#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৫৮|
ফায়াজ ওর প্রত্যেক বন্ধুকে কল করে এই পুতুলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে। এমনকি মেহেরের বন্ধুদের এবং অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিল তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে কে ফায়াজের নাম করে এই পুতুল দিয়েছে। কেউ স্বীকার করে নি। ফায়াজের মাথা গরম হয়ে আছে। এমন একটা কাজ কে করল? আজকাল যার যা খুশি করে যাচ্ছে। ও কিছুই করতে পারছে না। মেহেরকে সেফটি দিতে পারছে না। বারবার কেউ ওর স্ত্রীর সাথে বিভিন্ন ভাবে নোংরা খেলা খেলছে আর ও কিছু করতে পারছে না।
রাগে গজগজ করতে করতে দেয়ালে লাথি মারল। কিছুতেই রাগ কমছে না। কেউ একজন ওদের পুতুলের মতো নাচ্চাছে আর দূর থেকে মজা নিচ্ছে কিন্তু ধরতে পারছে না।
এদিকে ওর বন্ধুরাও আপসেট। বন্ধুর বউয়ের জন্মদিন খেতে গিয়ে যেন বেশ অপরাধ করে ফেলেছে। খেয়ে বাড়ি ফেরার পর পরই ফোন করে ঝাড়ি। ভালোমন্দ খাবারের সাথে যেন ঝাড়ি ফ্রি।
।
পরের দিন তুষার এসেছে। তুষার আর ফায়াজ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। ফায়াজের চুলগুলো উড়ছে। ফায়াজ চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে তুষারের দিকে তাকাল। তুষারকে বেশ চিন্তিত লাগছে। ফায়াজের চোখে চোখ পড়তেই তুষার বলল,
“ফায়াজ, আমার কিছু ডাউট হচ্ছে। তোকে বলব কি না বুঝতে পারছি না।”
ফায়াজ হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারছে। তবুও বলল,
“বলে ফেল।”
তুষার রেলিঙের উপর হাত দিয়ে বলল,
“বিষয়টা কাকতালীয় বা মজা করে ঘটানো হয় নি। আমার মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে এমন করেছে। আমি সবাইকে নিজে দায়িত্ব নিয়ে জিজ্ঞেস করেছি। ওরা কেউ করে নি। আর তোর কি মনে হয় মেহেরের সাথে ওরা এমন মজা করবে। এ ধরনের মজা করার সাহস পাবে। তুই যে ওদের ছাড়ার পাত্র নয় ওরা সেটা ভালো করেই জানে।”
ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি এটাই ভাবছি রে। এই কাজটা সে-ই করেছে। যে ব্যক্তি ওইদিন মেহেরকে আঁটকে রেখেছিল। কিন্তু সে যে কে বুঝতেই পারছি না। কে এমন করছে? কেন করছে? মেহেরকে নিয়ে আমি অনেক টেনশনে আছি।”
তুষার ফায়াজের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই, মেহেরকে এ-সব জানাস না। বললি আমরা মজা করেছি।”
ফায়াজ তুষারের কাঁধের হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“না, ওকে বলা যাবে না। ভয় পাবে।”
তুষার কিছু একটা ভেবে বলল,
“ভাই সাবধানে থাকতে হবে আর তোকে খেয়াল রাখতে হবে। সব কিছুর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। যে এই কাজ করেছে সে নিশ্চয়ই আবারও কিছু করার চেষ্টা করবে। তাই চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। একটু সাবধানে থাকলে তাকে ধরা যেতে পারে।”
ফায়াজ দেখল তুষার যুক্তিহীন কথা বলে নি। ওর কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। ওকে কেয়ারফুল থাকতে হবে। মেহেরের প্রতি আগের চেয়ে বেশি কেয়ারফুল হতে হবে।
।
ফায়াজ অফিস থেকে মাত্র ফিরেছে। ফায়াজের মা ফায়াজের জন্য জুস রেডি করছে। মেহেরকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জুস রেডি করে মেহেরের হাতে দিয়ে বলল,
“যাও, ফায়াজ এসেছে অনেকক্ষণ হয়েছে।”
মেহের গ্লাস হাতে ড্রয়িংরুম দিয়ে যাচ্ছে তখনই ফাইজা একটা বক্স হাতে ভেতরে এল। মেহের কৌতূহল বশত দাঁড়িয়ে গেল।
ফাইজা মেহেরকে দেখে স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“পার্সেল দিয়ে গেল। ভাইয়ার নামে এসেছে। তুমি উপরে যাচ্ছো? তাহলে নিয়ে যাও।”
মেহের হাত বাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ দাও। আমি উপরে যাচ্ছি।”
মেহের পেটের সাথে বক্স মিশিয়ে এক হাতে ধরল আর অপর হাতে জুস। ফায়াজ ঘরে নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। ফায়াজ নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে। মেহের বিছানার উপরে বক্স রেখে সেন্টার টেবিলের উপর গ্লাস রাখল। ফায়াজ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে টেবিলের উপর থেকে জুসের গ্লাস নিয়ে এক চুমুক পান করে বিছানার দিকে চোখ গেল। বিছানার উপরে একটা বক্স আর মেহের তার পাশে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে।
ফায়াজ গ্লাস টেবিলের উপরে রেখে বিছানার কাছে যেতে যেতে বলল,
“কি এটা?”
