শুধু তোমারই জন্য পর্ব-০২

0
660

শুধু তোমারই জন্য -২

আবির ব্যাংকক থেকে ফিরেছে। আবিরের মাও বাদামহাটি থেকে ফিরে এসেছেন।
তিনি সন্ধ্যা থেকে আবিরকে দুবার বললেন, নীলির সাথে কথা বলতে।
আবির উত্তর দিলো, হুট করে একজনকে কিভাবে ফোন করবো মা? আগে কোনোদিন দেখিও নি, কথাও হয়নি! ফোন দিয়ে কী বলবো বলো?

কিছুক্ষণ পরে আবিরের মা আর ছোটো বোন মিতুল আবার এলো।

মিতুল বলল, বল যে তুই আবির, ওর সাথে দেখা করবি, এটা বলতে পারবি না! ওর জন্য তো টুকটাক জিনিসপত্রও কিনেছে মা, সেগুলো দিতে হবে না?

আবির বলল, তোরা যা, গিয়ে দিয়ে আয়। সাথে এই আলমারিতে একটা ব্যাগ রাখা আছে, ওটাও নিয়ে যাস।

আবিরের উত্তরে তারা হতাশ হয়ে চলে গেল।
আবির অনেকক্ষণ ভাবল, একটা ফোন কি করবে?
নাকি একবারে দেখা করবে, যাই হোক, মেয়েটাকে “কবুল” তো বলেছে, মেয়েটাও বলেছে। নীলি নাহরিন, নামটাও সুন্দর। আচ্ছা আবির আহসান থেকে আহসান লাগাবে না নীলি! অনেক ভাবলেও কিন্তু ফোন আর করা হলো না।

আবির ফোন করল পরদিন দুপুরে। নীলির ক্লাশ অফ ছিল, দুদিনের লেকচার তুলে নিচ্ছিলো, ওর ফোনটা ওর দুজন বান্ধবীর কাছে ছিল। ফোন বাজলো তখন সাড়ে বারোটা বাজে। বান্ধবীরা রিসিভ করে নীলিকে বললো, অপরিচিত নাম্বার।

আবির শুনলো, আননোন! নাম্বারটা সেভ করেনি নাকি!
নীলি ফোন পিক করে বলল,
-হ্যালো কে বলছেন প্লিজ?
আবির একটু ইতস্ততভাবে বললো, আমি আবির!
-আবির? নীলি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো, এই তো সেই লোক, যার সাথে নাকি “কবুল” বলা হয়েছে, ইস, ওই সময়টুকু ভুলে যাওয়া যাচ্ছে না কেন, যেন কিছু হয়নি!
বিয়ে হয়েছে ছয় কি সাত দিন হবে, এ কদিনে ফোন করেনি, আজ কেন করেছে? তবে এত কিছু বললো না নীলি। শুধু বলল, বলুন?
-কেমন আছ?
-জি ভালো। -আপনি কেমন আছেন, জিজ্ঞেস করলো না নীলি।
-নীলি, আমার ভুল না হলে তোমার ক্লাশে থাকার কথা, আজ কি ক্যাম্পাসে এসেছো?
-জি, আমি ক্যাম্পাসে।
-আচ্ছা, আমার ধানমন্ডিতে একটা মিটিং আছে, শেষ হতে সাড়ে তিনটা বেজে যাবে। তারপর আর কোন কাজ নেই, তুমি কি দেখা করবে আমার সাথে?
নীলির ভীষণ ভয় করতে লাগলো। যদিও লোকটির কথা শুনতে ভালো, শ্রুতিমধুর যাকে বলে। গলার স্বরে গাম্ভীর্য আছে। সরাসরি না-ও করা চলে না। তাও, মাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে।

নীলি বললো, আমি তো এতক্ষণ ক্যাম্পাসে থাকবো না।
বাসায় ফিরতে হবে।

-আচ্ছা তোমার বাসা কোথায়, আমি এসে নিয়ে আসবো তোমাকে?
নীলি ভাবলো কি আশ্চর্য, লোকটা সমানে তুমি করে বলছে, অথচ বাসে তো আপনি, ম্যাম বলছিল! এখন বুঝে গেছে না, মেয়েটা আমার সম্পত্তি! হুহ! এত কিছু ভাবলেও মুখে বললো, আচ্ছা, দেখি।

-আচ্ছা আমি ফোন করবো তোমাকে, ফ্রি থাকলে বের হবে না হয়।।
নীলি মনে মনে বলল, ওরে ভদ্রতা আর কার্টেসী, মরে যাই মরে যাই, এত ভালো তো না জেনে শুনে বিয়েতে রাজী হলি কেন! ভাগ্যিস মনের কথা গুলো কেউ শুনে না।
শুনলে কি মনে করতো কে জানে!

আবির ফোন রাখার সাথে সাথে নীলি মা কে ফোন করে জানালো, আম্মু ওই লোক ফোন করেছে।
কোন লোক?

ওই যে, আবির!

নীলির মা বিরক্ত হলেন খুব, এখনি দেখা করার কি আছে, তিনি নীলির বাবাকে বললেন, আমি তো বলেছি, আগে নীলির পড়া শেষ হোক!

