#শৈবলিনী—৩৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★বিয়েতে আদিত্য আর নূরের পরিবারও এসেছে। শুধু অমালিয়া আর আদ্র বাদে। মিছরি বিয়ে বাড়িতে মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছিলো।দুই হাতে কাবাব নিয়ে খেতে খেতে এদিক ওদিক ঘুরছে সে। হঠাৎ কারোর সাথে ধাক্কা লেগে গেল তার। ফলস্বরুপ তার হাতের কাবাব গুলো নিচে পড়ে গেল। মিছরি রাগান্বিত চোখে সামনে তাকালো। তাকাতেই দেখতে পেল এক কিশোরকে। যে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মিছরি রাগান্বিত স্বরে বলল,
–এই ছোকরা,কে তুমি? চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘোরো? দিলেতো আমার কাবাব গুলো ফেলে।
ছেলেটার বোধহয় হয় হুঁশ হলো।মিছরিকে দেখে সে থমকে গিয়েছিল। সিনেমার মতো লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইড টাইপ কিছু হচ্ছে ওর। ছেলেটা ফিচেল হেঁসে বলল,
–সরি সরি আমি দেখতে পাইনি।
–তোমার সরি দিয়ে আমার পেট ভরবে?
–ব্যাপার না, আমি এখুনি অনেকগুলো কাবাব এনে দিচ্ছি তোমাকে। তুমি এই টেবিলে বসো।
–হুম,ঠিক আছে।
ছেলেটা একটু পরেই এক প্লেট ভর্তি কাবাব নিয়ে এসে মিছরির সামনে টেবিলে রাখলো। তা দেখেতো মিছরি ভীষণ খুশি। প্রফুল্লিত হয়ে কাবাবের প্লেটটা টেনে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
–ওয়াও,এত্তগুলা!
ছেলেটা মিছরির সামনের চেয়ারে বসে হাসিমুখে বলল,
–হ্যাঁ এগুলো সব তোমার। এখন আর রাগ নেইতো আমার ওপর?
–না না, আর রাগ নেই। তুমি খারাপ না।
মিছরি দুই হাতে দুটো করে কাবাব নিয়ে মনের আনন্দে খেতে লাগলো। আর কিশোর ছেলেটা টেবিলের ওপর দুই হাতের কনুই ঠেকিয়ে হাতের মাঝে থুতনি রেখে বিস্তৃত হাসিমুখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে দেখতে লাগলো মিছরিকে। পেছন থেকে যেন ব্যাকরাউন্ডে মিউজিক বাজছে, ♬ তুমহে যো মেনে দেখা, তুমহে যো মেনে জানা যো হোশ থা ওতো গায়া…..
খাওয়ার এক পর্যায়ে মিছরি একটা কাবাব ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–তুমি খাবে?
–না না, তুমিই খাও। তুমি খেলেই হবে। আচ্ছা তোমার নামটা তো বললেনা। আমার নাম তীর্থ আর তোমার নাম?
মিছরি গালভর্তি কাবাব নিয়ে বলল,
–আমার নাম মিছরি। বাসায় সবাই চিনি বলে ডাকে।
তীর্থ এবার মুগ্ধতার অতলে ডুবে বলল,
–ওয়াও, জানো কালই মা বাবাকে বলছিলো বাসায় নাকি চিনি শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে আমি সাথে করে নিয়ে যাই বাসায় তাহলে আর চিনির অভাব হবেনা।
তীর্থর কথায় মিছরি কাবাবের তেল লেগে থাকা চিকচিকে ঠোঁটে খিলখিল করে হেঁসে দিলো। যে হাসিতে মুগ্ধতার সপ্তমে পৌঁছে গেল তীর্থ। প্রেম প্রেম ফিলিংসে ভাসছে সে।
দূর থেকে এসব দেখে মাথা নেড়ে হাসলো আদিত্য। এই মিছরিটারও প্রেমের গাড়ি চালু হয়ে গেল। শুধু এই অভাগারই কপাল পোড়া।আন্ডার মতো পুঁচকে পুঁচকে ছেলেরা মেয়ে পটিয়ে ফেলছে আর আমি অভাগা কিছুই পারলাম না। মিছরির মতো ওর বোনটাও একটু নরম হলে কি হতো? বিধাতা যেন দুনিয়ার যতো কঠোরতা ওই একজনের মাঝেই দিয়ে রেখেছে। জীবন কয়লা কয়লা হয়ে গেল।
মিছরি আদিত্যেকে দেখে দৌড়ে গেল ওর কাছে। হাসিমুখে বলল,
–আরে নায়ক ভাইয়া! তুমি এখানে?
আদিত্য মিছরির গাল আলতো করে টেনে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
–হ্যাঁ, আমিও এখানে। তা কেমন আছ কিউটিপাই?
–ভালো আছি। কিন্তু আমি তোমার ওপর রাগ করেছি।
–কেন? কেন? কি দোষ এই অধমের?