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে মিষ্টি হেসে বলল,
“পার্সেল! তোমার নামে পার্সেল এসেছে।”
ফায়াজ নিজের নামে পার্সেলের কথা শুনে ভীষন অবাক হলেন। ফায়াজ কৌতূহল নিয়ে বক্সটা উলটে পালটে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
“কারো নাম নেই দেখছি। কে দিল? খুলেই দেখি।”
মেহের সায় দিল। ফায়াজ পার্সেলের দিকে মেহেরকে ঝুঁকে থাকতে দেখে মজা করে বলল,
“বোম-টোম থাকলে তোমার মুখে গিয়ে ফাটবে।”
মেহের ফায়াজের দিকে সরু চোখে তাকাল। তারপর ভেংচি কেটে দূরে সরে গেল।
ফায়াজ বক্স খুলে একটা বড় টেডি দেখতে পেল। ফায়াজ টেডি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। মেহের বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। ওর কেন জানি হাসি পাচ্ছে। কেউ ফায়াজের জন্য টেডি পাঠিয়েছে।
ফায়াজ পাশে টেডি রেখে খামটা নিয়ে খুলে পড়া শুরু করে।
প্রিয়তা,
“আজকাল বড্ড মনে পড়ে তোমায়। জ্যোৎস্না রাতেও তুমি হীনা নিকষ কালো অন্ধকার অনুভব করি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে একা অনুভব করি। কতশত স্মৃতি ভেসে উঠে চোখজুড়ে। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। কিন্তু তুমি বদলে গেছো। ভীষণ বদলে গেছো। তোমার কি মনে পড়ে না আমায়? এক মুহূর্তের জন্যও না? এত নিষ্ঠুর কি করে হলে প্রিয়া? তোমার লেখা চিঠিগুলো আজও যত্ন করে রেখেছি।
উহু, আজ আর যত্ন নয়। এই চিঠিগুলো আমাকে যন্ত্রণা দেয় তাই তোমাকে ফেরত পাঠালাম। ভালো থেকো তুমি ফায়াজের সাথে। আর হ্যা মেহের, টেডি তুমি খুব ভালোবাসো তাই তোমার পছন্দের টেডি পাঠালাম। ঘৃণা করে ফেলে দিও না। এগুলো ফায়াজের নামে পাঠিয়েছি যাতে কেউ সন্দেহ না করে।”
ইতি
যাকে প্রাক্তন বলে ছুড়ে ফেলেছো।
ফায়াজ কিছুই বুঝতে পারছে না। ওর নামে পার্সেল কিন্তু এ-সব কি লিখা। মেহেরের নাম। আর বলছে প্রাক্তন। ফায়াজ চিঠিটা আবারো পড়ল। চিঠির সারসংক্ষেপ বুঝতে পেরে মাথায় যেন বাঁজ পড়ল। ফায়াজ দ্রুত ভেতরের ছোট ছোট চিরকুটগুলো বের করল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ফায়াজকে বিচলিত দেখে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না।
ফায়াজ প্রতিটি চিরকুট খুলল। মেহেরের হ্যান্ড রাইটিং। মাহি মেহেরকে দিয়ে যেরকম চিঠি লিখতো ঠিক তেমনই। ফায়াজ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।
মেহেরের একটা অতীত ছিল? আর সেই অতীতে ওর জীবনে বিশেষ কেউ ছিল। কিন্তু মেহের কেন বলে নি ওকে? কেন হাইড করল? মেহেরের জীবনে কেউ ছিল সেটা ভেবেই ফায়াজের ভেতর টা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। মনে ভীষণ ঝড় উঠেছে। সে ঝড় থামার নয়।
মেহের ফায়াজকে এভাবে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেল। ওর চোখমুখ লাল হয়ে আছে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে। গালেও লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে। হটাৎ কি হলো বুঝতে পারছে না।
মেহের ভয়ে ভয়ে বলল,
“কি হয়েছে ফায়াজ? এগুলো কি?”
ফায়াজ মেহেরের হাতের উপর চিঠিটা রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
“নিজেই দেখে নেও।”
চিঠিটা পড়ে মেহেরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। মনে হচ্ছে শূন্যে ভাসছে।
মেহের ঢোক গিলে বলল,
“ফায়াজ, আমি এসবের কিছুই জানি না।”
ফায়াজ চোখ বন্ধ করে বলল,
“ছেলেটা কে?”
মেহের কেঁদে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি জানি না।”
ফায়াজ আবারও শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“ছেলেটা কে?”
