শৈবলিনী পর্ব-২২+২৩

0
666

#শৈবলিনী—২২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আদত্য তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিচে এলো। আদিত্যকে এভাবে বেড়িয়ে যেতে দেখে ডাইনিং টেবিল থেকে ডাকলেন রেহনুমা। সকালের খবরের কাগজে আদিত্যর নিউজটা বাসার সবাইসহ তিনিও দেখেছেন। এমনিতে রেহনুমা এসব বিষয়ে তেমন চিন্তিত হন না।ছেলের উপর তার আস্থা আছে। তিনি জানেন সেলিব্রিটিদের নিয়ে এসব নিউজ আজকাল ট্রেন্ড হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তিনি বিচলিত। বিচলিত হওয়ার হেতু হলো ছবির ওই মেয়েটা। রেহনুমার বিচক্ষণ নজর মেয়েটাকে চিনতে সময় নেয়নি। তিনি ঠিক চিনে ফেলেছেন এটা সেই মলের মেয়েটাই। আর এমন উশৃংখল, বখাটে টাইপের মেয়ের সাথে আদিত্যর কী সংযোগ হতে পারে এটাই চিন্তার বিষয়। আর এটাই জানতে হবে আদিত্যের কাছ থেকে। তবে শান্ত ভাবে। আগেই রাগারাগি করা যাবে না ছেলের সাথে। তাই স্বাভাবিক সুরেই আদিত্যকে ডেকে বললেন।
–আদি, নাস্তা না করে এভাবে বের হচ্ছো কেন?

–আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা মা। আমি বাইরে কিছু খেয়ে নিবো। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।

–পাঁচ মিনিটে কিছু হবেনা আদি। বসো তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।

আদিত্য এবার থেমে গিয়ে টেবিলের সবার দিকে তাকালো। সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। প্রশ্নবোধক চাহনি সবার। মায়ের জরুরি কথার বিষয়বস্তু কী তাও ভালোই বুঝতে পারছে আদিত্য। আদিত্য ডাইনিং টেবিলের সামনে এগিয়ে গেল।সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলো,
–মা, আমি জানি কী জরুরি কথা বলতে চাইছ তুমি। আর কী জানতে চাইছ। তো মা, বাবা, আন্নি,আদ্র এবং বাকি সবাই একবারে শুনে নাও।ভেবেছিলাম ঠিক সময় হলে বলবো। কিন্তু যেহেতু এমন একটা সিচুয়েশন চলে এসেছে। তাই আর না বলে পারছিনা। সবকিছু ডিটেইলস এ বলার সময় নেই। শুধু বলব, ছবিতে যে মেয়েটা আছে ওর নাম, নূর। আর এই মেয়েটা তোমাদের আদিত্যর ভালোবাসা। আদিত্যর লাইফলাইন। আশা করি তোমাদের জবাব পেয়ে গেছ। নাউ আই হ্যাভ টু লিভ,বাই।

বলেই বেড়িয়ে গেল আদিত্য। তার পিছু পিছু দৌড়াল জীদান। ডাইনিং টেবিলে সবাই হতবাক হয়ে বসে রইলো। কোনোরকম আগাম সতর্ক ছাড়াই আদিত্য যে বিস্ফোরণ করে গেল। তা সামাল দিতে কিছু সময়তো লাগবেই বেচারাদের। রেহনুমা অতি বুদ্ধিমতি মহিলা। উনি হাইপার হলেন না। বিষয় টা বিচক্ষণতার সাথে হ্যান্ডেল করতে হবে। বুঝে শুনে পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ছেলেকে কিছুতেই হাতছাড়া হতে দিবেন না উনি।

বাইরে গাড়ির দিকে এগুতে নিলেই ফোন বেজে উঠল আদিত্যর। চেয়ে দেখলো আবিরের ফোন। রিসিভ করে কানে ধরতেই আবির বলে উঠল,
–কীরে মিয়া তুইতো দেখি ঘরে ঘরে সকালের চায়ের বিস্কুট হয়ে গেছিস। তলে তলে টেম্পু চালাও মিঞা। কিন্তু টেম্পু কেউ এভাবে খোলামেলা জায়গায় চালায়? আরে এসব কাজ কেউ পাবলিক প্লেসে করে? আরে এসব করবি হোটেলে গিয়ে কর। তোর কী টাকার কমতি আছে? এতো কিপ্টা কেরে তুই?টাকা নিয়া ক,ব,রে যাবি? টাকা বাঁচাইতে জঙ্গলে মঙ্গল করতে যাওয়ার কী দরকার? ধরা খাইয়ে গেলিতো এখন।

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট। তোর মস্তিষ্কে যে কাহিনি চলছে তেমন কিছুই হয়নি। আমিতো শুধু নূরকে নিয়ে ওখানে বসে ছিলাম। জানিনা কে ওই সময় ছবি তুলে নিয়েছে।

–ওওও,, তাইলে তো বাসর ছাড়াই বউ প্রেগন্যান্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘইটা গেছে।

–আবির তোর সাথে পরে কথা বলছি। আমার মুড ঠিক নেই এখন।
___

–বাহ্ আপু,আমরা একটু টিভিতে হিরো দেখলেও তুমি রেগেমেগে আগুন হয়ে যাও।আর এখন নিজেই হিরোর সাথে ডেটিং করে বেড়াচ্ছ!