মিছরি বুঝতে না পেরে বোকার মতো বলল,
–অধম? সেটা আবার কে? আর অধমের দোষ কেন ধরতে যাবো আমি? আমিতো আপনার কথা বলছি। আপনি আর আমাদের বাসায় আসেন না কেন? তাই রাগ করেছি আমি।
আদিত্য আহ্লাদী ভঙ্গিতে বলল,
–আলে আলে, আমার কিউটিপাই টা রাগ করেছে? কিন্তু আমার কি দোষ? দোষতো তোমার আপুর।সেইতো আমাকে আসতে বারন করেছে। নাহলে কি আমি না এসে থাকতাম? তুমি তোমার আপুকে বলবে যে, আমাকে যেন আবার আসতে দেয় তোমাদের বাসায়। বলবে,নায়ক ভাইয়াকে আসতে বলো।
মিছরি ভীতু স্বরে বলল,
–আমি! আমি বলবো আপুকে! না বাবা না, এতো সাহস নেই আমার। দেখা গেল আপু আমাকে লবণ ছাড়াই কাঁচা খেয়ে ফেলবে। এই বয়সেই মরার ইচ্ছে নেই আমার। এখনতো বিয়েই হলোনা আমার।
মিছরির কথায় না হেঁসে পারলোনা আদিত্য। নূরের ত্রাসে গোটা বিশ্বই বুঝি আতঙ্কিত। আদিত্য আর মিছরির আহ্লাদী কাজকর্ম দূর থেকে খেয়াল করলো নূর। হঠাৎই যেন নিজের মন মস্তিষ্কে যুদ্ধ শুরু হলো নূরের। এই লোকটার কোন সত্তাটা আসল? এটাই কি সেই লোক যে ওকে ধোঁকা দিয়েছিল? তাহলে ওরই বোনের সাথে এতো মায়া কিসের? এগুলও কী কোনো ছলনা? নূর যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে। লোকটা কী এতই নিখুঁত অভিনয় জানে? নাকি ওরই কোথাও বোঝার ভুল আছে? না না,কোনো ভুল নেই। এই লোকটার কোনো ষড়যন্ত্রই আর সে সফল হতে দিবেনা।
রেহনুমা এতদিন পর ছেলেকে দেখে নিজেকে আটকাতে পারলেন না। আদিত্য যে টেবিলে বসেছিলো সেখানে গিয়ে ওর পাশে বসলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল,
–কেমন আছিস আদি? চেহারার একি হাল করে ফেলেছিস? আমাদের কথা কি একটুও মনে পরেনা তোর? এভাবে একা একা না থেকে বাড়ি ফিরে আয়না?
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–যে পরিবারে থেকেও নিজেকে পর মনে হয় এমন পরিবারের চেয়ে একাই ভালো। শুধু শুধু আমার চিন্তা করতে হবে না তোমাদের। আমি যেমন আছি বেশ আছি। আফটার অল তোমাদের দেওয়া সুখইতো ভোগ করছি৷
–আর কতো রাগ করে থাকবি বাবা। অনেকতো হলো। জানি তোর সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু আমিতো একজন মা। ছেলের জন্য নাহয় একটু স্বার্থপর হয়েছিলাম। কিন্তু তোকেও আমি কম ভালোবাসি না। তুই আমার প্রথম সন্তান। তোকে এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে থাকতে দেখে আমারযে কলিজা পোড়ে। দেখ তোর খুশি ওই নূরের মাঝে তাইতো। ঠিক আছে তাহলে তোর চাওয়াই পূরণ করবো আমি। প্রথমে আমিই মানা করেছিলাম। কিন্তু এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি নিজে তোদের বিয়ের কথা বলবো। নূরের মায়ের সাথে কথা বলবো। এখনতো তারা আত্ময়ই হয়। আমি বললে নিশ্চয় উনি মানা করবেনা। তাহলেতো তুই খুশি? এমনিতেও মেয়েটা এখন আর আগের মতো নেই। এখনতো ওরও একটা নাম হয়েছে।
আদিত্য আবারও তাচ্ছিল্যপূর্ন এক অট্টহাসি দিয়ে বলল,
–ওয়াও,ওয়াও,ওয়াও লাইক রিয়েলি ওয়াও। মানে আর কতো,আর কতো তুমি ছেলের চোখে নিজেকে নিচে নামাবে? যে নূরের নাম শুনলেও তোমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগতো আজ তাকেই খুশিমনে মেনে নিচ্ছ? কেন, কারণ নূর আজ প্রতিষ্ঠিত বলে? তার এখন নামডাক হয়েছে দেখে?এখন তুমি তাকে সোসাইটির সামনে মাথা উঁচু করে দেখাতে পারবে বলে? বাহ, কি চিন্তা তোমার!
–না আদি,তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। আমি সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। কারণ আমি বুঝে গেছি তোর খুশি নূরের মাঝে। নূরকে ছাড়া তুই ভালো থাকতে পারবিনা। আমি আমার ছেলেকে এভাবে জীবনযাপন করতে দেখতে পারছিনা। নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই আর সাথে তোর জীবনটাকেও।
আদিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–সরি টু ডিসিপয়েন্ট ইউ মা। সেই পথ তুমি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছ। নূরকে বিয়ে করে নিজের বউ করাটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন। থ্যাংকস টু ইউ এন্ড ইউর সান, সেই স্বপ্ন মাঝপথেই থেমে গেছে। এখন নূর আমাকে বিয়ে করাতো দূরের কথা। আমার মুখও দেখতে চায়না। জানি না নূরকে আর কখনো ফিরে পাবো কিনা তবে তোমার সামনে হাত জোর করে বলছি,প্লিজ আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও।তোমাদের যা করার ছিলো তা করে দিয়েছ এখন আমি নিজের টা নিজে বুঝে নিবো। আমাকে নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। আর নূরের মাকেও কিছু বলতে হবে না।
বলেই উঠে চলে গেল আদিত্য। রেহনুমার ভারাক্রান্ত মন আরও ভারী হয়ে গেল। এটা কি করে ফেলেছে সে! নিজের হাতেই নিজের ছেলের খুশি কেঁড়ে নিয়েছি। আমি সত্যিই মা হওয়ার যোগ্য না।
বিয়ের অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টারে কর্মরত এক নারী কর্মি কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ এক বেয়ারার হাতের বোল থেকে কিছুটা তরকারির ঝোল তার শাড়ীর ওপর পড়ে যায়। সেটা পরিষ্কার করতে সে ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমের পাশেই একটু সাইডে গিয়ে আবির সি,গা,রে,টের নেশাটা একটু মিটিয়ে নিলো। হালকা সি,গা,রে,ট টেনে অর্ধ খাওয়া জ্বলন্ত সি,গা,রে,ট,টা হাতে নিয়ে আবির ফিরতে নিলে হঠাৎ দেয়ালে ডেকোরেশন করা তারের সাথে ওর শার্টে টান লেগে শার্টের ওপরের বোতাম ছিঁড়ে যায়। আবির শার্ট ছাড়িয়ে ছেঁড়া বোতামের দিকে তাকিয়ে বোতাম ঠিক করার চেষ্টা করতে করতে সামনে এগিয়ে এলো। অন্যদিকে সেই নারী কর্মিটি তার শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আর এই নেহাৎ-ই কাকতালীয় ভাবে দুজনের এভাবে একসাথে আসাকে কোনো একজনের মস্তিষ্কে ভিন্নরকম এক কাহিনি তৈরী করে দিলো। সে হলো আহানা। আহানাও ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য এদিকেই আসছিলো। আর তখনই সে দেখতে পেল এই দৃশ্য। আর এই দৃশ্যের অন্য একটা মানে তৈরি করে নিলো তার মস্তিষ্ক। যদিও আবিরের ইমেজ অনুযায়ী এটা ভাবা খুব একটা অস্বাভাবিক না। এসব দেখে তার মনে যেন আবিরের প্রতি তীব্র ঘৃণার এক মহাপ্রলয় উপচে পড়লো। সীমাহীন ঘৃণার তিক্ততা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো চোখে মুখে। দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো দুইপাশের লেহেঙ্গা। তিগ্ম বিষধর কন্ঠে এযাবৎ কালের সর্বোচ্চ ঘৃণা স্বরুপ বলল,
–ছিহহহহহ্
আবির নিজের শার্টের বোতাম দেখছিলো। হঠাৎ এমন ঝংকার পূর্ণ আওয়াজ শুনে মাথা তুলে সামনে তাকালো সে। আহানাকে এভাবে ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো তার। আহানা বিষাক্ত কন্ঠে আবারও বলে উঠলো,
–ছিহহ্, শেষমেশ কাজের মেয়েদেরও ছাড় দিলেন না!! এতটা নিচ আপনি!
