#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব_৩
#আরশিয়া_জান্নাত
তৃণা ব্যাপারটা খুব এক্সাইটিং না বল? ট্রেনে পরিচয়, এখন আবার ২য় বার সাক্ষাৎ হবে বইয়ের উছিলা। কেমন যেন মুভির স্টাইলে এগুচ্ছে! হ্যাঁ রে তিনি দেখতে কেমন? হ্যান্ডসাম আছে তো?
রুপার কথায় তৃণা খানিকটা বিরক্তস্বরেই বললো, যাচ্ছিস তো সাথে তুই নিজেই দেখে নিস দেখতে কেমন! পারলে গজফিতাটাও নে হাইট মেপে নিবি!
রেগে যাচ্ছিস কেন? তোর যে হাইট, ওতে সব ছেলের সাথে তোকে মানাবে? নিম্নে তো ৫’১১ লাগবে।
আমার দাদী বলে লম্বা মেয়েদের জামাই লম্বা হয় না। তাই আমি ঐসব নিয়ে ভাবি না। যেই আসুক যেন মনের দিক থেকে বেস্ট হয়, আমাকে অনেক ভালোবাসবে, যত্ন করবে ওতেই চলবে আমার।
আমি তোর মতো ভাবিনা, চোখের দেখায় যদি শান্তি না মিলে আর কি হবে! মন পড়ার আগে চোখে লাগতে হয়…
চোখে দেখতে গিয়ে এই পর্যন্ত সব প্লেবয়ই পেলি। তারপরও তোর শিক্ষা হলোনা?
শিক্ষা হবেও না,,আমি চাই এমন একজন আসুক যে দেখতেও জোশ মনও ভালো।
হাহাহা কোনো অংশে ছাড় দিবি না তুই! মাথায় রাখিস কেউ ই শতভাগ পারফেক্ট না। দেখি চটজলদি রেডি হ, শাটলে সিট ধরতে হবে,,,
রুপা আর তৃণা ঝটপট তৈরি হয়ে নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে শাটলে উঠলো। জানলার ধারে বসে বাইরের দিকে মনোনিবেশ করতেই হঠাৎ রুপা কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। তৃণা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই রুপা ইশারায় দুই সিট পরে অপজিটে বসা ছেলেটাকে দেখালো। তৃণা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল, উনি এখানেও চলে এসেছেন!
রুপা হেসে বলল, তুই পাত্তা দেস না অথচ দেখ তোর পিছে কেমন আঠার মতো লেগে থাকে।
হতে পারে সে অন্য কাজে যাচ্ছে, তুই ওদিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকা।
রুপা তার কথা থোরাই পাত্তা দিলো, সে বরং হাত উচিয়ে হায় দেখালো। বিনিময়ে জাবেদ নামক সিনিয়র ভাইটা মুচকি হাসলো।
ঘড়ির দিকে চেয়ে আরেকবার পথের দিকে চাইলো ইরহাম। নাহ দূর দূরান্তেও সেই রমণীর ছায়া নেই। তবে কি আরো দেরি হবে! কারেন্ট এফেয়ার্স ম্যাগাজিন টা উল্টেপাল্টে কিছুক্ষণ পড়তেই তৃণা উপস্থিত হলো, আস্সালামু আলাইকুম ভাইয়া, খুব স্যরি অনেক লেট হলো।
অপেক্ষা করতে হয়েছে আপনাকে!
ইরহাম ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বলল, না না ঠিকাছে।
পরিচয় করিয়ে দেই, ও আমার ফ্রেন্ড রুপা।
হ্যালো
হ্যালো! আচ্ছা আপনার বইটা,,
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলে পছন্দের প্রচ্ছদের এই বইটা বহুকষ্টে যোগাড় করেছিলাম, এটা হারিয়ে ফেলয় ভীষণ খারাপ হয়েছিল। আমিতো আশাই করিনি ফেরত পাবো। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো গুরুত্বই দিতো না।
অনলাইনের টিকিট টা না থাকলে আমিও হয়তো ফেরত দিতে পারতাম না, তার মানে এই না গুরুত্ব দিচ্ছি না। সবাইই হয়তো ফিরিয়ে দিতে চায় কারো কাছে উপায় থাকে কারো কাছে থাকে না। এই আর কি!