নীলির বাবা বললেন , দেখা করলে সমস্যা কি, নীলিরও তো আবিরকে চেনা লাগবে নাকি? বিয়ে হয়েছে যখন, ওরা নিজেরা আলাপ পরিচয় সেরে নিক।

তাই নীলির মা অনিচ্ছায় বলে দিলেন , যাও, দেখা করে আসো। একা যাবে?

নীলি বললো, আমি তো কাউকে কিছু বলিনি, কাকে নিয়ে যাবো?

দেখা করতে সায় দিলেও নীলির মায়ের বুক ধুকপুক করতে লাগলো, এই ছেলে কেমন কে জানে! মনে হচ্ছে মেয়েটাকে বাঘের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।

আবির বের হয়েছে চারটায়, বের হয়ে নীলিকে ফোন করলো, নীলি আবিরকে স্টার কাবাবের গলিতে দাঁড়াতে বলে নিজে এলো বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে আসতে আসতে সাড়ে চারটা!

আবির গলির ভেতরে নিজের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল।
নীলিকে দেখল হেঁটে হেঁটে আসতে! নীলিকে দেখে হাত নেড়ে ডাকলো।

নীলি আবিরের পাশে এসে দাঁড়ালো, শীতের সময়, সন্ধ্যা হয় দ্রুত।

আবির জিজ্ঞেস করলো, নীলি কেমন আছ?
– জি ভালো, দুপুরে এই কথাই আর একবার জিজ্ঞেস করেছেন!

আবির ভাবল, আরে বাবা, পটের বিবি দেখি ফটফট করে কথা বলে! আবির হাসি চাপলো ঠোঁট চেপে।

– এখানেই কথা বলবে নাকি কোথাও বসি চলো?

নীলি মনে মনে বলল, ইশ, আমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার কত ইচ্ছে, যাবো না, এখানেই থাকবো!
কিন্তু মুখে ভদ্রভাবে বলল, এখানেই দাঁড়াই।
আবির বলল, এটা আবাসিক এরিয়া, এখানে একটু পরেই কেউ না কেউ কিছু বলবে, তখন?
-বলবে না।
আবির বিরক্ত হলো, মেয়েটার সমস্যা কি, সাধারণ কথাটা বুঝতে চাইছে না কেন!
আবির গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, এসো।
-কোথায় যাবো!
আবির একটু দুষ্টুমি করে বললো, আমি তো তোমাকে যে কোনো জায়গায়ই নিয়ে যেতে পারি!

ইশ, শখ কত, নীলি ভাবলো।
আবির বলল, কাছেই অনেক রেস্টুরেন্ট, চলো বসি কোথাও?

নীলি উঠে বসল। কাছাকাছি একটা ছিমছাম রেস্টুরেন্টে ঢুকলো আবির।
কি আশ্চর্য বিষয়, নিজের বউয়ের সাথে দেখা করতে এসে অপরিচিতের মত ব্যবহার করতে হচ্ছে!
নীলি একটা কথাও বললো না। আবির এক সময় বললো, আমার বাসা উত্তরা, তুমি যাবে?
– না এখন যাবো না!

আবির উত্তর দেওয়ার ধরণ দেখে হেসে বলল, আচ্ছা, তাহলে নিরিবিলি কোথাও চলো, এভাবে তো জরুরি কথা বলা যায় না।

-কি জরুরী কথা বলবেন! এখানেই বলেন!

-নীলি, তুমি রেগে রেগে কথা বলছো মনে হচ্ছে, কিন্তু এই বিয়েটা তুমিও যেমন জানতে না, আমিও জানতাম না, তুমি দেখেছো আমরা একই সাথে বাদামহাটি গিয়েছি!

নীলি মাথা নিচু কর বলল, আপনি চাইলে না করতে পারতেন। করেননি কেন!

-কারণ আমার নানাভাই বিয়েটা করতে বলেছে, আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে নানু অনেক করেছেন আমাদের জন্য, আমি তার কথা ফেলতে পারি নি, যাই হোক, তোমার কি কোনো সমস্যা আছে বিয়েটা নিয়ে? মানে অন্য কেউ পছন্দের আছে?

নীলি ঘাড় নাড়লো! কেউ নেই।

-অন্য কেউ পছন্দ না থাকলে তো অন্য সমস্যা থাকার কথা না! তুমি তো একেবারে ছোটো না, তোমাদের ক্লাশে আরো দুয়েকজনের বিয়ে হওয়ার কথা!

-এত হুট করে বিয়ে হয়, কিচ্ছু বুঝলাম না, কবুল আর সই, বিয়ে শেষ?

-আচ্ছা, তুমি কি তাহলে অনেক আয়োজন করে বিয়ে চাও? চাইলে বলো, তোমাকে ধুমাধাম করে উঠিয়ে আনা হবে।

নীলি বলল, আপনার কেউ পছন্দের নেই?
–ছিল, কিন্তু কি করবো বলো, বিয়ে তো করে ফেললাম!