আবির আহানার এই রিয়্যাকশনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়ে ওয়েট্রেস সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবির বুঝতে পারলো আহানা নিশ্চয় ওকে নিয়ে ভুল ধারণা পোষণ করছে। অন্য কেউ হলে হয়তো এখুনি আহানার ভুল ধারণা দূর করে দিতো। তবে আবির সেটা করবেনা। আজপর্যন্ত আহানার এতো প্রবল ঘৃণার বিষাক্ত নজর দেখেনি আবির। এটাতো তার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এই নজরের তীব্রতা আবিরকে অনাবিল আনন্দ দিচ্ছে। এই আনন্দের মাত্রা আরও বাড়াতে আবির এগিয়ে গেল আহানার কাছে। আহানার মুখের সামনে হালকা ঝুঁকে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
–তোর ভাবনার থেকেও বেশি নিচ আমি। কী বলবো আন্নি,এসব মেয়েদের ব্যাপারই আলাদা। সী ইজ আ ফায়ার….
গা গুলিয়ে এলো আহানার। সারা পৃথিবীর ঘৃণা ভলকে উঠলো চোখের পাতায়। মাত্রাতিরিক্ত ঘৃণায় কণ্ঠনালীও যেন আঁটকে এলো তার। আবারও সেই একই শব্দ উচ্চারণ করলো সে,
–ছিহহ্
আবির এক হাত নিজের মুখের ওপর চেপে ধরে মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে প্রসন্নচিত্তে বলল,
–উফফ! উফফ! উফফ! কি দিলি আন্নি! কলিজাটা জাস্ট আইসক্রিম হয়ে গেল। তোর আজকের “ছিহ” টা জাস্ট প্রো লেভেলের ছিলো। কেমনে, মানে কেমনে করস তুই! এমন মাইন্ড বোলিং ছিহ এর জন্য তোকে নোবেল দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।আই সোয়্যার, আরেকবার এই প্রো লেভেলের ছিহহ্ শুনলে খুশিতে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবো। তাই আমি এখন যাই। এতো খুশি হজম করতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
বলেই উল্টো ঘুরতে নিলো আবির। আহানার মন মস্তিষ্ক বিষে বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠলো। ঘৃণা, রাগ, কষ্ট মিলে এক ভয়ংকর অনুভূতির টর্নেডো বইতে লাগলো।অতিরিক্ত ক্ষোভের বশে আহানা তিক্ত স্বরে বলে উঠলো,
–আপনাকে চরিত্রহীন ভেবেছিলাম। তবে আপনি যে এতটা নিকৃষ্ট লোক তা কখনও ভাবিনি। আসলে আপনার কাছ থেকে আর আশাই কী করা যায়।চরিত্রহীনতা তো আপনার র,ক্তে মিশে আছে। যেখানে আপনার মা বাবাই এসব করে বেড়ায়, তাদের সন্তান হয়ে আপনার কাছ থেকে এরচেয়ে ভালো আর কী আশা করা যায়?
থমকে গেল আবিরের কদম। চেহারার রং হঠাৎই পাল্টে গেল।কঠিন হয়ে এলো চোখ মুখ। ঘুরে থাকায় তা দেখতে পেল না আহানা। আহানার কথার প্রতিত্তোরে আবিরের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হলোনা আহানার সামনে। তবে আবিরের হাতের মাঝে নির্মম ভাবে চেপে ধরা জ্বলন্ত সি,গা,রে,ট টা আর আহানার নজরে এলোনা। কিছুক্ষণ স্থির থেকে ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো আবির। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আহানার পানে।আহানা হালকা ঘাবড়ে গেল। রাগের বশে এভাবে বলাটা হয়তো ঠিক হয়নি। মানুষ যেমনই হোক, তারজন্য মা বাবা তোলা ঠিক হয়নি। আবির হয়তো এখন চরম রেগে যাবে। তবে আহানার ধারণাকে আবারও ভুল প্রমাণ করে, আবির হঠাৎ মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে সেই বিখ্যাত বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–বংশের ধারা বজায় রাখাতো একজন বংশধরের কর্তব্য। মা বাবার এই মহৎ কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে কেমন সন্তান হলাম! আমি আমার কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হয়েছি এটা যেনে ধন্য হলাম। ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে আমার প্রশংসা করার জন্য।
আহানা আর পারলোনা এই জঘন্য লোকের সামনে থাকতে। নাহলে নির্ঘাত আজ ওর হাতে খু,ন হয়ে যাবে। এই নিকৃষ্ট লোককে মেরে নিজের হাত নোংরা করতে চায়না সে। তাই দ্রুত গতিতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে। আহানা যেতেই মুখভঙ্গি আবারও কঠিন হয়ে এলো আবিরের। হাতের মাঝে চেপে ধরা সি,গা,রে,ট টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। এখন আর এই সামান্য নেশায় কাজ হবেনা। এখন তীব্র নেশার প্রয়োজন ওর। সেই তাগিদে হল ছেড়ে বেড়িয়ে গেল আবির।
ফাংশন শেষে বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে হলের বাইরে এলো নূর। ইভান মিছরিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে।মিছরির ঘুম পাচ্ছিল আর বাসায় মা অসুস্থ আছে। তাই ওরা আগে চলে গেছে। নূরও চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শিখার জোরাজুরিতে আর পারেনি। তাই শিখার বিদায়ের পালা শেষ করেই যেতে হচ্ছে ওকে। নূরের নজর না চাইতেও এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। হয়তো কাউকে দেখতে চাওয়ার বেয়াড়াপনা আবারও শুরু করেছে এই অবাধ্য নজর। ওই বদ লোকটা কী চলে গেছে? যাক গে, আমার কি? হঠাৎ ফট করে নূরের মুখের সামনে এসে দাঁড়াল আদিত্য। আচমকা এমন হওয়ায় নূর থতমত খেয়ে গেল। আদিত্য নূরের মুখের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলল,
–আমাকেই খুঁজছিলে বুঝি? এতো মিস করছিলে? এতই যখন ভালোবাস তাহলে চাপিয়ে কেন রাখ?