অমালিয়ার কথার পরিপেক্ষিতে ইভান তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,
–দেখ লিয়া, আপুর সম্বন্ধে আর একটা বাজে কথা বললে কিন্তু জান নিয়ে নিবো তোর। আজ একটা ছবিই তোর কাছে বড়ো হয়ে গেল? আরে এসব ছবিতো ইচ্ছে করলে এখুনি হাজার টা বানানো যাবে। আমরা কী আপুকে চিনিনা? তাহলে কে কী ছাপালো তাতে কী যায় আসে।

–হ্যাঁ হ্যাঁ আমাকেই বলতে পারো সবাই। এতেও বুঝি আমারই দোষ তাইনা? বাইরে গিয়ে দেখ লোকজন কতো রকমের কথা বলছে। অথচ যতো দোষ এই নন্দ ঘোষের।

নূর থমথমে মুখে বসে আছে। সকাল সকাল এই নিউজ ওদের বাড়িতেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।অমালিয়া কথা কাটা হয়ে বিঁধছে শরীরে। কিন্তু উপযুক্ত জবাব দিতে পারছেনা নূর। বাইরের মানুষ কে কী ভাবলো তাতে কিছু যায় আসেনা নূরের। কিন্তু আপনজনই যখন অবিশ্বাসের তীর চালায় তখন সেখানে কোনোকিছু বলাই বৃথা। বলে বিশ্বাস করাতে হবে এমন ঠুনকো বিশ্বাসের কী প্রয়োজন। নিউজ দেখার পর থেকে পাড়া প্রতিবেশী নানাজন নানা মন্তব্য করছে। লতিকা বেগম চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। দিশেহারা বোধ করছেন তিনি। মায়ের এমন শঙ্কিত চেহারা দেখে নূরের বুক পুড়ছে। নূর মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
–মা,তুমিও কী বাকিদের মতো আমাকে অবিশ্বাস করছ? তুমি কী চিনোনা তোমার মেয়েকে? তোমার মনে হয় তোমার মেয়ে কোনো অশালীন কাজ করতে পারে?

লতিকা বেগম ছলছল চোখে তাকিয়ে বললেন।
–নারে মা,তোকে আমি একটুও অবিশ্বাস করছিনা। আমি জানি আমার নূরের মতো খাটি সোনা আর একটাও নেই। কিন্তু এসব দেখে লোকজন যে নানান কথা রটাবেরে মা। আমার চিন্তা সেখানে৷

–কোনো চিন্তার কিছু নেই মা। তোমার বিশ্বাস আছে এটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাকি কে কী ভাবলো তাতে কিছু যায় আসেনা আমার। লোক কথা বলবেই। এই বিষয় নয়তো অন্য কোনো বিষয়ে বলবে। কারণ লোকের কাজই কথা বলা। ওসব কথা কানে নিলেই বোকামি। নিজে ঠিক থাকলে সবই ঠিক। এখন এসব চিন্তা করোনা। অসুস্থ হয়ে পড়বে।তুমি রেস্ট করো। আমি এখন কাজে যাচ্ছি।

মাকে শান্তনা দিয়ে বেড়িয়ে গেল নূর।বাইরে এসে হাঁটতে নিলেই নূর দেখলো আশেপাশের লোকজন কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইশার কী কী বলাবলি করছে। এরা যে এই নিউজ দেখেই এমন করছে তা বুঝতে পারছে নূর। আর এসবকিছুর জন্য ওই একজনকেই দায়ী করছে নূর। সব রাগ গিয়ে পড়ছে তার ওপর। যার কারণে তার পরিবারে এই অশান্তি এসেছে এবার তার সাথে বোঝাপড়ার পালা। আজতো এর একটা ফয়সালা করেই ফেলবে সে।
__

আদিত্যর ভ্যানিটির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো জিদান। স্যারের চিন্তায় তার হাঁপানি শুরু হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার মাঝেই সে দেখলো সামনে এক প্রকার ধেয়ে আসছে নূর। এভাবে কালিমূর্তির ন্যায় নূরকে আসতে দেখে জিদানের ভয়ে কলিজা ভুনা হওয়ার উপক্রম। আজ নির্ঘাত এই কুমিরের সরদারনী আমার ভোলাভালা স্যারকে গিলেই নিবে। হে খোদা, আমাকে শক্তি দাও। আমি যেন আমার স্যারের প্রাণ বাঁচাতে পারি। দেখতে দেখতেই নূর কাছে চলে এলো। ভেতরে ঢুকতে গেলেই জিদান নিজের জানের বাজি রেখে নূরের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে বলল,
–না ম্যাম, দাঁড়ান। দয়া করে আমার স্যারকে কিছু করবেন না ম্যাম। স্যারের কোনো দোষ নেই। চাইলে আমার জান নিয়ে নিন। কিন্তু আমার স্যারকে ছেড়ে দিন প্লিজ।

নূর দাঁত কিড়মিড় করে হ্যান্ডব্যাগ থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার টা বের জিদানের গলায় ধরে বলল,
–শোন মিঃ পাতিহাঁস, অলরেডি মগজের ব্লেন্ডার হয়ে আছে। আমাকে বিরক্ত করতে আসলে আজ সত্যি সত্যিই তোর জান কেঁড়ে নিবো। বল পাঠিয়ে দিবো তোকে পটল তুলতে?

নূরকে আর জিদানকে মারার জন্য খাটুনি করতে হলোনা।তার হুমকি শুনে বেচারা জিদান এমনই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। নূর সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে আদিত্য দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বুজে বসে ছিলো। নূর এসেই ওর সামনে টেবিলের ওপর ঠাস করে হাতের পত্রিকা টা আছাড় দিয়ে ফেলল। যার শব্দে মাথা তুলে তাকালো আদিত্য। তবে খুব একটা চমকায়নি সে। এমন একটা কিছু হবে সে জানতো।মনে মনে সে প্রস্তুত হয়েই ছিলো নূরের আসার অপেক্ষায়। নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠল,
–এখন নিশ্চয় খুশি আপনি তাইনা! এটাই তো চাচ্ছিলেন আপনি। এখন শান্তি হয়েছে আপনার!