মেহের একি উত্তর দিল। ফায়াজ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। কেউ মেহেরের জীবনে ছিল সেটা মানতে পারছে না আর ও নিজেই জানে না। মেহের ওকে জানায় নি।
ফায়াজ চিৎকার করে বলল,
“মেহের, তোমার জীবনে কেউ ছিল, তোমার অতীত ছিল। তুমি আমাকে এভাবে ঠকালে? আমি তো আমার লাইফের সব তোমাকে ক্লিয়ার করেছি। নিজেকে তোমার কাছে খোলা বইয়ের মতো রেখেছি আর তুমি..? ”
মেহের ফায়াজের হাত ধরে বলল,
“বিশ্বাস করো আমি মিথ্যা বলছি না। কেউ ইচ্ছে করে এমন করছে। তোমার আগে আমার জীবনে কেউ ছিল না আর থাকবেও না।”
ফায়াজ চিরকুটগুলো খুলে বলল,
“তোমার হ্যান্ড রাইটিং না?”
মেহের ভালো করে দেখল এই লেখাগুলো ওর। ওরই হাতের লেখা। কিন্তু ও তো কাউকে লিখে নি কেউ ছিল না ওর জীবনে। প্রাক্তন নামে কোন শব্দ ওর জীবনে ছিল না।
“হ্যাঁ এগুলো আমার হাতের লেখা কিন্তু আমি কাউকে লিখি নি। জানি না কিভাবে কি। কিন্তু আমার লাইফে কেউ ছিল না। আমি ছোট থেকেই সবার আদরে বড় হয়েছি। আমি যে বড় হয়েছি তাদের আচরণে প্রকাশ পায় নি। তাই নিজেকে সব সময় ছোটই ভেবে এসেছি। আমি কারো সাথে কোন রিলেশনে যাই নি। এগুলো সব মিথ্যা। আমি কসম করে বলছি। আল্লাহর ওয়াস্তে বিশ্বাস করো।” ( কাঁদতে কাঁদতে)
ফায়াজের একবার মনে হচ্ছে মেহের সত্যি বলছে আরেকবার মনে হচ্ছে ভয়ে মিথ্যা বলছে। কিন্তু কসম করে মিথ্যা বলার মেয়ে ও নয়।
ফায়াজ প্রথমে নিজেকে রিলেক্স করল। তারপর মেহেরকে বলল,
“মেহের, রিলেক্স। কান্না থামাও। আমার কথা শুনো।”
মেহের শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
ফায়াজ সত্যিটা জানার জন্য মেহেরকে আশ্বস্ত করে বলল,
“মেহের, ভয় পেও না। যেটা সত্যি সেটাই বলো। আমারও একটা অতীত আছে। তোমারও থাকতে পারে। অসম্ভব কিছু নয়। কেউ যদি থাকে তাহলে বলো। আমি কিচ্ছু বলব না। প্রমিস করছি।”
“সত্যি কেউ ছিল না।” মেহের আবারও কাঁদতে শুরু করল।
ফায়াজ উঠে গেল। দু পা এগিয়ে আবার মেহেরের কাছে বসে বলল,
“কাউকে কখনো মজা করে এসব দিয়েছো?”
মেহের মাথা নাড়াল। এখানেও না। ফায়াজ আবারও উঠে দাঁড়াল। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
“মেহেরের অতীতে কেউ ছিল না। তাহলে এ-সব কে করছে? কেন করছে? এসব কুরিয়ার করে কেন পাঠাবে?”
ফায়াজের নিজের চুল ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কেউ যে ওদের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করছে সেটা আর অজানা নয়।
ফায়াজ রুমে গিয়ে সবকিছু ওই বক্সে ঢুকিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছে।
মেহের চুপটি করে শুয়ে আছে। মেহেরের কিছুই ভালো লাগছে না। ওর সাথে কেন এমন হচ্ছে? কে ওর সুখের সংসারে আগুন জ্বালাতে চাইছে? কে ওর আর ফায়াজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইছে? ফায়াজ কি ওকে বিশ্বাস করেছে?
মেহের নীরবে চোখের পানি ফেলছে।
ফায়াজ মেহেরের পাশে শুয়ে পড়ল। মেহের বিছানায় ফায়াজের অস্তিত্ব অনুভব করছে। নীরব কান্না যেন বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফায়াজ ওকে এখন আরো প্রশ্ন করবে।
ফায়াজ এক হাতে মেহেরের কোমড় টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। মেহেরের ঘাড়ে নাক ঘষছে। উষ্ণ নিশ্বাস ঘাড় ছুয়ে যাচ্ছে।
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“ফায়াজ আমি সত্যি বলছি। আমি এসবের কিছুই জানি না।”
ফায়াজ মেহেরের ঠোঁটে আঙুল ছুইয়ে বলল,
“হিসস! আমি জানি। তুমি কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
“তুমি আমার কথা বিশ্বাস করেছো?”
ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
“আমি আমার জানকে বিশ্বাস করব না তো কাকে করব? আই ট্রাস্ট ইউ। যে এসব করেছে তাকে ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে।”
।
কয়েক মাস পর~
চারদিকে আলো ঝলমল করছে। ফাইজা একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। ওর শ্বশুর দুজন ব্যক্তির সাথে কথা বলছে। ফায়াজ মেহেরের জন্য ড্রিংকস আনতে গিয়েছে। মেহের চুপটি করে বসে বসে সবাইকে দেখছে। ওর খুব অসুস্থ লাগছে। শরীর মেজমেজ করছে। এত মানুষের ভীড়ে অসহ্য লাগছে। কেমন গা গুলিয়ে আসছে। লাগারই কথা। শরীরের আর কি দোষ! সময়টাই এমন। শরীর খারাপ লাগা বাধ্যতামূলক।
ফায়াজ মেহেরকে ড্রিংক এনে দিলে মেহের এক চুমুক পান করে বলল,
“আমি বাড়িতে যাব। ভালো লাগছে না।”
ফায়াজ অবাক হয়ে বলল,
“মেহের, আর একটু অপেক্ষা করো। এখনো ড্রিল সাইন হয় নি।”
“তুমি থাকো আমি চলে যাই।”
“ঠিক আছে তুমি ফাইজাকে নিয়ে যাও।”
মেহের ফাইজার দিকে তাকাল। ও রুহানের সাথে কথা বলছে। ওকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
“ফায়াজ আমি একাই যেতে পারব। ড্রাইভারকে বলো দিয়ে আসতে।”
ফায়াজ কিছু একটা ভেবে বলল,
“ঠিক আছে। পৌঁছে কল করো।”
মেহের ফায়াজের থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। কেমন সুনসান নীরবতা। রাত বেশি নয় ১০টা ৫৬ বাজে। কিন্তু বাড়ির গা ছমছমে পরিবেশ বলছে গভীর রাত। মেহের ফ্রেশ হয়ে ওর শাশুড়ী মায়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখে তিনি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি ঘুমাচ্ছে। সবাই এত তাড়াতাড়ি ঘুমাচ্ছে কেন? মেহেরের খুব অবাক লাগছে। মেহেরের অনেক ক্লান্ত লাগছে। চোখের দু পাতা ভারী হয়ে আসছে। শরীরটাও ভালো লাগছে না। ফায়াজকে ফোন করে বাড়িতে সেফলি চলে এসেছে। এটা জানিয়ে মেহের শুয়ে পড়তেই দুচোখে ঘুম প্রবেশ করল। ফায়াজ নিশ্চিন্তে নিজের কাজ করছে।
হটাৎ কিছু পোড়ানোর শব্দ পেয়ে মেহেরের ঘুম ভাঙল। মনে হচ্ছে আগুনে কিছু পুড়ছে। ওর নিজেরও গরম অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরে আগুনের তাপ লাগছে। মেহের লাগা লাগা চোখ খুলতেই বুক কেঁপে উঠল৷ চারদিকে আগুন জ্বলছে। ওর চারপাশে আগুন। মেহের দ্রুত উঠে বসে। কোথাও আছে জানে না। পেটে হাত দিতেই ওর ভয়টা বেড়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। চারদিকে আগুন কেন? আগুনের উত্তাল বেড়ে চলেছে। তাপে যেন ওর শরীর ঝলসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখছে। মেহের দরজার সামনে গিয়েও ভয়ে ফিরে আসছে। মেহের জোরে চিৎকার করছে।
“ফায়াজ! আগুন!” “বাঁচাও! আগুন।”
ফায়াজ ড্রিল সাইন করে বের হতেই ওর ফোনে একটা মেসেজ এলো। আননোন নাম্বার। ফায়াজ ওপেন করতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। পুরো দুনিয়া থেমে যাচ্ছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে মেহের আগুনের মধ্যে আটকে পড়েছে। আর চিৎকার করছে সাহায্যের জন্য। ওকে ডাকছে।
ফায়াজ যেন শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। হাত থেকে ফোন পড়ে গেল৷ সারা শরীর কাঁপছে। কিঞ্চিৎ শক্তি নেই শরীরে।
অস্ফুট স্বরে বলল,
“মেহের!”
ফায়াজ দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে। ওই নাম্বারে ফোন করল দ্রুত। রিসিভ হলো তবে রিসিভ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল এক মেয়েলী কন্ঠ।
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কে তুই? আমার মেহের কোথায়? ওর কিছু হলে আমি তোকে খুন করে ফেলব। মেহের কই?”
