#সে অবেলায় এসেছে
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব -৩
আরও একটা গুমোট সকালের সূচনা। নিত্যদিনের ভ্যাপসা গরমের সাথে বেড়ে চলেছে উৎকণ্ঠা। অর্থী আজকাল আর ধাক্কা খায়না কোনকিছুতে। বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নয়তো সঠিক ক্ষণের অপেক্ষায় দিন গুনছে। দিনগুলো ব্যাস্ততায় কাটলেও রাতগুলো বড্ডো পীড়া দিচ্ছে। নীলয়ের সাথে ব্যাক্তিগত মুহূর্তে সে আর নিজে থেকে সাড়া দেয়না। কেমন যেনো আত্মসমর্পণ করে সঁপে দেয় নিজেকে। নীলয়ের তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। তার তো চাই নারীদেহ। রক্ত মাংসে গড়া এক নারীদেহ। যাকে ভোগেই শান্তি তার। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে বিছানার এককোণে অর্থী। শরীরের শক্তি যেনো দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। হারাচ্ছে মানসিক ক্ষমতা। নির্ঘুম রাতের আকাশ একমাত্র জানে তার বেদনা। বুক ফাটা আর্তনাদের সাক্ষী একমাত্র নিঃসঙ্গ সেই চাঁদ। একাকি বিড়বিড় করে উন্মাধের মতো প্রলাপ করে অর্থী। অভিযোগগুলো কান্নার সাথে মিলেমিশে ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে। চাঁদের আলো হামাগুড়ি দিয়ে আছড়ে পড়ে তার মুখে। স্নিগ্ধ সুন্দর মুখশ্রী চাঁদের আলোয় আর জ্বলজ্বল করেনা। কেমন যেনো মিয়য়ে পড়েছে।
দুপুরের ভ্যাপসাভাব কমে খানিকটা শীতল হাওয়া বইছে পরিবেশে। বিচক্ষণ চাহনিতে চারিদিকে তাকিয়ে রুমের দরজা জানালা বন্ধ করলো অর্থী। সোফায় বসে অন করলো সেদিনের ভিডিওটা। মাথার উপর সিলিংফ্যানটা ঘুরছে নিজ গতিতে। তারপরও ঘামছে অর্থী। মন বলছে সামনে ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
হিংস্র পশুর মতো নীলয় একে একে কামড় বসাচ্ছে মেয়েটার সর্বাঙ্গে। সে যেনো মানুষ নয় জঙ্গলের হিংস্র কোনো পশু। যন্ত্রণায় ছটফট করছে নারীদেহ। জল ছাড়া মাছের মত কাতরাচ্ছে মেয়েটা। নির্দয় নীলয় তাও রেহাই দিচ্ছেনা। সে যেনো নিজ সত্ত্বায় নেই। বাঘের মতো ছিড়ে খেতে চাচ্ছে দেহটাকে। মেয়েটার আহাজারী প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ফাঁকা রুমের চারদেয়ালের মাঝে। অর্থীর মনে হচ্ছে সে কোনো হরর সিরিজ দেখছে। নীলয়ের মাঝে বাসা বেঁধেছে অশরীরী কোনো আত্মা। মনে প্রাণে চাচ্ছে এসব মিথ্যে হোক। মিথ্যে হোক তার দেখা। কিন্তু সত্যি কি আদৌ চাপা দেওয়া যায়? হাজার মিথ্যের স্তূপের মাঝে লুকিয়ে রাখলেও সত্য ঠিক নিজের রাস্তা বের করে নেয়। সময় লাগলেও ঠিকই প্রকাশিত হয় সবার সামনে। মুখে হাত চেপে ধরে অর্থী। কান্নার ফলে হিঁচকি উঠে গেছে। এই নীলয়কে একেবারে অচেনা লাগছে অর্থীর।
“নীল, আমাকে রেহাই দাও। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। নীল, তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো। তোমার কথায় নিজেকে সঁপে দিয়েছি। ভালোবেসে বিশ্বাস করেছি। আমাকে রেহাই দাও নীল। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
মেয়েটির আহাজারীতে খানিকটা থামলো নীলয়। মেয়েটার কষ্টের কথা ভেবে নয় বরং নিজের দুষ্কর্মে হাঁপিয়ে পড়েছিলো বলেই থামলো। নীলয়ের হাঁসির ঝঙ্কারে কেঁপে কেঁপে উঠছে দেহ। শয়তান যেনো ভর করেছে সেই হাসিতে। ভূবন কাঁপানো সেই হাঁসির শব্দে থতমত খেয়ে যায় মেয়েটা। শরীরের ব্যাথা ভুলে পলকহীন তাকিয়ে থাকে নীলয়ের দিকে।
“ভালোবাসা? নীলয় কখনও কাউকে ভালোবাসেনা। নীলয় শুধু ভোগ করে। নারীদেহ ভোগ করার জন্য নাটক করে তোদের মতো মেয়েদের সাথে। নীলয়ের ভালোবাসা, টান সব এই কোমল মাংসপিণ্ডের দেহে। আলাদা করে নারীদের ভালোবাসার কি প্রয়োজন। পুরুষ নারীকে ভালোবাসে শুধু দেহের জন্য। এই দেহই ত সব।”
“দেহ তো নিষিদ্ধ পল্লীতে গেলেও পেতে নীলয়। কেনো আমার জীবন নষ্ট করলে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তবে কেনো আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলে তুমি নীলয়? বলো কি পেলে আমাকে নিঃস্ব করে?”