আদিত্য শান্ত সুরে বলল,
–নূর রিল্যাক্স, এতো হাইপার হইও না। শান্ত হয়ে বসে কথা বলছি আমরা।

–শান্ত হয়ে বসে কথা বলবো? লাইক সিরিয়াসলি! সারাদেশে আমার তামশা হচ্ছে। আর আমাকে শান্ত হতে বলছেন আপনি! আজ আপনার জন্য আমার আর পরিবারের দিকে সবাই বিদ্রুপের নজরে তাকাচ্ছে। হ্যাঁ এমনিতে মানুষের কথায় আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু কেউ আমার চরিত্র নিয়ে পরিহাস করলে সেটা আমি কখনো সহ্য করবোনা। আজ এসবের কারণে আমার মা চিন্তায় প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু অফকোর্স, আপনার এসবে কী যায় আসে। আপনার তো বরং পাবলিসিটি হয়ে গেল তাইনা! দ্য সুপারস্টার আদিত্য আরও একবার মিডিয়ার মেইন আকর্ষণ হয়ে গেল।

এবার একটু রাগান্বিত হলো আদিত্য। কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বলল,
–লাইক রিয়েলি নূর! তোমার সত্যিই মনে হয় আমি পাবলিসিটির জন্য এমন চিপ কাজ করবো? তাও তোমার সাথে? এতদিনে কী এতটুকুও বুঝতে পারোনি আমাকে? এটা তোমার মতো আমার কাছেও আনাক্সপেক্টেড। ওখানে ওইমুহূর্তে কেউ আমাদের এভাবে ছবি তুলবে সেটা আমি বুঝতেই পারিনি।

–হ্যাঁ, আর ঠিক এই কারণেই আমি আপনাকে বারবার মানা করছিলাম। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম আমাদের দুনিয়া আলাদা। তাই এই বৃথা জেদ ছেড়ে দিন। আজ আপনি একজন সেলিব্রিটি দেখে এই ঘটনা ঘটলো। এই কারণেই আমার এসব নায়ক পছন্দ না। আমি অতি সাধারণ একটা মেয়ে। আর আমার জীবনও অতি সাধারণ। আমি কোনো অসাধারণ কিছু চাইনা আমার জীবনে। রোজ রোজ লোকের চর্চার বিষয় হতে চাইনা আমি।

–নূর শান্ত হও। বুঝতে পারছি এটা হওয়া ঠিক হয়নি। তবে চিন্তা করোনা তুমি। আমি সব ঠিক করে দিবো। আই প্রমিজ পরবর্তীতে আর এমন কিছু হবে না।

–কী গ্যারান্টি আছে আপনার কাছে। বলুন দিতে পারবেন গ্যারান্টি? পারবেন না। কারণ এটাই আপনার জীবন। এটাতো শুধু একটা মুশকিল এসেছে। আমাদের দুজনের পথ এক করার চেষ্টা করলে এর থেকেও বড়ো বড়ো মুশকিল আসবে। এখন আপনি হয়তো ফিল্মি ডায়লগ ঝাড়বেন , আমি তোমাকে ভালোবাসি নূর। তোমার জন্য আমি সব মুশকিল পেরিয়ে যাবো। চাঁদ সূর্য ছিনিয়ে আনবো ব্লা ব্ল..। এসব কথা শুনতেই ভালো লাগে। করতে গেলে না।আচ্ছা চলুন আপনি একটা জিনিস বলুনতো। আপনি যে সবসময় বলে বেড়ান ভালোবাসি ভালোবাসি। তো কখনো ভেবে দেখেছেন এর পরিণাম কী হবে? ধরুন আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মতি দিলাম। এরপর? এরপর কী হবে? এরপর নিশ্চয় আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন। কিন্তু আমিতো আপনাকে বিয়ে করতে পারবোনা। কারণ আমাকে আমার পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইভানের পড়াশোনা শেষ করিয়ে ওকে কোনো কর্মে সেটেল্ড করতে হবে। অমালিয়ার পড়াশোনা শেষ করিয়ে ওকে ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে। তারপর মিছরিকেও পড়াশোনা করিয়ে ওকেও একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে। আর এসব দায়িত্ব শেষ করতে করতে কতবছর লোগে যাবে তা আমি নিজেও জানি না। তো এতদিন পারবেন অপেক্ষা করতে? আচ্ছা মানলাম এটাও আপনি করলেন। কিন্তু আপনার পরিবার কী অপেক্ষা করবে? তারা একজন নায়কের সাথে সামান্য একটা গ্যারেজ মেকানিক যে কীনা বর্তমানে ট্যাক্সি ড্রাইভার। এমন মেয়েকে মেনে নিবে? হ্যাঁ আপনি হয়তো বলবেন আমার পরিবারের দায়িত্ব সব আপনি নিবেন। তাদের সব খরচ বহন করতে রাজি। কিন্তু আমিতো সেটা কখনো মানবোনা। আমিতো আমার পরিবারের দায়িত্ব কারোর ঘাড়ে দিবোনা। সে যেই হোকনা কেন। এমনকি কথার কথা যদি আমাদের বিয়েও হয়ে যায় তবুও না। তো বলুন আপনার পরিবার এমন বউকে মেনে নিবে?

আদিত্য নূরের এতগুলো শুধু স্মিথ হেঁসে বলল,
–তুমি এখনো আমার ভালোবাসাকে মাপতে পারোনি নূর । আর না ভরসা করতে পেরেছ। তো যেখানে ভরসাই নেই সেখানে যাই বলি বৃথাই যাবে। তোমার মনে হবে আমি আবারও ফিল্মি ডায়লগ ঝাড়ছি। তবে শুধু একটা কথা বলতে চাই। ভালোবাসার পথে সবসময়ই বাঁধা ছিল আর সামনেও থাকবে। তবে দুজনের মনের আত্মবিশ্বাস এক থাকলে কোন বাঁধা অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। যেদিন তুমি আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারবে সেদিন এই প্রশ্নগুলোর জবাব তুমি নিজেই নিজেকে দিয়ে দিবে।