আবির দেখলো, নীলির মুখ ভার হয়ে গেল!
-তাহলে তাকে ঠকানো হলো না!

আবির খেয়াল করল, বাহ, পটের বিবি তো দারুণ হিংসুটে! মুখে বলছে, বিয়ে করতে চায় নি, আবার হিংসেটাও লুকাতে পারছে না। তাই হো হো করে হেসে বলল, পছন্দ থাকলে তো পছন্দের কাউকে বিয়ে করতাম তাই না? তুমি ভীষন ছেলেমানুষ এখনো! তোমার বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় করাবে না?

-কেউ জানে না! আমি কাউকে বলিনি!

-আচ্ছা৷ তাহলে পরেই বলো। আজকে চলো, উঠি।

আবির নীলিকে এগিয়ে দিয়ে এলো নীলির বাসা পর্যন্ত!
নীলির জন্য আনার গিফটগুলিও দিলো! তারপর চলে গেল।
আবির চলে যাওয়ার পরে নীলির একটু মন খারাপ লাগতে লাগলো, একটু ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!


আমাদের গল্পের নায়িকা নীলি দেখতে কেমন?
একটু ছিপছিপে, ফর্সা, চোখগুলো বড় বড়, নাক খাড়া, এককথায় তাকে মোটামুটি সুন্দরী বলা যায় কিন্তু পড়াশোনা করতে গিয়ে কখনো সাজগোজের দিকে মন দেওয়া হয়নি। তাই সৌন্দর্যটা প্রাকৃতিক এখনো ঠিক কৃত্রিম হয়ে ওঠেনি।
আবির ভাবছিল, এর আগে যতবার মেয়ে দেখা হয়েছে, মেয়েগুলি আরো কিছুটা আকর্ষণীয় ছিল, নীলি কোথাও খুব সাধারণ। একটু বেশিই সাধারণ, মফস্বল থেকে ঢাকায় পড়তে আসা মেয়ে বোঝা যায়। এখনো শহরের চাকচিক্যময় জীবনের ছোঁয়া লাগেনি।
আবির বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা করছে, এবং মোটামুটি সফল বলা চলে। পড়াশোনা শেষ করার আগে থেকেই ব্যবসা করার পরিকল্পনায় ছিল, তাই এই ক্যারিয়ারে আট নয় বছর হয়ে গেছে।
ব্যবসা দাঁড় করাতে গিয়ে বিয়ে নিয়ে ভাবার সময় পায়নি।মা আর ছোটবোনকে নিয়ে উত্তরা থাকে।
বেশ কয়েকমাস ধরে আবিরের জন্য পাত্রী খোঁজা চলছিল, আবির যেহেতু ব্যবসা করে, বেশ স্ট্রেসফুল কাজ, তাই আবির চাইছিল, এমন কেউ আসুক, যার সাথে অন্তত কিছু সমস্যা শেয়ার করলে ভালো লাগবে। যাই হোক, নীলির সাথে আলাপে আবিরের মনে দাগ কাটার মতো কিছু হয়নি। নিতান্তই অপরিচিত একজনের সাথে দেখা করার মতো ঘটনা। ওখান থেকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে নীলির কথা মনেও পড়েনি।

নীলি ফ্ল্যাটে ফিরতেই ওর রুমমেটরা কাছে চলে এলো, -এটুকু সময়ে শপিং করে ফেললি!
-আরে না না, এগুলো গিফট!
-কে গিফট দিলো এত কিছু, দেখে তো বিদেশি মনে হচ্ছে!
নীলি হাসলো।
ব্যাগ, চকলেট, কিছু কসমেটিকস, নীলি কখনো এগুলো দিয়ে সাজেনি‌,তাই এর মর্ম সে বুঝলো না।
পম্পি, যে কিনা একটু সাজুগুজু বিশেষজ্ঞ, সে বললো, এগুলি তো অনেক এক্সপেনসিভ হবে নীলি!
নীলির অবশ্য গিফট টিফট নিয়ে অতো মাথা ব্যাথা ছিল না। তাই ও বেশি কথা বলল না। তবে এ কয়েক দিন একটা বিরক্তি কাজ করছিলো, আজ আর সেটা নেই, মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ হবে না।

নীলি বাড়িতে ফোন করে মাকে জানালো, দেখা হওয়ার গল্প। নীলির মা বললেন, গিফট পেয়ে আবার পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিও না। ছেলের যতোই টাকা পয়সা থাক, মেয়েদের কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত!

কথাগুলো বললেন ঠিকই কিন্তু মনে আশংকা, ছোটো বেলা থেকে এক যত্ন করে পড়িয়েছেন মেয়েটাকে, এই বিয়েশাদি হয়ে এবার পড়াশোনা গোল্লায় না যায়। এই ছেলের টাকা পয়সা আছে, দেখা যাবে বউয়ের পড়াশোনা নিয়ে কোন চিন্তাই করবে না।

রাতে কি নীলিকে আবির ফোন করবে একবার! অবচেতন মনে নীলি অপেক্ষা করতে শুরু করে, কিন্তু আবির ফোন করল না , ওর মনেই পড়ল না!

চলবে

শানজানা আলম