর ইভানের ব্রেসলেট টনির কামরায় পরেছিল?’
‘হ্যা।’
‘আর ওকে কী ধরনের বিষ দেওয়া হয়েছিল?’
‘সেটা তো অটো*পসি রি*পোর্ট আসার পরই বোঝা যাবে।’
‘আর ও যেই গ্লাসে স্ট্রবেরি শেইক খেয়েছিল সেটার ফিঙ্গার প্রিন্ট?’ নিনা উত্তেজিত চিত্তে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশ্ন করেই চলেছে যেন টনি কোথাও লুকিয়ে পরেছে। লুকোচুরির খেলা খেলছে সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবটা জানতে পারলে হয়তো নিনা তাকে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু আহা! এতো শুধুই কতগুলো শিশুসুলভ ভাবনা মাত্র!
মিস্টার মালিক উত্তরে বললেন,
‘ওয়েল ওইযে বললাম ওটা এমনিই টেবিলে পরেছিল। মিস ম্যারি বলেছেন যে, উনি প্রথমে ভেবেছেন স্বাভাবিক ভাবেই টনি হয়তো নিজের কামরায় ঘুমোচ্ছে তাই উনি সেসব দিকে মাথা না ঘামিয়ে গ্লাসটা নিয়ে ধুয়ে ফেলেন। ফলে ওর মধ্যে বি’ষ বা ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে থাকলেও এখন আর নেই।’
নিনা হতাশ ভাবে হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথায় হাত রাখল৷ আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে নিজের কামরায় চলে গেল৷ দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় সটানভাবে শুয়ে পরল। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। প্রকৃতি বৃষ্টির মাধ্যমে করুণ ব্যাদনায় মাখা ভাওলিনের সুর বাজিয়ে যায়। এ করুণ সুর হৃদযন্ত্রে থেকে থেকে চিনচিনে ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঘরজুড়ে বৃষ্টি ভেজা মাটির সুবাসের সঙ্গে সাবানের মতো ক্ষারিয় একটা গন্ধ মিলেমিশে আছে। অন্ধকার কামরা জুড়ে ঠান্ডা হাওয়ারা খেলা করছে।
>>>>>>>
এবড়োখেবড়ো পাথরে মোড়া খাঁড়া পথ। যদিও এটা সামান্য টিলা মাত্র। তবুও উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। জুলাই মাসের তীব্র গরম। মাথার ওপর সূর্য বহালতবিয়তে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ছয় ফিটের কাছাকাছি লম্বা, শুকনা, ফর্সা ছেলেটা আগে আগে প্রফুল্লচিত্তে টিলার চূড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে নিনা যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে উঠার চেষ্টায় আছে। কিছুক্ষণ পর উপরে উঠে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। টনি ওর দিকে গাল ভরা হাসি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল৷ ছোট চিকন চোখ ভরা জমকালো উদ্দীপনা।
টনি বলল,
‘আরেহ এতটুকু তেই অ্যাজমা ধরায় ফেললে হবে নাকি? এটা তো মাত্র টিলা।’
‘আরে ভাই তোমার সময় জ্ঞান কিছু নাই? ভর দুপুর এটা। যখন তখন তোমার এই ডে টু ডে চ্যালেন্জ করতে গিয়ে আধম*রা হয়ে যাচ্ছি আমি।’
‘আরেহ ধুর! ভুয়া কথা। ভালো মানুষরা সবসময় আগে আগে ম*রে যায়। দেইখো আমারই জটিল কোন রো*গ ধরবে।’
‘ওহ আচ্ছা আমি তো খারাপ মানুষ। ভুলে গেসিলাম।’
টনি দাঁত ঝিলিক দিয়ে হাসল। বলল,
‘ওফ হইসে। শোন তোমার মতো ইনট্রোভার্ট দের ধরে বেঁধে ঘর থেকে বের করে না আনলে বছর চলে গেলেও বাসার পাশে যে একটা পাহাড় আছে তাও জানবা না।’
‘প্রথমত এটা পাহাড় না। একটা টিলা বললেও ভুল হবে।’
‘উফ এত কমপ্লেইন করলে হবে না।’
‘অমিত কী কম ছিল?’
‘বাট তোমার একটা ডে*থ স্টেয়ারেই অমিত আধ*মরা হয়ে যায়। ওর দ্বারা এটা হবে না।’
‘হুম। বাট টনি আমার কথার মানে ওইটা না। এই গরমের মধ্যে ভরদুপুরে কেন পাহাড়ে উঠলাম আমরা?’