নূর রেগে গিয়ে বলল,
–বন্ধ করুন আপনার এই ভালোবাসার তানপুরা বাজানো। আজ আপনার এই ভালোবাসার কারণেই এসব ঘটেছে। তবুও শান্তি হইনি আপনার? আর কতো বদনামী দিতে চান আমাকে? আপনার সাথে দেখা হওয়ার আগেই ভালো ছিলাম আমি। আপনার সাথে কখনো দেখা না হলেই ভালো হতো।

বলেই উল্টো ঘুরে ধুমধাম করে বেড়িয়ে গেল নূর। আর তার বলে যাওয়া তিক্ত কথাগুলো তীর হয়ে বিঁধল আদিত্যর বুকে। রাগে দুঃখে টেবিলের সামনে থাকা কাচের গ্লাস টা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো সে। মুহুর্তেই ঝংকার দিয়ে সহস্র টুকরো হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লো গ্লাসটা। চোখ গেল টেবিলের ওপর রাখা পত্রিকার দিকে। অগ্নিলাল চোখে তাকিয়ে পত্রিকাটা হাতে উঠিয়ে নিলো সে। এক হাতে পত্রিকা ধরে আরেক হাতে ফোন বের ওর গ্যাং এর লোককে ফোন করলো আদিত্য। পত্রিকার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
–আজকের এই ছবি কে তুলেছে তাকে আজকের ভেতর চাই আমি। আর সকল সংবাদমাধ্যমের হেডদেরও চাই। কাজ হওয়া চাই। নাহলে তোমাদের কালকের সূর্য দেখতে দিবোনা আমি।

আদেশ অনুযায়ী সন্ধ্যার মাঝেই সেই ছবি তোলা ব্যাক্তিকে ধরে আনলো আদিত্যর লোক। আদিত্য আসলো সেখানে। হাতে গান নিয়ে অগ্নিমূর্তি হয়ে ছবি তোলা লোকটার সামনে গেল। ক্রুর চোখে তাকিয়ে বলল,
–তোর ছবি তোলার অনেক শখ না। চল আজ আমি তোর সুন্দর একটা ছবি তুলবো।কাল সকালের পত্রিকায় থাকবে তোর ছবি। শিরোনাম হবে, ****জায়গায় পাওয়া গেছে এক অজ্ঞাত লা,শ।

লোকটাতো ভয়ে অর্ধেক মরা এমনিতেই মরে গেছে। তারওপর এমন থ্রেট শুনে তার আত্না মুখে চলে এসেছে। লোকটা কেঁদে কেটে আকুতি মিনতি করে মাফ চাইলো আদিত্যর কাছে। তাই আদিত্যও হুমকি দিয়ে ছেড়ে দিলো লোকটাকে। তারপর সব সংবাদমাধ্যমের হেডকেও হুমকি দিয়ে এই নিউজ বদলাতে বলল। ভয়ে সবাই রাজি হয়ে গেল। পরদিন সকালেই সকল টিভি, পত্রিকাসহ সকল মাধ্যমে এই নিউজ ভুল বলা হলো। এবং এমন ভুল নিউজ দেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীর কাছে মাফও চেয়েছে তারা।

নিউজ নূরও দেখতে পেল। এটা যে আদিত্যরই কাজ বুঝতে বাকি রইলনা তার। ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে তার। কাল রাগের বশে অনেক বেশিই বলে ফেলেছে লোকটাকে। কিন্তু তার পর থেকেই অনেক খারাপ লাগছে নূরের। যদিও নূর ইচ্ছে করেই অতোটা কঠোর বাক্য বলেছিল। যাতে আদিত্য ওর পিছু ছেড়ে দেয়। লোকটা যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে সেটা বোঝাতে চেয়েছিল নূর। কিন্তু এখনতো নিজের বুকেই জ্বলছে। এতটা যন্ত্রণা কেন হচ্ছে ওর। তবে কী সত্যি করেই সে লোকটার মায়ায় জড়িয়ে পড়লো।

চলবে….

#শৈবলিনী—২৩
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★ঘন্টাখানিক শুট করে ভ্যানিটিতে চলে এসেছে আদিত্য। ভালো লাগছেনা ওর। শুটে বারবার ভুল হচ্ছিল। তাই ডিরেক্টর একটু আরাম করতে বলেছে। তবে আদিত্য আজকের শুটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে। মন মেজাজ তিক্ত হয়ে আছে। ভেতরটা প্রচুর অস্থিরতায় ছেয়ে আছে। শরীরও খারাপ লাগছে।মন অশান্ত থাকায় কাল রাতে ঘুমুতে পারেনি ঠিকমতো। সকাল থেকেই জ্বর জ্বর ভাব। তবে কাউকে সে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। জ্বর শরীরেই শুটিংয়ে চলে এসেছে। হয়তো মনের কোনে ক্ষীণ আশা ছিলো।শুটিং-এর উদ্দেশ্যে ভার্সিটিতে আসলে নূরকে দেখতে পাবে। তার দর্শনে মনের অশান্ত ঢেউ একটু হলেও শান্ত হবে। তবে তা আর হলো কই। নূর আসেনি। দেখতে পায়নি তাকে কোথাও। এটাই যে হবে তা হয়তো বুঝতে পেরেছিল আদিত্য। কালকের ঘটনার পর নিশ্চয় আর নূর আসবেনা। সেটা তার কালকের কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল। বেহায়া মন তবুও একটু আশা করছিলো, সে আসবে। নিজের ভাবনার উপর নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদিত্য। বেহায়া মনকে কীভাবে সত্যের বিষ সেবন করাই? নাছড় মন একদিন আমার জান নিয়েই মানবে।

মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে আদিত্যর। জ্বরটাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। চোখের পাতা লাল হয়ে উঠছে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে রইলো আদিত্য। সবকিছু অসহ্য,যন্ত্রণাদায়ক লাগছে তার। পৃথিবীটা হঠাৎই কেমন বিষন্নতায় ভরে উঠেছে যেন। নাহ,আর এখানে থাকতে মন চাইছে না তার। নূরতো আর আসবেনা, তাহলে আর এখানে বসে থেকে কী লাভ। হতাশ মনে এখান থেকে চলে যাওয়ার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলো আদিত্য। ঠিক তখনই সুপরিচিত সেই কন্ঠটি কানে এলো।
–আসতে পারি?