নূর আমতাআমতা করে বলল,
–এমন কিছুই না। আপনাকে কেন মিস করতে যাবো আমি? আমিতো বাসায় যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি খুঁজছিলাম।
–আর কতো শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবে? তোমার চোখ যেটা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছে, তোমার মুখ কেন সেটা বলতে চাইছেনা? কেন নিজেকে আর আমাকে দুজনেই কষ্ট দিচ্ছো? একবার শুধু বলে দাওনা মনের কথা। সত্যি বলছি তারপর যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিবো।
নূর তিরস্কার করে বলল,
–মনে হচ্ছে মেন্টালি ডিস্টার্ব আছেন আপনি। ভাঙা টেপ রেকর্ডারের মতো একই রেকর্ড বারবার বাজিয়ে যাচ্ছেন। কতবার বলবো আপনি ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে ভালো টালো কিছু বাসিনা।
–আমি ভুল ভাবছিনা নূর। হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, ভালোবাসা বোঝা যায়। তুমিযে আমাকে অনেক ভালোবাসো সেটাও বুঝতে পারি আমি। শুধু তোমার স্বীকারোক্তির মোহর চাচ্ছি ব্যাস। আর তোমার স্বীকারোক্তি তো এবার আমি নিয়েই ছাড়বো। তারজন্য যা কিছু হয়ে যাকনা কেন।
–আপনি এক কাজ করুন। স্টাম্প পেপার নিয়ে আসুন। সেখানে আমি বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে সই করে দিবো। তারপর সেটা দেয়ালে টানিয়ে রেখে সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা দেখবেন। তাহলে হয়তো আপনার মানুষিক সমস্যা টা দূর হবে। লাস্ট টাইম বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি নাআআআ…..
বলেই নূর চলে যেতে নিলো। কয়েক কদম এগুতেই আদিত্য পেছন থেকে বলে উঠলো,
–সময় থাকতে বলে দাও নূর। নাহয় দেখা যাবে মনের কথাটা বলতে এতটাই দেরি করে ফেলেছ যে, সেটা বলার মানুষটাকেই আর পেলেনা।
থমকে গেল নূর। বুকের মাঝে ভয়াবহ এক কম্পন ঘটলো। পেছনে ফিরে তাকালো না নূর। সামনেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে দ্রুত পায়ে সেটাতে উঠে বসলো নূর। লোকটা আবারও তাকে বশিভূত করতে চাইছে। আবারও ভাঙতে চাইছে ওকে। কিন্তু এবার যতযাই হয়ে নূর নরম হবে না। বাঁধবে না আর ওই মায়াজালে।
চলবে….
#শৈবলিনী—৩৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে অমালিয়া দেখলো খাটের পাশে ক্যাবিনেটের ওপর খাবারের রাখা। অমালিয়া এগিয়ে গিয়ে দেখলো সেখানে একটি চিরকুট রাখা। চিরকুটে খুলে দেখলো সেখানে লেখা আছে,
“বাসায় আজ কেউ নেই।সবাই বিয়ে বাড়িতে গেছে। তাই খাবার টা আমি নিয়ে এলাম। প্লিজ খেয়ে নিও। রাগ ঝাড়ার জন্যতো আমি আছিই। তাই খাবারের ওপর রাগ করাটা নাহয় স্কিপ করো প্লিজ। আর হ্যাঁ চিন্তা করোনা আমি তোমার সামনে আসছিনা। তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পরই আসবো। ”
চিরকুট পড়ে সেটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলো অমালিয়া। আদ্রর এই অযাচিত কেয়ার কাঁটার মতো বিঁধে ওর শরীরে। যাকে সে জীবনভর অশান্তিতে রাখতে চায়, যার প্রতিটি নিঃশ্বাস বিষাক্ত করে দিতে চায় সেই লোকটাই সবসময় কেন ওর এতো কেয়ার দেখায়? অসহ্য লাগে অমালিয়ার কাছে সবকিছু। সে যে উদ্দেশ্যে এই লোকটাকে বিয়ে করেছিল সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বিফলে যাচ্ছে। এই লোকটাকে যতোই শাস্তি দেই সে ততোই আরও অমালিয়ার প্রতি যত্নশীল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে অমালিয়াও যেন দূর্বল হয়ে পড়ছে। না পারছে আদ্রকে মাফ করতে আর না পারছে তাকে মেনে নিতে। সবকিছু যেন কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ওর কাছে। প্রতিবারের মতো ওর এবারের সিদ্ধান্ত টাও বুঝি বেঠিক ছিলো। আপুর কথা অমান্য করে এই বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি ওর। এখন তো না একুল আছে, না ওকুল।
ঘন্টা দুই পর আদ্র রুমে এসে দেখলো অমালিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবারের প্লেট দেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো সে। যাক, মেয়েটা খেয়েছে তো। আদ্র নিশ্চিত হয়ে সেও গিয়ে ডিভানে শুয়ে পড়লো। ঘন্টাখানিক পর কেমন একটা আওয়াজ পেয়ে বন্ধ করে রাখা চোখ দুটো মেলে তাকালো আদ্র। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই ঘাবড়ে গেল সে। অমালিয়া ঘুমের মাঝেই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে আর ভয়ে কাঁপছে। আদ্র দ্রুত উঠে অমালিয়ার সামনে ফ্লোরে বসে ওর হাতটা ধরলো। অমালিয়া ঘুমের মাঝেই আদ্রর হাত চেপে ধরে আতঙ্কিত কন্ঠে বলতে লাগলো,
