শ্যামারণ্য পর্ব-০৩

0
699

#শ্যামারণ্য
#পর্বঃ০৩
লেখনীতেঃ #ফাহমিদা_মেহেজাবীন

লোকটি তার কন্ঠের কৌতুকের ছাপ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শান্তভাবে বলতে লাগলো,”আমি বিষয়টা পুরোটাই বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।
প্রথম শর্ত হলো,আপনি আমার মনিবকে কখনো চোখে দেখতে বা দেখার চেষ্টা করতে পারবেন না। যদি বিয়েটা হয়,মনিব ঠিক রাত বারোটায় আপনার কক্ষে যাবেন এবং সকালের আগেই চলে আসবেন। এই পুরোটা সময়ই আপনার চোখ কাপড় দিয়ে বন্ধ অবস্থায় থাকতে হবে। এই শর্তটি কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয় শর্তটি হলো,যেটা একটু আগে আপনাকে বললাম। আমার মনিব তাকে প্রশ্ন করা পছন্দ করেননা। তাই তাকে দেখার বা জানার কোনো কৌতুহল দেখানো যাবেনা। তাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবেনা।

তৃতীয় শর্ত,আপনি রাত বারোটায় মনিব আসার সময় হতে মনিব কক্ষ বেরিয়ে যাওয়ার পরের সময় পর্যন্ত ছাড়া এ বাড়িতে আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন,যা খুশি করতে পারেন। শুধু দ্বিতীয় তলার শেষের ঘরটিতে প্রবেশ নিষেধ। আর হ্যাঁ, বাড়ি থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা থাকলে তাহলে তার আগের দিন রাতে অবশ্যই মনিবের অনুমতি নিতে হবে।

চতুর্থ শর্ত, আপনি মনিব সম্পর্কে কারো সাথে কোনো কথা বলতে পারবেন না। আপনি আপনার পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে জানানো বা না জানানো আপনার ব্যাপার কিন্তু তারা মনিব সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে আপনি তাদেরকে কিছু বলতে পারবেন না।

পঞ্চম শর্ত,এই পর্যন্ত বলা সকল শর্ত মান্য করা কিন্তু অনিবার্য। এর মধ্যে একটিও লঙ্ঘন করলে কিন্তু আপনি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবেন।
এবার আপনার মতামত বলুন,আপনি যদি এসব শর্তে রাজি থাকেন তাহলেই আমরা এই ব্যাপারে আগাবো”

সামনে বসা লোকটির শর্তগুলো শুনে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে শ্যামা। অনেককিছুই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার এই মূহুর্তে কিন্তু কথাগুলো তাকে এতোটাই শকড করেছে যে সে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। যেনো আশা করছে লোকটি এখনি বলবে যে সে তার সাথে নেহাৎ মশকরা করছিলো। কিন্তু না,অনেকক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পরও লোকটির অভিব্যক্তির মাঝে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলোনা,তার চেহারার গাম্ভীর্য জানান দিচ্ছে যে সে কোনো রসিকতা করছেনা তার সাথে।
কিছু সময় পর নিজের ভাষা খুঁজে পায় যেনো শ্যামা। সে লোকটির চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে তাকে,
“তাহলে আপনি আমাকে বলতে চাইছেন,আমি একজন কে বিয়ে করবো কিন্তু চেনা জানা তো দূরের কথা,আমি তাকে কখনো চোখের দেখাও দেখতে পারবোনা?তাকে প্রশ্ন করতে পারবোনা,তাকে জানতে চাইতে পারবোনা,আমার পরিবার বা সমাজ কেউ তার কথা জানবেনা,তার সাথে মূলত আমার এটুকুই সম্পর্ক হবে যে উনি আমার সাথে রাত কাটাবে। কিন্তু আমাকে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস তার অনুমতি নিয়ে নিতে হবে, তাইতো?”