ঝট করে মাথা তুলে চকিত নজরে তাকালো আদিত্য। দরজার সামনে নূরকে দেখে দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তার। নূর কী সত্যিই এসেছে? নাকি আবারও কোনো ভ্রম হচ্ছে তার। আদিত্যর ভাবনার মাঝেই নূর এগিয়ে এসে দাঁড়াল। আদিত্য উপলব্ধি করলো নূর সত্যিই এসেছে। হঠাৎই যেন অভিমানে মন ভার হয়ে উঠলো আদিত্যের। কালকের নূরের কথাগুলো মনে পড়লো তার।নূরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঠুর মেয়ের স্থানে বসিয়ে দিলো আদিত্যর অভিমানী মন। আর বলে উঠল,
–তুমি??

নূর নিজের মনোভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
–হ্যাঁ আমি। নূর তার কথায় কখনো বরখেলাপ করেনা। আপনাকে যেহেতু কথা দিয়েছি ত্রিশ দিন আসবো। তাই যাই হয়ে যাক সেই কথা রক্ষার্থে আমি আসবোই। আর তাছাড়া আমার উপর আপনার ঋণের ভারও তো আছে। তাই আসতেতো হবেই আমাকে।

নূরের কথায় যেন আদিত্যর অভিমানে আরও খোঁচা দিয়ে দিলো। আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–ওও, তাহলে ঋণ পরিশোধের দায়ে এসেছ। নাহলে কী আর এমুখো হতে! ঠিক আছে। এখন থেকে তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। এখন থেকে যা দরকার হয় জিদানকে বলে দিবো। সে জেনে আসবে তোমার কাছ থেকে। নাহয় ই-মেইল করে দিও। তাহলে আর আমার কারণে তোমার লাইফ হেল হবেনা।

নূর বুঝতে পারলো কালকের কথায় হার্ট হয়েছে আদিত্য। লোকটার এসব কথা খুব পোড়াচ্ছে নূরকে। নূর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সোফায় ধুম করে বসে বলে উঠলো,
–আপনি এই নিব্বা নিব্বিদের মতো এতো ঢং কীভাবে করতে পারেন? আমি আপনার সাথে কাজ করছি, আপনার সেক্রেটারির সাথে নয়। এখন এমন রস বের হওয়া লেবুর মতো মুখ না বানিয়ে , কী কাজ করতে হবে বলুন।

আদিত্যর জ্বর বাড়ছে। জ্বরের ঘোরে স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পাচ্ছে তার। কেমন মাতালের মতন হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য বাচ্চাদের মতো অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিতো শুধু ঢং-ই করি। আমিতো দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ লোক। তো যাও, কেন বসে আছ আমার মতো লোকের কাছে? থাকতে হবেনা তোমার আমার সাথে।

আদিত্যর আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে নূরের কাছে। স্বাভাবিক স্বর মনে হচ্ছে না। লোকটার কী কিছু হয়েছে? আদিত্য হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে কোথাও যেতে চাইলো। তখনই হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠল আদিত্যর। ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে নূর চমকে উঠে দ্রুত ধরে ফেললো তাকে। ধরতেই আৎকে উঠলো নূর। লোকটার শরীরতো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আদিত্যর চোখে তাকাতেই বুকের মাঝে কেঁপে উঠল নূরের। লাল চোখ জোরা দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। নূর ঘাবড়ে গিয়ে আদিত্যকে ধরে বসতে বললো। আদিত্য অভিমানের ভারে ডুব দিয়ে ঢুলুঢুলু কন্ঠে বলল,
–বসবো না আমি। ছাড় আমাকে।

–দেখুন, শরীরের অবস্থা ভালোনা আপনার। জেদ না করে বসুন এখানে। নাহলে পড়ে যাবেন।

–গেলে যাবো, তাতে তোমার কী যায় আসে। বরং আমি মরে গেলেই তুমি খুশি হবে। খুশিতে সারা শহরে মিষ্টি বিতরণ করবে। তোমার জীবনের আপদ সারাজীবনের জন্য চলে যাবে তাইনা?

নূরের বুকে তীব্র বেগে অদৃশ্য এক ছু,রি বিঁধল যেন। অন্তর কম্পিত হলো তার। পীড়াদায়ক অনুভূতি হলো বুক জুড়ে। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো নূরের। ক্রোধিত হয়ে নূর জোর করে ধরে আদিত্যকে ধুম করে সোফায় বসিয়ে দিলো। আদিত্য আবারও বিদ্রোহ করতে চাইলে, নূর আদিত্যর মুখের সামনে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
–চুপ,একদম চুপ। আর একটা কথা বললে বা এখান থেকে উঠার চেষ্টা করলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো একদম। চুপচাপ এখানে বসে থাকুন।

আদিত্য জ্বরের ঘোরে মাতাল অবস্থায় ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
–দেখেছ, আবারও বকছ তুমি আমাকে। সবসময়ই খালি বকঝকা করো। একটুও ভালোবাসোনা আমাকে। একটুও না।খুব পঁচা তুমি। থাকবোনা আমি এখানে। এখুনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিবো। বিদায় দুনিয়া, দুয়াওমে ইয়াদ রাখনা।

নূরের বিরক্তির মিটার হাই হয়ে গেছে। নূর এবার চোখ গরম করে আদিত্যর মুখের সামনে ঝুঁকে গিয়ে আরও রাগান্বিত স্বরে বলল,
–এই নায়কের বাচ্চা নায়ক, চুপ। আর একটা কথাও বলবিনা।