‘এমনিই। ইচ্ছে করেছে তাই। দেখো আমরা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এখন। যখন অন্যরা ঘরে অলস বসে পরে আছে।
নিনা ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। বলল,
‘আমরা লিটারালি একটা টিলায় দাঁড়িয়ে আছি যেটা মাটি থেকে মাত্র ২৪ ফিট উপরে। আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার খুশি দেখে মনে হচ্ছে আমরা এভারেস্ট জয় করেছি।’
‘ওয়েল প্রতিটা ছোট ছোট বিষয় নিয়েও বড় বড় লেভেলে খুশি হওয়া যায়।’ হাসি মুখে কথাটা বলে চোখ টিপল টনি।
‘পাগল একটা। এইসব করতে গিয়ে একদিন পরপারে পৌঁছে যাবা।’ হালকা হেসে বলল নিনা।
‘হুহ আসছে! আমি অলওয়েজ রেডি থাকি। এখন ম*রে গেলেও আমার কোন আফসোস থাকবে না।’ গর্বের সঙ্গে বলল।
<<<<<<<< সুন্দর সময়ের স্মৃতিগুলো জলজ্যান্ত ছবির মতো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। বহু দিন পুরন সুপ্ত অনুভূতি গুলো কাঁ*চের টুক*রোর মতো হৃদয়ে বিঁ*ধে যায়। অদৃশ্য র*ক্তে সিক্ত হয় মন, মস্তিষ্ক। বলা হয়নি কখনো, বলা হতোও না হয়তো কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভুতিগুলোর উপস্থিতি পরিষ্কার টের পেত ও। নিনা ভাবছে, 'কিভাবে এত শিওর ছিলো ও? কিভাবে? এখন যদি টনির সাথে কথা বলার কোন উপায় থাকতো, ও অবশ্যই আমাকে বলতো ওকে শুভেচ্ছা জানাতে। খুব গর্ব করে বলতো হ্যা ওর কথা ফলে গিয়েছে। কিন্তু আমি জানি অবশ্যই ওর কোন আফসোস থাকতো না হয়তো। তবুও ব্যাপারটা খুবই অযাচিত। ও আর যাই করুক আত্ম*হত্যা করবে না। এটা নিশ্চিত ভাবে খু'ন। নাহলে কেন ইভানের ব্রেসলেট ওর কামরায় পরে থাকবে? তাও আবার ভে*ঙে? কেনই বা ওর গিটারের স্ট্রিং গুলো কা*টা থাকবে? কেন সিসিটিভি ঠিক নির্দিষ্ট একটা সময় থেকে বন্ধ থাকবে? মানুষ কী বোকা নাকি যে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারবে না।' ভেবে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুইয়ে থাকল। সব ভাবনা চিন্তার ভারই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। তবুও বারবার ঘুরে ফিরে পুরনো স্মৃতি, কষ্ট, শূন্যতা ঘোট পাকাচ্ছে মনের অন্তরালে। নিনা ধপ করে উঠে বসল বিছানায়। টানটান করে পোনিটেল করা চুল মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। টান দিয়ে চুলের বাঁধন চুলে ফেললো। অন্ধকারে সকলের দৃষ্টির আড়ালে আঁটকে রাখা চোখের জল গুলো বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ভাবল, 'এভাবে না! এত সহজে না! আমার জীবনে আপনজন বলতেই আছে বাবা, ফাতিমা আপা আর একটা বোন যে থেকেও নেই। ফুফু যে এদেশে থাকে না আর মামা যার সাথে বছরে একবারও ঠিকঠাক দেখা হয় না। ঘরের বাইরে বন্ধু বলতে ছিল শুধু দুজন অমিত ও টনি। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র আপন মানুষের আরেকজন হারিয়ে গেল। আবার! জানি ও জাস্ট একজন বন্ধুই ছিল। যার জন্য আমার যে অনেক অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে তাও নয়। কিন্তু তবুও আর কত হারাবো আমি? আমিই কেন? কেন আমার সাথে রিলেটেড মানুষগুলোর সাথেই এমন হয়?' ভাবতে ভাবতে বন্ধ চোখের পাতা গলেও এক ফোটা পানি কানের কাছে গড়িয়ে পরল। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল। খোলা চুখ গুলো ভেজা গালের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অকারণেই হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগলো। ধীর পায় হেঁটে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসল। অনেক অনেক লম্বা সময় পর নিজেকে এতটা এলোমেলো লাগলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে লিভিং রুম এবং বাবার বেডরুম চেক করল। সেখানে ওনাকে না পেয়ে স্টাডি রুমে গেল। মি.মালিক সেখানেই বসে আছেন নিজের ল্যাপটপ খুলে। বন্ধ জানালা ভারি আকাশি পর্দা দিয়ে ঢাকা। খুব বেশি কিছু নেই স্টাডিতে। একটা ফাইল ক্যাবিনেট, ডেস্ক, চেয়ার এবং একটা সেল্ফ। নিনার উপস্থিতি লক্ষ্য করে মি.মালিক মুখ তুলে চাইলেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, 'এখন কেমন আছিস মা? কিছু বলবি?' 'বাবা আমি ন্যাশভিল হাই স্কুলে ভর্তি হব।' 'কী!?' 'হ্যা৷ আই এম সরি বাট আমি ব্যাপারটা এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না। এটা তো শিওর যে সেটা খু*নই ছিল৷ তাহলে? একজন খু*নি দিব্যি ঘুরে বেড়াবে আর তার কোন শা*স্তি হবে না? তাছাড়া সে তো আবারও খু*ন করতে পারে।' দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলল। মেয়ের উদাসীন তবে শক্ত ফ্যাকাসে মুখমন্ডলের দিকে মি.মালিক অবাক চোখে চেয়ে থাকলেন। ইনশাআল্লাহ চলবে। #মনোভূমির_ছায়া পর্ব - ২ লেখা - #মাহীরা_ফারহীন পরিষ্কার সুবিস্তীর্ণ ঝকঝকে আকাশ। গত দুদিনের ভয়াল ঝড়ের তান্ডব যেন কখনো ঘটেইনি এমন ভান ধরে প্রকৃতি ফুরফুরে মেজাজে আছে আজ। রৌদ্রোজ্জ্বল ফুরফুরে আবহাওয়া। পাইন ও সিডারের প্রশান্তিময় মিষ্টি সুবাস বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে৷ রোদের গড়াগড়িতে ধূসর রাস্তা রুপালি দেখায়। গাড়ি, বাস সাইকেল নিজ নিজ গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে। সাইডওয়াক দিয়ে পথচারীদের হাঁটতে দেখা যায়৷ ন্যাশভিল হাই স্কুলের গেটের সম্মুখে এই সময়টায় হলুদ বাসগুলো এসে ভির করে। ছাত্রছাত্রীরা স্রোতের মতো হইচই করতে করতে বাস থেকে বেরিয়ে আসছে৷ কয়েকটা ছাত্র ছাত্রী সাইকেল নিয়ে কান ফাটা শব্দে হর্ন দিতে দিতে গেট দিয়ে সাই সাই করে ঢুকে গেল। এমনটা করে ইচ্ছা করেই যেন জানান দিল তারা এসে গেছে। আবার অনেকেই নিজের গাড়ি পার্কিং লটে পার্ক করে হেঁটে ভেতরে ঢুকছে। যেহেতু এ দেশের নিয়মই ষোলো বছর উর্ধীদের ড্রাইভ করার অনুমতি দেয়। কাজেই নিনার গাড়ি চালানোর অনুমতি রয়েছে।এমনিতেও আর এক মাস পরেই আঠারো বছরে পা দিবে ও। নিনা পার্কিং লটে বিমূর্ষ মুখে নিজের কফি রঙের ফোর্ড গাড়িতে বসে গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। নতুন স্কুল, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। নিনার কাছে নতুন কিছু মানেই বিরক্তি। প্রাইমারি হতে হাই স্কুল এত বছর যেই স্কুলে কাটিয়ে এসেছে সেটাই ওর কম্ফোর্ট জোন। এর বাহিরে বেরিয়ে আসাটা রীতিমতো একপ্রকার যুদ্ধ। ওর অবশ্য এখানে হঠাৎ করে বছরের শেষ প্রান্তে এসে স্কুল পাল্টানোর ক্ষেত্রে তেমন একটা ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়নি। হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকায় খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে কথা। এগারো সেপ্টেম্বর টনির মৃ*ত্যু হয়েছে। বারো তারিখ নিনার নিকট খবর পৌঁছেছে। আর আজ চৌদ্দ তারিখ, নিনা নতুন এক স্কুল, নতুন পরিবেশের মাঝে একা দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িটা লক করে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। স্কুলে প্রবেশ করার পূর্বেই তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, যেন এই স্কুলে শান্তিতে এক দন্ড শ্বাস নিতে পারাটাও বড় দুষ্কর। অবশেষে বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিয়ে মুখ গোমড়া করে গটগট করে হাঁটা ধরল৷ কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করে শরীর সোজা, মাথা উঁচু রেখে হেঁটে চলেছে। বড় ইউরোপীয়ান ধাঁচের স্কুল দালানটা লাল ইঁটের তৈরি। সামনে বড় বড় লালচে কালো টাইলস করা ক্যাম্পাসের মেঝে। ক্যাম্পাসটা যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা বা পশুপাখির মেলা থেকে কম কিছু মনে হলো না। অন্তত নিনার জন্য। আমেরিকার সব স্কুলই একই রকম হয় না। কিছু কিছু হাই স্কুলে নিয়ম শৃঙ্খলা কড়াভাবে বজায় রাখা হয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন গোলমাল হওয়ার তেমন সুযোগ থাকে না বললেই চলে। বিশেষ করে ক্যাথোলিক স্কুল গুলো সেরকম হয়। নিনার পূর্বের স্কুলটা ছিলো ঠিক সেরকম ক্যাথোলিক স্কুল। আবার কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে কে টিচার কে শিক্ষার্থী তা নিয়েও যেন কারোও ভ্রূক্ষেপ নেই। যা ইচ্ছে তাই অবস্থা। এই স্কুলটা ঠিক সেরকম। লাল বিল্ডিংটার সামনে গোলাকার ফয়ার। সামনে চওড়া খোলা করিডর। গোটা করিডোর এবং ফয়ার জুরে চওড়া সাদা মার্বেল পাথরের রেলিঙ দেওয়া। সেখানে সারি বেধে একদল ছাত্রছাত্রী বসে রয়েছে। তাদের সকলের হাতেই মোবাইল। সকলেই আর কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করে একনাগাড়ে মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে রয়েছে। নিনা একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। "নিনা! হেই নিনা।" নিজের নাম কারোও মুখে উচ্চারিত হতে শোনা গেল। নিনা পরিচিত কন্ঠস্বরের খোঁজে এদিকওদিক চোখ বুলাল। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে চোখে পরল ভিরের মধ্য থেকে হলদেটে ফর্সা গড়নের লম্বা একটা ছেলে প্রায় ছুটে আসছে ওর দিকে। ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক দন্ড শ্বাস নিলো অমিত। এতক্ষণের বিরক্তি গুলো উবে গেল অমিতকে দেখে। অমিত নিনার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল, 'কী ব্যাপার তুই এই সময় নিজের স্কুল থুয়ে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে আমার স্কুলে কী করছিস?' 'অদ্ভুত কথা। পড়তে আসছি তাই ব্যাগ নিয়ে আসছি।' অমিত ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অতঃপর হেসে বলল, 'মজা করিস না। হঠাৎ তুই এখানে কেন আসতে যাবি? তুই না কত বড় মুখ করে বলতিস এটা কোন স্কুল হলো? পড়াশোনা কী জিনিস জানে ওরা?' শেষের কথাটা মুখ ভেঙ্গচি দিয়ে বলল। নিনা চোখের মণি ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। বলল, 'কথা ভুল বলিনি কিন্তু বলার জন্য এখন পস্তাচ্ছি।' বলে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। অমিত ওর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, 'হেই ব্রো তুই সিরিয়াসলি এখানে ভর্তি হয়েছিস? লাইক কেন?' 