“রিলেক্স! এত উত্তেজিত হওয়া ভালো না। আমি তোমাকে বলব, অবশ্যই বলব। আমি চাই তুমি ওর মৃত্যু সামনে থেকে উপভোগ করো। ছটফট করো। হেল্পলেসের মতো চেয়ে চেয়ে দেখো। এছাড়া ওর লাশ নিতে হবে তো।”
ফায়াজ চিৎকার করে বলল,
“আর একটা বাজে কথা বললে তোর জিভ কেটে ফেলব।”
“লোকেশন সেন্ট করছি চলে এসো। শেষ বারের মতো বউকে দেখে নেও।”
খট করে ফোন কেটে দিল। সাথে সাথে মেসেজ। ফায়াজ গাড়ির স্পিড ফুল করে দিল। ফায়াজ কন্ঠস্বরকে চেনার চেষ্টা করছে কিন্তু ব্রেইন কাজ করছে না। মেহের বিপদে আছে। ওর জীবন হুমকির মুখে। ওকে মেহেরকে বাঁচাতে হবে। মাথা কাজ করছে না।
ফায়াজ লোকেশনে পৌছাল। একটা ছোট ঘরে আগুন জ্বলছে। আশেপাশে কেউ নেই। ফায়াজ চিৎকার করে মেহেরকে ডাকল। মেহের ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে ফায়াজকে ডাকতে চাইছে কিন্তু পারছে না। সে শক্তি ওর নেই। শ্বাস নিতে পারছে না। কোন শব্দ আসছে না ভেতর থেকে। ফায়াজের ভেতরটা ধুক করে উঠল। কতগুলো লোক এসে ফাতাজকে বেঁধে ফেলে। ফায়াজ প্রাণপণ চেষ্টা করে ছোটার জন্য। কিন্তু পারছে না। ওরা ফায়াজকে একটা গাছের সাথে বেঁধে দূরে সরে যায়। ফায়াজ চিৎকার করছে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। মেহেরের কানে ফায়াজের চিৎকার ভেসে আসছে। ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ ফায়াজের হাত পায়ের বাঁধন থেকে রক্ত ঝড়ছে।
ফায়াজ জ্বলন্ত ঘরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল।
“আমি পারছি না আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যু দেখতে। আল্লাহ! আমি এতটা অসহায় যে আমার স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারলাম না। মেহের, আমাকে ক্ষমা করো না। আমি আমার কথা রাখতে পারি নি। আল্লাহ আমাকেও নিয়ে যাও। আমি মেহেরকে ছাড়া এই পৃথিবীতে থাকতে চাই না। এই নিষ্ঠুরতম পৃথিবীতে থাকতে চাই না।”
কথাস্বরগুলো বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে। ফায়াজের চিৎকার আর আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আসছে। নিস্তব্ধ রাতে অদৃশ্য হাহাকার আহাজারিতে দুজন মানব মানবীর স্বপ্ন অদূরেই দুঃস্বপ্নে রুপ নিল।
চলবে….!
#শেষ_পাতায়_তুমি
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-৫৯|
মানুষের কোলাহলের শব্দ ফায়াজের কানে পৌছাতে ফায়াজ পিটপিট করে চোখ খুলল। মনে হচ্ছে শুয়ে আছে। কিন্তু কোথায়? ফায়াজ চারপাশটা দেখার চেষ্টা করছে। ও একটা বেডে শুয়ে আছে। দেয়ালের সাথে লাগোয়া যন্ত্রগুলো জানান দিচ্ছে এটা হসপিটাল। ফায়াজ উঠে বসার চেষ্টা করছে। তখনই হাতে টান অনুভব করে। স্যালাইন চলছে। হটাৎ ওর মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগের কথা। একটা ঘরে আগুন জ্বলছে। মেহের, ফায়াজ বলে চিৎকার করছে। ওরা ওকে গাছের সাথে বেঁধে রেখেছে।
ফায়াজের শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে।
হাতের সব কিছু ছিড়ে ফেলে বেড থেকে নামতে নামতে চিৎকার করছে।
“মেহেররররররর!!”
ফায়াজ চিৎকার করে কাঁদছে আর মেহেরের নাম করছে। তুষার দৌড়ে এসে ওকে বাঁধা দিল। ফায়াজ তুষারকে দেখে ওর দু-বাহুতে হাত রেখে বলল,
“ওরা আমার মেহেরকে মেরে ফেলেছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। কাউকে না। সবাই কে খুন করে ফেলব।”
ফায়াজ হাউমাউ করে কাঁদছে। তুষার কিছুতেই ওকে থামাতে পারছে না। তুষারকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
“ফায়াজ, থাম। আমার কথা শোন। কি করছিস? তোর হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে।”
ফায়াজ বিলাপ করে বলছে, “ওরা মেহেরকে মেরে ফেলেছে। আমি কি করে বাঁচব? আমি মেহেরকে বাঁচাতে পারি নি। ওরা ওকে মেরে ফেলেছে।”
“ফায়াজ, মেহেরের ট্রিটমেন্ট চলছে। ও বেঁচে আছে। কি বলছিস তুই এ-সব?”