আদিত্য অবাক বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে চোখ জোরা দ্রুত গতিতে পিটপিট করে বলে উঠলো,
–ওসব তো ঠিক আছে।কিন্তু বাচ্চা কোথাথেকে আসলো? বাচ্চাতো নেই তাহলে চুপ করাবো কী করে? চলো আগে বাচ্চা করি, তারপর নাহয় চুপ করাবো। তুমি চিন্তা করোনা। বাচ্চা পালার দায়িত্ব আমার। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবেনা।

ভড়কে গেল নূর।অসহ্যকর বিরক্তিতে মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে তার। রাগে কটমট চোখে আদিত্যর ওপর আরেকটু ঝুঁকে গেল সে। নূরের এই অগ্নিমূর্তি আবতার নিয়ে নিজের দিকে আসতে দেখে ভয়ে আদিত্য পেছন দিকে ঝুঁকে গেল। চোয়াল চিবিয়ে চিবিয়ে নূর বলল,
–আর একটা কথা বললে এখুনি তোর মুখে নর্দমার পানি ঢেলে দিবো আমি।

এবার ভয় পেল আদিত্য। ভয়ে পেছন দিকে ঝুকে গিয়ে ভীতু চোখে তাকালো নূরের দিকে। মুখের ওপর আঙুল রেখে বুঝাল সে আর কথা বলবেনা। ভাবটা এমন যেন বলছে, থাপ্পাড় সে ডার নেহি লাগতা নূর,নর্দমার পানি সে লাগতাহে। হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো নূর। আদিত্যর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–ফার্স্ট এইড বক্স আছে এখানে? শুধু মাথা নেড়ে বলেন।

আদিত্য মুখে আঙুল রেখেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। নূর জানতে চাইলো কোথায় রেখেছে। আদিত্য হাতের ইশারায় ছোট কেবিনেট টা দেখালো। মানে ওটার ভেতর আছে। নূর উঠে গিয়ে কেবিনেট থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো। থার্মোমিটার বের করে আদিত্যর ঠোঁটের মাঝ দিয়ে মুখের ভেতর পুরে দিলো। আদিত্য থার্মোমিটার মুখে নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। এই ভঙ্গিতে আদিত্যকে দেখতে অনেক ফানি লাগছে। নূর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিরবে হালকা হাসলো। কিছুক্ষণ পর থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৩ ডিগ্রি জ্বর উঠে গেছে। ঘাবড়ে গেল নূর। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকলে জ্ঞান হারাতে পারে আদিত্য। কী করবে বুঝতে পারছেনা নূর। উঠে গিয়ে জিদানকে ডেকে আনলো নূর। আদিত্যর অবস্থা বয়ান করে বলল,
–উনাকে এখুনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। নাহয় ডাক্তারকে এখানে আনতে হবে।

জিদান আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
–কী বলেন ম্যাম। কিন্তু কীভাবে যাবো? বাইরে রাস্তায় ভার্সিটির দুই ছাত্রদলের মাঝে ভীষণ সংঘর্ষ বেঁধেছে। কোনো গাড়ি যাতায়াত করতে পারছেনা৷ ডাক্তারও এর মধ্যে আসতে চাইবেনা।
চিন্তায় পড়ে গেল নূর। সব কী একই সময় হওয়ার দরকার ছিল। লোকটাকে এইভাবে রাখলে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। জিদান হঠাৎ বলে উঠল,
–ম্যাম, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো? স্যারের কথা বললে নিশ্চয় চলে আসবে।

চিন্তার মাঝে জিদানের এমন উদ্ভট কথায় বিরক্তি এবার সপ্তমে। দাঁতে দাঁত চেপে নূর বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন নয়। এক কাজ করুন অপারেশন থিয়েটারও বুক করে ফেলুন। ওপেন হার্ট সার্জারীও করা লাগতে পারে।

–একদম ঠিক বলেছেন ম্যাম। আমি এখুনি বুক করছি।

নূর রাগে চোখ বুজে ধমকের সুরে বলল,
–শাট আপ ইডিয়ট। আপনার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এতে চাপ নিতে হবেনা। স্ট্রোক খেয়ে বসবেন। এক কাজ করুন, আপাতত আপনি গিয়ে নাপা এক্সট্রা নিয়ে আসুন। আর উনার জন্য খাওয়ার কিছু নিয়ে আসুন। বাকিটা আমি দেখছি।

–জি ম্যাম এখুনি আনছি।

আদিত্যর শরীরের তাপমাত্রা কমানো এইমুহুর্তে ভীষণ জরুরি। জ্বর আসলে নূর দেখতো ওর মা,ওদের মাথায় পানি ঢালতো, ঠান্ডা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে আর অতিরিক্ত তাপমাত্রা হলে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিতো। এতে শরীরের উচ্চতাপমাত্রা কমে যেত। এখন আদিত্যকেও এমন কিছুই করতে হবে। তবেই তাপমাত্রা কমবে। নূর আদিত্যর বাহুতে ধরে বলল,
–উঠুন, চলুন ওয়াশরুমে যেতে হবে।

আদিত্য দুষ্টু নজরে তাকিয়ে বলল,
–দুজন একসাথে যাবে ওয়াশরুমে? ওয়াও তুমিতো দেখছি সোজা মেইন সিনে চলে গেছ।

নূর দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–নর্দমার পানি মনে আছেতো?