–ছেড়ে দাও আমাকে। প্লিজ ছেড়ে দাও। আমার এতবড় সর্বনাশ কোরোনা। পায়ে পড়ি ছেড়ে দাও আমাকে।
ঘেমে নেয়ে গেছে অমালিয়ার পুরো মুখ। সে যে সেদিনের সেই ভয়ংকর রাতটাই স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছে এটা বুঝতে পারলো আদ্র। এটা নতুন না। প্রায় রাতেই অমালিয়া ঘুমের মাঝে এই ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। এসব দেখে আদ্রর নিজের ওপরই তীব্র ঘৃণা জন্মায়। আজ অমালিয়ার এই অবস্থার জন্য সেইতো দায়ী। সে চাইলেও তার করা সেই পাপের দাগ মুছে দিতে পারবেনা অমালিয়ার মন থেকে। অমালিয়া ওকে হাজার টা শাস্তি দিলে, ওর সাথে হাজার খারাপ ব্যবহার করলেও অতোটা কষ্ট লাগেনা যতোটা মেয়েটার এই অবস্থা দেখে হয়। নিজেকে নর্দমার কীটের চেয়েও জঘন্য মনে হয় তখন। পুলিশের হাতে ধরিয়ে না দেওয়ার যে অনুরোধ সে করেছিলো সেই কাজেও তার আপসোস হয়। মনে হয় এখুনি গিয়ে ফাঁ,সি,র দড়িতে ঝুলে যাই। কিন্তু সেটার জন্যেও যে এখন দেরি করে ফেলেছি। এখন আর সেই কাজ করেও কোনো লাভ নেই। বরং এতে সবার জীবন আরও মুশকিলে পড়ে যাবে। আমাকে বাঁচানোর জন্য মা আজ ভাইয়ার কাছে অপরাধী। মায়ের সেই সেক্রিফাইস বিফলে কীভাবে যেতে দেই। আর অমালিয়াও তখন আরও অকূল পাথারে পড়ে যাবে। তাইতো এখন আর সেই কাজে কারোরই উপকার হবেনা। তারচেয়ে অমালিয়ার দেওয়া শাস্তিতেই নাহয় নিজেকে দন্ডিত করি। তাতে কমছে কম মেয়েটা একটু হলেও যদি শান্তি পায়।
আদ্র অমালিয়ার হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডেকে বলল,
–লিয়া, লিয়া ওপেন ইউর আইস। দেখ সব ঠিক আছে। চোখ খোলো।
হঠাৎ ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো অমালিয়া। আদ্রকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে আদ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,
–তুমি! তোমার সাহস কি করে হলো আমার কাছে আসার! ঘুমের মাঝে আমার সুযোগ নিতে চাইছিলে তুমি! রে,প করার শখ এখনো মেটেনি মনে হচ্ছে। আবারও করতে চাও নাকি!
আদ্র এবার একটু চেতে উঠেই বলল,
–লিয়া…….
অমালিয়াও দ্বিগুন চড়া গলায় বলল,
–চেচিয়ে লাভ নেই। গলা আমারও কম নেই। কিছু কি মিথ্যে বলেছি তোমাকে। তোমার কৃতকর্মের আয়নাইতো দেখালাম শুধু। করতে পারলে শুনতেও হবে।
আদ্র এবার একটু নরম গলায় বলল,
–লিয়া তুমি ভুল বুঝছ আমাকে। তুমি ভয়ে কাঁপছিলে দেখেই আমি এসেছিলাম।
লিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–কি দেখতে এসেছিলে? যে তোমার দেওয়া আঘাতের ক্ষত কতটা র,ক্তা,ক্ত করে আমাকে? দেখেছ তো? খুশি লাগছে এখন? নিজের পুরুষত্বের ওপর নিশ্চয় অনেক গর্ব হচ্ছে এখন তোমার? যাও গিয়ে এখন কলিজা ঠান্ডা করে ঘুমাও। নিজেই আঘাত দিয়ে আবার দরদ দেখানোর নাটকের দরকার নেই। জাস্ট অসহ্য লাগে আমার। যাও এখান থেকে।
–ওকে ওকে যাচ্ছি আমি। তুমি হাইপার হইও না প্লিজ। আমি যাচ্ছি।
আদ্র উঠে বেলকনিতে চলে গেল। অমালিয়া বালিশে মুখে গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার আওয়াজ আদ্রর কানেও এলো। চোখের কোণে তারও অশ্রুধার জমলো। শার্টের হাতা দিয়ে মুছতে না মুছতেই আবারও বেড়িয়ে আসছে। আজ ওর একটা ভুলের জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেল। নিজেকে মেরে ফেলেও যদি এসব ঠিক হতো তবে তাই করতো আদ্র। নিঃশ্বাস টাও আজ ভারী মনে হচ্ছে। অমালিয়া ঠিক বলেছে। মরে যাওয়ার শাস্তিতো ক্ষণিকের। বেঁচে থেকে রোজ রোজ মরাটাই আমার জন্য আসল শাস্তি। যে শাস্তি আমার প্রাপ্য তা আমাকে ভোগ করতেই হবে।
___
বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই নিজের রুমে এসে দ্রুত দরজা আঁটকে দিলো, আহানা। রাগে দুঃখে দৌড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সব জিনিসপত্র হেঁচড়ে নিচে ফেলে দিলো। একটা একটা করে সব ভাংচুর করে ধপ করে নিচে বসে পড়ে নিজের দুই গালে পাগলের মতো চড়াতে লাগলো সে। আজ নিজের ওপরই চরম ঘৃণা হচ্ছে ওর। এমন একটা জঘন্য লোককে আমি কি করে ভালোবাসতে পারলাম। সেই ছোট্ট বেলা থেকে অনুভূতি জুড়ে শুধু ওই লোকটাই ছিলো। তার এতো বেপরোয়া ভাব, এতো মেয়েবাজি করা এতো কিছুর পরও তাকে কেন মন থেকে সরিয়ে দিতে পারি না আমি? যতই ঘৃণা করতে চাই ততই কেন অসফল হয়ে যাই? কেন ঘৃণার চাদরে মুড়ে তাকে মন থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না? কেন প্রতিবার ভালোবাসার সামনে ঘৃণা দূর্বল হয়ে পড়ে?কেন ওই জঘন্য লোকের প্রতিই সব অনুভূতি কাজ করে? কেন এতো বেহায়া,নির্লজ্জ আমি? কেন? কেন? কেন?