“অনেকটা তাই ম্যাডাম,তবে পুরোপুরি বিষয়টা এমন নয়।”,লোকটি বিব্রত কণ্ঠে জবাব দিলো।

লোকটির জবাব শুনে এবার উচ্চস্বরে হেসে ফেলে শ্যামা। রা’গে দুঃখে অপ’মানে তার পুরো শরীর জ্ব’লে যাচ্ছে,চোখের অশ্রুগুলোও বাধ মানছেনা। দারিদ্র্য আর অসহায়ত্ব আজ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। একবুক আশা নিয়ে সে এতোদূর ছুটে এসেছে কারণ তার কাছে আর কোনো পথ খোলা ছিলোনা। কিন্তু শেষে কিনা তাকে কোনো ধনী কা’পুরুষের র’ক্ষি’তা হতে হবে?না,কখনোই না। এতটাও নীচে নেমে যায়নি সে। এমন টাকায় বাবার চিকিৎসা করিয়েছি জানতে পারলে বাবা নিজেই গলায় দড়ি দেবে। আর এক দন্ড না ভেবে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।

“আমাকে মাফ করবেন চাচা। আমার বুঝতে ভুল হয়েছিলো। পাত্রী খোঁজার বিজ্ঞাপন পড়ে ভেবেছিলাম আপনারা বিয়ের পাত্রী খুঁজছেন,কিন্তু আপনারা যে আপনার মনিবের জন্য একজন র’ক্ষি’তা হিসেবে পাত্রী খুঁজছেন কে জানতো?বুঝতে পারলে এখানে আমি কখনো আসতাম না। এরপরের বার বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় এটা উল্লেখ করে দিবেন যে আপনারা র’ক্ষি’তা হওয়ার পাত্রী খুঁজছেন,এতে দুপক্ষেরই অনেক সময় বাঁচবে।”

“ম্যাডাম আপনি কিন্তু মনিবকে ভুল বুঝছেন। উনি এমনটা নয় যেমন আপনি ভাবছেন।”

কথাগুলো কানে যেতেই তেলে-বেগুনে জ্ব’লে উঠে শ্যামা। গর্জে উঠে বলে,”কিসের ভুল বুঝছি হ্যা?কিসের ভুল বুঝছি?আপনার মনিবের টাকা আছে অনেক,তাই তার কাছে গরীব মানুষদের মানুষ বলে মনে হয়না তাইনা?তাইতো অমন ডিমান্ড দিয়েছেন পত্রিকায়। কারণ জানতেন আমাদের ক্যাটাগরির মেয়েদের গায়ের রঙের কারণে কেউ চড়া দামের যৌতুক ছাড়া বিয়ে করেনা,সেখানে মেয়ের পরিবার গরিব হলেতো কথা ই নেয়। এই রকম মেয়েরা টাকার লো’ভে এই অফারটা নিশ্চয়ই লুফে নিবে তাইনা?এতোটা নীচ আপনারা কি করে হতে পারেন? কোনো ভালো ঘরের মেয়ে এমন প্রস্তাবে রাজি হবেনা দেখে আপনারা আমার মতো মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন?”

“দেখুন ম্যাডাম,আপনি প্লিজ আমার কথাটি শুনুন……”

“আমার যথেষ্ট শোনা হয়ে গেছে,আর কিছু শুনতে চাইনা আমি। আপনার মনিবকে বলে দিবেন,শ্যামা অসহায় হতে পারে কিন্তু দুর্বল নয়। আমার অসহায়ত্বকে দুর্বলতা ভেবে যেনো ভুল না করেন। আমার মতো মেয়েরা ঠিক কতটা সয্য করে এই সমাজে টিকে থাকে সে সম্পর্কে ওনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমাদের সয্যের সীমা ঠিক কতটুকু তা জানলে তিনি এই ভুল করতেন না। উনাকে বলে দিবেন শ্যামা এতটা নীচেও নেমে যায়নি যে কারো র’ক্ষি’তা হয়ে থাকতে হবে তার।”