'কী আর বলবো এই স্কুলে তো আর আমি শখে ভর্তি হইনি। তাও আবার সিনিয়র গ্রেডে উঠে।' হতাশ কন্ঠে বলল নিনা। অমিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হেসে উঠে বলল, 'জোস! তুই এখানে পড়লে অন্তত আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ড থাকব!।' নিনা হালকা হাসল। সেই সপ্তম গ্রেডে একটা লিটারেচার ক্লাবে এই অমিত কুমারের সঙ্গে দেখা। তখন থেকেই ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড। অমিত কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কিছু একটা ভাবল। ভ্রু কুঁচকে বলল, 'এটা রিসেন্ট ঘটা কোন ঘটনা যেমন...ওকে থামিয়ে দিয়ে নিমা নরম কন্ঠে বলল, 'পরে খুলে বলি সব?' অমিত আর এ বিষয় কিছু বলল না। বরং উৎফুল্লতার সঙ্গে বলল, 'আচ্ছা চল আমার স্কুল এবং এখানকার মানুষদের সঙ্গে পরিচয় দেই।' বলেই সামনে একদল ছাত্রছাত্রীদের দিকে ইশারা করল। এরা সকলেই হাতে গিটার বা কোন না কোন মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে বসে আছে। অমিত বলল, 'এরা হলো মিউজিক পার্টি। স্কুলের যেকোনো পার্টিতে ওরা আগে আগে উপস্থিত হয় গান করতে যদিও কেউ ওদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না।' 'কেন?' 'কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্কুল পার্টিগুলোতে লোকাল ফেমাস সিঙ্গারদের ডাকা হয়। সকলে তাদের নিয়েই মেতে থাকে। বুঝতে হবে আমরা মিউজিক সিটিতে বাস করি।' 'স্যাড লাইফ।' অমিত এবার দুটো পাশাপাশি বেঞ্চিতে বসা কয়েকজনকে দেখাল। ওদের দেখতে বেশ গোছানো এবং সভ্য লাগছে। ওদের সকলের হাতেই বই। অমিত বলল, 'এরা হলো স্কুলের নার্ড পার্টি। এরা সবসময় পড়ে আর শুধু পড়েই। আর.... নিনা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, 'ওয়াও ওরা তো পারফেক্ট!' অমিত সাথে সাথে বলল, 'এই থাম থাম! তুই দআবার ওদের দলে গিয়ে যোগ দিসনা৷ আমার কী হবে? স্কুলের কোন ছাত্রছাত্রীদের বাড়ির পার্টি বা স্কুল পার্টিতে ওদের কখনোই দেখা যায় না। আর হ্যা ওদের আবার রুলস খুব কড়াকড়ি। যদি কেউ ওদের গ্রুপে ঢুকেও এগুলো পার্টিতে যায় বা অন্য কাজে সময় নষ্ট করে আর সিরিয়াসলি না পড়ে তাহলে ওরা গ্রুপ থেকে বের করে দেয়। যেমনটা আমাকে দিয়েছিল।' শেষের কথাটা আফসোসের সঙ্গে বলল। নিনা হাসল। বলল, 'ঠিকই হয়েছে। তুই নার্ডদের সাথে আর কয়দিনই বা টিকতি।' এবার স্কুল ভবনের সামনের ছোট ছোট সিঁড়িগুলো দখল করে বসে থাকা ছোট একটা জটলার দিকে ইশারা করল। তাদের সকলের টি শার্ট, টপসে কমবেশি রংধনুর ছোঁয়া। অমিত বলল, 'এরা এলজি*বিটি*কিউ কমিউনিটি। এরা সাধারণত ওদের কমিউনিটি নিয়ে কাজ না করে সকলকেই হোমো*ফবিক বলে সন্দেহ করতে ব্যস্ত থাকে।' ওরা লালচে বিল্ডিংয়ের একপাশে এসে থামল। এখানে আশেপাশে অল্প কয়েকজন বসে আছে দেখে নিনা জিজ্ঞেস করল, 'আচ্ছা একটা কথা বল আজকাল স্কুলে কী চলছে? তোর স্কুলের খবর তো দেখি পেপার পর্যন্ত চলে আসছে। একটু বেশিই বারাবাড়ি পর্যায় চলে গিয়েছে না শিক্ষার্থীরা?' অমিত প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলল, 'ওহ ওয়েট! টনি ইয়েস! টনি। ঠিক টনির মৃ*ত্যুর সাথে কী তোর স্কুল পাল্টানো কোন ভাবে রিলেটেড? তুই না টনিকে পছন্দ করতি?" নিনা আলতো করে মাথা নাড়ল। বলল,'ওইরকম না আরকি। বাট হ্যা ওর সাথেই সব রিলেটেড। আমার দিকের ঘটনা তোকে পরে খুলে বলবো।' 