বিছানার উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো আহানা। আবিরের আজকের কাজে ওর মনটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। এরজন্য তাঁকে সে কখন মাফ করবেনা। কখনো না।
___
রাত সাড়ে বারোটার পর নেশায় বুদ হয়ে,ব্লেজার টা কাঁধে ঝুলিয়ে ধরে, টলমল পায়ে বাড়ি ফিরলো আবির৷ নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে যেতেই হঠাৎ সোফায় বসে থাকা আবিরের বাবা জাবেদ রায়হান আবিরকে ডেকে বলল,
–আবির, এতো রাত করে কোথাথেকে ফিরছ?
আবির ভ্রু উঁচু করে ঘাড় কাত করে ঘুরে তাকালো বাবার দিকে। তারপর আবার নিজের মতো করে চলে যেতে লাগলো সে। জাবেদ রায়হান আবারও ডাকলো আবিরকে,
–আবির, আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে? রোজ রোজ এমন রাত করে বাড়ি ফিরলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তা বুঝতে পারছ?
এবার ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে হাসলো আবির।যেন সে অনেক মজার কৌতুক শুনল। ঘুরে বাবার দিকে তাকিয়ে সে তিরস্কার স্বরূপ বলল,
–বাবা প্লিজ, হঠাৎ করে আমার প্রতি এতো কেয়ার দেখিওনা। আমি নিতে পারবোনা। হজম হবেনা আমার।আর হজম না হলে সকালে বাথরুমে কন্সট্রিপেশন হয়ে যাবে।
–এসব কি কথা আবির? তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো আমার। এইজন্য তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে তো বাড়িতে পাওয়াই যায়না। তবে মনে হচ্ছে না তুমি এখন কথা বলার অবস্থায় আছ। তাই গিয়ে রেস্ট করো। আমরা বরং সকালে কথা বলবো।
আবির ওর বাবার সামনে সোফায় বসে বলল,
–যা বলার এখুনি বলো। এখন তাও হয়তো শুনতে পারবো। কিন্তু একবার হুঁশে এলে আর তোমার শোনা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই কিছু বলার থাকলে এখুনি বলো।
–ঠিক আছে তাহলে এখুনি শোনো। দেখ বয়সতো ভালোই হলো। আর কতদিন এভাবে চলবে? তোমাকে আমি কখনো কোনো কাজের জন্য বাধা দেইনি। জীবনে যা চেয়েছ করেছ।
আবির তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–ওটাকে স্বাধীনতা বলে না বাবা। ওটাকে বলে দায়সারাভাব।কারণ আমার ভালো মন্দ দেখার সময়ই কোথায় ছিলো তোমার। ব্যস কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে তুমি তোমার কাজে ব্যস্ত ছিলে। এনিওয়ে, এসব কথা এখন কেন আসছে? কি বলার সেটা সরাসরি বলো।
–এসব কথা বলার কারণ হলো, জীবনে আনন্দ ফূর্তি, আড্ডাবাজিতো অনেক করলে। এবার একটু বিয়ে শাদি করে সেটেল্ড হও। হাজারটা মেয়ের সাথেতো প্রেম অনেক করলে। এবার শুধু একটা ভালো মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার জন্ম করো।
আবির আবারও তিরস্কার স্বরূপ হেঁসে বলল,
–বিয়ে? সংসার? ভালোবাসা? কেন বাবা? এসব করে কি লাভ আছে? ভালোবাসা, বিয়ে এসব শুধুই মিথ্যে মায়া। ভালোবেসে তো তুমিও মাকে বিয়ে করেছিলে, তো কি হলো? কোথায় গেল সেই ভালোবাসা? যখন পাঁচ বছরের শিশু বাচ্চা রেখে সে অন্য কারোর টানে তোমাকে ফেলে চলে গেল? আর তুমি সেই শোকে শোকাহত হয়ে তার থেকেও দ্বিগুণ জলদি অন্য নারীর সঙ্গ খুঁজে নিজেকে ধন্য করলে। আর মাঝখান থেকে তোমাদের এই ভালোবাসার ফল ভোগ করতে হলো ওই মাছুম বাচ্চাকে। তাহলে এই বুঝি ভালোবাসার লেনদেন? এমন ভালোবাসা আমার চাইনা বাবা। আই জাস্ট হেট লাভ। ভালোবাসা কাউকে কখনো সুখ দেয়না। ভালোবাসা শুধু ধ্বংস এনে দিতে পারে। ভালোবাসা দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর সম্পর্ক। যা মানুষকে বরবাদ করে দেয়। তাই আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি না আর না কখনো ভালোবাসার সম্পর্কে নিজেকে জড়াবো। আমিতো ঘৃণার সম্পর্ক করবো। ঘৃণার সম্পর্ক ইজ মোস্ট পাওয়ারফুল দেন ভালোবাসা। ভালোবাসার অনুভূতির থেকে ঘৃণার অনুভূতি বেশি লয়াল। ভালোবাসায় টান পড়তে পারে। তবে ঘৃণায় কখনো টান পরে না। ঘৃণা এমন একটা অনুভূতি যা মানুষের মন থেকে কখনোই কমেনা। ভালোবাসায় ধোঁকা আছে তবে ঘৃণায় কোনো ধোঁকা নেই। নেই কোনো ছলচাতুরী। ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণার সম্পর্ক সবচেয়ে অটুট। যা কখনো নড়বড়ে হয়না। আজীবন দৃঢ় থাকে। তাই আমিও ঘৃণার সম্পর্ক করবো বাবা, তীব্র ঘৃণার সম্পর্ক।
কথা শেষ করে উঠে চলে গেল আবির। জাবেদ রায়হানের বুক চিঁড়ে এক দুঃখজনক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ছেলের এই মনোভাবের জন্য হয়তো তিনিই দায়ী। আবিরের মায়ের ওভাবে চলে যাওয়ার পর আমি যদি ভেঙে না পরতাম। আর সেই কষ্ট ভুলানোর জন্য যদি অন্য নারীদের সঙ্গ না খুঁজে যদি ছেলেটার প্রতি একটু পিতৃস্নেহ দিতাম তাহলে হয়তো ছেলেটার মনে এমন মনোভাব জন্মাতো না। কিন্তু এখনতো অনেক দেরি করে ফেলেছি। এখন ছেলেটাকে কীভাবে সঠিক পথ দেখাবো আমি।