রাগান্বিত সেই কণ্ঠ একহাতে চেপে ধরে নীলয়। হিশহিশিয়ে বলে,” আমার সামনে চড়া গলায় কথা বললে নিঃশ্বাস টুকুও কেড়ে নেবো। নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েরা তো দেহ দেওয়ার জন্যই বসে থাকে। কিন্তু প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে মেয়েদের ভোগ করার মজাটাই আলাদা। এটাতে যে কি শান্তি!”
ঘৃণায় শরীর রি রি করে ওঠে অর্থীর। নিজের শরীরের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে তার। এই নোংরা মানুষের সাথে এতগুলো দিন এক বিছানায় শুয়েছে ভাবতেই বমি পাচ্ছে অর্থীর। এই লোকটার ছোঁয়া রয়েছে তার সর্বাঙ্গে ভাবতেই নিজের চামড়া ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। বারবার কানের কাছে বাজছে একটা কথা। সে কখনো কাউকে ভালোবাসেনি। প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ভোগ করেছে মাত্র। মরীচিকার মতো শুধু ভালোবাসা খুঁজেছে অর্থী। যে ভালোবাসার জন্য ছেড়েছে বাড়ী, হারিয়েছে আপনজন। প্রাণপ্রিয় বাবার সম্মান মিশিয়েছে ধুলোর সাথে। ভেঙেছে স্নেহের আদরের ভাইয়ের বিশ্বাস। তার জন্য প্রশ্ন উঠেছে মায়ের শিক্ষার উপর। সব তো এই ভালোবাসার জন্য। মিথ্যে ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সর্বহারা আজ অর্থী। বুকের অসহ্য যন্ত্রণায় টেকা দায় হয়ে পড়ছে।
যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মেয়েটার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লো। মুক্তি পেলো যন্ত্রণা থেকে। অসহ্য প্রাণনাশক যন্ত্রণার চেয়ে বোধহয় মৃত্যু শ্রেও। নিথর দেহটা প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। বড়ো বড়ো হয়ে আছে চোখ দুটো। প্রাণহীন চোখের কোণ ঘেঁসে অশ্রুর ছড়াছড়ি। কয়েকহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে নীলয়। চোখেমুখে নেই কোনো অসহায়ত্বের ছাপ। নেই অপরাধবোধ ছিটেফোঁটাও।
“নীলয় সাহেব,
আপনাকে সাহেব বললে সাহেবদের অপমান করা হয়। তাও বললাম। কেনো জানেন? কারণ আপনি একমাত্র ব্যাক্তি যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। কিশোরী সত্তা অবুঝের মতো যাকে বিশ্বাস করেছিলো। মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছিলো। সাধু বেশে নরপিশাচ আপনি। ছিঃ আমার ভাবতেও ঘৃণা হয় আমার কিশোরী মন আজও আপনাকে ভালোবাসে।
মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা? একেবারে জেন্টেলম্যান। নারীর প্রতি সম্মান যার শিরায় শিরায়। প্রেম নামক অসুখে জড়িয়েছি প্রতিনিয়ত। কতশত রাত অনিদ্রায় কেটেছে প্রেমালাপে। অথচ আপনি পাপী। আপনি হত্যাকারী। আপনি নিষ্ঠুর। আপনি নরপশু। নারীর শরীর দেখলেই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় যে পুরুষ আপনি সেই চরিত্রহীন পুরুষ। ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন খাদ্য পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আপনি নারীদেহ দেখলে তার চেয়েও ভয়ানক হয়ে পড়েন। মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে নারীদেহ দেখলে। আচ্ছা আপনি মানুষ তো? এতো নীচ মানুষ হয় বুঝি?