'হুম বুচ্ছি। ওয়েল স্কুলের পরিবেশ আগের থেকে একটু শান্ত এখন। আগামীকাল টনির ফিউ*নেরাল এবং তার পরের দিন স্কুলে টনির নামে ট্রিবি*উট করা হচ্ছে। সবাই কম বেশি শকড ব্যাপারটা নিয়ে।' 'তা তো হবেই। একটা ছাত্র কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ খু*ন হয়ে গেল?' 'ওফ ওর পরিবার পুরাই ফাউল। সবাই ত*দন্ত বন্ধ করার কথা শুনে বিরক্ত। সবাই ঘটনাটাকে খু*ন হিসেবেই দেখছে।' 'এটাই স্বাভাবিক ইউ নো? এটাকে আ*ত্মহ*ত্যা ভাবার পেছনে কোন লজিকই নেই। যাই হোক কাল যেতে হবে ফিউ*নেরালে।' কথাটা যেন ও নিজেকেই বলল। অমিত জিজ্ঞেস করল, 'যেতে হবে? তুই তো ওখানে কাউকে চিনিসও না। এসব এটেন্ডও করিস না। হঠাৎ তাহলে?' নিনা অমিতের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'তুই আমার সাথে চল।' 'আগামী কাল উইকেন্ড। আমি গ্র্যান্ডমার বাসায় যাই জানিস তো।' 'ওহ হ্যা৷ আচ্ছা সমস্যা নেই।' 'না, না। আমার দুইটা ফ্রেন্ড আছে, একজন হলো ওমানা। ও অবশ্যই যাবে। তুই ওর সাথে যেতে পারিস যদি বাসা চিনতে সমস্যা হয়।' 'না না থাক। আমার অত নতুন মানুষের সাথে মিশতে ভালো লাগে না। এইসব করার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।' অমিত নিরবে মাথা নাড়ল। গেট দিয়ে ওরা স্কুল বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করল। তবে আরেক কদম বাড়ানোর পূর্বেই দেখা গেল একজন সাই সাই করে স্কেট বোর্ড নিয়ে করিডোর ধরে ছুটে এসে কেন জানি ঠিক দরজার সামনেই থামলো। নিনা আরেকটু হলেই ঢাক্কা খেতে যাচ্ছিল। তবে তার পেছন পেছন আরোও দুজন স্কেট বোর্ড নিয়ে আসছিল। হয়তো তারা প্রথমজনের দেখা দেখি হঠাৎ থামতে পারল না। এবং তার সাথে ঢাক্কা খেয়ে তিনজনই ধম করে মেঝেতে পরে গেল। করিডরে উপস্থিত সকল ছাত্র ছাত্রীরাই সেদিকে তাকিয়ে আছে। প্রথমে হতবাক হয়ে পরলেও পরে করিডোর জুরে হাসির রোল পরে গেল। তিনজন যে স্তুপ হয়ে পরে আছে তার মধ্য থেকে আবার একজন হাত তুলে থামজ - আপ সাইন দেখাল যে ওরা ঠিক আছে। সেটা দেখে সকলে আরোও হাসতে শুরু করল। নিনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর মোটেও হাসি পাচ্ছে না। ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল, 'কী আশ্চর্য! স্কুলের মধ্যে....অমিত ওকে থামিয়ে দিয়ে টানতে টানতে পাশের করিডোরে ঢুকে গেল। রাগে কঠিন হয়ে আছে নিনার মুখমন্ডল। আবার কিছু বলতে পারেনি বলে আরোও বিরক্ত লাগছে বোধহয়। অমিত সুধীর কন্ঠে বলল, 'আরেহ ঠান্ডা হও। প্লিজ!' 'এটা কোন ধরনের কান্ড? স্কুলের ভেতর কেউ স্কেট বোর্ড চালায়? আমি তো এখনই ঢাক্কা খাচ্ছিলাম ওদের সাথে৷ আমি প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দিব!' তীব্র কন্ঠে বলল নিনা। 