আবির ঢুলতে ঢুলতে রুমে এসে শরীরটাকে আছড়ে ফেলল বিছানার ওপর। উপুড় হয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো সে। বালিশের তলা হাতড়িয়ে একটা ছবি বের করে আনলো সে। ছবিটা চোখের সামনে ধরে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে রইলো। ছবিতে চার/পাঁচ বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে হোয়াইট প্রিন্সেস ড্রেস পড়ে মিষ্টি করে হাসছে। আবির ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
–তুই কখনো যেন আমাকে ভালো বাসিস না, আন্নি। তুই আমাকে শুধু ঘৃণা করবি। তুই আমার ঘৃণার রত্ন। সবসময় আমাকে ঘৃণা দিয়ে ভরিয়ে দিবি। আর কিছু চাইনা তোর কাছে।
___
আজ নূরের গাড়ির মার্কেটিং লাউঞ্চ-এর উদ্ভোদনি অনুষ্ঠান। আজ থেকে কমার্শিয়ালী মার্কেটে গাড়ির বিক্রি শুরু হবে। বিশাল কার শোরুমে এর উদ্ভোদনির আয়োজন করা হয়েছে।সাংবাদিক মাধ্যমদেরও ইনভাইট করা হয়েছে। নূর ফিতা কেটে এই শুভ কাজের উদ্ভোদন করবে। আজ তার কাছে একটা বিশেষ খুশীর দিন। আজ ওর স্বপ্ন পুরোপুরি ভাবে সফল হতে চলেছে। হাজার বাঁধা বিপত্তি সংঘর্ষ কাটিয়ে উঠে ফাইনালি সেই শুভক্ষণ এলো ওর জীবনে। এই অনুভূতি ভাষাহীন। সকাল দশটার দিকে নূর এসে পৌঁছাল। একটু পর সোহানও এসে পৌঁছাল। নিজেদের সিটে এসে বসলো ওরা। হঠাৎ তখনই আদিত্যর গাড়ি এসে থামলো সামনে। গাড়ি থেকে আদিত্য নামতেই সাংবাদিকসহ সব লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়লো তার সামনে। এসব দেখে নূর বিরক্তির শেখরে। এই লোকটাকে এখানে আসার কী দরকার ছিল? নিশ্চয় মিঃ সোহান ইনভাইট করেছে। ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডরকে নাকি উদ্ভোদনে ডাকতে হয়। এমনটাই বলেছিলেন তিনি। কবে যে এই লোকটার ছায়া থেকে ছাড় পাবো কে জানে।
ফ্যানসদের সাথে মেলা শেষ করে নূরদের জয়েন করলো আদিত্য।আসতে আসতে নূরের দিকে সন্তর্পণে চোখ টিপ মেরে দিতে ভুললোনা। নূর তা দেখে বরাবরের মতোই অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। গাড়ির সম্পর্কে কিছুক্ষণ মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিলো নূর।আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে নূরকে। নূরের প্রতি তার খুব গর্ববোধ হচ্ছে আজ। মেয়েটা সত্যিই এক অনন্যা। কিছুক্ষণ পর উদ্ভোদনের আসল কাজ শুরু হলো। ফিতা কেটে গাড়ির প্রদর্শন আরম্ভ করা হলো। লোকজন ঘুরে ঘুরে গাড়িগুলো দেখতে লাগলো। সোহানের বোন এসেছে আদিত্যকে দেখতে। সে আদিত্যর বিশাল বড়ো ভক্ত। সোহান ওর বোনকে নিয়ে আদিত্যর সামনে এসে বলল,
–মিঃ আদিত্য, ও আমার বোন সাইমা। আপনার অনেক বড়ো ফ্যান। যখন থেকে শুনেছে আপনি আমাদের সাথে কাজ করছেন তখন থেকে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে আপনার সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য।
আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
–হ্যালো সাইমা।
সাইমা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–ওয়াও,আমি সুপারস্টার আদিত্যকে দেখছি, আই জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট! খুশিতে অজ্ঞান না হয়ে যাই। আমি আপনার সবচেয়ে বড়ো ফ্যান, এসি।
আদিত্য সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল,
–থ্যাংক ইউ সাইমা।
সাইমা ফোন বের করে আদিত্যর সাথে সেলফি নিতে লাগলো। সেলফি নেওয়ার সময় আদিত্যর সাথে একেবারে ঘেঁষে যাচ্ছে সে। দূর থেকে এসব দেখে ক্রোধে ফুঁসসে নূর। না চাইতেও বারবার চোখ ওদিকে চলে যাচ্ছে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে তার। সে চাইছে না তার ব্যাপারে কোনো কিছু ভাবতে। তবুও এসব তার সহ্য হচ্ছে না। গলায় মাছের কাটা আটকে যাওয়ার মতো মনোভাব হচ্ছে তার। সাইমা সেলফি নেওয়া শেষে হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরলো আদিত্যকে। আদিত্য নিজেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেও হজম করে গেল সে। নিজের ফ্যানসদের কখনো অবজ্ঞা করেনা আদিত্য। কিন্তু এই দৃশ্য নূরের ক্রোধের সীমা আরও বাড়িয়ে দিলো। অসহ্য রাগে সে থাকতে না পেরে অন্য দিকে চলে গেল। শো রুমের অন্য সাইডে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে একটু ফ্রেশ হাওয়ায় নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। ভাবতে চাইনা ওই লোকের ব্যাপারে কোনো কিছু। তার উপস্থিতি আমার ওপর প্রভাব ফেলতে দিতে পারি না। যা খুশি তাই করুক, আই ডোন্ট কেয়ার। হঠাৎ কেউ কানের কাছে এসে বলল,
–এতো জ্বলন? ভালোবাসনা তাহলে এতো কেন জ্বলছ?
হকচকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো নূর। আদিত্যকে দেখে তার ক্রোধের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। এই লোকের সাথে এখন কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। তাই নূর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। তবে তা হতে দিলোনা আদিত্য। নূরের হাত ধরে টান নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাদকতার সুরে বলল,
–কোথায় পালাচ্ছ? কতদিন নিজের অনুভূতি থেকে পালাবে? আমাকে ভালোবাসতে পারো, অন্য মেয়ের সাথে দেখে জ্বলতে পারো অথচ আমাকে তোমার মনের কথা বলোনা। কেন করছ এমন?
কষ্ট আর রাগের মিশ্রণে নূরের অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। নূর সইতে না পেরে আদিত্যকে সজোরে থাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
–হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি! স্টে ইন ইউর লিমিটস। এন্ড স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি।
বলেই উল্টো ঘুরে দ্রুত চলে গেল নূর। আদিত্য বেচারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো,নাজানি জিদ্দি নারীকে সে কবে মানাতে পারবে? কে বলেছিল এই কটকটে মহিলার প্রেমে পড়তে? জিদান ঠিকই বলে,কুমিরের সরদারনী একটা। মনে মনে এসব ভেবে নিজের মনেই হাসলো আদিত্য। তারপর এগিয়ে গেল আবারও নূরকে দেখতে। ভেতরে যেতে নিলেই হঠাৎ দেখলো সোহান নূরের সাথে আলাদা কি যেন কথা বলছে। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে একটু এগিয়ে গেল। সোহান আর নূর আদিত্যকে তখনও দেখেনি। সোহান হাসিমুখে নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–কংগ্রাচুলেশনস মিস নূর। ফাইনালী আপনার স্বপ্ন ডানা মেলে উড়ছে।
নূর সৌজন্যমূলক হেঁসে বলল,
–ধন্যবাদ মিঃ সোহান।
–আপনি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম।
–জি বলুন।
–না মানে, এখনতো আপনার স্বপ্ন পূরণ হলো। বলতে গেলে আপনি সবদিক থেকে সফল। তো এখন সামনে কি পরিকল্পনা করেছেন? মানে বিয়ে শাদির ব্যাপারে কি চিন্তা করেছেন আপনি? আপনি চাইলে কিন্তু সুপাত্রের লাইন লেগে যাবে। ইনক্লুডিং মি অলসো। তো কি খেয়াল আপনার এই ব্যাপারে? ঘটক পাঠাবো নাকি?
সোহান কথাটা মজার ছলে বললেও নূরের তা মোটেও ভালো লাগলো। সে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই সে দেয়ালের ওপাশে আদিত্যকে দেখতে পেল। তার মাথায় হঠাৎ কিছু এলো। আদিত্যর কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার এটাই সুযোগ। আজকে ওই লোকের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিবে নূর। সেই ভাবনা অনুযায়ী নূর মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে সোহানের উদ্দেশ্যে বলল,
–হোয়াই নট! বয়স হচ্ছে বিয়েতো করতেই হবে। কতকাল আর কুমারী থাকবো। আর আপনার মতো কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাওয়াতো যেকোনো মেয়ের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।
–সত্যিই বলছেন! জেনে ধন্য হলাম। তাহলে কালই খটক পাঠিয়ে দিচ্ছি কি বলেন?
–ইয়া সিওর।
বলেই দুজন হাসলো হালকা।আদিত্য সরে এলো ওখান থেকে। নূর সেটা দেখতে পেল। ভাবলো,এবার হয়তো আদিত্য ওর পিছু ছেড়ে দিবে। আর এই সোহানকে তো পরে অন্য ভাবে বুঝিয়ে দিবে। তবে নূর ধারণা করতেও পারবেনা তাদের এই কথপোকথন যে আদিত্যর মাঝে কি ভয়াবহ দাবানল জ্বালিয়ে দিলো। আদিত্য তীব্র ক্রোধের অগ্নিশিখা নিয়ে বাইরে এলো। রাগে মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে তার। বাইরে এসে বড়ো ফুলদানিটা লাথি মেরে ফেলে দিলো। গাড়ির কাছে এসে গাড়িতেও কয়েকবার লাথি মারলো। তাও রাগ কমছেনা তার। দুই হাতে মাথার চুল চেপে চাপা একটা চিৎকার দিলো সে। র,ক্তলাল হয়ে উঠলো চোখের পাতা। হাতের মুঠো সজোরে চেপে ধরে চোখ মুখ ভয়ংকর কঠিন রুপ ধারণ করে বিড়বিড় করে বলল,
–ব্যস,এটাই করা উচিত হয়নি তোমার নূর। এবার যা হবে তারজন্য তুমিই দায়ী থাকবে। এটা করতে বাধ্য করলে তুমি আমাকে।
চলবে……