আদিত্য চুপচাপ লক্ষি ছেলের মতো উঠে দাঁড়াল।নূর ওকে ধরে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে গেল। ওয়াশরুমে এসে আদিত্যকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিলো নূর। তারপর শাওয়ার চালু করে দিলো। আর নিজে সরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়াল।জ্বরের শরীরে শাওয়ারের পানি পরতেই ঠান্ডায় শিরশিরিয়ে উঠল আদিত্যর শরীর। শীতে লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।পানিতে ভিজে কাঁপতে লাগলো শরীর। হঠাৎ মাথায় দুষ্টুমি চাপলো আদিত্যর। আচমকা নূরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসলো আদিত্য। শাওয়ারের পানিতে ভিজে গেল নূরও। নূর ভড়কে গিয়ে বলল,
–আরে আরে কী করছেন? আমাকে কেন ভেজাচ্ছেন?

–আমি ভিজছি, আর তুমি শুকনো শুকনো দাঁড়িয়ে আছ। কেমন ব্যাড ম্যানার্স দেখায়। আর তুমিতো জানোই আমি গুড বয়ের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর।

–ফালতু কথা বন্ধ করুন। আর ছাড়ুন আমাকে।

আদিত্য ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত করে ধরলো।জ্বরের ঘোরে ওর হুঁশ নেই এখন। নেশায় মাতাল হওয়ার মতো হয়ে আছে এখন সে। এক হাতে নূরের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে ওয়াশরুমের দেয়ালে আঁটকে ফেললো।আরেক হাত দিয়ে নূরের হাত দুটো দেয়ালে চেপে ধরলো। শাওয়ারের পানি ভিজিয়ে দিচ্ছে দুজনকে। আদিত্যর চোখে নেশা। মারাত্মক নেশাময় চোখে তাকিয়ে আছে সে নূরের পানে। আদিত্যর ওই নেশাময় নজর নূরকে বিবশ করে দিচ্ছে। অন্তরস্থল ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে যেন। কারোর চাহুনিও এতোটা ধারালো কীভাবে হতে পারে। নূর তাকাতে পারছেনা ওই চোখে। না পারছে সরে যেতে। শরীরের শক্তি কেমন হ্রাস পাচ্ছে ওর। আর এই অসুখটা কেবল এই লোকটার কাছেই আসলে ইদানিং হয় ওর। এমনিতেতো একাই একশটাকে কপোকাত করার ক্ষমতা রাখে ও।কিন্তু এই লোকটার কাছে আসলে এতো দূর্বল হয়ে যায় কেন ও? মনে হয় শরীরে শক্তিবল বলতে ওর কিছুই নেই। আদিত্য নূরের কপালে কপাল মেশালো। তপ্ত গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে নূরের মুখে। অদ্ভুত শিহরণে চোখ বন্ধ করে নিলো নূর। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন৷ মৃদু কম্পন ঘটলো অঙ্গ জুড়ে। আদিত্য নেশালো কন্ঠে বলল,
–ছাড়বোনা নূর। কিছুতেই না। তোমাকে হারালে বাঁচব কী করে? তুমি কেন একটু বোঝো না আমাকে? আমি কী এতটাই খারাপ? একটুও কী ভালোবাসা যায়না আমাকে? ভালো না হয় নাই বাসলে, একটু নাহয় দয়াই করো আমার ওপর। এই যন্ত্রণা যে জান নিয়ে নিচ্ছে আমার।

আদিত্যর হৃদয় নিংড়ানো আকুতি নূরের পীড়াদায়ক অনুভূতিকে আরও একদফা নাড়িয়ে দিলো। অজান্তেই চোখের কোনে জল জমলো তার। শাওয়ারের পানিতে যা দৃশ্যমান হলো না। হৃদপিণ্ডে ভীষণ কোলাহল চলছে। সেই কোলাহলের প্রবনতা নূরকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে কেমন। আদিত্য নূরের নাকে নাক লাগিয়ে বলল,
–তখন আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলেনা। বলোনা, আমি মরে গেলি কী তুমি সত্যিই খুশি হবে? এক বিন্দুও কষ্ট হবেনা তোমার।? মনে পড়বেনা আমার কথা?

হঠাৎ যেন রাগটা আবার মাথা চারা দিয়ে উঠল নূরের। লোকটা বারবার এই কথা কেন বলছে। নূরের মোটেও ভালো লাগছেনা। অসহ্য রাগে গা জ্বলে উঠল ওর। রেগে উঠে পা দিয়ে আদিত্যর পায়ের ওপর পাড়া মারলো। আচমকা এমন হওয়ায় ব্যাথা পেয়ে নূরকে ছেড়ে পা উঁচু করে দাপাতে লাগলো আদিত্য। নূর সেই সুযোগে আদিত্যকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
–মনে হচ্ছে আপনার মরার খুব শখ জেগেছে। এক কাজ করি, চলুন আপনার শখ আজ পুরন করেই দেই। এখানেই আপনাকে গলা টি,পে মেরে দেই। তারপর জিব কেলিয়ে এখানেই পড়ে থাকুন।

আদিত্য হেঁসে উঠে বলল,
–ইয়া সিওর। ইট ওয়াজ মাই প্লেজার। তবে এভাবে রেগে না। ভালোবেসে বলো। ভালোবেসে বললে তো হাজার বার তোমার নামে জান কুরবান করে দিবো।

নূর চোখ মুখ বিকৃত করে করে বলল,
–ছিহ..এতো থার্ড ক্লাস ডায়লগ আপনার দারাই সম্ভব। এসব বন্ধ করে বলুন, এইযে পানি পানি খেললেন। এখন আমি পড়বো কী?