ফায়াজ কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। তুষারের কথা ওর কানে মধুর সুর হয়ে বাজছে। ফায়াজ কান্না থামিয়ে তুষারকে ছেড়ে ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে। তুষার ফায়াজের চোখের পানি মুছে বলল,
“মেহেরের ট্রিটমেন্ট চলছে ভাই।”
ফায়াজ আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে। তুষারকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কিছুক্ষণ আগেও কাঁদছিল। তবে এ কান্নার মধ্যে পার্থক্য আছে। এ কান্না সুখের কান্না।
তুষার ফায়াজকে সব খুলে বলল। ফায়াজের মাথা কাজ করছিল না ওই ভিডিও দেখার পর। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ছিল। ড্রাইভিং করতে করতে তুষারকে ফোন করে সব জানায়। তুষার তাৎক্ষণিক পুলিশ আর ফায়ার ব্রিগেডকে লোকেশন জানায়। ওরা এসে মেহেরকে উদ্ধার করে। ফায়াজকে সেন্সলেস অবস্থায় পায়। ততক্ষণে তুষারও চলে আসে। তারপর ওদের দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়।
সবটা শুনে ফায়াজ তুষারকে আবারও জড়িয়ে ধরে।
“আমি অনেক ভাগ্যবান তোর মতো বন্ধু পেয়েছি। তুই সব সময় আমার পাশে থাকিস। তোকে আমি আমার সব বিপদে কাছে পেয়েছি। আজ-কাল এমন বন্ধু কারো ভাগ্যে জুটে না। আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবান। তুই আজ আবারো আমাকে বাঁচিয়ে দিলি। তোর এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।”
“শোধের কথা বলছিস কেন? তুই আমার বন্ধু। আর বন্ধু তো সেই হয় যে বিপদে পাশে থাকে। আমি আমার বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করেছি।”
“তবুও। তুই আমার জন্য অনেক করেছিস। আজ পর্যন্ত আমি তোর জন্য কিছুই করি নি।”
তুষার আগ্রহ নিয়ে বলল,
“তাহলে কিছু কর। সামিরার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দে। দুদিন পর পর ব্রেকাপ করে। অন্য কাউকে বিয়ে করার হুমকি দেয়।”
“ঠিক আছে ওকে তুলে নিয়ে আসব। তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে সেই ছেলেকে উপরে পাঠিয়ে দেব। এই ঝামেলাটা মিটতে দে তারপর কথা দিচ্ছি। আমি নিজে তোদের বিয়ে দেব।”
তুষার মুচকি হাসল। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“পুলিশ কাউকে খুঁজে পায় নি। ওরা কারা ছিল জানিস কিছু? আর সব চেয়ে অদ্ভুত বিষয় কি জানিস? ওরা যেসব পদার্থ ব্যবহার করেছে তাতে আগুন ধীরে ধীরে জ্বলবে। মানে অনেক সময় লাগবে। কাউকে মারতে চাইলে দ্রুত মারতে চাইবে কিন্তু ওরা.. ”
ফায়াজ চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“যাতে মেহের ধীরে ধীরে মরে আর আমি ছটফট করছে থাকি। তিলে তিলে মেহেরকে মরতে দেখি। কষ্ট পাই। তাই এমন করেছে।”
তুষার অবাক হয়ে বলল,”কিন্তু কেন? ওরা কারা?”
ফায়াজ মুখ গম্ভীর করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি জানি ওরা কারা ছিল।”
তুষার কৌতূহল নিয়ে বলল,”কে?”
ফায়াজ ওর দিকে চেয়ে বলল,”হিমি!”
তুষার দাঁড়িয়ে গেল।
“হিমি!! হিমি এ-সব করেছে? কিন্তু কেন? তুই ওকে দেখেছিস?”
ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“ও-ই আমাকে ফোন করেছিল। ও-ই এসব করেছে। কিন্তু কেন সেটা তো আমি পরে দেখে নিব।”
“আচ্ছা, ওকে পরে দেখছি মেহেরকে নিয়ে ভাব। ওর অবস্থা অনেক ক্রিটিকেল। আমি আংকেলকে জানিয়েছি। ওরা আসছে।”
ফায়াজ মেহেরের অবস্থা ক্রিটিকেল শুনে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি ওকে এখুনি দেখতে চাই।”
তুষার ফায়াজের হাত ধরে বলল,
“পাগলামি করিস না। ড্রেসিং হচ্ছে। তবে বেশি পুড়ে নি। তুই চিন্তা করিস না।”
“ওর শরীর পুড়েছে? অনেক কষ্ট পাচ্ছে? হিমি ওকে এত কষ্ট দিল? আমি হিমিকে ছাড়ব না। ওরা আমার মেহেরের সাথে যা করেছে আমিও ওদের সাথে তাই করব। কাউকে ছাড়ব না। ভয়ানক শাস্তি দেব।”
“আচ্ছা, আচ্ছা দিস। তবে এখন শান্ত হ। ওর জন্য দোয়া কর। আর যেভাবে রক্ত ঝড়ছে তুই নিজেই জমের বাড়ি চলে যাবি।”
ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
“মেহের যেহেতু বেঁচে আছে আমি এত তাড়াতাড়ি জমের বাড়ি যাচ্ছি না। হিমির থেকেও যে প্রতিশোধ নেওয়া বাকি।”
হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে ভোর থেকে। সকালে মেহেরের জ্ঞান ফিরল। ফায়াজ পুরো রাত দরজার বাইরে বসে ছিল। ভেতরে ঢোকার পারমিশন দেয় নি। মেহেরের বাবা-মাও রাতে চলে এসেছেন। আর বারবার কেন উনার মেয়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটছে তার কৈফিয়তও চেয়েছেন। মাহি আর তূর্জ সকালে এসেছে। ফায়াজের বাবা-মা, ফাইজা খবর পেয়ে সাথে সাথেই চলে এসেছে।
সকালে মেহেরের জ্ঞান ফিরতেই ফায়াজ মেহেরের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। ওর জামা-কাপড়ে রক্তের ছিপছিপ দাগ। চুল এলোমেলো, মুখটা ফ্যাকাসে, চোখগুলো কেমন ছোট ছোট হয়ে আছে।
ফায়াজকে ডাক্তার বলে দিয়েছে মেহের এখনো ট্রমার মধ্যে আছে। ভয় পেয়ে আছে খুব। তাই মেহেরকে এমন কোন কথা বা প্রশ্ন যেন না করে যাতে আবারও ভয় পেয়ে যায়।
মেহের চোখ খুলে শরীরে ব্যথা অনুভব করছে। ও ভাবছে ওকে ফায়াজ নিয়ে এসেছে হসপিটালে৷ ফায়াজ ভেতরে ঢুকে মেহেরের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ দেখতে পেল। মেহেরের খোলা চোখ যেন কাউকে খুঁজছে।
ফায়াজকে দেখেই মুচকি হাসল। মেহের ভাবে নি আর ফিরে আসবে। চোখ বন্ধ করার আগ মুহুর্তে মনে হয়েছে দুনিয়ার সঙ্গ শেষ। আর এই দুনিয়া দেখতে পাবে না।
মেহের হাত বাড়িয়ে ফায়াজকে ডাকল। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে হাতে চুমু খেয়ে চোখের পানি মুছল।
মেহের কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“ফায়াজ, আমি শুধু তোমাকে কাঁদাই। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। সবাইকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। জানো আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চারদিকে আগুন জ্বলছে আর তার মাঝে। তোমাকে ডাকছি কিন্তু তুমি আসছো না। চোখ বন্ধ করলেই আমার সামনে এগুলো ভেসে উঠে। আমার এখনও ভয় করছে। আমি ভাবতে পারি নি আমি আবার এই দুনিয়ার আলো দেখতে পাব। তোমাকে দেখতে পাব। ভেবেছিলাম সব শেষ।” ( মেহের ডুকরে কেঁদে উঠল)
ফায়াজ কিছু বলতে পারছে না। ও মেহেরকে সাহায্য করতে পারে নি। চুপচাপ দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। নিজেকে অপরাধী লাগছে। মেহের ফায়াজকে চুপ দেখে বলল,
“আমাকে একটু উঠিয়ে বসাও।”
ফায়াজ মেহেরকে উঠিয়ে বসাল।
“মেহের, আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারি নি। আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারি নি। আমি তোমার ব্যর্থ স্বামী। সরি।”
মেহেরের হটাৎ কি জানি মনে পড়ল। পেটে হাত দিয়ে চোখ বড়বড় করে আছে। চোখে মুখে ভয় বিরাজ করছে।
ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“ফায়াজ, আমার বেবি? বেবি ঠিক আছে?”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কি উল্টো পালটা কথা বলছে। ডাক্তার বলল ও ট্রমায় আছে, শকড। শকডের জন্য এমন উলটা পালটা কথা বলছে। মাথায় সমস্যা হয় নি তো?
ফায়াজকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে মেহের চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকল। চিৎকার শুনে নার্স দৌড়ে এল। কিছুক্ষণ পরে একজন ডাক্তার এল।
মেহের বিচলিত কন্ঠে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল,
“আমার বেবি? বেবি ঠিক আছে?”
ডাক্তার মুচকি হেসে বলল,
“জি, আপনার বেবি একদম ঠিক আছে।”
ফায়াজ ডাক্তারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তারপর আমতা আমতা করে আধো আধো হেসে বলল,
“কি বলছেন ডাক্তার? কিসের বেবি?”
ডাক্তারের আগে নার্স বলল,
“ওমা, আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। আপনি জানেন না?”
ফায়াজ বিস্ময় নিয়ে ডাক্তারের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিল।
ডাক্তার মুচকি হেসে বলল,
“জি, আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। ফায়াজের বুক ঢিপঢিপ করছে। কেন করছে? আনন্দে? মেহের চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ এখন ওকে চিলের মতো ধরবে। কেন ওকে জানায় নি। মেহেরও তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল।
“মেহের! ডাক্তার কি বলছে? তুমি আমাকে বলো নি কেন?”
মেহের দৃষ্টি নত করে বলল,
“আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই…..”