কি জানি! তবে আমি আজ পর্যন্ত বই পড়তে দিয়ে ফেরত পাই নি। যাই হোক চলুন চা খাবেন,
নাহ ঠিকাছে, আমার একটু তাড়া আছে আসলে।
একটু চা খওয়ার সময় হবেনা? প্লিজ চলুন, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ চা অন্তত গ্রহণ করুন?
অগত্যা ইরহামকে তাদের সাথে যেতেই হলো। একটা ক্যাফেতে বসে তৃণা কেবল চা-ই অর্ডার করলো না, চিকেন শর্মা, বাটার নান আর চিকেন চাপ নিলো। রুপা আর সে এমনভাবে তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলো যেন বহুদিনের চেনা।
খাওয়া শেষে ইরহাম বিল দিতে চাইলেও তৃণা শুনলো না। হাসিমুখে বিদায় নিয়ে এগোতেই হঠাৎ তৃণা পিছিয়ে এসে বলল, আপনার মনমানসিকতা ভীষণ স্নিগ্ধ। এর পরিচর্যা করবেন সবসময়।
ইরহাম মাথা চুলকে হাসলো।
নিউমার্কেটে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা শেষে রুপা আর তৃণা হলে ফেরে। রুপা দাঁত কেলিয়ে বলে, দোস্ত ইরহাম ভাই দেখতে সেই। তোর সাথে সেই মানাইছে। আমি বলি কি তুই উনার সাথেই ঝুলে পড়। একই শহরের মানুষ তোরা, তার হাইট ও ৬ফুট হবেই। একটু চিকন এটাও সমস্যা না, ছেলেদের বয়স হলে স্বাস্থ্য ফিরে। তখন আরো বেশি হ্যান্ডসাম লাগবে। পড়তেছেও চুয়েটে ফিউচার ব্রাইট!
তুই এমনভাবে হিসাব নিকাশ করছিস যেন তুই আমার বান্ধবি না ঘটক! এক কাজ করলে পারিস ঘটক হয়ে যা। যেভাবে বর্ণনা করিস এইদিকে তোর ক্যারিয়ার জমবে।
মজা নিস না, আমি এই পর্যন্ত অনেক ছেলে দেখছি, কাউকেই তোর জন্যপারফেক্ট লাগেনাই। এটাকে লাগছে।
আবারো বাহ্যিকভাবে বিচার করছিস?
তুই নিজেই তো বললি উনার মন মানসিকতা স্নিগ্ধ। তো হলো তো ২ এ ২ এ ৪? আর কি লাগে?
তুই আসলেই গেছস! সবাইকছ টেনেটুনে কাপল বানাতে চাস। কয়দিন আগে বললি জাবেদ ভাই জোশ। ক্যাম্পাসে দাপট আছে, কোনো প্যারা খেতে হবেনা। আজ আবার ইরহাম ভাইয়ের পিছে পড়লি?
জাবেদ ভাইয়ের পাওয়ার আছে, হলে সুবিধা পাওয়া যেত সেই হিসাবে বলছি।
আমি বলি কি তুই আমার কথা বাদ দিয়ে নিজের জন্য ছেলে খোঁজ। আমার সময় হলে আমি খুঁজে নিবোনে।
তুই আমার কনসার্ন বুঝতেছোস না। দেখ আমরা সেশন জটে আটকা আছি, আমাদের সাথের গুলো এই বছর বের হয়ে যাবে, বাট আমাদের সেশন শেষ হতে আরো ৩/৪ বছর লাগবে। ততদিনে আমরা একটাও ছেলে পাবো? কোনো ছেলে বসে থাকবে ২৬/২৭ বছরের বুড়িকে বিয়ে করতে? তাই আমার কেন প্রত্যেক মেয়ের উচিত একটা করে প্রেমিক তথা উড বি রেডি রাখা। পারলে এর মাঝেই কাবিন করে রাখা। বিয়েশাদী ব্যপারটা খুবই ইমপর্ট্যান্ট বুঝলি!
ও ভাই, রোজ তোর এক ফিলোসফি ভাল্লাগেনা শুনতে। যা না বিয়ে করে ফেল তোকে পড়তে বলছে কে?
ট্রাস্ট মি ব্রো যদি জানতাম এতো বছর লাগবে অনার্স শেষ করতে আমি ভুলেও আসতাম না। তখন তো চবির টানে আবেগে কাজ করছে, বিবেকে কাজ করে নাই!