–আরে চিন্তা করোনা। কাবার্ডে অনেক কাপড়চোপড় আছে। ওখান থেকে কিছু পড়ে নাও।

–ঠিক আছে। আপনি দাঁড়ান। আমি আপনার জন্য কাপড়চোপড় এনে দিচ্ছি। চেঞ্জ করে নেন।
নূর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে। কাবার্ড থেকে আদিত্যর জন্য আর নিজের জন্য টিশার্ট আর টাওজার বের করলো। আদিত্যরটা আদিত্যকে ওয়াশরুমের ভেতর দিয়ে দিলো। তারপর বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে। ভেতরে নিজে চেঞ্জ করে নিলো। চেঞ্জ শেষে আবার দরজা খুলে দিলে আদিত্য বেরিয়ে এলো। ততক্ষণে জিদানও ঔষধ আর খাবার নিয়ে চলে এলো। তবে আদিত্য আর নূরকে এই অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। মস্তিষ্কের রেলগাড়ী চালু করে ছুটলো তাদের এই অবস্থার বিবরণ খুঁজতে। অতঃপর তার মস্তিষ্ক যেটা খুঁজে পেল তা ভেবে ভেবেই লজ্জাজনক হাসলো সে। স্যারতো জ্বর কমানোর ভালোই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। নূর জিদানের এই ঠোঁট টিপে হাসা দেখে ওর ভাবনা কোন এলাকায় দৌড়াচ্ছে তা বুঝতে পারলো। নূর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–এইযে মিঃ পাতিহাঁস, মাথায় ব্রেইন নামক যে পঁচা আলুর গোদাম আছে তা আর ছড়ানোর দরকার নেই। আপনার স্যারের জ্বর কমানোর জন্য গোসল করাতে গিয়ে দুজনেই ভিজে গেছি। আর কিছু না।

জিদান থতমত খেয়ে ঔষধ আর খাবারের প্যাকেট দিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। নূর আদিত্যকে সোফায় বসিয়ে বলল,
–সকালে কিছু খেয়েছেন?

আদিত্য মাথা নেড়ে না বোঝাল। নূর প্যাকেট থেকে একটা স্যান্ডুইচ বের করে আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–নিন এটা খেয়ে নিন। তারপর ঔষধ খাবেন।

আদিত্য নাক শিটকিয়ে বলল,
–খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।

–ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। খালি পেটে ঔষধ খাওয়া যাবেনা। নিন ফটাফট খেয়ে নিন।

–কিন্তু খাবো কী করে? আমার হাতে না শক্তি পাচ্ছি না। হাত নাড়াতে পারছিনা। এই দেখ।

আদিত্যর এসব শক্তিহীনতা দেখানোর উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝতে পারছে নূর।এসব যে নূরের হাত থেকে খাওয়ার ফন্দি তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। বিরক্তিতে শরীর জ্বলছে তার। এতো পরিমাণ জ্বালা সে কারোর সহ্য করেনি।আজ কীভাবে পারছে সে? অথচ এই লোকটাকে ফেলেও যেতে পারছেনা সে। লোকটাকে এমন অসুস্থ অবস্থায় রেখে তার মন কোনমতেই যেতে পারছেনা। অগত্যা না পেরে নূর স্যান্ডউইচ টা আদিত্যর মুখের কাছে ধরে বলল,
–নিন, খান।

আদিত্যর খুশি দেখে কে। আদিত্য ফট করে খাবার মুখে নিলো। খেতে খেতে দুষ্টু হেঁসে বলল,
–আমার না তোমাকে আজ একদম বউ বউ লাগছে। যেমন বউ স্বামীর কেয়ার করে ঠিক সেভাবেই করছ তুমি। আমার স্বামী স্বামী ফিলিং হচ্ছে। আহা কী অপূর্ব অনুভূতি। আচ্ছা শোন,তুমিতো আমাকে ভালোবাসনা তাহলে আমার এতো কেয়ার করছ কেন? বলো বলো? তবে কী সামথিং সামথিং??

–ঘোড়াথিং, ঘোড়াথিং। বেশি খেয়ালিপোলাও বানানোর দরকার নেই। চুপচাপ খেয়ে নিন।

খাওয়া শেষে নূর ঔষধ খাইয়ে দিলো আদিত্যকে। তারপর বেডের ওপর নিয়ে এসে শুয়ে আরাম করতে বলল আদিত্যকে। আদিত্য শুয়ে পড়লো। নূর সরে যেতে নিলেই আদিত্য হাত ধরে আবেগী কন্ঠে বলল,
–প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা। এখানেই থাকোনা আমার পাশে।

আদিত্যর এই আকুতি ভরা আবদার মানা করতে মন সহমত হলো না। কেমন মায়া হলো তার। অগত্যা আদিত্যর পাশে বসে রইলো সে। আদিত্য নূরের হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিজের গালের নিচে হাতটা জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে শুয়ে রইল। নূরের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় প্রশান্তিতে ঘুম নেমে এলো চোখে। আদিত্যর ভারী নিঃশ্বাসের ভাব দেখে নূর বুঝতে পারলো আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো নূর।চোখ আটকে গেল আদিত্যর মায়াবী মুখমন্ডলে। কতো নিষ্পাপ লাগছে তাকে এখন। মায়ার রাজ্য যেন তার এই চেহারায়। নূরের হাত ধরে সে কতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে সে। অজান্তেই নূরের খোলা হাতটা চলে গেল আদিত্যর গালে। আলতো করে ছুঁইয়ে দিল। লোকটার মায়ায় সত্যি সত্যিই জড়িয়ে যাচ্ছে সে। তবে কী ভালোবাসা নামক অসুখে সেও জড়িয়ে পরলো? হঠাৎ হাত ছিটকে সরিয়ে নিলো নূর। না না, এটা সম্ভব না। এই মায়ায় তার জড়ানো যাবেনা। কিছুতেই না। এই মায়াজালে আবদ্ধ হতে পারবেনা সে। নূর ধীরে ধীরে আদিত্যর ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। আদিত্যর দিকে কতক্ষণ মায়াবী চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর সরে গেল সে। ফোন করে শিখাকে সব খুলে বলল আর ওর পড়ার জন্য কিছু কাপড় আনতে বললো। একটু পরে শিখা কাপড়চোপড় নিয়ে এলে নূর সেটা পড়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আরও একবার দেখে নিল আদিত্যর মুখটা। তারপরই চলে গেল সে।

চলবে………