'আরেহ না না শুন এখানে এগুলো রোজকার ব্যাপার। আর ওদের কথা এখানে সকলেই জানে। ওরা সব জায়গায় রোলার স্কেট অথবা স্কেট বোর্ড নিয়েই চলাফেরা করে। অবশ্য সিঁড়িটা বাদ দিয়ে। এমনকি ক্লাসেও একই অবস্থা।' নিনা বিরক্তি নিয়ে বলল, 'আশ্চর্য! ওদের ব্রেইন কী স্বাভাবিক ভাবে চলতে পারে না?' 'না এটাই ওদের স্টাইল। বলেছিলাম না এখানে সবচেয়ে বিচিত্র মস্তিষ্কধারী দের দেখা যায়।' 'আহ আজাইরা সব মানুষ! আই অলরেডি হেইট দিস প্লেস!' 'আসছিস যখন এখানে সহ্য তো করতেই হবে। সে যাই হোক তোর ক্লাসের রুটিন নিয়েছিস?' 'ওহ না অফিস থেকে নিয়ে নিচ্ছি।' ওরা আবারও হাঁটতে আরম্ভ করল। করিডর গিজগিজ করছে ছেলেমেয়েতে। প্রচুর কোলাহল এবং চিৎকার চেচামেচি যেন দেওয়াল গুলোতে বারি খেয়ে আবার ফিরে আসছে। নিনা জিজ্ঞেস করল, 'আচ্ছা টনি স্কুলে কী রকম ছিলো?' 'স্কুলে তো...ওয়েল কাইন্ড অফ স্কুলের হাইলাইট থাকতো ও আর ইভান। মোস্টলি ওদের ঠুকাঠোকির জন্য। বাট টনি এমনি মানুষ হিসেবে কাইন্ড এন্ড জেনটাল ছিল। সবার কাছে ওর ইমপ্রেশন ছিল খুব ব্রাইট এন্ড চার্মিং একটা মানুষ হিসেবে।' 'হওয়ারই কথা। আর এই ইভানের সাথে সমস্যা টা কী?' ' অনেক আগে থেকেই ওদের মধ্যে রেশারেশি ছিল বাট গত বছর থেকে সেটা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল।' 'কেন?' 'জানি না। আসল কারণটা আমরা কেউই জানি না। পাবলিক্যালি কিছু হতে দেখা যায়নি। কিন্তু ওদের ব্যাপারটা এমন ছিল যে বাই চান্স ওদের যদি তর্কবিতর্ক লাগে কোন কিছু নিয়ে তাহলে সেটা মারামারি পর্যন্ত গড়াবেই।' নিনার কপালে চিন্তার ভাজ পরেছে। নিজ মনে কিছু একটা ভাবছে। অমিত খেয়লা করে বলল, 'তুই টনির খু*নটা ইনভে*স্টিগেট করতে এসেছিস। তাই না?' 'হ্যা।' শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল নিনা। ওরা দুই তলার করিডোরের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নিনা বলল, 'আচ্ছা আরেকটা কথা। ইভান আসলে কি রকম?' 'ইভান আসলে....কী বলবো খুবই জটিল একটা মানুষ। আমি ওকে বুঝি না। ও কেমন জানি খুব চঞ্চল, পোলাইট। জেনটেলও বটে বাট রুক্ষ ধরনেরও আবার। কোন কারণে কারো পিছনে লাগলে ওর লাইফটা হেল করে ছাড়ে। এই দিক দিয়ে দেখলে ও খুবই মিন।' নিনা মাথা দোলাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ' অদ্ভুত। আচ্ছা তোর কী মনে হয় মার্ডারটা কি স্কুলের মধ্য থেকে কেউ করেছে?' হঠাৎ এমন প্রশ্নে অমিত কিছুটা বিচলিত হলো। ইতস্তত করে বলল, 'আসলে ব্যাপারটা এত সংবেদনশীল যে কাউকে নির্দিষ্ট করে সন্দেহও করা যায় না। তবে খু*নি স্কুলের মধ্য থেকেই কারো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ এখন কথা হলো ইভান ছাড়া আরো কয়েকজন আছে যাদের খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিলো না। এই যেমন জর্ডান হাই স্কুলের বাস্কেটবল টিমটা খুব ভাই*ওলেন্ট। ওদের সাথে কতবার যে আমাদের স্কুলের এখানে সেখানে মারামারি লেগেছে। একবার টনির গাড়িকে ওদের স্কুলের একজন গাড়ি দিয়ে ঢাক্কা মেরে অর্ধেক মুচড়িয়ে দিয়েছিল।' 'বাপরে বাপ এত ভাইও*লেন্স কেন এখানে?' 'কথা দেখো। তুই নিজে কী কম ভাইও*লেন্ট?' নিনা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ওই গাড়ির কাঁ*চ ভা*ঙ্গা তো একবারের ঘটনা ছিলো। আমি কী বারবার এমন করি নাকি?' 'সাধারণ মানুষের জীবনে একবারও এমন ঘটনা ঘটে না।' ইনশাআল্লাহ চলবে।