এতক্ষণে ভিডিওটা দেখেছেন নিশ্চয়ই। যে মেয়েটাকে আপনি শেষ করলেন সে কে ছিলো জানেন? আমার দিদিভাই। দিদিভাই আমাকে বারবার বলেছিলো আপনি নাটক করছেন। দিদিভাইয়ের হাতে অনেক মার খেয়েছি আমি আপনার জন্য। অনেক ভালোবাসতো দিদিভাই আমাকে। তাইতো আমাকে আপনার মতো নোংরা, রাস্তার কিটের হাত থেকে বাঁচাতে সেদিন নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। ভিডিও কলে ছিলাম আমি। সবটাই রেকর্ড করতে বলেছিলো দিদিভাই। শেষে যখন দিদিভাই ছটফট করছিল বাঁচার জন্য দিশেহারার মতো চিৎকার করেছি আমি। বারবার মিনতি করেছি দিদিভাইকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার চিৎকার পৌঁছায়নি আপনার কানে। আমাকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে শেষ করলো দিদিভাই। ছোটো বোনের জীবন রক্ষা করতে শুলে চড়ালো নিজেকে। আপনাকে ভালোবাসার মাশুল হিসেবে হারালাম আমি আমার এক সত্তা। দিদিভাই আমার আর একমাত্র সত্তা ছিলো। আমি কিভাবে ভুলবো দিদিভাইকে করা আপনার অত্যাচারের কথা? কিভাবে ভুলবো আমার ভুলের মাশুল দিলো আমার দিদিভাই। কিভাবে মেনে নেবো আমার দিদিভাই আর নেই। আপনাকে পুলিশের হাতে দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আছে। হ্যা সবটাই দিদিভাইয়ের দৌলত। তবুও আপনি এখনো বেঁচে আছেন। কেনো জানেন? কারণ ভিডিওতে আমার দিদিভাই আছে। আমি চাইনা দিদিভাইকে কেউ এমন অবস্থায় দেখুক। আপনি তো আপনাকে পাপের শাস্তি পাবেন। খুব শীঘ্রই পাবেন। প্রতিটা সিজদায় আমি লুটিয়ে পড়ি আল্লাহর দরবারে। ধ্বংস চাই এক মানবের। নৃশংস মৃত্যু চাই আপনার। হেরে যাওয়া মানুষের ফরিয়াদ আল্লাহ ফিরিয়ে দেবেন না আমি জানি। আপনি নৃশংভাবে মরবেন।”
হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে কান্না করছে অর্থী। চিঠিটাতে লেখা আছে কারো বোন বাড়ানোর গল্প। লেখা আছে তিক্ত কিছু অতীত। নিজেকে বড্ডো বোকা বোকা লাগছে তার। এতো বোকা সে কিভাবে হলো? কিভাবে মানুষ চিনতে ভুল করলো? ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু। নিঃস্ব হওয়ার কষ্ট কুরে কুরে খাচ্ছে অর্থীকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। কান্নার ফলে ভিজে গেছে বুক। মাথার উপর ফ্যান চলছে তবুও ঘেমে চলেছে ক্রমাগত। ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে জামা।
কেঁপে কেঁপে উঠছে অর্থী। কান্নার ধমকে হেঁচকি উঠে গেছে। চেয়ার ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে গেলো আলোক। পানির গ্লাস এনে ধরলো অর্থীর মুখের কাছে। ঢকঢক করে সবটুকু পানি শেষ করলো অর্থী।
“মিস অর্থী, সেই ফোন আর ভিডিও কি আপনার কাছে আছে? আমি কথা দিচ্ছি মেয়েটার মুখ কারোর সামনে আসতে দেবোনা। অন্তত নিজের সন্তানের জন্য একটু বাঁচার চেষ্টা তো করতেই পারেন তাইনা?”
“আমার একটা কথা রাখবেন?”
“বলুন।”
“আমার সন্তানকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দেবেন? বাপের রক্তের চেয়ে মায়ের গুণাগুণ তার মধ্যে প্রকট এটা প্রমাণ করতে পারবেন? যদি কখনো মনে হয় সে বাবার গুন পেয়েছে। সেই মুহূর্তে শেষ করে দেবেন ওকে। দ্বিতীয় কোনো নীলয় যেনো না আসে পৃথিবীতে।”
#চলবে?