হাহাহা,,, আন্টিকে বলি তোর জন্য ছেলে দেখুক?
দেখতেছে, কিন্তু আমার পছন্দ হয়না। হাহ কবে যে আমার সে আসবে, আর আমি ২/৪টা বাচ্চা নিয়ে কনভোকেশনে আসমু!
তৃণা আর কথা বাড়ালো না, রুপা বরাবরই এমন। মেয়েটা মুখে পটর পটর করলেও মনের দিক থেকে অনেক ভালো। বিয়ে নিয়ে যতই বকবক করুক পাত্রপক্ষ এলে তারই বেশি রাগ উঠে। তখনতার ভিন্নরুপ দেখা যায়। তৃণা বুঝেনা সারাবছর বিয়ে বিয়ে করে জান দিলেও বিয়ের কথা পারিবারিকভাবে উঠলেই কেন রুপার ভাব বদলে যায়। হয়তো ওর এক্সপেক্টশন অনুযায়ী পাত্র পাচ্ছেনা বলে কিংবা অন্য কোনো কারণে। সে যাই হোক আপাতত সে একটা ঘুম দিবে। আজ অনেক জার্নি হয়েছে।
।
ইরহাম পড়াশোনার পাশাপাশি বেশ কিছু কোচিং সেন্টারেও পড়ায়। নিজের যাবতীর খরচ সে নিজেই বহন করে আসছে। সংসারটা তার বাবা একাই সামলেছেন। কখনো বাড়তি চিন্তা করতে হয়নি তাকে। বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়েছিলেন তার বাবা। এইযে পরিবার ছেড়ে এতোদূরে একা পাড়ি জমানো, এটা তার জন্য সহজ ছিলনা। ছেলেরা সাধারণত মা ভক্ত হলেও ইরহাম তার বাবাভক্ত ছিল। বাবাকে অনুকরণ করা তার ছোটবেলার অভ্যাস।তার বাবা একজন আদর্শ মানুষ। তিনি চাইলেই একটা ভালো অবস্থানে যেতে পারতেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় সামাজিক উচ্চপদে আসীন হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সবসময় অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন।ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। তার কাছে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো জ্ঞান, শিক্ষা। টাকা পয়সা জমিজমা সবাই কেড়ে নিতে পারলেও জ্ঞান কেউ কেড়ে নিতে পারে না, এটা ব্যক্তির একান্ত সম্পদ। এই সম্পদ যার আছে সে কখনোই অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়না। সে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিতে পারেন। তার এই ছোট্ট সাধারণ জীবনে একটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তা হলো হজ্জ করা! সেটা পূরণ হলো না। ইরহাম ভেবেছিল সে টাকা জমিয়ে বাবাকে হজ্জ করাবে। কিন্তু তার বাবা সেই সুযোগ আর পেলেন না। হলে ফিরলে প্রথম কল আসতো তার বাবার, এই প্রথম তার কল আসেনি। ইরহাম বাবার নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এই নাম্বার থেকে আর কখনোই বাবার কল আসবে না, কেউ আর ফোন করে বলবেনা, বাবা হলে পৌঁছেছিস তো ঠিকঠাক? সময়সমতো খেয়ে ঘুমাবি, স্বাস্থ্যের প্রতি অযত্ন করবিনা।
ইরহামের বুক ভার হয়ে আসে। চোখও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অশ্রু ঝরাতে পারেনা। বুকের উপর বোঝা হয়ে দলা পাকিয়ে যন্ত্রণা হয়ে থাকে।
হ্যালো ভাইয়া? পৌঁছেছ ঠিকমত?
হুম, চিন্তা করিস না। মায়ের আর নিজের খেয়াল রাখিস।
আচ্ছা।
মা ঠিক আছেন? কি করছেন?
যা করে,, বাবার পাঞ্জাবি নিয়ে বসে আছে।
ইরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা রাখি। পরে কথা হবে।
আচ্ছা।
ইরহাম ফোন রেখে বসতেই তার বন্ধুরা আসে। সবাই তাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেয়। সময়টা দ্রুত যাচ্ছে না কেন? এই দুঃসময়টা জলদি ফুরিয়ে যাক না!
চলবে,,