“হ্যাঁ তোমার সারপ্রাইজের ঠেলায় সব যাচ্ছিল।”
ডাক্তার আর নার্স বেরিয়ে গেল। ফায়াজ মেহেরের আরেকটু কাছে গেল। মেহেরের লজ্জা লাগছে। কেমন অদ্ভুৎ লজ্জা।
ফায়াজ মেহেরের গালে ঠোঁট ছুয়ালো। ওর কি যে খুশি লাগছে। এই খারাপ সময়ে এত ভালো নিউজ, ভাবা যায়। মেহের আবারও ডুকরে কেঁদে উঠল।
ফায়াজ বিচলিত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে কাঁদছো কেন?”
মেহের কেঁদে কেঁদে বলল,
“আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ফায়াজ, খুব। নিজের জন্য না আমাদের বেবির জন্য। মনে হচ্ছিল আমি ওকে বাঁচাতে পারব না। ওকে আমি দুনিয়ার আলো দেখাতে পারব না। অনেক ভয় হচ্ছিল। আমার কতটা ভয় লাগছিল তোমাকে বুঝাতে পারব না।”
ফায়াজের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো।
“মেহের, কথা দিচ্ছি তোমার আর আমাদের বেবির উপর যে চোখ তুলে তাকিয়েছে এইবার আমি আর তাকে ছাড়ব না। ওকে ধরে ফেলেছি। ওকে আমি ভয়ানক মৃত্যু দেব।”
“কে? কে এমন করছে? আমি তো ঘরে শুয়ে ছিলাম। ওখানে গেলাম কিভাবে তাও জানি না।”
“হিমি, হিমি করেছে। কেন করেছে জানি না। তবে জেনে যাব। আগে তুমি সুস্থ হও তারপর। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দেব না। তোমার পুরো খেয়াল রাখব। কোন ফাঁক রাখব না।”
“আচ্ছা, তবে আমার একটা কথা রাখবে? আমার কথা না ভেবে হোক, আমাদের বেবির জন্য।”
“তোমার কোন কথা আমি রাখি না?”
“হিমিকে পুলিশের কাছে দেবে। তুমি নিজে কিছু করতে যাবে না। আমি চাই না তুমি এমন কিছু করো যার প্রভাব আমাদের অনাগত বাচ্চার উপর পড়ুক। তুমি তো বলেছিলে আমাদের বাচ্চা হলে তাকে সুস্থ-সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যের একটা জীবন দিবে।”
ফায়াজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,”আচ্ছা, ওকে পুলিশের কাছেই দেব।”
সবাই একে একে মেহেরকে দেখে গেল। কিছুদিন পরে মেহের ডিসচার্জ পেয়ে গেল। তবে নিয়মিত চেকাপের উপর থাকতে হবে। ঘা না শুকানো পর্যন্ত সাবধানে থাকতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিয়েছে।
~~
মেহের আর ফায়াজ পুলিশ স্টেশনে হিমির সামনে বসে আছে। হিমি হিংস্র চোখে মেহের আর ফায়াজের দিকে তাকাল।
ফায়াজ নম্রভাবে জিজ্ঞেস করল,
“মেহেরের সাথে তোমার কি সমস্যা? কেন ওর পেছনে পড়ে আছো? সেই ভার্সিটি থেকে দেখছি। কেন বলো তো? কি সমস্যা?”
হিমি ফায়াজের দিকে ক্ষীপ্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“আমার সমস্যা তোমার সাথে। আমি চাই তোমাকে কষ্ট পেতে দেখতে। আমি চাই তোমার জীবনে ভালোবাসা বলতে কিছু না থাকুক। তুমি সর্বহারা হয়ে রোজ জ্বলে পুড়ে মরো। এতেই আমার শান্তি। তাই তো মাহিকে ব্যবহার করেছিলাম।”
মেহের ফায়াজ দুজন দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাল।
হিমি হেসে বলল,
“বুঝতে পারছো না? আমি মাহিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। মাহি তূর্জকে ভালোবাসে, তূর্জের সাথে বিয়ে ঠিক সব জানতাম তাই ওকে ব্যবহার করলাম তোমাকে হার্ট করার জন্য। কিন্তু কি হলো? তুমি ওর বোনকে বিয়ে করে নিলে। আর তাকে পাগলের মতো ভালো বাসতে লাগলে। সুখের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল তোমার জীবন। তাই তোমার জীবন থেকে তোমার বেঁচে থাকার অবলম্বন মেহেরকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেটা সম্ভব হয় নি। প্রথমে চেয়েছিলাম তুমি নিজেই মেহেরকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দেও তাই ওই পার্সেল পাঠিয়েছিলাম বাট ফেইল। তাই নতুন প্ল্যান করি ওকে মারার। কিন্তু আপসোস সেখানেও বেঁচে গেল।”
মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ফায়াজের প্রতি এত রাগ কেন? কি করেছে ফায়াজ?
মেহের জিজ্ঞেস করল,
“ফায়াজের প্রতি এত রাগ কিসের? কি করেছে ও?”
হিমি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“তোমার বরের জন্য আমার আদরের বোন আজ নিথর হয়ে পড়ে আছে।”
মেহের ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
চলবে…