এই বলে হনহনিয়ে হেটে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে লোকটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।

শ্যামার এই মূহুর্তে মাথা ঠিক নেই,রাগের মাথায় আশেপাশের পরিবেশে দৃষ্টি রাখার কথা মাথায় আসেনি তার,প্রচন্ড রাগে বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। কারণ মাথা ঠান্ডা থাকলে ঠিকই দেখতে পেতো দোতলার শেষ ঘরটার জানালা খোলা হয়েছে, চাঁদের মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে জানালার কাছে পর্দার সরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে একটি অবয়ব,যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার যাওয়ার পানে। মুখে খেলা করছে তার একটি স্মিত হাসির রেখা। শেষ কবে হেসেছিলো সে মনে নেয় তার,কিন্তু এই মুহুর্তে তার মনে তীব্র এক ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এই অনুভূতি সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞাত সেই ব্যক্তি। তাইতো ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে,যে এই নতুন সৃষ্ট অজ্ঞাত অনুভূতিগুলো ভবিষ্যতে একদিন তার জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করবে।

দড়জায় মৃদু কড়াঘাতে সম্ভিত ফিরে তার। মুহুর্তেই গম্ভীর হয়ে যায় তার অভিব্যক্তি। আদেশের সুরে অনুমতি দেয়,”ভেতরে এসো”

অনুমতি পেয়ে ভেতরে এসেই মনিবের পায়ের কাছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সামশের। থরথর করে কাঁপছে সে ভয়ে। তার মনিব রেগে গেলে তার শা’স্তি হয় ভয়ানক। ওই মেয়েটির অবাধ্য কথাগুলো নিশ্চয়ই মনিবকে রাগিয়ে দিয়েছে। এখন তার কপালে কি শাস্তি আছে তা ভেবেই ভয়ে কাঁপছে সে।
কাঁপাকাঁপা কন্ঠে কোনো রকম বলে উঠে,”ক্ষমা…ক্ষমা করে দিন এই নির্বোধকে মনিব। আপনার জন্য মেয়ে খোঁজার দ্বায়িত্ব ছিলো আমার। আজকে একটি সাধারণ মেয়ের মুখে এতো কথা শুনতে হলো আপনাকে,এটা আমার ব্যর্থতা। আমাকে যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো আমি।”

চরম বিরক্তি নিয়ে ঘুরে তাকায় ব্যক্তিটি সামশের নামের লোকটির দিকে।
“বেশি কথা আমি পছন্দ করিনা সামশের,কতবার বলতে হবে তোমাকে?আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি এখনো?পরের বার থেকে আমি কিছু বলার আগেই এভাবে বিচলিত হবেনা।”

“কিন্তু মনিব,তিনটি মেয়ে এসেছিলো তার মধ্যে যাকে পছন্দ হয়েছে আপনার সেও নাকচ করে দিয়েছে। আমি কি করতে হবে কিছু বুঝতে পারছিনা। আমাকে আদেশ করুন মনিব কি করা উচিত আমার।”

আবার বিরক্তিতে ভ্রুযুগল কুঁচকে ফেলে ব্যক্তিটি,”বললাম তো বিচলিত হওয়ার কিছু হয়নি,তোমাকে কিছু করতে হবেনা,তুমি যেতে পারো।”

“কিন্তু মনিব আপনার বিবাহ….”

“শ্যামা ফিরবে। ফিরে তাকে আসতেই হবে। সেই ব্যবস্থা আমি করবো। তোমাকে এই নিয়ে আর ভাবতে হবেনা। এবার যেতে পারো তুমি। আবার যেনো বলতে নাহয় কথাটা!”

মাথা নীচু করে উঠে দাঁড়ায় সামশের,মনিবের হুকুম তার কাছে অকাট্য বাণী। তার কথার পিঠে প্রশ্ন করার নিয়ম নেই।

(চলবে)